খাঁচার ভিতর অচিন পাখি – ৫

দাদীমা সন্ধ্যার মুখে মুখে চলে আসলেন। অয়নকে দেখা মাত্র পিলে চমকে উঠলেন

— ‘তুই ফিরলি শেষমেষ? কোথায় ছিলি এতদিন!!’ উত্তেজনার বশে কথা বলতে গিয়ে ঘাড়ের রগ ফুলে উঠল বৃদ্ধার। দেখে মায়া হলো অয়নের।

সে ফ্যাকাসে হাসলো। সংসারে এই একটা মানুষের সামনে দাঁড়ালে এখনো তার ভেতরটা নড়বড়ে হয়ে যায়। এই বৃদ্ধা রমণীটির ছায়া তার পেছনে আঠার মতো লেগে থাকে যত দূরেই সে যাকনা কেন। অয়ন এগিয়ে এসে দাদীমাকে জড়িয়ে ধরল। দাদীমার শরীর কী নরম তুলতুলে! মনে হয় যেন গায়ের সাথে মিশে যাবে। গা থেকে কী সুন্দর একটা পবিত্র গন্ধ ছুটে আসে। অয়নের বেশ লাগে। দাদীমা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে অয়নের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, ‘না না! এইসব সোহাগে আমি ভুলছিনা, আগে বল তুই কোথায় গিয়েছিলি? অন্যান্য বার পাঁচ ছ দিনের ভেতরেই ফেরত চলে এসেছিস, এবার মাস গড়ালো কেন শুনি? আর কত জ্বালাবি তুই আমাদের, হ্যাঁ?’

অয়ন শান্ত গলায় বলল, ‘আহা দাদীমা! এতদিন পর দেখা হলো, তুমি প্রথমেই ঝাড়া শুরু করলা!’

ছেলের জন্মদিন উপলক্ষ্যে দাদিমা নিজের হাতে কেক বানিয়েছেন। এখন সেই কেক কাটা হবে। যে মানুষটাকে নিয়ে এত আয়োজন সেই মানুষটা এই বাড়িতে, এত কাছাকাছি থেকেও কিছুই টের পাচ্ছেনা। বেঁচে থেকেও সে মৃত।

রাতে খাবার পর দাদীমার ঘরে ডাক পড়ল। গিয়ে দেখা গেল বুশরাও আছে।

— ‘এতদিন কোথায় ছিলি?’ প্রশ্নটা দাদীমার। বাড়ি ফেরার পর তৃতীয়বারের মতো একই প্রশ্নের মুখোমুখি হলো অয়ন।

— ‘প্রথম কয়েকদিন ছিলাম উত্তরায়, এক ফ্রেন্ডের বাসায়, এরপর কুষ্টিয়া’

— ‘কুষ্টিয়া কোথায় উঠেছিলি? কার বাসায়?’

— ‘কারো বাসায় না, ছিলাম লালনের মাজারে

— ‘সে কী! এই এতগুলো দিন তুই মাজারে পড়ে ছিলি? পাগল নাকি?’ অয়ন ঠাট্টার সুরে বলে, ‘আমাদের পাগলের বংশ, পাগল হতে আর কতক্ষণ!’

দাদীমা রাগ হয়ে যান এ কথা শুনে, ‘হাবিজাবি কথা বলিস কেন? ওখানে শুনেছি লোকে গভীর রাতে গাঞ্জা টানে, নেশা করে, তুইও এসব অনর্থ করে এসেছিস নাকি?’

অয়ন মিট মিটিয়ে হাসে। কিছু বলেনা। বুশরা খোঁচা মারার ঢঙে ফোড়ন কাটলো, ‘পাগল না, তোমার নাতি মনে হয় ফকির দরবেশ টাইপের কিছু হয়ে যাচ্ছে দাদীমা! মাজারে মাজারে ঘুরে বেড়ায়! বাপরে! দারুণ ব্যাপার!’

অয়ন বেশ মজা পেল বুশরার কথায়, নাটকীয় ভাবে বলল,

‘কিঞ্চিত ধ্যানে মহাদেবও, সে তুলনা কি আর দেব
লালন বলে গুরু ভাব যাবেরে মনের ধোকা
ওরে যাবেরে মনের ধোকা
পাবে সামান্যে কি তাঁর দেখা!’

বুশরা বিরক্তিতে মুখ চোখ কুঁচকে ফেলল। অয়ন দাদীমার কোলের ওপর মাথাটা রেখে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে ছিল। দাদীমার বিছানাটা বেশ বড়, সেই পুরনো দিনের খাটের মতো। যেমন আয়তনে বড় তেমনি উঁচু। চারপাশে মশারী টাঙ্গানোর জন্য লম্বা লম্বা কাঠের স্ট্যান্ড।

দাদীমা অয়নের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন,

— ‘এবার তোর একটা বিয়ে দেব আমরা, সুন্দর দেখে একটা পুতুল বউ নিয়ে আসব’

— ‘আনলেই পারো, খুব বেশি দাম হবেনা, বাড়ির পাশের মার্কেটেই পেয়ে যাবে।’

দাদীমা ওর মাথায় একটা গাট্টা মেরে বললেন, ‘খুব ফাজলামো হচ্ছে, না?’ অয়ন গাট্টা খেয়ে নিজের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, ‘তুমিই তো বললে পুতুল বউ আনবে, সে তো কিনতেই পাওয়া যায়!’

বুশরা বলল, ‘ওর সাথে বিয়ে দিয়ে কোনো মেয়ের জীবন নষ্ট করো না’

অয়ন বরাবরই বুশরাকে ক্ষ্যাপাতে ভালোবাসে, সে ঠাট্টার গলায় বলল, ‘দাদীমা, বুশরার কোন ফ্রেন্ড যেন আমার জন্য পাগল, তুমি ওই মেয়েটাকে একবার দেখতে পারো’

দাদীমা বেশ মনোযোগী হয়ে উঠলেন ‘তাই নাকি? কোনটা বলতো? দেখতে কেমন? বাবা কী করে?’

বুশরা মুখ বাঁকালো, ‘ভ্যাট, এখন তোমার নাতিকে দেখলে লেজ তুলে পালাবে, এক কালে পছন্দ করতো, এখন সেটা রুপকথা’

অয়ন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু দরজার কাছটায় একটা ছায়া মূর্তির আকস্মিক আগমন তার মুখের কথা কেঁড়ে নিল। আয়শা ফিরেছেন মাত্র অফিস থেকে। এখনো বাসি জামা কাপড় ছাড়েননি। চোখে মুখে ক্লান্তির স্পষ্ট ছাপ। বাড়ি ফিরেই এক কাপ কফি খাওয়া তার অনেক দিনের অভ্যাস। সেই কফি তিনি নিজের হাতে বানান। বাড়ির চাকরদের কোনো প্রকার সাহায্য এ সময়টায় তিনি নেন না। আজকেও তার হাতে কফির মগ। তিনি ঘরে ঢুকে দেখলেন পরিবারের সবাই একত্রে বসে গল্পে মেতে আছে। বিছানায় তার একমাত্র ছেলে দাদীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। ছেলের মুখ হাসি হাসি।

আজ কতদিন পর ছেলেটাকে নিজের বাড়িতে দেখতে পেলেন তিনি! দৃশ্যটা দেখা মাত্র মন ভালো হয়ে গেল। অফিসে ঘটে যাওয়া দুপুরবেলার ঘটনাগুলো মুহূর্তে ভুলে গেলেন। যদিও অয়নের সামনে তিনি আজকাল বেশ খানিকটা আড়ষ্ট বোধ করেন। অদৃশ্য একটা দেয়াল তাদের মা ছেলের মাঝে তৈরী হয়ে গেছে সেটা তিনি টের পান।

আয়শা ঘরের ভেতর ঢুকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন। বুশরা গদ গদ গলায় বলে উঠল, ‘মা তুমি এসেছ? গ্রেট! তোমাকেই মিস করছিলাম এতক্ষণ’।

অয়নের চোয়াল ততক্ষণে শক্ত হয়ে গেছে। হাত হয়ে গেছে মুষ্টিবদ্ধ। চোখের দৃষ্টি অস্থির। দাদিমা আয়শাকে বললেন, ‘আজকে রাস্তায় জ্যাম ছিল নাকি খুব, বৌমা?’

— ‘জ্বি মা, খুব জ্যাম ছিল। প্রায় দেড় ঘন্টা লেগে গেল আমার এ পর্যন্ত পৌঁছুতে

অয়ন শক্ত হয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ। উঠে দাঁড়ালো। বেরিয়ে এলো ঘরটা থেকে কাউকে কিছু না বলেই। আয়শা তার ধারে কাছে আছে, এই ব্যাপারটা সে আজকাল সহ্য করতে পারেনা।

রাস্তায় নেমে পকেট থেকে সিগারেট বের করতে গিয়ে হাত পড়ল মোবাইল সেটটার ওপর। মনে পড়ল আজ দুপুরে অফিসে ওয়েটিং রুমের চেয়ারে ফোনটা পেয়েছিল সে। কেউ হয়ত তাড়াহুড়ায় ফেলে গেছে। ফোনটা অন করতেই স্ক্রীনে একটা মেয়ের চেহারা ভেসে উঠল। খুব সাধারণ একটা চেহারা। কাটা কাটা নাক, টানা চোখ, গায়ের রংটা একটু কালোর দিকে। হাসছে। হাসিটা বড় সুন্দর। একটু খেয়াল করতেই সৌন্দর্যের কারণটা ধরতে পারলো অয়ন। হাসির ফাঁকে গজদাঁত উঁকি দিচ্ছে। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। মনে পড়েছে। একেবারে কোনার দিকের চেয়ারটায় বসে ছিল মেয়েটা। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ভয়ের চোটে নিজের সেল ফোনটাই ফেলে রেখে চলে গেছে। নিজের মনে হেসে ফেলল অয়ন। বেচারী ইন্টারভিউ দিতে এসে খুব শিক্ষা হয়ে গেছে। সে যাই হোক, ফোনটা ফিরিয়ে দেয়া দরকার। অয়ন ডায়াল লিস্টে গিয়ে দেখতে পেল মা নামে একটা নম্বর সেভ করা আছে। আগেপিছে কিছু চিন্তা না করে অয়ন কল করে ফেলল। খুব সম্ভবত মেয়েটার মা ই ফোন ধরবে। রিং পড়তে লাগল।

ভর দুপুরে চৈতিদের বাড়িতে হানা দেয়ায় চৈতির আম্মা বুঝি কিছুটা বিরক্ত হলেন। টেবিলে খাবার সাজাচ্ছিলেন তিনি। চৈতি মুখে ফেস প্যাক লাগিয়ে রোবটের মত মুখ করে বসে আছে একটা চেয়ারে। আহিরকে দেখে তার চোখ দুটো আনন্দে চক চক করে উঠল। ফিক করে হেসে ফেলতে গিয়ে শুকনো খড় খড়ে ফেস প্যাকে টান পড়ল। ব্যথায় হালকা কঁকিয়ে উঠল সে। এরপর ছুট দিল ওয়াশরুমে মুখ ধুয়ে আসার জন্য। আহির চৈতির আম্মাকে একটা সালাম দিয়ে চৈতির ঘরে ঢুকে গেল। তাদের বাসার প্ল্যান আর এই বাসার প্ল্যান পুরোপুরি একই বলতে গেলে। দুটা বেডরুম আর ড্রইং ডাইনিং। এই ফ্ল্যাটে শুধু চৈতির আব্বা বাড়িওলাকে বলে একটা সার্ভেন্ট টয়লেট বানিয়ে নিয়েছেন। আজ প্রায় বছর দশেকের মতো হয়ে গেল চৈতিদের পরিবার আর আহিরদের পরিবার পাশাপাশি আছে। এ বাড়িতে এসেই চৈতির সাথে আহিরের প্রথম পরিচয়। একই ক্লাসে পড়ার কারণে ওদের মাঝে বন্ধুত্বটাও হয়ে গেল খুব তাড়াতাড়ি। চৈতি বেঁটে খাটো কিন্তু মিষ্টি দেখতে একটা মেয়ে। ভীষণ হাসি খুশি আর আমুদে স্বভাবের। আহির তাই মন থেকেই খুব পছন্দ করে মেয়েটাকে।

চৈতির ঘর প্রতিদিনের মতোই এলোমেলো। বিছানার ওপর ছড়ানো ছিটানো বইয়ের লহর। কাপড়ের স্তুপ চেয়ারের ওপর। এমনকি ঘরের ভেতর একটা উটকো গন্ধ। অন্য কোনো মেয়েকে আহির এতটা নোংরা হয়ে থাকতে দেখেনি কখনো। সে বুঝে পেলনা কোথায় একটু বসা যায়। চৈতি মুখ ধুয়ে এসে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিয়ে বলল,

— ‘দেখ তো, ফর্সা ফর্সা লাগে নাকি? এই ফেস প্যাকটা নতুন কিনসি’

আহির পানসে মুখে বলল, ‘তুই তো এমনিই ফর্সা, এর বেশি ফর্সা হয়ে কি ভূত সাজতে চাস?’

চৈতি গলায় আক্ষেপ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বলল, ‘আর ফর্সা হলেই বা কী হবে ভাই? আমাদের তো ভাত নাই, ভাত তো তোর, বাড়িওয়ালার বেকুবটা পর্যন্ত তোর দিকেই গেল, কই আমার ফর্সা রং তো কাউকে টানছেনা দেখছি!’

আহির হেসে ফেলল, ‘বেকুবটা এখন আমাদের বাসায় বসা, তুই চাইলে গিয়ে আলাপ করতে পারিস

চৈতি চক চকে চোখ নিয়ে বলল, ‘সেকি! সে তোদের বাসায় কী করছে?’

— ‘কী আর করবে, সোফায় বসে বসে পা দুলাচ্ছে’।

— ‘ওহ!! দেখতে শুনতে একটু ভালো হলে দেখতি ঠিকই বাগে নিয়ে আসতাম, কিন্তু যা একখান সুরত! ইচ্ছা করেনা। তা তুষার সাহেব কেমন আছেন?’

— ‘তোর ফোনটা দে তো, তুষারকে একটা ফোন দিতে হবে, আজকে জানিসনা তো কী কান্ডটা হয়েছে!’

— ‘কী হয়েছে?’ রহস্যের গন্ধ পেয়ে চৈতি উদ্বেগ নিয়ে বলল।

— ‘পরে বলছি, আগে তুষারকে ফোন লাগা!’

— ‘হ্যালো তুষার?’

— ‘হ্যাঁ, মিটিং এ আছি, কী বলবে তাড়াতাড়ি বল’

আহির ঢোঁক গিলল। আমতা আমতা করে বলল,

— ‘ইয়ে, আমার ফোনটা হারিয়ে গেছে, তুমি আমাকে ফোন করে পাবেনা, এটা জানাতে চাইছিলাম’

তুষার নিরুত্তাপ গলায় বলল,

— ‘ও, আচ্ছা!’

অবাক হলো আহির, বারে! ফোন হারানোটা যেন নিত্যদিনের ঘটনা। একটু চুপ থেকে তুষার বলল,

— ‘ওকে, আমি তোমাকে টিএনটিতে ফোন দিব, তখন বিস্তারিত শুনব, এখন খুব ব্যস্ত আছি সোনা! ছাড়ছি বায়, লাভ ইউ!’

ফোন কেটে গেল। তুষার এ মাসেই স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্ক এ জয়েন করল, এ কথা সত্য সে আজকাল ভীষণ ব্যস্ত থাকে, তবু আহিরের এত বড় একটা দুঃসংবাদ শোনার পরেও কী তার কাছে কাজই বেশি হয়ে গেল? মনটা খারাপ হয়ে যায় আহিরের। গত কাল রাতেও তুষার এই ইন্টারভিউ সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করেনি। কোথায় অফিস, কি সমাচার কিছুই জানতে চাইল না। ব্যস্ততা মানুষকে এতটা বদলে দেয়?

একটু বাদেই মায়ের ডাক পড়ল। চৈতির ফোনে। যাবার সময় চৈতি বলল,

— ‘বিকেলে ছাদে আসিস পারলে, খুব গল্প করব

আহির একটা হাসি দিয়ে সম্মতি সূচক মাথা নেড়ে বেরিয়ে আসল। বাসায় আসতেই মা হইচই লাগিয়ে দিলেন।

— ‘ফোন এসেছিল, ফোন এসেছিল!’

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি

আহির অবাক, ‘কার ফোন, কিসের ফোন?’

— ‘তোর নম্বর থেকে

— ‘সেকি!’

মায়ের উত্তেজিত কন্ঠস্বর থেকে বেরিয়ে আসা শব্দগুলো দ্বারা যা বোঝা গেল তা হলো, কোনো এক হৃদয়বান ব্যক্তি তার ফোনটা খুঁজে পেয়েছেন, এখন সেই হৃদয়বান ফোনটা ফিরিয়ে দিতে চান, আগামীকাল বিকেল পাঁচটায় শাহবাগ মোড়ে সে অপেক্ষায় থাকবে।

মাথা মুন্ডু বুঝে উঠতে আহিরের একটু সময় লেগে গেল। ফোনটা কার হাতে যেতে পারে! ইন্টারভিউ দিতে আসা পাশে বসে থাকা ছেলেটা নয় তো? কিংবা ওই অফিসেরই কোনো কর্মচারী হতে পারে। এই আজগুবী ফোনের ওপর বিশ্বাস করে কাল শাহবাগ মোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা আসলে কতটা যুক্তিযুক্ত হবে আহির সেটা বুঝতে পারছেনা।

মা বললেন, ‘তুই একা যাসনা, একা মেয়ে পেয়ে আবার কী না কী শয়তানী করে, তুই বরং তুষারকে সঙ্গে নিয়ে যা, সেই ভালো হবে’

আহির একটু চমকে তাকালো মায়ের দিকে। মা কবে থেকে আবার তুষারকে বিশ্বস্ত ভাবা শুরু করেছেন! বাব্বাহ! সূর্য কোনদিকে উঠল আজ? সে যাই হোক মায়ের মুখে আস্থার সাথে তুষারের নামটা শুনতে পেয়ে ভালো লাগল। ফোনটা আবার ফিরে পাবার একটা আশা দেখতে পাওয়াতেও মনটা একটু নেচে উঠল। একটু আগের বিষণ্ণ ভাবটা এখন আর কাজ করছেনা।

রাস্তায় নামার পর থেকেই শীতটা টের পাওয়া যাচ্ছে। অয়নের গায়ে একটা পাতলা পাঞ্জাবী। সেই পাঞ্জাবী ভেদ করে একরোখা হাওয়া শরীরে চাবুক বসাচ্ছে। কুয়াশায় আবছা হয়ে আছে রাজপথের ফ্লুরোসেন্ট আলো। রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানটা খোলা। অবশ্য রাত খুব বেশি একটা হয়নি। দশটা বাজে মাত্র।

অয়ন এক কাপ চা দিতে বলে বেঞ্চিতে বসলো পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে। চায়ের দোকানদার অয়নকে দেখে একগাল হাসি দিয়ে বলল,

— ‘মামা কই আসিলেন এদ্দিন? অনেক দিন পর দেখতাসি’

অয়ন হাসে, ‘এইতো মামা! আমার আর থাকা না থাকা, আমি পাগল মানুষ, আমার কি ঠিক আছে কিছু?’

কাঁধের কাছে একটা হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে তাকায় অয়ন। বেশ পরিচিত একটা মুখ হাসি হাসি চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অয়নের আজকাল চেনা লোকের সংখ্যা এত বেশি বেড়ে গেছে যে রাস্তা ঘাটে হঠাৎ দেখায় কারও নাম মনে করতে পারেনা সে। নাম গুলিয়ে ফেলে। ভুল নাম বলে শেষ মেষ লজ্জায় পড়তে হয়। মনে হচ্ছে এই ছেলেটার নাম তানিম। এ পাড়াতেই থাকে, খুব চেনা মুখ। ছেলেটা হাস্যজ্জ্বল মুখে বলল,

— ‘অয়ন ভাই! কী অবস্থা?’ অয়ন হাসলো, বেঞ্চের এক কোণে সরে এসে ছেলেটাকে বসার জায়গা করে দিয়ে বলল,

— ‘ভালো, তুমি কেমন আছ?’ বসে পড়ল ছেলেটা,

  • ‘ভালো, আপনাকে অনেক দিন পর দেখলাম’

— ‘হুম, ঢাকার বাইরে ছিলাম’

নাহ, ছেলেটার নাম নিয়ে কনফিউশন কাটছেনা। আসলেই কি এটা তানিম নাকি অন্য কেউ? যতদূর মনে পড়ে তানিমের গালে সারা বছর ব্রণ উঠে ভরে থাকে। চুল ঘাড় অবধি লম্বা। কিন্তু এই ছেলের গাল পরিষ্কার। রাস্তার আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চুল ছোট করে ভদ্রলোকের মতো কাটা। নাহ তবে এটা তানিম না। নাম না জেনে আলাপ চালিয়ে যাওয়াটা বেশ বাজে একটা ব্যাপার। আবার হুট করে এখন নাম জিজ্ঞাসা করে বসাটাও অভদ্রতা হয়ে যাবে। অয়ন যার পর নাই একটা অস্বস্তি নিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিল। ছেলেটাকে চায়ের অফার করতেই টুপ করে রাজি হয়ে গেল। অয়ন গলা চড়িয়ে হাঁক দিল, ‘মামা! আরো এক কাপ দাও’

ছেলেটা হঠাৎ বেশ সরল গলায় বলে উঠলো, ‘ভাইয়া মনে হয় আমাকে চিনতে পারেননি’

অভিনয়টা ধরা পড়ে যাওয়ায় অয়ন একটু লজ্জা পেয়ে গেল। অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল, ‘ইয়ে, তোমার নামটা! আমি আসলে আজকাল বড্ড ভুলে যাই বুঝলে, কিচ্ছু মনে থাকেনা, তোমার চেহারাটা খুব চেনা চেনা লাগছে কিন্তু নামটা কিছুতেই মনে করতে পারছিনা, সরি!’

ছেলেটা প্রসন্ন হাসলো, ‘সরি হবার কিছু নেই, আপনি ব্যস্ত মানুষ, মনে না থাকারই কথা, আমি তুষার, কাছাকাছিই থাকি। এ পাড়ায়ই থাকি।

— ‘এবার মনে পড়েছে, তুমি তো স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডে জয়েন করেছ শুনেছিলাম, কেমন চলছে চাকরী? বাই দ্যা ওয়ে, তুমি আমার চাইতে বেশি ব্যস্ত, জব টব কর, আমি তো টো টো কোম্পানীর ম্যানেজার’

— ‘চাকরি ভালোই চলছে, মাত্র তো ঢুকলাম এখনো বুঝে উঠতে পারছি না আসলে সইবে কী সইবেনা, অনেক প্রেসার! আপনার কী খবর, কিছু করছেন না কেন ভাইয়া? আপনার মতো একটা ব্রাইট ছেলে যদি এভাবে বসে থাকে তাহলে কী করে চলবে?’

অয়ন হাসলো। তুষারকে এখন খুব ভালো মতোই মনে পড়েছে। ওর চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং এর ছাত্র। অয়ন ছিল ফার্মেসী ডিপার্টমেন্টে। এক বিকেলে আড্ডা শেষ করে করে হল থেকে ফেরার সময় ছাত্রলীগ আর ছাত্র দলের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার মাঝে ফেঁসে গিয়েছিল অয়ন। সেই সময় এই তুষারের সাথে দেখা। একই পাড়ায় থাকার সুবাদে তুষার আগে থেকেই কিছুটা চিনতো অয়নকে। অয়নের মনে আছে সেদিন তুষারের দয়াতেই প্রচন্ড হাঙ্গামার ভেতরও রেহাই পেয়ে গিয়েছিল সে। তুষার সে সময় মন প্রাণ দিয়ে রাজনীতি করত। মনে পড়তেই অয়ন প্রশ্ন করল,

— ‘আমার কথা ছেড়ে দাও, তোমার খবর বল, পলিটিক্স কেমন চলছে?’ তুষার হাসলো। হাসলে হালকা পাতলা লাজুক লাজুক ছেলেটাকে বেশ মিষ্টি লাগে। মুখে এখনো কচি কচি ভাবটা রয়ে গেছে।

— ‘পলিটিক্স তো ভাইয়া আমার রক্তে মিশে আছে, কিন্তু এখন আর কই সময় পাই বলুন? চাকরি বাকরি এইসব হাবিজাবিতেই টাইম চলে যায়। সামনে হয়ত বিয়েটাও করে ফেলতে হতে পারে

— ‘গ্রেট! খুব ভালো, তা তোমার নিজের পছন্দে বিয়ে করছ? নাকি পরিবারের পছন্দে?

— ‘নিজের পছন্দ,’

— ‘বাহ, কী করে মেয়ে? তোমার সাথেই পড়াশোনা করেছে?

— ‘নাহ, ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইকোনমিক্সে অনার্স করেছে,

এখন চাকরী খুঁজছে, যুতসই পাচ্ছেনা,’

অয়ন চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলল, ‘দারুণ! খুব তাড়াতাড়ি তাহলে আমরা একটা বিয়ে খাচ্ছি, এবার তাহলে একটু রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে মনুষ্যনীতি কর, সেই ভালো’

তুষার ম্লান ভাবে বলল,

— ‘রাজনীতির প্রতি আপনার আক্ষেপটা তাহলে এখনো যায়নি ভাইয়া’

— ‘আক্ষেপ না কী আসলে তা ঠিক বলতে পারবনা, শুধু এতটুকু বলতে পারি যে রাজনীতি করে কখনো দেশের মানুষের পাশে সত্যিকার অর্থে দাঁড়ানো যায়না। রাজনীতি হলো রাজরাজড়াদের নিয়ম কানুন, সাধারণ মানুষের এখানে কোনো স্থান নেই’

— ‘সরকার তো দেশের মানুষই ভোট দিয়ে নির্বাচন করে, তাইনা? দেশের মানুষগুলোর জন্যই তো গণতন্ত্র!’

অয়ন হাসলো, of the people, by the people, for the people, এই শব্দগুলো এখন মিউজিয়ামে তোলা আছে বুঝলে, কোনো প্রয়োগ নেই, আচ্ছা বলতো এই যে এতগুলো দিন পলিটিক্স করছ, কখনো এই শীতের রাতগুলোতে রাস্তার পাশে শুয়ে থাকা কোনো পথ শিশুকে তুলে নিয়ে নিজের আরামের বিছানাটা ছেড়ে দিয়েছ তার জন্য? বলো দিয়েছ?’

তুষার একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সে জানে এই ছেলেটার মাথায় একটু ছিট আছে। তবুও কোনো এক অজানা কারণে এই মানুষটাকে সে সম্মান করে। একটা কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলল,

— ‘নাহ, তা তো করিনি, পলিটিক্স করি ভাই, মানবাধিকারের কাজ করিনা’ বলেই তুষার খুব হাসলো। যেন অনেক উঁচুমানের একটা রসিকতা করে ফেলেছে সে।

অয়ন একটু ভারী গলায় বলল, ‘ডেমোক্রেসির বেসিক নিশ্চয়ই তোমার জানা আছে। respect for human rights and fundamental freedoms মানবাধিকার নিয়েই যদি না ভাবলে তো কিসের রাজনীতি কর তোমরা ভাই?’

— ‘ধীরে ধীরে সবই হবে ভাইয়া, দেখুন এই ক বছরে উন্নতি কিন্তু কিছু কম হয়নি, গ্রামে গঞ্জে প্রতিটা ঘরে ঘরে বিদ্যুত গেছে, প্রতিটা স্কুল ঘরে কম্পিউটার গেছে, ইন্টারনেট এখন গ্রামের ছেলেমেয়েদের কাছেও সহজলভ্য। পুরো পৃথিবীটা হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। সত্যিকার অর্থে ডিজিটাল হয়ে উঠছে দেশটা, এই দিক দিয়ে একটু ভাবুন ভাইয়া! একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন আওয়ামী লীগ আসলে কী কাজটা করছে দেশের জন্য’ অয়ন পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে চেপে ধরল। শীতটা ভালোই পড়ছে। কাল থেকে আর চাদর গায়ে দেয়া ছাড়া বেরোনো যাবেনা বাসা থেকে।

সিগারেটে আগুন ধরিয়ে একটা টান দিয়ে অয়ন বলল,

— ‘তোমাদের সমস্যা কি জানো তুষার? দেশ বলতে তোমরা সবসময় আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপি বোঝো, ভাই এইসব দল টল থেকে এবার বেরিয়ে আসো, শুধুমাত্র নিজের দেশটাকে নিয়ে ভাবো, দেশের মানুষগুলোকে নিয়ে ভাবো। আমি কোনো দলের হয়ে কথা বলতে চাইছিনা।

— ‘যে উন্নয়নটা হচ্ছে সেটা কি দেশের মানুষের জন্যই নয়? সরকার তো জনগণের থেকে আলাদা কিছু না, সরকার যা করছে জনগণের জন্যই করছে’

অয়ন একটা শ্লেষের হাসি হাসলো,

— ‘যে দেশে worth of humanity নাই সে দেশের আবার উন্নয়ন! এই যে শীত আসছে, দেখবে রাস্তা ঘাটে কুকুরের পাশে মানুষগুলোও ঠান্ডায় জমে গিয়ে কুঁকড়ে পড়ে আছে। আচ্ছা তোমাদের ওই গদিতে বসে যে লোকগুলো দেশ চালাচ্ছে, তারা কি কখনো রাস্তায় নামেনা? হাঁটেনা? চোখ মেলে দেখেনা? মনে হয় দেখেনা, যদি দেখতো তাহলে দেশের সর্বোচ্চ সিংহাসনে বসে থেকে এরা দুশ্চিন্তা আর আত্মগ্লানিতে ঘুমাতে পারতো না।’

— ‘দারিদ্রতা যতদিন আমাদের বুক আঁকড়ে পড়ে থাকবে, ততদিন এসব থেকে বেরিয়ে আসা কি সম্ভব? ওসব বাদ দিয়ে একটু পজেটিভ চিন্তা করুননা ভাইয়া, এই যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, জাতি কলঙ্কমুক্ত হচ্ছে, কত বড় একটা স্বার্থকতা!’

— ‘হ্যাঁ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে সেটা খুব ভালো কথা, কিন্তু জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করা এত সহজ কথা না, এক অর্থে, এ দেশের আনাচে কানাচে, অলিতে গলিতে আরো কত কত রাজাকার ঘাপটি মেরে বসে আছে তা আমাদের জানা নেই! এদের সবকটাকে খতম না করলে দেশ কখনো কলঙ্কমুক্ত হবেনা, তবে একটা ব্যাপার কি জানো? মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা জানতাম যে আমাদের শত্রু পক্ষ কারা। কিন্তু এখন… এখন আসলে আমরা বুঝেই উঠতে পারছিনা যে কাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে!’

তুষার একটু নড়ে চড়ে বসলো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে খানিকটা বিরক্ত। তবুও বুঝি নেহাৎ ভদ্রতার খাতিরেই বলল,

— ‘ভাইয়া, আপনি কথা বলেন খুব সুন্দর, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু সবসময় আসলে আপনার কথার সাথে আমি একমত হতে পারিনা, মাফ করবেন’

— ‘আরে না, মাফ করার কিছু নাই, আমি জাস্ট আমার ভাবনাটা শেয়ার করলাম তোমার সাথে’

তুষার হাসল, অয়ন উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

— ‘আসি ভাই, অনেক কথা বললাম, hope you wouldn’t mind!’

— ‘কী যে বলেন ভাইয়া, মাইন্ড করার প্রশ্নই আসেনা। চাকরি বাকরি কিছু একটা ধরুন ভাইয়া, এভাবে আর কদ্দিন চলবে!’

— ‘আরে না, চাকরি বাকরি আমার দ্বারা হবেনা, দাসবৃত্তি পছন্দ করিনা আমি!’

— ‘তাহলে আপনার আম্মার বিজনেসে ঢুকে যান, স্বাধীন থাকবেন’

— ‘নারে ভাই, স্বাধীনতা কোথাও নেই, ব্যবসা বল আর চাকরি বল, সেই অর্থের কাছে, টাকা পয়সার কাছে দাসত্ব স্বীকার করতেই হবে, আমি ঠিক করেছি কিছুই করবনা, খেয়ে না খেয়ে পার করে দেব, এই একটা জীবন!’

তুষার হাসে। এতটাও আবোল তাবোল মানুষ হয়?

আকাশে পেঁজা তুলো মেঘ। চাঁপা ফুল রঙের মিষ্টি একটা আদুরে রোদ্দুর ছড়িয়ে আছে ধূলোমাখা গাছগাছালিতে, উঁচু দালানের কার্নিশে, ব্যস্ত রাস্তার গায়ে গায়ে। আহির দাঁড়িয়ে আছে শাহবাগের ফুলের দোকানগুলোর সামনে। তার গায়ে হালকা বেগুনী রঙের সালোয়ার কামিজ। তার ওপর ম্যাচিং করা পাতলা চাদর। চুলগুলো এলো করে খোলা পিঠের ওপর। মিষ্টি রোদটা গালে এসে পড়ায় তার বাদামী গায়ের রং চিক চিক করছে। সুন্দর দেখাচ্ছিল আহিরকে। রাস্তার মানুষগুলোর নজর আটকে ছিল ওর ওপর। পুরোপুরি আজগুবি একটা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এই পর্যন্ত চলে আসায় নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগছিল। কিন্তু হারানো জিনিস ফিরে পাবার আশায় এই রিস্কটুকু নেবার লোভ সামলাতে পারেনি সে। মায়ের মোবাইলটা সাথে ছিল। ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে নিয়ে নিজের হারানো নম্বরে কল করলো। রিং পড়ছে কিন্তু ধরছেনা কেউ। মনটা খারাপ হয়ে গেল। নেহাৎ কেউ একজন ফাজলামো করেছে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে। আর মা সেটা বেকুবের মত বিশ্বাস করেছে। প্রায় আধা ঘন্টা হয়ে গেছে সে এখানে দাঁড়িয়ে আছে। তুষারের আসার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে একটা কাজ পড়ে গেল। তুষার সাথে থাকলে সময়টা এত বাজে কাটত না। শেষ বারের মতো আশেপাশে চোখ বুলালো আহির। খুব কাছেই একটা জটলা তৈরি হয়েছে। মেরুন কালারের একটা এলিয়েন গাড়িকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে ভিড়টা। লুঙ্গি গেঞ্জি পরা দোকানদার ধরনের লোকজন ঘিরে আছে গাড়িটাকে। গাড়ির সামনেই একটা রিকশা দাঁড়ানো। মনে হচ্ছে রিকশাওয়ালার সাথেই কোনো ঝামেলা হয়েছে গাড়ির মালিকের। বেশ চড়া গলায় হইচই হচ্ছে। একটু মনোযোগ দিয়ে তাকাতেই আহির দেখল ড্রাইভিং সিটে ষোল কী সতেরো বছরের এক কিশোরী বসে আছে।

আহির গা বাঁচাতে একটু দূরে সরে আসলো। রাস্তাঘাটের এসব গন্ডগোল দেখলে কেমন ভয় ভয় লাগে আজকাল। দেশের পরিস্থিতি যা হয়েছে, এক মুহূর্তের ভরসা নেই। কখন কী হয়ে যায়। আরেকবার তাকাতেই এই এতগুলো পিপীলিকার মতো মানুষের ভিড়ের মাঝে একটা চেহারার ওপর চোখ আটকে গেল। কালো ফতুয়া গায়ে দেয়া। আহির কোথায় যেন দেখেছে এর আগে এই চেহারাটা। কোথায় দেখেছে ঠিক মনে করতে পারছেনা। খুব চেনা চেনা লাগছে। উঁচু গলায় কথা বলছে ছেলেটা। মনে হচ্ছে যেন এই আকস্মিক গন্ডগোলের মূল হোতা সে নিজেই। ঠিক সেই সময় চেনা চেনা মুখের ছেলেটার চোখ পড়ল আহিরের দিকে। চোখে চোখ পড়তেই আহিরের মনে পড়ে গেল, আরে এইটা তো সেই পাগলটা!!!

হৃদপিন্ডটা লাফিয়ে উঠল। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইল। এতক্ষণে বুঝতে পারল আহির এই ভিড় ভাট্টার কারণ কী। পাগলটা নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা বাঁধিয়েছে। আহির আর কোনো কিছু চিন্তা না করেই ফেরার পথে পা বাড়ালো। নাহ এখানে আর একটা মুহূর্তও না। জান নিয়ে পালাতে হবে। সেদিনের মত ভাংচুর করে বিপদ ঘটানোর আগেই।

— ‘এই যে! এই যে শুনুন!’

আহির পেছন ফিরে তাকালো, ওমা একি!! পাগলটা তাকেই ডাকছে!!! কিছু না শোনার ভান করে আহির হাঁটতে লাগল। সামনে একটাও খালি রিকশা নেই যে চট করে উঠে যাবে। বিপদ আসলে সব দিক থেকে একসাথে আসে! হায় খোদা এখন কী হবে!

— ‘এই যে ম্যাডাম! আপনি শুনতে পাচ্ছেননা?’

এবারে গলার আওয়াজ একেবারে ঘাড়ের কাছে পাওয়া গেল। আহির চমকে তাকালো। পাগল ছেলেটা তার দিকে খুব অবাক চোখে চেয়ে আছে। যেন আহির মানুষ না, চিড়িয়াখানার কোনো চিড়িয়া।

বুকটা কাঁপছিল, তবুও কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে আহির বলল, ‘কী চাই?’

— ‘আশ্চর্য! আপনি পালাচ্ছেন কেন?’ সোজা সাপটা প্রশ্ন। আহির একটু কেমন থতমত খেয়ে গেল। পাগলটা পাগল হলেও কিন্তু ভীষণ স্মার্ট! কথায় ধার আছে। ভেতরে ভেতরে কেমন একটু কুঁকড়ে গেল আহির। তবুও গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল, ‘কী চাই আপনার?’

— ‘স্ট্রেঞ্জ!’ বলল পাগলটা। যদিও এখন তার আচার আচরণ মোটেও পাগলের মতো না।

একটু থেমে কিছু একটা চিন্তা করে নিয়ে ছেলেটা নাটুকে গলায় বলল, ‘আমি ভাই কিছুই চাইনা আপনার কাছ থেকে, আপনার ফোনটা শুধু আপনাকে ফেরত দিতে চাই, আপনি দয়া করে আপনার ফোনটা ফেরত নিয়ে আমাকে ধন্য করুন’

বিষম খেল আহির। শেষমেষ এর হাতেই গেছে তার ফোন! সত্যি বিশ্বাস হচ্ছিল না। মুখটা একটু হা হয়ে গেল আহিরের। ছেলেটা পকেট থেকে ফোনটা বের করতে করতে বলল, ‘এ জন্যই জ্ঞানী লোকেরা বলে গেছেন, মেয়েদের উপকার করতে নেই!’

আহিরের মুখ খানা ছাইবর্ণ হয়ে গেল। ছিঃ কি কান্ডটা হলো। বেচারা পাগল ছাগল ছেলেটা তার হারানো ফোন ফিরিয়ে দেবার জন্য ডাকছিল আর সে কিনা কী দুর্ব্যবহারটাই করে ফেলল। আহির কী বলবে খুঁজে পাচ্ছিল না। কে বলবে স্কুল কলেজে পড়াকালীন সময়ে এই মেয়েটা কী দুর্দান্ত বিতার্কিক ছিল। এখনো অবশ্য আহিরের সাথে যুক্তিতে খুব কম লোকই পারে কিন্তু আজকে সবকিছু কেমন একটু বেসামাল হয়ে গেল। কাঁপা হাতে নিজের ফোনটা হাতে নিল সে।

— ‘এক্সকিউজ মি!’

ওরা দুজনেই খানিকটা চমকে তাকালো। কিশোরী মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে, যে এতক্ষণ গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে ছিল। হ্যাংলা পাতলা মেয়েটা লম্বায় প্রায় পাঁচ ফুট পাঁচ ছাড়িয়ে গেছে। গায়ে একটা বাদামী রঙের ফুল হাতা সোয়েটার। কালো জিন্স। রঙ করা চুল। টকটকে ফরসা গায়ের রং। একবার তাকালেই চোখে ধাঁধা লেগে যায়। আহির সত্যি বলতে খুব মুগ্ধ হলো মেয়েটাকে দেখে। এত কম বয়সেই এর পার্সোনালিটি দেখার মত। তার ওপর রূপের চমক তো আছেই!

— ‘শিওর!!’ অয়ন বলল।

বাচ্চা মেয়েটা একটু হেসে একবার আহিরকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে অয়নকে বলল,

— ‘ইওর গার্লফ্রেন্ড?’

— ‘না না!’ ছেলেটা আঁতকে উঠল। একটু লাল হল আহির। মেয়েটা হাসলো আবার, ছেলেটাকে বলল,

— ‘ওহ সরি! বাই দ্যা ওয়ে, উমমম, মে আই হ্যাভ ইওর ফোন নাম্বার?

— ‘ইয়েস ইউ মে, বাট সরি টু সে, যে ফোনটা বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ থাকে!’ মেয়েটাকে দেখে মনে হলো সে কথাটা বিশ্বাস করল না। চোখ দুটোতে হালকা অবিশ্বাস চকচক করে উঠল। মুখে তখনও লটকে আছে সেই হাসিটা। একটুও বিচলিত না হয়ে বলল, ‘তাহলে যেটা সবসময় খোলা থাকে সে নম্বরটাই দিন, কিংবা কোনো মেসেঞ্জার! যেটাতে আপনি এভেইলেবল!’

— ‘আমার কোনো কিছুই নেই’

আহির বেশ মজা পাচ্ছিল। চেনেনা জানেনা হুট করে কোনো ছেলের কাছে কোনো মেয়েকে ফোন নম্বর চাইতে এই প্রথম দেখল সে। এই জেনারেশনটা সত্যি খুব অন্যরকম হয়ে বেড়ে উঠছে। ভাবতে অবাক লাগে।

মেয়েটা এবার কৌতুকের স্বরে বলল, ‘আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? আমি খুব বেশি বিরক্ত করব না, আসলে আজকে আপনি আমার অনেক বড় উপকার করলেন তো! আমি… আমি জাস্ট আপনার সাথে কানেক্টেড থাকতে চাইছি।’

ছেলেটা হাসলো,

— ‘এটা এমন কিছুনা, আমি না থাকলে অন্য কেউ হেল্প করত আপনাকে, তবে একটা কথা বলি, লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানোর সাহস আর করবেন না। আর বয়সও একেবারে কম আপনার। অ্যাডাল্ট হয়ে উঠুন তারপর না হয় এসব রিস্ক নেবেন! আজকে রিকশায় বসে থাকা মহিলাটার যদি কিছু হয়ে যেত তো আপনার খবর ছিল!’

— ‘ওকে স্যার! আপনার কথা গুলো মনে থাকবে! ফোন নম্বরটা মনে হয় দেবেন না আপনি!’

— ‘না না! দেবোনা কেন? উমমম আসলে আমার ফোন নম্বর আমার মনে নেই, আপনি আপনারটা বলুন আমি মিস কল দিচ্ছি।’

আহির মিটিমিটি হাসছিল আর এই ফোন নম্বর আদান প্রদানের খেলাটা দেখছিল। ফোন নম্বর নেয়া হলে মেয়েটা বলল,

— ‘আপনি সত্যি খুব অদ্ভূত মানুষ। নিজের নম্বর নিজের মনে থাকেনা!! বাই দ্যা ওয়ে, আপনার নামটা জানা হলো না!’

  • ‘অয়ন’ নিজের নামটা বলল ছেলেটা। আহির শুনলো।

মেয়েটা এবার আহিরকে ইঙ্গিত করে অয়নকে বলল,

— ‘আপনার বন্ধু বুঝি?

অয়ন কিছু বলল না, তবে মুখে একটা হ্যাঁ সূচক হাসি লটকে রাখল। মেয়েটা আহিরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল,

— ‘আমি তিয়ানা! ডু ইউ নো সামথিং এবাউট ইওর ফ্রেন্ড? হি ইস আ ব্রেভ ম্যান, আই এম টোটালি ইম্প্রেসড!’

মেয়েটির চটক দেখে আহির তখন অবাক সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। কোনো রকমে হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিজের নামটা বলল, ‘আহির।’

অয়ন চোখ তুলে দেখল একবার আহিরকে। ‘আহির!’ এ আবার কেমনতর নাম!

— ‘ওকে, বায়! হ্যাভ ফান!’ বলেই মেয়েটা তার অতি সরু কোমর খানা

দুলিয়ে দুলিয়ে হাই হিল জুতো ঠক ঠকিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। আহির হা হয়ে তাকিয়ে ছিল। সাঁই করে চোখের সামনে দিয়ে প্রায় উড়ে গেল গাড়িটা। উড়ার সাথেসাথেই দুজনে ঠিক এক সাথে বলে উঠল, ‘বাহ!’

এরপর চমকালো দুজনেই। হেসে ফেলল। অয়ন বলল,

— ‘আরে জানেন না তো! স্পিডে গাড়ি চালাতে গিয়ে একটা রিক্সার সাথে

লাগিয়ে দিয়েছিল ধাক্কা। রিকশায় বসা ছিল এক মহিলা। সেই মহিলা রিকশা থেকে নেমে এই মেয়েকে কী যে ধমক। রাস্তার লোকজনও মজা পেয়ে মহিলার হয়ে খুব দালালী শুরু করল। আমি গিয়ে থামালাম। বাচ্চা মেয়ে! কী দরকার মোড়ে মোড়ে গাড়ি চালানোর!’

— ‘হুম তাই তো দেখছিলাম, খুব হইচই হচ্ছিল। তা বেশতো! মেয়েটা একেবারে আপনার ডাই হার্ট ফ্যান হয়ে গেছে!’ কৌতুকের গলায় বলল আহির।

সন্ধ্যে হয়ে আসছিল। কুয়াশা গভীর হয়ে চেপে বসছে ধুলোমাখা শহরের গায়ে। ওরা ফুটপাথ ধরে কিছুটা সময় হাঁটলো। কেউ কোনো কথা বলছিল না। একটা খালি রিকশা সামনে পেয়ে গেল। আহির অয়নকে বলল, ‘আমি তাহলে আসি’ এই প্রথম ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, একে সে বহুকাল ধরে চেনে। সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষকে হঠাৎ এই সন্ধ্যেবেলার বাদামী আলোয় কেন এত চেনা চেনা লাগছে!

আহির রিকশার ভাড়া ঠিক করে তাতে উঠে বসলো। অয়ন দাঁড়িয়ে ছিল তখনও। আহির অয়নের দিকে তাকিয়ে গভীর গলায় বলল,

— ‘আসলে, আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেব! ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা’ অয়ন হাসলো শুধু, কিছু বললনা।

— ‘এহ: নাক বোঁচা আর কপালটা বিশাল বড়, দেখলে মনে হয় চুল নাই মাথায়’ অয়ন বলল বিষঢালা গলায়। সে পা তুলে বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে বুশরার বিছানায়। জানালা গেলে মেঝেতে এসে পড়েছে মৃদু হিম জড়ানো সকাল বেলার মিষ্টি রোদ। বারান্দার রেলিঙের ধারের বেল গাছটার ডালে বসে দু তিনটা পাতি চড়ুই বেশ অনেকক্ষণ হলো জোরে- সোরে ঝগড়া করছে। অয়নের কটাক্ষ ভরা উক্তিতে বুঝি ওদের ঝগড়াতেও ব্যাঘাত ঘটল। হঠাৎ চুপ করে গেল ওরা। দাদীমা কিছু বললেন না। শুধু ভ্রুটা একটু কুঁচকে ফেললেন। বুশরা কম্পিউটার টেবিলে বসে ছিল। দাদীমা নির্দেশ দিলেন,

— ‘নেক্সট!’

বুশরা বাধ্য মেয়ের মত মাউস ঘুরিয়ে নেক্সট বাটনে ক্লিক করল। সবুজ শাড়ি পরা একটা ঝলমলে মেয়ের ছবি ভেসে উঠল আঠারো ইঞ্চির এলইডি মনিটরে। বুশরা আর দাদীমা দুজনই তাকালো অয়নের দিকে। অয়ন বেশ মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখার ভান করল। দু এক মিনিট সময় নিয়ে দেখে বলল,

— ‘ইশশ!! দেখো দাদীমা, মেয়েটার চেহারার মধ্যে একটা কেমন যেন জম্বি জম্বি ভাব আছে।’

দাদীমা এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘সেটা আবার কী জিনিস? তোদের এসব কথা বার্তা বাপু আমি বুঝিনা। এই মেয়ে ডাক্তার, মেয়ের বাবা মা ডাক্তার, খুবই ভালো পাত্রী! আমার মনে হয় এ ক্ষেত্রে আমরা এগোতে পারি।

অয়ন খিক খিক করে হেসে উঠে বলল, ‘এই ডাক্তার মেয়ে আমার মতো বেকার ভাদাইম্যা একটা ছেলেকে কেন বিয়ে করবে, বল তো দাদীমা?’

— ‘করবেনা আবার! করার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে, আমার নাতী কী যেন তেন নাকি? হাজারে একটা!’

বুশরা একটু জ্বালা ধরা গলায় বলল, ‘তুমি বরং তোমার নাতীর জন্য ঐশ্বরিয়া রাই কে নিয়ে আসো দাদীমা, তোমার নাতীর কোনো সাধারণ মেয়ে পছন্দ হবেনা’

— ‘নাহ, ঐশ্বরিয়া না, এলিসা কুথবার্টকে ভালোলাগে, ওই রকম মেয়ে পেলে বিয়ে করব, প্রমিজ!’

দাদীমা বোকাটে একটা চেহারা বানিয়ে কি যেন চিন্তা করলেন কিছুক্ষণ। এরপর খুব সিরিয়াস ভঙ্গীতে কথা বলা আরম্ভ করলেন, যেন চাইলেই এলিসা কুথবার্টকে তাঁর নাতবউ বানানো যায় এবং ব্যাপারটা বুঝি আসলেই খুব ভাববার বিষয়।

— ‘এইসব নায়িকা টায়িকা নিয়ে সংসার করা যায়না বাপু, সংসার করার জন্য চাই শালীন এবং ঘরোয়া মেয়ে, বলে দিলাম আগে থেকেই! ‘

বুশরা বলে, ‘ফর গড সেক দাদীমা, তোমার এই বাউন্ডুলে নাতীটার সাথে বিয়ে দিয়ে কোনো মেয়ের জীবন নষ্ট করোনা।

দাদীমা রসিকতার গলায় বললেন,

— ‘একবার বিয়েটা হয়ে গেলেই দেখবি, সব ঠিক হয়ে যাবে, তোর দাদাভাই ও বিয়ের আগে ঠিক অয়নের মতোই ছিলেন, অয়নকে দেখি আর আমি অবাক হই, ঠিক যেন ওই মানুষটাই খানিকটা মুখোশ পাল্টে ফেরত এসেছেন আমাদের মাঝে’

বুশরা বলল,

— ‘দাদাভাই তোমাকে খুব ভালোবাসতেন, তাইনা?’

দাদীমার চোখ দুটো চক চকে হয়ে উঠল। সম্মোহনের গলায় বললেন,

— ‘তোর দাদাভাই মানুষটা ছিলেন খুব অদ্ভূত। তার মনের ভেতর কী চলতো তা কেউ কোনোদিন টের পেত না।’

— ‘তুমিও না?’ বুশরার প্রশ্ন। দাদীমার সাতাত্তর বছর বয়সের কাঁপা কন্ঠটা আকস্মিক কেমন চাপল্যে ভরে উঠল,

— ‘আমি বুঝতাম যে তিনি আমাকে মনে মনে কতটা পছন্দ করতেন… হে হে, সে সব কথা তো আর তোমাদের বলা যাবে না গো!’

অয়নও বেশ মজা পাচ্ছিল। সে ঢং করে বলল,

— ‘কেন গো? বলা যাবেনা কেন গো? দাদীমা ফোকলা দাঁতে হাসলেন। বললেন,

— ‘তখন আমার বয়স তেরো, সেই তেরো বছর বয়সে তোদের বাড়ির বউ হয়ে আসলাম।’

এই খবরটা ওদের দুজনেরই জানা আছে। দাদীমার মুখেই শুনেছে। কিন্তু তাঁর আজকাল ভুলে যাবার রোগ হয়েছে। এক কথা মনের ভুলে চোদ্দ বার বলতে থাকেন। প্রতিবারই পুরনো গল্পটা নতুন উদ্যমে বলা শুরু করেন। যেন সম্পূর্ণ গোপন কোনো তথ্য শেয়ার করছেন তিনি। বুশরা অবশ্য তাঁর গল্প বলায় কখনো বাঁধা দেয়না। প্রতিবারই খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছে এমন একটা ভান করে। অয়ন ভান করতে পারেনা বললেই চলে। সংসারে প্রিয়জনদের খুশি করতে হলে

যে মাঝেমধ্যে একটু আকটু মিথ্যে অভিনয় করতে হয়, এই কায়দাটা তার জানা নেই। সে ভোঁতা মুখে বলল,

— ‘হুম জানি, এই গল্প একশ বার করসো, বিয়ের আগে দাদাভাইকে দেখার সৌভাগ্য তোমার হয়নি’

দাদীমা ফোড়ন কাটলেন, ‘আমি দেখতে চাইও নি!’

অয়ন অবহেলার গলায় বলে, ‘ওই একই, এরপর বিয়ের প্রথম রাতে, আই মিন তোমাদের বাসর রাতে দাদাভাইকে দেখে তোমার রাজকাপুরের কথা মনে পড়ল, কারণ দাদাভাই দেখতে একদম রাজকাপুরের মতো ছিলেন, সেই রূপ আমরা কেউ পাইনি, বাবাও না, আমিও না! উফ, একটা মানুষ নিজের বরের প্রশংসা করতে এত ভালোবাসে কী করে?

দাদীমা খিট খিটে গলায় বললেন, ‘তা তোর এত হিংসা হচ্ছে কেন শুনি?’ অয়নের মোবাইলটা বাজছিল। একটা অপরিচিত নম্বর। অয়ন বিরক্তির সাথে ফোন ধরল।

— ‘হ্যালো!’ একটা নারী কন্ঠ কথা বলে উঠল

— ‘হ্যাঁ, কে?’ অয়নের কটমটে প্রশ্ন।

— ‘অয়ন বলছেন?’

— ‘বলছি’

— ‘গতকাল সারাটা দিন আপনার ফোন বন্ধ পেলাম!’

— ‘আরে আজব! আপনি কে সেইটা তো আগে বলেন!’

ধমক শুনে ওপাশের মেয়েটা একটু বিষম খেল।

— ‘আমি তিয়ানা’

— ‘তিয়ানা? কে তিয়ানা?

তিয়ানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অস্বস্তি নিয়ে বলল,

— ‘সেই যে আমার গাড়ি একটা রিক্সাকে মেরে দিল, রাস্তার লোকজন আমাকে গণপিটুনি দেবার জন্য তৈরী হচ্ছিল, আর আপনি এসে বাঁচালেন, এর মাঝেই ভুলে গেলেন দেখি! বাহ!’

অয়নের মনে পড়ল। অবাক লাগল ওর। মেয়েটা এমন ধুম করে ফোন দিয়ে ফেলবে ভাবতেই পারেনি সে। ফোনটা নিয়ে দাদীমার সামনে থেকে সরে আসলো সে।

— ‘ওহ! সরি! আসলে আপনার কন্ঠ চিনতে পারিনি, আর আপনার নামটাও চট করে মাথায় ক্লিক করেনি’

— ‘এপোলজি একসেপটেড’ তিয়ানা হাসলো।

— ‘মাই পেস্নজার’

— ‘আজকে বিকেলে ফ্রি আছেন?’

— ‘কেন বলুনতো?’

— ‘মিট করতে চাই’

অয়ন একটু ভড়কালো। অপ্রস্তুত গলায় বলে ফেলল,

— ‘কেন?’

— ‘আসলে আপনাকে না আমার খুব পছন্দ হয়েছে, আমি কিন্তু সোজাসাপ্টা কথা বলতে ভালোবাসি, প্লিজ অন্যভাবে নেবেন না, আমি… আমি কি আপনার বন্ধু হতে পারি?’

খাইছে! পিচ্চি কয় কী!! অয়ন ভ্রু কুঁচকালো। হতবাক গলায় বলল, ‘বন্ধু!!’

— ‘হ্যাঁ, বন্ধু।’

— ‘আপনার বয়স কত?’ চট করে প্রশ্নটা করে ফেলল অয়ন।

— ‘সুইট সিক্সটিন!’ দারুণ স্মার্ট উত্তর দিল তিয়ানা।

— ‘আর আমার কত জানো? ছাব্বিশ হলো এ বছর!’

— ‘তাতে কি? ইউ আর ইয়াং! আপনার বয়সী কত এডমায়ারার আছে আমার জানেন? বড্ড সেকেলে লোকদের মতো কথা বলছেন আপনি! একটা চান্স নিয়ে দেখুন না! গড প্রমিজ, বোর হবেন না আপনি

অয়ন হেঁসে ফেলল। নাহ, খারাপ লাগছেনা বাচ্চা মেয়েটার কথাগুলো শুনতে। বেশ তো, একটা চান্স নিয়ে দেখাই যাক না! কী আছে জীবনে!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *