খাঞ্জা খাঁ
মনে করা হয় যে, খাঞ্জা খাঁ প্রবাদটির মূলে আছেন খানজাহান আলী খাঁ নামক দক্ষিণবঙ্গের সেনাশাসক যার অসাধারণ কীর্তি বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ (ষাট খাম্বাজ) মসজিদ। খানজাহানের মতো দিলদরিয়া ভাব, নবাবি চালচলন ও চালবাজ মানুষের প্রতি এই প্রবাদ প্রযুক্ত হয়।
খানজাহান আলী স্বাধীন সুলতানি আমলের (১৩৩৪-১৫৩৮ খ্রি.) সেনাশাসক। সুখময় মুখোপাধ্যায় বলেছেন—
‘বিভিন্ন সূত্র থেকে আমরা তিনজন খান জাহানের উল্লেখ পাই, এরা তিনজনে একই সময়ে বর্তমান ছিলেন। প্রথম খানজাহানের নাম পাওয়া যায় বাগেরহাটে প্রাপ্ত ৮৬৩ হিজরির (১৪৫৯ খ্রি.) এক শিলালিপিতে, এতে তার মৃত্যুর উল্লেখ আছে। বারবক শাহের সমসাময়িক খানজাহান দ্বিতীয় খানজাহান। তৃতীয় খানজাহানের নাম তারিখ-ই-ফিরিশতা ও রিয়াজ-উস- সালাতিনে পাওয়া যায়। এই দুই বইয়ের মতে এই খানজাহান ছিলেন জালালুদ্দিন ফতেহ শাহের উজির। ফিরিশতার মতে, এই খানজাহান নপুংসক ছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, গিয়াসুদ্দিন আজম শাহের জনৈক উজিরেরও নাম খান-ই-জাহান ছিল। সম্ভবত বাংলার সুলতানের প্রধান উজিরদের সাধারণ উপাধিই ছিল খান-ই-জাহান বা খানজাহান।’
আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া বলেন-
‘খান-ই-জাহানের প্রকৃত নাম কি ছিল, তা জানা যায় না। কবরের শিলালিপিতে তাঁকে উলুঘ খান-ই-জাহান বলে অভিহিত করা হয়েছে। এটি কোনো নাম নয়, এটি একটি উপাধি এবং এর অর্থ হচ্ছে পৃথিবীর মহান খান কিন্তু তিনি সর্বত্রই খানজাহান আলী ওরফে খাঞ্জালী খান সংক্ষেপে খাঞ্জালী বলে পরিচিত। শিলালিপিতে উলুঘ খান-ই-জাহানের পরে আলায়হে অর্থাৎ উপর শব্দটি আছে। খুব সম্ভব এ শব্দ থেকেই তার আলী নাম এসেছে ভুলক্রমে।’
বুঝা যায় যে, মাহমুদ শাহী সুলতানদের আমলে প্রধান উজিরের পদবি ছিল খান-ই-জাহান বা খানজাহান। নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের আমলের খানজাহানের সমাধিলিপি বাগেরহাটে (খলিফাবাদ) পাওয়া গেছে। তাঁর ও নাসিরুদ্দিনের মৃত্যু একই বছরে অর্থাৎ ৮৬৩ হিজরিতে। ঐ সময় নাসিরুদ্দিন- পুত্র বারবক শাহ পিতার সাথে রাজকার্য পরিচালনা করতেন। অর্থাৎ পিতার জীবনকালেই বারবক শাহ নিজ নামে মুদ্রা প্রচলন করেন। একই ঘটনা এই বংশে আরও দেখা যায়। বলা প্রয়োজন যে, আমাদের দেশের পণ্ডিতেরা অন্যান্য আমলের মতোই মাহমুদশাহী বংশের নানা বিষয় নিয়ে প্রকৃত গবেষণা করতে পারেননি এখনো।
একটি রাজ্যের প্রধান উজির অনেক ক্ষমতাধর হবেন—এটিই স্বাভাবিক। মনে হয় খাঞ্জা খাঁ প্রবাদের উৎসে সেই প্রধান উজিরের শানশওকত বিবেচিত হয়েছে। বাগেরহাটে পাওয়া শিলালিপির খানজাহান থেকে এ প্রবাদের উৎপত্তি ঘটেছে বলে মনে করা যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ নয়। কারণ তার সম্পর্কে পরিষ্কার পরিচিতি অথবা তার চালবাজির খবর আমরা ইতিহাসবিদগণের কাছ থেকে পাইনি। তবে প্রতীয়মান হয় যে, সুলতান বা উপরওয়ালার ডানহাত বলে বিবেচিত অন্য কোনো খান-ই-জাহান অথবা সব খান-ই-জাহানের প্রকৃতি থেকে এ প্রবাদের মূলভাব ধারণ করা হয়েছে।
আমরা জানি যে, মৌলভিবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার পৃথিমপাশার নবাব পরিবারের পূর্বপুরুষ শেখ সালামত পারস্য (ইরান) থেকে এসে ১৪৯৯ খ্রিস্টাব্দে বাস শুরু করেন এদেশে। তার ছেলে ইসমাইল খান লোদি সুলায়মান কররানির (১৫৬৫-১৫৭২ খ্রি.) সময় উড়িষ্যার শাসক ছিলেন বলে জানা যায়। তার পদবি খাঞ্জা খাঁ ছিল। সুলায়মান কররানির পুত্র দাউদ খান কররানির (১৫৭২-১৫৭৬ খ্রি.) সময়েও এই খাঞ্জা খাঁ উড়িষ্যার নিয়োজিত ছিলেন। হয়তো তিনিও হতে পারেন খানজাহান খাঁ বা খাঞ্জা খাঁ।
হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ গ্রন্থে লেখক সুধীরকুমার মিত্রের মতে, “নবাব খাঞ্জা খাঁ হুগলীর শেষ ফৌজদার, তিনি হুগলীর মোগল দুর্গের একটি বৃহৎ অট্টালিকার মধ্যে বসবাস করিতেন। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিস হুগলীর ফৌজদারের পদ তুলিয়া দেন এবং সেইজন্য তাহার আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়। তাহার ন্যায় বিলাসী ব্যক্তি তৎকালে বঙ্গদেশে কেহই ছিলেন না। আজও বঙ্গদেশে কোনো ব্যক্তি বাবুয়ানা করিলেও তাহাকে নবাব খাঞ্জা খাঁ বলিয়া অভিহিত করা হয়। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি গতাসু হইলে তাহার স্ত্রী যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন ইংরেজ সরকারের নিকট হইতে একশত টাকা করিয়া বৃত্তি পাইতেন। তাহার পরলোকগমনের পর মোগল দুর্গের শেষ চিহ্ন পর্যন্ত ধূলিসাৎ করিয়া লুপ্ত করা হয় এবং দুর্গের ভগ্নস্তূপ পরে দুই হাজার টাকায় বিক্রীত হইয়াছিল। গোন্দলপাড়া তালুক পূর্বে নবাব খাঞ্জা খাঁ জমিদারিভুক্ত ছিল।’
রূপমঞ্জরী প্রথম খণ্ডে (১৯৯০) লেখক নারায়ণ সান্যাল (১৯২৪-২০০৫ খ্রি.) বলেছেন যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে পারস্যের রাজধানী তেহরান থেকে আসেন খাঁ জাহান খাঁ। তিনি হুগলীতেই থাকতেন। প্রথমে মোগল, পরে ইংরেজ বেনিয়া কোম্পানির কাছে সুবেদারি পেয়ে বিলাসিতার চূড়ান্ত বাহ্যাড়ম্বরে তিনি ভাষায় স্থান পেয়েছেন।
আমাদের মনে হয় শেষোক্ত খাঞ্জা খাঁ থেকে বাংলার বিশিষ্ট প্রবাদটি আসা অধিকতর যৌক্তিক।