খলবলি

খলবলি

।। এক।।

উত্তরবঙ্গের এ এক ছোট্ট জনপদ। রেল স্টেশন থেকে শুভেন্দুর গন্তব্য ইরিগেশন বাংলার দূরত্ব মাইল দশেক। ডিপার্টমেন্টের একটা গাড়ির রেল স্টেশনে থাকার কথা ছিল শুভেন্দুকে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু স্টেশনে নামার পর শুভেন্দু টেলিফোন করে জানতে পারল ব্রেকডাউন হয়েছে গাড়িটা। কাজেই ভাড়া গাড়ি নিয়েই সেচ দপ্তরের বাংলোর দিকে রওনা হয়েছিল। বাংলোটাকে এখন এ অঞ্চলের সবাই চেনে। তাকে কেন্দ্র করেই তো শুরু হয়েছে বাঁধ নির্মাণের কর্মযজ্ঞ। শুভেন্দুর গাড়িটা শহরের কলরবকে পিছনে ফেলে এসেছে অনেকক্ষণ। ফাঁকা রাস্তা দিয়ে ছুটছে গাড়িটা। রাস্তার দু’পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় গাছ—শাল-সেগুন-পিয়াল। কখনও আবার তার ফাঁক গলে দেখা যাচ্ছে অনাবাদী জমি, দু-চারটে বাড়িঘর। এতক্ষণ ড্রাইভার একটাও কথা বলেনি। জায়গাটার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে গাড়িটা। এতক্ষণ পর সে হঠাৎ মুখ খুলে জানতে চাইল, ‘আপনিই তো নতুন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তাই না? বাঁধের কাজ দেখতে এসেছেন?’

শুভেন্দু সেচ দপ্তরের ইঞ্জিনিয়ার। সত্যিই সে এসেছে বাঁধের কাজ তদারকি করতে। কলকাতার সেচ দপ্তরের অফিস থেকে পাঠানো হয়েছে তাকে। ড্রাইভারের কথা শুনে শুভেন্দু মৃদু বিস্মিতভাবে বলল, ‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি জানলেন কিভাবে?’

গাড়ি চালাতে চালাতে ড্রাইভার বলল, ‘আন্দাজ করলাম। আসলে ছোট জায়গা তো, সবাই সবকিছুর খবর রাখে। আগের ইঞ্জিনিয়ারবাবু মারা যাবার পর তো কাজ বন্ধ হয়ে আছে। শুনছিলাম নতুন ইঞ্জিনিয়ারবাবু আসবে। আবার কাজ শুরু হবে। কাজ শুরু হলে অবশ্য আমাদেরই ভালো। লোকজনের আসা-যাওয়া বাড়ে এখানে। আমরা দুটো ভাড়া পাই। তবে…’

শুভেন্দু বলল, ‘হ্যাঁ, আর ক’দিনের মধ্যেই আবার কাজ শুরু হবে। কিন্তু ‘তবে’ কী?’

ড্রাইভার ছেলেটা বলল, ‘তবে খলবলি’ শেষ পর্যন্ত মারাই গেল!’

‘খলবলি’ কে? জানতে চাইল শুভেন্দু।

সে জবাব দিল, ‘ওই নদীটার নাম। যাকে বাঁধ দেওয়া হচ্ছে।’

যে নদীতে বাঁধের কাজ হচ্ছে সেটা মহানন্দার একটা শাখানদী এটা জানে শুভেন্দু। তবে তার নামটা জানা ছিল না শুভেন্দুর। আর সে অর্থে নদীটা খুব একটা পরিচিতও নয় বাইরের লোকের কাছে। এমন অসংখ্য ছোট ছোট নদী ছড়িয়ে আছে সারা উত্তরবঙ্গ জুড়ে। নামটা শুনে শুভেন্দু বলল, ‘খলবলি! বেশ নাম তো! এ নামের মানে কী?’

ছেলেটা বলল, ‘এমনিতে নদীটা বেশি বড় নয়। কিন্তু বর্ষাকালে খলবলি হয়ে উঠত নদীটা। ভালো বোরোলি মাছ পাওয়া যেত নদীটাতে। মানে এই কদিন আগেও মরবার আগে পর্যন্ত।’

‘খলবলি’ শব্দের মানে এবার বুঝতে পারল শুভেন্দু। খলবলি অর্থাৎ উচ্ছল অথবা ছলছল।

ড্রাইভার ছেলেটা এরপর যেন একটু আফসোসের সুরে বলে উঠল, ‘খুব সুন্দর ছিল নদীটা।’

বাঁধ দিলে নদী মরে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। শুভেন্দু যতটুকু শুনেছে এ নদীতে বাঁধ দেওয়া হচ্ছে দুটো কারণে। প্রথম বর্ষার সময় এ নদীতে হু-হু করে জল ঢুকতে শুরু করে। ছোট নদীটা সে সময় নাকি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। নদীখাত বেশি গভীর না হওয়াতে তার দু-কূল প্লাবিত হয়ে দু-পাশের বেশ কিছু গ্রাম ভেসে যায়। বাঁধ হলে বন্ধ হবে এ ঘটনা। আর দ্বিতীয় ব্যাপার হল বাঁধ সংলগ্ন যে ছোট জলাধার নির্মিত হবে, সেই জলাধার থেকে শুখা মরশুমে ক্যানেল দিয়ে চাষের জমিতে জল সরবরাহ করা যাবে। যদিও শুভেন্দু শুনেছে যে, স্থানীয় এক পরিবেশপ্রেমী সংগঠন নাকি এই নদীতে বাঁধ দেবার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। তারা বলছে নদীতে বাঁধ দিলে প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হবে। ইকো সিস্টেম নষ্ট হবে। অবশ্য এ ধরনের আন্দোলন তো এসব ক্ষেত্রে হয়েই থাকে।

ড্রাইভারের কথা শুনে শুভেন্দু বলল, ‘হঠাৎ নদীটা মরে গেল বটে। কিন্তু আর বন্যা হবে না। আর চাষের জলও সারা বছর পাওয়া যাবে।’

ছেলেটা এ প্রশ্নের কোনও জবাব দিল না। সম্ভবত শুভেন্দুর এ কথাটা তার তেমন মনঃপুত হল না।

শুভেন্দুর অবশ্য কিছুদিন আগে পর্যন্ত এ প্রজেক্টের কাজে আসার কোনও কথাই ছিল না। আসতে হল এ প্রজেক্টের যিনি দায়িত্বে ছিলেন তিনি হঠাৎ মারা গেলেন বলে। তার মৃত্যু সংবাদটা খবরের কাগজেও বেরিয়েছিল। প্রথমে একটু জলঘোলাও হয়েছিল ব্যাপারটা নিয়ে। প্রাথমিক অবস্থায় কেউ কেউ দাবি করেছিলেন যে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে কেউ মেরে নদীতে ফেলে দিয়েছিল। পরে অবশ্য পুলিশের রিপোর্টে জানা যায় যে ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়। তার গায়ে কোনও আঘাতের চিহ্ন ছিল না। তিনি কোনও কারণে নদীতে নেমেছিলেন। তারপর তার হার্ট অ্যাটাক হয়। নদীখাতে পড়ে যাবার পর অচৈতন্য অবস্থায় নাকে মুখে জল ঢুকে দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু হয় তার। বিষয়টা অন্য কিছু নয়।

তবুও ব্যাপারটা একবার যাচাই করে নেওয়ার জন্য শুভেন্দু ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, আগের ইঞ্জিনিয়ারবাবুকে আপনি চিনতেন? তিনি কিভাবে মারা গেলেন জানেন? আপনি স্থানীয় লোক বলে জানতে চাচ্ছি?’

ছেলেটা জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, চিনতাম। উনি তো প্রায় একবছর ছিলেন এখানে। সান্যাল সাহেব। সরকারি গাড়ি খারাপ হলে মাঝে মাঝে আমার গাড়ি নিয়ে বাঁধের কাজ দেখতে যেতেন। ঠিক কিভাবে মারা গেলেন আমি বলতে পারব না। তবে তার বাড়িটা আমি দেখেছি। নদীতে বেশ কিছু বড় বড় পাথরের চাঁই আছে। তারই একটার গায়ে আটকে ছিল দেহটা। জায়গাটাতে জলই ছিল না বলা যায়। খুব বেশি হলে গোড়ালি সমান জল হবে।’

শুভেন্দু জানতে চাইল ‘ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সঙ্গে ওখানে কারও ঝগড়া-অশান্তি হয়েছিল?’

গাড়ির হুইল ঘোরাতে ঘোরাতে ছেলেটা বলল, ‘ওই যারা চায় না বাঁধটা হোক, যারা মিছিলটিছিল করে তাদের সাথে সাহেবের ক’বার তর্কাতর্কি হয়েছিল। তবে তার জন্য খুন জখম হবার সম্ভাবনা নেই। এমনিতে সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার ছিল সাহেবের। তার কোনও তেমন শত্রু ছিল বলে শুনিনি।’

শুভেন্দু আগের ইঞ্জিনিয়ারের মৃত্যু সম্বন্ধে যা শুনেছিল তা মোটামুটি মিলে গেল ড্রাইভার ছেলেটার বক্তব্যের সঙ্গে। কিন্তু এরপর ছেলেটা বলল, ‘অনেকে আবার সাহেবের মারা যাওয়া নিয়ে আর একটা কথা বলে।’

‘কী কথা?’ জানতে চাইল শুভেন্দু।

ড্রাইভার ছেলেটা বলল, ‘ওই সান্যাল সাহেব এসেই তো বাঁধ দেবার কাজ শুরু করেছিলেন ঠিকাদার মহেশ সিংকে নিয়ে। তিনিই তো নদীটাকে মারলেন। তাই নদীও তাঁকে মেরে প্রতিশোধ নিল।’

ছেলেটা যে কথা বলল, সে কথার কোনও জবাব হয় না। কাজেই শুভেন্দু আর কোনও কথা বলল না। গাড়ি এগিয়ে চলল। কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি একটা বাঁক নিতেই কিছুটা দূরে একটা একতলা ছোট বাড়ি চোখে পড়ল। ইটের তৈরি বাড়ি, মাথায় টিনের ছাদ। বাংলো বলতে যা চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাড়িটা দেখতে মোটেও তেমন নয়। শুভেন্দু অবশ্য শুনেছিল তথাকথিত ওই বাংলোটা নাকি আসলে প্রাইভেট প্রপার্টি। ইরিগেশন দপ্তর সাময়িক ভাবে ভাড়া নিয়েছে বাড়িটা। ড্রাইভার জানাল, ‘হ্যাঁ, ওটাই সেচ দপ্তরের বাংলো।’ বাড়িটার সামনে একটা সাইনবোর্ডে সে কথাই লেখা আছে।

গাড়িটা এসে বাড়ির সামনেই থামল। গাড়িতে বসেই ভাড়া মেটাল শুভেন্দু। ড্রাইভার ছেলেটা শুভেন্দুর হাতে একটা চিরকূট ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এতে আমার ফোন নম্বর লেখা আছে। দরকার হলে ডাকবেন স্যার।’

‘আচ্ছা’ বলে তার ব্যাগ-সুটকেস নিয়ে শুভেন্দু গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। গাড়ি ঘুরিয়ে ফেরার পথ ধরল ছেলেটা। শুভেন্দু ভালো করে তাকাল বাড়িটা আর তার চারদিকে। বেশ নিরিবিলি জায়গাটা। আশেপাশে অন্য কোনও ঘরবাড়ি নেই। বাড়িটার সামনেই বেশ বড় একটা সেগুন গাছ দাঁড়িয়ে আছে, আর পিছন দিকেও বেশ অনেকটা বড় বড় গাছ আছে। আর হ্যাঁ, বাড়ির একপাশে একটা দরমার ঘরও আছে। তবে দেখেই বোঝা যাচ্ছে লাল ইটের তৈরি বাড়িটা বেশ পুরনো। মালপত্র নিয়ে শুভেন্দু এগোল বাড়িটার দিকে। আর গাড়ির আওয়াজ শুনেই মনে হয় টালির ছাউনিওলা দরমার ঘর থেকে বেরিয়ে এল একটা লোক।

।। দুই।।

শুভেন্দুকে দেখেই লোকটা তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে দাঁড়াল তার সামনে। লোকটাকে বুড়োই বলা যেতে পারে। মাথায় শনের মতো সাদা চুল, মুখে বলিরেখা। পরনে হাঁটু পর্যন্ত তোলা ধুতি আর খাকি হাফশার্ট। লোকটার বয়স হলেও তার কালো রঙের ছোটখাট চেহারাটা এখনও বয়সের তুলনাতে বেশ শক্ত সমর্থ বলেই মনে হল শুভেন্দুর। লোকটা শুভেন্দুর সামনে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে বলল, ‘আপনিই তো নতুন ইঞ্জিনিয়ারবাবু? আমি এ বাড়ির কেয়ারটেকার ভিখু রাজবংশী।’

শুভেন্দু বলল, ‘হ্যাঁ, আমিই নতুন ইঞ্জিনিয়ার। কলকাতা থেকে আসছি।’

কথাটা শুনেই লোকটা বলল, ‘আসুন সাহেব আসুন। আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি।’ এরপর সে শুভেন্দুর হাত থেকে সুটকেস আর ব্যাগটা নিয়ে রওনা হল বাড়িটার ভিতরে যাবার জন্য।

কাঠের দরজাতে একটা তালা ঝুলছিল। কোমরের ঘুনসি থেকে একটা চাবি বার করে দরজা খুলে মাল সমেত শুভেন্দুকে নিয়ে বাড়িটাতে প্রবেশ করল কেয়ারটেকার ভিখু। ওরা যে ঘরে ঢুকল সে ঘরে কাঠের খাট, আলমারি, টেবিল চেয়ার সবই আছে। সবই পুরনো দিনের হলেও বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ঘরের লাগোয়া একটা বাথরুমও আছে। শুভেন্দুর ঘরের পাশে পরপর আরও দুটো ঘর আছে। শুভেন্দু জানতে চাইল, ‘এ বাড়িতে আর কেউ থাকেন?’

ভিখু জবাব দিল, ‘না, সাহেব। বড়বাবু মানে বর্মনবাবুর বাড়ি জলপাইগুড়ি। উনি সেখান থেকেই বাঁধের ওখানে বা দরকার হলে এখানে আসা-যাওয়া করেন। আর ঠিকাদারবাবুও বাঁধের ওখানে মজুরদের সাথে তাঁবু খাটিয়ে থাকেন। আগের ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এ বাড়িতে একলাই থাকতেন।’

বড়বাবু বা বর্মনবাবু হলেন সেচ দপ্তরের এখানকার হেড ক্লার্ক কাম ক্যাশিয়ার। তার সঙ্গে ইতিমধ্যেই শুভেন্দুর টেলিফোনে কথাবার্তা হয়েছে। তারই কথা ছিল শুভেন্দুকে স্টেশন থেকে আনার। তিনিই গাড়ি খারাপের কথাটা টেলিফোনে শুভেন্দুকে জানিয়েছিলেন। শুভেন্দু জানতে চাইল ‘বর্মনবাবু তো টেলিফোনে আমাকে বললেন যে, ওখানে থাকবেন। তিনি এসেছিলেন?’

ভিখু বলল, ‘সকালের দিকে একবার এসেছিলেন। আমাকে দিয়ে দরজা খুলিয়ে সব পরিষ্কার করালেন। তারপর চলে গেলেন। এসে যাবেন হয়তো এখনই। আমি আপনার জন্য চা করে আনি সাহেব। আর লন্ঠনটাও আনি।’

লণ্ঠনের কথা শুনে শুভেন্দু এবার খেয়াল করল ঘরে কোনও সুইচবোর্ড নেই। মাথার ওপর কোনও ফ্যানও নেই! সে বললে, ‘এ বাড়িতে ইলেকট্রিক নেই?’

ভিখু জবাব দিল, ‘না’ সাহেব। তবে আপনার গরম লাগবে না। ওই দক্ষিণ দিকের জানালাটা খুললেই বারান্দা। প্রচুর বাতাস ঢোকে।’

কী আর করা যাবে। কথাটা শুনে শুভেন্দু বলল, ‘ঠিক আছে তুমি চা করে আনো।’

ভিখু চলে যাবার পর ব্যাগ খুলে জামাকাপড় বার করে বাথরুমে ঢুকল শুভেন্দু। বালতিতে জল ভরা আছে। মুখ-হাত ধুয়ে পোশাক পাল্টে ফ্রেশ হয়ে নিল সে। তারপর ঘরের অন্য দিকে যে দরজা আছে সেটা খুলে দিল। সামনেই নিচু রেলিং দেওয়া একটা লম্বাটে বারান্দা। শুভেন্দুর ঘরের সামনে থেকে শুরু হয়ে পাশের ঘরদুটো অতিক্রম করে সেটা শেষ হয়েছে। তবে বারান্দার শেষপ্রান্তে কোনও আগল নেই। শুভেন্দু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল বারান্দার শেষপ্রান্তে। বিকাল হয়ে গেছে। দিন শেষের আলো মেখে একসারি গাছ দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির পিছন দিকে। বারান্দা থেকে একটা পায়েচলা পথ রওনা হয়েছে সেই গাছগুলোর মধ্য দিয়ে আরও ওপাশে। গাছের গুঁড়ি আর ঝোপঝাড়ের ফাঁক গলে ওদিকের কিছুটা দেখা যাচ্ছে। সে জায়গাটা যেন উন্মুক্ত স্থান বলে মনে হল শুভেন্দুর। কী যেন একটা চিকচিক করছে সেখানে। সরু লম্বা ফিতের মতো একটা রেখা। নদী নাকি? একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে বারান্দার শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এই নতুন জায়গার নিস্তব্ধ সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগল শুভেন্দু।

মিনিট দশেকের মধ্যে চা নিয়ে হাজির হল ভিখু বুড়ো। কাপ সমেত প্লেটটা হাতে নিয়ে শুভেন্দু তার কাছে জানতে চাইল, ‘গাছগুলোর ওপাশে কী আছে?’ ভিখু জবাব দিল, ‘ওখানেই তো সেই মরা নদীটা। ওর নাম খলবলি।’

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে শুভেন্দু জানতে চাইল, ‘এখান থেকে নদীর পাড়ে যাওয়া যায়?’

বুড়ো ভিখু জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, সাহেব। গাছগুলোর একটু ওপাশেই মরা নদীটা।’ এরপর সে কী বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বাড়ির সামনের দিক থেকে একটা শব্দ শোনা গেল। গাড়ির শব্দ। একটা গাড়ি এসে যেন থামল।

ভিখু বলল, ‘ওই বর্মনবাবুরা এলেন বোধহয়।’

শুভেন্দু পিছু ফিরে বারান্দা দিয়ে এগিয়ে এসে আবার ঘরে ঢুকল। খোলা দরজা দিয়ে বাড়ির সামনের অংশে একটা হুডখোলা জিপগাড়ি দেখতে পেল। তার মধ্য থেকে নেমে এসে শুভেন্দুর ঘরে ঢুকল দু’জন লোক। তাদের একজনের ছোটখাট চেহারা। তাম্বুলরঞ্জিত ঠোঁট। মাথায় টাক, চোখে চশমা, পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। অন্যজনের বেশ ছিপছিপে লম্বা শক্তপোক্ত চেহারা। মোটা গোঁফ আছে লোকটার। পরনে শার্টপ্যান্ট কাঁধে একটা বন্দুক। তার চেহারাতে একটা অবাঙালি ছাপ আছে। ঘরে ঢুকেই লোক দু’জন হাত জোড় করে নমস্কার জানাল শুভেন্দুকে। শুভেন্দুও তাদের প্রতি নমস্কার জানাল।

মধ্যবয়সী লোক দু’জনের মধ্যে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা লোকটা নিজেদের পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আমিই হলাম হলধর বর্মন, আর ইনিই হলেন আমাদের বাঁধের ঠিকাদার মানে কন্ট্রাকটার মহেশ সিং?’

নিজেদের পরিচয় দেবার পর বর্মনবাবু বললেন, ‘ডিপার্টমেন্টের গাড়িটা হঠাৎ বসে গেল। আপনাকে তো জানালাম ব্যাপারটা। কিন্তু তারপরেই সিং-সাহেব চলে এলেন ওর জিপটা নিয়ে। আপনার মোবাইলে ফোন করার চেষ্টা করে লাইন পেলাম না। আপনাকে আনার জন্য আমি আর সিং-সাহেব চলে গেলাম রেল স্টেশনে। আমরা যখন স্টেশনে পৌঁছলাম তার কিছুক্ষণ আগেই সম্ভবত আপনি ওদিকে রওনা হয়ে গিয়েছিলেন। বাঁধের দিক থেকে একটা শর্টকার্ট পথে আমরা রেলস্টেশনে গেছিলাম বলে পথে আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি। আপনাকে কষ্ট করে ভাড়া গাড়ি নিয়ে আসতে হল। কিছু মনে করবেন না।’

ঘরের মধ্যে দুটো চেয়ার রাখা আছে। শুভেন্দু ইঙ্গিতে ওদের চেয়ারে বসতে বলে নিজে খাটে বসল। চেয়ার টেনে নিয়ে তারা দু’জন শুভেন্দুর মুখোমুখি বসল। শুভেন্দু এরপর ওদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘ভাড়া গাড়িতে এলেও এখানে আসতে আমার তেমন কষ্ট হয়নি। বাঁধটা এখান থেকে কত দূর?’

মহেশ শিং জবাব দিলেন ‘তিন কিলোমিটার। আপনার চিন্তা নেই। ডিপার্টমেন্টের গাড়ি যতদিন না ঠিক হচ্ছে ততদিন আমার জিপটাই এ জায়গা থেকে বাঁধ পর্যন্ত আপনাকে আনা নেওয়া করবে। অন্য কোথাও গেলেও আমার গাড়ি নিয়েই যেতে পারবেন। কোনও সমস্যা হবে না।’

শুভেন্দু বলল, ‘ধন্যবাদ। কিন্তু এদিককার খবর কী?’

বর্মনবাবু বললেন, ‘সান্যালসাহেব মারা যাবার পর থেকে একমাস কাজ বন্ধ। তবে আপনি যখন চলে এসেছেন তখন আর আমাদের চিন্তা নেই। এবার কাজ শুরু হবে।’

শুভেন্দু জানতে চাইল, ‘ক’দিনের মধ্যে শুরু হবে?’

মহেশ সিং বললেন, ‘আশা করছি দিন তিনেক পরেই শুরু হবে। আসলে প্রায় এক মাস ধরে লেবারদের বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে হচ্ছিল আমাকে। কাজ না করলেও অর্ধেক মজুরি দিতে হচ্ছিল। ওরা ছুটি চাইতেই দিন সাতেক আগে ওদের ছুটি দিয়েছি। তাতে আমার খরচ বাঁচবে। জনা দশেক মজুর বাদে বাকিরা সব গ্রামে ফিরে গেছে। তবে খুব বেশি দূরে ওদের বাড়ি নয়। কাল তাদের খবর পাঠালে দু’দিনের মধ্যে সব ফিরে আসবে। তারপর দিন থেকে কাজ শুরু করা যাবে। মালপত্র সব মজুত আছে। কোনও চিন্তা নেই। মাঝে শুধু তিনদিন সময় চাই।

শুভেন্দু মহেশ সিংকে বলল, ‘বেশ ভালো কথা। কিন্তু আর কোনও সমস্যা নেই তো? শুনেছি কারা যেন ওই বাঁধটা তৈরি করার বিরোধিতা করছে? আর আপনার সঙ্গে বন্দুক কেন?’

মহেশ সিং প্রথমে হেসে দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব দিয়ে বললেন, ‘এটা আমার লাইসেন্সড গান। আমি এই নর্থবেঙ্গলে নানা জায়গাতে ঠিকাদারি করে বেড়াই। অনেক সময় বনে জঙ্গলেও কাজ করতে যেতে হয়। সেখানে বন্য জন্তুর ভয় থাকে। তাছাড়া কাজের জায়গাতে মালপত্র পড়ে থাকে। সেগুলো অনেকে চুরি করার চেষ্টা করে। সঙ্গে বন্দুক থাকলে চট করে কেউ সেসবের সাহস পাবে না। বন্দুক হল এমন জিনিস যে তা সঙ্গে থাকলে ভূত-প্রেতও কাছে ঘেঁসে না।’

এ কথা বলার পর প্রথম প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, কিছু অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে বাঁধের কাজ বন্ধ করার জন্য মাঝে মাঝে আসে ঠিকই, কিন্তু ওদের নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। কুড়ি-বাইশ বছর বয়সি দশ-পনেরোজন ছেলেমেয়ে। জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি কলেজের ছাত্রছাত্রী সব। ওদের পিছনে কোনও পলিটিক্যাল পার্টির সাপোর্টও নেই। পলিটিক্যাল পার্টিগুলো তো চাচ্ছে বাঁধটা হোক। ভোটের ব্যাপার আছে। ওই ছেলেমেয়েগুলো মাঝেসাঝে আসে। প্ল্যাকার্ড নিয়ে ঘোরে, কিছুক্ষণ শ্লোগান দেয় তারপর ফিরে যায়। একবারই শুধু ওরা আগের ইঞ্জিনিয়ার সান্যাল সাহেবের গাড়ির সামনে শুয়ে পড়েছিল। আমার মজুরেরা চ্যাংদোলা করে সরিয়ে দিয়েছিল ওদের। হয়ত ওরা আপনার কাছেও বাঁধ বন্ধ করার দাবি নিয়ে আসবে। তারপর আবার চলেও যাবে।’ চিন্তার কিছু নেই।’

শুভেন্দু আশ্বস্ত হল ঠিকাদারের কথা শুনে। তারপর বলল, ‘আগের চিফ ইঞ্জিনিয়ার সান্যাল সাহেবের মৃত্যুটা খুব দুর্ভাগ্যজনক। তিনি থাকলে আমাকে এখানে আসতে হত না।’

বর্মনবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, স্যার খুব দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। কেন যে তিনি মাঝরাতে নদীতে নেমেছিলেন কে জানে! এই ভিখুই তো নদীর বুকে সান্যাল সাহেবের লাশটা প্রথম দেখতে পায়। তারপর আমাদের খবর দেয়।’

একথা বলার পর তিনি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভিখুকে বললেন, ‘যাও, জিপ থেকে সাহেবের খাবারের চাল-ডাল-সবজিগুলো নামাও। আর কটা মুরগিও আছে। দেখো পায়ের দড়ি খুলে পালিয়ে না যায়।’

বর্মনবাবুর নির্দেশ পালন করার জন্য চলে গেল ভিখু।

ভিখু চলে যাবার পর বর্মনবাবু বললেন, ‘ভিখু লোকটা এ বাড়িতে প্রায় পঞ্চাশবছর কেয়ারটেকারের কাজ করছে। এই বয়সেও কর্মঠ লোক। ভালো বাঁশিও বাজাতে পারে। দোষ বলতে শুধু একটাই। রাতে মহুয়া খায়। আশাকরি আপনার কোনও অসুবিধা হবে না। এখানে সমস্যা শুধু একটাই। ইলেকট্রিক বাতি নেই।’

শুভেন্দু বলল, ‘তাতে কী আর করা যাবে! তবে সব পরিস্থিতিতেই আমি মানিয়ে নিতে পারি। আপনারা ভাববেন না।’

এরপর বেশ কিছুক্ষণ কাজের নানা বিষয় নিয়ে বর্মনবাবু আর মহেশ সিং এর সঙ্গে কথা হল শুভেন্দুর। এরপর একসময় ফেরার জন্য উঠে পড়ল তারা। যাবার আগে তারা বলে গেল পরদিন সকাল আটটা নাগাদ মহেশ সিং-এর জিপ শুভেন্দুকে নিতে আসবে বাঁধের কাছে নিয়ে যাবার জন্য।

বর্মনবাবু আর মহেশ সিং চলে যাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই বাইরে অন্ধকার নামল। ভিখু কেয়ারটেকার এসে ঘরে লণ্ঠন জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। রাত আটটা নাগাদ আবার সে ঘরে এল খাবার নিয়ে। গরমভাত, সবজি আর মুরগির ঝোল। খাওয়া সেরে রাত সাড়ে আটটা নাগাদ শুভেন্দু বিছানাতে শুয়ে পড়ল ঘরের দরজা বন্ধ করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে শুনতে পেল বাঁশির সুর। সুমধুর অথচ অদ্ভুত এক করুণ সুর। বাড়ির পিছন দিক থেকেই আসছে শব্দটা।

নিশ্চয় বুড়ো ভিখু বাঁশি বাজাচ্ছে। বর্মনবাবু বলেছিলেন ভিখু ভালো বাঁশি বাজাতে পারে। সেই বাঁশির শব্দ শুনতে শুনতে সারা দিনের ক্লান্তিতে একসময় ঘুম নেমে এল শুভেন্দুর চোখে।

।। তিন।।

ভোর ছটা নাগাদ ঘুম ভাঙল শুভেন্দুর। দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে পিছনের বারান্দায় এসে বসল। সুন্দর ভোর। পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। গাছগুলোর আড়াল থেকে নদীতটটাও যেন দেখা যাচ্ছে। ভিখু চা নিয়ে এল কিছুক্ষণের মধ্যেই। শুভেন্দুর হাতে কাপ-প্লেট তুলে দিয়ে কিছুটা তফাতে সে সরে দাঁড়াল। চা পানের পর শুভেন্দু বলল, ‘চলো একবার নদীটা দেখে আসি।’

ভিখু বলল, ‘চলুন সাহেব। তবে খলবলি এখন মরে গেছে।’ মৃদু বিষণ্ণতার সুর যেন বেজে উঠল তার গলায়। বারান্দা থেকে নেমে পায়ে চলার পথ ধরে শুভেন্দু ভিখুর সঙ্গে রওনা হল খলবলিকে দেখার জন্য। গাছগুলো পেরিয়ে একটু এগিয়েই নদীর পানে পৌঁছে গেল তারা। চওড়ায় বেশি বড় নয় খলবলি। অনেকটা বড় খালের মতো। এপার থেকে জোরে একটা পাথরের টুকরো ছুঁড়লে ওপারে গিয়ে পড়বে। অগভীর নদীখাতে গোড়ালি সমান স্বচ্ছ জল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নদীখাতের নুড়িপাথরগুলো জলের নীচে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পাশে কয়েকটা বড় পাথরখণ্ডও জলের ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। তার মধ্যে একটা পাথরখণ্ড বেশ বড়। আকারে সেটা বুক সমান হবে। ধবধবে সাদা গোলাকার পাথরখণ্ডটার নীচের দিকে জলস্রোতের ধাক্কায় একটা খাঁজ সৃষ্টি হয়েছে। নদীখাতের ঢালটা শুভেন্দুরা যেদিকে দাঁড়িয়ে তার বিপরীত দিকে। মরা নদীটার অপর পাড়ে চাষের ক্ষেত, আর তারপর দূরে কিছু বাড়িঘরও দেখা যাচ্ছে। বর্ষার সময় নিশ্চয় নদীর ওপারটাও ভাসিয়ে দিত খলবলি। ব্যাপারটা অনুমান করল শুভেন্দু। এঁকেবেঁকে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে নদীখাতটা। উত্তর দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে ভিখু বলল, ‘সাহেব, ওই ওদিকে বাঁধটা হচ্ছে। বাঁকের আড়ালে বলে এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না।’

শুভেন্দুর হঠাৎ মনে পড়ল আগের ইঞ্জিনিয়ারের মারা যাবার ব্যাপারটা। সে বলল, ‘সান্যাল সাহেব কি ওখানেই মারা গেছিলেন?’

ভিখু জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, ওই যে বড় পাথরের খাঁজটাতে আটকে ছিল দেহটা।’

‘তখন জল কি এমনই ছিল?’

‘হ্যাঁ সাহেব।’ সংক্ষিপ্ত জবাব দিল ভিখু।

শুভেন্দু নদীখাতের দিকে এগিয়ে ঝুঁকে পড়ে হাত ছোঁয়াল জলে। বেশ ঠান্ডা জল। ভিখু বলল, ‘মরা মানুষের দেহের মতো ঠান্ডা জল তাই না?’

অদ্ভুত উপমা। শুভেন্দু জবাব দিল, ‘হুঁ।’

বেশ কিছুক্ষণ নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে রইল শুভেন্দু। তারপর ভিখুকে নিয়ে ঘরে ফেরার জন্য পা বাড়াল।

বাড়িতে এসে স্নান সেরে নিল শুভেন্দু। ব্রেকফাস্ট নিয়ে এল ভিখু। খাওয়া সেরে বেরোবার জন্য তৈরি হয়ে গেল সে। ঠিক আটটাতেই একজন ড্রাইভার ঠিকাদারবাবুর জিপটা নিয়ে হাজির হল। বাঁধের কাজ পরিদর্শনের জন্য রওনা হল শুভেন্দু।

জিপে মিনিট কুড়ি সময় লাগল সে জায়গায় পৌঁছতে। একটা বাঁকের মুখে খলবলির বুকের ওপর বাঁধ দেওয়া হচ্ছে। জায়গাটাতে পৌছলেই বোঝা যায় একটা কর্মযজ্ঞ চলছে। নদীর পাড়ে ডাঁই হয়ে পড়ে আছে ইট, বড় বড় লোহার বিম, স্টোনচিপ, বালিপাথর। টিনের চাল দেওয়া বেশ কিছু অস্থায়ী ছাউনিও সেখানে তৈরি হয়েছে মালপত্র রাখার জন্য এবং মজুরদের থাকার জন্য।

শুভেন্দু গাড়ি থেকে নামতেই বর্মনবাবু আর মহেশ সিং এগিয়ে এসে নমস্কার জানাল। শুভেন্দু তাদের সঙ্গে এগোল বাঁধটা দেখার জন্য। নদীর বুক থেকে আকাশের দিকে মাথা তুলেছে সার সার লোহা আর কংক্রিটের স্তম্ভ। নদীখাত থেকে এক মানুষ উচ্চতায় চওড়া দেওয়াল গাঁথা হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। আর তাতেই আটকে গেছে জলপ্রবাহ। চিরদিনের মতো স্তব্ধ হয়ে গেছে খলবলির উচ্ছ্বলতা। বাঁধের যে পর্যন্ত কাজ হয়েছে তার ওপর উঠল শুভেন্দু। মহেশ সিং-এর হাতে রোল করা বাঁধের নকশাটা ছিল। সেটা খুলে শুভেন্দু বাঁধের ওপর ঘুরে ঘুরে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল কাজটা। বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে বাঁধটা দেখল শুভেন্দু। প্রয়োজনে বর্মনবাবু আর মহেশ সিংকে কিছু নির্দেশও দিল।

বাঁধ দেখা শেষ হয়ে গোডাউনগুলোও পরিদর্শন করল সে। এসব করতেই ঘণ্টা দুই-তিন সময় কেটে গেল। এরপর শুভেন্দুকে নিয়ে টিনের ছাউনি দেওয়া একটা অফিসঘরের মতো ঘরে এনে বসাল বর্মনবাবু আর মহেশ সিং। কাগজপত্রের যেসব কাজ আছে তা ওখানে বসেই শুরু করল তারা তিনজনে মিলে। আরও ঘণ্টাখানেক সময় লাগল সে কাজ মিটতে। আর তারপরই বাইরে একটা শোরগোলের শব্দ শুনে তারা তিনজনে ছাউনি ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল।

জনা দশ-বারো অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে হাজির হয়েছে সেখানে। তারা কারা তা বুঝতে অসুবিধা হল না শুভেন্দুর। তাদের অনেকের গলায় নদী বাঁচাও প্লাকার্ড ঝুলছে। শুভেন্দুর পরিচয় অনুমান করে তারা এসে ঘিরে দাঁড়াল শুভেন্দুকে। তারপর বলতে লাগল বাঁধ তৈরি বন্ধ করার কথা। কেউ বলতে লাগল বাঁধ হলে কিভাবে এখানকার পরিবেশ নষ্ট হবে। কেউ বলল, খলবলিতে বাঁধ দেওয়ায় যেসব মানুষ নদীতে মাছ ধরে তাদের জীবিকা নষ্ট হবার আশঙ্কার কথা। একটা মেয়ে আবার আবেগভরে বলল, ‘এই যে নদী, এই যে অরণ্য প্রকৃতি—ওদেরও তো প্রাণ আছে। এরা কোনও কথা বলতে পারে না বলে কি ওদের খুন করার অধিকার আমাদের আছে?’

মাথা ঠান্ডা করে কৌশলে এদের নিরস্ত করতে হবে। তাই সব শোনার পর শুভেন্দু তাদের বলল, ‘দেখুন, আমি আপনাদের কথা শুনলাম। আপনারা যা বললেন তার সব কথাই অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ। আমিও সমর্থন করি আপনাদের যুক্তি। তবে আমি ইঞ্জিনিয়ার হলেও সরকারের চাকর মাত্র। বাঁধ করা বা না করা এর কোনোটাই আমার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে না। আপনাদের বক্তব্যে তো অনেক যুক্তি আছে। ব্যাপারটা আপনারা সরকারকে লিখিতভাবে জানান না। দেখুন না কী হয়!’

কথাটা শুনে একজন বলল, ‘একবার জানানো হয়েছিল। কিন্তু তাতে তো কাজ হল না।’

শুভেন্দু বলল, ‘আবার জানান। হয়ত সে কাগজ সরকারের ঘরে ঠিক লোকের হাতে পড়েনি। অথবা ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে আছে। আপনারা যদি আমাকে কোনও দাবি সনদ দেন তবে আমি কথা দিচ্ছি যে আমি সরকারের ঘরে সেটা ঠিক টেবিলে পৌঁছে দেব। দেখুন না তারপর কী হয়।’

শুভেন্দুর নরম সুরে বুঝিয়ে বলার ঢঙে কিছুটা যেন আশ্বস্ত হল ছেলেমেয়েগুলো। হাজার হোক ওদের বয়স অল্প। যুক্তির থেকে ওদের মধ্যে আবেগ খেলা করে বেশি। মেমোরেন্ডাম তারা সঙ্গে করেই এনেছিল। নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ আলোচনা সেরে নিয়ে তারা সেই মেমোরেন্ডামটা শুভেন্দুর হাতে ধরিয়ে চলে গেল। তারা চলে যাবার পর সে কাগজটা বর্মনবাবুর হাতে তুলে দোবার আগে একবার চোখ বুলিয়ে নিতে গেল শুভেন্দু। মাত্র জনা পঞ্চাশেক মানুষের স্বাক্ষর করা বাঁধ বন্ধের একটা দাবিপত্র।

নামগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎই একটা জায়গাতে চোখ আটকে গেল শুভেন্দুর। একটা টিপসই দেওয়া আছে দাবিপত্রে। আর টিপসইয়ের পাশে ব্রাকেটে লেখা আছে ‘ভিখু রাজবংশী’।

এ কোন ভিখু? কেয়ারটেকার ভিখু নাকি অন্য কোন লোক? শুভেন্দু অবশ্য মুখে কিছু বলল না নামটা দেখে। চিঠিটা সে বর্মনবাবুর হাতে দিয়ে ফাইলে রেখে দিতে বলল যথাস্থানে পাঠিয়ে দেবার জন্য। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই এদিনের মতো কাজ মিটিয়ে ঘরে ফেরার জন্য রওনা হয়ে গেল সে।

বেলা দুটো নাগাদ শুভেন্দুকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেল জিপটা। সে ঘরে ঢোকার কিছুক্ষণের মধ্যে খাবার নিয়ে এল ভিখু। শুভেন্দু একবার ভাবল যে সেই টিপসইয়ের ব্যাপারটা তার কিনা তা তাকে একবার জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু তাকে এ প্রশ্ন করা ঠিক হবে কিনা বুঝতে না পেরে সে আর এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করল না ভিখুকে। দুপুরের খাওয়া খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল শুভেন্দু।

বিকাল পাঁচটা নাগাদ দরজাতে টোকা দেবার শব্দে ঘুম ভাঙল শুভেন্দুর। ভিখু বুড়ো চা নিয়ে এসেছে। চায়ের কাপ টেবিলে নামিয়ে রেখে চলে গেল সে। মুখেচোখে জল দিয়ে চায়ের কাপ নিয়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল শুভেন্দু। অনেকক্ষণ হল বিকাল হয়ে গেছে। সূর্য ঢলে পড়তে শুরু করেছে। গাছের ফাঁক দিয়ে নদীতটটা দেখা যাচ্ছে। শুভেন্দুর এখন আর কোনও কাজ নেই। সন্ধ্যা নামলেই তো তাকে লণ্ঠন জ্বালিয়ে বদ্ধ ঘরের মধ্যে থাকতে হবে। শুভেন্দু ভাবল নদীর দিকটাতে সন্ধ্যা নামার আগে একবার খোলা বাতাসে ঘুরে আসা যাক। এক চুমুকে বাকি চা-টা শেষ করে কাপ নামিয়ে রেখে বারান্দা থেকে নেমে শুভেন্দু রওনা হল নদীর দিকে। গাছের গুঁড়িগুলো অতিক্রম করে সে পৌঁছে গেল খলবলির পাড়ে। নির্জন নদীতট। কেউ কোথাও নেই। দিন শেষের আলো এসে পড়েছে মৃত নদীর জলে, জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা সেই পাথরটার ওপর। কেমন যেন এক অদ্ভুত বিষণ্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে চারদিকে। মৃত নদীটা যেন তাকিয়ে আছে শুভেন্দুর দিকে। নদীখাতটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎই কেন জানি শুভেন্দুর মনে পড়ে গেল ডেমনেস্ট্রেশন দিতে আসা মেয়েটার সেই কথা—’এই যে নদী, এই যে অরণ্য-প্রকৃতি, এদেরও তো প্রাণ আছে। এরা কোনও কথা বলতে পারে না বলে কি তাদের খুন করার অধিকার আমাদের আছে?’—কথাটা মনে পড়তেই নদীর দিকে তাকিয়ে মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল শুভেন্দুর। সে নদীর মাঝে চেয়ে থাকা পাথরটার দিকে তাকিয়ে রইল। আরও ঢলে পড়তে লাগল আলো।

হঠাৎই একটা অস্পষ্ট শব্দ যেন কানে এল শুভেন্দুর। ছলাৎ করে একটা শব্দ। সেদিকে তাকাল শুভেন্দু। তার হাত পনেরো দূরে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা বাচ্চা মেয়ে। সম্ভবত বছর দশেক বয়স হবে তার। মেয়েটার পরনে ভেজা জামা। মাথার চুল থেকেও জল ঝরে পড়ছে। যেন এতক্ষণ নদীর বুকে শুয়ে ছিল সে। মেয়েটা তাকিয়ে আছে শুভেন্দুর দিকে। বাচ্চা মেয়েটাকে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল শুভেন্দু। মেয়েটা কখন এখানে এল? শেষ বিকালের আলোতে মেয়েটার মুখেও যেন অদ্ভুত বিষণ্ণতা জেগে আছে। কিছুক্ষণ দৃষ্টি বিনিময়ের পর শুভেন্দু হেসে তাকে প্রশ্ন করল, ‘তোর নাম কী রে?’

মেয়েটা মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে জবাব দিল, ‘খলবলি’।

শুভেন্দু বলল, ‘খুব মিষ্টি নাম। এই নদীর নামে নাম। তুই এখানে থাকিস?’

মেয়েটা জবাব দিল, ‘হ্যাঁ।’

এরপর শুভেন্দুকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে জলে নেমে গেল। একটু ঝুঁকে পড়ে জলের নীচটা দেখতে দেখতে মেয়েটা সোজা এগোল জলের মধ্যে জেগে থাকা সেই পাথরটার দিকে। তারপর সেই পাথরের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। শুভেন্দু বেশ কিছুক্ষণ পাথরটার দিকে চেয়ে থাকার পরও সে পাথরটার আড়াল থেকে আর বেরোল না। এখানকার মানুষেরা খুব গরীব। হয়তো বা বাচ্চা মেয়েটা ওই পাথরটার আড়ালে গেঁড়ি-গুগলি বা কোনও মাছ খুঁজছে। এখানকার মানুষদের এভাবেই বেঁচে থাকতে হয়। এমনকি ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরও। মনে মনে ভাবল শুভেন্দু। আর এর পরই দ্রুত সূর্য ঢলতে শুরু করল। মরা নদীতট ছেড়ে ঘরে ফেরার জন্য পা বাড়াল শুভেন্দু। সে ঘরে ঢোকার কিছুক্ষণের মধ্যে ঝুপ করে সন্ধ্যা নামল।

লণ্ঠনের সামনে একটা বই নিয়ে বসে রাত আটটা পর্যন্ত কাটিয়ে দিল শুভেন্দু। সাড়ে আটটা নাগাদ খাবার নিয়ে এল ভিখু। খাবার খেয়ে দরজা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল শুভেন্দু। গতকাল পথশ্রমের ক্লান্তিতে রাতে শোবার পর তার চোখে ঘুম নেমে এলেও এদিন তার চোখে এসময় ঘুম এল না। আসলে কলকাতায় থাকলে রাত বারোটার আগে কিছুতেই বিছানায় যায় না সে। ঘন্টাখানেক সময় বিছানায় এপাশ ওপাশ করেই কেটে গেল তার। এরপর হঠাৎই তার কানে এল বাঁশির শব্দ। ভিখু বাঁশি বাজাচ্ছে। অদ্ভুত করুণ সেই সুর। বারান্দার ওপাশ থেকেই শব্দটা আসছে। শুভেন্দু বিছানা থেকে নেমে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে ভিখু। কিন্তু শুভেন্দু বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই বাঁশি থামিয়ে বারান্দার দিকে ফিরে দাঁড়াল ভিখু। হয়তো তার কানে গিয়ে থাকতে পারে দরজা খোলার শব্দ। পুরনো দিনের দরজা। ক্যাঁচ করে বড্ড শব্দ হয় দরজা খুললে। শুভেন্দু তাকে এগিয়ে আসতে দেখে বারান্দার শেষপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়াল। কাছে এগিয়ে এল ভিখু। বারান্দায় ওঠার যে ধাপটা আছে সেখানে বাঁশি কোলে নিয়ে বসল ভিখু। দিন দুই বাদেই মনে হয় পূর্ণিমা। গাছের ফাঁক গলে চাঁদের আলো এসে পড়েছে ভিখু যেখানে বসে আছে ঠিক সে জায়গাতে। চাঁদের আলোতে ভিখুর বলিরেখাময় মুখে বিষণ্ণতা জেগে আছে।

শুভেন্দু তাকে বলল, ‘খুব সুন্দর বাঁশি বাজাও তুমি। কিন্তু বাঁশির সুরে কান্না কেন?’

ভিখু জবাব দিল, ‘মন ভালো নেই তাই। ওই নদীটার জন্য।’

শুভেন্দু বলল, ‘নদীটাকে তুমি খুব ভালোবাসতে?’

ভিখু বলল, ‘হ্যাঁ। পঞ্চাশ বছর আমি ওকে চিনি। ও যে আমার মেয়ের মতো ছিল। এমন চাঁদনি রাতে আমি যখন খলবলির পাড়ে বসে বাঁশি বাজাতাম তখন সে ঢেউ তুলে নাচত। আমার তো কেউ নেই, শুধু ওই ছিল। কিন্তু সেও মারা গেল।’ এই বলে চুপ করে গেল ভিখু।

বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপভাবে কেটে গেল। শুভেন্দু চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। একসময় ভিখু ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। শুভেন্দুকে সে বলল, ‘এবার ঘরে যান সাহেব। আমিও যাই। বেশ রাত হল।’ এই বলে নিজের কুঁড়ের দিকে পা বাড়াল সে। শুভেন্দুও ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল।

।। চার।।

আগের দিনের মতো এ দিনও ভোর ছ’টা নাগাদ ঘুম ভাঙল শুভেন্দুর। মুখ-হাত ধুয়ে চায়ের প্রত্যাশাতে সে বারান্দায় এসে বসল। নিশ্চয়ই ভিখু চা নিয়ে আসবে এখনি। হঠাৎ বারান্দার মেঝেতে নজর পড়ল তার। লম্বা বারান্দার মেঝেয় জলের ছাপ আঁকা হয়ে আছে। যেন ভেজা পায়ে বারান্দাতে উঠে এসেছিল কোনও ছোট ছেলে বা মেয়ে। ছাপগুলো দেখে তেমনই মনে হল তার। আর কেন জানি সেই ভেজা পায়ের ছাপ দেখে হঠাৎই তার মনে পড়ে গেল খলবলি নামের সেই ছোট্ট মেয়েটার কথা।

চা নিয়ে এরপরই হাজির হল ভিখু। চায়ের প্লেটটা হাতে নেবার পর শুভেন্দু তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা ভিখু, এখানে কাছাকাছি অন্য কোনও ঘরবাড়ি আছে?’

ভিখু জবাব দিল, ‘না, নেই। তবে নদীর ওপারে আছে।’

শুভেন্দু এরপর সেই জলের ছাপগুলো দেখিয়ে বলল, ‘কেউ এসেছিল এখানে? এই ছাপগুলো কোথা থেকে এল? ছোট ছেলেমেয়ের পায়ের ছাপ বলে মনে হচ্ছে।

ভিখু তাকাল মাটির দিকে, তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘পায়ের ছাপ নয়। আপনার জন্য বালতিতে জল আনছিলাম। বালতিটা ফুটো হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি, সেই জলই পড়েছে। আমি আবার বালতি ফেরত নিয়ে গেলাম।’

শুভেন্দু বলল, ‘এবার বুঝলাম। কিন্তু ছাপগুলো দেখো। যেন অবিকল বাচ্চা ছেলেমেয়ের পায়ের ছাপের মতো লাগছে।

এ কথার কোনও জবাব দিল না ভিখু।

শুভেন্দু এরপর জানতে চাইল, ‘এ বাড়িটা এখানে বানানো হয়েছিল কেন জানো? কাছাকাছি তো অন্য কোনও ঘরবাড়ি নেই এখানে!’

ভিখু জবাব দিল, ‘আমি যখন প্রথম এ বাড়িতে আসি তখনও এ বাড়ির চারপাশে জঙ্গল ছিল। হরিণ নদীতে জল খেতে আসত। হামেশাই চিতা বাঘের দেখা মিলত। মানে আমি পঞ্চাশ বছর আগের কথা বলছি। আর এ বাড়িটা বানানো হয়েছিল তারও পঞ্চাশ বছর আগে। কোচবিহারের রাজারা সে সময় এখানে বাঘ শিকার করতে আসতেন। তাদের জন্যই বানানো হয়েছিল এ বাড়িটা। তালাবন্ধ ঘরদুটোর মধ্যে এখনও একটা ঘরে একটা হরিণের মাথা রাখা আছে।’ কথাগুলো বলে ভিখু চলে গেল শুভেন্দুর জন্য ব্রেকফাস্ট বানাতে।

এদিনও ঠিক আটটায় ঠিকাদারবাবুর জিপ এসে গেল। বাঁধের দিকে রওনা হয়ে গেল শুভেন্দু। সেখানে গতদিনের মতোই তার জন্য অপেক্ষা করছিল বর্মনবাবু আর ঠিকাদার মহেশ সিং। শুভেন্দুকে নিয়ে গিয়ে আগেরদিনের সেই অফিসেই বসাল তারা। শুভেন্দু বলল, ‘তাহলে কাজ কবে থেকে শুরু হবে?’

মহেশ সিং বললেন, ‘লেবার মিস্ত্রিদের সব খবর পাঠানো হয়েছে। আজ সকাল থেকেই দু-একজন করে ফিরে আসতে শুরু করেছে। আগামীকাল সকালের মধ্যেই আশা করি এসে পড়বে সব। পরশু থেকে কাজ শুরু হবে।’

কথাগুলো বলে সে একটু ইতস্তত করে বলল, আপনি যদি লেবার পেমেন্টের জন্য টাকা দেবার ব্যবস্থা দিন সাতেকের মধ্যে করে দেন তবে খুব উপকার হয়। আসলে একমাস ধরে ওদের খাওয়াতে হয়েছে, মজুরি দিতে হয়েছে। আমার ভাঁড়ার শেষ হয়ে এসেছে। টাকার ব্যবস্থা হলে আমার কিছুটা সুরাহা হবে।

শুভেন্দু বলল, ‘দেখছি কী করা যায়। পেমেন্টের ফাইলগুলো আমাকে তবে দেখতে হবে।’

বর্মনবাবু বললেন, ‘আমি সব কাগজপত্র গুছিয়ে রেখেছি স্যার। সিং-সাহেব কত পাবেন সব হিসাব সেখানে আছে।’ এই বলে তিনি উঠে গিয়ে তিনটে ঢাউস ফাইল হাজির করলেন তার সামনে।

শুভেন্দু যেখানে রাত্রিবাস করছে, সেখানে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। কিন্তু এখানে লোহার রড, বিম, ইত্যাদি ইলেকট্রিক করাত দিয়ে কাটার জন্য, রাত্রে কাজ করার জন্য বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে। শুভেন্দু তার মোবাইল ফোনটা বর্মনবাবুর হাতে দিয়ে চার্জে বসাতে বলে একটা ফাইল খুলে বসল। কাগজপত্রে ঠাসা ফাইল। টাকা পয়সার ব্যাপার বলে কথা। মন দিয়ে দেখতে হবে। শুভেন্দু বুঝতে পারল এই তিনটি ফাইল দেখতে তার কমপক্ষে দুটো দিন সময় লাগবে। তার সামনে বসে ছিলেন বর্মনবাবু আর ঠিকাদার মহেশ সিং। বর্মনবাবু একটু উসখুস করে বললেন, ‘স্যার আমাদের একটু আজ বোরোতে হবে। আমাকে জলপাইগুড়ি যেতে হবে বেতন তোলার জন্য। আর ঠিকাদার সাহেব শহরে যাবেন লেবারদের রসদ সংগ্রহের জন্য। আপনাকে জিপটা বাড়িতে পৌঁছে ফিরে এলে তবেই আমরা সেখানে রওনা হতে পারি। আজ আর কাল তো এখানে কোনও কাজ নেই স্যার। আপনি বরং ফাইলগুলো বাড়ি নিয়ে যান। পরশু থেকে তো আমি আপনি আর অন্য কোনও কাজ করার বা বিশ্রামের ফুরসত পাব না। আজ আর কাল আপনি ঘরে বসে বিশ্রাম নিন আর ফাইলের কাজ সেরে ফেলুন।’

শুভেন্দুর মনে হল যে কথাটা খারাপ বলেননি বর্মনবাবু। সে বলল, ‘আচ্ছা, তাই করব।’

এরপর সামান্য কয়েকটা টুকটাক কথাবার্তার পর ফাইলপত্র নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল তারা তিনজন। বর্মনবাবু জিপের সিটে ফাইলগুলো তুলে দিলেন। গাড়িতে উঠে বসতে যাচ্ছিল শুভেন্দু। ঠিক তখনই তাদের সামনে হাজির হল একটা লোক। তার পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে সে সিকিউরিটি গার্ড অর্থাৎ নিরাপত্তারক্ষী বা পাহারাদার। তাকে দেখে বর্মনবাবু বললেন, ‘পাহারার কাজ ঠিকমতো চলছে তো? যদিও এখানে চোর-ডাকাতের উপদ্রব নেই, তবুও রাতে গোডাউনগুলোর দিকে নজর রাখবে।’

লোকটা বলল, ‘হ্যাঁ, স্যার। আমি সারা রাত ঘুরে ঘুরে চারপাশে নজর রাখি।’ এ কথা বলার পর সে বলল, ‘জানেন স্যার, কাল একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছিল। কাল মাঝরাতে আমি টহল দিচ্ছি, হঠাৎ চাঁদের আলোতে দেখি একটা বাচ্চা ওই পিলারটার ওপর চড়ে বসেছে!’ এই বলে লোকটা নির্মীয়মান বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা গোলাকার একটা কংক্রিটের থাম দেখাল। অন্তত পনেরো ফুট উঁচু হবে সেটা।

বর্মনবাবু বললেন, ‘তারপর?’

পাহারাদার বলল, ‘ব্যাপারটা দেখার সঙ্গে সঙ্গেই আমি বাচ্চাটাকে নামাবার জন্য তাড়াতাড়ি উঠলাম বাঁধের ওপর। কিন্তু ওই সময়টুকুর মধ্যেই মনে হয় আমাকে দেখে ফেলে পিলার বেয়ে নেমে কোথায় লুকিয়ে পড়ল। কাছে গিয়ে দেখি পিলারের মাথায় কেউ নেই। আর পিলারের মাথা থেকে জল ঝরছে। কেউ যেন কয়েক বালতি জল ঢেলেছে পিলারের মাথায়। হয়তো পিলারটার মাথায় কোনোভাবে জল জমে ছিল। বাচ্চাটা ওপরে ওঠাতে জলটা পড়তে শুরু করেছিল। তবে চারপাশে টর্চ মেরেও আর বাচ্চাটাকে পেলাম না। কোথায় লুকিয়ে পড়ল কে জানে!’

তার কথা শুনে অবাক হয়ে গেল সবাই। এত রাতে এখানে বাচ্চা এল কোথা থেকে! বর্মনবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘বাচ্চাকাচ্চাদের বুদ্ধিশুদ্ধি কম হয়। কাউকে এ জায়গার ধারেকাছে ঘেঁসতে দেবে না। কোনও বিপদ ঘটলে মিডিয়া, সংবাদপত্র রে রে করে উঠবে। দেখলে না সান্যালসাহেবের মৃত্যুটা নিয়ে মিডিয়া কেমন জলঘোলা করার চেষ্টা করেছিল!’

মহেশ সিং বলল, ‘এখানকার বাচ্চাগুলি খুবই ডানপিটে। দিন-রাত বিপদ-আপদের কোনও কেয়ার তারা করে না। সান্যাল সাহেব যে রাতে মারা গেলেন সেদিন রাতে তিনি আমাকে বলেছিলেন যে আগের রাতে নাকি উনি নদীর পাড়ে বেড়াতে গিয়ে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছিলেন। ওখানে নদীর মধ্যে যে পাথরের বড় চাঁইটা আছে, তার ওপর নাকি একটা বাচ্চা মেয়ে বসেছিল। ব্যাপারটা একবার ভাবুন! নদীর ওপাশের যে গ্রামটা আছে সেখান থেকেই সম্ভবত ওরা আসে।’

মহেশ সিং-এর কথা শুনে শুভেন্দুর মনে হল, সান্যাল সাহেবের দেখা মেয়েটা সেই খলবলি নয় তো? শুভেন্দু চড়ে বসল গাড়িতে।

আজ বেশ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরল শুভেন্দু। বাড়ি ফিরে সে ফাইল নিয়ে বসে কিছুক্ষণ কাজ করল। ভিখু দুপুরের খাবার দিয়ে গেল। তা খেয়ে একটা ঘণ্টা তিনেকের ঘুম। আগের দিনের মতোই বিকালে চা নিয়ে এল ভিখু। চা পান করে একটু হেঁটে আসার জন্য শুভেন্দু এগোল নদীর দিকে।

সে যখন নদীর পাড়ে পৌঁছল, তখন আগের দিনের মতো সূর্যাস্ত হতে চলেছে। বেলা শেষের বিষণ্ণ মায়াবী আলো ছড়িয়ে পড়েছে জলে, নদীর ওপর জেগে থাকা সেই পাথরটার ওপর। তবে চারদিকে তাকিয়েও সেই বাচ্চা মেয়েটা বা অন্য কোনও লোককে ধারেকাছে দেখতে পেল না শুভেন্দু। চটি খুলে নদীর জলে পায়ের পাতা ডোবাল শুভেন্দু। জলটা কী হিমশীতল! পা উঠিয়ে নিল সে। তার মনে পড়ে গেল ভিখুর বলা গতদিনের উপমাটার কথা—’মৃত মানুষের দেহের মতো ঠান্ডা জল!’ জল থেকে পা উঠিয়ে নিল সে। তারপর বেশ কিছুক্ষণ নদীর জলের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। খলবলির জলে কোনও স্পন্দন নেই। মরে গেছে সে। গোড়ালি সমান জল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মরা মাছের চোখের মতো স্বচ্ছ স্থির অচঞ্চল চোখে সে তাকিয়ে আছে শুভেন্দুর দিকে। নদীর জলে আলো গলে গেল একসময়। শুভেন্দু ফেরার পথ ধরল। অন্ধকার নামতে শুরু করল খলবলির বুকে।

ফাইলের কাজগুলো দু’দিনের মধ্যে শেষ করে ফেলতে হবে শুভেন্দুকে। মহেশ সিংকে তার বকেয়া পাওনা মেটাবার প্রয়োজন। বলা যায় না মহেশ সিং হয়তো শেষে শ্রমিকদের বেতন মেটাতে পারল না। বন্ধ হয়ে গেল বাঁধের কাজ। তখন ওপরতলার কাছে এ জন্য কৈফিয়ৎ দিতে হতে পারে শুভেন্দুকে। ভিখুকে একটা বাড়তি লণ্ঠন দিতে বলেছিল শুভেন্দু। সে সেটা ঘরে রেখে গেছে। শুভেন্দু সেই লণ্ঠনটা জ্বালিয়ে নিয়ে টেবিলে বসে ফাইল ঘাঁটতে শুরু করল। সন্ধ্যা এগোতে শুরু করল রাতের দিকে। চাঁদও উঠতে শুরু করল বাইরে।

এখন প্রায় রাত ন’টা বাজে। ঘণ্টা তিনেক কাজ করার পর লণ্ঠনটা হঠাৎ দপ দপ করা শুরু করল। তেল ফুরিয়ে এসেছে বোধহয়। অল্প আলোতে একটানা ফাইল দেখে শুভেন্দুর চোখটাও যেন মৃদু টনটন করতে শুরু করেছে। ভিখু নিশ্চয় এখনই খাবার আনবে। তার আসার সময় হয়ে গেছে। তাই এদিনের মতো কাজ বন্ধ করে কাগজপত্র ফাইল গুটোতে লাগল সে। কাগজ সাজিয়ে ফাইলে যখন শুভেন্দু দড়ি বাঁধছে তখন হঠাৎই এক জায়গাতে চোখ গেল তার। বারান্দার দিকের দরজাটা খোলা রাখা ছিল। সেই খোলা দরজা দিয়ে বাইরের চাঁদের আলো ঘরের মধ্যে এসে পড়েছে। আর তার মধ্যে জেগে আছে একটা মানুষের অবয়ব! কেউ যেন দরজার বাইরের বারান্দাতে এসে দাঁড়িয়েছে। আর তার ছায়াটাই মেঝেতে এসে পড়েছে। একটা খর্বাকৃতি মানুষের ছায়া। কয়েক মুহূর্ত ছায়াটার দিকে তাকিয়ে থেকে শুভেন্দু বলে উঠল, ‘কে ভিখু নাকি?’

কোনও জবাব মিলল না প্রশ্নের। শুধু ছায়াটা যেন একটু নড়ে উঠল।

শুভেন্দু আবার বলল, ‘কে, কে ওখানে?’

এবারও কোনও জবাব মিলল না। আর তারপরে বাইরে যে দাঁড়িয়েছিল সে যেন সরে গেল। মেঝে থেকে ছায়াটাও উধাও হয়ে গেল।

কী হল ব্যাপারটা! শুভেন্দু সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এল। না, বারান্দায় কেউ নেই। সামনের জমিটাতেও কেউ নেই। তবে অন্য একটা ব্যাপার নজরে পড়ল শুভেন্দুর। দরজার কিছুটা তফাতে বারান্দাতে জল থই থই করছে। কেউ যেন কয়েক বালতি জল ঢেলে রেখে গেছে সেখানে। মেঝে থেকে জল গড়িয়ে আসছে শুভেন্দুর পায়ের দিকে। এত জল এখানে এল কিভাবে শুভেন্দু ঠিক বুঝতে পারল না। একটা জলরেখা এসে স্পর্শ করল ওর একটা পায়ের আঙুল। কী ঠান্ডা জলটা! ঠিক যেন খলবলির জলের মতোই ঠান্ডা। আর এরপরই শুভেন্দু দেখল খাবারের থালা বাটি নিয়ে ভিখু আসছে।

বারান্দায় উঠে এল ভিখু। কিছুটা এগিয়েই সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল মেঝেতে পড়ে থাকা জলের সামনে। হয়তো তার খালি পায়ের পাতা স্পর্শ করেছিল সেই জল। চাঁদের আলোয় মেঝেতে পড়ে থাকা জলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল সে। শুভেন্দু তাকে এ জায়গাতে জল এল কিভাবে সে প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই সে বলল, ‘কুকুর বা অন্য কোনও প্রাণী বারান্দায় উঠে এ জায়গাটা নোংরা করেছিল, আমিই জল দিয়ে জায়গাটা ধুয়েছি।’

হতে পারে ব্যাপারটা। শুভেন্দু কাজে মগ্ন ছিল বলে জল ঢালার শব্দ পায়নি হয়তো। শুভেন্দু বলল, ‘ও আচ্ছা! কিন্তু যেন এখনই এ জায়গাতে কেউ দাঁড়িয়েছিল মনে হয়। ঘরের মেঝেতে একটা মানুষের ছায়া যেন দেখলাম। আর তাই দেখে বাইরে এলাম।’

ওর কথা শুনে ভিখু রাজবংশী বেশ দৃঢ় স্বরে বলল, ‘আপনি ভুল দেখেছেন। এখানে কেউ আসে না। চলুন এবার খেয়ে নেবেন।’

একপাশ দিয়ে জলটাকে পাশ কাটিয়ে খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকল ভিখু। শুভেন্দুও ঢুকল। টেবিলে খাবার নামিয়ে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ভিখু। শুভেন্দু খাওয়া সেরে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই লণ্ঠন নিভিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। বেশ কিছুক্ষণ জেগে রইল সে। তারপর একসময় বাইরে থেকে ভেসে আসতে শুরু করল বুড়ো ভিখুর বাঁশির শব্দ। সেই করুণ বিষণ্ণ বাঁশি। ভিখুর বাঁশি কাঁদছে খলবলির জন্য। কখন যেন সেই বাঁশির শব্দ শুনতে শুনতে ঘুম নেমে এল শুভেন্দুর চোখে।

।। পাঁচ।।

আজ আর বাঁধে যাবার কোনও তাড়া ছিল না। ঘুম ভাঙার পরও বিছানাতে কিছুক্ষণ শুয়ে রইল শুভেন্দু। ভিখু ঘরে এসে চা দিয়ে গেল। তারপর উঠল শুভেন্দু। প্রাতরাশও চলে এল এক সময়। প্রাতরাশ সাঙ্গ করে ফাইলপত্র খুলে কাজে বসল শুভেন্দু। একটানা দুপুর পর্যন্ত কাজ করে ফাইলগুলো সে শেষ করে ফেলল। তারপর স্নান খাওয়াদাওয়া সেরে ঘুমিয়ে নেবার জন্য শুয়ে পড়ল সে। পরদিন থেকে বাঁধের কাজ শুরু হবে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সে আর বিশ্রাম নেবার সুযোগ পাবে না। তার আগে যথাসম্ভব বিশ্রাম নিয়ে শরীরটাকে চাঙ্গা করে নেওয়া প্রয়োজন।

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে শুভেন্দুর যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকাল পাঁচটা বাজে। সামনের দরজাতে কড়া নাড়ছে কেউ। শুভেন্দু উঠে গিয়ে দরজা খুলল। একজন লোক সঙ্কুচিত ভাবে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝবয়সি লোকটার পরনে অতি সাধারণ পোশাক। তাকে দেখে স্থানীয় মানুষ বলেই মনে হয়। একটু ইতস্তত করে লোকটা বলল ‘ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আছেন? আমি তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’

শুভেন্দু বলল, ‘আমিই ইঞ্জিনিয়ার।’

লোকটা শুভেন্দুর পরিচয় শুনে হাতজোড় করে প্রথমে নমস্কার করল। তারপর বলল, ‘আমি এখানেই থাকি স্যার। আমার ছেলে এখানকার একটা কলেজে পড়ে। ওদের ভুল হয়ে গেছে স্যার। আর ওরা এসব ব্যাপারে নাক গলাবে না। আপনি ওদের ক্ষমা করে দিন।’

তার কথা বুঝতে না পেরে শুভেন্দু বলল, ‘কিসের ক্ষমা?’

লোকটা বলল, ‘আজ ওরা বাঁধের কাছে গেছিল বাঁধ বন্ধের দাবি জানাতে। তারপর পুলিশ বাড়িতে খুঁজতে গেছিল। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। আবেগের বশে আন্দোলন করতে নেমেছিল। ওরা আর কেউ ওখানে যাবে না। স্যার একটু দেখুন। পুলিশ যেন ওদের না ধরে।’

এবার ব্যাপারটা বুঝতে পারল শুভেন্দু। তবে সে তো এসব ব্যাপারে কিছুই জানে না। আর পুলিশই বা ডাকল কে? লোকটাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে শুভেন্দু বিছানা থেকে মোবাইল ফোনটা তুলে নিয়ে ফোন করল বর্মনবাবুকে। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর বর্মনবাবুর ফোনে রিং বাজল।

বর্মনবাবু ফোনটা রিসিভ করে বললেন, ‘আপনাকে বহুবার ফোন করেছি। কিন্তু কিছুতেই লাইন পাচ্ছি না। নেটওয়ার্কের ভীষণ প্রবলেম।’

শুভেন্দু জানতে চাইল ‘বাঁধের ওখানে কোনও গন্ডগোল হয়েছে নাকি?’

বর্মনবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, সেটা জানানোর জন্য ফোন করেছিলাম। আজ সকাল থেকে ছেলে-মেয়েগুলো আবার এসেছিল। কোথা থেকে ওরা জানতে পেরেছে যে আগামীকাল থেকে কাজ শুরু হতে চলেছে। হয়তো বা লেবারদের ফিরে আসা দেখে তারা ব্যাপারটা অনুমান করেছে। যাই হোক ওদের দাবি হল যে যতক্ষণ না সরকারের ঘর থেকে ওদের চিঠির জবাব আসবে, ততক্ষণ কোনও কাজ করা যাবে না। এই মর্মে বাঁধের উপর পোস্টার লাগিয়ে গেছে তারা।’

শুভেন্দু বলল, ‘ওখানে তবে তেমন কোনও গন্ডগোল হয়নি? শুনেছি ওই ছেলে মেয়েগুলোর বাড়িতে নাকি পুলিশ গেছিল খুঁজতে?’

বর্মনবাবু বললেন, ‘পুলিশের ব্যাপারটা জানি না। তবে তারা চলে যাবার পর বিডিও সাহেব এসেছিলেন। সম্ভবত তিনি এ পথ দিয়ে অন্য কোথাও যাচ্ছিলেন। তারপর পোস্টারগুলো দেখে দাঁড়িয়ে পড়েন। আমাদের থেকে তিনি ব্যাপারটা জানতে চাইলেন। আমরা ঘটনাটা বললাম তাকে। তারপর তিনি জানতে চাইলেন যে ছেলেমেয়েগুলোর নাম পরিচয় আমরা জানি কিনা? ঠিকাদারবাবু তখন ফাইল থেকে ওদের পিটিশনের কাগজটা বিডিও সাহেবকে দেখায়। তিনি নামগুলো টুকে নিয়ে গেছিলেন। তারপর কী হয়েছে আমার জানা নেই।’

শুভেন্দু একটু উষ্মা প্রকাশ করে বলল, ‘আমাকে না জানিয়ে নামগুলো না দিলেই পারতেন। ঠিকাদার সাহেব কোথায়?’

বর্মনবাবু জবাব দিলেন আপনাকে ফোন করার চেষ্টা করেছিলাম বিডিও সাহেব কথা বলতে চান আপনার সাথে। কিন্তু তখনও লাইন পাওয়া যায়নি। ঠিকাদার সাহেব আজও শহরে গেছেন কিছু জিনিসপত্র কিনতে। তিনি রাতে গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করবেন।’

শুভেন্দু বলল, ‘বিডিও সাহেবের ফোন নম্বরটা আপনার কাছে আছে? থাকলে আমায় দিন।’

বর্মনবাবু বললেন, ‘অফিসের ফোন নম্বরটা আছে। বলছি স্যার।’

বর্মনবাবু নম্বরটা বললেন শুভেন্দুকে। সে তারপর বর্মনবাবুর লাইনটা কেটে দিয়ে ফোন করল বিডিওকে। ফোনটা বিডিও সাহেবই ধরলেন। শুভেন্দু নিজের পরিচয় দিতেই তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ আপনার সঙ্গে আমার কথা বলার ছিল। শুনেছেন হয়তো যে আমি বাঁধের ওখানে গেছিলাম। আপনার কোনও চিন্তা নেই। কাল থেকে নিশ্চিন্তে কাজ শুরু করুন। পুলিশ প্রোটেকশানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে ওখানে। কাল কাজ শুরুর সময় আমিও হাজির থাকব ওখানে।’

বিডিও সাহেব বললেন, ‘ব্যাপারটা আমিই পুলিশকে জানিয়েছি। তবে অ্যারেস্ট করতে নয়। গেছিলাম যাতে তারা কাজে বাধা না দেয় সে ব্যাপারে সাবধান করতে। তবে কাজে বাধা দিলে পুলিশ হয়তো তাদের অ্যারেস্ট করবে।’

এরপর তিনি বললেন, ‘প্রশাসনের ওপরতলা থেকে আমার কাছে নির্দেশ এসেছে যে বাঁধের কাজে যেন কোনও বিঘ্ন না ঘটে, সে ব্যাপারটা দেখার জন্য। আর তিন মাস বাদে বর্ষা নামবে। প্রতি বছর বর্ষাকালে ওই নদীটার জন্য দু-তিনটে গ্রাম ডুবে যায়। অনেক ক্ষতি হয় মানুষ আর সরকারের। আমাদের মানুষের স্বার্থ দেখতে হয়। বর্ষা নামার আগে বাঁধটা যত সম্ভব উঁচু করতে হবে।’ এ কথার পর, কাল সকালে কাজের জায়গাতে দেখা হবে বলে ফোন রেখে দিলেন বিডিও সাহেব।

দরজার বাইরে লোকটার কাছে আবার ফিরে এল শুভেন্দু। তাকে সে বলল, ‘হ্যাঁ, টেলিফোনে ব্যাপারটা জানলাম। আসলে পুলিশ ওদের সাবধান করতে গেছিল। সরকারি কাজে বাধা দিলে হয়তো পরে তারা গ্রেফতার হতে পারে। আসলে ওই বাঁধটা তৈরি হবার সঙ্গে বহু মানুষের স্বার্থ জড়িয়ে আছে। জানেনই তো ওই নদীটার জন্য গ্রামের ক্ষেতে জল ঢোকে। সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষার কাজ করতে হয় সরকারকে। আপাতত আপনি বাড়ি যান। ওরা যদি ব্যাপারটা থেকে সরে যায় তবে আর কোনও চিন্তা নেই।’

কথাটা শুনে লোকটা বলে উঠল, ‘তাহলে আপনি বলছেন স্যার পুলিশ ওদের ধরবে না! আমি বলছি স্যার, ওরা আর ওখানে যাবে না। আসলে সব অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে মিলে প্রকৃতি বাঁচাতে গেছিল। ব্যাপারটা নিয়ে যে থানা পুলিশ হবে তা বোঝেনি ওরা। সকলেরই ভবিষ্যৎ আছে। একবার পুলিশের খাতায় নাম উঠলে চাকরি-বাকরি পেতে সমস্যা হবে।’

শুভেন্দু একটু চুপ করে বলল, ‘ওদের বক্তব্য হয়তো মিথ্যা নয়। কিন্তু মানুষের স্বার্থের অগ্রাধিকার বেশি। এবার আপনি আসুন, নমস্কার।’

শুভেন্দুর কথায় আশ্বস্ত হয়ে তাকে নমস্কার জানিয়ে ফেরার পথে পা বাড়াল লোকটা। দরজা বন্ধ করে পিছনে ফিরতেই দেখল বারান্দার দিকের দরজা দিয়ে কখন যেন চায়ের কাপ নিয়ে হাজির হয়েছে ভিখু। শুভেন্দুর দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ভিখু বলল, ‘তাহলে ছেলেমেয়েগুলো আর বাঁধের কাজ আটকাতে যাবে না?’

অর্থাৎ শুভেন্দু আর লোকটার মধ্যে কথাবার্তা শুনেছে ভিখু।

শুভেন্দু বলল, ‘না যাবে না। পুলিশ সাবধান করেছে ওদের। তাছাড়া কাল থেকে পুলিশ থাকবে বাঁধের ওখানে। সরকারি কাজে কেউ বাধা দিলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করবে।’

ভিখু বলল, ‘তাহলে বাঁধের কাজ হচ্ছেই!’

শুভেন্দু এবার সেই কথাটা জিজ্ঞাসা করল ভিখুকে। সে বলল, ‘আচ্ছা ভিখু, ওই ছেলেমেয়েগুলোর কোনও কাগজে তুমি টিপসই দিয়েছিলে?’

ভিখু জবাব দিল ‘হ্যাঁ।’

শুভেন্দু প্রশ্ন করল, ‘ও কাগজে কী লেখা ছিল তা জেনে তুমি ছাপ দিয়েছিলে?’

ভিখু বলল, ‘হ্যাঁ, জেনেই দিয়েছিলাম। ওরা বলেছিল ও কাগজে বাঁধ বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে। সরকারের ঘরে ও কাগজ জমা পড়বে।’

শুভেন্দু বলল, ‘বুঝতে পারছি তুমি সত্যিই খুব ভালোবাসো খলবলিকে। কিন্তু ওসব কাগজে সই করলে বিপদ হতে পারে।’

ভিখু তখন জবাব দিল, ‘আমার আর কী বিপদ হবে? আমার কেউ নেই, কিছুই নেই। থাকার মধ্যে ছিল এক ওই খলবলি। ছেলেগুলো বলছিল তারা আবার বাঁচিয়ে তুলবে খলবলিকে। এখন বুঝতে পারছি সে আর কোনোদিনই বাঁচবে না।’ কথাগুলো বলতে বলতে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল ভিখু।

সে চলে যাবার পর চায়ের কাপ নিয়ে শুভেন্দু বাইরে এসে বসল। সূর্য ঢলতে শুরু করেছে। গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে আবছা ভাবে নদীতটটা দেখা যাচ্ছে। কেমন যেন এক অদ্ভুত বিষণ্ণ পরিবেশ ছড়িয়ে আছে সামনের জমিটাতে।

একটা পাখির ডাকও নেই কোথাও। শুভেন্দুর মনকেও যেন একটা বিষণ্ণতা ঘিরে ধরতে শুরু করল। বেশ কিছুক্ষণ বারান্দাতে চুপচাপ বসে রইলো শুভেন্দু। অন্ধকার নামতে শুরু করল। অস্পষ্ট হয়ে যেতে লাগল চারপাশ। বারান্দা থেকে উঠে ঘরে ঢুকে পড়ল শুভেন্দু।

।। ছয়।।

আলো না জ্বালিয়ে অন্ধকার ঘরেই চুপচাপ শুয়ে নানা কথা ভাবছিল সে। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ বাড়ির বাইরে একটা গাড়ি এসে থামার শব্দ পেয়ে বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলল শুভেন্দু। ঠিকাদার মহেশ সিং-এর জিপ এসে দাঁড়িয়েছে। হুড খোলা জিপের পিছনটা জিনিসপত্রের বস্তায় ভর্তি। শুভেন্দু শুনল, গাড়ি থেকে নেমে মহেশ সিং তার ড্রাইভারকে বলছেন, ‘মালগুলো গুদামে রেখে দিয়ে তুই ওখানেই থাক। আমি তোকে ফোন করে ডেকে নেব।’

ড্রাইভার জিপ ঘুরিয়ে রওনা হয়ে গেল। আর মহেশ সিং বন্দুক কাঁধে হাতে একতাড়া কাগজ নিয়ে শুভেন্দুর দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন।

ঘরে পা রেখে মহেশ সিং মৃদু বিস্মিতভাবে বললেন, ‘ঘর অন্ধকার কেন স্যার! ভিখু আলো দেয়নি?’

তার কথার জবাব না দিয়ে শুভেন্দু দেশলাই দিয়ে লণ্ঠনটা জ্বালাল। তারপর সেটাকে টেবিলে রেখে টেবিল সংলগ্ন জানলাটা খুলল। পিছনের জমিটা ইতিমধ্যেই চাঁদের আলোয় ভর্তি হয়ে গেছে। আজ মনে হয় পূর্ণিমা। সেদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে শুভেন্দু ঘরের ভিতর দাঁড়িয়ে থাকা মহেশ সিংকে বলল, ‘আসুন এখানে বসুন।’

মহেশ সিং পিঠ থেকে বন্দুকটা খুলে বারান্দার দিকে দরজার কোণে দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে রাখলেন। তারপর টেবিলের সামনে এসে শুভেন্দুর মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসলেন। শুভেন্দুর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয় তার মুখের ভাব পাঠ করতে পারলেন ঠিকাদারবাবু। তিনি শুভেন্দুকে বললেন, ‘আপনাকে এত গম্ভীর দেখাচ্ছে কেন স্যার?’

শুভেন্দু বলল, ‘আপনি বিডিও সাহেবকে আমাকে দেওয়া ওদের সেই মেমোরেন্ডামের কাগজটা দেখিয়ে ঠিক করেননি। ওদের বাড়িতে পুলিশ গেছিল। আমি অন্যভাবে ব্যাপারটা হ্যান্ডেলিং করতাম।’

মহেশ সিং বললেন, ‘দেখুন স্যার, ওরা এসে কাল থেকে কাজ করতে দেবে না বলে গেছিল। বিডিও সাহেব যা করেছেন তা ঠিক করেছেন বলে আমার মনে হয়। একটা কথা বলি স্যার কিছু মনে করবেন না। আপনি বা বর্মনবাবু সরকারি লোক। বাঁধের কাজ চলুক বা বন্ধ হোক না কেন, মাস গেলে আপনারা বেতন পাবেন। কিন্তু কাজ বন্ধ হলে, কাজ না করলে সরকার আমাকে টাকা দেবে না। আমি ঠিকাদারি করে খাই। গত একমাস ধরে শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে হয়েছে, নিজের পকেট থেকে অর্ধেক মজুরিও দিতে হয়েছে। কাজ বন্ধ হলে আমার ক্ষতিই সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া অন্য একটা ব্যাপারও হয়েছে। তাতে একটু ঘাবড়ে গেছে শ্রমিকরা।’

শুভেন্দু জানতে চাইল, ‘কী ব্যাপার?’

কথাটা বলতে যাচ্ছিল মহেশ সিং। কিন্তু হঠাৎ একটা অস্পষ্ট শব্দ হল। বারান্দার দিকের দরজা দিয়ে ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে ভিখু। তাকে দেখে থেমে গেলেন মহেশ সিং। শুভেন্দু ভিখুকে বলল, ‘তুমি কিছু বলবে?’

ভিখু জবাব দিল, ‘না, সাহেব।’ কথাটা বলে দাঁড়িয়ে রইল ভিখু।

মহেশ সিং ভিখুকে বললেন, ‘তুমি এখন যাও। আমরা এখন কথা বলব।’

ভিখু তার কথা শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সে চলে যাবার পর মহেশ সিং বললেন, ‘আপনি খেয়াল করেছেন কিনা জানি না, ওই মেমোরেন্ডামের কাগজটাতে ভিখু রাজবংশী নামে একজনের টিপসই আছে। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি এ নামে এখানে অন্য কেউ নেই। টিপ সইটা সম্ভবত এই ভিখুরই। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ওর যোগাযোগ আছে। ওর সামনে কোনও কথাবার্তা না বলাই উচিত।’

শুভেন্দু কোনও মন্তব্য করল না তার কথায়। সে বলল, ‘শ্রমিকদের ব্যাপারে কী বলছিলেন যেন?’

মহেশ সিং বললেন ‘ও হ্যাঁ। কাল সকালে তো গার্ডের মুখে শুনেছিলাম যে, সে দেখেছিল একটা মেয়ে বাঁধের পিলারের উপর চড়ে বসেছিল। কাছে যেতেই সে উধাও হয়ে যায়! ওই মেয়েটাকে আবার কাল দেখা গেছে! মাঝরাতে একজন শ্রমিকের ঘুম ভেঙে যায়। সে তাদের চালা ঘরের খোলা দরজা দিয়ে দেখতে পায় একটা বাচ্চা মেয়ে চাঁদের আলোতে তাদের চালার কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে আছে! কিন্তু তাকে দেখে লোকটা চালার বাইরে আসতেই যেন মুহূর্তের মধ্যে বাতাসে মিলিয়ে যায় মেয়েটা! যেখানে মেয়েটা দাঁড়িয়েছিল সেখানে শুধু অনেকটা জল পড়ে আছে। এ ব্যাপারটা নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়েছে। কে যেন প্রচার করেছে যে ওই মেয়েটা আসলে জলদেবী। তিনি চান না বাঁধের কাজটা হোক। আমার মনে হয় এটা ওই আন্দোলনকারীদের চালাকি। এ ভাবে ওরা শ্রমিকদের ভয় দেখিয়ে কাজ বন্ধ করার চেষ্টা করছে। আমি ভেবেছি আজ সারারাত আমি জেগে বসে থাকব। বাচ্চা মেয়েটাকে যদি পাকড়াও করা যায় তবে ব্যাপারটা বোঝা যাবে। এতদিন পর আমার একটা কথা মনে পড়েছে। সান্যাল সাহেব তার মারা যাবার দিন কয়েক আগে একবার বলেছিলেন যে একটা বাচ্চা মেয়েকে তিনি নাকি এখানে নদীর পাড়ে মাঝে মাঝে দেখতে পান।’

কথাটা শুনে মৃদু চমকে উঠল শুভেন্দু। তবে সে খলবলি নামে সেই বাচ্চা মেয়েটা নাকি? যাকে নদীর পাড়ে দেখেছে শুভেন্দু।

ঠিকাদারবাবু এরপর শুভেন্দুকে বলল, ‘বাঁধের নক্সাটা আর কাল কীভাবে কাজ শুরু হবে তার পরিকল্পনার খসড়াও করে এনেছি আমি। আপনি একবার শুধু ওগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিন। যদি কিছু পরিবর্তন করার থাকে বলবেন। সেই মতো কাজ হবে।’

টেবিলের ওপর এরপর কাগজপত্র খুলে বসল শুভেন্দু আর মহেশ সিং। নকশা, কাগজের খসড়া ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা শুরু হল। বাইরে রাত আর চাঁদের আলো বাড়তে থাকল।

একঘণ্টা মতো সময় লাগল সব আলোচনা শেষ হতে। কাগজপত্র গুছিয়ে মহেশ সিং মোবাইল ফোন বার করে বললেন, ‘এবার জিপটাকে ডেকে নিই।’

কিন্তু ফোনটা করতে গিয়েও হঠাৎ জানলার বাইরে তাকিয়ে থেমে গেলেন তিনি। তার চোখমুখে কেমন একটা বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠল। আঙুল তুলে ইশারায় জানলার বাইরে ফাঁকা জমির এক অংশের দিকে দেখালেন তিনি।

শুভেন্দু সেদিকে তাকিয়ে দেখল চাঁদের আলোতে একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে একটা বাচ্চা মেয়ে। শুভেন্দু চিনতে পারল তাকে। খলবলি নদীর পাড়ের সেই বাচ্চা মেয়েটা। যার নামও খলবলি।

আর এরপরই চেয়ার থেকে উঠে ঘর ছেড়ে পেছনের বারান্দায় বেরোলেন মহেশ সিং। আর তার পেছনে শুভেন্দুও। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে মেয়েটাকে আর দেখতে পেল না। তারা। মুহূর্তের মধ্যেই গাছের নীচ থেকে মিলিয়ে গেছে সে!

বিস্মিতভাবে শুভেন্দু বলল, ‘মেয়েটা কোথায় গেল?’

মহেশ সিং বললেন, ‘নিশ্চয় ও নদীর দিকে পালিয়েছে। বাচ্চাটাকে ধরতে হবে। তাহলে বোঝা যাবে ব্যাপারটা। এ কথা বলে শুভেন্দুকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে এগিয়ে গিয়ে বারান্দা থেকে নিচে নেমে পড়লেন মহেশ সিং। তারপর এগোতে লাগলেন গাছগুলোর দিকে তাদের আড়ালে থাকা নদীর দিকে যাবার জন্য। অগত্যা শুভেন্দু বারান্দা থেকে নেমে অনুসরণ করল মহেশ সিংকে। মিনিটখানেকের মধ্যে’ই তারা পৌঁছে গেল নদীর পাড়ে। প্রথমে মহেশ সিং। আর তার কয়েক পা পিছনে শুভেন্দু।

আজ পূর্ণিমা। মাথার উপর বিরাট রুপোলি থালার মতো চাঁদ উঠেছে। জ্যোৎস্নাবিধৌত চরাচর। আর এখানেই তারা দেখতে পেল চাঁদের আলোতে দাঁড়িয়ে থাকা সেই বাচ্চা মেয়েটাকে। কিছুটা তফাতে নদীর কিনারে দাঁড়িয়ে মেয়েটা যেন হাসছে। শুভেন্দুর দিকে তাকিয়ে। তাকে দেখে প্রথমে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন মহেশ সিং। তারপর মেয়েটাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তোর নাম কী? এত রাতে এখানে কী করছিস? এদিকে আয়।’

প্রশ্ন শুনে মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, ‘আমি খলবলি।’

তবে সে মহেশ সিং এর ডাকে কাছে এল না। জলে নেমে এগোতে লাগল। এই দেখে মহেশ সিং নদীর কিনারে এসে দাঁড়ালেন। আর তার সঙ্গে সঙ্গে শুভেন্দুও। চাঁদের আলো খেলা করছে নদীর গোড়ালি সমান জলে। জলের দিকে তাকিয়ে শুভেন্দুর মনে হল চাঁদের আলোতে জলতল যেন নড়ছে। যেন মৃদু স্রোত বইছে নদীতে। অথচ কোনও বাতাস নেই, আর বাঁধের দিক থেকে জল ঢোকার তো কোনও প্রশ্নই নেই এই মরা নদীখাতে।

খুব শান্তভাবে ধীরে ধীরে জল ভেঙে নদীর বুকে গিয়ে দাঁড়াল সে। তার কিছু দূরে নদীর ওপর চাঁদের আলোতে জেগে আছে ধবধবে সেই পাথরটা। মেয়েটা ঘুরে দাঁড়াল নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা শুভেন্দুর দিকে। তারপর খলবলি খিলখিল করে হেসে উঠল। আর তার সাথেই যেন শুভেন্দুর পায়ের সামনে থাকা নদীর জল মৃদু ছলাৎ ছলাৎ শব্দে একটা ঢেউ তুলল। মহেশ সিং বলে উঠল, ‘উঠে আয়, পাড়ে উঠে আয় বলছি। নইলে কিন্তু জলে নেমে তোকে ধরে আনব।’

মেয়েটা আবারও খিলখিল করে হেসে উঠল। যেন সে বেশ মজা পেয়েছে মহেশ সিং-এর কথা শুনে। তারপর সে আঙুল তুলে দেখাল সেই সাদা পাথরটার দিকে। ভালো করে পাথরটার দিকে তাকিয়েই শুভেন্দু আর মহেশ সিং দুজনেই অবাক হয়ে গেল। পাথরটার ওপর রাখা আছে একটা বন্দুক!

বিস্মিত স্বরে মহেশ সিং বললেন, ‘আরে ওটা যে আমার বন্দুক! ঘর থেকে এখানে এল কিভাবে? নিশ্চয় আমরা যখন টেবিলে বসে কাজ করছিলাম তখনই ঘরে ঢুকে বন্দুকটা নিয়ে ওখানে গিয়ে রেখে এসেছিল! বাচ্চা হলেও কি সাংঘাতিক মেয়ে দেখেছেন!’

মহেশ সিং-এর কথা মেয়েটার কানে গেল কিনা জানা নেই, কিন্তু মেয়েটা আরও একবার হেসে উঠল। তারপর এগোল পাথরটার দিকে।

মেয়েটা পাথরটার দিকে দৌড়ে গেল। তারপর কোনও এক অদ্ভুত কৌশলে সেই গোলাকার পাথরটার ওপর উঠে দাঁড়াল। তার পায়ের সামনে রাখা আছে বন্দুকটা। মহেশ সিং এগোলেন পাথরটার দিকে। পাথরটার থেকে যখন তার হাত কুড়ি ব্যবধান তখন মেয়েটা হাসতে শুরু করল। না খিলখিল হাসি নয়, এ যেন অট্টহাস্য! শুভেন্দুর পায়ের সামনে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হতে শুরু হল। মেয়েটার হাসি যেন ঢেউ তুলেছে মরা নদীতে। মৃদু স্রোতের ঝাপটা যেন মহেশ সিং-এর পায়ে লাগল। কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে নদীর দিকে তাকালেন। তারপর আবার এগোলেন পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে। পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে শুভেন্দু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সবকিছু।

মহেশ সিং যখন প্রায় পাথরটার কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন তখন হাসি থামিয়ে দিল মেয়েটা। পাথরটার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মহেশ সিং আর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা শুভেন্দুর চোখের সামনেই মেয়েটার দেহ মুহূর্তের মধ্যেই পাথরটার মতোই ধবধবে সাদা হয়ে গেল, তারপর স্বচ্ছ রূপ ধারণ করল। যেন জলের তৈরি তার দেহ! আর তার পরেই তার দেহটা ভেঙে খানখান হয়ে গেল। একরাশ জল পাথরের ওপর থেকে এসে পড়ল মহেশ সিং-এর ওপর। তার আঘাতে পড়ে গেলেন মহেশ সিং। আর সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ থেকে জলস্রোত ছুটে আসতে লাগল মহেশ সিং যেখানে পড়ে গেলেন সে জায়গাতে।

শুভেন্দুর চোখের সামনে মহেশ সিং আর পাথরটাকে কেন্দ্র করে একটা জলস্রোত তৈরি হতে লাগল। শুভেন্দুর পায়ের সামনে থেকেও যেন জল ছুটে চলেছে সেই জলস্তম্ভের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই জলস্তম্ভের নীচে হারিয়ে গেল পাথরটাও। চাঁদের আলোতে নদীর বুকে দাঁড়িয়ে রইল এক অদ্ভুত জলস্তম্ভ। তারপর এক সময় সেটা আবার ধীরে ধীরে নীচে নামতে শুরু করল। তারপর একসময় মিশে গেল নদীর সঙ্গে।

শুভেন্দুর যখন হুঁশ ফিরল তখন নদীর জল আবার স্থির হয়ে গেছে। কোনও চঞ্চলতা নেই তার মধ্যে। মরা নদীর জলে তা থাকার কথাও নয়। চাঁদের আলোয় নদীর বুকে জেগে আছে সেই ধবধবে পাথরটা। খলবলি কোথাও নেই অথবা সে কোথাও আছে। তবে সাদা পাথরটার গায়ে স্বচ্ছ জলের ভিতর পড়ে আছে মহেশ সিং-এর দেহটা। শুভেন্দু বুঝে উঠতে পারছিল না সে যা প্রত্যক্ষ করল তা সত্যি না কল্পনা? তবে মহেশ সিং-এর দেহটা সে দেখতে পাচ্ছে। তিনি কি বেঁচে আছেন? শুভেন্দু জলে নামতে যাচ্ছিল তার কাছে যাবার জন্য। ঠিক এই সময় তার হাত টেনে ধরল কেউ। শুভেন্দু তাকিয়ে দেখল তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুড়ো ভিখু। শুভেন্দুকে সে বলল, ‘জলে নামবেন না। ওখানে গেলে সান্যাল সাহেবের মতো, ঠিকাদার সাহেবের মতো আপনিও বাঁচবেন না আর।’

শুভেন্দু বলল, ‘তবে যা দেখলাম তা কি সত্যি?’

ভিখু জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, যা দেখলেন সব সত্যি। তবে এ গল্প কাউকে করতে যাবেন না, আপনি যে এখানে এসেছিলেন সে গল্প করতে যাবেন না কাউকে। ব্যাপারটা বিশ্বাস করবে না কেউ। উল্টে বিপদ বাড়বে। ঠিকাদার সাহেবের লাশটা আমিই ভোরে এসে দেখতে পেয়েছি বলে জানাব। যেমন জানিয়েছিলাম সান্যাল সাহেবের বেলাতে। এবার ফিরে চলুন।’

শুভেন্দু বলল, ‘ওই খলবলি কে? যে আমাদের টেনে আনল এখানে?’

ভিখু বলল, ‘ওসব কথা পরে হবে। আগে ঘরে চলুন।’

শুভেন্দু ভিখুর কাঁধে ভর দিয়ে টলতে টলতে ফেরার পথ ধরল।

।। সাত ।।

রাত কেটে গিয়ে পরদিন ভোরের আলো যথা নিয়মে ফুটল। রাতে ঠিকাদার সাহেব তার ড্রাইভারকে ফোন না করাতে কাকভোরেই মহেশ সিং-কে নিতে জিপ নিয়ে হাজির হয়েছিল সে। ভিখু তাকে জানাল নদীর পাড়ে গিয়ে ঠিকাদার সাহেবের লাশ দেখেছে সে। তারপর পুলিশ চলে এল কিছুক্ষণের মধ্যে।

শুভেন্দু তাদের বলল, গত রাতে আলোচনার শেষে কাগজপত্র রেখে ঘর ছেড়েছিলেন মহেশ সিং। তিনি কোথায় যাচ্ছেন তা শুভেন্দুকে বলেননি। শুভেন্দুও তাকে সেটা জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন মনে করেননি। ভোরবেলা ভিখুর কাছেই সে খবরটা জেনেছে। এরপর সদলবলে সবাই রওনা হল নদীর দিকে।

নদীর পাড়ে পৌঁছোল সবাই। ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়েছে স্থির, অচঞ্চল মরা খলবলির বুকে। সেই সাদা পাথরটার নীচে জলের মধ্যে পড়ে আছে মহেশ সিং-এর লাশটা। আর পাথরটার ওপর রয়েছে তার বন্দুকটা। কয়েকজন পুলিশ কর্মী জলে নেমে মহেশ সিং-এর দেহটা আর বন্দুকটা উদ্ধার করে আনল। নদীর পাড়ে শোয়ানো হল সেই মৃতদেহটাকে। তার দেহে কোনও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেল না। শুধু তার খোলা চোখ দুটোতে যেন অপার বিস্ময় জেগে আছে। এরপর ঠিকাদার সাহেবের মৃতদেহ নিয়ে থানার দিকে এগোল সবাই। স্বাভাবিক ভাবেই শুভেন্দুও তাদের সঙ্গী হল।

প্রথমে থানায় যেতে হল শুভেন্দুকে। তারপর সেখান থেকে হেড অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ। তারা শুভেন্দুকে ফিরে আসার নির্দেশ দিল। সব শেষে বিকালের দিকে বাঁধের কাছে যেতে হল তাকে। ঠিকাদার সাহেব মারা গেছে অতএব এখন আর কাজ হবে না। ব্যাপারটা সরকারিভাবে তাদের জানিয়ে দিল শুভেন্দু। বর্মনবাবুর মাধ্যমে রাতের ট্রেনে কলকাতায় ফেরার টিকিটের ব্যবস্থাও করতে হল তাকে। এসব করতে করতেই সারাদিন কেটে গেল। একটা গাড়ি যখন শুভেন্দুকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে গেল তখন তার অনেক আগেই অন্ধকার নেমে গেছে। এ গাড়িটাই আবার ঘণ্টাখানেক বাদে ফিরে এসে শুভেন্দুকে রেল স্টেশনে পৌঁছে দেবে। রাত নটায় ট্রেন।

বাড়িতে ঢুকে বার কয়েক হাঁক দিয়েও ভিখুর দেখা মিলল না। লণ্ঠন জ্বালিয়ে নিয়ে সে গোছগাছ শুরু করল। তারপর স্নান সেরে শুকনো খাবার খেয়ে পোশাক পরে সে তৈরি হয়ে নিল। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি আসবে তাকে নিতে। হঠাৎ বাঁশির শব্দ শুনতে পেল শুভেন্দু। ভিখুর বাঁশির সুর। অদ্ভুত এক সুরে আজ সে বাঁশি বাজাচ্ছে!

সেই বাঁশি শুনে ঘর ছেড়ে বারান্দায় বেরিয়ে এল শুভেন্দু। জমিটার শেষপ্রান্তে গাছগুলো যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে ভিখু। কিন্তু আজও সে শুভেন্দু বারান্দাতে গিয়ে দাঁড়াতেই বাঁশি থামিয়ে দিল। তারপর ধরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল বারান্দার দিকে।

তাকে আসতে দেখে শুভেন্দু এগিয়ে গেল বারান্দার শেষ প্রান্তে আগলহীন যে প্রান্ত দিয়ে নীচের জমিটায় নামা যায় সেখানে। ভিখু এসে দাঁড়াল সেখানে। চাঁদের আলো এসে পড়েছে ভিখুর বলি রেখাময় মুখে। অদ্ভুত রুপোলি দেখতে লাগছে তার শনের মতো চুল। ভিখু বুড়ো শুভেন্দুকে বলল, ‘আপনি চলে যাচ্ছেন, ভালো করছেন। আপনি এখানে থাকলে সে আপনাকেও ছাড়বে না। সে প্রতিশোধ নেবে আপনার ওপরও। আপনাকেও ঠিক ও কোনওভাবে টেনে নিয়ে যাবে ওই পাথরের কাছে…।’

শুভেন্দু প্রশ্ন করল, ‘কে? ওই খলবলি নামের বাচ্চা মেয়েটা?’

বুড়ো ভিখু জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, সে।’

শুভেন্দু বলল, ‘ঠিকাদার সাহেবের বন্দুকটা পাথরের ওপর গেল কিভাবে? তুমি কি তাকে বন্দুকটা ঘর থেকে নিয়ে দিয়েছিলে?’

ভিখু বলল, ‘না, সে নিজেই ঘরে ঢুকে বন্দুকটা নিয়েছিল। সে তখন জলের মতো, কাঁচের মতো হয়ে গেছিল বলে আপনারা তাকে খেয়াল করেননি। আমি আপনার খাবার দিতে বারান্দায় উঠে চাঁদের আলোতে তার পায়ের ছাপ দেখতে পাই কাল রাতে। তারপর আপনাকে ঘরে না দেখে ব্যাপারটা অনুমান করে নদীর তীরে যাই।’

শুভেন্দু তাকে প্রশ্ন করল, ‘তুমি বাঁশি বাজিয়ে ডেকে আনোনি তো তাকে? তুমি বলেছিলে চাঁদনি রাতে তোমার বাঁশির সুরে খলবলি নাচত।’

ভিখু বলল, ‘না, বরং আমি করুণ সুরে বাঁশি বাজিয়ে খলবলিকে এ জায়গা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম। করুণ সুর মোটেও পছন্দ করে না সে। আমার বাঁশির আনন্দ-সুরে চাঁদনি রাতে যে নদীতে ঢেউ তুলত সে জীবন্ত খলবলি।’

শুভেন্দু বলল, ‘ওই খলবলি নামের বাচ্চা মেয়েটা কে?’

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বুড়ো ভিখু জবাব দিল, ‘ও তো খলবলি। খলবলি নদী। মানুষের প্রাণ আছে নদীরও তো প্রাণ আছে। তাই মানুষ অপঘাতে মরলে যেমন প্রেত হয়, তেমনি নদী মরলেও প্রেতনী হয়। বাঁধ দেওয়া হলে অপঘাতে মরে খলবলিও প্রেতনী হল। তবে আজও তাকে আমি ভালোবাসি। জীবিত হোক বা মৃত, সে তো আমার মেয়েই।

বুড়ো ভিখুর কথা শুনে শুভেন্দুর চোখে ফুটে উঠল গত রাতের সেই দৃশ্যটা— চাঁদের আলোতে নদীর বুকে জেগে থাকা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা খলবলির দেহটা প্রথমে পাথরের মতো সাদা হয়ে গেল! তারপর সে জলের মতো স্বচ্ছ হল! আর তারপর সেই জলমূর্তি ভেঙে পড়ল ঠিকাদার মহেশ সিং-এর ওপর! খলবলির দেহটা জল হয়ে মিশে গেল খলবলির সাথে!

দৃশ্যটা মনে হতেই কেঁপে উঠল শুভেন্দু। তারপর বাড়ির সামনে গাড়ির শব্দ শোনা গেল। এ বাড়ি ছেড়ে এবার ফিরতে হবে শুভেন্দুকে। ঘরে ফিরে কাগজপত্র নিয়ে সে যখন গাড়িতে উঠে বসল তখন সে শুনতে পেল বাড়ির পেছন দিক থেকে বুড়ো ভিখুর বাঁশির সুর এগিয়ে চলেছে খলবলির দিকে। বুড়ো ভিখুর বাঁশির অদ্ভুত সুর খলবলিকে কী বলছে শুভেন্দুর তা জানা নেই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *