কোন ভাঙনের পথে এলে

কোন ভাঙনের পথে এলে

দিন- ১

গাড়িটা যখন বাংলোর সামনে দাঁড়াল তখন দুপুর দেড়টা বাজে। আকাশের মুখ ভার। চারদিক অন্ধকার করে এসেছে। যখন তখন ভাসিয়ে দেবার প্ল্যান করছে। ঠিকানাটা আরেকবার দেখল নীল । ঠিকই আছে। কেয়ারটেকার থাকার কথা একজন। একটা নাম্বারও দিয়েছিল ভাদুড়িদা। মোবাইল বের করে ফোন করল সে। ফোন সুইচড অফ বলছে। নীল গাড়ি থেকে নামল। ড্রাইভারকে বলল “একটু দাঁড়ান, আমি একটু দেখি, কেউ আছে নাকি।”

ড্রাইভার গোটা রাস্তার নাছোড়বান্দা ভাবের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বলল “স্যার, এখানে কিচ্ছু নেই বিশ্বাস করুন, কত ভাল ভাল জায়গা আছে, আপনি এখানে থেকে কী করবেন?”

নীল কানে দিল না কথাটা। বাংলোর গেট খুলে ভিতরে প্রবেশ করল। বাগান ছিল এককালে। এখন ইতস্তত বিক্ষিপ্ত জঙ্গল। শীত লাগছিল নীলের। মাফলারটা ভাল করে পেচিয়ে নিল। “কেউ আছেন?”

বাংলোর দরজার সামনে গিয়ে জোরে হাঁক দিল নীল। দরজায় তালা নেই। নীল আশান্বিত হল। “আছেন কেউ?”

“সেনগুপ্ত সাহেব?”

নীল দেখল বাংলোর কোণা থেকে হাফ প্যান্ট পরা একজন বেরিয়ে এল,“আপনি তুষারবাবু?”

“একদম, ঠিক ধরেছেন।”

“আপনার ফোন অফ কেন?”

“কী করব, কাল দুপুরে পাওয়ার কাট হয়েছে স্যার, এখনও আসে নি।”

নীল বলল “সেকী! তাহলে?”

তুষারবাবু বললেন “মোমবাতি আছে তো, চিন্তা করছেন কেন?”

মোমবাতি থাকলেই যেন সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল এমনভাবে দাঁত বের করলেন তুষারবাবু। ভদ্রলোকের কথায় একটা পূর্ববঙ্গীয় টান আছে। “আচ্ছা, আপনার লাগেজটা গাড়িতেই আছে তো?”

নীল বলল “হ্যাঁ।”

“চলুন স্যার, নামিয়ে নি।”

নীল আপত্তি জানাল, “না না, আপনি কেন নেবেন, আমি নামিয়ে নিচ্ছি।”

তুষারবাবু জিভ কেটে বললেন “কী যে বলেন স্যার, আপনি সাহেবের গেস্ট বলে কথা।”

ড্রাইভার ডিকি খুলে ব্যাজার মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। তুষারবাবু নীলের একটা কিট ব্যাগ আর স্যুটকেসটা নামিয়ে নিলেন। নীল ড্রাইভারকে টাকা মিটিয়ে দিল। ড্রাইভার বলল “স্যার, ফিরবেন কী করে?”

নীল অবাক হল “কেন এখানে গাড়ি পাওয়া যাবে না?”

ড্রাইভার মাথা চুলকে বলল “পাওয়া যাবে, তবে কোন সমস্যা হয় যদি? এক কাজ করুন, আমার নাম্বারটা নিয়ে রাখুন।”

নীল নম্বরটা নিয়ে নিল। ছেলেটা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। তুষারবাবু বাংলোয় ঢুকতে ঢুকতে বললেন “এই শীতে কি কোন কাজে এসেছেন স্যার? সাধারণত এই সময় তো কেউ আসে না।”

নীল বলল “না, আমি ছুটি কাটাতে এসছি, জানলা গুলো খুলবেন না?”

“বৃষ্টি নামবে স্যার এক্ষুণি, দেখছেন না কী কালো করে এসছে?”

নীল কিছু বলল না। তুষারবাবু তার হাফ প্যান্টের পকেট থেকে টর্চ বের করে মোমবাতি খুঁজে সেগুলো জ্বাললেন। মোমের আলোয় নীল বুঝতে পারল ড্রয়িংরুমের আসবাবপত্র সবই দামী কাঠের। “আপনার লাঞ্চ কিন্তু রেডি স্যার। এখন খেয়ে নেবেন?”

নীল বলল “নাহ, ফ্রেশ হলাম না তো”!তুষারবাবু বললেন “ঠিক ঠিক, আচ্ছা আমি গরমজল পাঠাচ্ছি। চলুন আপনার রুমটা দেখিয়ে দি।”

নীল তুষারবাবুর পিছন পিছন গেল। তুষারবাবু একটা মোমবাতি নিয়ে এসছিলেন। বেডরুমের দরজা খুলতেই পাওয়ার চলে এল। তুষারবাবু উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন “আপনি খুব লাকি স্যার। এবার ভেবেছিলাম দুদিন লাগিয়ে দেবে।”

নীল বেডরুম দেখে খুশি হল। বিরাট ঘর। ঘরের সঙ্গে মানানসই চমৎকার খাট। সাদা ধবধবে চাদর পাতা। কম্বল পাতা পায়ের কাছে। নীলের বিছানাটা দেখেই ঘুম পেয়ে গেল। তুষারবাবু তার স্যুটকেস আর কিট ব্যাগ এনে ঘরে ঢুকিয়ে বললেন “আপনি একটু বসুন স্যার, আমি গরম জল পাঠাচ্ছি।”

ঘরের ভিতরে বেশ ঠান্ডা লাগছিল। নীল ঠিক করল লাঞ্চ করেই কম্বলের ভিতর ঢুকে যাবে। তুষারবাবু হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন।

নীল বলল “আচ্ছা শুনুন।”

তুষারবাবু বললেন “হ্যাঁ স্যার।”

“বলছি এখানে ব্যাঙ্কটা কোনদিকে?”

“ব্যাঙ্কে যাবেন? আজ তো রবিবার।”

অবাক হয়ে বললেন তুষারবাবু। নীল মাথা নাড়ল “না ব্যাঙ্কে কাজ নেই, একজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে।”

তুষারবাবু বললেন “ওহ, ব্যাঙ্কের লোকের সঙ্গে?”

নীল বলল “হ্যাঁ। ব্যাঙ্ক কি কাছেই?”

তুষারবাবু বললেন “না, ব্যাঙ্কের জন্য আপনাকে বাজারে যেতে হবে স্যার। দূর আছে। আচ্ছা, দুপুরে খেয়েই বেরিয়ে যাবেন?”

নীল বলল “না না, বিকেলের দিকে বেরোতে পারি।”

তুষারবাবু বললেন “দুপুরে যাবেন? এখানে কিন্তু ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে যায়। চিনে ফিরতে পারবেন তো?”

নীল বলল “সে না হয় দেখা যাবে, বাজারে গাড়ি পাওয়া যাবে তো?”

তুষারবাবু বললেন “তা পাওয়া যাবে। কিন্তু আপনি যার সঙ্গে দেখা করতে যাবেন, তিনি কোথায় থাকেন? আজ ছুটির দিনে ব্যাঙ্কে গিয়ে তাকে পাবেন কী করে? একটা জিনিস হতে পারে, আপনি ওনাকে ফোন করে নিন বরং।”

নীল থমকাল কথাটা শুনে। তারপর বলল “আচ্ছা, আজ না হয় বাজারে হেঁটেই আসা যাবে।”

তুষারবাবু বললেন “ঠিক আছে। আচ্ছা, কথায় কথায় দেরী হয়ে যাচ্ছে স্যার,ওহ…” বলে থমকালেন তুষারবাবু, “দেখেছেন? আমি আবার গ্যাসে জল গরম করার কথা বলতে যাচ্ছিলাম, এখন তো পাওয়ার চলে এসছে। আপনি গীজার ব্যবহার করুন। আচ্ছা, আমি চালিয়ে দিচ্ছি।”

বেডরুম সংলগ্ন বাথরুমে ঢুকে গীজার চালিয়ে দিলেন তুষারবাবু। “মিনিট দশেক পরে গরম জল চলে আসবে স্যার। আচ্ছা দুপুরে মুরগীর ঝোল, আলুভাজা আর ভাত। অসুবিধা নেই তো?”

নীল হাসল “মুরগীতে আমার কোনদিনও অসুবিধা নেই।”

“তাহলে আমি লাঞ্চের ব্যবস্থা করি। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন স্যার।”

তুষারবাবু বেরিয়ে গেলেন। নীল মোবাইলটা বের করল। হোয়াটস অ্যাপ খুলে একটা কন্ট্যাক্ট খুলে অনেকক্ষণ ডিপিটার দিকে তাকিয়ে বলল “ভাল আছ, তিতির?”

রান্না বেশ ভাল হয়েছিল। রান্নার লোক একজন নেপালি মহিলা। তিনিই সার্ভ করে দিলেন। তুষারবাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন।

নীল বলল “আপনিও খেয়ে নিতে পারেন তো?”

তুষারবাবু অদ্ভুতভাবে হেসে বুঝিয়ে দিলেন এটা তিনি ভাবতেই পারেন না।”

নীল বলল “আপনারা ঝালটা একটু বেশি খান না?”

তুষারবাবু বললেন “বেশি হয়েছে ঝাল? এ বাবা, দেখেছেন।”

নীল বলল “না না, বেশি হয় নি। আমি ঝাল বেশিই খাই, ও নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আচ্ছা আপনাদের এখানে মোমো বানায় না?”

তুষারবাবু বললেন “হ্যাঁ, আজ বিকেলে তো মোমোই থাকছে স্যার।”

নীল বলল “বাহ। আপনি তো এরকম করলে আর কোথাও যাওয়া হবে না আমার। এত ভাল খাওয়াচ্ছেন।”

তুষারবাবু খুশি হলেন “থাকুন না স্যার যত খুশি, এই পোড়ো জায়গায় কেউ আসেই না।”

নীলের চোয়াল শক্ত হল “নাহ, থাকলে হবে না, একটা কাজ আছে, করেই চলে যাব।”

তুষারবাবু বুঝলেন না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। খেয়ে দেয়ে ঘরে ফিরে নীল বুঝল তুমুল বৃষ্টি নেমেছে।

জানলার পর্দা সরাল। চারদিক ধুয়ে যাচ্ছে বৃষ্টিতে।

“আজ আর আপনার বেরনো হবে না স্যার।”

তুষারবাবু এসছেন।

নীল বলল “তাই দেখছি, এখানে তো ভালই শীত পড়ে।”

তুষারবাবু বললেন “তা পড়ে। রাতের দিকে আরও পড়বে। পাহাড়ি এলাকা, শীত তো পড়বেই। আপনি কি এর মধ্যে চারদিকটা ঘুরবেন? একটা গাড়ি ঠিক করে দেব?”

নীল বলল “এক কাজ করুন, কালকে ব্রেকফাস্ট করে আমি বাজার যাব একটু। তখন গাড়ি ঠিক করে দিলেই হবে।”

তুষারবাবু বললেন “আচ্ছা স্যার। আপনি তবে রেস্ট নিন। আর পারলে মোবাইলটা চার্জে বসান। ভাবগতিক সুবিধের ঠেকছে না। আবার কারেন্ট চলে যেতে পারে।”

নীল মাথা নাড়ল। তুষারবাবু বললেন “আমি আসছি স্যার।”

নীল অবাক হল “আপনি এখানেই থাকেন না?”

তুষারবাবু বললেন “হ্যাঁ, পিছনে একটা ঘর আছে। তবে রান্না করার লোক বাইরে থেকে আসে। সব সময় তো আর গেস্ট আসেন না, সব সময় কী বলছি, খুব কম দিনই এখানে কেউ আসেন। কী করবে এসে এখানে? কিছু দেখার তো তেমন নেই। বেশিরভাগ চা বাগানও বন্ধের মুখে। সাহেব তো শুনছিলাম বাংলোটাও বেঁচে দিতে পারেন।”

নীল বলল “এই বাংলোয় ভূত আছে নাকি?”

তুষারবাবু হাসতে হাসতে বললেন “ও থাকলেই ভাল হত বোধহয়। কারও সঙ্গে কথা বলা যেত অন্তত।”

“আপনি কলকাতার?”

“হ্যাঁ। কলকাতা ঠিক না, আমার বাড়ি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায়।”

“বাংলো বিক্রি হয়ে গেলে কি করবেন?”

“যিনি কিনবেন তিনি আর কাকে পাবেন বলুন তো স্যার? কে থাকতে আসবে এখানে?”

“বাহ, আপনি তো বেশ কনফিডেন্ট।”

“কী করব স্যার? হাতে পায়ে ধরে থাকতে হবে। সাতচল্লিশ পেরোলাম। এই বয়সে আর কোথায় যাব? বিয়ে থা করিনি। একটা পেট। চলে যাবে কম মাইনে দিলেও।”

“বিয়ে থা করেন নি, কেন?”

“হাসালেন স্যার। নিজের পেটই চলে না আবার আরেকজনকে জুটাব?”

নীল আর কিছু বলল না। তুষারবাবু বললেন “আচ্ছা, স্যার আপনি রেস্ট করুন।”

তুষারবাবু চলে গেলে নীল জানলার কাছে দাঁড়াল। তুমুল শীত। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাইরে বৃষ্টির শব্দ। সে লাইট অফ করে দিল। ঘরের মধ্যে অদ্ভুত এক আলো আঁধারি তৈরি হয়েছে। খাটে বসল নীল। ফোনটা খাটেই ফেলে খেতে গেছিল। চার্জে বসানোর জন্য ব্যাগ থেকে চার্জার বের করে কী মনে হল, সে তিতিরকে ফোন করল। ফোনটা বেজে গেল। তিতির ধরল না। নীল জানত ধরবে না। অন্য নম্বর থেকে ফোন করবে না সে কোনদিন। ধরলে চেনা নম্বর থেকেই ধরুক নয়ত ধরতে হবে না। ফোনটা চার্জে বসিয়ে চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করল নীল। সারারাত ট্রেনে এক ফোঁটাও ঘুমাতে পারে নি। শরীরে ক্লান্তি আছে। যেদিন থেকে ঠিক করেছে, ব্যাপারটা করতে হবে, সেদিন থেকে রাতে ঘুম হচ্ছে না তার। ওই মুখটা, যেটা তাকে ছেড়ে গেছে, সেই মুখটা যেন আর কারও না হয়। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে হবে মুখটা।

দিন ২

পর্ব ৩

সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল তোরসার। সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। ঘুম ভেঙে বেশ খানিকক্ষণ বিছানাতেই শুয়ে থাকল সে। কলকাতায় থাকাকালীন এত শীতের কথা ভাবাই যেত না। কোন কোন দিন তো ফ্যানও চালাতে হত!

ডিসেম্বর মাসে এখানে শীত যে কামড়টা দেয় তা শীতকাতুরেদের সহ্য হবার কথা নয়। তোরসা শীতকাতুরে নয়। সে শীতপ্রেমী। এই চাকরিটা এ ক’দিনেই সে ভালোবেসে ফেলেছে। নতুন জায়গা, নতুন মানুষ, নতুন চাকরি। আর এই পোস্টিংটা কলকাতা থেকে দূরে হয়ে সব থেকে ভাল হয়েছে। যদিও ব্যাঙ্কের চাকরি একটু গোলমেলে আছে, ক্যাশে বসতে প্রথম প্রথম একটু ভয় ভয় করত, তবু মাসের শেষে মাইনেটা ঢুকলে বেশ ভাল লাগে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ছ’টা দশ। তোরসা রোজের মতই সকাল সকাল স্নান, পুজো সেরে নিল। অভ্যাসবশত হোয়াটস অ্যাপ চেক করল। একগাদা মেসেজ বন্ধুদের গ্রুপের। সেগুলো চেক করে রিপ্লাই দিতে দিতে আটটা বাজল। মাসী আসার সময় বাজার নিয়ে আসে। তোরসা বলল “তুমি আজ কী আনলে, মাছ না মাংস?”

মাসী রান্নাঘরে ব্যাগ নামিয়ে বলল “বাজার তো খোলে নি ভাল করে। আমি সব্জি নিয়ে এলাম শুধু। রাতে মাংস খেয়ো।”

তোরসা বলল “একটু দেরী করে আসতে কী হয় তোমার? নিরামিষ খেতে একদম ভাল লাগে না। তাছাড়া এই ওয়েদারে কোথায় একটু মাংস করবে।”

মাসী ফ্রিজ খুলে বলল “ডিম করে দিচ্ছি। ফ্রিজে ডিম আছে।”

তোরসা ঠোঁট ওলটাল, “আচ্ছা, তাই কর।”

মাসী রান্নাঘরে বসল আলু নিয়ে। বলল “তুমিও কিন্তু রান্না শিখতে পারো দিদি। যা শীত আর বৃষ্টি পড়ছে, কোনদিন আটকে পড়লে তো না খেয়ে থাকবে”!তোরসা বলল “কেন? রান্না পারি তো। ম্যাগি।”

মাসী হেসে দিল “হ্যাঁ,তাও ঠিক ঠাক পারো না।”

তোরসা চোখ বড় বড় করে বলল “একদম মিথ্যা কথা বলবে না, তুমি কবে খেলে?”

মাসী বলল “কেন? সেদিন খাওয়ালে না বিকেলে? ঈশ, তোমার যে কী হবে শ্বশুরবাড়ি গেলে?”

তোরসা বলল “আমার কী হবে? রান্না করতেই হবে এটা কোথাও লেখা আছে নাকি? তাছাড়া আমি তো শর্ত দিয়েই দেব, ছেলেকে ভাল রান্না জানতে হবে।”

মাসী গজগজ করতে লাগল “ওই আশাতেই থাকো। ছেলেদের তো চেনো না। প্রথমে অনেক কিছু বলবে, এই করে দেব, সেই করে দেব, তারপরে দেখবে কচু পারবে। নিজে পারলেও বউকে দিয়েই করাতে হবে। বউ তো না, চাকর যেন। বাঙালি বল, গোর্খা বল, নেপালি বল, ভুটিয়া বল, আর বিহারি বল। সব সমান।”

তোরসা বুঝল এবার মাসীর গল্পের ঝাঁপি খোলার সময় এসে গেছে, সে আগ্রহী মুখ করে বলল “কেন কেন? কোন বাড়িতে আবার এই কেস হল?”

মাসী বলল “ওই যে তোমার বিশ্বাস বাড়ি। ছেলের একটু পায়ে সমস্যা আছে। সেদিন গিয়ে দেখি বউকে কী ঝাড়! কী, না অফিস থেকে ফেরার পর সে বাবু বউকে বলেছে পা টিপে দিতে, বউ বলেছে স্কুল থেকে ফিরে তারও শরীরটা ভাল ঠেকছে না। ব্যস, কেন বলেছে! কেন বউ পা টিপে দেয় নি। চ্যাঁচামেচি বাড়ির মধ্যে। বউটা ওদিকে কত ভাল টিচার। সবাই মান্যি গণ্যি করে।”

তোরসা বলল “বউটারই তো দোষ, অত কথা শোনার কী আছে? থাকুক তোমার সংসার বলে বেরিয়ে গেলেই হল”!মাসী গালে হাত দিল, “একী অলুক্ষুণে কথা গো। অত সোজা নাকি সবকিছু।”

তোরসা বলল “আমি হলে তাই করতাম। সম্মান নিয়ে কোন কম্প্রোমাইজ করব না। যা পারো করে নাও।”

মাসি গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল “ভাল করেছ তুমি বিয়ে কর নি। ঝামেলা হতই।”

তোরসা বলল “ঠিক হয়ে যাওয়া বিয়ে ভেঙেও তো দিলাম এজন্যই মাসী। যেখানে আমার সম্মান নেই, সেখানে আমি নেই।”

মাসী বলল “সে ছেলে তো তোমাকে ভালোবাসে?”

তোরসা বলল “যে ছেলে আমার সম্মান রাখতে পারে না, তাকে তো ভালোবাসা বলা যায় না মাসী।”

মাসীর সব্জি কাটা হয়ে গেছিল। উঠে গ্যাস চালিয়ে রান্না শুরু করতে করতে বলল “কী জানি, আমরা তো চিরটা কাল লাথি ঝাঁটা খেয়েই কাটিয়ে দিলাম। তোমার মত ভাবতে পারলে তো ভালই হত।”

তোরসা বলল “তুমি রান্না কর, আমি একটু ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াই।”

মাসী বলল “তা দাঁড়াও, আচ্ছা শোন, আজ কিন্তু রাতে আমার আসতে একটু দেরী হবে।”

তোরসা বলল “আবার কী হল? ডাক্তার দেখাতে যাবে নাকি?”

মাসী বলল “না, আরে আমার পাশের বাড়ির ওই নেপালী মেয়েটা, গুড়িয়া, ওর পা ভেঙে গেছে।”

তোরসা অবাক হয়ে বলল “তার সাথে তোমার আসা না আসার কী সম্পর্ক?”

মাসী বলল “ও তো ওই এস্টেটের বাংলোতে রান্না করে। এখন গেস্ট এসেছে। আমাকেই রান্নার জন্য ঠিক করে দিয়েছে এ ক’টাদিন!”তোরসা বলল “গেস্ট হাউসে লোক এসছে? বল কী গো? এখানে কে এল?”

মাসী বলল “তার আমি কী জানি। আজ গেলে খবর পাওয়া যাবে।”

তোরসা বলল “আচ্ছা। যাও। আর শোন, বিকেলে যদি নিরামিষ খাইয়েছ তাহলে তোমাকে বাথরুমে আটকে রেখে দেব বলে দিলাম, হ্যাঁ!”

পর্ব ৪

আদৃতার স্কুটি যখন তোরসার বাড়ির সামনে এল তখন তোরসা তালা লাগাচ্ছিল। তোরসা স্কুটিতে ওঠার আগে বলল “ঈশ তোকে কী গোলু গোলু লাগছে।”

আদৃতা বলল “কী করব বল, ভেবেছিলাম একটু ডায়েটিং করব, মা কালকে পেস্ট্রি নিয়ে এসছিল, সামলাতে পারলাম না নিজেকে।”

তোরসা হি হি করে হেসে বলল “আর সামলে কাজ নেই। সাবধানে চালা আজকে, রাস্তায় স্কিড করতে পারে, আর কথা বলিস না।”

আদৃতা শুনল না। বক বক করতে করতে সারা রাস্তা গেল। ব্যাঙ্কে পৌঁছে বায়োমেট্রিক পাঞ্চ সেরে আদৃতা বলল “আজকে মনে হয় তোকে ক্যাশে বসতে হবে।”

তোরসা মুখ ব্যাকাল “কেন আজ বিজনদা আসে নি?”

আদৃতা বলল “কালকেই শুনছিলাম আসবেন না।”

তোরসা বলল “দেখি,দ্য গ্রেট ডিক্টেটর কী বলে!”আদৃতা বলল “এক গাদা অ্যাকাউন্ট ওপেনিং ফর্ম আছে। আমার আজ মাথা খারাপ হবে।”

তোরসা বলল “তাও ভাল, আমার মত সারাদিন হাতের কাজ করে যেতে হবে না, উফ কী কুক্ষণে যে ব্যাঙ্কের চাকরি করলাম।”

আদৃতা বলল “শোন না, আজ পেস্ট্রি এনেছি টিফিনে। খাবি তো?”

তোরসা চোখ বড় বড় করে বলল “খাব না মানে, পেস্ট্রি আমি খাব না, হতে পারে কোনদিন?”

আদৃতা বলল “ওই দেখ, এসে গেছে তোর ডিক্টেটর।”

ব্যাঙ্ক খুলে গেছিল। ধীরে ধীরে লোক আসা শুরু হয়েছে। ভিড় কম নয়। তোরসা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাজে লেগে গেল। এই সময়টা ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখে সে। ফোন এলে ধরে না। বাড়িতে বলা আছে, ব্যাঙ্কিং আওয়ারসে খুব বিরাট কিছু না হলে কেউ ফোন করবে না। একজনকে কম্পিউটারে এন্ট্রি করে টাকাটা দিতে যাবে এই সময় সেই পরিচিত মুখটাকে দেখতে পেল তোরসা। কাউন্টারে এসে দাঁড়িয়েছে। সে প্রথমেই মাথা নিচু করল। তারপর বুঝল ব্যাপারটা বোকা বোকা হয়ে যাচ্ছে। মাথা তুলে তার চোখে চোখ রেখে বলল “বলুন।”

সে বলল “একটু কথা বলা যাবে?”

তোরসা বলল “কী ব্যাপারে বলুন? অ্যাকাউন্ট ওপেন করতে চান? সাত নম্বরে চলে যান।”

সে টোকেনটা তার টেবিলে দিয়ে বলল বলল “না, আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।”

তোরসা একই রকম যান্ত্রিক ভাবে বলল “কাজ না থাকলে ভিড় করবেন না প্লিজ। ব্যাঙ্কিং আওয়ারসে অনেক কাজ থাকে।”

সে কাউন্টারের সামনে থেকে সরে চুপচাপ চেয়ারে গিয়ে বসল। পরের জন চলে এসছিল। তোরসার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছিল। তবু সে নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। আবার কেন সে ফিরে এসেছে?তোরসা আর তার দিকে তাকাল না। একমনে কাউন্টার সামলে যেতে লাগল। একবার মনে হল সিকিউরিটিকে ডাকবে, পরক্ষণে বহু কষ্টে নিজেকে সামলাল। আদৃতার দিকে তাকাল একবার। আদৃতা চোখ বড় বড় করে ইশারায় জানতে চাইল ছেলেটা কে। তোরসা চোখ ফিরিয়ে নিল। লাঞ্চ আওয়ার হয়ে এসছিল। সে কাউন্টার থেকে উঠতে যেতেই সে চলে এল “এবার কথা বলা যাবে?”

তোরসা বলল “অফিসের মধ্যে অফিসিয়াল কাজ ছাড়া কোন কথা বলা যাবে না।”

সে বলল “অফিস আওয়ারসের পরে কথা বলা যাবে? বা এখন তো লাঞ্চ আওয়ারস। একসাথে লাঞ্চ করা যেতে পারে।”

তোরসা বলল “আমার টিফিন আছে। থ্যাঙ্কস।”

 আর তাকে কথা বলার সুযোগ দিল না তোরসা। কাউন্টার ছেড়ে বেরিয়ে রেস্টরুমে চলে গেল। আদৃতা তাকে দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়ল, “উফ, ছেলেটা কী হ্যান্ডু রে, কী বলছে তোকে?”

তোরসা গম্ভীর হয়ে বলল “খেয়ে নি।”

আদৃতা অভিমানী সুরে বলল “বলবি না?”

তোরসা আদৃতার চোখে চোখ রেখে বলল “ইনি আমার এক্স। আমাকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে এসছেন। বুঝেছেন?”

আদৃতা তোরসার হাত ধরে বলল “উফ, এত হ্যান্ডু। এর সঙ্গে কেউ ব্রেক আপ করে?”

তোরসা বলল “যেটা জানিস না, সেটা নিয়ে কিছু না বললেই ভাল বোধ হয়।”

আদৃতা বলল “থাক। বলতে না চাইলে বলতে হবে না। শোন না, আমাকে দিবি?”

তোরসা অবাক হয়ে বলল “কী দেব?”

আদৃতা বলল “তোর এক্সকে?”

তোরসা হেসে ফেলল, পাগলীটা এমনই। বলল “নিয়ে নে। নিয়ে আমাকে বাঁচা।”

আদৃতা বলল “হুহ, আমাকে যেন কত দেখবে। তোর মত সুন্দরীকে ছেড়ে কেউ আসবে আমার কাছে?”

তোরসা আদৃতার থুতনি নেড়ে দিয়ে বলল “আসবে মানে? দৌড়ে দৌড়ে আসবে।”

আদৃতা বলল “বল না বল না, তোর স্টোরি টা। এদ্দিন পুরো চেপে ছিলিস, হ্যাঁ?”

পর্ব ৫

“স্যার দুপুরে তো কিছু খেলেন না, এখন কি কিছু খাবেন?”

ঘুম ভাঙ্গালেন তুষারবাবু। নীল দেখল তুষারবাবু দাঁড়িয়ে আছেন। সে দরজাটা খুলেই ঘুমিয়েছিল। বলল “খেতে ইচ্ছা করছে না কিছু।”

তুষারবাবু বললেন “সে কথা বললে হবে? সাহেব জানলে তো রাগারাগি করবেন।”

নীল বলল “বলার দরকার নেই কিছু।”

তুষারবাবু ইতস্তত করে বললেন “বাজার যাওয়ার আগে তো বললেন ডিম ভাত খাবেন, রান্নাও করানো হল। খাবারটা নষ্ট হয়ে যাবে স্যার।”

নীল বলল “নষ্ট হবে কেন? রাতে খেয়ে নেব।”

তুষারবাবু বললেন “এখন কিছু আর রান্না করাব না? রাঁধুনির সঙ্গে একটু কথা বলে নিন স্যার। কাল কী খাবেন।”

নীল বিরক্ত হল। লোকটা তো ঘ্যান ঘ্যান করেই যাচ্ছে। বলল “আপনি বলে দিন না।”

তুষারবাবু বললেন “আমি কী করে বলি বলুন তো?”

নীল বলল “আমাকে কি তবে আবার উঠে ডাইনিং রুমে যেতে হবে?”

তুষারবাবু বললেন “এখানে ডাকব?”

নীল কয়েক সেকেন্ড ভেবে বলল “ডাকুন।”

তুষারবাবু বেরলেন। নীল উঠে বসল। আগে জানলে এই বাংলোতে উঠত না। এই লোকটা এত কেয়ার নিলে তো সমস্যা!রাধুনি মহিলাকে নিয়ে তুষারবাবু তার ঘরে ঢুকলেন। নীল অবাক হল “কী হল? ইনি?”

তুষারবাবু দাঁত বের করলেন “আর বলবেন না স্যার, ওই মেয়েটা পা ভেঙেছে।”

নীল বলল “সেকি”!তুষারবাবু বললেন “হ্যাঁ, এখান থেকে বেরিয়েই। যাই হোক, এও গেস্ট হাউসেই রান্না করত এক সময়। আপনি ওকে বলে দিলে হবে।”

মাসী বলল “সকালে কী খাবেন?”

নীলের নিজেকে কেমন দেশের রাস্ট্রপতি বলে মনে হচ্ছিল। সে বলল “যেটা খুশি করুন না। কোন অসুবিধা নেই।”

মাসী একটু অবাক হয়ে তুষারবাবুর দিকে তাকাল, বুঝতে পারল না কী করবে। তারপর বলল “পরোটা তরকারি খাবেন?”

নীল বলল “হ্যাঁ। তাই করুন।”

“আর দুপুরে?”

তুষারবাবু নীল বলার আগেই বললেন “দুপুরে মাংসই কর। কী স্যার ঠিক আছে না?”

নীল বলল “আচ্ছা। তাই হোক।”

তুষারবাবু বললেন “এখন কিছুই খাবেন না?”

নীল বলল “এখন ক’টা বাজে?”

তুষারবাবু ঘড়ি দেখলেন “পৌনে সাতটা।”

নীল বলল “আমি এখন একবারে ডিনার খেয়ে নি।”

তুষারবাবু অবাক হয়ে বললেন “এখনই খেয়ে নেবেন?”

নীল বলল “হ্যাঁ, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।”

তুষারবাবু বললেন “তাহলে কি ভাত বাড়তে বলব?”

নীল বলল “হ্যাঁ ভাত বাড়ুন, আমি মুখ ধুয়ে আসছি।”

মাসী অবাক চোখে নীলকে দেখতে দেখতে ঘর থেকে বেরোল। নীল চুপচাপ বসে থাকল কিছুক্ষণ। তুষারবাবু ডাক পাড়লেন “স্যার, খেতে আসুন, খাবার বেড়েছে।”

নীল উঠল। এ লোকটা না খেলে মাথা খারাপ করে রেখে দেবে। মুখ ধুয়ে খেতে বসল। মুসুরির ডাল, আলুভাজা, আর লাল লাল ডিমের ঝোল। নীল সব একসাথে মেখে ফেলল। মাসী অবাক হয়ে বলল “এ আবার কেমন খাওয়া”!

নীল বলল “আমি এভাবেই খাই।”

মাসী আর কিছু বলল না। জাঁকিয়ে শীত পড়ছে। গরম গরম ভাত খারাপ লাগছিল না খেতে। খেতে খেতে নীল বুঝতে পারছিল ভাল খিদে পেয়েছিল আসলে। মাসী বলল “রাতে খিদে পেলে কী করবেন? কিছু করে রাখব?”

নীল বলল “খিদে পাবে না আর, এই তো খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ব আবার।”

তুষারবাবু বললেন “স্যার আপনার কাজ হয়েছে আজকে?”

নীল খেতে খেতে থমকাল “হ্যাঁ, ওই আর কী, কাল আরেকবার যেতে হবে।”

তুষারবাবু বললেন “কাল কিন্তু দুপুরে খাবেন স্যার। এভাবে খাওয়াদাওয়ার অনিয়ম করলে পাহাড়ে যদি শরীর খারাপ বাধান তাহলে মহা সমস্যা হয়ে যাবে।”

নীল বলল “না না, কী আর হবে, আমার অভ্যাস আছে এভাবে খাওয়ার।”

তুষারবাবু বললেন “একটা প্রশ্ন করব?”

নীল বলল “খেয়ে নি। তারপর যত পারেন করুন।”

তুষারবাবু তার বিখ্যাত দাঁত আবার বের করলেন “এহ হে, ঠিক ঠিক। আচ্ছা স্যার। আপনি খেয়ে নিন। তারপরে জিজ্ঞেস করব।”

নীল বিরক্ত মুখে ভাতটা শেষ করে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। দরজা খোলা থাকলেই লোকটা ভাইভা শুরু করে দিচ্ছে। টিভি আছে এ ঘরে একটা। সে টিভি চালাল। বেশ কয়েকবার এ চ্যানেল সে চ্যানেল করে বিরক্ত হয়ে টিভিটা বন্ধ করে দিল। তারপর বিড়বিড় করতে লাগল “কথা না বলা বের করছি তোমার।”

পর্ব ৬

“উফ দিদি, গেস্ট হাউসে একটা পাগল ছেলে এসে উঠেছে।”

দরজা খুলতেই মাসীর প্রথম কথা। তোরসা বলল “তাই? কেন বলত?”

মাসী বলল “আর বল কেন? বাজারে না কোথায় গেছিল, সেখান থেকে ফিরেছে তিনটের সময়। তারপর তেজ দেখিয়ে খায় নি। এখন দেখি পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।”

তোরসার একটা হার্টবিট মিস হল। মুখে আগ্রহ দেখাল না। বলল “তুমি কি আমাকে নিরামিষ খাওয়াবে আজকেও?”

মাসী রান্নাঘরে ঢুকে বলল “উফ, না গো, মাংস করছি রাত্তিরে। তোমায় চিন্তা করতে হবে না। আচ্ছা তারপর যেটা বলছিলাম, ওই কেয়ারটেকারবাবু তো ওনাকে ডেকে তুললেন। উঠে কী বলে জানো?”

তোরসা উত্তর দিল না। মাসী বলে যেতে লাগল “বলে আমি এখন খেয়ে নেব। তারপর খাওয়া শোন।”

তোরসা বিরক্ত মুখে বলল “আহ মাসী। কোন লোক কী খেয়েছে তার বৃত্তান্ত আমাকে কেন শোনাচ্ছ। রান্না কর তো! আমার কাজ আছে।”

মাসী অবাক হল, তোরসা কখনও এভাবে তার সঙ্গে কথা বলে না। বলল “তোমার আবার কী হল?”

তোরসা বলল “অন্য লোকের কথা আমাকে বলছ কেন?”

মাসী গালে হাত দিল “ওমা! অন্য লোকের কথা তুমি যেন শোন না?”

তোরসা কিছু বলল না। মাসী বলল “ডাল ভাত আলুভাজা ডিমের ঝোল সব একসাথে মেখে খাওয়া শুরু করল। কী পাগল রে বাবা!”তোরসা আনমনে বলল “দুপুরে খায় নি?”

তারপরেই বুঝে গেল ভুল করে ফেলেছে, তাড়াতাড়ি ম্যানেজ করতে গেল “মানে তোমার রান্না খেল না? তুমি এত কষ্ট করে রেঁধেছিলে?”

মাসী জিতে যাওয়ার হাসি হাসল “তবে? এই যে বলেছিলে বলবে না?”

তোরসা রেগে গেল “বললে বল, নাহলে বাদ দাও।”

মাসী বলল “না না বললাম যখন শুনেই নাও। দুপুরে কিচ্ছু খায় নি। আমি তো দাঁড়িয়েছি ভাত বাড়ব বলে। সে কী তেজ! কেয়ারটেকারবাবু জিজ্ঞেস করলেন স্যার খাবেন না? কী রেগে গেলেন, বলে আপনাদের কি খাওয়া ছাড়া আর কোন কথা নেই! তারপর ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। আমাকে দেখতেও পেল না যেন। সেই লোকই ঘুম থেকে উঠে চেঞ্জ। আগের মাসির কথা শুনে জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে। পুরো পাগল।”

মাসী হাসতে লাগল। তোরসা মাসীর সামনে টুল নিয়ে বসে গল্প করে রোজ। আজ আর বসে থাকল না। উঠে ঘরে চলে এল। মাসী ডাকল “কী হল আবার?”

তোরসা বলল “কাজ আছে একটু। তুমি রান্না হয়ে গেলে ডেকো।”

মাসী বলল “কী যে হল তোমার।”

তোরসা কান দিল না। ঘরে এসে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। আবার কেন ফিরে এল ও?তাকে খুঁজেই বা পেল কী করে? তার বন্ধুদের মধ্যেই কি কেউ? সবাইকে তো বলাও হয় নি। এমনিতেই যতবার সিম চেঞ্জ করেছে, ততবার কোথাও না কোথাও থেকে নাম্বার জোগাড় করে ফোন করেছে। সে ধরে নি। তবু বার বার ফোন করে গেছে। মেসেজ করে গেছে। কখনও নরম স্বরে, কখনও রাগী স্বরে বলেছে, “ফিরে এস।”

তোরসা ঠোঁট কামড়াল। কালকে নিশ্চয়ই আবার ব্যাঙ্কে যাবে। চুপচাপ বসে থাকবে আজকের মতই। কথা বলতে আসবে। রোজ রোজ ব্যাপারটা ঘটলে কলিগরাই বা কী ভাববে তাকে? বিচ্ছিরি সীন ক্রিয়েট হবে। ছুটি নিয়ে নেবে?পরক্ষণেই মনে হল কতদিন ছুটি নেবে? নতুন চাকরি। বেশিদিন তো ছুটি নিয়ে ঘরে বসে থাকতেও পারবে না। ফোনটা বেজে উঠল। আবার ফোন করেছে। কয়েকবার রিং হয়ে চুপ করে গেল। রোজ এভাবেই চলছে। তোরসা ফোনটা হাতে নিল। নম্বরটায় ডায়াল করেই তাড়াতাড়ি কেটে দিল। আরেকটু হলেই রিং হত। ফোনটা খাটের ওপর ছুঁড়ে ফেলল সে। নাহ। মাসীর সামনেই বসতে হবে। এখানে একা একা থাকলেই আবার ফোন করতে ইচ্ছা করবে। সে উঠে চুপচাপ রান্নাঘরে টুলে গিয়ে বসল। মাংস বসিয়েছে মাসী। বলল “কালকে সকালে পরোটা খাবে?”

তোরসা বলল “ঠিক আছে। কোর।”

মাসী বলল “ওই ছেলেটাও কাল পরোটা খাবে বলেছে। বাবা! প্রথমে তো বলতেই চাইছিল না কী খাবে।”

তোরসা বলল “ওহ, শোন শোন, কাল পরোটা খাব না। কালকে আমি ভাত খাব।”

মাসী বলল “তোমার কী হয়েছে বলত? থেকে থেকে কেমন পাগল পাগল ভাব করছ? কী হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ হয়েছে নাকি?আগের মাসে বললে খুব পেট ব্যথা করছে। এবারেও সেরকম কিছু?”

তোরসা বলল “না না। তুমি এক কাজ কর তো। ওই বসু বাড়ির গল্পটা বল। ওই বাচ্চাটা কী বলছিল যেন?”

মাসী উৎসাহিত হয়ে অন্য গল্প করা শুরু করল। তোরসা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

পর্ব ৭

একবার ঘুম ভাঙার সমস্যা হল দ্বিতীয়বার ঘুম আসাটা অতটা সহজ হয় না। আগের রাতে পথের ক্লান্তিতেই ঘুম চলে এসছিল, আজ দুপুরে এসে ঘুমানোর পরে আর ঘুম আসছিল না। বেশ কয়েকবার তিতিরকে ফোন করেছিল সে। ফোন তোলে নি। তারপর ফোন অফ করে রাত ন’টায় শুয়ে পড়েছিল। শেষ মেষ সাড়ে দশটা নাগাদ উঠে পড়ল। আলো জ্বালল। ব্যাগ থেকে আরেকটা ফোন বের করল। যেদিন ট্রেনে উঠেছে সেদিন থেকে ফোনটা সুইচ অফ করে রেখে দিয়েছিল। ফোনটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকল নীল। একটু ভেবে সেটা সুইচ অন করল। ব্যাটারি কম দেখাচ্ছে। যে কোন সময় অফ হয়ে যাবে। একের পর এক এস এম এস পাঠিয়েছে শ্রমণা। নীল বেশ কিছুক্ষণ সেগুলো দেখল। ফোনটা আবার অফ করতে যাবে এই সময় বেজে উঠল। শ্রমণা। নীল প্রথমে ভাবল ধরবে না। কিন্তু অসাবধানে ফোনটা কাটতে গিয়ে রিসিভ করে ফেলল। অগত্যা কানে দিল ফোনটা, ওপাশ থেকে শ্রমণার গলা “হ্যালো, হ্যালো, নীল।”

“বল।”

 শান্ত গলায় বলল নীল। “তুমি কোথায় এখন?”

“কেন?”

“তোমাকে ফোন করে যাচ্ছি, ফোন অফ, হোয়াটস অ্যাপ করছি মেসেজ সীন হচ্ছে না, আন্টিকেও ফোন করতে সাহস হচ্ছে না যদি টেনশন করেন, তুমি সত্যি বলত কোথায়?”

নীল একটু থমকে বলল “আমি একটু নর্থ বেঙ্গলে এসছি।”

ওপাশে একটু নীরবতা। তারপর বলল “নর্থ বেঙ্গল? কেন? তোরসার খোঁজ পেয়েছ?”

নীল বলল “হ্যাঁ।”

“বাহ, তাহলে তো এখন রি ইউনিয়নের পালা। যাও, আমি আর ডিস্টার্ব করব না। গিয়ে জড়িয়ে ধর তোমার এক্সকে।”

নীল শান্ত গলায় বলল “জড়িয়ে ধরতে তো আসি নি।”

“তবে?”

“আমি ওর মুখটা পুড়িয়ে দিতে এসেছি। যাতে কোন শুয়োরের বাচ্চা ওর ইনোসেন্ট মুখ দেখে ওকে পছন্দ না করতে পারে।”

“হোয়াট! আর ইউ ক্রেজি নীল? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এসব কী বলছ? তুমি কোথায় আছ এখন? একজ্যাক্ট কোন লোকেশনে?”

“বলব না।”

“নীল শোন, তুমি বড় সড় ফেঁসে যাবে। ইউ রেপড দ্যাট বিচ, ও কিচ্ছু বলে নি, কোথাও যায় নি। চুপচাপ পালিয়ে গেছে ট্রান্সফার নিয়ে। এবার আর কিছু পাগলামি কোর না যাতে বড় কোন প্রবলেম হয়।”

“আই শ্যাল টক টু ইউ লেটার।”

“শোন শোন নীল, প্লিজ শোন, ইউ লাভ মি, ইউ লাভ মি না বেবি?”

“অফকোর্স আই লাভ ইউ, আর কাকে ভালবাসব? সেই মেয়েটাকে যে আমায় লাথি মেরে চলে গেল?”

“তবে? বোঝ, প্লিজ শোন, ওকে যা ইচ্ছা করতে দাও, নিজের মত থাকতে দাও। কেন শুধু জড়াচ্ছ বল তো?”

নীল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ফোনটা অফ হয়ে গেল। সে খানিকক্ষণ ফোনটার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ব্যাগে রেখে দিল। মাথাটা গরম হয়ে গেছিল এই শীতেও। সে ওয়াশরুমে গেল। বেসিনে গিয়ে দাঁড়াল। হীমশীতল জল বেরোচ্ছে কল থেকে। গীজার চালাল না সে। ওই বরফ ঠান্ডা জলই মাথায় দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। চোখ লাল হয়ে গেছে। ফোন ধরবে না কেন ও? কেন ধরবে না?ভীষণ রাগ হচ্ছিল তার। টাওয়েল মাথায় দিয়ে বেরিয়ে খাটে এসে বসল সে। অন্য ফোনটা অন করে তিতিরের ফোন আবার ট্রাই করতে লাগল। ফোন একবার রিং হয়েই বিজি বলল। “ব্লক করে দিয়েছ? ব্লক করে দিয়েছ?”

বলে ব্যাগ থেকে ফোনের পিনটা বের করল সে। সিম চেঞ্জ করে আবার ফোন করা শুরু করল তিতিরের নম্বরে। দুবার রিং হয়ে গেল, ফোন ধরল না। তিন বারের বার করতে গিয়ে বুঝতে পারল ফোন অফ করে দিয়েছে। রেগেমেগে ফোনটা দেওয়ালে ছুঁড়ে মারল নীল। তারপর ব্যাগ হাতড়াতে শুরু করল। বেশ খানিকক্ষণ পরে ঘুমের ওষুধের স্ট্রিপটা খুঁজে পেল। দুটো ওষুধ বের করে খেয়ে নিল। আয়নার দিকে তাকাল নীল। নিজেকে চিনতে পারছিল না…

পর্ব আট

দিন -৩

অনেকক্ষণ ছটফট করে রাত দুটোয় ঘুমোতে পেরেছিল তোরসা। ঘুম ভেঙে গেল সকাল ছ’টাতেই। জানলা খুলতেই নির্মেঘ নীল আকাশ উঁকি মারল। গত কয়েকদিন আকাশজুড়ে মেঘ ছিল। এখন একদম পরিষ্কার। তোরসা খানিকক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। স্নান করল, পুজো করল মন দিয়ে। নতজানু হয়ে বেশ খানিকক্ষণ ঈশ্বরের সামনে বসে রইল। রোজই বসে, আজ একটু বেশি সময় ধরে বসল। সমর্পণ শেষে ফোন অন করে বাড়িতে ফোন করল। সব খোঁজ খবর নিয়ে ফোনটা রাখল যখন, তখন সাড়ে সাতটা বাজে। বাড়ির সামনের ছোট জায়গাটায় কয়েকটা নেপালি বাচ্চা ফুটবল খেলছে। তোরসা দেখছিল। ইচ্ছা হচ্ছিল একটু খেলে পরক্ষণে নিজেকে সামলাল। বাচ্চাগুলো খুব বিচ্ছু। একবার ভাব করে নিয়ে তার ঘরে আসলে সব দফা রফা সেরে রেখে দেবে। মাসী গজগজ করতে করতে এল। তোরসা অবাক হল “কী হল? গজগজ করছ কেন?”

মাসী বলল “আর বোল না,কালকে পরোটা ঠিক হয়েছিল, একটু আগে কেয়ারটেকারবাবু খবর দিল এখন আবার ছেলে বলছে সকালে একবারে ভাত খেয়েই বেরোবে। আমার ময়দা কেনা হয়ে গিয়েছিল কাল। ও যাই বলুক, টাকা আমি নিয়ে ছাড়ব ওর থেকে।”

তোরসা বলল “ও।”

মাসী রান্নাঘরে ঢুকল “এইজন্য আমি বাংলোতে রান্না ছেড়ে দিয়েছিলাম জানো, কলকাতা থেকে সব বড়লোক সাহেবরা আসে, তাদের একটারও মাথার ঠিক থাকে না। একবার এক সাহেব এসছিল, সে আবার এর চেয়েও আরও তিন কাঠি উপরে। নিজেই বলবে এই এই রান্না কর, তারপর খেতে বসলেই শুরু করে দেবে আবদার, একটু পাপড় ভাজো তো, বা একটা ডিম ভেজে দাও তো। খুব বাজে এগুলো। ক’টা টাকার জন্য এরা একেবারে কুকুর ছাগল ভাবে আমাদের।”

তোরসা বলল “কর কেন, না করলেই তো পার। কী এমন দেয়?”

মাসী বলল “করতাম নাকি? গুড়িয়ার জন্য করলাম। ওই মেয়েটার বর তো সারাদিন মদ খেয়ে চুর হয়ে থাকে। যে কটা টাকা পাব, ওকেই তার থেকে কিছুটা আলাদা করে দিয়ে দেব। সংসারটা ভেসে যাচ্ছে গো দিদি।”

তোরসা বলল “ওর বর খুব মদ খায়?”

মাসী ঘাড় নাড়ল “খায় মানে? আর কী করে না? মদ খায়, জুয়া খেলে, ঝামেলা করে, সব কিছুতে আছে।”

তোরসা বলল “কাজ বাজ কিছু করে না?”

মাসী বলল “কাজ বাজ? তাহলেই হয়েছে। বউয়ের পয়সায় খায়, আর রাতে মদ খেয়ে এসে সেই বউকেই পিটায়। তবে এখন গুড়িয়াও ছেড়ে কথা বলে না। ওকে তেড়ে আসলে ওও তেড়ে যায়। পড়ে পড়ে আর কতদিন মার খাবে?”

তোরসা বিড় বিড় করে বলল “পড়ে পড়ে মার খেয়েই তো এই অবস্থা হয়।”

মাসী বলল “কী বলছ তুমি?”

তোরসা সামলে নিল “কিছু না। তুমি আজ কী রাঁধছ?”

মাসী বলল “চালানি রুই।”

তোরসা মুখ ব্যাকাল “কেন? ছোট মাছ পাওয়া গেল না?”

মাসী বলল “বেশি ছিল না। ভেবেছিলাম নেব।”

তোরসা বলল “তাহলে নিলে না কেন?”

মাসী বলল “মনে হল তুমি যদি না খাও।”

তোরসা বলল “চালানি রুইয়ের থেকে ছোটমাছই ভাল। পরের দিন পেলে ওই এনো। আর আমার জন্য এক পিস ভাজা রেখো।”

মাসী ঘাড় নাড়ল। #আদৃতা স্কুটিতে উঠতেই বলল “আজকেও নিশ্চয়ই আমাদের হ্যান্ডু হিরো আসবে?”

তোরসা বলল “তোর আর কোন টপিক নেই? আর রাস্তায় ঠিক করে চালা। এটা তোর কলকাতার সমতল না।”

আদৃতা বলল “তা বটে। কিন্তু আজ যদি আসে, তাহলে তুই ছুটি নিয়ে নিস, দুজনে মিলে একটা রোম্যান্টিক দিন কাটাস।”

তোরসা বিরক্ত মুখে বসে থাকল। কোন কথা বলল না। ব্যাঙ্কে পৌঁছে দেখল বিজনদা এসে গেছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ক্যাশে বসলে এমনিতেই খুব চাপ থাকে। তার ওপর সে আসার ফলে ব্যাপারটা গতকাল খুব পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছিল। তোরসা তৈরীই ছিল যে কোন সময় নীল আসবে বলে। অ্যাকাউন্ট ওপেনিংয়ের কাজ করছিল আর কেউ এলেই তার চোখ চলে যাচ্ছিল দরজার দিকে। আদৃতা পর্যন্ত একবার ফিসফিস করে বলে গেল “আজ এলে একটু পরিচয় করিয়ে দিস না। তোকে নিজের হাতে মোমো বানিয়ে খাওয়াব।”

তোরসা পাত্তা দিল না। এখানকার সমস্যা হল বেশিরভাগ লোকজনই সোজা কথা সোজাভাবে বুঝতে পারে না। লোকজনকে বোঝাতে কাল ঘাম ছুটে যায়। পাব্লিক ডিলিং করতে অবস্থা খারাপ হচ্ছিল রোজের মতই। একটা সময় টিফিন টাইম হল। তোরসা উঠল। রেস্টরুমে গেল। আদৃতা টিফিন খুলে বসেছে। তাকে বলল “কী রে, আমি তো ভেবেছিলাম আজকেও আসবে।”

তোরসা বলল “আমাকে প্লিজ বারবার এই নিয়ে খোঁচা দিস না। বিশ্বাস কর, আমি ঠিক নিতে পারছি না।”

আদৃতা বলল “তোকে নিতে কে বলল? তুই আমাকে দিয়ে দে না।”

তোরসা একটু থমকে বলল “ওর স্টেডি গার্লফ্রেন্ড আছে তো। তুই এত চাপ নিচ্ছিস কেন?”

আদৃতা হিহি করে হেসে বলল “কে সেই স্টেডি গার্লফ্রেন্ড? নিশ্চয়ই তুই?”

তোরসা বলল “না। আমি কেন হতে যাব।”

আদৃতা বড় বড় চোখ করে বলল “সেকী! স্টেডি গার্লফ্রেন্ড আছে তবু তোর পিছন পিছন ছুটছে কেন?”

তোরসা বলল “শুধু তাই না, মামণি ওর মায়েরই পছন্দ করে দেওয়া।”

আদৃতা চারদিকে চোখ বুলিয়ে তার কানে কানে বলল “তাহলে তো আলুর দোষ আছে বলতে হবে। গাছেরও খাব, তলারও কুড়োব? তুই ঠিকই করেছিস, একদম পাত্তা দিস নি। আমি হলে তো জুতো পেটা করতাম। চন্দনদাকে বলে রাখব?”

চন্দনদা সিকিউরিটি গার্ড। তোরসা মাথা নাড়ল “নাহ, কিচ্ছু বলতে হবে না। আমি শুধু ওকে আর আমার লাইফে একটুও স্পেস দিতে চাই না, দ্যাটস ইট।”

আদৃতা বলল “আজ এল না কেন বলত?”

তোরসা হাসল “অন্য কোন প্ল্যান করছে হয়ত। মেবি অ্যাসিড ছুঁড়বে। প্রায়ই তো ভয় দেখাত।”

আদৃতা শিউরে উঠে বলল “সেকী! তুই এত নির্লিপ্ত ভাবে কথাটা বলছিস কী করে?”

তোরসা বলল “আমার আর কিছু যায় আসে না রে। যা পারে করুক। আমি আর ওকে নিয়ে একটুও ভাবছি না।”

পর্ব নয়দিন -৩
নীল দশটায় উঠে খাবার টেবিলে এল। তুষারবাবু সেখানেই ছিলেন। তাকে দেখে বললেন “এই তো স্যার, ফ্রেশ হয়ে নিয়েছেন?”

নীল বলল “হ্যাঁ। খেতে দিতে বলুন।”

খাবার টেবিলে ছিল। মাসী প্লেটে ভাত বাড়তে লাগল।

নীল বলল “পরোটা হবার কথা ছিল না?”

তুষারবাবু অবাক হয়ে বললেন “সকালে তো একবার ঘুম ভেঙে এসে আপনি ভাতের কথা বলে গেলেন।”

মাসী অবাক হয়ে নীলের দিকে তাকিয়ে ছিল।

নীল বলল “ওহ, ভাত বলেছি না? আচ্ছা, শুনুন, আমি একটু অপেক্ষা করছি, পরোটাই বানাক মাসী। ভাত খেতে ইচ্ছা করছে না এখন।”

তুষারবাবু ভয়ে ভয়ে একবার মাসীর দিকে তাকালেন। মাসীর মুখ থমথমে। ঝড়ের পূর্বাভাষ পেলেন তুষারবাবু। বললেন “স্যার, রান্না তো হয়ে গেছে। এখন আবার…”নীল উঠল। “অসুবিধা থাকলে ছেড়ে দিন। আমি রাস্তায় খেয়ে নেব।”

বলে বেডরুমে চলে গেল। স্নানে ঢুকল। গীজার চালালো না আর। হীমশীতল জলেই কাঁপতে কাঁপতে স্নান সেরে নিল। বেরিয়ে জামা কাপড় পরছিল, তুষারবাবু এসে দাঁড়ালেন। “স্যার।”

“বলুন।”

“পরোটা হচ্ছে। খেয়ে বেরোবেন।”

“দেরী হবে?”

“কত আর দেরী হবে, আধঘন্টা খুব বেশি।”

“আধঘণ্টা? ছেড়ে দিন। আমি বাইরে খেয়ে নেব।”

“মাসী তো রান্না শুরু করে দিয়েছে।”

“ভাল তো। আপনারা খেয়ে নেবেন।”

“হে হে, কী বলছেন স্যার। এ আবার হয় নাকি?”

“কেন হয় না, আপনি খান না? কী খান আপনি?”

“খাই স্যার, কিন্তু এটা তো আপনার জন্য করা হচ্ছে।”

“আমার জন্য? ওহ। তা ঠিক। আচ্ছা। আমি বসছি। আপনি রান্না হলে জানান।”

“ঠিক আছে স্যার।”

নীল স্যুটকেস থেকে তিতিরের দেওয়া সোয়েটারটা বের করল। মেরুন রঙের সোয়েটার। কলেজে পড়ার সময় টিউশন পড়িয়ে টাকা জমিয়ে এই সোয়েটারটা তাকে কিনে দিয়েছিল। তিতির বলেছিল “এই সোয়েটারটা যখন পরবে, মনে করবে আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে আছি।”

সোয়েটারটা পরে বেশ খানিকক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রইল নীল। চোখ বন্ধ করে তিতিরের মুখটা মনে করার চেষ্টা করল। মিনিট পাঁচেক সে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। বাইরে গাড়ির হর্ন শোনা গেল। এই গাড়িটা তুষারবাবু ঠিক করে দিয়েছেন কাছাকাছি ঘোরার জন্য। নীল হন হন করে বাংলো থেকে বেরিয়ে গেল। সে ভুলেই গেছিল তার জন্য পরোটা হচ্ছে। তুষারবাবু বাংলোর পিছনের দিকে ছিলেন বলে তাকে দেখতে পেলেন না। গাড়িতে উঠে

নীল বলল “এখান থেকে শিলিগুড়ি কতক্ষণ?”

ড্রাইভার বলল “বাজার যাবেন না?”

নীল বিরক্ত হল “আহ, যেটা জিজ্ঞেস করছি জবাব দিন।”

“দু ঘন্টা লাগবে।”

“চলুন।”

“কিন্তু আপনি তো বললেন লোকাল ঘুরবেন।”

“আপনার যেতে অসুবিধা আছে?”

“না অসুবিধা কেন হবে?”

“চলুন তাহলে।”

নীল বলল “খেয়েছেন সকালে?”

“হ্যাঁ স্যার।”

“কী খেয়েছেন?”

“ভাত খেয়ে এসছি স্যার।”

“রাস্তায় কোথাও একটা দাঁড়াবেন তো। আমার খাওয়া হয় নি।”

“আচ্ছা স্যার।”

নীল বসে বসে শিষ দিতে লাগল। কিছুক্ষণ পর বলল “এখানে একটা নদী আছে না? কী যেন নাম?”

“নেওড়া স্যার।”

“নেওড়া?”

“হ্যাঁ স্যার।”

“জঙ্গল আছে?”

“হ্যাঁ স্যার। মাঝখানে চিতাবাঘ বেরিয়েছিল।”

“তাই? ওখানে নিয়ে যাবেন?”

“কিন্তু স্যার এখন তো আপনি শিলিগুড়ি যাচ্ছেন”!“হ্যাঁ ঠিক। এখন তো শিলিগুড়ি যাচ্ছি। কাল নিয়ে যাবেন?”

“ঠিক আছে স্যার।”

“চিতাবাঘ দেখা যাবে?”

“সেটা কী করে বলব স্যার।”

“হ্যাঁ। ঠিক ঠিক। সেটা কী করে বলবেন আপনি। কী হল দাঁড়ালেন কেন?”

“খাবেন বললেন যে”!“ওহ খাব বলেছি না! আচ্ছা ছেড়ে দিন, আপনি চলুন। শিলিগুড়িতে গিয়েই খাব।”

“আচ্ছা।”

“আচ্ছা, দাঁড়ান, দাঁড়ান। আমি খেয়ে নি।”

গাড়ি দাঁড়াল। নীল নামল। একটা ছোট হোটেল। ভিড় আছে যথেষ্ট। বসে বলল “কী আছে ব্রেকফাস্টের জন্য?”

“আলুপরোটা আছে স্যার।”

“আচ্ছা, দিন।”

বসে মোবাইল ঘাটা শুরু করল নীল।

পর্ব ১০

“এ পৃথিবীটা হেরে যাওয়া মানুষদের জন্য না।”

কথাটা বার বার ডায়েরীর পিছনের পাতাগুলোয় বড় বড় করে লিখে রাখত তোরসা। ডায়েরীটায় অনেকদিন কিছু লেখা হয় নি। টেবিলের ওপরেই ছিল। আজ পিছনের পাতাটা খুলে দেখল। ডিপ্রেশনের সময়টা ডায়েরীটাই ভরসা ছিল তার। এখানে প্রথম প্রথম শীত লাগলে সব সোয়েটার পরে কম্বলের তলায় গুটিশুটি মেরে থাকত। ধীরে ধীরে শীত সহনীয় হয়ে গেছে। ডিপ্রেশনও অনেকটা শীতের মতই। অভ্যাস হয়ে গেলে অতটা কষ্ট হয় না। সামান্য মোবাইলের গেমও হয়ে উঠতে পারে ডিপ্রেশন কাটাবার অমোঘ উপায়। কিংবা শপিং। বাজার থেকে একই রঙের চারটে সোয়েটার কিনেছে সে। আদৃতাকে অফিসের পর বলে দিয়েছিল বাড়ি চলে যেতে, আদৃতা দু চারবার জিজ্ঞেস করেছে, “তুই শিওর?”

 তোরসা বলেছে, “হ্যাঁ শিওর। যা এবার।”

আদৃতা চোখ নাচিয়ে বলেছে “গোপন ডেটিং আছে নাকি?”

তোরসা হাসিমুখে বলেছে “আছে তো। তুই গেলেই আমি ওই হ্যান্ডুর সাথে ঘুরতে বেরোব।”

আদৃতা প্রথমে সত্যি ভেবেছিল। তারপর বুঝেছে তোরসা ইয়ার্কি মারছে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলে গেছে। তোরসা সোয়েটার কিনল। অনেক খুঁজে পছন্দের রঙের চুড়ি কিনল। একগাদা সব্জি বাজার করল। মাংস কিনল। তারপর সব কিছু নিয়ে একা একা চড়াই ভেঙে কোয়ার্টারে ফিরল। মাসীকে ফোন করে ছুটি দিয়ে দিল। নিজে অনেকক্ষণ বসে বসে রান্না করল। টেবিলে সাজিয়ে রাখল খাবারগুলো। সবশেষে ডায়েরীটা নিয়ে বসল। অনেকক্ষণ লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকল। ডায়েরীতে লেখার সময় কোন জায়গাটা চোখের জল লেগে আছে এখনও মুখস্ত বলে দিতে পারে তোরসা। সাড়ে আটটা বাজল। তোরসা উঠল। ডায়েরীটা যত্ন করে খাটের উপর রাখল। আলমারি থেকে সব থেকে পছন্দের শাড়িটা বের করল। আধঘন্টা ধরে যত্ন করে সাজল। চোখে কাজল দিল। ঠোঁটে লিপস্টিক। নখে নেলপালিশ। তৈরী হয়ে গেলে দরজায় তালা দিয়ে রাস্তায় নামল। জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। রাস্তা সুনসান। খানিকটা হাঁটার পর তোরসা অনুভব করল এক মাতাল পিছু নিয়েছে তার। সে ঘুরে দাঁড়াল। মাতালটা কী বুঝল কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে অন্য দিকে দৌড় মারল। সে দৃঢ় পায়ে হেঁটে বাংলোর সামনে এসে দাঁড়াল। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নিল। তারপর বাংলোর গেট ঠেলে ভিতরে ঢুকল। আলো জ্বলছিল সামনের ঘরে। তোরসা কলিং বেল টিপল। তুষারবাবু দরজা খুলে হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন “আপনি?”

তোরসা বলল “নীল আছে?”

তুষারবাবু বললেন “স্যার তো ঘুমাচ্ছেন সন্ধ্যে থেকে।”

তোরসা বলল “আমি অপেক্ষা করছি, ডেকে দিন।”

তুষারবাবু দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। তোরসা ড্রয়িংরুমে এসে বসল। তুষারবাবু তার সামনে এসে দাঁড়ালেন “আপনি ব্যাঙ্কে আছেন না ম্যাডাম?”

তোরসা বলল “হ্যাঁ। আপনি ডাকুন ওনাকে।”

তুষারবাবু ইতস্তত করে বললেন “স্যার যদি রাগ করেন?”

তোরসা বলল “রাগ করবেন না। ডাকুন। আর শুনুন, উনি এলে আপনি একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াবেন। কনফিডেন্সিয়াল কিছু কথা বলার আছে তো। বলা যাবে না।”

তুষারবাবু কয়েক সেকেন্ড তোরসার দিকে তাকিয়ে “আচ্ছা ম্যাডাম” ঘরের ভিতরে চলে গেলেন। তোরসা অপেক্ষা করছিল। মিনিট পাঁচেক পরে নীল এসে দাঁড়াল। তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল “তুমি?”

তোরসা বলল “হ্যাঁ। বল কী বলার আছে তোমার?”

নীল সোফায় বসল। সোফার ওপরে পা তুলে বাবু হয়ে বসল কয়েক সেকেন্ড পরে। তারপর বলল “তিনটে ঘুমের ওষুধ খেয়েছি তিতির।”

তোরসা কিছু বলল না।

নীল বলল “এই যে ঘুমের ওষুধ খেয়েছি, দেড় ঘন্টা হয়েছে। তুমি নিশ্চয়ই আমার হ্যালুসিলেশন। তুমি নিশ্চয়ই তুমি না তাই না?”

তোরসা বলল “হ্যাঁ আমিই। ভাল করে দেখো। দেখতে পাচ্ছ না?”

নীল চোখ বড় বড় করে তোরসাকে দেখার চেষ্টা করল। দু হাত দিয়ে নিজের চোখ মুছল। তারপর ফিক ফিক করে হাসতে হাসতে বলল “আমি আসলে এখন স্বপ্ন দেখছি। সেই লাল শাড়িটা, যেটা গড়িয়াহাট থেকে কিনেছিলে, পরে আছ। এই শীতে সোয়েটার পর নি, কিচ্ছু পর নি। না না। তিনটে ঘুমের ওষুধ খেলে কেউ জেগে থাকে নাকি? ধুস?”

তোরসা বলল “কেন ডাকছিলে ব্যাঙ্কে এসে সেটা বল, আমি জানতে এসেছি।”

নীল বলল “তিতির সোনা, তোমায় চিতাবাঘের সামনে ছেড়ে দেব। এইটুকু ছোট্ট শরীর, খাবলে খাবলে খাবে চিতাবাঘ।”

তোরসা বলল “চিতাবাঘ? প্ল্যান চেঞ্জ করলে?”

নীল বলল “আমার খুব ঘুম পেয়েছে। এই সব হ্যালু হ্যালু খেলা আমার আর ভালো লাগছে না। স্বপ্নের মধ্যে কী সব দেখে যাচ্ছি। তিতির, আমার তিতিরপাখি, তুমি এখন বাসায় ফিরে যাও।”

তোরসা বলল “আমি আর কোথাও ফিরে যেতে আসি নি নীল। তুমি বল তোমার কী বলার আছে?”


পর্ব ১১

নীল বলল “তোমার ছেলে বন্ধুদের খবর কী? যাদের সঙ্গে তুমি আমায় লুকিয়ে গল্প করতে? আমায় লুকিয়ে ঘনিষ্ঠ হতে?”

তোরসা বলল “এখনও সন্দেহ করে বেড়াচ্ছ? তা বেশ তো, দেখতে পারছ না? তারা আমার চারপাশে বসে রয়েছে, আমার সঙ্গেই তারা থাকে”!নীল জোরে জোরে মাথা নাড়াল “ঠিক, তিতিরপাখি, ঠিক। তুমি ঠিক বলেছ। আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে না। আমি জানি, আমি ঠিক জানি তারা তোমার চারপাশেই বসে রয়েছে। আমি এখনও স্বপ্নে দেখি আমি যখন থাকি না তারা তোমার কাছে আসে, তোমায় আদর করে। আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায়, ইচ্ছা করে তোমাকে ওদের সঙ্গে মেরে, পুঁতে দি।”

তোরসা বলল “তারা তোমায় কিছু বলে না?”

নীল তোরসার দিকে তাকিয়ে “বলে তো, তারা বলে তোর তিতিরকে একদম বিশ্বাস করবি না, একদম না। মেয়েটা কাউকে ভালোবাসে না আসলে। আমাদের বাসে নি, তোকেও কোনদিন ভালবাসে নি। আমার ঘুম হয় না তিতির, আমি রাতের পর রাত জেগে বসে থাকি। পাঁচটা বছর কেটে গেল। রাতের পর রাত শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে থাকি। তুমি আমাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছ। ফোন নাম্বার পেতে কত কষ্ট করতে হয়েছে আমায়। এবার পেয়েছি আমি। তোমার মুখ, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেব। ওই মুখ আর কোন ছেলেকে দেখতে হবে না আর। কারও হতে দেব না তোমাকে আমি। কেন আমায় ছেড়ে চলে গেলে তুমি!”নীল অস্থির হয়ে উঠছিল। তোরসা বিচলিত হল না, শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল “শ্রমণা কেমন আছে নীল? খুব ভালোবাসে তোমায়? তোমরা বিয়ে করছ কবে?”

নীল দুহাতের তালু ঘষতে ঘষতে বলল “খুব বড় স্বপ্ন দেখছি তো আজকে। এরকম স্বপ্ন রোজ রোজ দেখি না।”

তোরসা একই স্বরে একই প্রশ্ন রিপিট করল “শ্রমণা কেমন আছে নীল? বিয়ে করছ কবে?”

নীল তোরসার দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর হো হো করে হাসতে শুরু করল। তোরসা বলল “কী হল, হাসছ কেন? প্রশ্নটা কি খুব কঠিন প্রশ্ন করেছি?”

নীল বলল “আমি কাউকে ভালবাসি না। কাউকে না। আমায় কেন ছেড়ে দিয়ে গেলে তুমি?”

তোরসা বলল “আমায় তুমি দিন রাত সন্দেহ করেছ নীল। আমার মোবাইল ঘাটছ, আমার অজান্তেই আমাকে ফলো করছ। মেরেছ। বারবার প্রশ্ন করে গেছ। তারপর… বলব তোমায়? তারপর কী করেছ?”

নীল দুহাতে নিজের চুল আঁকড়ে ধরে বসে রইল। তারপর বলল “তুমি চলে যাও। আমি আর তোমায় স্বপ্নে দেখতে চাই না তিতির। চলে যাও তুমি।”

তোরসা বলল “আমি তোমার স্বপ্নে নেই নীল। আমি বাস্তবেই আছি। তোমার সামনে বসে।”

নীল অবিশ্বাসীর মত তোরসার দিকে তাকিয়ে থাকল। পকেট থেকে মোবাইল বের করল। তোরসার ফটোর সঙ্গে সামনে বসা তোরসাকে মিলিয়ে দেখল। তারপর উঠে তোরসার কাছে এসে দাঁড়াল। তোরসাকে ছুঁল। তোরসার পায়ের কাছে মেঝেতে বসে পড়ল। ক্লান্ত স্বরে বলল “তোমার ফোন বিজি থাকে এখনও। কারা ফোন করে তোমায় তিতির? তোমার বয়ফ্রেন্ড?”

তোরসা বলল “তোমার গার্লফ্রেন্ডও করে কখনো সখনও। ফোন করে হুমকি দেয়। তোমার জীবন থেকে যেন সরে যাই।”

নীল বলল “তিনটে ঘুমের ওষুধে আজ অবধি কারও কিছু হয় নি। আমি রোজ একটা একটা করে বাড়াব। কাল চারটে খাব। পরশু পাঁচটা। তারপরের দিন ছ’টা। তারপরের দিন সাতটা। ঘুম আসবে না এভাবে তিতির পাখি?”

তোরসা সোফা থেকে নেম নীলের পাশে মেঝেতে বসল। তারপর বলল “কী ভুলতে চাও তুমি?”

নীল বলল “তোমার অবিশ্বাসী চোখটা। তোমার শরীরটা। যেটাকে বারবার আঘাত করেছি। জোর করে দখল করেছি। যেদিনের পরে তুমি সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে গেলে আমার জীবন থেকে। রোজ ভোলার চেষ্টা করি।”

তোরসা কয়েক সেকেন্ড নীলের দিকে তাকিয়ে বলল “লিস্টে আরেকটা জিনিস অ্যাড করে নাও নীল।”

নীল বলল “কী?”

তোরসা বলল “তোমার একটা চার বছরের মেয়েও আছে।”

নীল হাঁ করে তোরসার দিকে তাকাল। বলল “কোথায়?”

তোরসা উঠল। বলল “অ্যাসিড বাল্ব নিয়ে মুখে মেরো আমার। পুড়িয়ে দিয়ে যেও। আর কোন ছেলে কোনদিন আমায় দেখতে না পারে। এখন মারবে? অপেক্ষা করব?”

নীল দুহাতে মুখ ঢেকে বসে রইল। তোরসা ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে গেল। বাইরে প্রবল শীতের মধ্যে তুষারবাবু চুপচাপ একা একা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তোরসা বলল “আমার সঙ্গে একটু চলুন তো, পৌঁছে দেবেন।”

পর্ব ১২

দিন ৪

“আজ আমি বাংলোতে যাই নি।”

মাসী এসে শুরু করল। তোরসা কিছু বলল না। চুপচাপ বসে ছিল। মাসী বলে চলল “কাল জানো আমার কী অবস্থা করেছে? সকালে রান্না করে বসে আছি বলল পরোটা খাব। পরোটা করছি এই সময় কেয়ারটেকারবাবু এসে বললেন স্যার গাড়ি করে পালিয়েছে। আমি পরিষ্কার বলে দিলাম, দেখো বাপু, তোমার টাকা তোমার কাছে রাখো, আমি আর যাব না। কেয়ারটেকারবাবু বাড়ি অবধি চলে এসছিল। আমি শুনিনি। রাত্তিরে কী করেছে কে জানে, হোটেল থেকে এনেছে বোধ হয়।”

তোরসা বলল “আজ মাছ মাংস কিছু খাব না মাসি। নিরামিষ কোর।”

মাসী অবাক হয়ে গালে হাত দিয়ে বলল “একী কান্ড! এ দেখি বিড়াল বলে মাছ খাব না! কী হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ?”

তোরসা একটু থেমে বলল “হ্যাঁ, শরীর খারাপ।”

মাসী বলল “সোয়াবিন করে দেব?”

তোরসা বলল “হ্যাঁ, তাই কর, আর শোন, দুধটাকে ঘন করে জাল দিয়ে রাখো। আমি পায়েস বানাবো।”

মাসী বলল “শরীর খারাপ, পায়েস খাবে? তুমি কেন বানাবে, আমিই বানিয়ে দিচ্ছি।”

তোরসা বলল “না না, আমি বানাবো। যা বললাম কর তো।”

মাসী গজগজ করতে লাগল “শরীরের আর দোষ কী! সারাক্ষণ শুধু উল্টোপালটা খেয়ে যাবে। পেট খারাপ তো হবেই।”

তোরসা বলল “তুমি রান্না করে যাবার সময় ডেকো, আমি একটু শুই। তুমি গেলে পায়েস করব।”

মাসী বলল “যাও। অফিস যাবে তো আজ?”

তোরসা বলল “দেখি, নাও যেতে পারি।”

কলিং বেল বেজে উঠল। তোরসা বলল “মাসী দেখো তো, পেপারের বিল বোধ হয়।”

মাসী বেরোল। দরজা খুলে আবার রান্নাঘরে এসে বলল “এই।”

তোরসা বলল “কী হল?”

মাসী উত্তেজিত গলায় বলল “ওই পাগলা ছেলেটা! এখানে কী করতে এসছে?”

তোরসা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠল, বলল “তুমি রান্না কর। আমি দেখছি।”

মাসী বলল “তুমি চেনো নাকি?”

তোরসা বলল “তুমি রান্না কর।”

দরজা খোলা ছিল। নীল দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে, বোঝা যাচ্ছে সারারাত ঘুমোয়নি। তোরসা বলল “তুষারবাবু কি বাইরে দাঁড়িয়ে?”

নীল বলল “না চলে গেছেন”। তোরসা বলল “এসো।”

নীল ঘরে ঢুকল। তোরসা বলল “মাসী আছে, কোন সীন ক্রিয়েট কোর না।”

নীল বলল “আমি কোন সীন ক্রিয়েট করতে আসি নি।”

তোরসা বলল “বস।”

ড্রয়িং রুমের সোফায় বসল নীল। চোখে মুখে অস্থির ভাব। তোরসা বলল “তুমি খেয়েছ কিছু সকালে?”

নীল মাথা নাড়ল। “খাবে?”

“আমাদের মেয়ে কোথায় তিতির?”

তোরসা বলল “খাবে না?”

নীল বলল “আমি কিছু খেতে পারব না যতক্ষণ আমার মেয়েকে দেখব।”

তোরসা বলল “দেখবে? দেখে কী করবে?”

নীল বলল “আমরা সংসার করব। তুমি বুঝতে পারছ না তিতির? আমার মেয়ে! আমাদের মেয়ে! আমাদের স্বপ্নগুলো, যেগুলো আমরা একসাথে দেখতাম, সব ভুলে গেছ তুমি?”

তোরসা ঠান্ডা গলায় বলল “গলা নামাও নীল। মাসী আছে। এখানে আমায় থাকতে হবে, ভুলে যেও না।”

নীল এগিয়ে এসে তোরসার হাত ধরল “প্লিজ তিতির, আমার মেয়েকে দেখাও। প্লিজ।”

তোরসা উঠল। বলল “এসো।”

বেডরুমে গেল। আলমারী খুলল। লকার থেকে একটা কাগজ বের করল, “এ নাও।”

নীল বলল “এটা কী?”

তোরসা বলল “ওর ডেথ সার্টিফিকেট। জন্মের পরেই। ডাক্তার বলেও ছিলেন বাঁচানো যাবে, গেল না। ভাল দিনেই এসেছ। আজ ওর জন্মদিন “।

নীল অবিশ্বাসী চোখে সার্টিফিকেটটার দিকে তাকিয়ে থাকল। সেটা নিয়েই মেঝেতে বসে পড়ল। মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর কান্নায় ভেঙে পড়ল। তোরসা পাথরের মত বসে রইল। মাসী শব্দ শুনে বেডরুমে চলে এসছিল। তোরসা বলল “মাসী তুমি রান্না হয়ে গেলে চলে যেও।”

মাসী অবাক হয়ে নীলকে কাঁদতে দেখছিল। চোখে অনেক প্রশ্ন। তোরসা বলল “দুধ জাল দিয়ে যেতে ভুলো না মাসী। আজ আমাদের মেয়ের জন্মদিন।”

মাসী স্তম্ভিত মুখে নীলের দিকে আরেকবার তোরসার দিকে তাকাল। দাঁড়াল না আর। রান্নাঘরে চলে গেল। অনেকক্ষণ পরে

নীল বলল “আমি তোমাকে কী বলি নি তিতির! পাগলের মত খুঁজে বেরিয়েছি তোমায়। তোমাকে শেষ করে দেব বলে। তোমার মুখ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেব ভেবে এসছি কতবার! আর তুমি…”তোরসা উঠল, “পায়েস খেয়ে যেও, জন্মদিনের পায়েস।”



শেষ পর্ব“স্যার খাবেন না?”

তুষারবাবু ঘুম ভাঙালেন। ঘর অন্ধকার। নীল হাত বাড়িয়ে আলো জ্বালল। ঘুম জড়ানো গলায় বলল “ক’টা বাজে?”

“সন্ধ্যে সাতটা বাজে। আপনি তো সারাদিন কিছু খান নি।”

“আমি? খেয়েছি।”

“কী খেয়েছেন স্যার?”

“পায়েস খেয়েছি।”

“ম্যাডামের ওখানে?”

“হ্যাঁ। আজ আর কিছু খাব না তুষারবাবু। কাল আমি চলে যাব।”

“স্যার, আপনি সাতদিন থাকবেন কথা ছিল তো।”

 অবাক গলায় প্রশ্ন করলন তুষারবাবু। নীল ক্লান্ত স্বরে বলল “আমার কাজ হয়ে গেছে তুষারবাবু। আর থাকার দরকার নেই। আপনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন, বসুন না।”

তুষারবাবু চেয়ার টেনে বসলেন।

নীল বলল “আপনি খেয়েছেন? মাসী তো আসেনি আজ।”

তুষারবাবু বললেন “আমি তো চাল ডাল আলু ফুটিয়ে খেয়ে নি রোজ। গেস্ট না আসলে মাসী রাখার প্রয়োজন নেই তো।”

“আগের মাসীর খোঁজ নিয়েছেন? কেমন আছে?”

“ভাল আছে। ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করবেন না স্যার।”

“এখন কি বৃষ্টি পড়ছে? শব্দ আসছে মনে হচ্ছে।”

“হ্যাঁ স্যার। আবার সেই শুরু হয়েছে।”

“এই বাংলোটা বেশ ভাল। বৃষ্টির শব্দ শোনা যায়। আমার মনে হচ্ছে কতদিন আমি এই শব্দটা শুনি নি। কেমন একভাবে হয়ে যাচ্ছে।”

তুষারবাবু উত্তর দিলেন না। “আপনি এখানে একা একা কী করেন তুষারবাবু?”

“কী করব স্যার? কিছুই তো করার নেই। একা একা পাহারা দি। বাংলো বিক্রি হয়ে গেলে সেটাও হবে না আর। এখানে যে চা বাগানগুলো ছিল, সেগুলোও তো অনেকগুলো বন্ধ হয়ে গেল। বাকিগুলো ধুঁকছে। ভূতের মত মড়া আগলে আছে কিছু লোকজন।”

“আমাদের জীবনটাই তো তাই তুষারবাবু। নিজেদের মড়া আগলেই কাটিয়ে দেওয়া।”

তুষারবাবু একটু ইতস্তত করে বললেন “স্যার একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

“করুন।”

“ম্যাডাম কি আপনার কেউ হন?”

নীল তুষারবাবুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল “কী করবেন জেনে?”

তুষারবাবু বললেন “এমনি জিজ্ঞেস করলাম, এখানে তো কেউ আসেন না, এতদিন পরে আপনি এলেন, কাল চলে যাবেন ভাবতে কেন জানি না খুব খারাপ লাগছে স্যার।”

নীল কিছু বলল না। চুপচাপ বসে রইল। তুষারবাবু বললেন “ড্রাইভার রতন ছেলেটা বলছিল ভ্যালিতে যাবেন বলেছেন। যাবেন না?”

নীল বলল “নাহ। আর গিয়ে কী করব। ফিরে যাই।”

তুষারবাবু বললেন “সুন্দর জায়গা স্যার। অনেকে আসেন ঘুরতে। মাঝে লেপার্ড বেরিয়েছিল বলে কাগজে লেখালেখিও হয়েছিল।”

নীল বলল “আপনি দেখেছেন কোনদিন লেপার্ড?”

তুষারবাবু বললেন “না স্যার, এখানে সেসব দেখি নি কোনদিন। তাছাড়া আমি তো বেরোইও না খুব বেশি।”

নীল বলল “ইচ্ছা করে নি দেখতে লোকের মুখে শুনে?”

তুষারবাবু ম্লান হাসলেন “ছোটবেলায় যখন খেলার বয়স ছিল তখন বাবার সঙ্গে ধুপকাঠি বেচতে বেরোতাম স্যার। তখন থেকেই কৌতূহলটা কমে গেছে। আপনার ওপর কেন জানি না একটা মায়া পড়ে গেল এ ক’দিনে। তাই ম্যাডামের কথাটা জিজ্ঞেস করলাম। নইলে তাও জিজ্ঞেস করতাম না।”

নীল বলল “ ভাল করেছেন জিজ্ঞেস করেছেন। বেশ করেছেন। আপনার সঙ্গে আমার কোন মিল নেই তুষারবাবু। আপনি শৈশবে ধুপকাঠি বেচতে বেরিয়েছেন, আর আমার এই তিরিশ বছর বয়সে আজ সকাল অবধি শৈশব ছিল। এক ধাক্কায় আমি বড় হয়ে গেলাম আজকে। অনেকটা। শুধু ধাক্কাটার জন্য অনেকটা মূল্য দিতে হল।”

তুষারবাবু বললেন “আবার আসবেন স্যার। খুব ভাল লাগল আপনার সঙ্গে কথা বলে। কেউ তো এভাবে বসিয়ে কথা বলে না। সবাই কুকুর বেড়ালের মত ব্যবহার করে। তাতেও অপেক্ষা করে থাকি। যদি কেউ আসে। বকা ঝকা করলেও কথা তো বলবে”!নীল মাথা নাড়ল, “আমি আর কোনদিন আসব না তুষারবাবু। আমার আর কোনোদিন আসা হবে না।”

তুষারবাবু আর কথা বললেন না। চুপ করে বসে রইলেন। কিছুক্ষণ পরে

নীল বলল “আপনি এবার নিজের রান্না বসান তুষারবাবু। আমিও দেখি ঘুমানোর চেষ্টা করি।”

তুষারবাবু বললেন “আপনি কিছুই খাবেন না তাহলে?”

নীল বলল “এক কাজ করুন, এক মুঠো ভাত বেশি নিন। আপনার সঙ্গে বসে খাই। আলুসেদ্ধ ভাতই খাই।”

তুষারবাবু চমকে উঠে বললেন “আমার সঙ্গে খাবেন?”

নীল বলল “কেন? কী অসুবিধা? আচ্ছা এক কাজ করুন, চালে ডালে বসিয়ে দিন। খিচুড়ি খাই। পারবেন না?”

তুষারবাবু বললেন “পারব স্যার। কিন্তু খাবেন তো? আমি রান্না করলাম আর আপনি ঘুমিয়ে পড়লেন।”

নীল বলল “হবে না। বললাম না আপনাকে, আমার শৈশব কেটে গেছে। চিন্তা করবেন না। আপনি বসিয়ে দিন।”

#দিন-৫“ আমি রাখব গেঁথে তারে রক্তমণির হারে,বক্ষে দুলিবে গোপনে নিভৃত বেদনাতে”॥বৃষ্টি রাতেই থেমেছে। তবে মেঘ পুরোপুরি কাটে নি। নীলের গাড়ি এসে গেছিল। তুষারবাবুর হাজার কাকুতি মিনতি সত্ত্বেও নীল নিজেই স্যুটকেস আর কিট ব্যাগটা গাড়িতে তুলল। নীল মানিব্যাগ থেকে এক হাজারটাকা বের করল, “এই টাকাটা আপনি রাখুন তুষারবাবু।”

তুষারবাবু বললেন “না না স্যার, আমি মাইনে পাই তো। আপনি আমাকে টাকা দেবেন কেন?”

নীল বলল “রাখুন তুষারবাবু। আপনি না নিলে আমি কষ্ট পাব।”

তুষারবাবু টাকাটা নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। নীল গাড়িতে উঠল। ড্রাইভারকে বলল “চলুন।”

ড্রাইভার বলল “কোথায় স্যার? লেপার্ড দেখতে?”

নীল বলল “নাহ বাগডোগরা চলুন।”

গাড়ি স্টার্ট দিল। নীল তুষারবাবুকে হাত নেড়ে বিদায় জানাল। গাড়িটা খানিকটা যাবার পর

নীল বলল “আপনাকে অনেক জ্বালাতন করেছি আমি। একটা শেষ বারের মত রিকোয়েস্ট করব?”

ড্রাইভার হাসল “বলুন স্যার।”

“আপনি একটু বাজারে ব্যাঙ্কের সামনে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়াতে পারবেন?”

“আচ্ছা স্যার।”

#তোরসা ক্যাশ কাউন্টারে বসেছিল। আজকেও বিজনদা আসে নি। বেশ ব্যস্ততার সঙ্গে কাউন্টার সামলাচ্ছিল। নীল ব্যাঙ্কের ভিতর ঢুকল। তোরসার ব্যস্ততা দু চোখ ভরে দেখল। তারপর উঠল। ধীর পায়ে ব্যাঙ্ক থেকে বেরোল। আর ফিরে তাকাল না। মনে মনে বলল “ভালো থেকো তিতির পাখি, আর কোনদিন তোমাকে জ্বালাতে আসব না।”

গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিল এই সময় শুনতে পেল “পালাচ্ছ শেষমেষ?”

নীল দাঁড়িয়ে পড়ল। তোরসা কাউন্টার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে।

নীল বলল “হ্যাঁ। ভেবেছিলাম আর জ্বালাব না তোমাকে। কিন্তু শেষবারের মত দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না তিতির।”

তোরসা বলল “তুমি কোনোদিনও বড় হবে না বল?”

নীল হাসল “জানি না। হয়ত হব কোনদিন। তুমি দেখতে পাবে না। আমি এলাম। ভাল থেকো তিতির।”

“তুমিও ভাল থেকো। আর শোন।”

“বল।”

“কোনদিন এসো না আমার সামনে।”

“কথা দিলাম তিতির, এলাম।”

নীল গাড়িতে উঠল। ড্রাইভারকে বলল “বাগডোগরা না, আপনি বরং আমাকে ওই লেপার্ড দেখাতেই নিয়ে চলুন।”

ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিল। তোরসা দাঁড়িয়ে রইল। একা একা…

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *