কেশবন্ধ যুগে যুগে
”হে মুনিসত্তম মৈত্রেয়, কলিকালে স্ত্রীগণ কেবল কেশ দ্বারাই আপনাকে সুন্দরী মনে করিবে—স্ত্রীনাং রূপমদশ্চৈব কেশৈরেব ভবিষ্যতি। আর সেই সময়ে স্ত্রীগণ সুবর্ণ, মণি, রত্ন ও বস্ত্রাদিতে বঞ্চিত হইয়াও কেবল কেশের পারিপাট্য দ্বারা আপনাকে ভূষিত করিবে—কলৌ স্ত্রিয়ো ভবিষ্যন্তি তদা কেশৈরলংকৃতাঃ।”—পৌরাণিকের ভূমা দৃষ্টিতে আমাদের কালের সার্থক চিত্রটি যেমন ধরা পড়েছে, তেমনি সফল জ্যোতিষীর ভাগ্য নির্ধারণের মতো পুরাণকারের ভবিষ্যৎ কেশচিত্রে দুটি নির্দিষ্ট সময়ের ইঙ্গিতও আছে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে, যখন আজকের এই ঘোর কলি আরম্ভ হয়নি তখনকার স্ত্রীলোকেরা লম্বায়-চওড়ায় চুলের অস্তিত্বমাত্রেই আনন্দিত হতেন, অর্থাৎ কিনা মহামুনি যাকে রূপের অহংকার (রূপমদ) বলেছেন, তার প্রধান উপকরণ ছিল কেশ। স্বভাবতই আমাদের বৃদ্ধপিতা-মাতামহীগণ পঁচিশ থেকে পঞ্চাশ ভরির ভারে ঈষৎ আনত হয়ে চিকন চাঁচর কেশ দুলিয়ে শ্বশুরবাড়ি আলো করে রাখতেন। কিন্তু এ তো গেল প্রথম শ্লোকের কথা। ভেবে আশ্চর্য হই, ভারতবর্ষ ফলিত জ্যোতিষে কত উন্নত ছিল যে, সে যুগের পুরাণকর্তা ধরতে পেরেছিলেন—কলিযুগের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়েছে এই কিছুদিন হল। কি করে তিনি বুঝতে পারলেন যে এই সময়ে চুরি, রাহাজানি, ছেনতাই এত বেড়ে যাবে কিংবা সোনার দাম হবে এমনই যে, ‘সুবর্ণ, মণি, রত্নাদি’র আশা আকাঙ্ক্ষা থেকেও বঞ্চিত হবে কলির যুবতীরা। আর উত্তরাধিকারের কথা? ”একদিকে কন্যা বসিয়া আছেন, মায়ের অলংকারের বাস্ক হইতে কিয়দংশ সংগ্রহ করিবেন—কিন্তু ঝুনোর শস্য এমনি কঠিন যে মেয়ের দাঁত বসিল না—ঝুনো দয়া করিয়া একটি মাকড়ি বাহির করিয়া দিল।” কাজেই সমস্ত উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত, ঘোরকলির ললনাগণ—যেমন আছ তেমনি এসো আর কোরো না সাজ। বেণী না হয় এলিয়ে রবে/সিঁথে না হয় বাঁকা হবে/নাই বা হল পত্রলেখায় সকল কারুবাজ।
সত্যি গলিতহৃদয় প্রেমিকের কাছে চিরায়মানা রমণীর চুলবাঁধার কারুকার্য সহ্য হয় না—সে আজও হয় না তখনও হত না; বিশ্বাস না হয় ভাগবত পুরাণে শ্যামচাঁদের ঘনঘন তাড়নাপূর্ণ বাঁশি শুনে ব্রজগোপীদের আলুথালু অবস্থার প্রতি দৃষ্টি দিন। গলিতহৃদয় প্রেমিকের মতোই পদকর্তা গোবিন্দদাস লক্ষ করেছেন তাঁদের ‘গলিত বেণী লোলনী’ অর্থাৎ সেই কথা—’বেণী না হয় এলিয়ে রবে।’
কিন্তু মনে রাখা দরকার—প্রেমিকের হৃদয় সবসময় গলিত থাকে না, বিশেষত উৎসবে আনন্দে আর পাঁচজন মহিলা যখন তাঁদের কেশপুচ্ছ উচ্চে তুলে ঘোরাফেরা করেন এবং যদি সৌভাগ্যবশত প্রেমিক এবং স্বামী একই মানুষ হন তবুও তাঁর হৃদয় আপন হৃদয়েশ্বরী অগৌরবে এবং অন্যদের অবহেলায় দৃঢ় হয়ে উঠতে পারে আমাদের এই অনুমান আজকে সত্যি কিনা জানি না, তবে মহামুনির আপন কালে এবং শিবঠাকুরের আপন দেশেই কেশসজ্জা নিয়ে যুদ্ধ পর্যন্ত হয়ে গেছে। চিরকালের ঝগড়াটে নারদমুনি স্বর্গের পারিজাত ফুল নিয়ে কৃষ্ণকে সময় বুঝে উপহার দিলেন। ‘সময় বুঝে’ বলছি এই জন্যে যে, পাশেই ছিলেন রুক্মিণী, কৃষ্ণের ইঙ্গিতে তিনি সেই কুসুমস্তবকটি গুঁজে দিলেন খোঁপায়। এদিকে কৃষ্ণের ভালোবাসার রানী সত্যভামার দাসীরা এই খবরটি তুলে দিল সত্যভামার কানে। ফল হল এই—সত্যভামা গোসাঘরে প্রবেশ করলেন। কৃষ্ণ শেষপর্যন্ত অনেক কাকুতিমিনতি, অনেক পাখার হাওয়া, অনেক চাটুকারিতা করে জানতে পারলেন যে, ক্রোধের কারণ হল রুক্মিণীর মাথার পারিজাতগুচ্ছ। স্পষ্ট করে তিনি কৃষ্ণকে জানালেন যে, ওই ফুল চাইই, কেননা ওই ফুল খোঁপায় গুঁজে সতীনদের মনে জ্বালা না ধরানো পর্যন্ত তাঁর শান্তি নেই—বিভ্রতী পারিজাতস্য কেশপক্ষেণ মঞ্জরীম। সপত্নীনামহং মধ্যে শোভেয়মিতি কাময়ে। এই কামনার ফল কৃষ্ণের সঙ্গে ইন্দ্রের ঘোর যুদ্ধ, ইন্দ্রপত্নী শচীর সঙ্গে সত্যভামার কথা কাটাকাটি এবং শেষপর্যন্ত সেই ফুল গোঁজা হল সত্যভামার মাথায়। এই ঘটনায় যদিও প্রেমিকপ্রবর কৃষ্ণের বেশি হাত নেই কিন্তু সমস্ত ঘটনাটি যে অপরের প্রতি ঈর্ষাবশত, তার প্রমাণ সবিস্তারে লেখা আছে হরিবংশ আর বিষ্ণুপুরাণে। এবার সোজাসুজি কেশবন্ধের কথায় আসি।
প্রথমেই বলে রাখা ভালো—চুল না থাকাটা কোনো কালেই আনন্দের নয়, এমনকী টাকমাথা ভাবী অমঙ্গলের চিহ্ন বহন করত, কেননা রাবণ সবংশে ধ্বংস হওয়ার আগে ত্রিজটা রাক্ষসী রাবণের টাকমাথা দেখেছিল স্বপ্নে, কাজেই টাকমাথায় চুল গজানোর জন্য ঋগবেদের ঋষিরা পর্যন্ত মন্ত্র পড়েছেন এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস ঋষিদের মাথায় যে ব্যালোল জটাজাল দেখতে পাই—তা শত ঋক মন্ত্রের ফল। মন্ত্রশক্তি যদি কাজ না করে তার জন্য অবশ্য বিকল্প ব্যবস্থা ছিল—অথর্ববেদের কিছু প্রক্রিয়া। তবে সে প্রক্রিয়া আর কিছুই নয়, আজকের দিনের মতো মাথার মরুভূমিতে মরূদ্যান সৃষ্টি করা কোনো তৈলাক্ত ওষুধ আর কি। যেখানে পুরুষদের চুলের জন্য এত উৎকণ্ঠা সেখানে মেয়েরা যে বিশাল কেশকলাপের জন্য লালায়িত হবে সে আর বেশি কথা কি? পুরুষদের চুলের কথা অনিবার্যভাবে এসে পড়ছে এই কারণে যে পুরুষরাও সে যুগে চুল বাঁধত। মহারাজ দশরথ যখন মারা যান, তখন কুমার ভরত মামাবাড়িতে শুয়ে শুয়ে ভীষণ অশুভ স্বপ্নে জেগে উঠেছিলেন। সেই স্বপ্নে দশরথের মুখখানি ছিল মলিন আর চুলগুলি খোলা—মলিনং মুক্তমূর্দ্ধজম। ভরত এমনটি আগে কোনোদিন দেখেননি, তাই অনুমান করি বৃদ্ধ দশরথ তাঁর পাকাচুল বেঁধে রাখতেন। এমনকী দুধারে বিনুনী করে চুল-বাঁধা—এও পুরুষদের অভ্যাস ছিল; একে বলা হত কাকপক্ষ। তবে কাকপক্ষ চুলের ফ্যাসানটি বোধ হয় কিশোরদের মধ্যেই চালু ছিল বেশি, না হলে রণক্ষেত্রে সপ্তরথীর মাঝখানে মৃত পড়ে আছেন অভিমন্যু কিন্তু ব্যাসদেব লক্ষ করেছেন যে তাঁর চাঁদমুখখানির ওপরে কাকপক্ষ চুল উলটে এসে তার রণক্লান্ত চক্ষুদুটিকে ঢেকে দিয়েছে—কাকপক্ষাবৃতাক্ষিকম। অন্যদিকে আবার রামায়ণে দেখি, কিশোরাকৃতি লক্ষ্মণ বিশ্বামিত্রের আদেশে রামচন্দ্রের পেছন পেছন চলেছেন তাড়কাবধের জন্য, কিন্তু সেই প্রথম অযোধ্যাপুরীর বাইরে যাবার আনন্দেই বোধহয় চুলটি কাকপক্ষ করে ঝুলিয়ে দিতে ভোলেননি লক্ষ্মণ—কাকপক্ষধরো ধন্বী। আমরা দুধারে ঝোলানো কাকপক্ষ চুলের কথা বলছি এই কারণে যে সেকালের কিশোরদের চুলের ঢং আজকের দিনের কিশোরী স্কুলে-পড়া মেয়েদের মধ্যে এখনও টিকে আছে।
চুল বেঁধে লম্বা বিনুনী করার রীতি তৈরি হতে বেশি দিন সময় লাগেনি। বৈদিকযুগের সাধাসিধে রমণীরা, যাঁদের কাছে ঘন চুলের অস্তিত্বটাই বড় কথা ছিল, তাঁরাও যে তাঁদের আলুলায়িত কেশপাশ চারভাগে ভাগ করে ফেলেছিলেন তার প্রমাণ যজ্ঞদেবীর চারটি কোণের সঙ্গে রমণী-কেশের চারটি কপর্দের তুলনায়। এই চুলই পেছন দিকে টেনে এনে বিনুনী তৈরি করে দিয়েছেন মহাভাষ্যকার পতঞ্জলি। অবশ্য যেহেতু সুদূর ১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভাষা তৈরির জন্য ব্যাকরণের কচকচি নিয়ে তিনি ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন তাই কবরী কিংবা মাথার ওপরে চূড়া করে শিঙের মতো বাঁধা কেশচূড় ছাড়া তাঁর কাছে বেশি কিছু আশা করা যায় না। কিন্তু রাজা মিনান্দার, যিনি প্রথম শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্মীয় প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে মিলিন্দপংহের জন্ম দিয়েছেন, তাঁর শান্ত আলোচনার মধ্যেও চুল বাঁধার রীতিনীতি কিছু ঢুকে পড়েছে, যার প্রমাণ মিলবে ‘ধোবন’, ‘বন্ধন’, ‘কোপ্পক’—এইসব শব্দগুলির মধ্যে। এর মধ্যে ‘কোপ্পক’-এর সঙ্গে আধুনিক খোঁপা কথাটির কোনো মিল আছে কিনা জানি না, তবে বৈদিক কেশপাশে ‘কুম্বা’র সঙ্গে যে মিল আছে একথা সবাই বুঝতে পারবে। এ বিষয়ে এই যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ বোধ হয় ভরতের নাট্যশাস্ত্র। ভরত যেহেতু নাট্যামোদী মানুষ, তাই কোনো নাটকে যদি গৌড়দেশের নারীর ভূমিকা থাকে, সেখানে তিনি অবন্তীর কেশসজ্জা সহ্য করবেন বলে মনে হয় না। কাজেই অবন্তীযুবতীর রূপসজ্জায় যদি কোঁকড়ানো চুলের গ্রন্থি থাকে—শিরঃ সালক কুন্তলম, গৌড়ীর মাথায় থাকবে খোঁপা কিংবা পাশে ঝোলানো বেণী। রাখালিয়া আভীরিণী কিন্তু আবার দুটি বেণী করে সমস্ত মাথাটিকে ভরিয়ে দেবে এমনি ভাবে যাতে একটা ঝুটিবাঁধা কাকাতুয়ার মতো দেখাতে পারে। কেশবিন্যাসের বৈচিত্র্য কিন্তু চিরকালই উত্তর ভারতের থেকে দক্ষিণভারতে বেশি। ভরত সেই যুগে লক্ষ করেছেন যে দক্ষিণী যুবতী চুল বেঁধেছে ছোট্ট একটি জলঘটের আকারে—কুম্ভীপদকসংযুক্তম এবং সেই কেশঘট ঠিক রেখেছে অলংকারের সাহায্যে। এ ছাড়া ছিল ললাট আবর্তন করে বাঁধা চুল—আবর্তললাটিকম। দক্ষিণীদের মধ্যে খুব রেওয়াজ ছিল সমস্ত কেশজাল পাঁচভাগে ভাগ করে খোঁপা এবং বিনুনী তৈরি করার। এই ঘরানার পরিচয় মিলবে পরবর্তী তামিল সাহিত্যেও।
সাহিত্য এবং ভাস্কর্য যদি সমাজের প্রতিচ্ছবি হয়, তাহলে বিশ্বাস করতেই হবে চুল বাঁধার হাজারো বৈচিত্র্য ছিল প্রাচীন ভারতে, যার তুলনা এখনকার বিউটি পার্লারগুলোতেও পাওয়া যাবে না। কেউ হয়তো একটি বড় খোঁপা করে চার পাশ থেকে অসংখ্য সরু সরু বিনুনী এনে জুড়ে দিয়েছেন মূল খোঁপাটির সঙ্গে। কেউ বা আবার বিরাট দুটি বিনুনী বেঁধে তার শেষের দিকটা জুড়ে দিয়েছেন নিতম্বের উপরিভাগে। কেশবিন্যাসের প্রকারভেদ, কারুকার্য আছে আরও অনেক, এমনকী আজকের দিনের হীনকেশী মহিলারা খোঁপা বড় দেখানোর জন্য যেমন ‘বল’ জাতীয় জিনিস আমদানি করেন চুলের মধ্যে, তেমনি প্রাচীনরাও অনেক কিছুর সাহায্য নিতেন। আর একটা জিনিস, যেটিকে অনেকটা খেলার রিং-এর মতো দেখতে, সেটি মাথার ওপরে লাগিয়ে তার ভিতর দিয়ে কিংবা ওপর দিয়ে চুল গলিয়ে সুদৃশ্য করে ফেলা হত সম্পূর্ণ মাথাটিকে। এই বস্তুটি এত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল যে পেরিপ্লাস অব দ্য ইরিথ্রিয়ান সী-এর লেখক তাঁর নিজের দেশের যুবতীদের দুর্ভাগ্য নিয়ে মাথা চাপড়েছেন, অবশ্য শেষে বলেছেন এই বস্তুটি তাঁর দেশে আমদানি করা হত ভারতবর্ষ থেকে। বিনুনী না করে এই পত্র-পুষ্প মণিখচিত রিং কিংবা চ্যাপলেট দিয়ে চুল বাঁধার উপযোগিতা ছিল এই যে, এতে যেমন কেশবিন্যাসের সৌকর্য চোখে পড়বে, তেমনি চোখে পড়বে মরাল গ্রীবাটি।
আজকের দিনে যেমন চুল কার্ল করায় কিংবা কানের পাশে খুচরো চুলের মধ্যে পেনসিল গুঁজে একটি কৃত্রিম কুঞ্চনের সৃষ্টি করা হয়, তেমনি কাশ্মীরের কবি ক্ষেমেন্দ্র উল্লেখ করেছেন কৃত্রিম-কুঞ্চিত কেশের কথা। এখন বুঝি কবিগুরুর মানসপটে যে রমণী সখীদের সাধছিল—দে লো তুলে দে লো, চঞ্চল কুন্তল কপোলে পড়িছে বারেবার—সে কুন্তল তার স্বেচ্ছাকৃত অবহেলায় আপন অবসরে তৈরি করা মায়ার খেলা। সুবিন্যস্ত কেশকলাপের পাশে এই কৃত্রিম-কুঞ্চিত কেশ বৈপরীত্যে নিশ্চয়ই একরকম শোভা বর্ধন করে এবং একে প্রাচীন কেশশিল্পের পরিভাষায় আমরা বলতে পারি চূর্ণকুন্তল। এর আবার কারুকার্য অনেক—সুবিন্যস্ত কেশপাশের মধ্যে যখন একগুচ্ছ চুল কপালে এসে পড়ত তাকে কবিরা বলেছেন ‘ভ্রমরক’, আবার সেটি যদি মাথার বা কানের পাশ থেকে এসে রবীন্দ্র মানসীর কপোলে পড়ে, তবে তার নাম শিখণ্ডক। এ ছাড়াও বিভিন্ন কেশবন্ধের আরও অষ্টোত্তর শত নাম করেছেন কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা। দক্ষিণাবর্ত, কোকিলকেশপাশ, কৈশিক—এরকম আরও কত শত, এমনকি বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণে ‘সিংহকেশর’ নামে যে কেশবন্ধের নমুনা পাই, তাতে ভাবার উপায় নেই যে আমরাই ‘ববছাঁটে’র সৃষ্টিকর্তা, কেননা সিংহকেশর কেশবন্ধে চুলটি থাকবে মাত্র ঘাড় পর্যন্ত আর আমাদের মতে এই সিংহকেশরে একটু রমণীয় কুঞ্চন মেশালেই বা ক্ষতি কি?
এতরকম হেয়ার স্টাইলের জন্যে কাঠখড় কম পোড়াতে হত না। চুলের মধ্যে ফাঁপা-ফাঁপা মায়াবী আবেশ তৈরি করার জন্য শ্যাম্পু ছিল না বটে, কিন্তু নানা রসায়নে তৈরি আমলকীর নির্যাস ছিল। তার পর বকুল, চম্পক কিংবা অতিমুক্তকের গন্ধ দেওয়া তেলে কেশগুচ্ছ সুবাসিত করে তাতে লাগানো হত কালাগুরু ধূপের ধোঁয়া। এতে চুল শুকানো এবং হেয়ারস্প্রের কাজ একসঙ্গে হত। কালিদাস যখন উমাকে বধূবেশে সাজিয়ে দিয়েছেন, তখন ধূপের উষ্ণতায় পার্বতীর কেশগুচ্ছের আর্দ্রতা শুকিয়ে দিতে ভোলেননি—ধূপোষ্ণনা ত্যাজিতমার্দ্রভাবম। রাজধানীর কবি কালিদাস উজ্জয়িনীর হর্ম্যমালার গবাক্ষপথে বেরিয়ে আসা কেশধূপের ধোঁয়ায় কেশসংস্কারধূপৈঃ অলকা পথিক মেঘের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছেন একেবারে। এর পরে চুল বাঁধা তারপর অলংকরণ। সত্যিকারের সোনার গয়না দিয়ে সুচারু কেশবন্ধ একেবারে ঝলমলে করে তুলতেন সেকালের বরনারীরা। সোনার সুতোয় মণিমুক্তখচিত করে বেঁধে নিতেন ‘ধম্মিল্ল’ কেশপাশ। আর ছিল ফুলের গয়না খোঁপার চারপাশে কেয়ারী করে দেওয়া। কালিদাসের পার্বতীকে দেখেছি প্রথম প্রেমের অবনতিতে তাঁর আলোকশোভী কর্ণিকার পুষ্প ঝরে পড়েছে মহাদেবের পায়, আর বিয়ের সময় তাঁর খোঁপাটি ঘিরে আছে হলুদ মধূক ফুলের মালা, যার মাঝে মাঝে আছে দুর্বাদলের সবুজ মেশানো গ্রন্থি—দুর্বাবতা পাণ্ডুমধূকদাম্না।
বিচিত্র কেশবন্ধ, তার অলংকরণ—এ সব কিছু একা আপনহাতে করা সম্ভব নয়। আজকের দিনে এখানে সেখানে গজানো বড় বড় বিউটি পার্লার সে যুগে ছিল না ঠিকই, তবে সৈরিন্ধ্রী ছিল, যারা দরকারমতো মুদ্রার বিনিময়ে অন্যের বাড়িতে সুচারু কেশবন্ধ তৈরি করে দিত। তবে নিঃসন্দেহে এ কাজ ভদ্রঘরের মেয়েরা করত না, কেননা পঞ্চস্বামী-গর্বিতা দ্রৌপদী যখন বিরাট মহিষী সুদেষ্ণার চুল বাঁধার অছিলায় অজ্ঞাতবাস নিতে চাইলেন, তখন এই কাজের মর্যাদাহীনতাই তাকে সে সুযোগ দিয়েছে। তিনি যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন—”লোকে শিল্পকর্ম সম্পাদনের জন্য দাসী নিযুক্ত করে কিন্তু সৎকুলে জাত রমণীরা কখনও সে কাজ করে না, তাই আমি কেশসংস্কার করার কাজ নেব। বিরাট যদি আমাকে পূর্ব অভিজ্ঞতার কথা জিজ্ঞাসা করেন তা হলে বলব, আমি দ্রৌপদীর চুল বেঁধে দিতাম।” এ থেকে বোঝা যায়, তখনকার সুমহিলাদের বাঁধাধরা সৈরিন্ধ্রী থাকত এবং যে সৈরিন্ধ্রী পাণ্ডবঘরণী দ্রৌপদীর চুল বাঁধত, বাজারে তার দাম আলাদা, যেমনটি এখন কোন বিউটি পার্লারের ওজন কত তা বোঝা যায় কত বড় সিনেমা অ্যাকট্রেস সেখানে চুল বেঁধেছে—সেই থেকে। এ ছাড়া সে যুগের পুরুষ মানুষরাও যেহেতু চুল বাঁধতেন তাই কখনও প্রণয়বশে দয়িতার খোঁপাটিও বেঁধে দিতেন তাঁরা। অমন যে রাবণদমন রামচন্দ্র তাঁকেও দেখেছি সীতার মাথায় ফুল গুঁজে তাঁর বনবাসী চুলের শোভা বাড়াতে। আর গীতগোবিন্দের যে নায়কটির অভ্যাস ছিল ‘সকচগ্রহচুম্বনদানম’ তিনি শতকোটি গোপীর সঙ্গে নাচতে নাচতে একটি বিশেষ রমণীকে নিয়ে অন্তর্ধান করেছিলেন। ভাগবতপুরাণে এই সৌভাগ্যবতীর নাম নেই বটে, তবে চৈতন্যপন্থীরা বলেন গন্ধ আছে। ইনি নাকি শ্রীরাধিকা। কৃষ্ণ যাকে একান্তে তুলে নিয়ে গিয়ে সদ্য ফোটা ফুলে কেশপ্রসাধন করেছেন আর তার চিহ্ন দেখে অন্য গোপীরা অভিমানে বলেছেন কেশপ্রসাধনং হ্যত্র কামিন্যাঃ কামিনা কৃতম। এই প্রসঙ্গে আর একটি ঘটনা উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে। মহাভারতের পাণ্ডবপুঙ্গব ভীম, যাঁকে বঙ্কিমচন্দ্রের কল্যাণে এবং আজকের নাথবতী অনাথবৎ-এর সৌজন্যে দ্রৌপদীর সবচেয়ে সুযোগ্য স্বামী বলে জানি, তাঁর রমণীকেশের পারিপাট্য ভালোই জানা ছিল। ঘটোৎকচ জননীর লম্বা লম্বা চুল তিনি বেঁধে দিতেন কি না সে প্রমাণ ব্যাসদেব রাখেননি কিন্তু মাঝে মাঝে চুল বেঁধে দিয়ে তিনি যে অর্জুন-মোহগ্রস্তা দ্রৌপদীর মন পেতে চেষ্টা করতেন, তার প্রমাণ বিলক্ষণ আছে। না হলে কৌরবসভায় দুঃশাসনের সাহস তথা দ্রৌপদীর অপমান দেখে তিনি যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তাতে দুঃশাসনের বুক চিরে রক্ত খাওয়ার ভীষণতার মধ্যেও, সেই রক্তে দ্রৌপদীর বেণীসংহার (চুল বাঁধা) করার ইচ্ছেটি তাঁর অভ্যস্তবিদ্যার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
আমরা শুনেছি, যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে। একথায় রান্নার প্রতি তাচ্ছিল্য আছে যেমন, তেমনি তাচ্ছিল্য আছে চুল বাঁধার ওপরেও। বাস্তবে কিন্তু সে রকম করে চুল বাঁধতে গেলে পঞ্চব্যঞ্জনে রান্নার সময় নাও থাকতে পারে। ঠিক যেমন জুতসই রান্না করতে গেলেও সময় থাকবে না ভালো করে চুল বাঁধার। কিন্তু বিশ্বজনহিতায় সমস্ত দিন সরন্ধনে কাটালেও ধন্যি ধন্যি, কিন্তু সমস্ত দিন চুল বাঁধলে? অথচ প্রাচীনা যাঁরা, যাঁরা চিরকাল, রাঁধা খাওয়া আর শোয়ার বৃত্তে বাঁধা বলেই জানি, তাঁদের চুল বাঁধার পরিপাটি যে কত নিপুণ ছিল এবং তার পিছনে তাঁরা অসময়েও কত সময় দিতেন—তা বোঝানোর জন্য প্রাচীন বৃন্দাবনের একটি কাকভোর সকালে ফিরে যেতে হবে। কৃষ্ণজননী যশোদাকে আমরা মাতৃমূর্তির আদর্শ বলেই জানি। সেই যশোদা সকালবেলায় কৃষ্ণ ঘুম থেকে ওঠার আগেই দুধ চাপিয়ে দিয়েছেন উনুনে, অন্যদিকে চলছে দধিমন্থন। দধিমন্থন যে কাকভোর সকালেই হত তার প্রমাণ যথেষ্ট আছে ভাগবত পুরাণে, তাছাড়া ”ওরে বিহান হল জাগো রে ভাই ডাকে পরস্পরে, ওরে ওই যে দধিমন্থধ্বনি উঠল ঘরে ঘরে” এ তো প্রমাণ। সে যাই হোক, সেই কাকভোর সকালেও মাতৃমূর্তি যশোদা কিন্তু চুল বেঁধে নিয়েছেন সুদৃশ্য কবরীবন্ধনে এবং সেই সাতসকালেও তাতে ফুল গুঁজে দিতে ভোলেননি; কেননা দধিমন্থনের পরিশ্রমে তাঁর খোঁপার মালতীকুসুম খসে খসে পড়ছিল—কবরবিগলন্মালতী নির্মমন্থ। একই সময়ে কৃষ্ণ ঘুম থেকে উঠে দৌরাত্ম্য আরম্ভ করলে পর যশোদা তাকে ধরবার জন্য দিলেন দৌড়। কিন্তু দৌড়তে গিয়ে তাঁর সাধের খোঁপাটি গেল খুলে এবং আবারও দেখি ফুল খসে পড়ছে মাটিতে—জবেন বিস্রংসিত কেশবন্ধন/চ্যুত প্রসূনানুগতি পরামৃশৎ। এর পরে কৃষ্ণকে ধরে ফেলার পর আরম্ভ হল দামবন্ধন অর্থাৎ কোমরে দড়ির বাঁধন। তখন দেখি তিনি ঘামে ভিজে গেছেন, তাঁর কানের পাশে চূর্ণকুন্তলগুলি গালের ওপরে লেপটে রয়েছে, কিন্তু রসিক ভাগবতকার তৃতীয়বার উল্লেখ করতে ভুললেন না যে, তাঁর খোঁপায় লাগানো মালাটি, যা এতক্ষণ হয়তো কোনোরকমে ঝুলে ছিল, তাও খসে পড়ে গেছে মাটিতে, বিস্রস্তকবরস্রজঃ। অনুমান করি, সেই কাকভোর সকালে উঠে কত ফুল যশোদা গুঁজে দিয়েছিলেন খোঁপায় যে ভাগবতকার তিন তিনবার উল্লেখ করে তাকে সম্পূর্ণ খসাতে পেরেছেন। কৃষ্ণের মতো খ্যাপাটে ছেলে সামাল দিয়ে তার দধি, দুগ্ধসেবার সুব্যবস্থা করেও যদি এই কেশসজ্জার ধৈর্য থাকে, তবে তার অবস্থা হবে ঠিক এমনিতর—এইটেই ভাগবতকারের ব্যঞ্জনা নয় তো?