খাওয়া দাওয়ার গল্প
নকুড়চন্দ্র চাকলাদারকে তোমরা চেনো না। চেনার কথাও নয়। তিনি তো আর আব্রাহাম লিঙ্কন, গান্ধীজি, নেতাজী কি রবীন্দ্রনাথের মতো বিখ্যাত কেউ নন।
আমিও তাঁকে চিনতাম না। দু মাস আগে পাটনা থেকে বদলি হয়ে যেই তিনি আমাদের অফিসে এলেন তার তিন দিনের মধ্যে জানতে পারলাম তিনি এসে গেছেন।
আমাদের অফিসটা বিরাট। পেল্লায় একখানা সাত তলা বাড়িতে ছ’শো লোক কাজ করে। আমার ঘর চার তলায়।
খবর রটে গেল নকুড়বাবুর মতো খাইয়ে লোক নাকি ইণ্ডিয়াতে আর দ্বিতীয়টি নেই। আমাদের অফিসের চারপাশে যত খাবারের দোকান আছে, সেগুলোতে যত ইডলি দোসা এগরোল আর তেলেভাজা বানানো হয় তার সিকি ভাগই নাকি তিনি খেয়ে ফেলছেন। আরো জানা গেল, তিনি কলকাতায় চলে আসার পর পাটনায় নাকি দুটো খাবারের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। ঐ দুটো দোকানের যত লাড্ডু, গুলাবজাম, কলাকন্দ আর প্যাঁড়া তিনি একাই নাকি কিনে নিতেন। নকুড়বাবু চলে আসায় দুই দোকানদার খুবই কান্নাকাটি করছে। শোনা যাচ্ছে তারা কলকাতায় এসে অফিসের বড় কর্তাদের হাতে-পায়ে ধরে ফের নকুড়বাবুকে পাটনায় নিয়ে যেতে চেষ্টা করবে।
আরো জানতে পারলাম, নকুড়বাবুর কেউ নেই। বাবা মা ভাই বোন, কেউ না। বিয়ে পর্যন্ত করেন নি। শিয়ালদার কাছে এক বন্ধুর বাড়িতে একখানা ছোট ঘরে থাকেন আর যা মাইনে পান, সবই খেয়ে শেষ করে ফেলেন। তাঁর খাওয়ার যা বহর তাতে নাকি মাইনের টাকায় চলে না, মাঝে মাঝেই ধার করতে হয়।
আমাদের ডিপার্টমেন্টের কানাইবাবু, গজকেষ্টবাবু, ভবতোষবাবু, এমনি অনেকেই নকুড়বাবুর সঙ্গে আলাপ করে এসেছেন। তাঁরা বলেছেন, ‘যান যান মশাই, একবার নকুড়বাবুর খাওয়া দেখে আসুন। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবেন না মানুষ যে এত খেতে পারে!’
লোকটাকে দেখার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল। আজকাল তো আর খাইয়ে লোক তেমন চোখে পড়ে না। চারখানার জায়গায় ছ’খানা লুচি আর দু-হাতা মাংস খেলেই লোকের পেট আইঢাই করতে থাকে। তিনদিন খাওয়া-দাওয়া বন্ধ রাখতে হয়। এখনকার মানুষজনের পেট খুব ছোট হয়ে গেছে। তাতে খাবার দাবার খুব কম ধরে।
নকুড়বাবুর কাছে যাই যাই করে পনের দিন কেটে গেল। অফিসে ভীষণ কাজের চাপ চলছিল। শেষ পর্যন্ত একদিন তাঁর ঘরে চলেই এলাম।
আগেই খবর পেয়েছিলাম, নকুড়বাবু বসেন এক তলায়। তাঁর ঘরে আসতেই চোখে পড়ল গোলগাল, টুকটুকে ফর্সা একটি লোক খালি গায়ে চেয়ারে বাবু হয়ে বসে আছেন, আর দর দর করে ঘামছেন। সময়টা গরমকাল কিনা, তাই এত ঘাম।
যতই গরম পড়ুক, কেউ যে জামা-গেঞ্জি খুলে অফিসে বসে থাকতে পারে, আগে কখনও দেখি নি। ভদ্রলোকের সামনে বড় টেবল। টেবলের এধারে চেয়ারে আরো তিনজন বসে আছেন। এঁদের আমি চিনি, এঁরা আমাদের অফিসেই কাজ করেন।
খালি গায়ের লোকটি যে নকুড়বাবু, বলে দিতে হল না। আমাকে দেখেই হাতজোড় করে বললেন, ‘আসুন আসুন। নমস্কার।’
‘নমস্কার।’ বলে টেবলের কাছে চলে এলাম।
‘বসুন বসুন।’
একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লাম।
নকুড়বাবু বললেন, ‘আমাকে দেখতে এলেন বুঝি! আমার খাওয়া-দাওয়ার কথা নিশ্চয়ই কেউ আপনাকে শুনিয়েছে।’
কেন এসেছি, নকুড়বাবু ঠিক ধরে ফেলেছেন। কিন্তু সে কথা তো মুখের ওপর বলা যায় না। একটু আমতা আমতা করে বললাম, ‘আপনি আমাদের এই অফিসে নতুন এসেছেন। তাই আলাপ করতে এলাম।’
নকুড়বাবু লোকটা পয়লা নম্বরের বিচ্ছু। হেসে হেসে বললেন, ‘না মশাই, আলাপ-টালাপ করতে না, আপনি আসলে এসেছেন আমার খাওয়া-দাওয়া দেখতে।’ একটু থেমে ফের বললেন, ‘সবাই তাই দেখতে আসে কিনা, তাই বললাম। কিছু মনে করবেন না।’
বললাম, ‘না না, মনে করব কেন?’
এরপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার নাম, অফিসের কোন তলায় বসি, কোন ডিপার্টমেন্টে কাজ করি−এই সব জিজ্ঞেস করলেন নকুড়বাবু। আমি উত্তর দিতে লাগলাম।
আমাদের কথাবার্তার মধ্যে সামনের দেয়ালের বড় ঘড়িটায় টং টং করে তিনটে বাজল। সঙ্গে সঙ্গে চঞ্চল হয়ে উঠলেন নকুড়বাবু। দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে ডাকতে লাগলেন, ‘কেষ্ট কেষ্ট।’ কেষ্ট নকুড়বাবুর বেয়ারা।
কেষ্টকে চিনি। এই অফিসে অনেকদিন কাজ করছে। ফড়িংয়ের মতো রোগ। টিঙটিঙে চেহারা। মুখ বোতলের মতো লম্বা। মাথার চুল খাড়া খাড়া, দাড়ি-গোঁফ পিনের মতো ফুটে আছে। গোল গোল চোখদুটো সবসময় বাঁই-বাঁই করে ঘুরছে। দেখেই বোঝা যায়, তার মাথায় সারাক্ষণ শয়তানির কারখানা চলছে।
লোকটার বয়স বোঝা যায় না। তিরিশ হতে পারে, পঁয়ত্রিশ হতে পারে, আবার চল্লিশ হলেই বা আটকাচ্ছে কে?
দরজার পাশের টুল থেকে উঠে প্রায় দৌড়েই নকুড়বাবুর কাছে চলে এল কেষ্ট। ঘাড় হেলিয়ে বলল, ‘বলুন স্যার−’
দেয়াল ঘড়ির দিকে আঙুল বাড়িয়ে নকুড়বাবু বললেন, ‘ক’টা বাজল খেয়াল আছে?’
‘আছে স্যার। আপনি না ডাকলেও আমি ঠিক চলে আসতাম। দিন−’ বলে হাত পাতল কেষ্ট।
টেবলের ড্রয়ার থেকে মানিব্যাগ বার করতে করতে নকুড়বাবু বললেন, ‘তোমাদের এখানে রাবড়ি কত করে কিলো?’
‘তিরিশ টাকা স্যার।’
গুনে গুনে নগদ তিরিশটি টাকা পঁচিশ পয়সা, কেষ্টর হাতে দিয়ে নকুড়বাবু বললেন, ‘যাও, এক কিলো নিয়ে এসো। বেশি দেরি করবে না। ওই সঙ্গে জর্দা দিয়ে একটা পান এনো।’
‘আচ্ছা স্যার।’ কেষ্ট এক সেকেণ্ডও আর দাঁড়াল না, ছুটে বেরিয়ে গেল।
নকুড়বাবু এবার আমাদের দিকে ফিরে হে হে করে একটুহাসলেন। তারপর বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না, তিনটের সময় আমি টিফিন করি। গল্প করতে করতে খাওয়া যাবে’খন, কি বলেন−’
একটু লোভ হল, এক কিলো রাবড়ি যখন আসছে তখন তার থেকে একটু আধটু ভাগ কি আর পাওয়া যাবে না?
আমার আগে নকুড়বাবুর ঘরে এসে বসে ছিলেন অবিনাশবাবু, নরেনবাবু আর ললিতবাবু। আমরা সবাই একসঙ্গে মাথা নেড়ে বললাম, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে নকুড়বাবু টেবলের ড্রয়ার থেকে ধবধবে ফর্সা তোয়ালে বার করে উঠে পড়লেন, ‘দয়া করে আপনারা একটু বসুন। আমি হাতমুখ ধুয়ে আসি।’
‘আসুন।’
নকুড়বাবুর ঘরের পাশেই বাথরুম। তিনি সেখানে চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে নকুড়বাবু গেঞ্জি আর পাঞ্জাবি পরে ভাল করে চুল আঁচড়ে নিলেন। বললেন, ‘খাওয়া-দাওয়া একটা খুব পবিত্র ব্যাপার। যেমন তেমন করে খেলে হয় না। শুদ্ধ মনে শুদ্ধ পোশাকে খেতে হয়। তবেই না খাওয়াটা খাওয়ার মতো হয়।’
এমন কথা আগে আর কখনও শুনিনি। আমরা বোকার মতো ঘাড় কাত করে সায় দিলাম, ‘তা তো বটেই, তা তো বটেই।’
ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে কেষ্ট রাবড়ির একটা হাঁড়ি আর কলাপাতায় মোড়া পানের খিলি নিয়ে এল। রাবড়ি আর পান টেবলে রেখে বলল, ‘জল এনে দিই?’
‘দাও।’ নকুড়বাবু এবার আমাদের দেখিয়ে বললেন, ‘এঁদের জন্যে চা আর বিস্কুট এনো।’
কেষ্ট কাচের গেলাসে জল দিয়ে, চা-বিস্কুট আনতে চলে গেল।
নকুড়বাবু রাবড়ির হাঁড়ির মুখটা খুলতে খুলতে বললেন, ‘হেঁ হেঁ, রাবড়ি দেখে আপনাদের হয়ত চেখে দেখার একটু ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু কিছু মনে করবেন না, আপনাদের কিছু রাবড়ির ভাগ আপনাদের দিতে পারব না। রাবড়িটা আমি খুব ভালবাসি কিনা।’
রাবড়ির হাঁড়ি দেখে যে আশাটুকু হয়েছিল, নকুড়বাবু এক ফুঁয়ে তা নিভিয়ে দিলেন। কী আর করা, উনি যদি না দ্যান, আমরা তো কেড়ে খেতে পারি না। মুখে করুণ হাসি ফুটিয়ে আমরা চারজন একসঙ্গে বলে উঠলাম, ‘না না, আমাদের দিতে হবে না। আপনিই খান।’
নকুড়বাবু চোখ বুজে এক মিনিট কী ভাবলেন। তারপর আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বললেন, ‘উঁহু, আমি খাব আর আপনারা শুকনো মুখে সামনে বসে থাকবেন, সেটা ভীষণ খারাপ দেখায়।’ বলে কেষ্টর দিকে ফিরলেন। মানিব্যাগ থেকে একটা টাকা বের করে তাকে দিতে দিতে বললেন, ‘যাও, ক্যানটীন থেকে বাবুদের জন্যে চার কাপ চা আর চারখানা থিন বিস্কুট এনে দাও।’
কেষ্ট দৌড়ে গিয়ে চা-বিস্কুট এনে আমাদের দিল।
নকুড়বাবু বললেন, ‘এবার তা হলে শুরু করা যাক।’ তারপর লোকে যেভাবে পুজোয় বসে অবিকল সেইরকম মুখচোখের ভাব করে রাবড়ির হাঁড়ি থেকে পুরু সর তুলে মুখে পুরলেন।
খেতে খেতে গল্পও চলতে লাগল।
নকুড়বাবু বললেন, ‘আপনাদের কলকাতার রাবড়ি যাই বলুন, তেমন ভাল না। উত্তম রাবড়ি যদি খেতে হয়, তা হলে যেতে হবে মথুরা-বৃন্দাবনে। আহা, কী চমৎকার তার গন্ধ আর স্বাদ। একবার খেলে সারা জীবন আর ভুলতে পারবেন না।’
আমরা কেউ কোনদিন মথুরা-বৃন্দাবন যাই নি। তবু তেতো চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললাম, ‘তা তো বটেই, তা তো বটেই।’
নকুড়বাবু বললেন, ‘যত তাড়াতাড়ি পারেন অফিসে ছুটি নিয়ে একবার মথুরা-বৃন্দাবনটা ঘুরে আসুন। ওখানকার রাবড়ি না খেলে ভীষণ দুঃখ থেকে যাবে।’
ললিতবাবু বললেন, ‘আপনি যখন এত করে বলছেন তখন রাবড়ির জন্যে ছুটি নিয়ে একবার মথুরা-বৃন্দাবনটা যেতেই হবে।’
নকুড়বাবু কথা বলছেন ঠিকই, তবে রাবড়ি খাওয়া সমানে চলছেই। আমাদের চোখের সামনে ঘন দুধে ভেজা মোটা এক-একটা সর হাঁড়ি থেকে তুলে, নাচিয়ে নাচিয়ে মুখে পুরছেন। মাঝে মাঝে হাঁড়িটা মুখের কাছে এনে একটু কাত করে সুন্দর করে চুমুক দিচ্ছেন।
একবার খাওয়াটা কিছুক্ষণের জন্যে বন্ধ রেখে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছে নিলেন। আমরা দেখলাম রাবড়ির হাঁড়ি অর্ধেক ফাঁকা হয়ে গেছে।
বুঝতে পারলাম এখন খাওয়ার ব্যাপারে ইন্টারভ্যাল চলছে। নকুড়বাবু বললেন, ‘মথুরা-বৃন্দাবন যখন যাবেন তখন দেওঘরের কথাটাও মনে রাখবেন। ওখানকার প্যাঁড়ার তুলনা নেই। ওটা চেখে না দেখলে জীবনে বড় আপশোষ থেকে যাবে।’
আমরা মাথা নেড়ে বললাম, ‘নিশ্চয়ই, দেওঘরের প্যাঁড়ার কথা আমাদের মনে থাকবে।’
নকুড়বাবু বলতে লাগলেন, ‘তারপর ধরুন মিহিজামের কলাকন্দ, লখনৌয়ের বাদাম বরফি। এ সব না খেলে বেঁচে থাকার সুখ নেই।’
আমরা চারজন তেতো কালচে চায়ে চুমুক দিতে দিতে তক্ষুনি সায় দিলাম−সত্যিই সুখ নেই।
নকুড়বাবু নড়েচড়ে বসে এবার বললেন, ‘জানেন, আমি একবার ভারত ভ্রমণে বেরিয়ে ছিলাম। কেন বলতে পারেন?’
হচ্ছিল বরফি কলাকন্দের কথা, তার মধ্যে হঠাৎ ভারত ভ্রমণটা কেন নিয়ে এলেন নকুড়বাবু, বুঝতে পারছি না। আমরা বোকার মতো তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে একসঙ্গে বললাম, ‘না তো।’
হেঁ হেঁ করে হেসে হেসে নকুড়বাবু বললেন, ‘স্রেফ নানা রকম খাবার চেখে দেখতে। আমাদের এই দেশে কত রকম মিঠাই, কত রকম মাংসের খাবার আর নিরামিষ খাবার আছে, ভাবতে পারবেন না। দিল্লীতে চলে যান, সেখানে পাবেন মোগলাই আর পাঞ্জাবি খানা−পোলাও, কোর্মা থেকে পালং-পনীর, সোহন হালোয়া, শনপাপড়ি, চানা-বাটোরা, ক্রিম-মটর। হায়দ্রাবাদে যান, পাবেন কাবাব। কাবাব কি একরকমের! টিকিয়া কাবাব, গুলি কাবাব, শিক কাবাব। বেনারস যান−পাবেন মেওয়া, মালাই। জয়পুর যান−সেখানে যে কত রকমের ভাজিয়া তার ঠিক নেই। তবে মশাই সাউথ ইণ্ডিয়ায় তেমন জুত পাবেন না। কাঁহাতক আর ইডলি দোসা খাওয়া যায় বলুন। তবে গোয়ায় যেতে ভুলবেন না। ওখানকার কুকেরা তো ওয়ার্ল্ড ফেমাস-জগদ্বিখ্যাত। ওদের ধনেপাতা দিয়ে মুরগির মাংস যে না খেয়েছে সে জানে না তার কত বড় ক্ষতি হয়ে গেছে।’ বলতে বলতে দু’চোখ জ্বল জ্বল করতে থাকে নকুড়বাবুর। খাবার−গুলোর নাম করতে করতে জিভে জল এসে গিয়েছিল, সুড়ুত করে টেনে নিয়ে গিলে ফেললেন।
আমরা হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।
নকুড়বাবু থামেন নি। একটানা বলতে লাগলেন, ‘ভাববেন না, আপনারা যখন ভারত ভ্রমণে বেরুবেন তখন একটা চার্ট করে দেব। কোথায় গিয়ে কোন হোটেলে বা ধর্মশালায় উঠবেন, কোন দোকানে ভাল রাবড়ি, কোন রেস্তোরাঁয় বেস্ট কাবাব পাওয়া যায়, সব তাতে লেখা থাকবে। চার্টটা হাতে থাকলে আপনাদের এতটুকু অসুবিধা হবে না।’
আমরা ঘাড় নেড়ে জানালাম−নকুড়বাবু চার্ট করে দিলে অসুবিধা হবে না।
নকুড়বাবু এবার বললেন, ‘আরে মশাই, লোকে দেশ ভ্রমণে গিয়ে শুধু পুরনো মন্দির, ভাঙা দুর্গ, পাহাড় পর্বত জঙ্গল লেক−এ সব দেখে বেড়ায়। এগুলো দেখে কী যে লাভ, আমার মাথায় ঢোকে না। তার চেয়ে যেখানে যাবি সেখানকার ভাল ভাল জিনিস চেখে দ্যাখ, তবেই না জীবন সার্থক হবে। নইলে শুধু শুধু ঘোরাঘুরি করে লাভটা কী?’ বলতে বলতে আবার রাবড়ির হাঁড়িতে হাত ঢুকিয়ে খেতে শুরু করলেন।
খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা ভারতবর্ষের খাবার-দাবারেরও লিস্ট দিয়ে সেগুলোর স্বাদ কেমন, বুঝিয়ে দিতে লাগলেন নকুড়বাবু।
এদিকে আমাদের চোখের সামনে রাবড়ির হাঁড়ি একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল। তারপর নকুড়বাবু হাঁড়িটার ভেতর মুখ ঢুকিয়ে জিভ দিয়ে চেটে চেটে সেটার গায়ে যেটুকু রাবড়ি লেগে ছিল, সাফ করে ফেললেন। এখন দেখলে কে বলবে কয়েক মিনিট আগেও ওটার ভেতর পুরো এক কিলো রাবড়ি ছিল।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ফাঁকা হাঁড়িটা কেষ্টর হাতে দিয়ে তিনি বাথরুমে চলে গেলেন। মুখটুখ ধুয়ে ফিরে যখন এলেন, তাঁর মুখ-চোখ কুঁচকে গেছে। পেটে হাত বুলিয়ে এবং টিপেটুপে কী যেন বুঝতে চেষ্টা করলেন।
আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হল নকুড়বাবু?’
নকুড়বাবু অন্যমনস্কর মতো বললেন, ‘আমার একটা খটকা লাগছে।’
‘কিসের খটকা?’
‘পরে বলছি।’ বলে একটা লম্বা ঢেকুর তুলে টেবল থেকে জলের গেলাসটা নিয়ে ঢক ঢক করে খেয়ে ফেললেন। তারপর সেই জর্দা দেওয়া পানের খিলিটা মুখে পুরে বললেন, ‘আপনারা প্লিজ বসুন। দয়া করে চলে যাবেন না। আমি একটু ঘুরে আসছি। পনের মিনিটের মধ্যে ফিরে আসব।’
ভদ্রলোকের হঠাৎ কী হল, কিছুই বুঝতে পারছি না। আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম। ভাবলাম, দেখাই যাক, পনের মিনিট অপেক্ষা করে।
পনের মিনিট বসতে হল না। তের মিনিট আটাশ সেকেণ্ডের মাথায় নকুড়বাবু ফিরে এসে তাঁর চেয়ারে বসতে বসতে হাঁক দিলেন, ‘কেষ্ট−’
কেষ্ট দরজার বাইরে তার টুল থেকে উঠে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল।
নকুড়বাবু ধীরেসুস্থে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ডান হাতটি পাতলেন। মধুর গলায় বললেন, ‘তিনটে টাকা ফেরত দাও ভাই।’
কেষ্ট প্রথমটা চমকে উঠল। তারপর একটি কথাও না বলে সুট করে পকেট থেকে তিনটি টাকা বের করে নকুড়বাবুর হাতে দিয়ে এক দৌড়ে আবার তার টুলে গিয়ে বসে পড়ল।
আমরা হাঁ হয়ে গেলাম। কিছুই মাথায় ঢুকছে না।
নকুড়বাবু আমাদের মনের কথাটা টের পেয়েছিলেন। হেসে হেসে বললেন, ‘বুঝতে পারছেন না তো?’
‘না−’
টেবলের ওপর দিয়ে আমাদের দিকে ঝুঁকে নকুড়বাবু বললেন, ‘আরে মশাই, কেষ্ট এক কিলোর জায়গায় ন’শো গ্রাম রাবড়ি এনেছে। কিন্তু আমার চোখে কি ধুলো দেওয়া কি এতই সোজা।’
ললিতবাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘একশো গ্রাম কম এনেছে, বুঝলেন কী করে?’
নকুড়বাবু বললেন, ‘আমার পেটে রাবড়ির জন্যে এক কিলোর একটা খোপ আছে। কিন্তু কেষ্ট যে রাবড়িটা আনলো সেটা খেয়ে মনে হল, খোপটা ঠিক ভরে নি, একটু যেন খালি খালি লাগছে। তাই−’
‘তাই কী?’
‘আপনাদের বসতে বলে বেরিয়ে গেলাম। এখানে তিনটে রাবড়ির দোকান আছে। প্রথম দুটো দোকানে কেষ্টর চেহারার ডেসক্রিসন দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এরকম কেউ এক কিলো রাবড়ি কিনতে এসেছিল কিনা। তারা ‘না’ বললে, থার্ড দোকানদার জানালো, ‘হ্যাঁ’। তবে এক কিলো না, ন’শো গ্রাম নিয়ে গেছে। খাবার-দাবারের ব্যাপারে আমার সঙ্গে চালাকি নয় বাপু। দেখলেন তো আপনাদের চোখের সামনে কেষ্টকে ক্যাঁক করে ধরে কেমন একশো গ্রামের দামটা আদায় করলাম।’ বলে খুশিতে গলার ভেতরে গুন গুন করে কী একটা গানের সুর ভাঁজতে লাগলেন।
-সমাপ্ত-