ক্লাস সেভেনের কালীপদ – প্রচেত গুপ্ত

ক্লাস সেভেনের কালীপদ – প্রচেত গুপ্ত

সব স্কুলেরই একজন করে বোকাসোকা, খ্যাপাটে ধরনের ছেলে থাকে। এরা লেখাপড়া তেমন পারে না। ফেল করা এদের কাছে সহজ ঘটনা। তা নিয়ে এদের তেমন দুশ্চিন্তাও থাকে না। পরীক্ষায় ফেল করলে এরা যতটা না লজ্জা পায়, পাস করলে তার চেয়ে বেশি লজ্জা পায়! খাতা হাতে সকলের দিকে তাকিয়ে এমনভাবে হাসে, যেন পাস করে বড়ো কোনো অন্যায় করে ফেলেছে! মুশকিলের ব্যাপার হল, এই ধরনের ছেলে মাঝেমধ্যেই নানারকমের অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটায়। সেই কাণ্ড দেখে সন্দেহ হয়, ছেলে কি সত্যি বোকা? নাকি অন্য কোনো ব্যাপার আছে?

আমাদের স্কুলে এই বোকাসোকা খ্যাপাটে ধরনের ছেলের নাম ছিল কালীপদ। পড়ত আমাদের সঙ্গে, ক্লাস সেভেনে। আজকালকার দিনে স্কুলে চট করে ‘কালীপদ’ নাম পাওয়া যাবে না। সেই সময় পাওয়া যেত। কালীপদকে আমরা ডাকতাম ‘কালী’ বলে। ‘কালী’ শুনলেই মনে হয় গায়ের রং কালো। কালীপদ মোটেই কালো ছিল না। বরং বেশি ফরসাই ছিল। তবে স্কুলে আসত উসকোখুসকো হয়ে। ময়লা জামা-প্যান্ট, কাদা-লাগা জুতো, এলোমেলো চুল। বেশিরভাগ দিনই প্যান্টের মধ্যে জামা গুঁজতে ভুলে যেত। পিছন দিকে খানিকটা ঝুলে থাকত। জুতোর ফিতে থাকত খোলা। সাদা মোজাগুলোকে সাদা বলে চেনাই যেত না। পিঠের বদলে ব্যাগ হাতে চেপে ধরে ব্যস্ত সমস্ত হয়ে স্কুলে ঢুকত কালীপদ। রোজই মনে হত, শেষরাত থেকে বিস্তর লেখাপড়া করছে, তাই সকালে স্কুলের জন্য ঠিকমতো তৈরি হওয়ার ফুরসত পায়নি। যদিও মাস্টারমশাইরা যখন পড়া ধরতেন তখন উঠে দাঁড়িয়ে খুব মনোযোগের সঙ্গে বাঁ-হাত দিয়ে মাথা চুলকোত।

সেবার হাফইয়ারলি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর পর অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল।

দুম করে একদিন দেখি, কালীপদ একেবারে ফিটফাট হয়ে গিয়েছে। ইস্ত্রি করা জামা-প্যান্ট পরেছে। জুতো ব্রাশ করেছে। পাটপাট করে চুল আঁচড়ানো। কানের পাশ দিয়ে একটু-একটু তেলও গড়াচ্ছে। গা থেকে ভুরভুর করছে সাবানের গন্ধ। মনে হচ্ছে, তিনদিনের সাবান একদিনেই মেখে এসেছে।

হাঁটাচলার ভঙ্গির মধ্যেও একটা বদল। ধীরস্থিরভাবে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। টোকা দিয়ে-দিয়ে জামার ধুলো ফেলছে। মাঝে-মাঝে ব্যাগ থেকে কাপড়ের ঠুকরো বের করে জুতোর কাদা মুছছে। দেখলাম, পকেটে করে দাঁত-ভাঙা একটা ছোট্ট চিরুনিও এনেছে। ফাঁক পেলে ঝট করে চুলে বুলিয়ে নিচ্ছে। খেলাধুলো করলে পাছে জামা-প্যান্ট নোংরা হয়ে যায়, এই কারণে স্কুলের মাঠে যাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিল কালীপদ। সবমিলিয়ে যাকে বলে বাড়াবাড়ির চূড়ান্ত। আমরা অবাক হয়ে গেলাম। ছেলেটার হল কী!

প্রথমে ভাবলাম, ব্যাপার একদিনের। একদিনেই ওর ধোপদুরস্ত সাজবার নেশা কেটে যাবে। কিন্তু ঘটনা একদিনের বদলে দু-দিন হল। দু-দিন থেকে তিনদিন, চারদিন, এমনকী, সাতদিন পর্যন্ত গড়াল! এবার আমরা চিন্তিত হয়ে পড়লাম। নিশ্চয়ই সাংঘাতিক কিছু একটা হয়েছে। নইলে ছেলেটো হুট করে এতখানি পালটে যাবে কেন? প্রথমে নিজেরাই খোঁজখবর নিলাম। জানা গেল, হাফইয়ারলি পরীক্ষায় মোট চার বিষয়ে ফেল করেছে কালীপদ। এ আর এমন কী? সব বিষয়ে ফেল করার অভিজ্ঞাতাও তার আছে। পাস-ফেল নিয়ে তাকে কখনও মাথা ঘামাতে দেখিনি। তা ছাড়া মাথাই যদি ঘামাবে লেখাপড়া নিয়ে ঘামাবে, সাজগোজ নিয়ে ঘামাবে কেন?

এদিকে প্রায় রোজই স্কুলে লেট হতে লাগল কালীপদর। ক্লাসটিচার বিমানবাবুর নিয়ম ছিল, যতক্ষণ লেট তার ডবল সময় ক্লাসরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কালীপদকেও দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তবে এতে তার কোনো সমস্যা হল না। বরং ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে তার সুবিধে হচ্ছে বলেই মনে হল। জামা-প্যান্টে বেঞ্চের ধুলোবালি লাগছে না।

আটদিনের মাথায়ও আমরা আর পারলাম না। কালীপদকে ধরলাম।

আমি বললাম, ‘আজও দেরি করলি যে বড়ো! কী হয়েছিল তোর?’

কালীপদ গম্ভীর গলায়. বলল, ‘মোজা ভিজে ছিল।’

মানস বলল, ‘মোজা ভিজে ছিল বলে লেট করলি?’

কালীপদ বলল, ‘মোজা ভিজে ছিল বলে লেট করিনি। লেট করেছি ফ্যানের জন্য। আমাদের শোবার ঘরের ফ্যানে গোলমাল আছে।’

ঋজু চোখ কপালে তুলে বলল, ‘শোবার ঘরের ফ্যান! তুই কি স্কুলে আসার সময় ফ্যান মেরামত করছিলি?’

কালীপদ এমনভাবে ঋজুর দিকে তাকাল, যেন এই প্রশ্নের কোনো মানেই হয় না। অন্য কেউ হলে উত্তর দিত না, নেহাত এক ক্লাসে পড়ে, তাই দিচ্ছে।

‘না, ফ্যান মেরামত করিনি। ফ্যানের হাওয়ায় ভেজা মোজা শুকোচ্ছিলাম। খাটের উপর টুল পেতে, তার উপর দাঁড়িয়ে মোজা জোড়া ফ্যানের দিকে তুলে ধরেছিলাম। বললাম তো, ফ্যানটায় গোলমাল আছে। ঠিকমতো হাওয়া হয় না। হলে তাড়াতাড়ি মোজা শুকোত, আমারও দেরি হত না।’

উজ্জ্বল হাসি চেপে বলল, ‘স্কুলে আসার আগেই মোজা শুকোতে হল! অন্য কোনও সময় পেলি না?’

কালীপদ অবাক গলায় বলল, ‘বাঃ, ভিজে মোজা পরে আসব কী করে? মোজা কাচতে হল যে!’

সায়ন বলল, ‘সকালবেলায় মোজা কাচতে হল কেন?’

কালীপদ বলল, ‘সকালে নয়, ঠিক স্কুলে আসার সময় কাচতে হল। জুতো পরতে গিয়ে দেখলাম, মোজায় কালো দাগ। তখন ধুয়ে নিলাম।’

আমি বললাম, ‘একদিন না-হয় মোজার দাগ নিয়েই চলে আসতিস। আমাদের অনেকেরই তো মোজার অবস্থা খুব খারাপ। আমারটাই দ্যাখ না, কী হাল হয়েছে!’

কালীপদ সিরিয়াস মুখ করে বলল, ‘দুঃখিত, সেটা পারব না।’

কথা শেষ করে নিজের পেটের কাছে হাত বুলিয়ে-বুলিয়ে জামার ইস্ত্রি ঠিক করতে লাগল কালীপদ।

তমাল এবার চোখ সরু করে বলল, ‘হ্যাঁ রে, তোর কী হয়েছে ঠিক করে বল দেখি কালী? হঠাৎ করে সাজগোজের এত ঘটা শুরু করেছিস কেন? এটা স্কুল না বিয়েবাড়ি?’

কালীপদ মাথা গোঁজ করে বলল, ‘আমাকে স্যার বলেছেন।’

তমাল বলল, ‘স্যার বলেছেন? স্যার তোকে সেজেগুেজে স্কুলে আসতে বলেছেন? কোন স্যার?’

কালীপদ প্রথমটায় চুপ করে রইল, তারপর আমাদের চাপাচাপিতে যা বলল, তা ভয়ানক বললে কম বলা হয়, বলা যায় অতিভয়ানক।

হাফইয়ারলির ভূগোল পরীক্ষায় সে প্রথমে পেয়েছিল শূন্য। তার পরেও পাঁচ নম্বর কাটা হয়েছে খাতা নোংরা করার জন্য। ভূগোলস্যার শশাঙ্কবাবুর এটাই নিয়ম। তিনি অপরিষ্কার খাতা মোটেও বরদাস্ত করেন না। খাতায় বিচ্ছিরি কাটাকুটি, খারাপ হাতের লেখা, কালি ধেবড়ানো দেখলেই নম্বর কেটে নেন।

আমরা ভয়ে-ভয়ে থাকি। উত্তর ঠিক করেও নম্বর কাটা গেলে খুব দুঃখের ব্যাপার হত। তার উপর শশাঙ্কস্যারের ছিল ভীষণ খুঁতখুঁতুনি। পরিষ্কারের ব্যাপারে মন ভরত না কিছুতেই। যতই সাবধানে থাকি না কেন, এক-দু-নম্বর হারাতেই হত। কিন্তু কিছু বলতেও পারতাম না। কালীপদর নম্বর কাটার ফলে ভূগোলে সেবার সে পেল শূন্যর চেয়েও কম। মাইনাস ফাইভ। ক্লাস সেভেনের ভূগোল পরীক্ষায় এটা একটা রেকর্ড নম্বর। শূন্য হয়েছে, কিন্তু কখনও মাইনাস নম্বর হয়নি। কালীপদকে টিচার্সরুমে ডেকে পাঠান শশাঙ্কবাবু। প্রথমে রেকর্ড নম্বর পাওয়ার জন্য পিঠ চাপড়ে অভিনন্দন জানান। তারপর কান মলে দিয়ে বলেন, ‘একেই তো একটা উত্তরও ঠিক লিখিসনি, তার উপর খাতার অবস্থা যাচ্ছেতাই করে রেখেছিস। ম্যাপ পয়েন্টিং করতে গিয়ে যেভাবে কালি মাখিয়েছিস, তাতে পাঁচ কেন, আমার দশ নম্বর কেটে রাখা উচিত ছিল। পরেরবার তাই দেব। মাইনাস টেন পাবি। তুই যেমন নোংরাভাবে থাকিস, তোর পরীক্ষার খাতাও তেমন নোংরা। নিজে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না-হলে পরীক্ষার খাতাও কোনোদিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হবে না। মনে রাখিস কালীপদ, পরীক্ষায় ফেল করলে যতটা না বিপদে পড়বি, এভাবে মাইনাস নম্বর পেতে থাকলে তার চেয়ে অনেক বেশি বিপদে পড়বি। কেটে রাখা নম্বর এত বেশি হয়ে যাবে যে, দশটা পরীক্ষাতেও শোধ করতে পারবি না। এখনই সাবধান হ।’

কালীপদ নাকি তখন কাঁচুমাচু মুখে বলেছিল, ‘ঠিক আছে স্যার। তাই হব।’ এর পরেই সাবধান হয়েছে কালীপদ।

ফিটফাট থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্কুলের জামাকাপড়, জুতো-মোজা নিয়ে ভীষণরকম ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। রাতে ইস্ত্রি করা জামা আবার নিজেই ইস্ত্রি করছে। বাড়িতে বকাবকি করবে বলে লুকিয়ে করছে। ইলেকট্রিক ইস্ত্রি চালাতে গিয়ে একদিন হাতে ছ্যাঁকা খেয়েছে।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই পড়েছে জুতো নিয়ে। চকচকে হওয়ার পরও মন ভরছে না। আবার ব্রাশ ঘষছে। স্নানের সময় তেল-সাবান মাখতে বাথরুমেই কাটাচ্ছে আধঘন্টা। এর পরেও লেট নাহয়ে উপায় কী? শুধু লেট নয়। পরিচ্ছন্ন হতে গিয়ে তার লেখাপড়া একেবারে শিকেয় উঠেছে। যা-ও একটু-আধটু পড়ত, তাও বন্ধ। মাস্টারমশাই পড়া জিজ্ঞেস করলে আগে একহাতে মাথা চুলকোত, এখন দু-হাতে চুলকোয়।

স্কুলে এই ঘটনা রটে যেতে বেশি সময় লাগল না। সবাই জেনে গেল, পরীক্ষার খাতা পরিচ্ছন্ন রাখতে কালীপদ ভূগোলস্যারের আদেশ অক্ষরে-অক্ষরে পালন করছে। নিজেকে আগে পরিষ্কার করছে। ফলে রোজই স্কুলে লেট।

লেখাপড়া বন্ধ। ঘটনা ভূগোলস্যারের কানেও গেল। তিনি কালীপদকে আবার ডেকে পাঠালেন। ডেকে পাঠিয়ে কী বললেন আমরা জানি না। তবে দেখলাম, পরদিন থেকে কালীপদ আবার আগের চেহারায় ফিরে এল। যাকে বলে স্বমূর্তিতে। উসকোখুসকো চুল। আধময়লা জামা। কাদা-মাখা জুতো। তাকে জিজ্ঞেস করায় সে কিছু বলল না। শুধু বোকা-বোকা মুখে মিটিমিটি হাসতে লাগল। শশাঙ্কবাবু অবশ্য সেই থেকে নম্বর কাটার নিয়ম তুলে দিলেন। তিনি আর কোনোদিন মাইনাস নম্বর দেননি।

মানস বলেছিল, ‘কালীর কাণ্ডটা দেখলি? শশাঙ্কস্যারকে কেমন ম্যানেজ করল! আমাদের সকলরেই উপকার হল।’

আমি বললাম, ‘দুর, ওর এত বুদ্ধি হবে কী করে?’

সুজয় বলল, ‘এই ধরনের ছেলের এটাই তো সুবিধে। বাইরের বোকা আর খ্যাপাটে ভাবটা দেখা যায়, ভিতরের বুদ্ধিটা চট করে কেউ জানতে পারে না। সেটা গা-ঢাকা দিয়ে থাকে।’

কালীপদর মাথায় সত্যি বুদ্ধি লুকিয়ে থাকে কিনা তখনই বলতে পারিনি, তবে নানান রকম উদ্ভট পরিকল্পনা আছে, সেটা হামেশাই বুঝতে পারতাম। দু-একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।

আমাদের ক্লাসের সৌম্য অঙ্কে ছিল ভয়ংকর। আমরা তাকে ডাকতাম ‘অঙ্ক-সৌম্য’ বলে। অঙ্কে ফুল মার্কস পাওয়া তার বদখত অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে ওঠার সময় একশোর মধ্যে সাতানব্বই পেয়ে মারাত্মক কান্নাকাটি শুরু করল।

মাস্টারমশাইয়রা বললেন, ‘তুমি তো ভালো নম্বর পেয়েছে। কান্নাকাটির কী হল?’

সৌম্য বলল, ‘বুঝতে পারছি স্যার। কিন্তু থামতে পারছি না।’

চন্দন দাঁত বের করে বলল, ‘তুই সাতানাব্বই পেয়ে কাঁদছিস, আর আমাকে দ্যাখ, সাঁইত্রিশ পেয়ে কেমন হাসছি। পা তো করেছি!’

সৌম্য চোখের জল মুছতে-মুছতে বলল, ‘দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু…।’

একটু পরে অঙ্ক-সৌম্য হেঁচকি তুলতে শুরু করল। আমরা ছুটলাম জল আনতে। কিন্তু জল খাইয়ে হেঁচকি থামাতে পারলাম না।

শুভ্র বলল, ‘জলে কাজ হবে না। মাথায় বাতাস কর।’

আমরা হাতের কাছে যে যা পেলাম তাই নিয়ে সৌম্যর মাথায় বাতাস করতে লাগলাম। ইতিহাসের খাতা, ভূগোলের ম্যাপ, বাংলা ব্যাকরেণের বই, কিচ্ছু বাদ দিলাম না। তাতেও লাভ হল না।

কালীপদ একটু দূরে একটা বেঞ্চের উপর বসে ঘটনা দেখছিল আর পা নাড়ছিল। এবার আমাদের ঠেলে এগিয়ে এল। বলল, ‘ইতিহাস, ভূগোল চলবে না। অঙ্কের খাতা-বই চাই।’

আমরা রেগে গিয়ে বললাম, ‘সে কী! হেঁচকির সঙ্গে অঙ্কের কী সম্পর্ক?’

কালীপদ আমাদের রাগকে পাত্তা না-দিয়ে বলল, ‘অঙ্কের কারণে হেঁচকি, তাই অঙ্কখাতার বাতাস দরকার। মেলা বকবক না-করে যা বলছি তাই করা দেখি।’

আমরা বাধ্য হয়ে তাই করলাম। আমি ক্লাসওয়ার্কের চার নম্বর খাতা দিয়ে হাওয়া করলাম। প্রবুদ্ধ হোমওয়ার্কের বারো নম্বর বাঁধানো খাতা দিয়ে হাওয়া করল। আশ্চর্যের ব্যাপার হল,

অঙ্কখাতার বাতাসে সৌম্যর হেঁচকি সত্যি-সত্যি থেমেও গেল! আমাদের অঙ্কের মাস্টারমশাই রেবতীস্যার খুবই নার্ভাস হয়ে পড়েছিলেন। তিনি চেয়ারে বসে রুমাল দিয়ে ঘনঘন কপাল থেকে ঘাম মুছছিলেন। সৌম্য খানিকটা সুস্থ হলে তিনি আর দেরি করলেন না।

পরীক্ষায় খাতায় নম্বর বাড়িয়ে, একশোয় একশো করে দিয়ে বললেন, ‘ঝুঁকি নিয়ে দরকার নেই। হেঁচকি যদি আবার ফিরে আসে!’

হেঁচকি এমনিতেই থেমে যেত।

অঙ্কখাতার বাতাস না-দিলেও থামত। তবু আমরা কালীপদকে বাহবা জানালাম। সে লজ্জা-লজ্জা মুখ করে বলল, ‘এতে বাহবা দেওয়ার কী আছে? একবার ছোটকার থাপ্পড়ে আমার দাঁতকপাটি লেগে গেল। ডাক্তারবাবুকে খবর দিতে, তিনি বললেন, ‘আর-একটা থাপ্পড় দিন, দাঁতকপাটি খুলে যাবে!’

‘ছোটকা আর-একটা থাপ্পড় দিল, আমিও ঠিক হয়ে গেলাম। এখানেও তাই হয়েছে।’

কালীপদর একটা বড়ো কাণ্ডের কথা বলে তার গল্প শেষ করব।

আমাদের হেড়ডমাস্টারমশাই জগদীশ পাঠক ছিলেন একজন নামি রাগি মানুষ। হুংকার, চোখরাঙানি, থাপ্পড় এবং কানমলায় তিনি আশপাশের চার-পাঁচটা স্কুলের মধ্যে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ‘সেরা স্কুল’, ‘সেরা ছাত্র’, ‘সেরা শিক্ষক’দের জন্য নানারকম পুরস্কার আছে, কিন্তু ‘সেরা রাগি হেডমাস্টারমশাই’দের জন্য কোনো পুরস্কার নেই। থাকলে তিনি অবশ্যই সেই পুরস্কার পেতেন। কে জানে, হয়তো আমাদের স্কুলে সেই উপলক্ষ্যে একদিন হাফ ছুটিও হয়ে যেত।

জগদীশবাবুর রাগের বিশেষত্ব হল, তিনি কোনো কারণ ছাড়াই রাগতে পারতেন। ছেলেরা গোলমাল করলে যেমন বকাঝকা করতেন, তেমনই চুপ করে থাকলেও হুংকার দিতেন। এ ছাড়াও তাঁর একটা হাত-পা ঠান্ডা করে দেওয়া স্বভাব ছিল। হুটহাট যাকে খুশি ধরে কঠিন-কঠিন বাংলা, ইংরেজি বানান আর ইতিহাসের সাল-তারিখ জিজ্ঞেস করতেন। কখন কাকে ধরবেন, বোঝা যেত না। ক্লাসরুমে ঢুকেও ধরতে পারেন, আবার বারান্দাতেও ধরতে পারেন। টিফিনের সময়ও বাদ যেত না। এমনকী, খেলতে যাওয়ার পথেও পাকড়াতেন। ফুটবল হাতে শেরশাহের জন্মতারিখ বলতে হত। না পারলে গাট্টা। পারলে কানমলা দিয়ে চোখপাকিয়ে বলতেন, ‘সহজ বলে পারলি!পরেরদিন শক্ত একটা ধরব। না-পারলে মজা বুঝবি।’

সেই ছেলে পেটব্যথার নাম করে দু-দিন স্কুলে আসত না। সবমিলিয়ে বলা যেতে পারে হেডমাস্টারমশাইয়ের ভয়ে গোটা স্কুল একেবারে তটস্থ হয়ে থাকত।

তাকে দেখলে ছেলেদের মুখ শুকিয়ে এইটুকু হয়ে যেত। শেষের দিকে আর তাঁর কটমট করা চোখ দেখতে হত না, পায়ের আওয়াজ শুনলেই কাজ হত।

ক্লাসে-ক্লাসে ছেলেরা বেঞ্চের আড়ালে গা-ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করত। যারা বাইরে থাকত, তারা ক্লাসের দিকে ছুটে পালাতে চেষ্টা করত। যারা পালাতে পারত না, তারা গুটিগুটি পায়ে হাঁটত এবং বিড়বিড় করে পড়া মুখস্থ বলত।

ভূগোল, ইতিহাস, বিজ্ঞান যা মনে আসত, তাই বলত। মানুষ যেমন বিপদে পড়লে ভাগবানের নাম জপে, ছেলেরা তেমন পড়া জপত।

একদিন আমাদের বাংলাস্যার কামাই করলেন। খবর পেলাম, রিকশা থেকে নামতে গিয়ে পা মচকে গিয়েছে। আমরা বাংলা ক্লাসে মহানন্দে দাপিয়ে বেড়াচ্ছি।

কেউ বুক-ক্রিকেট খেলতে বসে গিয়েছে। কেউ বেঞ্চ টপকানো প্র্যাকটিস করছি। কেউ আবার কাগজের বল বানিয়ে লোফালুফি করছি। এমন সময় হেডমাস্টারমশাই ঘরে ঢুকে পড়লেন। আমাদের তো দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। সকলের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তিনি হুংকার দিয়ে বললেন, ‘কী ক্লাস?’

আমরা কোনোরকমে ঢোক গিলে বললাম, ‘বাংলা।’

জগদীশবাবু চোখ বড়ো করে বললেন, ‘বাংলায় আজ কী পড়ার কথা? গদ্য না পদ্য? নাকি ব্যাকরণ?’

সায়ন কাঁপতে-কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘রচনা, স্যার!’

‘ভেরি গুড! তা কোন-কোন রচনা তোমাদের পড়া হয়েছে?”

বিবেক বড়ো করে শ্বাস টেনে বুকে বল আনল। তারপর বলল, ‘অনেক ক-টা স্যার। ‘আমার পছন্দের কবি’, ‘আমার পছন্দের গ্রাম’, ‘আমার পছন্দের ভ্রমণ’, ‘আমার পছন্দের দেশনেতা’, আমার পছন্দের খেলা’…।’

জগদীশবাবু হাত তুলে বিবেককে ধমক দিলেন, ‘চুপ করো! পছন্দের তো অনেক হয়েছে দেখছি। অপছন্দের কিছু হয়নি?’

বিবেক ঘাবড়ে বিষমটিষম খেয়ে একটা কাণ্ড করল। জগদীশবাবু সেদিকে না-তাকিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাদের রচনা লিখতে দেব। নাও, খাতা বের করো। দেখি, কেমন শিখেছ! তবে আজ আর পছন্দের নয়, আজ লিখতে হবে…।’ কথা শেষ করে ব্ল্যাকবোর্ডে ঘসঘস করে চক দিয়ে লিখলেন, ‘আমার অপছন্দের মানুষ’।

খাতা বের করলেও আমাদের মাথায় বাজ পড়ল। এ আবার কেমন বিষয়! এই রচনা কীভাবে লিখব! আমাদের সিলেবাস পছন্দে ঠাসা। এতদিন আমরা তা-ই শিখেছি। মুখস্থও আছে খানদশেক। ‘অপছন্দ’ লিখব কেমন করে? তাও আবার যে-সে ‘অপছন্দ’ নয়, একেবারে ‘অপছন্দের মানুষ’!

ক্লাসরুম নিস্তব্ধ। ইংরেজিতে প্রবাদ আছে ‘পিন ড্রপ সাইলেন্স’। যার মানে হল, আলপিন পড়লেও আওয়াজ শোনা যাবে। কিন্তু জগদীশবাবুর কারণে মনে হল, সেদিন আলপিনও আওয়াজ করে পড়তে সাহস পাচ্ছিল না। আমরা হাত কামড়াতে লাগলাম। কেউ খাতার সাদা পাতার দিকে তাকিয়ে রইলাম ফ্যালফ্যাল করে। কেউ আবার মাথার চুল খামচাতে লাগলাম। সায়নের দিকে তাকালাম আড়চোখে। সে ফার্স্টবয়। প্রশ্ন যতই কঠিন হোক, সবসময়ই তার হাত খাতার উপর দিয়ে ঝড়ের বেগে ছোটে। মনে হয়, লিখছে না, ফাঁকা রাস্তা দিয়ে যেন সাইকেল ছোটাচ্ছে! সেই সায়নকেও দেখলাম, মাথা চুলকোচ্ছে! যে বাংলাস্যারের পা মচকানোর কারণে আমরা একটু আগে আনন্দ করছিলাম। এখন তাঁর জন্যই চোখ ফেটে জল আসার জোগাড় হল! উনি যদি আজ আসতেন, এই বিপদে আমরা পড়তাম না।

এই রকম একটা ভয়ংকর সময় হঠাৎ শুনি, কালীপদর গলা। মুখ ফিরিয়ে দেখি, কালীপদ উঠে দাঁড়িয়েছে।

হেডমাস্টারমশাই আমাদের বিপদে ফেলে চেয়ারে বসে পা নাচাচ্ছিলেন। কালীপদর উঠে দাঁড়ানোয় ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কী হয়েছে?’

কালীপদ কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘স্যার, একটা কথা বলব?’

হেডমাস্টারমশাই ধমক দেওয়ার গলায় বললেন, ‘কথার কী আছে? লিখতে দিয়েছি, লিখবে। এর মধ্যে কথার তো কিছু নেই। তোমরা লিখবে, আমি খাতা নিয়ে চলে যাব। দেখব, রচনা লেখা কেমন শিখেছ।’

কালীপদ বলল, ‘তবু স্যার, একটা কথা ছিল।’

আমরা প্রমাদ গুনলাম। এবার বড়ো একটা গোলমাল হবে। কঠিন ধরনের শাস্তি জুটবে গাধাটার কপালে।

জগদীশবাবু যেন নিজেও কালীপদর এত সাহস কল্পনা করেননি। খানিকটা থমকে গেলেন। বললেন, ‘কী কথা?’

‘স্যার, সত্যি কথা লিখতে পারি?’

হুংকার দিতে গিয়েও নিজেকে সামলালেন হেডমাস্টারমশাই। বললেন, ‘আলবাত পারো। আমি কি তোমাদের মিথ্যে শেখাতে এসেছি?’

এরপর কীভাবে আমরা রচনা শেষ করলাম জানি না। কী লিখলাম তাও জানি না। মনে হয় সকলেই বানিয়ে-বানিয়ে অপছন্দের মানুষের কথা লিখলাম। কে আর সত্যি-সত্যি অপছেন্দের মানুষের কথা বলে ঝামেলায় পড়তে চায়? কেউ তো আর বোকাসোকা, খ্যাপাটে কালীপদ নয়!

পরদিন থেকে বড়ো আশ্চর্য ঘটনা ঘটতে লাগল।

আমাদের হেডমাস্টারমশাই জগদীশ পাঠক রাতারাতি বদলে গেলেন! যখন-তখন ধমক, হুংকার, শাসানি, কানমলা সব উধাও হয়ে গেল! ছেলেদের সঙ্গে তিনি নরম গলায় কথা বলতে শুরু করলেন। ক্লাসে এলে পড়া শুরুর আগে খানিকটা ছেলেবেলার গল্প শোনাতে লাগলেন। আমরা হাসি চাপতে চেষ্টা করতাম, কিন্তু পারতাম না। সেইসব গল্পের বেশিটাই তো দুষ্টুমির গল্প।

ব্যাপার এখানেই শেষ নয়। জগদীশবাবু এক শনিবারের বিকেলে ফুটবলম্যাচের সময় মাঠেও চলে এলেন। সবাই ছুটে এসে তাঁকে চেয়ার পেতে দিল। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, গোলের পর সকলের সঙ্গে তিনিও হাততালি দিচ্ছেন! আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।

তবে ছেলেদের হঠাৎ-হঠাৎ পাকড়াও করে বানান বা ইতিহাসের সাল-তারিখ জিজ্ঞেসের অভ্যেস ছাড়লেন না। ঠিক বললে একগাল হেসে পিঠ চাপড়ে বলতে লাগলেন, ‘শাবাশ! কাল কিন্তু আরও শক্ত জিজ্ঞেস করব। তখন পারলে ডবল শাবাশ পাবি।’ আমরাও ‘ডবল শাবাশ’ পাওয়ার জন্য খুব চেষ্টা চালাতাম। অপেক্ষা করতাম, হেডমাস্টারমশাই কখন পাকড়াও করবেন।

কী করে এমন হল? জানি না। তবে সেদিন কালীপদর রচনার মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো রহস্য ছিল। সেটা কী? ও কী হেডমাস্টারমশাইকে নিয়ে কিছু লিখেছিল? বোকাসোকা, খ্যাপাটে ছেলেটার এত সাহস হবে? জিজ্ঞেস করলে এলোমেলো চুল ঝাঁকিয়ে কালীপদ কাঁচুমাচু মুখে বলত, ‘আমার কী দোষ? আমি তো সত্যি কথাই লিখেছিলাম! আমার অপছন্দের মানুষ হলেন…।’ এই পর্যন্ত বলেই চুপ করে যেত কালীপদ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *