খাঁচার ভিতর অচিন পাখি – ২৫

২৫

ট্রেনটা চট্টগ্রাম স্টেশনে এসে যখন থামল, বাইরে তখন রূপো রঙের দুপুর তেজী রোদ আর ধূলোমাখা বাতাস। স্টেশন জুড়ে মানুষের কোলাহল। কুলিদের ছুটোছুটি। বেঁচে থাকার তাগিদে দুরন্ত গতিতে ছুটছে এই পার্থিব জীবন! সারাটা পথ অয়ন আহিরের সাথে আর কোনো কথা বলেনি। আহিরও না।

দুজন দুজনের নিজস্ব চিন্তায় বুঁদ হয়েছিল। ট্রেন থেকে নামার পর আহির শুধু একবার বলল, ‘চললাম!’

— ‘তা চললেন কোথায়?’

—’দেখি!’

অয়ন চোখ কপালে তুলে বলল, ‘শুনুন, আপনি নিজেকে যতটা স্মার্ট মনে করেন, ততটা স্মার্ট আপনি নন, তাই বলছি, ফিরে যান। আহির কিন্তু এবার রাগলো না। দুর্বল গলায় বলল, ‘আসলে, আমি কটা দিন বাড়ির বাইরে থাকব’।

— ‘বেশ ভালো কথা, তা থেকে আসুন না কয়েকটা দিন আপনার কোনো রিলেটিভের বাড়িতে, খোলা রাস্তায় নেমে পড়লেন কী বুঝে?’

আহির একটু অপ্রস্তুত হলো – ‘আপনি… আপনিও তো নেমেছেন খোলা রাস্তায়’

— ‘ম্যাডাম!, আমার রাস্তায় ঘুরে ঘুরে অভ্যাস আছে,আপনার যে এক বিন্দুও অভ্যাস নেই, তা ট্রেনের ভেতরে যেভাবে আমার সাথে জোঁকের মতো লেগে ছিলেন তাতেই বুঝেছি, এখন প্ল্যানটা কী বলুনতো? আমার পিছু ছাড়ছেন নাকি ছাড়ছেন না?’

— ‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’

— ‘কক্সবাজার’

— ‘বাহ!’ নিজের অজান্তেই শব্দটা বেরিয়ে গেল আহিরের ঠোঁট দিয়ে।

— ‘খুব লোভ হচ্ছে বুঝি? জি না, আমি আপনাকে নিতে পারব না, আর তাছাড়া আমার কিছুর ঠিক নেই, আমি হয়তো চলতে চলতে রাস্তায় রাত পার করে দেবো, এমনকি ফুটপাতেও শুয়ে পড়তে পারি!’

— আমিতো একবারও বলিনি আমি আপনার সাথে যেতে চাই! নিজেকে যে কী ভাবেন আপনি! উফ!

আহির কথাটা শেষ করে পা বাড়ালো। ছেলেটা কী ভাবছে কে জানে। মান সম্মান বলতে কিছু আর রইল না তার। কোথাও না কোথাও একটা জায়গা হয়ে যাবে। এ পৃথিবীই তার আশ্রয়। সুবিশাল পৃথিবীর বুকে আহির কয়েকটা দিন নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াবে। সময় দেবে নিজের ভেতরের নিজেকে।

— ‘আহির দিলশাদ!’ পাগলটা ডাকছে। শুধু আহির না, আহির দিলশাদ। কেউ তাকে কখনো পুরো নাম ধরে ডাকেনা। একটু চমক লাগল আহিরের। ঘুরে দাঁড়ালো।

— ‘কী?’

—আমার এক কাজিনের বাসা আছে এখানে, আন্দরকিল্লায়, আপনি চাইলে ওখানে আপনার থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারি।’

— ‘হুম’

— ‘হুম মানে কী? কথা বলুন!’

— ‘ওকে’ বলে ভারী লজ্জা হলো আহিরের। ইশ! নিজেকেই নিজের কাছে বোঝা বলে মনে হচ্ছে।

আন্দরকিল্লা অয়নের কাজিনের বাসায় এসে দেখা গেল বাড়ি খালি। তারা ব্যাংকক গেছে। অয়ন এবার সত্যি ভীষণ বিরক্ত হলো, ‘ধ্যাত! শালারা আর ব্যাংকক যাওয়ার টাইম পাইলোনা।’

আহিরের মুখ খানা দুশ্চিন্তায় ছোট হয়ে গেল। টাকা পয়সা কিছু সাথে নেই, সব মিলিয়ে তিনশো টাকা ব্যাগে আছে। থাকার জায়গা নেই, কোনো গন্তব্য নেই, আহির যাবে কোথায়, থাকবে কোথায়? খাবে কী? এতটা অসহায় সে কেন হলো? বোকার মতো কিছু না বুঝে শুনেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে যে কী পাগলামোটা করলো সে! অয়ন আহিরের দিকে তাকিয়ে ছিল কুঞ্চিত ভ্রু,

তীক্ষ্ণ চোখ নিয়ে। আহির সেই দৃষ্টির সামনে আরো বেশি সংকুচিত হয়ে যাচ্ছিল। তার চোখ ফেটে জল গড়িয়ে আসছিল। অনেক কষ্টে সামলে নিল সে। অয়ন হঠাৎ সুর পাল্টে বলল, ‘যাই হোক, চলুন, কিছু খাওয়া যাক, পেটের ভেতর ছুঁচো দৌড়াচ্ছে।’

ওরা একটা রেস্তোরায় এসে বসলো। দুপুর বেলার প্রচন্ড ভিড়। একটা টেবিল খালি পাওয়া গেল। অয়ন অর্ডার দিল, ভাত, ডাল আর মুরগীর মাংস। আহির ওয়াশ রুমে এসে হাত মুখ ধুয়ে নিল। তার চোখে মুখে রাত জাগার ক্লান্তি। চুল হয়ে আছে ধুলো আর বাতাসের সংস্পর্শে আঠালো। এক বিচ্ছিরি অবস্থা। তবুও মনে হচ্ছে এই ধকলটার প্রয়োজন ছিল। এই যে এই সংকটময় মুহূর্তটা তো কিছুটা সময়ের জন্য হলেও ভুলতে সাহায্য করছে তার জীবনে মাত্র ঘটে যাওয়া বিশ্রী ঘটনাটাকে। এই বা কম কী?

আহির এসে দেখল খাবার চলে এসেছে। অয়ন গোগ্রাসে গিলছে। পাঞ্জাবির হাতা কুনুই পর্যন্ত গুটিয়ে নিয়ে বেশ আয়েশ করে খাচ্ছে। পুরুষ মানুষদের গপ গপ করে খেতে দেখলে আহিরের খুব বিশ্রী লাগে, সে তার বাবাইকেও বলে প্রায়ই কথাটা, ‘বাবাই, ধীরে ধীরে খাও, অত তাড়াহুড়োর কী আছে? কেমন রাক্ষসের মতো লাগছে!’ বাবাই হাসে, বলে, রাক্ষসের মতো না খেলে খাবার আনন্দ আছে নাকিরে? বাবাইয়ের কথা মনে পড়তেই বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠল, কী করছে এখন ওরা?কেমন আছে? অয়নও ঠিক রাক্ষসের মতোই খাচ্ছে। আহির মনের অজান্তেই বেশ গম্ভীর গলায় বলে ফেলল, ‘বাপরে বাপ!’ অয়ন খাওয়া থামিয়ে আহিরের দিকে নির্লিপ্তভাবে তাকালো একবার, কী হলো?’

— ‘নাহ কিছুনা!’

— ‘মনে হলো, বিদ্রূপ করলেন!’

— ‘না না, বিদ্রূপ করবো কেন?’

অয়ন আবার খাওয়া শুরু করল, ঝড়ের গতিতে। আহির নাক কুঁচকে তাকালো একবার অয়নের দিকে। অয়ন বলল, ‘খেয়ে নিন, খেয়ে নিন, আবার কখন খেতে পান ঠিক নেই, যাযাবর জীবনটা অত সহজ নয় খাবার দেখলে ফকিরের মতো গলা পর্যন্ত খেয়ে নিতে হয়, যাতে অনেকক্ষণ পর্যন্ত পেটে থাকে।’

আহিরেরও বেশ ক্ষিদে পেয়েছিল। তবুও অয়নের মতো গপগপ করে খেতে পারছিল না সে। একটু ভাত নিয়ে অনেকক্ষণ নাড়াচাড়া করছিল। রুচি নেই মুখে। অয়ন খুব মনোযোগ দিয়ে খাওয়া শেষ করল। তৃপ্তির সাথে একটা ঢেকুর তুলে বলল, ‘কী ঠিক করলেন?’

— ‘কী বিষয়ে?’

— ‘করবেনটা কী? ফিরে যাবেন নাকি আমার পিছে পিছেই ঘুরবেন’

— ভাবছি… এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেই নি

— ‘তাড়াতাড়ি ভাবুন, ঐ যে বললাম, যাযাবর জীবনটা অত সহজ নয়। আমি যাব কক্সবাজারের একটা দ্বীপে মহেশখালী, সেই দ্বীপে যেমন মানুষ আছে, সাপ খোপও আছে। জঙ্গলে শেয়াল আছে। খাওয়া দাওয়ার ঠিক থাকবেনা, রাতে থাকার জায়গা থাকবেনা। খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হতে পারে…’

— ‘আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?’

—ঠিক তা নয়, বাস্তব সম্পর্কে আইডিয়া দিচ্ছি, আর তার চেয়েও জরুরী কথা হলো আমি ভীষণ একা থাকতে পছন্দ করি, আসলে একা থাকার জন্যই বাড়ি থেকে এরকম হুট হাট বেরিয়ে পরা, আমি চাইনা কেউ আমার সাথে সারাক্ষণ জোঁকের মতো লেগে থাকুক, আর এবার আমার মনটা বিশেষ খারাপ, আমি হয়তো আর কোনদিনও বাড়ি ফিরবো না।’

শেষের কথাটা খুব লাগল আহিরের, বলল,

— ‘হ্যাঁ, আমার তো আর কাজ নেই আপনার সাথে জোঁকের মতো লেগে থাকব!’

— ‘আপাতত তো আপনার আর কোনো কাজ দেখছিনা আমি’, অয়ন বলল অকপট ভাবে।

আহিরের মুখ খানা বেলুনের মতো চুপসে গেল। ঠান্ডা ভাতগুলো নাড়তে নাড়তে ভাবতে লাগল সে। বাড়ি ফিরে যাবার পর আসলে কী ঘটনাটা ঘটতে পারে? বাবাই আর মা ভীষণভাবে ক্ষেপে আছেন তার ওপর। হয়ত আহিরকে ফিরে পেয়ে তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচবেন তবে সব কিছু কি ঠিক আগের মত হবে? আর তুষার? তুষারকে নিয়ে বাবা মায়ের আদিখ্যেতা কি কমবে? নাকি জোর করে তুষারের সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসানোর তোর জোড় শুরু করবে? সেই গদবাঁধা জীবনে ফিরে যাওয়া, পাওয়া না পাওয়ার হিসেব কষা। স্বপ্নগুলোকে চোখের সামনে মুখ থুবড়ে নিঃশেষ হতে দেখা! কিন্তু এর বাইরেই বা আছে কী? এই যে সুবিস্তৃত আকাশের নিচে হাজার হাজার মানুষের মিলেমিশে ঘুরপাক খাওয়া, হরেক রকম জীবিকায়, আশায়, মতলবে! কারণে অকারণে আমরণ ছুটে চলা! কোথাও প্রাণের তাগিদ নেই, কেবল প্রয়োজনের তাগিদ। কোথায় যাবে আহির? কী করবে? কোথায় গেলে একটু স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলবে সে?

আহির খেতে পারল না কিছুই ঠিক মতো। ঝুটা হাত নিয়েই বসে রইল বেশ খানিক্ষণ গুম হয়ে। অয়ন হঠাৎ ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠল, ‘মাই গড! আপনি আবার সুইসাইড করার কথা ভাবছেন না তো?’ আহির শুন্য দৃষ্টিতে অয়নের দিকে তাকালো, ‘আমার অত সাহস নেই’।

অয়ন আহিরের চোখ দুটোতে কী যেন খুঁজে নিয়ে বলে, ‘থাক, আপনাকে এখনই ফিরতে হবে না, থাকুন আমার সাথে, বাট বিরক্ত করবেন না একদম, অযথা কথা বলবেন না।’

২৬

অয়ন ভারি বাজে রকম একটা পরিস্থিতিতে পড়েছে। সে বুঝতে পারছেনা মেয়েটা আসলে কী চাইছে। বোঝা যাচ্ছে তার জীবনে এমন কিছু একটা ঘটেছে যা কিনা তাকে মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করে তুলেছে। কিন্তু এর দায় কেন অয়ন নেবে? এ কথা সত্য তার এই এতটুকু জীবনে যেখানে সুযোগ পেয়েছে সে অপরকে সাহায্য করেছে। অন্যকে সাহায্য করার একটা সহজাত প্রবৃত্তি তার ভেতরে আছে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। জাগতিক কোনো কিছুতেই তার আর মন বসছেনা। এ জীবনটা তার কাছে বোঝা হয়ে গেছে। যতক্ষণ আছে শুধু গাধার মতো টেনে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। এমন একটা সময়ে এ কেমন তর ঝামেলা তার কাঁধে এসে পড়ল? তার ওপর মেয়েটা তুষারের বান্ধবী। তুষার ছেলেটা এক কথায় চমৎকার। নম্র-ভদ্র, এ যুগে এরকম ছেলে পাওয়াই যায়না। মেয়েটার যদি কিছু হয়ে যায় সে তুষারকে কী জবাব দেবে?

ওরা একটা নন এসি বাসে উঠেছে। গন্তব্য কক্সবাজার। দুজন পাশাপাশি বসেনি। আহির সামনের দিক থেকে তিন নম্বর সিটে বসেছে আর অয়ন পেছন দিকের সিটে। দুপুর গড়িয়ে গেছে তখন। শেষ মাঘের মিষ্টি রোদ রাস্তা জুড়ে সোনালী পাটি বিছিয়েছে। ধুলো মাখা গাছের পাতায় হাওয়ার নাচন। পাশে এক বয়স্ক ভদ্রলোক বসেছেন। ভদ্রলোক মোবাইলে কথা বলায় বেজায় ব্যস্ত। বাসে ওঠার পর থেকেই তার মোবাইলে একটার পর একটা ফোন এসে যাচ্ছে। তিনি কথা বলে যাচ্ছেন। এই লোকের বকবকানির জ্বালায় অয়ন ঘুমাতে পারছেনা। সে ভেবেছিল বাসে উঠে একটা ঘুম দেবে। ঘুমোলে মাথার ভেতরে অনবরত কিলবিল করতে থাকা হরেক রকম দুশ্চিন্তার পোকাগুলোও ঘুমিয়ে পড়ে। তার নিজের চাইতেও ওদের ঘুমটা বেশি জরুরী। অয়ন জানালা দিয়ে মাথা বের করে রুক্ষ আকাশটাকে দেখছিল। পাশের লোকটা হঠাৎ অয়নকে কুনুই দিয়ে একটা গুঁতো দিয়ে বলল, ‘আপনাকে ডাকছে’ অয়ন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো আহির দাঁড়িয়ে আছে। চুল আলুথালু, ঠোঁট শুকনো।

— ‘একটু শুনুন!’

— ‘বলুন!’ অয়নের পাশেই বয়স্ক ভদ্রলোক বসা। আহিরের কথা বলতে হচ্ছে ওই লোককে ডিঙিয়ে। আর অয়ন সেখানে বসে থেকেই কথা শোনার জন্য কান পেতে দিয়েছে। আশ্চর্য ছেলে!

— ‘আহা, শুনুন না!’

–‘বলুন না!’

— এভাবে নয়, ইয়ে, একটু গোপন কথা’

অয়ন অবাক হলো। কী আবার অত গোপন কথা! মতলবটা কী মেয়েটার! সে পাশের লোকটার দিকে তাকিয়ে বেশ ইনোসেন্ট গলায় বলল, ‘আঙ্কেল! কাইন্ডলী আমার সিটে এসে বসবেন, জাস্ট কিছুক্ষণের জন্য’।

ভদ্রলোক কোনো বাক্যব্যয় না করে উঠে পড়লেন। অয়ন এ পাশের চেয়ারে এসে বসতেই আহির অয়নের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে মুখটা যতটা সম্ভব ওর কানের কাছে নিয়ে খুব আস্তে করে বলল, ‘শুনুন, বাসটা কি কোথাও থামাবে? আমার একটু ওয়াশরুমে যাওয়া দরকার’

অয়ন এহেন আশ্চর্য কথা যেন জীবনে শোনেনি। ঠোঁট দুটো হা হয়ে গেল তার, চক্ষু চড়কগাছ। ঠোঁট দুটো অনেক কষ্টে নেড়ে বলল, ‘আমি এখন ওয়াশরুম কোথায় পাব?’

— ‘ইশ! আস্তে বলুন না! লোকে শুনবে তো!’ অয়ন একবার ‘ও’ বলে আশেপাশে দেখে নিয়ে গলাটা খাদে নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘ওয়াশরুম কোথায় পাব?’

— ‘দেখুনতো ড্রাইভারকে বলে, আমার বাবাইয়ের সাথে লং জার্নিতে বের হলে, এসব কোনো সমস্যাই হয়না, বাবাই কী করে যেন ম্যানেজ করে ফেলেন।’

অয়ন ভারি বিরক্ত গলায় বলল, ‘আমি আপনার বাবা নই, আর আমি পারব না এসব করতে, আপনি ওয়েট করুন, খুব বেশিক্ষণ লাগবেনা, পৌঁছে যাবো’।

— ‘কতক্ষণ লাগবে?’

— ‘ঘন্টা দেড়েক’

আহির কিছু বলল না। নড়লও না জায়গাটা থেকে। অয়ন মিনিট দেড়েক পর বাধ্য হয়ে উঠে দাঁড়াল। কী বলল সামনে গিয়ে কে জানে একটা পেট্রোল পাম্পের সামনে বাস থামল। আহির নামল, সাথে অয়নও।

— ‘আগেও বলেছি, যাযাবর জীবনে অনেক সমস্যা, এইসব শৌখিন টয়লেট সমস্যা কাটিয়ে উঠুন, নইলে সারভাইভ করতে পারবেন না।’

— ‘দেখা যাবে, সারভাইভ করতে পারি কী পারিনা, সময়ই বলে দেবে, আপনি অত পক পক করছেন কেন?

— ‘পক পক করছি কারণ এটা একটা বিগ প্রবলেম, আপনি যেখানে সেখানে বলে বসবেন, ওয়াশরুম চাই, না আমি তো অল দা টাইম আপনাকে এইসব প্রোভাইড করতে পারব না! আহির একটু লাল হলো,

— ‘আপনি লোকটা কিন্তু ভারি অসভ্য!’

—আপনারা মেয়েরা ছেলেদের অসভ্য ডাকতে খুব ভালোবাসেন তাই না? একটা কৌতুক আছে না? এক মেয়ে তার বান্ধবীকে প্রশ্ন করল, এই ছেলেরা কী নিয়ে কথা বলেরে? বান্ধবী উত্তর দিল, কী নিয়ে আবার, আমরা যা নিয়ে কথা বলি, তাই নিয়ে, মেয়েটা আঁতকে উঠে বলে উঠল, ছি ছি! ছেলেরা কি অসভ্য!

আহির হেসে ফেলল। ঝিলিক মারল ওর গজদাঁত। অয়নের মনে হলো এই মেয়েকে সে এর আগে কখনো হাসতে দেখেনি। সে খুব সহজে মুগ্ধ হয়না। জন্মগত ভাবেই তার মুগ্ধ হবার ক্ষমতা কম। কিন্তু হাসলে মেয়েটাকে ভালো দেখায়। অয়ন তাকিয়ে ছিল। তার চোখে কিছু একটা ছিল, মুগ্ধতা না ভালো লাগা কে জানে!

২৭

সমুদ্র টানছিল। আহির সমুদ্র দেখেনা বহুদিন! উত্তাল সীমানাহীন সমুদ্রের বুকে স্পীডবোটটা সাঁই সাঁই করে ছুটে যাচ্ছিল, সূর্য ডুবতে বসেছে। লালিমায় ঘেরা আকাশের প্রতিচ্ছবি বিস্তৃত সমুদ্রে। বাতাস বন্য। আহির এক অদ্ভুত দুরন্ত ভালোলাগায় বুঁদ হয়ে ছিল। শুধু ছুটে চলার মাঝে এত তীব্র আনন্দ! এভাবেই, হ্যাঁ এভাবেই সে এক ছুটে পালিয়ে যেতে চাইছিল ওই জীবনটা থেকে। মনে হচ্ছে সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে সাথে, স্পীড বোটের ঝাঁকুনির সাথে, একটা একটা করে কষ্টগুলো খুলে খুলে পড়ে যাচ্ছে, মিশে যাচ্ছে নোনা জলে। আহ! জীবন এখানে বড় সুন্দর! যে জীবনে সে শুধু নিজের জন্যেই নিঃশ্বাস নেবে। নিজের কথাই ভাববে। প্রয়োজন নয়। জীবিকা নয়। স্বার্থ নয়। শুধু মনের দাবীতে এই বেঁচে থাকা।

এটা রাখাইন পল্লী। বড় ছিমছাম, সুন্দর আর সাধারণ। ছোট একটা গ্রাম কিন্তু তার মাঝে যে এত প্রাণের প্রাচুর্য। অয়ন বলেছিল কোথায় থাকবে, কী করে রাত কাটাবে, কী খাবে তার কোনো কিছুরই ঠিক নেই। সেই শর্তেই রাজি হয়েছিল আহির। কিন্তু এই পাহাড়িয়া দ্বীপে এসে, শহুরে যান্ত্রিকতা কে অনেক দূরে ফেলে এসেও মাথার ওপর একটা ছাদ পেয়েছে সে। একটা টিনের চালার ঘর, পাহাড়ের গা ঘেঁষে। একটি ছোট পরিবার। বাবা মা এবং এক মাত্র মেয়ে নূড়ি। মেয়েটি দুর্দান্ত রূপবতী। পাতলা ছিপছিপে দেহ, কাঁচা হলুদ গায়ের রং, লম্বা রেশমী চুল। লম্বাটে মুখে নাক, চোখ খুঁতনি সব যেন তুলি দিয়ে আঁকা। নাকটা একটু ছোট, পাহাড়ীদের যেমন হয় আর কী! কোনো প্রসাধন নয়, সাজ পোশাকের আড়ম্বর নয়, শুধু একটা লুঙ্গি আর টপ পরে আছে তবুও কী অপূর্ব লাগছে! অয়নকে কী করে যেন এরা চেনে। আহিরকে নিয়ে যখন এখানে আসলো মেয়েটা ভারি অবাক হয়ে বলল, ‘বাবু বিয়ে করলেন নাকি?

অয়ন চমকে ওঠা গলায় বলল, ‘না! না!… উনি, উনি এই গ্রামে একটা কাজে এসেছেন, একটা দুটা দিন থাকবেন এখানে, তোমাদের জায়গা হবে?’ সুন্দর করে গুছিয়ে বলল অয়ন। বিশাসযোগ্য মনে হলো।

— ‘হ্যাঁ, তা হবে’

আহির চোখ ঘুরিয়ে দেখলো, জায়গা আর তেমন কী। ছোট দুটা ঘর। একটায় চকি বিছানো, অন্যটায় মাদুর। দারিদ্রতার ছাপ ষোলো আনা স্পষ্ট। বাইরে বাঁশ দিয়ে তৈরী করা একটা বারান্দা আছে কিন্তু ওটাতে তাঁতের তৈরী বস্ত্র আর উলের শীতকালীন পোশাক দিয়ে বোঝাই। এটাই বোধহয় ওদের জীবিকা নির্বাহের উপায়। কুপি বাতি জ্বলছে। সারা ঘরে একটা ধুপজ্বালা গন্ধ। কত অপ্রশস্ত, অনাড়ম্বর অথচ কত মনোরম!

আহির গোসল সেরে কাপড় পাল্টে নিল। একটা সুতির সালোয়ার কামিজ। গায়ে জড়ালো মায়ের মোটা উলের শালটা। শহরে শীত প্রায় পালাতে বসেছে। কিন্তু এখানে টের পাওয়া যাচ্ছে মাঘ মাসের প্রকোপ। অয়ন আহিরকে রেখে সেই তখন যে পালালো আর দেখা নেই। ছেলেটা বড় অদ্ভূত! মাটির চুলায় ভাত চড়ানো হয়েছে। সবজি রাঁধার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। বাড়ির পুরুষ সদস্যটি নিতান্তই অলস প্রকৃতির। সন্ধ্যে থেকে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। আহির মাদুরের ওপর বসে ওদের কাজ দেখছিল। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল কে জানে। দু চোখের পাতা জুড়ে রাজ্যের ঘুম চেপে বসলো। ঘুম ভাঙ্গলো রাখাইন মেয়েটির ডাকে, ‘দিদি, খেতে আসেন’। আহির হকচকিয়ে উঠল। উঠার পর একটু সময় লাগল সব কিছু মনে পড়তে। যখন মনে পড়ল, তখন না চাইতেও ভাবনাটা মাথায় এসে গেল, বলল, ‘উনি? উনি কোথায়?’

— ‘দাদার কথা বলছেন? ওনার কোনো ঠিক নেই। রাতে ফিরতে পারেন, নাও ফিরতে পারেন, কিন্তু আমি জানি, উনি কোথায় আছে’।

মেয়েটা রহস্যময় হাসে। আহির সন্দেহের গলায় প্রশ্ন করে?’ কোথায় আছেন?’

— ‘পাহাড়ের ওপরে, মন্দিরের পাশে’

— ‘কী করে জানলে?’

— ‘উনি যতবার আসেন, সেই জায়গাটায় বসেই রাত কাটান, কেমন যেন অদ্ভুত মানুষ, কোনো ভয় ডর নেই। ‘

— ‘তা, উনি কি প্রায়ই আসেন এদিকটায়?’

— ‘এর আগে আরো তিনবার এসেছেন, প্রথমবার আসলেন ওনার এক বন্ধুর সাথে, ওনার বন্ধুর সাথে আমাদের বিজিনেস ডিল ছিল, এখান থেকে তাঁতের জিনিস লটে নিয়ে যেতেন তিনি।’

— ‘ওহ, তাই বল’

— ‘আপনি যাবেন?’

— ‘কোথায়?’

— ‘পাহাড়ের ওপর?

আহির না করতে পারল না, ‘হ্যাঁ যাব, তুমি নিয়ে যাবে আমায়?’ মেয়েটা মিষ্টি হাসলো, ‘খেয়ে নিন, তারপর নিয়ে যাচ্ছি’।

পাহাড়টির নাম মৈনাক পাহাড়। কুয়াশায় সাদাটে ভূত হয়ে আছে চারপাশ। এর চুড়োয় আদিনাথ মন্দির। পাহাড়ের গা কেটে সাপের মতো হয়ে ওপরে উঠে গেছে সিঁড়ি। এক পাশে কাটা আধখানা পাহাড়ের মাটির শরীর। অন্যপাশে বন্য ঝোপ। ঝোপ জঙ্গলে ভরা পথটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে অনেক নিচ পর্যন্ত। নদীর কাছাকাছি।

অন্ধকারের একটা নিজস্ব ভাষা আছে, আলো আছে। সেই আলোয় পথ চেয়ে চেয়ে ওরা উপরে উঠছিল। কোথাও কোনো শব্দ নেই, শুধু অবিরাম ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর পাতায় পাতায় টুপ টুপ করে শিশির ঝরার ফিসফিসানি বাতাসে উড়ছে হিম। হাড় কাঁপানো শীত। আহিরের মনে হলো জোনাকী থাকলেই ষোলো কলা পূর্ণ হতো, কিন্তু শীতকালে যে জোনাকী জ্বলেনা। আরো খানিকটা ওঠার পর মন্দিরের ঘরটা উঁকি দিল। এই রাত্তির বেলায়ও স্থানীয় লোকজন মন্দিরে ঘুরঘুর করছে। কেউ পূজো করছে, বাইরে বসে গান করছে। শ্বেতপাথরে বাঁধানো পরিচ্ছন্ন সিঁড়ি। আহিররা ওদিকে গেল না। মন্দিরটা ফেলে একটা সরু রাস্তা ধরে এগোলো ওরা। পাহাড়ের ওপরে একটি সোনালি মাথার গম্বুজ। তার চারিপাশে চারটি সিংহমূর্তি রাজকীয় ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারেও তাদের গাম্ভীর্য টের পাওয়া যায়। আহিরের ঠিক সেই সময় হঠাৎ চোখ পড়ল, ওমা একি! আকাশ ভরা তারা!! এত তারার মেলা সে জীবনে কোনো দিন দেখেনি। মনে হচ্ছে পুরো আকাশটা ভেসে যাচ্ছে নীলচে আলোর ঝলকানিতে!

২৮

“আর কি হবে এমন জনম, লুটবি মজা মনের মতন
বাবার হোটেল ভাঙবে যখন, খাবি তখন কার বা শালে।”

অয়ন গুন গুন করছিল শিশির ভেজা ঘাসের ওপর বসে। গায়ে একটা লেদারের জ্যাকেট পরা আছে। তবুও হিম হাওয়া শরীরে ঢুকে পড়ে কামড় বসাচ্ছে। বাবার হোটেল ভাঙবে যখন, খাবি তখন কার বা শালে…. বাবার হোটেল ভেঙে গেছে, সে এখন কার শালে খাবে এটি একটি গভীর চিন্তাযুক্ত ব্যাপার। বেঁচে থাকলে পেট পূজো করতেই হবে। না খেয়ে থাকার চাইতে আত্মহত্যা করে মরে যাওয়া ভালো। এই মুহূর্তে যদি অয়ন এই পাহাড়ের ওপর থেকে লাফ দেয় তাহলেই ল্যাঠা চুকে যায়। এপার আর ওপারের মাঝে জীবন মরণের তফাৎ। কিন্তু এই তফাৎটা অতিক্রম করতে কয়েক সেকেন্ডও লাগেনা। জন্ম আর মৃত্যুর মাঝখানে হরেক রকম ভান ভণিতার রঙে মোড়ানো এই ঠুনকো জীবন। কোনো মানে নেই এ জীবনের। আজ যদি সে স্মৃতি ভ্রষ্ট হয়, তাহলে কী করে জানবে যে সে কে, কার ছেলে, কী বা তার পরিচয়?

তবে এ পৃথিবী তার বড় প্রিয়। মানুষগুলোর সাথে আজও তার বন্ধন মজবুত হলোনা, কিন্তু এই তারা ভরা আকাশ, বন্য পাহাড়ি গন্ধ, দূরদূরান্ত অবধি বিস্তৃত হয়ে পড়ে থাকা লোনা জলের সমুদ্র, আঁকা বাঁকা বয়ে যাওয়া নদী, ডানা ঝাপটানো গাংচিলের শব্দ! রাতের গায়ে টুপ টুপ করে পড়া শিশিরের অস্তিত্ব, ভর দুপুরের মিষ্টি রোদে পাতি চড়ুইয়ের ঝগড়া, এই সবকিছুর সাথে যে তার আত্মার বন্ধন, জন্ম জন্মান্তরের বন্ধন! এই বন্ধন ছিন্ন করার সাহস যে এখনো হয়নি!

ঘাসের ওপর কারো পায়ের চলার শব্দ শোনা গেল। এদিকটায় খুব একটা কেউ আসেনা। রাখাইন মরদরা জঙ্গলের ভেতর গিয়ে শীতের রাতে আগুন জ্বালিয়ে মদ খায়। গান ধরে, মাদল বাজায়। এইপাশটা নিরিবিলি বলে অয়নের বেশ পছন্দ।

— ‘কী করছেন?’ আহির প্রশ্নটা করতে করতে ঘাসের ওপর অয়নের পাশে বসলো। কথাগুলো নিঃশব্দ বনস্থলীতে পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে যেন প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ক্রমাগত ডাক ছাড়া চারপাশে আর কোনো শব্দ নেই তখন।

— ‘এইতো, কিছুনা’

— ‘দুঃখিত, কথা দিয়েছিলাম আপনাকে বিরক্ত করব না, তবুও চলে আসলাম বিরক্ত করার জন্য।

অয়ন একটু ফ্যাকাসে হাসলো, ‘কিন্তু জানলেন কী করে আমি এখানে আছি?’

— ‘ঐ যে, মেয়েটা নিয়ে এলো, নুড়ি নাম’

— ‘ও’ এটুকু বলেই অয়ন চুপ হয়ে ঝিম মেরে গেল। এখন ভাঙা চাঁদ উঁকি দিচ্ছে।

একটা পাতলা নীলচে আলো আকাশ থেকে নেমে এসে কুয়াশার সাথে মিশে গেছে। রাত তেমন গভীর নয়, তবুও পাহাড়ের বুক চিরে রাত্রির গভীর নিঃশ্বাস। আহির শাল মাথায় তুলে দিয়ে কান ঢেকে আপ্লুত কন্ঠে বলল, ‘এত তারা একসাথে আমি কোনো দিনও দেখিনি জানেন?

—হুম

— ‘আপনাকে একটি ধন্যবাদ দিতে চাই, নেবেন?’ অয়ন চোখ তুলে তাকালো আহিরের দিকে। এই প্রথম কেউ তার কাছ থেকে ধন্যবাদ দেবার জন্য অনুমতি চাইলো। ব্যাপারটা দারুণ তো! এভাবে আগে কখনো ভাবা হয়নি। আমরা কেন ধন্যবাদের বোঝাটা সর্বদা অপর লোকে না চাইলেও ঘাড়ে চাপিয়ে দেই?

— ‘যদি না নেই?’

— দেব না’

অয়ন হাসলো, ‘এখন নয়, পরে কোনো এক সময় দিয়েন। এই মুহূর্তে ধন্যবাদটি রাখার কোনো জায়গা নেই। কিছু ধন্যবাদ ডিলিট করে একটু স্পেস খালি হলে পরে আপনার ধন্যবাদটি নেব।’

— ‘ফান করছেন?’

— ‘বাহ, আপনি ধন্যবাদ দেবার জন্য পারমিশন চাইতে পারবেন, আর আমি একটু ফান করতে পারব না, তা কি হয়?’

— ‘না ব্যাপারটা আসলে একটু অন্যরকম, আপনি মানুষটা তো অদ্ভুত। তাই ভাবলাম না বলে কয়ে একটা ধন্যবাদ দিয়ে দেবার পর যদি আপনি আবার বিরক্ত হয়ে যান, ফিরিয়ে দেন বা বেঁকে বসেন, তখন আমিই ইনসাল্ট ফিল করব। তাই অনুমতি চাইলাম।’

ওপাশের জঙ্গলে, যেদিকটায় মাটি উত্রাই হয়ে নেমে গেছে বাঁকখালী নদীর কাছাকাছি, সেইদিকটায় কিছু একটা সরে যাওয়ার আওয়াজ হলো। শুকনো পাতা মড় মড়িয়ে উঠল। আহির চকিতে তাকালো। এখন কেউ নেই। অন্ধকারে সাদা কুয়াশার ভেতর শুধু গাছের ডাল নড়ছে।

— ‘মেয়েটা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল।’

— ‘কোন মেয়ে?’

— ‘নুড়ি’

— ‘ওহ!’

— ‘খুব সম্ভবত সে আমাদের কথা শোনার চেষ্টা করছিল। আমার সাথে আপনার সম্পর্ক নিয়ে তার মনে একটি ক্ষীণ সন্দেহ দেখা দিয়েছে’

অয়ন হাসলো। আহির অন্ধকারে না দেখেও সে হাসিটা কী করে যেন টের পেল।

— ‘মেয়েটা দেখতে কিন্তু দারুণ! এত সুন্দর মেয়ে আমি কদাচিৎ দেখেছি’

— ‘তাই নাকি?’

— ‘হ্যাঁ তাই তো! কেন আপনার মনে হয়নি?’

— ‘আসলে ওভাবে নোটিস করিনি কখনো। আর যেহেতু নজরে আসেনি তার মানে সৌন্দর্যটা তেমন নজর কাড়া নয়’

— ‘কী যে বলেন? এতো স্নিগ্ধ একটা রূপ আপনার নজর কাড়লোনা? আপনার কি মন বলে কিছু নেই?’

— ‘There is no exquisite beauty… without some strangeness in the proportion…’

— ‘কী যে বলেন, আবোল তাবোল, বুঝিনা, সে যাই হোক, আপনি সারাক্ষণ অত কী ভাবেন বলুন তো?’

অয়ন হাসে, গুনগুন করে-

“ভবরঙ্গে থাকি মজে, ভাব দাঁড়ায় না হৃদয় মাঝে।
গুরুর দয়া হবে কিসে, দেখি ভক্তিবিহীন পশুর ছন্দ।
মনের হলো মতিমন্দ…
তাইতে হয়ে রইলাম আমি জন্ম- অন্ধ”

— ‘আপনি রহস্য করতে খুব ভালোবাসেন তাইনা?’

— ‘চারপাশে এত এত রহস্য, নতুন করে আর কী রহস্য করব বলুন? এই যে এই জায়গাটায় এর আগে কত রাত কাটিয়েছি একদম একা, শুধু ভাবনার ভেতর ভাবনা মিশিয়ে দিয়ে, অথচ আজকে আপনি আমার পাশে, অন্য কেউ নয়, চেনা কেউ নয়, কোনো বন্ধু নয়, আত্মীয় নয়, আপনি, যেই আপনাকে আমি কোনদিনই চিনতাম না… যেই আপনি আমার পাড়ার ছোট ভাইয়ের বান্ধবী, আপনার সাথে কি আমার এইখানটায় দেখা হওয়ার কথা ছিল কখনো? এটাও কি একটা রহস্য নয়?’

— ‘আত্মার সাথে আত্মার যোগ ঘটলেই তো আত্মীয়, তাইনা? সে অর্থে কে কখন কার আত্মীয় হয়ে যায় তার তো কোনো ঠিক নেই’

— ‘এটা ভালো বলেছেন, তবে তা বড় কঠিন ব্যাপার।

আহির হঠাৎ অন্য রকম গলায় বলে, ‘জানেন, এ জায়গাটা না ভারি মায়াবী, কেমন স্বর্গের মতো লাগছে, ভালো কিছু দেখলে, ভালো কিছুর সংস্পর্শে আসলেই আপনজনের কথা মনে পড়ে, বাবাই আর মায়ের ওপর রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, অথচ এই মুহূর্তে ওদের ভীষণভাবে মিস করছি, মিস করছি আমার ছোট ভাইটিকেও।’

— ‘তাই?’

— ‘হ্যা, আপনারও কি এমন হয়?’

অয়ন একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আমার জীবনটা আসলে ঠিক আর দশজনের মতো স্বাভাবিক নয়, আমি মানুষটাও স্বাভাবিক নই’

— ‘ওটা আপনার স্টাইল, খুব স্বাভাবিক আছেন আপনি, নিজেকে অস্বাভাবিক ভাবতে ভালোবাসেন শুধু’।

অয়ন চমকে তাকালো আহিরের দিকে। কেউ কখনো এভাবে বলেনি তো! অন্ধকার কুয়াশায় আহিরকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কী ভাবছে, কী দেখছে তার কিছুই বোঝা যায়না। অয়ন সেই ঝাপসা আহিরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কথাটা আপনি খারাপ বলেননি, তবে হান্ড্রেড পার্সেন্ট সত্য নয়। আসলে এভাবে থাকতে থাকতে এই জীবনটায় অভ্যস্থ হয়ে গেছি, অন্য কিছু আমার ধাতে আসেনা’

— ‘আপনি আপনার বাবাকে মিস করেন, তাই না?’ কথাটা বলেই আহির বাতাস গিলল, এই যা, প্রশ্নটা একটু ব্যক্তিগত হয়ে গেল।

অয়ন বিস্মিত গলায় বলল, ‘আপনি কী করে জানলেন?

— ‘তুষার বলেছে, আপনার বাবা নেই, হারিয়েছেন ছোট বেলায়’

— ‘না, কথাটা ভুল, হারিয়েছি ঠিক, কিন্তু ছোটবেলায় নয়, একদিন আগে ত ‘কী বলছেন? আমি শুনেছি আপনার বাবা মারা গেছেন বহু বছর আগে’

— ‘লোকে তাই জানে, এটাই জানানো হয়েছে তাদের’

আহির বাতাসে রহস্যের গন্ধ পায়, উদ্বেগ নিয়ে বলে, ‘কিন্তু কেন?

অয়ন কী যেন গভীরভাবে চিন্তা করে। তারপর চোখ নিচের দিকে নামিয়ে বলে ‘আমার বাবা পাগল’

— ‘মানে?’

— ‘হুম, পাগল, বদ্ধ উন্মাদ, গেল শুক্রবারে শেকল খুলে ফেলে কী করে যেন পালিয়ে গেল, কোথায় গেল কে জানে! সম্পূর্ণ নিখোঁজ।’

— ‘ওহ! সরি!’

—না সরি হবার কিছুই নেই, আসলে এই কথাটা আমি আজ অবধি কাউকে কখনো বলিনি, কিন্তু আজকে এই খোলা আকাশের নিচে বসে, প্রকৃতির এত কাছাকাছি এসে, এত বিশুদ্ধতায় ডুবে গিয়ে, আপনি যখন প্রশ্নটা করলেন, কেন যেন না বলে থাকতে পারলাম না’

আহির স্তিমিত গলায় বলল, এতটা খারাপ অবস্থা হলো কী করে? ট্রিটমেন্ট চলছেনা?’

—প্রথম দু বছর ট্রিটমেন্ট কাজে এসেছে। আমার জানা মতে সে ক্ষেত্রে কোনো কমতি ছিল না। কিন্তু দু বছর পর ডাক্তার বলে দিলেন আর আশা নেই। মেন্টাল হসপিটালে রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমি রাজি হইনি। বাসায় একজন ডাক্তার নিয়ম করে আসতেন। শেষ দিকে, তিনিও আসা বন্ধ করে দিলেন।’

— খোঁজ লাগান, অসুস্থ মানুষ কোথায় আর যাবেন? ঠিক খুঁজে পাবেন দেখবেন?

— ‘আমার মন মাঝে মাঝে আমাকে কিছু সিগন্যাল দেয়, আমি সিগন্যাল পাচ্ছি, বাবা আর ফিরবেন না’ অয়নের গলাটা এই প্রথম একটু ভারী শোনালো আহিরের কাছে।

আহির কী বলবে খুঁজে পেল না। কারো বাবা বেঁচে থেকেও হারিয়ে গেলে, না থাকলে কেমন লাগে তা তার জানা নেই। তার বাবাই আছে, মা আছে এরপরেও তাদের ফেলে আহির এত দূরে না বলে কয়ে চলে আসল। তারা শুধু তাদের মেয়ের একটি সুনিশ্চিন্ত ভবিষ্যত চাইছিল এটাই কি তাদের দোষ? বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল আহিরের। কিন্তু একটা দুশ্চরিত্র, লম্পট লোকের সাথে আহির যে কোনো দিনও ভালো থাকবেনা, যে ছেলে প্রথম জীবনেই এত বড় একটা ধোঁকা দিয়ে ফেলল সে সারাটা জীবন কী করে সুফী হয়ে থাকবে বাবা মায়ের মনে এই প্রশ্নটা কেন একটিবারের জন্যও উঁকি দিল না? তুষার যে আহিরকে কত বড় সর একটা ধোঁকা দিল, বিশ্বাস নিয়ে খেলল, এই অপরাধের কি কোনো শাস্তি হবেনা?

আহির হতবিহবল হয়ে প্রশ্ন করে, ‘আর মা? আপনার মা কোথায়? মাকে ফেলে চলে আসলেন যে? বলে এসেছেন?’

অয়ন কাঠ কাঠ গলায় বলল, ‘আমার কোনো মা নেই’

— ‘সে কী! আমি তো শুনেছি আপনার মা ভীষণ ক্ষমতাধর মহিলা, আর হ্যাঁ, আমি যতদূও জানি আপনার মায়ের অফিসেই ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম, যেখান থেকে আপনি তাড়িয়ে দিলেন, মনে আছে?’

— ‘হ্যাঁ মনে আছে’

— ‘সে মহিলা তবে কে হন আপনার?’

অয়ন মুচকি হাসে, বরফ শীতল গলায় বলে, ‘কেউ না! পেটে ধরলেই কি মা হওয়া যায়?’

— ‘কী বলছেন অয়ন? কী বলছেন আপনি?’ আহির বিস্মিত

—কি বলছি?’

— ‘যে মানুষটা আপনাকে দশ মাস পেটে ধরে এই পৃথিবীর আলো দেখালেন! সেই মানুষটা আপনার কেউ হয়না? কী করে বললেন এ কথাটা? অন্যায়, এ ভারি অন্যায়!’

— ‘পৃথিবীর আলো দেখানোই যদি সবটা হয়, তবে আলোটা চোখে প্রবেশ করার সাথে সাথে গলা টিপে মেরে ফেলল না কেন?’

— ‘আপনি ভুল করছেন।’

— ‘আপনি সবটা জানেন না

— ‘জেনে থাকলেও আমি এই কথাটিই বলব, আপনি ভুল করছেন। নিজের মা কে নিয়ে কেউ এমন কথা বলে?’

— ‘ওই মানুষটা ঠান্ডা মাথায় আমার বাবাকে খুন করেছে। বাবার এই অবস্থার পেছনে শুধু ওই একটা মানুষই দায়ী।’

— ‘আপনার বাবা বেঁচে আছেন অয়ন, তাকে খুন করা হয়নি’

অয়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার ভেতর একটা কেমন ঘোর কাজ করছে। চিরকাল সে ঘন্টার পর ঘন্টা নিজের মনের সাথে কথা বলে। সে নিজেই তার নিজের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। অন্য কারো সামনে সে এতটা ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে মুখ খোলেনা কখনো। আজকে কী হলো? সামনে বসা মানবীটি কি তার মনেরই প্রতিচ্ছবি? এই অনুভূতি তার জীবনে প্রথম। মনে হচ্ছে ভেতর থেকে তার নিজেরই একটি অংশ বুঝি বের হয়ে সামনে বসে আছে। সেই অংশের সাথে অনায়াসে সব কথা বলা যায়।

— ‘ছোটবেলায় মাকে জড়িয়ে ধরে না ঘুমোলে আমার ঘুম হত না রাতে। কিন্তু মা শুধু ওই রাতের বেলার সময়টুকুতেই আমার ছিল। বাকি সময়গুলো মা ছিল বাইরের জগতের জন্য বরাদ্দ। উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা দাদাভাইয়ের রাজপ্রাসাদ তুল্য বাড়িটার মালিক হয়েছিলাম। সুবিশাল বাড়িটির কারণেই আমরা ছোট বেলা থেকে নিজেদের বড়লোক বলে জানতাম। দাদিমা তখন ফুপুর সাথে অস্ট্রেলিয়ায় থাকতেন। রোজ খাবার টেবিলে আমরা শুধু দুটা মানুষ খেতে বসতাম, আমি আর আমার বাবা। আমার ছোট বোনটির তখন বছর তিনেক বয়স। সে বেশ সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়ে। তাকে খাওয়ানোর দায়িত্বটিও ছিল আমার বাবার। মা নামক মানুষটা বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা কী বারোটা বেজে যেত। তিনি তখন চাকরি করতেন একটি প্রাইভেট ফার্মে। এত রাত অবধি তার কী কাজ থাকত তা আমার বাবা কখনো জানতে চেয়েছিলেন কিনা আমি জানিনা। ছুটির দিনগুলোও তার কাজকর্ম আর অফিসিয়াল মিটিং দখল করে রাখত। আমার মনে পড়েনা মায়ের হাতের বানানো কোনো চমৎকার খাবারের কথা কিংবা কোনো একটা স্মৃতিময় দিন, যখন সারাটাদিন আমি আমার মায়ের কোল দখল করে ছিলাম।

বলতে কী আমার বাবা মানুষটা একটু বোকা সোকা ছিলেন। নানাজান হয়তো দাদাভাইয়ের এককালের প্রভাব প্রতিপত্তি দেখেই আমার মাকে বিয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু পরবর্তিতে সে প্রতিপত্তি আর কোনো কাজে আসেনি। বাবার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কম ছিল। দু একবার ব্যবসা করতে গিয়ে ধরা খেলেন। এত বড় ফ্যামিলির ছেলে হয়ে যেখানে সেখানে চাকরি করার মানসিকতাও হয়ে উঠল না। সারাদিন ঘরে বসা। কিন্তু এর বাইরে আমার বাবা মানুষটি ছিলেন চমৎকার। পুঁথিগত বিদ্যা না থাকলেও তার জ্ঞানের ভান্ডার ছিল সমৃদ্ধ। তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন এ জগতে সবচাইতে বেশি দাম হলো একজন ভালো মানুষের, একটা ভালো মনের আর একটি প্রাণখোলা হাসির। তিনিই প্রথম শিখিয়েছিলেন আশেপাশের মানুষগুলোর বাইরেও বিশেষ কিছু আপনজন আমাদের সর্বক্ষণ ঘিরে রেখেছেন, যেমন: লালন সাঁই, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ।’

অয়ন অনেকগুলো কথা একসাথে বলে থামল। অন্ধকারে কথা বলার একটু সুবিধা আছে। অপর জনের মুখ দেখা যায়না, মুখের অভিব্যক্তি বোঝা যায়না। অনায়াসে সব কথা বলা যায়। আহির নিশ্চুপ হয়ে শুনছিল। কটা বাজে কে জানে। ঘড়ি নেই ওদের কাছে। আধুনিক যান্ত্রিক বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ দূরে ওরা এখন। একটা তিতির ডাকছিল আশেপাশের কোনো একটা ঝোপ থেকে।

— ‘তারপর?’ আহির বলল হালকা ভাবে।

— ‘ধীরে ধীরে বাবাই আমার সবটা হয়ে গেল, বাবা, মা, বন্ধু, সব! আমরা দু ভাইবোন বলতে গেলে বাবার কাছেই বেড়ে উঠেছি। মা শুধু রোজ সকালে স্কুলে যাবার সময় বেশ কিছু উপদেশ দেয়া ছাড়া আর কোনো ধরনের দায়িত্ব পালন করার প্রয়োজন বোধ করতেন না। আমার এ নিয়ে কোনো আফসোস ছিল না। বরং স্কুলে একটু উঁচু ক্লাসে ওঠার আগ পর্যন্ত আমার ধারনা ছিল বুঝি এটাই নিয়ম, বাবারা ঘরে থাকবে, ঘরের কাজ করবে আর মায়েরা বাইরে। কিন্তু একটু বড় হবার পরেই ভুলটা ভাঙ্গতে লাগল। একটু একটু করে আমি বুঝতে শিখলাম আমাদের পরিবারটা আসলে ঠিক আর দশটা পরিবারের মত নয়। মায়ের চাকরিতে তখন উন্নতি হচ্ছে। আমরা দু ভাইবোন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়া শুরু করেছি, ভালো খেতে শুরু করেছি, ভালো পরছি, বাজারের সবচেয়ে দামী খেলনাটা আমাদের বাড়িতে আসছে। উইকেন্ডে দামী রেঁস্তোরায় ডিনার করছি। কিন্তু মায়ের বাইরের জগৎটা দিনকে দিন আমার চক্ষুশূল হয়ে উঠতে লাগল। বাবার কোনো বিকার ছিল না। একদিন আর না পেরে বাবাকে বলেই ফেললাম, তুমি কেমন মানুষ, তোমার বউ সারাদিন বাইরে থাকে আর তুমি ঘরে বসে ডিম পারো, নিজে কিছু করলেও তো পারো। বাবার মুখটা সেদিন দেখার মতো হয়েছিল। আমার কাছ থেকে এ ধরনের কথা শুনবেন এটা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। বাবা কিছু বললেন না। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম আমার ওই কথাটা বাবাকে সেদিন থেকে ভেতরে ভেতরে কুরে কুরে খেতে লাগল।

ঘটনাগুলো ঘটলো খুব দ্রুত। মা চাকরী ছেড়ে ব্যবসা ধরলেন। যেখানে হাত দিচ্ছেন সোনা ফলাচ্ছেন। মায়ের কৃতিত্বে সবাই গর্বিত। গর্বে আটখানা হয়ে আমার দাদীমা দেশে ফিরে আসলেন। সব কিছু ভালোই চলছিল। কিন্তু কেউ জানলোনা, কেউ দেখলোনা মা যতবেশি বাইরের পৃথিবীর হতে লাগল, বাইরের লোকের সাথে যতটা তার সংযোগ বাড়তে থাকল, আমার সাথে তার দূরত্বটাও ততটাই মজবুত হতে থাকল। একদিন এক কান্ড ঘটলো। আমার তখন এ লেভেল এক্সাম চলছে। বিদেশ থেকে মায়ের বায়ার এসেছে। সেই দুপুরে আমাদের বাড়িতে তাদের নেমন্তন্ন। দুজন বিদেশী ভদ্রলোক এবং একজন বাংলাদেশী। বাংলাদেশী ভদ্রলোক বেশ নামকরা। টিভিতে প্রায়ই তাকে বিভিন্ন টকশোতে দেখা যায়। তা যা হবার ছিল তাই হলো, অতিথিরা বাড়িতে এসেই বাড়ির কর্তাটির খোঁজ করলেন। আমি আর বাবা একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিলাম। মা তার জীবনের সব চাইতে নিষ্ঠুরতম কাজটা বোধহয় সেদিন করলেন। মুখের ওপর বলে বসলেন, ‘তিনি নেই’। বাংলাদেশী ভদ্রলোক মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দ করে বললেন, ‘ওহ! সরি, সরি!’

বাবা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। সেই প্রথম বাবার মুখে আমি অপমানের রেখা দেখতে পেলাম। এত বড় একটা বয়স্ক লোক আমার চোখের সামনে শিশুর মতো লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন। আমার শিরা উপশিরায় সেই পাগলাটে শুয়োপোকার কামড়টা সেই প্রথম উপলব্ধি করলাম। রাগে আমার গা জ্বলতে থাকল। অতিথিরা চলে গেলে সরাসরি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, ‘তুমি মিথ্যে বললে কেন?’ আমার চোখে চোখ না রেখে বলল, ‘প্রয়োজন ছিল’ আমি দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললাম, ‘কী প্রয়োজন শুনি?’ সে চিৎকার করে বলে উঠল,

— ‘তোমাকে বলতে বাধ্য নই আমি!’ আমার সামনে একটা জার্মান কাচের দামী ফুলদানী সাজানো ছিল। প্রচন্ড রাগে আমি সেই ফুলদানিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিলাম। টের পেলাম আমার ভেতরে একটা বন্য আক্রোশ তিলে তিলে জমা হয়ে মহীরুহর আকার ধারণ করেছে। এবারে ধ্বংস অনিবার্য। বেরিয়ে গেলাম বাড়ি ছেড়ে। সেই প্রথম বারের মতো। তিন চারদিন এখানে সেখানে ঘুরে যখন বাড়ি ফিরলাম, তখন আর বাবাকে আগের মতো পেলাম না। বাবা কেমন আবোল তাবোল হয়ে গেছেন। সারা বাড়ি একা একা ঘুরে বেড়ান। নিজের মনে কথা বলেন। হঠাৎ হঠাৎ ভয়ে চিৎকার করে উঠে সারা বাড়ি মাথায় তোলেন। বছর দুয়েক এভাবেই চলল, ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল পাগলামো।’

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস অয়নের বুক চিরে বেরিয়ে এলো, ‘এবার বলুন? আমার বাবার এই অবস্থার পেছনে কে দায়ী? এটা কি খুনের চাইতে কিছু কম?’

আহির অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। একটা সময় অয়ন অধৈর্য হয়ে বলে উঠল, ‘কথা বলুন!’

— ‘দেখুন অয়ন, হাতের পাঁচটা আঙুলতো সমান হয়না। সবার মাকেই যে এক রকম হতে হবে, সাংসারিক হতে হবে, ঘর কুনো হতে হবে এমনতো কোনো কথা নেই। আপনার মা হয়ত স্রোতের বিপরীতের একজন। কিন্তু তিনি যা কিছু করেছেন সবটাতো আপনাদের দু ভাই বোনের জন্যই করেছেন তাইনা? আপনার বাবা যা করতে পারেননি মা তাই করে দেখিয়েছেন। একটু পজিটিভলী নিন না ব্যাপারটা! ক’জন মহিলা পারেন এমন সফল হতে বলুন?’

— ‘আমি যে এত সফল মা চাইনি। একজন রক্ত মাংসের সত্যিকারের মা চেয়েছিলাম। যে মা ঘরে থাকে বলেই ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করে।

— ‘আমি শিওর, আপ্লুনার মা আপনার জন্য আজও ঘরে বসে অপেক্ষা করছেন, আপনি শুধু বুঝতে পারছেন না, আপনি… আপনি ভুল বুঝছেন’

অয়ন তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো, ‘এখন আর কোনো কিছুতেই কিছু আসে যায়না, ওই মানুষটার জন্য আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি, আমার ছেলেবেলা হারিয়েছি, আজকে আমার পুরো জীবনটা ওলট পালট হয়ে গেছে।’

মন্দিরের ওপাশটায় কারো চলাচলের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আহির একটু সচকিত ভঙ্গীতে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কে?’

— ‘কে আবার, হয় মনুষ্য, নয় সাপ খোপ বা বেজী’

— ‘সাপ?’

— ‘হ্যাঁ সাপ, সাপ অবশ্য নিঃশব্দে চলাচল করে, সাপ কখন আসবে আপনি তা টেরও পাবেন না’

আহির ভয় খেলো এবার। ঢোঁক গিলে বলল, ‘আপনি… আপনি শুধু শুধু আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন’

— ‘মোটেও না, এই জংলার ভেতরে সাপ আছে, সাপ আছে মন্দিরের ওদিকটায়, জঙ্গলের ভেতর শেয়ালও আছে। হঠাৎ হঠাৎ তাদের মর্জি মতো বেরিয়ে আসে’।

কথাটা শোনা মাত্র আহির সচেতন ভঙ্গীতে এপাশ ওপাশ তাকাতে লাগল।

অয়ন বলল,

— ‘ভয় পাচ্ছেন কেন, বাড়ি ঘর সব ছেড়ে ছুঁড়ে দিয়ে চলে এসেছেন, মরলেই কী আর বাঁচলেই কী?’

— ‘তাই বলে… তাই বলে সাপের কামড় খেয়ে মরতে হবে?’

অয়ন এবার শব্দ করে হেসে উঠল। ঘোর ঘন পাহাড়ি বন্য রাতে সেই হাসি গায়ে কাঁটা ধরায়। ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল সে। ভেজা শিশির শরীরে লাগতেই গা শিরশিরিয়ে ওঠে। জোরে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আরে ম্যাডাম! ভয় টয় বাদ দিন, ওপরে বিস্তৃত আকাশ আর নিচে আপনি প্রকৃতির সাথে মিশে আছেন। আজকে প্রকৃতির মতোই আকাশের সাথে আপনার দিগন্তজোড়া সম্পর্ক। এই অনুভূতির কোনো তুলনা হয়না।’

আহির কিছু বলল না। সে জানে এমন রাত হাজার বছরে একটা আসেনা। অন্তত তাদের শহুরে যান্ত্রিকতার ভেতর তো এহেন আকাশ পাওয়া দুর্লভ। কিন্তু তার যে বড় সাপের ভয়। এই ছেলেটা এত কিছু থাকতে সাপের নাম ধরতে গেলো কেন? ভয়ে আঁট সাঁট হয়ে বসে রইল আহির। অয়ন চোখদুটো প্রসারিত করে আকাশে হীরের টুকরোর মতো জ্বলতে থাকা তারা গুলোর দিকে তাকিয়ে বলল-

টুইঙ্কেল টুইঙ্কেল লিটল ষ্টার, হাও আই ওয়ান্ডার হোয়াট ইউ আর! জেন টেইলর যখন ১৭৮৩ সালে এই ছড়াটা প্রথম লিখেছিলেন তখন অবধি পৃথিবীর মানুষ আকাশের তারা দেখে মুগ্ধ হতো, ছোট শিশুরা চমকিত হতো, এখন আর হয়না! যত দিন যাচ্ছে আমাদের আশ্চর্য হবার, মুগ্ধ হবার ক্ষমতা কমছে। সে যাই হোক, আহির দিলশাদ, আপনার গল্পটা শোনা হলো না।’

আহির একটু নড়ে চড়ে বসলো, বলল, ‘কী আর বলব, আপনার বন্ধুর কীর্তি- কলাপের কথা।’

— ‘আমার বন্ধু?’

— ‘হুম, তুষার।’

— ‘ও, তুষার আমার বন্ধু নয়, পাড়ার ছোট ভাই, বয়সে বছর দুয়েকের ছোট হবে।’

— ‘ওই হলো’

—কী করেছে সে?’

আহির একটু সময় নিয়ে কথাগুলো নিজের মনে সাজালো। তারপর খুলে বলল সবটা। অয়ন শুনে বিস্মিত,

— ‘তুষার এমনটা করেছে! কী বলছেন আপনি? বাট আমি তো দেখেছি সে আপনার জন্য কতটা ডেডিকেটেড ছিল, কী করে সম্ভব!’ আহির কথাগুলো বলতে গিয়ে শেষেরদিকে কেঁদে ফেলেছিল। অয়ন থতমত খেয়ে উঠে পড়ল শোয়া থেকে, ‘একি আপনি কাঁদছেন কেন?’ আহির আর কোনো কথা বলতে পারল না। প্রায় অনেকটা সময় নিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল। অয়ন বসে রইল বোকার মতো। মেয়েদের চরিত্রের এই দিকটাই সব চাইতে বেশি বিরক্তিকর। কারণে অকারণে ফিচ ফিচ কান্না। আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ে অবশ্য তার সামনে বসে এভাবে কাঁদেনি। অয়ন তাই কী করবে, কী বলবে কিছুই খুঁজে না পেয়ে একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। কিছুটা সময় পার হলে আহির ধাতস্থ হলো, বলল,

— ‘আমাদের পরিবারে শুধু একটিই সমস্যা ছিল সর্বদা। অর্থাভাব। বাবার স্বল্প রোজগারের চাকরী। খুব বেশি বিলাসীতা আমরা কখনোই চোখে দেখিনি। তবুও কি জানেন? আমরা সুখী ছিলাম একটা সময়ে। বাঁধা ধরা মাইনে দিয়ে আমাদের পড়াশোনার খরচ, বাড়ি ভাড়া, খাওয়া দাওয়া, সব কিছুই টান টান ভাবে হয়ে যাচ্ছিল। একটু বড় হবার সাথে সাথে আমাদের চাহিদা বাড়তে থাকল, প্রয়োজন বাড়তে থাকল, কিন্তু বাবার আয় বাড়ল না। আমাদের ওই টানাটানির মধ্যবিত্ত সংসারে তাই তুষার একটা সময় আশির্বাদ হয়ে আসলো। বাবা মা তাই তুষারকে কোনো ভাবেই হাত ছাড়া করতে চাইছেন না। অর্থাভাব তাদের নৈতিকতাবোধটুকু পর্যন্ত ধুয়ে নিয়ে গেছে। আজ তারা অন্ধ! বাহ্যজ্ঞান রহিত। আমি এখন কী করব? আল্লাহ আমার ভাগ্যেই কেন এমনটা লিখে রাখলেন? কী পাপ করেছিলাম আমি?’

অয়ন স্তিমিত গলায় বলল,

— ‘আপনার বাবা মার দোষ নেই, আসলে কী, এই মুহূর্তে আপনার বিয়ে দিতে পারলেই তারা বাঁচেন। তুষারের ব্যপারে মোটামুটি একটা মাইন্ড সেট আপ তাদের হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে তুষারকে বাদ দিয়ে আবার নতুন করে বিয়ের সম্বন্ধ খোঁজ করা একটা হেসেল হবে তাদের জন্য’

— ‘তাই বলে আমার দিকটা একটু দেখবেনা ওরা? যে ছেলেটাকে আমি ঘেন্না করতে আরম্ভ করেছি, তাকে আমি কী করে বিয়ে করবো? কী করে তার সাথে সারাটা জীবন কাটাবো?’

— ‘দেখুন, আমার মনে হয় তুষারকে আপনার একটা চান্স দেয়া উচিত। লেট হিম ডিফেন্ড হিমসেলফ!’

— ‘আমার ঘেন্না হচ্ছে’

— ‘লুক, একটা ব্যাপার কি জানেন, ফিজিক্যাল নিড তো থাকতেই পারে, তাইনা?’

আহির বিস্ফারিত নয়নে তাকালো, ‘কী করে বললেন আপনি? আপনারা পুরুষেরা… আপনারা এভাবেই চিন্তা করেন তাই না? ছি! এতটা শরীর সর্বস্ব কেন আপনারা?’

অয়ন থতমত খেয়ে গেল, মিন মিন করে বলল, ‘আমি আবার কী করলাম!’

— ‘ঐ যে বললেন, ফিজিক্যাল নিড? যতসব অসভ্য চিন্তা ভাবনা’

অয়ন হো হো করে হেসে ফেলল, ‘আপনি কিন্তু বড্ড সেকেলে! মিডেল ক্লাস সেন্টিমেন্ট।’

— ‘খুব ভালো হয়েছে, আপনি থাকুন আপনার আপার ক্লাস সেন্টিমেন্ট নিয়ে।’ ঝাঁঝালো গলায় বলল আহির।

— ‘চেতলেন নাকি? বলছিলাম, শরীর আর মন দুটো আলাদা জিনিস! মনটাই আসল, শরীর কিছু না। সউল ইজ এটার্নাল। তুষার যদি আপনাকে ভালোবেসে থাকে মন দিয়ে, তাহলে আমি বলব ওই জিনিস দুর্লভ, সামান্য একটা ভুলকে কেন্দ্র করে ওটা হারাবেন না।’

আহির দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘আপনার কাছে যেটা সামান্য ভুল, আমার কাছে সেটা সামান্য নয়! আর ভালোবাসলে আমাকে ধোঁকা দিতে বাঁধলোনা কেন তার? আপনার ভালোবাসার মানুষটি যদি আপনার সাথে এহেন কান্ড করতো তাহলে আপনি কী করতেন? বলুন কী করতেন?

অয়ন আহিরের দিকে কিছুটা সময় নিশ্চুপ তাকিয়ে থেকে চোখ নিচের দিকে নামিয়ে বলল, ‘জানিনা!’

—জানবেন না কেন? ভেবে দেখুন একবার! আপনি প্রেম টেম করেননি জীবনে?’

অয়ন হাসলো, ‘প্রেম করিনি, তবে প্রেম প্রেম ভাব হয়েছিল, আমাদের পাশের বাড়িতে এক খ্রিস্টান মেয়ে থাকত, মিশনারী তে পড়ত। খুব ভালো লাগত আমার। ঠিক করেছিলাম বড় হয়ে ওকে বিয়ে করব।’

— ‘বেশ তো, তা সে কোথায় এখন?’

— ‘আরে, ধ্যুর জানিনা’

— ‘ব্যাস এ টুকুই?’

— ‘হ্যাঁ এটুকুই’

— ‘বলেন কী?’

— ‘সত্যি বলছি’

— ‘সন্ন্যাসী হবেন নাকি?’

— ‘এখন তো সেটা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছিনা! সন্যাস জীবনই একমাত্র পাথেয়।

— ‘আর কি হবে এমন জনম, লুটবি মজা মনের মতন

বাবার হোটেল ভাঙবে যখন, খাবি তখন কার বা শালে!’

— ‘আপনি লালনের খুব ভক্ত তাইনা?’

অয়ন গভীর গলায় বলে, ‘তা আর বলতে! এমন দর্শন এ পৃথিবীতে বিরল!

“আট কুঠুরী নয় দরজা আঁটা, মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাঁটা।
তার উপরে সদর কোঠা, আয়না মহল তায়।
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়?”

মানুষ আমরণ এক অচিন পাখিকে পোষার চেষ্টা করে। তবে কজনই সত্যিকারের পোষ মানাতে পারে এই রহস্যময় অচিন পাখিকে?’

“মন তুই রইলি খাঁচার আশে
খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশে
কোনদিন খাঁচা পড়বে ধসে
লালন ফকির কয়।”

দেহ নামক মাটির পিঞ্জরে পাখিটির অবাধ চলাফেরা, কিন্তু বেঁধে রাখা দায়। পাখিটি উড়াল দিলে পিঞ্জরের আর কোনো অস্তিত্ব থাকেনা।

আহির কিছু বলল না। ভাঙ্গা চাঁদটা পশ্চিমের আকাশের হেলে পড়েছে। রাত বাড়ছে। শীত বাড়ছে। নিশুতি প্রাণীরা সচল এবং সজাগ হয়ে উঠছে। হিম ধরা হাওয়ায় নিঃশব্দে হেলে দুলে ঢেউ খেলছে, শীতকালের রুগ্ন বাঁকখালী নদী। রূপের অহংকারে মজে গিয়ে প্রকৃতি তার নিজেকে নিয়ে বড় বেশি ব্যস্ত। দুটি যুবক যুবতী আকাশের কোলে জনমানবহীন পাহাড়ে নিশ্চিন্তে বসে আছে। বড় মোহময় এই রাত। পৃথিবীর বুকে চির জাগুরুক হয়ে থাকুক এমন রাত!

আহিরের একটু তন্দ্রার মতো এসেছিল। একটা বনমোরগের কর্কশ ডাকে ওর ঘুম ভাঙ্গলো। পূবের আকাশে গোল বলের মতো সূর্যটার মাথা উঁকি দিয়েছে। লালচে আকাশের নিচে ঝুলে আছে সাদা কুয়াশার চাদর। সেই চাদর ভেদ করে সোনা রঙা পবিত্র ভোর মাত্র অবতরণ করেছে পাহাড়ের বুকে। এক গুচ্ছ রেশমী হাওয়া সঙ্গে নিয়ে। আকাশের কাছাকাছি নানা রকম পাখি, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে। পান্থ- পরিযায়ী পাখি ওরা। কোন দেশ থেকে এসেছে আবার কোন দেশে যাবে কে জানে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে এখনো অন্ধকার ঘাপটি মেরে আছে। মন্দিরে কেউ একজন ঘন্টা বাজাচ্ছে। ঘন্টা শুনে একটা সঙ্গীহীন জলপাই সবুজ পাখনার টুনটুনি ঝোপের কাছ থেকে ডানা ঝাপটে উড়াল দিল। অয়ন ঘুমুচ্ছে তখনও গুটিশুটি মেরে আদুরে বেড়ালের মতো। সোনামোড়ানো নরম আলো এসে পড়েছে ওর গালে। সুন্দর দেখাচ্ছিল ওকে। আহির ওর হাতটা একটু ঠেলে দিয়ে বলল, -’অয়ন!’

— ‘হুম?’

— ‘অয়ন উঠুন

— ‘হুম’

— ‘উঠুন না!’ অয়ন চোখ খুলল। আহিরের মাথায় এখন কাপড় জড়ানো নেই। চুলগুলো এলো করে খোলা পিঠের ওপর। ওর ঠিক মাথার পেছনেই সূর্যদেব উঁকি দিয়ে কিরণ ছড়াচ্ছেন। পান পাতার মতো লম্বাটে মুখটা ভোরের আলোয় উদ্ভাসিত। রাতের অন্ধকারে এই মানবী অদৃশ্য ছিল। অর্ধেক মানবী ছিল অর্ধেক কল্পনা। ভোরের পবিত্র আলোয় তার সম্পূর্ণ রূপ বিকশিত হলো। অয়ন কিছুক্ষণ আহিরের অপার্থিব রূপের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবালু কণ্ঠে

বলল,

“আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল;
তবুও এ জল কোথা থেকে এক নিমিষে এসে
কোথা চলে যায়;
রাত ফুরুলে পদ্মের পাতায়।”

আহির হাসলো, হেসে পরের পংক্তিটা ধরলো,

“আমার মনে অনেক জন্ম ধরে ছিল ব্যথা
বুঝে তুমি এই জন্মে হয়েছ পদ্মপাতা;
হয়েছ তুমি রাতের শিশির –
শিশির ঝরার স্বর”

অয়ন শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে পরের তিনটা লাইন আবৃত্তি করল,

“জীবন ক্ষণস্থায়ী তবু হায়।
এই জীবনের সত্য তবু পেয়েছি এক তিল;
পদ্মপাতায় তোমার আমার মিল।”

আহির পুনরাবৃত্তি করল,

‘পদ্মপাতায় তোমার আমার মিল!’

অয়ন উঠে দাঁড়ালো। আহিরও। পাহাড়ের কিনারে এসে দাঁড়ালো দুজন। ঢালু হয়ে বন বনানী আর পায়ে হাঁটার মাটির রাস্তা নিয়ে তিনশ ফুট নিচে নেমে গেছে আদিনাথ মন্দিরের পাহাড়। উত্তাল ফুলগন্ধি হাওয়ায় জীবন এখানে মুহূর্তে মুহূর্তে নতুন রূপ পাচ্ছে। আহির বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, ‘নাহ! জীবন অতটা খারাপ না’ অয়ন হাসলো। এই মুহূর্তে তাকে দেখে মনে হলোনা তার ভেতরে কোনো খেদ আছে, কষ্ট আছে।

আহির লাজুক গলায় বলল, ‘অয়ন! আমি কি আপনার হাতটা ধরতে পারি?’

অয়ন একটু লাল হলো। মেয়েদের হাত ধরার অভ্যাস নেই তার। মুখে কিছু বলল না। হাত বাড়িয়ে আহিরের হাতটা নিজের হাতে নিল। নরম বাচ্চা খরগোশের মতো তুলতুলে একটা হাত! মেয়েদের হাত বুঝি এত নরম হয়!

একটা সময় আহির আলতো স্বরে বলল, ‘অয়ন, আপনি আপনার মা কে ক্ষমা করে দিন, কষ্ট পাচ্ছেন তিনি। একজন মাকে এত কষ্ট দিয়েন না।

— ‘বলছেন?’

— ‘বলছি’

— ‘চেষ্টা করব, আপনিও… হ্যাঁ আপনিও তুষারকে আরেকটা চান্স দিন, বেচারা সত্যি চায় আপনাকে

আহির হাসলো। ঝিলিক মারলো ওর গজদাঁত, বলল ‘ঠিক আছে’

— ‘আহির দিলশাদ! বলেছিলাম না? There is no exquisite beauty… without some strangeness in the proportion? আপনার দাঁতগুলোর স্ট্রেঞ্জ প্রপর্শনের কারণেই আপনার হাসিটি এত বেশি সুন্দর।’ আহির চোখ লুকালো। কিছু বলতে পারল না। মনের ভেতরটায় এত আলোড়ন এর আগে কোনদিন হয়নি। এ কেমন এক আশ্চর্য অনুভূতি। এই অনুভূতির নাম কী?

২৯

— ‘তুই ফিরেছিস?’ দাদিমা অয়নকে দেখে প্রায় দৌড়ে আসলেন। জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলেন। ‘আমি ভেবেছিলাম তুই আর কোনোদিন ফিরবি না’

অয়ন দাদীমার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,

— ‘কেঁদোনা দাদীমা! এইতো আসলাম আমি ‘

— ‘তোর বাবাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি অয়ন, কেউ খুঁজে পায়নি, আমার পাগল ছেলেটা কোথায় চলে গেল, কোথায় আছে, কেমন আছে! এসব চিন্তা করে আমি আর বাঁচতে পারছিনা। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, আমি আর পারছিনা!’ দাদীমা বাচ্চা মেয়ের মতো অয়নকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললেন, আর তোর মা, তোর মায়ের শরীর খারাপ, প্রেশার প্রচন্ড হাই ছিল গত দুদিন, হসপিটালে ভর্তি ছিল, আজ সকালে বাড়ি ফিরল।’

— ‘তুমি শান্ত হও দাদীমা, এতটা ভেঙে পড়োনা’

অয়ন তার নিজের ঘরে যাবার আগে, আজকে অনেক অনেক দিন বাদে স্বইচ্ছায় আয়শার ঘরে উঁকি দিল। আয়শা শুয়ে আছেন বিছানায়। মাথার কাছটায় বুশরা বসে আছে। অয়নের হঠাৎ মনে হলো ঠিক এই মুহূর্তে তার বাড়ি ফিরে আসাটা খুব দরকার ছিল। আহিরকে একটা ধন্যবাদ দেয়া খুব জরুরী হয়ে পড়েছে। কিন্তু কী করে দেবে? কমলাপুর স্টেশনে ওদের রাস্তা যখন পৃথক হয়ে গেল, তখনও একটা বারের জন্যও মাথায় ক্লিক করেনি যে ফোন নম্বরটা নিয়ে রাখা দরকার। ফোন নামের যে একটা যন্ত্র আছে, এটাই সে ভুলে গিয়েছিল। শুধু ফোন কেন, ফেসবুক, টুইটার না কোনো ঠিকানাই নিয়ে রাখেনি অয়ন।

অয়ন ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো। শেষ বিকেলের মরা আলো এসে মেঝেতে পড়েছে। আয়শা চোখ বুজে রেখেছেন। বুশরা অয়নকে দেখে বেশ কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। কয়েকটা থমকে যাওয়া সেকেন্ড কেটে যাবার পর অয়ন মুখ খুলল, ‘কী অবস্থা?’

আয়শা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলেন অয়নের গলা শুনে। চোখ খুলে তাকালেন। তার চোখের নিচে রাত জাগার ক্লান্তি। মুখটা একটু ফুলে গেছে কোনো কারণে। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি সুস্থ নেই। আয়শা উঠে বসার চেষ্টা করলেন। বুশরা এগিয়ে গিয়ে মা কে ধরলো। অয়ন বিছানার পাশে পেতে রাখা চেয়ারে বসলো। মা মেয়ে হতবাক দৃষ্টিতে পরস্পরের মুখের দিকে চাইল। দুজনের চোখেই বিস্ময় ফেটে পড়ছে। অয়ন নিজের ইচ্ছেয় এই ঘরে এসেছে, বসেছে। এ যেন অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

— ‘কেমন আছিস তোরা?’

— ‘ভাইয়া, বাবাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি’

— ‘জানি’

— ‘কী করে জানিস?’

— ‘টের পাই’

— ‘তুই কী মনে করে বাড়ি ফিরলি?’ ঝাঁঝালো গলায় প্রশ্ন করে বুশরা। -’সেই কৈফিয়ৎ তোকে দিতে হবে?’

— ‘এমন একটা বিপদের মুহূর্তে তুই আমাদের ফেলে চলে গেলি, এখন এসেছিস ঢং করতে?’ আয়শা ধমক লাগলেন বুশরাকে, ‘আহ! চুপ কর তো! ও কী বলতে চায়, তা তো আগে শুনতে দে!’ বুশরা মায়ের ধমক খেয়ে সাময়িক চুপ করল, কিন্তু তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে রাগে তার সারা শরীর জ্বলছে। আয়শা অয়নের চোখে শীতল দৃষ্টি রেখে বললেন, ‘বলো!’

অয়ন আয়শার দিকে তাকালো। তার মনে পড়েনা শেষ বার সে কবে তার মায়ের চোখে চোখ রেখেছিল। কিন্তু আজ এই এতদিন পরে, এই বিকেল শেষের আলোতে, ছেলেবেলার স্মৃতিতে ভরা পুরোনো ঘরটায় বসে থেকে অয়নের হঠাৎ মনে হলো, এই মাকে সে একদিন ভালোবাসতো! একটা ভারী নিঃশ্বাস ফেলে সে বলল,

— ‘না ভাবছিলাম! ফাইনালি, বাবা আমাদের জীবন থেকে পুরোপুরিই সরে পড়লো। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে, একটা অসুস্থ মানুষকে এভাবে বোঝার মতো বয়ে নিয়ে যাওয়াটা.. আসলে… আসলে অনেক কষ্টকর একটা ব্যাপার।’

কথাটা শোনা মাত্র আয়শা থর থর করে কেঁপে উঠলেন। তার দুচোখ বেয়ে স্রোতের মতো জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। বুশরা জাপটে ধরল মাকে। তারস্বরে বলল, ‘ভাইয়া, আমরা এমনিতেই ভালো নেই, খুব খারাপ আছি, তুই উড়ে এসে জুড়ে বসে আমাদের কষ্টটা আর বাড়াস না’

অয়ন বুশরার কথাটা শুনেও না শোনার ভান করল। আয়শার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি কাঁদছ কেন? তোমার মনে নেই সেই দিনটার কথা?’ আয়শা চকিতে তাকালেন তার ছেলের দিকে। ছেলে আপনি থেকে তুমিতে নেমেছে। টানা চার বছর পর ছেলে তাকে তুমি সম্বোধন করছে। আয়শা নিজের দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে বললেন ‘কোন দিন?’

— ‘যেদিন তুমি তোমার ইম্পর্টেন্ট বায়ারদেরকে বলেছিলে, বাবা নেই, কারণ তুমি চাইছিলেনা আমার স্বল্পশিক্ষিত, আনস্মার্ট, বোকা বাবা তোমার পার্টনারদের সামনে দাঁড়িয়ে তোমার ইমেজ খারাপ করুক। তাই জীবিত একজন মানুষকে তুমি নেই বানিয়ে দিলে! পরে আমি জানতে পেরেছিলাম বাড়ির কাজের লোকদের পর্যন্ত তুমি শিখিয়ে রেখেছিলে ওরা যেন ভুলেও সেই দিন অতিথিদের সামনে বাবার উপস্থিতির কথা না বলে। কী করে পেরেছিলে তুমি? এত বড় জঘন্য একটা কাজ করতে!’

অয়ন একটু থেমে বলল, ‘আসলে কি জানো? আমার বাবা… আমার বাবা সেদিনই মরে গিয়েছিল। চোখের সামনে বাবার সেই মুখটা আজও ভাসে! একটা জীবিত মানুষ যে কী করে দিনকে দিন মৃত্যুর দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যায় তা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানেনা।’

আয়শার কান্নার দমক বাড়লো। কান্না জড়ানো গলায় তিনি সজোরে মাথা নেড়ে বললেন, আমি জানি তুই আমাকে ঘেন্না করিস, সব আমার দোষ, সব আমার দোষ! সব কিছুর জন্য আমিই দায়ী। তোরা… তোরা আমাকে গলা টিপে মেরে ফেল’ আয়শা সত্যিই বুশরার হাত দুটো খামচে ধরে নিজের গলার ওপর চাপিয়ে দিলেন। বুশরা আর্তনাদ করে উঠল, ‘আরে মা করছ কী! করছ কী তুমি!’

অয়ন উঠে এসে মায়ের পাশে বসল। মায়ের কপালের কাছে পড়ে থাকা এলোমেলো একগাছি চুল কানের পেছনে আটকে দিয়ে বলল, ‘কী দরকার ছিল এত অর্থবিত্তের? তোমার ওই অর্থের পেছনে ছুটে চলা আমার শৈশবটাকে কেড়ে নিয়েছে, আমার পরিবারটাকে কেড়ে নিয়েছে।

— ‘অয়ন, সংসার চালানোর মতো কোনো ক্ষমতা তোর বাবার ছিল না! আমি আজীবন গাধার মতো খাটুনি খেটে পয়সা উপার্জন করেছি বলেই তোরা মানুষ হয়েছিস।’

অয়ন হাসলো, ‘মানুষ! মানুষ কি হয়েছি সত্যি? আর এই মানুষ হবার জন্য যদি এত বড় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, তাহলে সেই মনুষ্যত্বের কোনো দাম নেই আমার কাছে। সে যাই হোক, যা গেছে, তা তো চলেই গেছে, আমি তোমাকে যে কথাটা বলতে এসেছি তা হলো…’

— ‘কী? কী কথা?’

অয়ন নিস্প্রভ গলায় বলল

— ‘মা, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি’

আয়শা বিস্ময় ভরা চোখে তাকালেন ছেলের দিকে। অনেক অনেক দিন বাদে অয়ন তাকে মা ডাকল। মনে হলো ধু ধু মরু প্রান্তরে বহু বহু দিন পর তিনি এক ফোটা জলের ছোঁয়া পেলেন। এই জল টুকুর জন্য তার অন্তরাত্মা জ্বলে পুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছিল। ছেলের মাথাটা বুকে চেপে ধরে কান্না জড়ানো গলায় বললেন, ‘ক্ষমা করিস না বাবা, ক্ষমা পাবার যোগ্য আমি নই, এভাবেই শুধু নিজের মাকে, মা বলে ডাকিস!’ অয়ন দু হাত দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। মায়ের গায়ের গন্ধ একটুও পাল্টায়নি। সেই ছোটবেলার মতোই আছে। পৃথিবীর অন্য কোথাও এই ঘ্রাণটি নেই। হঠাৎ কী হলো কে জানে অয়ন বাচ্চা ছেলের মতো হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলল। কান্না জড়ানো গলায় বলতে লাগল, ‘আমার অনেক কষ্ট মা! অনেক কষ্ট! তুমি বুঝলেনা কেন? কেন বুঝলেনা তুমি?’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *