ক্রিস্টিনা ডি’ সিলভার গল্প
প্রায় আটান্ন বছর হয়ে গেল। আমি তখন বম্বেতে। সেই সময় বম্বে মুম্বই হয়নি। সেখানকার বর্ষা যে কী বিষম বস্তু আরব সাগরের পাড়ের ওই শহরটায় না গেলে মালুম হতো না।
অনেকেই হয়তো জানে ক্লাসিক্যাল মিউজিক মানে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ওস্তাদ গাইয়েরা একবার গাইতে শুরু করলে গানের ঘেঁটি ধরে সন্ধে থেকে মাঝরাত পার করে ভোর না হওয়া অবধি ছাড়াছাড়ি নেই। ওস্তাদ কালোয়াতরা তবু রাত কাবার করে থেমে যায়। কিন্তু বম্বের বর্ষা আজ শুরু হলে কবে থামবে, কেউ জানে না। দিন নেই রাত নেই ঝম ঝম বৃষ্টি চলছেই। হয়তো পাঁচদিন কি গোটা সপ্তাহ পর বর্ষার এই একটানা ধ্রুপদ ধামার থামল। কিন্তু রেহাই নেই। দু’তিনদিন ইন্টারভ্যালের পর কোমর বেঁধে শুরু হয়ে গেল।
যারা এই গল্পটা পড়তে বসেছে, তাদের কপাল নিশ্চয়ই এর মধ্যে কুঁচকে গেছে। হয়তো ভাবছে, পড়ব তো একটা গল্প, তা বর্ষা নিয়ে এত ভ্যানর ভ্যানর কেন হে বাপু। সাতকাহনটা যে ফাঁদতে হল তার কারণ এই বর্ষাটা না হলে গল্পটাই যে হয় না।
বর্ষা ছাড়া আরও একজন আছেন। তিনি শ্রীমতী ক্রিস্টিনা ডি’ সিলভা। গোয়ার খ্রিস্টান। গোয়ার পানাজি থেকে কোন ছেলেবেলায় মহারাষ্ট্রের রাজধানী বম্বেতে চলে এসেছিলেন। তারপর থেকে এখানকারই স্থায়ী বাসিন্দা। একে দেখলে যাঁর ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে তিনি হলেন স্বয়ং আমাদের রণচণ্ডী। না না, চেহারায় নয়, মেজাজে। প্রায় তেমনই ভয়ঙ্করী।
বর্ষা আর ক্রিস্টিনা ডি’ সিলভা এই গল্পের আসল নায়ক নায়িকা। এরা ছাড়া আমরা কয়েকজন পাঁচ ফোড়নের মতো এধারে ওধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছি।
এবার আমার সম্বন্ধে দু’চার কথা না জানালেই নয়। কেননা আমাকে বাদ দিলে গল্পটা বলবে কে?
আমি হলাম পদ্মাপাড়ের আকাট বাঙাল। অল্প বয়স থেকেই আমার দু’পায়ে চাকা লাগানো। দু’চার দিন হয়তো শান্তশিষ্ট সুবোধ বালকের মতো চুপচাপ বাড়িতে বসে রইলাম। তারপরেই মাথায় পোকা নড়ে উঠল। আমিও বেরিয়ে পড়লাম। এইভাবেই সারা দেশটা চষে বেড়াতাম।
সেবার হাতে ঠাকুরদার আমলের সাত পুরোনো একটা স্যুটকেস ঝুলিয়ে আর কাঁধে শতরঞ্জি দিয়ে জড়ানো বিছানা ফেলে, ঘুরতে ঘুরতে বম্বেতে এসে হাজির হলাম।
বিশাল চোখধাঁধানো শহর। পকেটে রেস্ত বলতে হাজার দেড়েকের মতো টাকা। বম্বের মতো শহরে তা আর কতটুকু। আমাকে মেপে মেপে, টিপে টিপে খরচ করতে হবে। নইলে ওই মূলধন দু—চারদিনেই ফুড়ুত।
ঘুরে ঘুরে খুব সস্তাগণ্ডার কয়েকটা সেকেলে গুজরাটি শাকাহারী হোটেলে নোঙর ফেলে, নোঙর তুলে দেখা গেল পকেটের হাল খুবই খারাপ হয়ে এসেছে। দেড় হাজার কমে ছ—সাতশোয় দাঁড়িয়েছে।
এই মহা দুঃসময়ে একটি বন্ধু জুটে গেল। তার নাম পরমেশ্বরণ।
মাদ্রাজের (তখনও চেন্নাই হয়নি) তামিল। আমার অনেক আগে মাঝারি একটা থলে বোঝাই করে টাকাপয়সা নিয়ে বম্বেতে এসেছিল।
দেশের পশ্চিম দিকের এই মহানগরটির আগাপাশতলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখব বলে আমি বম্বেতে এসেছি। এ ছাড়া অন্য কোনও উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু তামিল ব্রাহ্মণ সন্তান তার বাবার তোরঙ্গ ভেঙে ভেতরে যা ছিল সাফ করে একটা বিরাট স্বপ্ন ঘাড়ে চাপিয়ে মাদ্রাজ থেকে বম্বেতে পাড়ি দিয়েছিল। স্বপ্নটা কী? সেটা ধীরে ধীরে জেনেছি। তার একমাত্র লক্ষ্য বা পাখির চোখ হল রাজ কাপুর, শাম্মী কাপুর, ধর্মেন্দ্র বা রাজেশ খান্নার মতো সুপারস্টার হওয়া। কিন্তু কয়েক মাস ফিল্ম কোম্পানির স্টুডিয়োগুলোতে সূর্য ওঠা থেকে সূর্য ডোবা অবধি ধরণা দিয়ে দিয়েও তেমন জুত যে করতে পারেনি, তা মুখ ফুটে বলেনি। কিন্তু আমার তো চক্ষু কর্ণ নাসিকা আছে। ঠিক আঁচ করতে পেরেছি। এদিকে মাদ্রাজ থেকে টাকা বোঝাই যে থলেটা নিয়ে বম্বেতে এসেছিল সেটা চুপসে এতটুকু হয়ে গেছে। কিন্তু স্বপ্নটাকে হাত ছাড়া করতে সে আদৌ রাজি নয়। রাজ কাপুর ধর্মেন্দ্র রাজেশ খান্নারা তার ঘাড়ের ওপর ঠেসে বসে আছে।
মাদ্রাজ থেকে এসে গোড়ার দিকে সে বেশ দামি দামি হোটেলে কাটিয়েছে। তারপর সস্তা শাকাহারী হোটেলে।
একদিন পরমেশ্বরণ বলল, ‘দ্যাখ ইয়ার, বম্বেতে টিকে থাকতে হলে কুছ কুছ কামাই করতে হবে। আমি একটা ফ্যাক্টরিতে পার্ট টাইম কাজ জুটিয়ে নিয়েছি। বিকেল চারটে থেকে সন্ধে সাতটা পর্যন্ত ডিউটি। তুইও একটা কিছু জুটিয়ে নে। কামাই না হলে বম্বেতে টিঁকে থাকা যাবে না।’
ঠিকই বলেছে পরমেশ্বরণ। আমার পকেটের যা হাল, কিছু না জোটালেই নয়।
পরমেশ্বরণ আরও বলল, ‘দ্যাখ ইয়ার, আর হোটেল টোটেল নয়, আমি একটা আস্তানার খোঁজ পেয়েছি। এই গুজরাটি হোটেলে থাকা আর খাওয়ার জন্যে আমাদের যা খরচ হয় তার হাফ খরচে সেখানে থাকা যাবে।’
আমি চনমনে হয়ে উঠি, আস্তানাটা কোথায় রে, কোথায়?’
‘খার—এ। সমুন্দরের কাছে ক্রিস্টিনা ডি সিলভার একঠো ব্যারাক টাইপের বিল্ডিং আছে। লোকে বলে ‘চওল’। সেখানে পিদ্রুরাই (গোয়ার খ্রিস্টান) বেশি থাকে। মাসে একটা কামরায় ভাড়া পঞ্চাশ রুপিয়া। তুই আর আমি থাকব। ভাড়া আধা আধা। টোয়েন্টি ফাইভ, টোয়েন্টি ফাইভ। ইলেকট্রিসিটির বিল বেশি না। তোর হাফ, আমার হাফ। নজদিগ সর্দারজিদের ধাবা আর উদিপিদের ছোটা ছোটা হোটেল আছে। ছে—আনায় ব্রেকফাস্ট, বারো আনায় লাঞ্চ, আট আনায় ডিনার। বম্বেতে এর চেয়ে সস্তায় আর কোথায় থাকা যাবে?’ আমার দিকে তাকিয়ে সে ভুরু নাচাতে লাগল।
আমি প্রায় লাফিয়ে উঠলাম,—’কবে সেখানে শিফট করতে চাস?’
‘কবে আবার। আজই—এক্ষুণি। স্যুটকেশ আর বিস্তারা গুছিয়ে নে—।
দশ মিনিটের ভেতর স্যুটকেস টুটকেস ঘাড়ে চাপিয়ে এক তামিল আর এক বঙ্গসন্তান বড় রাস্তায় গিয়ে বি ই এস টি’র লাল রঙের ঝকঝকে বাস—এ উঠে পড়লাম। আধ ঘণ্টাও লাগল না, বাসটা খার—এর সমুদ্রতীর থেকে বেশ খানিকটা দূরে আমাদের নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।
এদিকে রাস্তার হাল বেজায় খারাপ। চারিদিকে খানাখন্দ, কোথাও কোথাও বিরাট বিরাট গর্ত। কয়েকটা গর্তের চেহারা দেখলে ভিরমি খেতে হয়। একবার পা ফসকে পড়লে সোজা পাতালে।
বম্বে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের কর্মীরা শহরের এই এলাকাটা এলোপাতাড়ি খুঁড়ে টুঁড়ে খুব সম্ভব গুপ্তধন খুঁজে চলেছে।
খুব সাবধানে পা ফেলে ফেলে আমরা শ্রীমতী ক্রিস্টিনা ডি’সিলভার চওল—এর সামনে চলে এলাম। গেট খোলা ছিল। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল, মাঝারি ধরনের ফাঁকা একটা চত্বর। তার ওধারে আদ্যিকালের লম্বা ব্যারাকের মতো দোতলা বিল্ডিং, মাথায় টালির চাল। বাড়িটার বয়স কম করে সত্তর আশি বছর তো হবেই। দেওয়ালের পলেস্তারা অনেক জায়গায় খসে গিয়ে ইট বেরিয়ে পড়েছে। জং ধরে রেন—ওয়াটার পাইপগুলো ঝুরঝুরে। ছাদের টালিগুলোর বেশির ভাগই ভাঙা। পুরো চওলটা কিন্তু বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে ঘেরা।
বম্বে শহরের অন্য সব চওল—এর মতোই এই চওলটারও একতলা এবং দোতলায় লাইন দিয়ে পর পর ঘর। আট দশটা কামরার পর খানিকটা গ্যাপ। সেখানে দোতলায় ওঠার সিড়ি। একটা কি দুটো করে ঘর নিয়ে একেকটা ভাড়াটে ফ্যামিলি।
সামনের খোলা চত্বরের একধারে সারি—সারি কয়েকটা জলের কল। অন্য দিকে সাত—আটটা পায়খানা। তা ছাড়া বাউন্ডারি ওয়াল ঘেষে বিরাট চাকার মতো টায়ার লাগানো দুটো ঠেলা গাড়ি।
সময়টা ভর দুপুর। লোকজন তেমন একটা চোখে পড়ছে না। খুব সম্ভব পুরুষ ভাড়াটেরা যে যার কাজে বেরিয়ে গেছে। এধারে ওধারে কিছু মাঝবয়সি মহিলা আর বাচ্চা কাচ্চা ছাড়া আর কেউ নেই। তাদের চেহারা এবং লম্বা ঝুলের স্কার্ট আর শার্ট দেখে বোঝা যায় এরা পিদ্রু। দূর থেকে ওরা আমাদের লক্ষ করছে।
পরমেশ্বরণ দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তার দেখাদেখি আমিও। সে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে। কেমন একটা অস্থির অস্থির ভাব।
এখানে আসার আগেই ঘর ভাড়ার অধের্ক টাকা আমার কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছে পরমেশ্বরণ। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানেই থেমে গেলি যে? আমাদের ঘরে চল।’
পরমেশ্বরণ জবাব দিল না। চওল—এর এ—মাথা থেকে ও—মাথায় তার চোখ দুটো চরকির মতো ঘুরেই চলেছে।
ওর রকম—সকম দেখে খটকা লাগছিল। ঝাঁঝিয়ে উঠলাম, ‘এখানেই স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি। আমাদের কামরাটা কোথায়?’
এতক্ষণে আমার দিকে ঘাড় ফেরাল পরমেশ্বরণ, বারকয়েক ঢোঁক গিলে মিয়ানো গলায় বলল, ‘কামরা কামরা মাত করনা।’
আমি অবাক। বলছে কী আমার সঙ্গীটি! নিজের অজান্তেই গলা দিয়ে ফস করে বেরিয়ে এল, ‘মতলব?’
‘কামরা থোড়াই ভাড়া হয়েছে।’
এবার আমার গলা থেকে তোড়ে কিছু উৎকৃষ্ট গালাগাল ঠিকরে ঠিকরে বেরুতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই দুনিয়া—কাঁপানো বাজখাঁই আওয়াজ কানে এল, ‘কৌন হো রে?’
এমন কণ্ঠস্বর কোনও মানুষের হতে পারে বলে মনে হল না। এই বিকট শব্দের সোর্স যে চওল—এর দোতলায় তা আন্দাজ করে দুজনে সেদিকে তাকালাম। পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ক্ষমতা যার, এবার তার দর্শন মিলল। রামায়ণ মহাভারতে যে অতিমানবীদের পাওয়া যায় ইনি খুব সম্ভব তাদের বংশধর। দু’মণ ওজনের গোলাকার একটা মাংসপিণ্ড দোতলার রেলিংয়ের ওপর ঝুঁকে আছে। বিপুল ধড়ের ওপর বিশাল মাথাটি ঠেসে বসানো। তার মাথায় টুপি, গায়ে ফুল প্যান্ট আর শার্ট। সে বলল, ‘এখানে কী চাস? কার হুকুমে চওল’—এর ভেতরে ঢুকেছিস?’
গলার স্বর আগের মতো ততটা তীব্র নয়। বুকের ধড়ফড়ানি কিঞ্চিৎ কমে এল। তবু ভয়ে ভয়ে পরমেশ্বরণ বলল, ‘শুনা হ্যায়—’
তাকে থামিয়ে দিয়ে শ্রীমতী রণচণ্ডী গলার স্বর আরেক পর্দা নামাল, হিঁয়াপে হিঁয়াপে, উপ্পর আ যা। দোমাল্লা দোমাল্লা। বীচবালা স্টেয়ারকেস। আ—আ—’
মাঝখানের সিঁড়ি দিয়ে আমাদের দোতলায় যেতে বলছে।
কেন দোতলায় যেতে বলা হচ্ছে? মতলবটা কী? দোনোমনো করে উঠেই পড়লাম। দেখাই যাক কী হয়।
দোতলাতেও সারি সারি কামরা। একটা কামরার মাথায় ইংরেজিতে বড় বড় হরফে লেখা—অফিস। রণচণ্ডী আমাদের ঘরে নিয়ে গেল।
মস্ত একটা টেবিল, কয়েকটা চেয়ার, আলমারি টালমারি দিয়ে অফিস ঘরটা সাজানো। টেবিলটার ওপর প্রচুর ফাইল, টেলিফোন। এক ধারে কাঠের তিনকোণা ফলকে লেখা—’ক্রিস্টিনা ডি’ সিলভা। নামের নিচে প্রোপ্রাইটর। শ্রীমতী রণচণ্ডীর নাম এবং সে যে এই ‘চওল’—এর মালকিন তখনই আমরা ভালো করে জানতে পারি।
টেবিলটার একধারে গদি—আঁটা, হাতল—লাগানো যে চেয়ারটায় ঠেসেঠুসে সে বসল। সেটার মাপ অন্য সব চেয়ারের ডাবল তো বটেই, বেশিও হতে পারে। নিশ্চয়ই অর্ডার দিয়ে এই ভেরি ভেরি স্পেশ্যাল কুরসিটি বানানো হয়েছে।
নিজের চেয়ারে গদিয়ান হয়ে ক্রিস্টিনা ডি’ সিলভা তার উলটো দিকের ক’টা কাঠের চেয়ারের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল, ‘বৈঠ যা, বৈঠ যা—’
কাঁধ থেকে লটবহর নামিয়ে বেশ ভয়ে ভয়েই বসে পড়লাম।
ক্রিস্টিনা ডি’সিলভা জিজ্ঞেস করল, ‘ঘাড়ে স্যুটকেস ফুটকেস চাপিয়ে আমার চওল—এ ঢুকেছিস কেন? মতলবটা কী? বল—বল—বলে ফেল—’
এ প্রশ্নটা এবার নিয়ে খুব সম্ভব দ্বিতীয়বার। আমাদের দু’জনেরই জিভ টিভ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। পরমেশ্বরণ তার শুকনো জিভটা বের করে বার কয়েক ঠোঁটের ওপর বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘আন্টিজি।’
তার কথা শেষ হবার আগেই ক্রিস্টিনা ডি’ সিলভার গলায় সেই বাজখাঁই আওয়াজটি ফিরে এল। পিলে—চমকানো একটা ধমক দিয়ে বলল, ‘আন্টিজি বলবি না। বল ম্যাম। বম্বের হর আদমি আমাকে ম্যাম বলে। মনে থাকবে?’
‘হাঁ, আন্টিজি।’
এবার দু’নম্বর ধমক। এবং সেটা আরও জোরদার। ক্রিস্টিনা ডি’সিলভা আঙুল নাড়তে নাড়তে বলল, ‘ফের আন্টিজি। উল্লু কাঁহাকা।’
হাতজোড় করে বেজায় কাঁচুমাচু হয়ে পরমেশ্বরণ বলল, ‘কসুর হয়ে গেছে। আর হবে না আন্টি—না, না ম্যামজি—’
আমি তো জানি পরমেশ্বরণ একটি মিচকে শয়তান। আন্টি বলে মুহূর্তে সামলে নিয়ে কুঁকড়ে যাবার ভঙ্গিতে সে যে ভুল শুধরে ‘ম্যামজি’ বলল সেটা তার বজ্জাতি। হাসি পাচ্ছিল। কিন্তু ঠোঁট টিপে বসে রইলাম। বুঝতে পারছি, প্রথম দিকে রণচণ্ডীর বিশাল বপু আর হুঙ্কার শুনে পরমেশ্বরণ যতটা ভয় পেয়েছিল, তার অনেকটাই কেটে গেছে। এখন রণচণ্ডীকে সে একটু নাচাতে চাইছে।
ওদিকে শ্রীমতী রণচণ্ডী চোখ সরু করে পরমেশ্বরণের ‘ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না’ গোছের সরল, নিষ্পাপ মুখটি কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে বলল, ‘তুই বহুত বদমাশ।’
তার বজ্জাতি যে ধরা পড়ে যাবে, ভাবতে পারেনি পরমেশ্বরণ। মাথা নীচু করে সে বসে রইল।
ক্রিস্টিনা ডি’সিলভা চোখ সরায়নি। বলল, ‘এবার বল কী চাস।’
মিন মিন করে পরমেশ্বরণ বলল, ‘ম্যামজি, আপনার চওল—এ ভাড়ায় একটা কামরা নিয়ে আমরা থাকতে চাই।’
‘উল্লু কা পাঠঠে, তোকে তো এই মহল্লায় আগে কখনও দেখিনি। আমার ”চওল”—এ কামরা ভাড়া পাওয়া যায়, জানলি কী করে?’
‘ম্যামজি, আপনার চওল’—এর নাম দুনিয়ার হর আদমি জানে। তাদের মুখে শুনে আমার এই দোস্তকে নিয়ে এসেছি। আমরা দুজনে যেখানে যাই একসাথ থাকি। মওত তক, একসাথই রহেঙ্গে।’
মাত্র দিন পনেরো হল এক গুজরাটি হোটেলে এই সাউথ ইণ্ডিয়ানটির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। এর মধ্যেই আমি নাকি তার এমন জিগরি দোস্ত হয়ে গেছি যে শেষ নিঃশ্বাস না ফেলা অবধি বাকি জীবন একসঙ্গে কাটাবে। ভারি মজা লাগছিল। আড়চোখে তাকে দেখতে লাগলাম।
ক্রিস্টিনা ডি’সিলভা পরমেশ্বরণের দিকে তাকিয়ে আছে। বলল, ‘দোনো মিলকে বহুৎ বঢ়িয়া জোড়ি!’
দেবশিশুর মতো মুখ করে বসে রইল পরমেশ্বরণ।
ক্রিস্টিনা ডি’ সিলভা এবার জিজ্ঞেস করল, ‘তোদের দেখে তো মারাঠি, গুজরাটি, সিন্ধি, পার্সি, পিদ্রু—কিছুই মনে হচ্ছে না। কোন কোন মুল্লুক থেকে তোরা বম্বেতে এসে জুটেছিস?’
আমি বললাম, ‘কলকাতা’। পরমেশ্বরণ বলল, ‘মাদ্রাজ’।
‘মতলব তুই কলকাত্তাবালা বেঙ্গলি আর তুই মাদ্রাজবালা তামিল। ইস্ট আর সাউথ। ঠিক বলছি?’
আমরা জানিয়ে দিলাম, শতকরা একশো ভাগ ঠিক।
‘গুড। নাম বাতা—’
নাম বললাম।
‘তোরা তো আমার ”চওল”—এ থাকতে চাস। রুমের রেন্ট তো দিতে হবে। কামাই হয় কীভাবে? চোরি, ওরি, হিঁয়াকা মাল উঁহা, উঁহাকা মাল ইহাঁ—অ্যায়সা কুছ?’
আমরা আঁতকে উঠি, ‘না না, আমরা ভদ্র বংশের ছেলে। শিক্ষাদীক্ষা আছে। চুরি টুরির মতো নোংরা কাজ করব কেন?’
‘বহুৎ আচ্ছা। চোরি করিস না, তা হলে করিসটা কী? চারবেলা খেতে পয়সা লাগে, জামা কাপড় কিনতে হয়, বাসভাড়া, সাবার্বান ট্রেনের টিকিট কাটা, লন্ড্রিতে জামাকাপড় সাফাই, সেলুনে চুল কাটাই—কত রকমের খরচ। কী করে এসব জোটে?’
পরমেশ্বরণ বলল, ‘আমি একটা কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে কাজ করি।’
ডান হাতের বুড়ো আঙুলের পাশের আঙুলটা সোজা আমার দিকে তাক করে শ্রীমতী রণচণ্ডী বলল, ‘আর তুই?’
সত্যের সঙ্গে মিথ্যের ভেজাল দিয়ে মুহুর্মুহু ঢোক গিলে বললাম, ‘খুব শিগগির আমার একটা কাজ হয়ে যাবে।’
‘যতদিন কাজটা না হচ্ছে, বাড়িভাড়া দিবি কী করে?’
‘আমার কাছে টাকা আছে। ফিকর মাত করনা ম্যামজি—।’
‘দ্যাখ, রুপাইয়া পাইসার ব্যাপারে আমি দুনিয়ার কারওকে বিশোয়াস করি না। পাইসা আমার মা—বাপ। যাদের পাকা নৌকরি বা বেওসা আছে তারা কামরা চাইলে এক মাহিনার রেন্ট অ্যাডভান্স নিই। তোদের কিন্তু তিন মাহিনার রেন্ট আগাম দিতে হবে। রাজি?’
আমরা দু’জনেই ঘাড় কাত করলাম—রাজি।
‘গুড। আমার আরও ক’টা কন্ডিশন আছে।’
‘বলুন।’
‘তোরা পান বিড়ি সিগারেট খাস?’
শ্রীমতী ক্রিস্টিনা ডি’সিলভার এই চওলটা রামায়ণ মহাভারতের সাধু—সন্ন্যাসীদের আশ্রম—টাশ্রম গোছের কিনা বোঝা যাচ্ছে না। হয়তো নেশা—টেশা এখানে নিষিদ্ধ। আমার কোনও রকম নেশাই নেই। জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, ‘না’।
পরমেশ্বরণ ঘাবড়ে গেছে। সে দিনে কম করে তিরিশ চল্লিশটা সিগারেট ফোঁকে। বার কয়েক ঢোক গিলে সে বলল, ‘ম্যামজি, আমি দু’তিনটে সিগারেট খাই।’
ক্রিস্টিনা ডি’ সিলভা হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘চলবে না। পোড়া বিড়ি সিগারেটের টুকরো ফেলে সামনের চত্বরটা নোংরা করা, পানের পিক ফেলে পেন্টিং করা—এসব আমি বিলকুল বরদাস্ত করি না। সমঝা?’
মাথাটা ডান দিকে হেলিয়ে হাত জোড় করল পরমেশ্বরণ, ‘সমঝ গিয়া। আজ থেকে দু’তিনটে সিগারেটও খাব না।’ তার ঠোঁটে মিচকে হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল।
ক্রিস্টিনা ডি’সিলভা খুব সম্ভব হাসিটা লক্ষ করেনি। বলল, ‘ভেরি গুড। সিগারেট ফুঁকে লাংটা ঝাঁঝরা করার কী দরকার। উমর দশ বিশ সাল কমে যাবে। ব্রিদিং ট্রাবল নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে খতম হয়ে যাবি।—এবার তিন মাহিনার অ্যাডভান্স রেন্টটা বের কর। একটা কামরার হর মাহিনার রেন্ট কত জানিস।’
‘জানি ম্যামজি, পঞ্চাশ রুপাইয়া।’
শ্রীমতী রণচণ্ডী অবাক, ‘তাজ্জব কি বাত। তুই জানলি কী করে?’
‘আগেই তো বলেছি, পুরা দুনিয়া আপনার ”চওল”—এর খবর রাখে। তাদের কারও কাছ থেকে জেনেছি।’
চোখ গোলাকার করে ক্রিস্টিনা ডি’সিলভা কয়েক লহমা তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, ‘তোর মতো বিচ্ছু পুরা জিন্দেগিতে আর একটাও দেখিনি।’ বলতে বলতে হেসে ফেলল।
এই ভয়ঙ্করী সারা জীবনে কখনও হেসেছে বলে মনে হয় না। তার মুখে হাসি ফোটানো সহজ ব্যাপার নয়। মাত্র আধ ঘণ্টা হল আমরা এই ‘চওল’—এ এসেছি। এর মধ্যেই খুব সম্ভব পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন একটা কাজ করে ফেলল পরমেশ্বরণ। মনে মনে তাকে স্যালুট করলাম।
ক্রিস্টিনা ডি’সিলভা বলল, ‘তিন মাহিনার অ্যাডভান্সটা বের কর।’
আমি আগেই একমাসের জন্য পঁচিশ টাকা দিয়েছিলাম। আরও পঞ্চাশ বের করলাম। আমার ভাগের মোট পঁচাত্তর। পরমেশ্বরণ বের করল তার ভাগের পঁচাত্তর। পাঁচটা কড়কড়ে দশ টাকার নোট আর বাকিটা এক টাকা, আট আনা, চার আনার কয়েন ‘চওল’—এর মালকিনের দিকে বাড়িয়ে দিল পরমেশ্বরণ।
টাকাপয়সা খুব মনোযোগ দিয়ে গুনে টেবিলের দেরাজে চালান করে রসিদ লিখে পরমেশ্বরণের হাতে দিয়ে ক্রিস্টিনা ডি’সিলভা বলল, ‘তিন মাস পেরুবার পর থেকে হর মাসের পাঁচ তারিখের ভেতর রেন্ট মিটিয়ে দিতে হবে।’
‘দেব। ফিকর মাত কীজিয়ে।’
‘এখন নীচে চল। আউর কুছু কুছ কন্ডিশন আছে। তোদের লাগেজ ঘাড়ে তোল।’
শ্রীমতী রণচণ্ডী এর মধ্যে দুটো চাবি বের করে হাতের মুঠোয় পুরে নিয়েছেন। আমরা স্যুটকেস ব্যাগ ট্যাগ তুলে নিলাম। সারি—সারি কামরার সামনে দিয়ে টানা বারান্দা চলে গেছে। নীচে নেমে একটা কামরার সামনে আমাদের নিয়ে এল ক্রিস্টিনা ডি’সিলভা বলল, ‘এটাতেই তোরা থাকবি।’ কামরাটা তালাবন্ধ। তালা খুলে বলল, ‘অন্দর আ।’
ভেতর ঢুকতেই চোখে পড়ল, কামরার দুই দেওয়ালে দুটো বড় বড় জানালা। মেঝেতে দেওয়াল ঘেঁষে দুটো তক্তপোষ। আর এক দেওয়ালের গায়ে একটা বুক—সমান হাইটের পুরনো, সেকেলে আলমারি। সিলিংয়ের মাঝখান থেকে একটা মোটা লোহার হুক নেমে এসেছে। সেটার দু’পাশে খানিকটা গ্যাপ দিয়ে দুটো লম্বা তারের নীচের দিকে আটকানো দুটো বাল্ব জ্বলছে।
আমরা মালপত্র নামিয়ে তক্তপোষের ওপর রেখেছিলাম। শ্রমতী রণচণ্ডী সিলিংয়ের দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘ওই দ্যাখ, বিজলির ব্যবস্থা আছে। দুটো বাল্বের জন্যে হর মাহিনা তিরিশ তিরিশ ষাট রুপিয়া। আর বম্বেতে তো বহুৎ গরম। ওই হুকটা থেকে তোদের ফ্যান ঝোলাতেই হবে। একটা ফ্যান কিনে ঝুলিয়ে নিস। না হলে টিকতে পারবি না। ফ্যান চালানোর জন্যে দিতে হবে চল্লিশ। ইলেকট্রিসিটির বিল হল থার্টি প্লাস থার্টি প্লাস ফোর্টি। মতলব পুরাপাক্কা ওয়ান হানড্রেড। হিসাব ঠিক হ্যায়?’
কামরা ভাড়া পঞ্চাশ, লাইট টাইটের বিল একশো। দু’জনে ভাগ করে দিলে মাথা পিছু পঁচাত্তর। এই টাকাতে বম্বের ফুটপাথেও থাকার জায়গা পাওয়া যাবে না। বলতেই হল, ‘ঠিক হ্যায়।’
‘রাজি?’
‘বিলকুল।’
‘এখন আমার সঙ্গে চত্বরে চল।’ ক্রিস্টিনা ডি’ সিলভা আমাদের সামনের ফাঁকা জায়গাটায় নিয়ে এল। বলল, ‘দ্যাখ, কেমন সাফ সুতরা। এক ভি পোড়া বিড়ি কি সিগারেটের টুকরা, ফালতু অন্য কোনও জিনিস টিনিস নেই।’
সত্যিই চত্বরটা পরিষ্কার। আবর্জনা টাবর্জনা কিচ্ছু নেই। ভাড়াটেদের শ্রীমতী রণচণ্ডী যে প্রবল দাপটে রাখে বোঝাই যাচ্ছে। তার সঙ্গে এক দিকের বাউন্ডারি ওয়ালের পাশে চলে এলাম। এখানে পর পর পাঁচটা জলের কল। আগেই আমরা তা দেখেছি। শ্রীমতী রণচণ্ডীর জন্য আরও একবার দর্শন করতে হল। সে বলল, ‘বম্বে মিউনিশিপ্যাল কর্পোরেশন দিনে তিন দফে ওয়াটার সাপ্লাই করে। সুবে সাত বাজে একবার, দু’পহর বারো বাজে একবার, সামকো সাত বাজে ফির একবার। বম্বেতে পানি বহুৎ মাহেঙ্গা। এক বুঁদ ভি ওয়েস্ট মাত করনা। এই চওল—এ সিক্সটি ফ্যামিলি হ্যায়। তারা নিজেদের খানা উনা পাকায়। কমসে কম বাচ্চা টাচ্চা নিয়ে দো’শো মানুষ। বহুৎ পানি দরকার। ও বাদে ফ্যামিলি নেই, তোদের মতো আরও চল্লিশ পঞ্চাশজন আছে। তারা খানা পাকায় না। বাইরে হোটেলে টোটেলে খায়। তোরা কি আপনা খানা পাকাবি?’
‘না। আমরা একটু বেলা হলেই বেরিয়ে পড়ি। বাইরে হোটেল টোটেলে খেয়ে নিই। যেখানেই থাকি, ফিরতে ফিরতে সন্ধে পেরিয়ে যায়।’
‘ফির ভি বহুৎ আচ্ছা। তোরা চওল’—এ থাকলে এটার জন্যে ওটার জন্যে পানি লাগবে। সারাদিন যখন থাকবিই না, সেই পানিটা বেঁচে যাবে। ওই যে ওদিকে দ্যাখ।’ ক্রিস্টিনা ডি’সিলভা কাছাকাছি কয়েকটা পুরোনো জংধরা টিনের চালার দিকে আঙুল বাড়াল, ‘ওগুলো বাথরুম। সুবে সুবে উঠে ওখানে পানি নিয়ে গিয়ে চানটা সারবি। তোদের লাগেজের মধ্যে তো বালতি টালতি দেখলাম না।’
বললাম, ‘আমাদের বালতি নেই।’
‘আজই বালতি কিনে আনবি। কখন কী দরকার হয়, সব সময় কামরায় দো বালতি পানি মজুত রাখবি।’
পরামর্শটি খুবই মূল্যবান মনে হয়। বললাম, ‘হ্যাঁ, ম্যামজি।’
‘আউর দো কন্ডিশন।’ সোজাসুজি অন্য দিকের বাউন্ডারি ওয়ালের গায়ে চটের পর্দা লাগানো পায়খানাগুলো দেখিয়ে শ্রীমতী রণচণ্ডী বলল, ‘ওগুলো ইউস করে পানি দিয়ে সাফ করবি। গন্ধি হয়ে যেন না থাকে।’
আমরা রাজি।
‘এবারে লাস্ট কন্ডিশন। রাত বারোটায় আমার চওল—এর গেটে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। তারপর কেউ এলে ঢুকতে দেওয়া হয় না। মনে থাকবে?’
‘থাকবে।’
‘যে কন্ডিশনগুলো বললাম, সবসময় মনে রাখবি। একটা কন্ডিশন যদি ভাঙিস ঘাড় ধাক্কা দিতে দিতে বের করে দেব। মনে থাকবে? কঠোর দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকাল ক্রিস্টিনা ডি’সিলভা।
আমরা জানিয়ে দিলাম প্রতিটি শর্তই আমাদের সর্বক্ষণ মনে থাকবে। কোনওটাই অমান্য করা হবেনা।
‘ফাইন’। ক্রিস্টিনা ডি’সিলভা খুব সম্ভব আমাদের মতো ভাড়াটে পেয়ে অখুশি হয়নি। কামরার চাবি দুটো আমাদের হাতে দিয়ে দোতলায় উঠে গেল। আর আমরা তালা লাগিয়ে বালতি কিনতে বেরিয়ে পড়লাম।
আমরা—এক তামিল আর এক বঙ্গসন্তান ক্রিস্টিনা ডি’সিলভার খাসতালুকের প্রজা হয়ে গেলাম। এই চওল—এ এসেছি এপ্রিল মাসের গোড়ার দিকে। বম্বেতে তখন বেজায় গরম। যতদিন যাচ্ছে তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। এত গরমে টিকে থাকাই মুশকিল। নিজেদের পকেটের হাল তো জানি। ঝট করে নতুন একটা ফ্যান যে কিনে ফেলব, তা একেবারেই সম্ভব নয়। খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেল খার মার্কেটে একটা দোকানে পুরানো জিনিস টিনিস ভাড়া দেয়। সেখান থেকে মাসিক তিরিশ টাকা ভাড়ায় আদ্যিকালের চার ব্লেডের ফ্যান এনে ঘরের সিলিংয়ে লাগিয়ে দিলাম।
এখানে আসার দু’তিন দিনের মধ্যে জেনে গেলাম চওল—এ শুধু পিদ্রুরাই থাকে না, বাঙালি, বিহারি, ওড়িয়া, সাউথ ইন্ডিয়ান, নর্থ ইন্ডিয়ান—এসব অনেকেই থাকে। নেপালি, ভুটিয়া, টুটিয়াও বাদ নেই। সব মিলিয়ে মিনি ভারতবর্ষ।
আমাদের দিনগুলো এইভাবে কাটছে। সকালে ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে দৌড় শুরু। আগের দিন দুটো বালতিতে যে জল ধরে রাখি তার সবটা খরচ করি না, কিছুটা বাঁচিয়ে রাখি। বালতিসুদ্ধ সেই জল নিয়ে প্রথমে চলে যাই পায়খানাগুলোর সামনে। ততক্ষণে সেখানে লম্বা লাইন পড়ে গেছে। চওল’—এ ষাটটা ফ্যামিলির দু—আড়াইশো মেম্বার ছাড়াও আমাদের মতো যাদের ফ্যামিলি নেই তাদের সংখ্যাটাও তো কম নয়। এদের অর্ধেক লাইন দেয় পায়খানাগুলোর সামনে, বাকি অর্ধেক জলের কলের দিকে। কে আগে তার কাজটি সারবে, তাই নিয়ে চলে ধাক্কাধাক্কি, ঠেলাঠেলি, চিৎকার চেঁচামেচি। সব মিলিয়ে হুলস্থূল কাণ্ড। সুতরাং রঙ্গমঞ্চে ক্রিস্টিনা ডি’সিলভার আবির্ভাব। সাক্ষাৎ রণচণ্ডী হয়ে ঘন ঘন হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে সে চিৎকার করতে থাকে, ঝামেলা মাত করো। লাইনমে ঠিকসে খাড়া রহো। হল্লা মাত মচাও। যে ঝঞ্ঝাট করবে তাকে ঘাড় ধরে চওল থেকে বের করে দেব।’
তার দাবড়ানিতে ম্যাজিকের মতো কাজ হয়। ধাক্কাধাক্কি হল্লাটল্লা থেমে যায়।
এদিকটা ঠান্ডা করে নিজের বিপুল শরীরটা টানতে টানতে ক্রিস্টিনা ডি’সিলভা জলের কলগুলোর দিকে দৌড় লাগায়। সেখানেও ততক্ষণে লম্বা লাইন হয়ে গেছে। কে আগে বালতিতে জল ভরবে তাই নিয়ে চলছে তুমুল লড়াই। কলতলাটা যেন রণক্ষেত্র। ক্রিস্টিনা ডি’সিলভা এখানেও শাসিয়ে, তাড়িয়ে দেবার ভয় দেখিয়ে সবাইকে চুপ করিয়ে দেয়। এটাই রোজকার ঘটনা। আর ওইভাবেই শ্রীমতী রণচন্ডী চওল—এর শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখে। তার মুখের ওপর ট্যাঁ ফোঁ করার মতো বুকের পাটা কারও নেই।
আমরা রোজই এক দিকে লাইন দিয়ে পেটের ভার নামিয়ে আরেক দিকে গিয়ে লাইন দিয়ে চান টান সেরে দু’জনে দু’বালতি জল হাতে ঝুলিয়ে কামরায় ফিরে আসি। ঘরের ভেতর দড়ি টাঙিয়ে রেখেছি। সেটার ওপর ভেজা জামা প্যান্ট মেলে দিয়ে পোশাক পাল্টে, ফিটফাট হয়ে বেরিয়ে পড়ি। দু’দিকের লাইনে দু’আড়াই ঘণ্টা কাটিয়ে তৈরি হয়ে কোনও দিনই দশটা, সাড়ে দশটার আগে বেরুনো হয় না।
বাইরে গিয়ে পুরি ভাজি কি চা টোস্ট দিয়ে ব্রেকফাস্ট চুকিয়ে যে যার ধান্দায় চলে যাই। পরমেশ্বরণ পণ করেছে রাজকাপুর, ধর্মেন্দ্র কি রাজেশ খান্না বা শাম্মী কাপুর না হয়ে ছাড়বে না। সেটা তার ঘাড়ের ওপর থেকেই তো নামেইনি, আরও চেপে বসেছে। ব্রেকফাস্টের পর সে ফিল্মে একটা রোলের জন্য স্টুডিয়োতে স্টুডিয়োতে, বা প্রোডিউসারদের অফিসে অফিসে কিংবা নামকরা ফিল্ম ডিরেক্টরদের আস্তানায় হানা দেয়। এই চক্করটা চলে বিকেল অবধি। আমি বম্বেতে আসার অনেক আগে থেকেই এই চক্কর দেওয়াটা তার চলছেই। ধন্যি ছেলের অধ্যবসায়।
আর আমি? রিজার্ভ ব্যাঙ্কটা তো স্যুটকেসে পুরে নিয়ে আসিনি। পকেট ধাঁ ধাঁ করে ফাঁকা হয়ে আসছে। আমদানির কিছু একটা ব্যবস্থা না হলে বোম্বাই মহানগরী আর রণচণ্ডী ক্রিস্টিনা ডি’সিলভাকে স্যালুট করে লটবহর কাঁধে ফেলে সোজা ভিক্টোরিয়া টারমিনাসে গিয়ে ক্যালকাটা মেলে উঠে বসতে হবে।
কিন্তু কী আশ্চর্য, শ্রীমতী রণচণ্ডীর চওল—টা আমার পক্ষে বেশ পয়াই বলতে হবে। এখানে আসার একমাসের ভেতর একটা বিজ্ঞাপন এজেন্সিতে কাজ জুটে গেল। না না, দশটা—পাঁচটা চাকরি নয়। অতটা সময় এক জায়গায় আটকে থাকা আমার ধাতে নেই। এজেন্সি ফি সপ্তাহে আমাকে বেশ কিছু ইংরেজি কপি দেয়। সেগুলো ঝরঝরে, সহজ বাংলায় ট্রানস্লেশন করে দিতে হয়। খটমটো, দাঁত ভাঙা, যুক্তাক্ষরওয়ালা শব্দ ব্যবহার করা চলবে না। কপিগুলো বাংলায় তর্জমা করে এক সপ্তাহ বাদে এজেন্সির অফিসে দিয়ে আসি। সঙ্গে সঙ্গে হাতে চলে আসে কড়কড়ে নগদ এবং নতুন এক গোছা কপি। এইভাবে সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলছে।
বিজ্ঞাপন এজেন্সির ইংরেজি কপির অনুবাদই নয়, ছপ্পর ফুঁড়ে আরও এক সুযোগ একেবারে হাতের তালুতে নেমে এল। একটা হান্টারওয়ালি মার্কা ছবি চিত্রনাট্য লিখে দিতে হবে। আমদানি মন্দ হচ্ছে না।
এদিকে পরমেশ্বরণ রাজকাপুর, ধর্মেন্দ্র, রাজেশ খান্না টান্না হতে পারেনি ঠিকই, টানা এগারো মাস বম্বের মাটি কামড়ে পড়ে থেকে আমার মতো একটা হান্টারওয়ালি মার্কা ফিল্মের ডিরেক্টরের চার নম্বর অ্যাসিস্টান্টের কাজ জুটিয়ে নিয়েছে। এতেই সে ডগমগ। তার বিশ্বাস এই চতুর্থ অ্যাসিস্টান্টগিরির সিঁড়ি বেয়েই সে রাজ কাপুর বা রাজেশ খান্না বনে যেতে পারবে। আকাশের চাঁদ তখন তার হাতের মুঠোয়।
যারা এই লেখাটা পড়ছে, নিশ্চয়ই ভীষণ অধৈর্য্য হয়ে পড়েছে। ভাব ক্রিস্টিনা ডি’ সিলভার দর্শন পাওয়া গেছে কিন্তু বম্বের বর্ষা কোথায়? তার হদিস তো মিলছে না। মিলবে, মিলবে। তার সময় হয়ে আসছে।
মার্চ মাসে আমরা এই চওল’—এ এসেছিলাম। তারপর এপ্রিল, মাস পার হয়ে মে মাসটাও শেষ হতে চলল। সময়টা জুনের প্রায় দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে।
এর মধ্যেই মনসুন উঁকি ঝুঁকি দিতে শুরু করেছে। আমাদের ঘরের জানলা খুললেই আরব সাগর। দেশের পশ্চিম দিকের এই সমুদ্র এমনিতে খুব শান্ত। বে অফ বেঙ্গলের মতো বদমেজাজি, খামখেয়ালি নয়, যখন তখন খেপে উঠে পাহাড়প্রমাণ ঢেউ তুলে তুলকালাম কাণ্ড ঘটায় না। বর্ষার সময়টা ছাড়া আরব সাগর বাকি বছর চুপচাপ, গ্রাম্য কোনও নিরীহ জলাশয়ের মতো যেন ঘুমিয়ে থাকে। ঢেউ ওঠে কি ওঠে না। কেমন একটা ঝিমিয়ে থাকা ভাব। কিন্তু মনসুনের পায়ের আওয়াজ যেই কানে এল, আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে।
আমাদের কামরার দুটো জানলা খুললেই চোখে পড়ছে, সমুদ্রের ঢেউ উঁচু উঁচু হয়ে ধেয়ে আসছে বেলাভূমির দিকে। মধ্য প্রাচ্য নাকি অন্য কোনও দিক থেকে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ এসে বম্বের আকাশে জড়ো হতে শুরু করেছে। সি—গাল পাখিগুলো অদ্ভুত অদ্ভুত আওয়াজ করে ডানা ঝাপরাতে ঝাপরাতে মাঝসমুদ্র থেকে তীরের দিকে চলে আসছে। যে কোনও সময় যে দুর্যোগ এসে পড়তে পারে তার সংকেত খুব সম্ভব ওরা আগেই পেয়ে যায়।
মে মাসের বাকি দিন ক’টা নিমেষে ফুরিয়ে গেল। জুন মাস পড়ে গেছে। যত দিন যাচ্ছে আকাশ গাঢ় মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে। মেঘ চিরে ক্কচিৎ কখনও চকিতের জন্য মরা মরা রোদ দেখা দিয়েই মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। দিনের বেলাতেই আলো জ্বালতে হয়।
সেবার জুনের আট তারিখেই বর্ষা এসে গেল। প্রথমে দশ দিক কাঁপিয়ে ঘন ঘন বাজ পড়ার আওয়াজ, মেঘ আর আকাশ চিরে ফেড়ে বিদ্যুৎ চমকে যাওয়া আর অল্প অল্প বৃষ্টি। আরব সাগর কয়েক দিনে উত্তাল হয়ে উঠেছে।
আরও তিন চার দিন পর যা শুরু হল তার নাম তাণ্ডব। বিপুল তোড়ে আকাশ থেকে জলের ধারা নেমে আসছে। চারিদিক ঝাপসা, বিশ ফিট দূরে যারা চলছে ফিরছে, সব যেন ছায়ামূর্তি।
এই গল্পের গোড়ায় ধ্রুপদ ধামারের কথা বলেছিলাম। তাই প্রবল প্রতাপে শুরু হয়ে গেছে। বর্ষার ক্লাসিক্যাল মিউজিক।
বম্বে এমন এক শহর, ঝড়বৃষ্টি ভূমিকম্প যাই হোক না তাকে ঘরে আটকে রাখা অসম্ভব। চওল’—এর সবাই সকালে চান টান করে কামধান্দায় বেরিয়ে পড়ে।
কলকাতায় থাকলে হয়তো গরম গরম খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা খেয়ে কম্বল চাপা দিয়ে ঘরের এককোণে তোফা একখানা ঘুম লাগাতাম। কিন্তু শহরটার নাম যে বম্বে। অঝোরে বৃষ্টি ঝরে যাচ্ছে এই অছিলায় যে যার ডেরায় পড়ে কী থাকবে? কক্ষনো না। বম্বেতে কয়েক মাস মাত্র আছি। কিন্তু এর মধ্যে পরমেশ্বরণ আর আমি এখানকারই মতো হয়ে গেছি। দু’জনে দুটো রেনকোট কিনে নিয়েছি। গায়ে তাই চাপিয়ে দুপুরের অনেক আগে আগে বেরিয়ে পড়ি।
এদিকে বৃষ্টির থামাথামি নেই। চলছে তো চলছেই। ফোর্ট এরিয়ায় বিজ্ঞাপন এজেন্সির অফিসে সপ্তাহে দু’দিন যেতে হয়। বাকি পাঁচদিন যোগেশ্বরীতে। যে ফিল্ম কোম্পানির চিত্রনাট্য লিখছি, তারা সেখানে আমার জন্য একটা গেস্ট হাউস ঠিক করে দিয়েছে। নিরিবিলিতে সেখানে লেখালেখির কাজটা চালাই।
বৃষ্টিটা একনাগাড়ে প্রবল বেগে চলার পর তোড় কমে আসে, কিছুক্ষণ পর আবার যে কে সেই।
চওল—এ ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। ততক্ষণে শহরের রাস্তাঘাট জলে ডুবে গেছে। সাবার্বন ট্রেনও বন্ধ, কেননা রেললাইন কোমর সমান জলের তলায়। একমাত্র ভরসা এই বি ই এস টি’ র বাস।
জানতে পারলাম রাত বারোটার ভেতর চওল—এ ফেরার যে শর্তটা রয়েছে বর্ষকালে সেই কড়াকড়িটা থাকে না। ট্রেন বন্ধ, ট্যাক্সি বন্ধ, চওল—এর ভাড়াটেরা ঠিক সময়ে ফিরবে কী করে? গেট খোলাই থাকে। কেউ ফেরে রাত একটায়, কেউ দুটোয়, কি তারও পরে।
রোজই লক্ষ করি, দোতলার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে ক্রিস্টিনা ডি’সিলভা। শেষ ভাড়াটেটি না ফেরা অবধি দাঁড়িয়েই থাকে। কেউ ফিরলেই জিজ্ঞ্যেস করে, ‘রাস্তায় বহুৎ তখলিফ হল তো? যা যা, বিলকুল ভিজে এসেছিস। কামরায় গিয়ে গা মাথা ভালো করে মুছে ফেল। বারিষের পানি বহুৎ খতরনাক। বুখার টুখার হয়ে যায়। এই মনসুনে তোদের জন্যে খুব চিন্তা হয়। যা—যা—।’
শ্রীমতী রণচণ্ডীর এই ভারী নরম চেহারাটা আগে আর কখনও দেখিনি। বেশ অবাকই হই। কিন্তু আরও বড় রকমের বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছিল তা কি জানতাম।
সেই আমার প্রথম বম্বেতে আসা। লোকের মুখে মুখে শুনলাম সেবারের মতো বেয়াড়া, সৃষ্টিছাড়া মনসুন বম্বে আগে আর কখনও নাকি দেখেনি। অন্য সব বছর চার কি পাঁচ দিন একটানা বৃষ্টির পর দু’—একদিনের ইন্টারভ্যাল, তারপর নতুন এনার্জি ফের নিয়ে শুরু।
কিন্তু সেবার? সেই যে একদিন ভোরবেলায় টিপ টিপ, ঝিপ ঝিপ করে শুভারম্ভটা হয়েছিল তারপর বৃষ্টিটা জোর বাড়িয়ে টানা দশ দিন ঝরেই যাচ্ছে। বিশ্রাম টিশ্রাম নেই। শহরের নীচু এলাকাগুলো পনেরো ফিট জলের তলায়। রেললাইনে আট দশ ফিট জল। বেশির ভাগ রাস্তা ডুবে আছে। ট্যাক্সি, ট্রেন অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ। বাসও অনেক কম বেরুছে। খবেরর কাগজে লিখেছে বম্বের ইতিহাসে এটাই নাকি রেকর্ড বৃষ্টিপাত। আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে আরও পাঁচদিন বর্ষণ চলবে।
এই ভয়ঙ্কর দুর্যোগও বম্বেকে ঘরে ঢুকিয়ে দিতে পারেনি। গায়ে বর্ষাতি চাপিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ বেরিয়ে পড়েছে। মাথার ওপর বৃষ্টি নিয়ে হাঁটু কি কোমর সমান জল ঠেলতে ঠেলতে চলেছে তারা নিজের নিজের কাজের জায়গায়—অফিসে, আদালতে, ফ্যাক্টরিতে।
পরমেশ্বরণ শহরে নেই। সে গেছে দার্জিলিংয়ে। সেখানে তাদের ছবির শুটিং চলছে। দু’সপ্তাহ পর ফিরবে।
আমিও অন্য সবার মতোই বেরিয়ে পড়ি। চিত্রনাট্যটা খুব তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। তাই বিজ্ঞাপন এজেন্সিকে জানিয়ে দিয়েছি, একটা সপ্তাহ ফোর্ট এরিয়ায় তাদের অফিসে যেতে পারব না। পরে গিয়ে ইংরেজি কপিগুলো নিয়ে আসব।
খার—এর চওল থেকে বেরিয়ে জল ভাঙতে ভাঙতে সেদিন বড় রাস্তায় অর্থাৎ এস ভি রোডে চলে এসেছি । সেখান থেকে দু’তিনটে বাস পালটে যোগেশ্বরীর সেই গেস্ট হাউসে। সেখানে আমার একপ্রস্থ শুকনো পোশাক রেখে দিয়েছি। যোগেশ্বরীতে পৌঁছে সারা শরীর মুছে ভেজা জামা প্যান্ট পালটে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলাম। তারপর এক কাপ কফি নিয়ে চিত্রনাট্যের খাতা খুলে বসে পড়লাম। লেখার ফাঁকে একসময় লাঞ্চ, বিকেলের চা এবং রাত বারোটায় ডিনার। তারপর গায়ে বর্ষাতি চাপিয়ে বেরিয়ে এলাম।
রাস্তা সুনসান। সমানে বৃষ্টি পড়েই চলেছে। এধারে ওধারে তাকাতে তাকাতে চোখে পড়ল, বাসের চিহ্নমাত্র নেই। সাত আটটা লোক, তাদের গায়েও রেনকোট, বিরাট বিরাট চাকাওয়ালা মস্ত একটা ট্রাকে উঠছে। একরকম দৌড়েই তাদের কাছে চলে গেলাম। জিজ্ঞ্যেস করে জানলাম, ওদের কেউ বান্দ্রায় যাবে, কেউ খার—এ, কেউ সান্তাক্রুজে। বললাম, ‘আমাকে কাইন্ডলি আপনাদের সঙ্গে নিন। আমি খার—এ সমুদ্রের ধারে যাব।’
ট্রাক ড্রাইভার আমাদের কথা শুনছিল। বলল, ‘সমুন্দরের দিকে যাব না সাহেব। ওদিকে রাস্তার হাল বহুৎ বুরা। চাক্কা ফাঁস যায়েগা। বড়ে সড়ক এস ভি রোড তক নিয়ে যেতে পারি। ভাড়া দেড়শো।’
এস ভি রোড পর্যন্ত যেতে পারলে সমুদ্রের দিকের রাস্তাটা হেঁটেই যেতে পারব। বললাম, ‘ঠিক হ্যায়।’
‘চড়িয়ে।’
ওপরে উঠে ট্রাকের ছাউনির তলায় ঢুকে গেলাম। আমার সহযাত্রীরা সেখানেই রয়েছে। কথায় কথায় জানা গেল, যোগেশ্বরীর দিকে বাস বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তায় তারা দাঁড়িয়ে ছিল। আচমকা এই ফাঁকা ট্রাকটা দেখে থামিয়েছে।
একজন বলল, ‘একেবারে হেভেন—সেন্ট, ঈশ্বরপ্রেরিত। ট্রাকটা না পেলে আজ কী হাল যে হতো!’
ট্রাকটা যখন খার—এর পাশে এস ভি রোডে আমাকে নামিয়ে চলে গেল, রাত প্রায় দেড়টা।
সমুদ্রের দিকের রাস্তাটা আর রাস্তা নেই, প্রায় নদী হয়ে উঠেছে। প্রবল বেগে স্রোত চলছে আমাদের চাওলটার দিকে।
কোথাও মানুষজন নেই। বর্ষার এই মাঝরাতে বম্বে যেন এক ভুতুড়ে শহর। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। আমি পা বাড়িয়ে দিলাম। হাঁটতে আর হল না, জলস্রোত আমাকে ধাক্কা মারতে মারতে নিয়ে চলল। একটু অসাবধান হলেই ফেলে দেবে। কোনও রকমে ব্যালান্স রাখতে রাখতে এগিয়ে চললাম।
এই রাস্তাটা শুকনো থাকলে পনেরো মিনিট হাঁটলেই ক্রিস্টিনা ডি’সিলভার চওল। আজ তার কাছাকাছি পৌঁছতে তার তিনগুণ সময় লেগে গেল।
রেনকোট গায়ে থাকলেও বম্বের বর্ষাকে ঠেকানো প্রায় অসম্ভব। ক’দিন ধরে সমানে ভিজতে ভিজতে যোগেশ্বরীতে যাচ্ছি, আবার ভিজতে ভিজতেই ফিরছি। শরীর এমনিতেই কাহিল হয়ে আছে। জ্বর জ্বর ভাব। এই নিয়েই বেরুচ্ছিলাম। কিন্তু বম্বের মনসুন আজ আমাকে আগাগোড়া ঝাঁকিয়ে যাচ্ছে। ঠিকমতো হাঁটতে পারছি না; এক কোমর জলের তলায় এলোমেলো ধুঁকতে ধুঁকতে এলোমেলো পা ফেলছি। মাথাটা ভীষণ ঘুরছে। যে কোনও মুহূর্তে বোধ হয় টাল খেয়ে পড়ে যাব।
আমাদের চওলটার খুব কাছেই প্রচুর খানাখন্দ এবং একটা বিশাল গর্ত। প্রথম যখন এখানে আসি ওগুলো চোখে পড়েছিল। তারপর থেকে খুব সাবধানে যাওয়া—আসা করেছি। কিন্তু আজ টাল সামলাতে না পেরে জলে বোঝাই মস্ত গর্তটার ভেতর পড়ে গেলাম। গর্তটা যে এত গভীর, আগে বুঝতে পারিনি।
হাত বাড়িয়ে সেটার একটা দিক ধরে যে ওপরে উঠে আসব তেমন শক্তি শরীরে নেই। ক্রমশ মনে হচ্ছে আমি নীচের দিকে তলিয়ে যাচ্ছি। গোঙানির মতো আওয়াজ করে শুধু বলতে পারছি, ‘বাঁচাও—বাঁচাও!’ বলছি! আর জলের ভেতর এলোপাতাড়ি হাত—পা ছুড়ছি। বাঁচার মরিয়া চেষ্টা।
হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি ভেদ করে কয়েকটি শব্দ কানে এল, ‘এ যোহন, এ ব্রাগাঞ্জা, এ রামনাথ! ঘরসে জলদি জলদি নিকালকে আ—’
নিশ্চয়ই ক্রিস্টিনা ডি’ সিলভার কণ্ঠস্বর। মনে পড়ল, যত রাতই হোক চওল—এর সব বাসিন্দা না ফেরা পর্যন্ত সে দোতলার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।
একটু পরেই আবছাভাবে দেখতে পেলাম কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে ক্রিস্টিনা ডি’সিলভা দৌড়তে দৌড়তে এসে আমাকে গর্ত থেকে টেনে তুলল। ভালো করে তাকাতে পারছি না, চোখ বুজে বুজে আসছে। তারই মধ্যে দুজন আমাকে কাঁধে তুলে আমাদের কামরাটার সামনে নিয়ে এল।
যারা আমাকে কাঁধে চাগিয়ে এনেছে তারা ছাড়াও কয়েকজন রয়েছে। ক্রিস্টিনা ডি’সিলভা তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘লেড়কাটার পকেটে চাবি আছে। নিকালকে কামরা খুলো।’
তালা খোলার মতো শব্দ কানে এল। তারপর আমাকে ঘরে ঢুকিয়ে, আলো জ্বেলে, রেন কোট, ভেজা জামা প্যান্ট খুলে, দড়িতে ঝুলানো শুকনো পোশাক পরিয়ে দিয়ে আমাকে শুইয়ে দেওয়া হল।
যারা আমাকে পাতাল প্রবেশ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে তাদের সারা শরীর, পোশাক ভিজে সপসপে হয়ে গেছে। কামরায় মেঝেতে জলের স্রোত।
ক্রিস্টিনা ডি’সিলভা বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে লক্ষ্য করছিল। কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠল, ‘আরে! বঙ্গালি লেড়কাটার গা তো পুড়ে যাচ্ছে। তাওয়া বসিয়ে রোটি সেঁকা য্যায়সে। বহুৎ টেম্পারেচার। আভি ডক্টর নিম্বলকারের কোঠিতে চলে যা। ডক্টরকে সাথ নিয়ে চলে আসবি। ফিরে এসে কামরার জল মুছে দিয়ে তোদের কাপড়া উপড়া চেঞ্জ করে আসবি। তারপর আমি চেঞ্জ করে আসব। যা—জলদি ওয়াপস আনা—।’
সবাই চলে গেল। আমরা দুটো প্লাস্টিকের টুল কিনেছিলাম। একটা টেনে এনে আমার বিছানার পাশে বসল ক্রিস্টিনা ডি’সিলভা। কপালে হাত বুলোতে বুলোতে ভারি কোমল গলায় বলল, ‘খুব দর্দ হচ্ছে?’
রণচণ্ডী মার্কা এই মানুষটাকে আজ যত দেখছি, ততই অবাক হচ্ছি। একটা মানুষের মধ্যে কতরকম মানুষ যে লুকোনো থাকে। মাথাটা যন্ত্রণায় টন টন করছে, কপালের দুপাশের রগগুলো যেন ছিঁড়ে পড়বে। বললাম, ‘হ্যাঁ।’
‘ডক্টর নিম্বলকাকরের খুব নাম। সব ঠিক হয়ে যাবে। ডরো মাত।’ ক্রিস্টিনা ডি’সিলভা আমার কপালের দু’পাশে টিপে দিতে লাগল।
যারা ডাক্তার নিম্বলকারকে আনতে গিয়েছিল আরেক দফা বৃষ্টিতে ভিজে জামাপ্যান্ট আরও সপসপে করে ফিরে এসে জানাল, ‘ডাক্তারের গাড়ির চাক্কা ফেঁসে গেছে। তাছাড়া তিনি যেখানে থাকেন, সেদিকের রাস্তা টাস্তার হালও ভীষণ খারাপ। এই অবস্থায় তাঁর পক্ষে আসা সম্ভব নয়।’
ক্রিস্টিনা ডি’সিলভা এক রকম লাফ দিয়েই উঠে দাঁড়াল। চড়া গলায় বলল, ‘সম্ভব না বললেই হল। আমরা থাকতে এই বঙ্গালি লেড়কা মরে যাবে? দু’জন এখান থেকে লেড়কাকে দ্যাখ। বাকি সবাই আমার সঙ্গে চল?’ দলবল নিয়ে সে বেরিয়ে গেল।
আমার চোখ দুটো আধাআধি বোজা। কষ্ট করে পুরোটাই খুললাম। যা দেখলাম ভাবতেও পারিনি। সামনের চত্বরের একধারে বিরাট বিরাট চাকা লাগানো দুটো ঠেলাগাড়ি রয়েছে। বেশ উঁচু উঁচু। তার একটা বের করে ঠেলতে ঠেলতে ওরা চলে গেল।
মিনিট কুড়ি পঁচিশ বাদে দেখা গেল ঠেলা গাড়ির ওপর স্যুটবুট পরা, বর্ষাতিতে মোড়া, মাথায় বৃষ্টি ঠেকানোর ক্যাপ—একজন বসে আছেন। নিশ্চয়ই ডাক্তার নিম্বলকার। তাঁর মাথার ওপর ঠেলাগাড়ির দু’পাশ থেকে দু’জন তেরপোল ধরে আছে। দু’জন পেছন থেকে গাড়িটা ঠেলছে, সামনের দিক থেকে আরও দু’জন টেনে আনছে। তাদের আগে আগে হুঁশিয়ার করতে করতে এগিয়ে আসছে ক্রিস্টিনা ডি’সিলভা,—’সামহালকে—সামহালকে। সড়ককা গাড্ডা বাচাকে—।’
ধুম জ্বরের মধ্যেও মজাই লাগল। ছেলেবেলায় পূর্ব বাংলায় নৌকো, ঘোড়া বা পালকিতে চড়ে ডাক্তার কবিরাজকে রুগিদের বাড়িতে যেতে দেখেছি। কলকাতায় এসে মোটরে চড়া ডাক্তারদের দেখেছি। কিন্তু ঠেলাগাড়িতে চড়া ডাক্তার সেই প্রথম।
খোলা গেটের ভেতর দিয়ে ঢুকে গাড়িটা চওল—এর চত্বর পেরিয়ে আমাদের কামরার সামনে এসে দাঁড়াল।
ক্রিস্টিনা ডি’সিলভা বলল, ‘আসুন ডক্টর, আসুন। পেশেন্ট এখানেই আছে।’ বলে সে আমাদের কামরায় ঢুকে পড়ল। তার পেছনে পেছনে পেট মোটা, ঢাউস একটা মেডিক্যাল ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে ডাক্তার নিম্বলকার। যারা ঠেলাগাড়ি ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এসেছে তারা বাইরে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। তারা এমন ভিজেছে যে ঘরে ঢুকলে তাদের জামা প্যান্ট থেকে জল ঝরে মেঝেতে ঢেউ খেলে যাবে।
ডাক্তার নিম্বলকার পরমেশ্বরণের ফাঁকা বিছানায় তাঁর ব্যাগটা রেখে আমার দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিলেন, ‘এই ছেলেটাই পেশেন্ট তো?’
ক্রিস্টিনা ডি’সিলভা মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ।’
ডাক্তার আমার কপালে হাত রেখেই তক্ষুনি সরিয়ে নিয়ে চটপট তাঁর ব্যাগটা খুলে থার্মোমিটার আর স্টেথিসকোপ বের করে প্রথমে আমার জিভের তলায় থার্মোমিটার ঢুকিয়ে দিয়ে জ্বর দেখলেন। টেম্পারেচার এক শো পাঁচ। তারপর চোখের তলা টেনে, বুক পিঠ পরীক্ষা করে বললেন, ‘কেসটা বেশ সিরিয়াস।’
ক্রিস্টিনা ডি’ সিলভার চোখে মুখে উদ্বেগ ফুটে বেরোল। ‘কীরকম—’
‘মনে হয় ছেলেটা অনেকক্ষণ জলে ভিজেছে। নিমুনিয়া হল কিনা ব্লাড টেস্ট না করলে বোঝা যাবে না। কালই টেস্টের ব্যবস্থা করব। যাই হোক, আজ একটা ইনজেকশান দিচ্ছি। দু’দিনের মতো ট্যাবলেটও দিয়ে যাব। দাওয়াই এম্পটি স্টমাকে খাওয়াবেন না। আজ একটা ট্যাবলেট, কাল তিনটে। শক্ত খাবার চলবে না। তিন দিন দুধ আর পাতলা সুজি। আর হাঁ, অ্যারেবিয়ান সী থেকে খুব ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। পেশেন্টকে এভাবে ফেলে রাখা ঠিক হবে না। কম্বল টম্বল দিয়ে ওর বডিটা ঢেকে দিন।’
‘ভুল হয়ে গিয়েছিল। ব্যবস্থা করছি।’
ইনজেকশন দেওয়া হল। একটা ছোট কাগজের প্যাকেটে ট্যাবলেট ভরে ক্রিস্টিনা ডি’সিলভাকে দিতে দিতে কখন কখন খাওয়াতে হবে বুঝিয়ে দিয়ে ডাক্তার বেজার মুখে বললেন, ‘ম্যাডাম, আপনি আমাকে ধমকি দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে এসেছেন, অন্য কেউ হলে তা পারত না। এই বারিষে আমার খুব তকলিফ হয়েছে।’
‘ঝড় তুফান, বারিষ, আর্থকোয়েক যাই হোক, পেশেন্টের বাড়ি থেকে ডাক এলে আপনাকে যেতেই হবে। মানুষের জান বাঁচানোই আপনার কাজ।’
ডাক্তার কেমন যেন মিইয়ে গেলেন। উত্তর দিলেন না। বুঝতে পারলাম, শুধু এই চওল—এই নয়, সমস্ত এলাকাটা জুড়ে ক্রিস্টিনা ডি’সিলভার প্রবল দাপট।
শ্রীমতী রণচণ্ডী তার শার্টের পকেট থেকে একতাড়া ভিজে নোট বের করে বলল, ‘ডক্টর, আপনি তো পেশেণ্টের বাড়ি গেলে ফী নেন ফোর হানড্রেড রুপিজ। এখানে এইট হানড্রেড আছে। বারিষে আপনার তখলিফ হয়েছে। তাই ফী—টা ডবল। যে কদিন বেঙ্গলি লেড়কাটা বিলকুল কিওরড না হচ্ছে, খাড়া হয়ে না বসছে, রোজ আপনাকে আসতে হবে। আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, আরও কয়েকদিন জোর বারিষ হবে। হোক। রোজ ঠেলা গাড়ি পাঠিয়ে দেব। রোজ ফী—টা ডবল। আর হাঁ, নোটগুলো ভিজে গেছে। বাড়ি ফিরে ওভেনে তাওয়া চাপিয়ে তার ওপর রেখে ওগুলো শুকিয়ে নেবেন।’
এবারও ডাক্তারের জবাব নেই। তাঁকে ঠেলাগাড়িটায় তুলে দেওয়া হল। যারা তাঁকে টানতে টানতে নিয়ে এসেছিল, তারাই তাঁকে পৌঁছে দিতে গেল।
এদিকে এত মানুষের গলার আওয়াজে চওল—এর অনেকের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তারা দৌড়ে আমাদের কামরায় চলে এল।
ক্রিস্টিনা ডি’ সিলভা তাদের বলল, ‘তোরা এসেছিস, ভালো হয়েছে। যোহন রামনাথরা ডক্টরকে পৌঁছে দিতে গেছে। ওরা বারিষে খুব ভিজেছে। আর ওদের খাটাব না। ওদের যার যার কামরায় পাঠিয়ে দেব। বাকি রাতটা ঘুমিয়ে নিক। তোরা দু’জন বাঙ্গালি লেড়কাটার পাশে বোস। বাকি সবাই বালতি কাপড়া ঝাড়ু এনে ফ্লোরের জল সরিয়ে মুছে ফেল। আমি কম্বল খুঁজি।’
ক্ষীণ গলায় জানালাম, আমাদের কোনও কম্বল টম্বল নেই।
ক্রিস্টিনা ডি’ সিলভা আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে। আমি ওপরে যাচ্ছি। ড্রেস ট্রেস চেঞ্জ করে জলদি ফিরে আসব।’
ঘরের জল সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্রিস্টিনা ডি’ সিলভা ভেজা পোশাক পালটে গরম দুধ এবং একটা কম্বল হাতে নিয়ে ফিরে এল। আমার গায়ে কম্বলটা চাপিয়ে ট্যাবলেট আর দুধ খাইয়ে দিয়ে বলল, ‘ঘুমিয়ে পড়।’ সে আমার মাথায় হাত বুলোতে লাগল।
ট্যাবলেট আর ইঞ্জেকশনে এমন কিছু ছিল, আর তাকিয়ে থাকা গেল না। দু’চোখ জুড়ে ঘুম নেমে এল।
পরদিন যখন ঘুম ভাঙল, সকাল হয়ে গেছে। কিন্তু বৃষ্টি থামেনি। চোখে পড়ল, শিয়রের কাছে বসে আছে ক্রিস্টিনা ডি’ সিলভা। সারারাতই তা হলে এখানেই না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে।
সে বলল, ‘তোর মুখ ধোবার জন্যে জল, টুথ পাউডার, দুধ হালুয়া টালুয়া নিয়ে আসছি।’ চওল—এর দু’জনকে ডেকে আমার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে চলে গেল।
এরপর আমার রক্ত, থুতুটুকু পরীক্ষা করা হল। না, নিমুনিয়ার কোনও লক্ষণ নেই। জ্বরটা হয়েছে দিনের পর দিন বৃষ্টিতে ভিজে।
বর্ষার বিক্রম এতটুকু কমেনি। একটানা ঝরেই চলেছে। অতএব রোজই ঠেলা গাড়িতে আরোহণ করে আমাকে দেখতে আসছেন ডাক্তার নিম্বলকার।
রোজই দিনের বেশির ভাগ সময়টা আমার ঘরে থাকে ক্রিস্টিনা ডি’ সিলভা। পুরো রাতটা আমার পাশে বসে কাটিয়ে দেয়। সকালে মুখ ধুইয়ে দুধ সুজি খাইয়ে ওষুধ খাওয়ায়। দুপুরে এবং রাত্তিরে ফের সুজি।
পাঁচ দিন পর বৃষ্টি থামল। আমার জ্বরটাও আর নেই। ডাক্তার দিয়েছে ওষুধ। পথ্যও। আমি ডিম মাংস খাই—না, তাই আমার জন্য ভেজিটেবল সুপ এবং মাছ ভাজা আর ফল।
আরও কয়েকদিন বাদে বেশ কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলাম। ডাক্তার আর আসছে না। ফোনে ক্রিস্টিনা ডি’ সিলভার কাছ থেকে আমার খবর নেন।
ক্রিস্টিনা ডি’ সিলভা আগের মতো সারারাত আমার শিয়রে বসে কাটায় না। তবে বেশ খানিকটা সময় কাছেই থাকে। দিনের বেলা খাবার তৈরি করে আনে। সেসব খাওয়ানোর পর ওষুধ খাইয়ে যায়।
পুরোপুরি সুস্থ হতে আরও কিছুদিন লাগল। ডাক্তারের অ্যাডভাইস, এখন বাইরে বেরুতে পারি। তবে বেশি ঘোরাঘুরি বা বেশি কাজের চাপ নেওয়া চলবে না।
দার্জিলিংয়ের শু্যটিং সেরে পরমেশ্বরণ ফিরে এল। ক্রিস্টিনা ডি’ সিলভার দায়িত্বও কিছুটা কমে গেল।
এর ভেতর একদিন যে প্রোডিউসারের চিত্রনাট্য লিখছিলাম তিনি আমার জ্বরটরের খবর পেয়ে বেশ কিছু টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন।
একদিন বিকেলে হাজার চারেক টাকা পকেটে পুরে দোতলায় ক্রিস্টিনা ডি’ সিলভার অফিসে গেলাম। চওল—এর মালকিন টেবিলের ওপর ঝুঁকে গুচ্ছের কাগজপত্র দেখছিল। পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকাল, ‘আয় আয়। বৈঠ।’
আগে আমাকে তুমি করে বলত। জ্বরটা বাধাবার পর ‘তুমি’ টা ‘তুই’ হয়ে গেছে।
মুখোমুখি বসে পড়লাম।
ক্রিস্টিনা ডি’ সিলভা এবার বলল, ‘এতটা সিঁড়ি ভেঙে উঠলি। তখলিফ হচ্ছে না তো?’
‘না। আমি ঠিক আছি।’
‘কিছু বলবি?’
‘হ্যাঁ।’ পকেট থেকে টাকাগুলো বের করে বললাম, ‘আমার জন্যে রাতের পর রাত জেগেছেন, কত যত্ন করেছেন। আমাকে বাঁচিয়েছেন। অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। তাই—’
‘তাই কী?’
নোটের গোছাটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘যাঁদের কাজ করছি তাঁরা টাকা পাঠিয়েছেন। এখানে চার হাজার আছে।’
মুহূর্তে বাজ পড়ার মতো আওয়াজ হল, ‘তুই আমাকে টাকা দিতে এসেছিস! ইউ আর অ্যাজ গুড অ্যাজ মাই সন। এত সাহস হল কী করে? বান্দর, উল্লু কাঁহিকা। যা, ভাগ।’
আমি হতচকিত। ভয়ে ভয়ে উঠে দরজা পর্যন্ত গিয়ে একবার ফিরে তাকালাম। ক্রিস্টিনা ডি’ সিলভার মুখে ভারি মিষ্টি একটি হাসি ফুটে উঠেছে। এমন হাসি শুধু মায়েরাই হাসতে পারে। একে কী বলে? স্বর্গীয় হাসি কি?
আমি প্রায় সারা দেশ ঘুরেছি। মায়েদের দেখেছি, দেখেছি কখনও আন্দামানের পেনাল কলোনিতে, কখনও কলকাতার অলিগলিতে, কখনও মাদ্রাজের মেরিনা বীচে। সেদিন দেখলাম আরব সাগরের ধারের এক চওল’—এ।
__