কেন ফিরে আসছে না কল্পনা চাকমা? – আবেদ খান
পার্বত্য চট্টগ্রামে আমার অন্ততঃপক্ষে বার ছয়েক যাবার সুযোগ হয়েছে। সর্বপ্রথম যাই সম্ভবতঃ তেহাত্তর সালের দিকে। তৎকালীন সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র লারমার সৌজন্যে। পাহাড়ি মানুষদের বঞ্চনার কথা বলতেন প্রায়ই সংসদ অধিবেশনে। ব্যক্তিগত পরিচয় গড়ে উঠেছিল সে সময়ই। আর সেই সুবাদেই পার্বত্য চট্টগ্রাম দেখা। তখনও শান্তিবাহিনী গড়ে ওঠেনি।
এরশাদ আমলে একবার ব্যক্তিগতভাবে গিয়েছিলাম খানিকটা। কিন্তু তখন শান্তিবাহিনীর প্রবল প্রতাপ। যাঁর গাড়িতে গিয়েছিলাম সে সময় তিনি বলেছিলেন চিম্বুক পাহাড় দেখাবেন। তিনি থাকলে শান্তিবাহিনীর লোকজন কিছু বলবে না, তবে পুলিশ- মিলিটারির সঙ্গে যাওয়া অনেক বেশি রিস্কি। অবশ্য তিনি তাঁর দাবির যথার্থতা প্রমাণের সুযোগ পাননি। গাড়ির চালক সাফ বলে দিয়েছিল সে কখনই যাবে না ওদিকে। অতএব আমাদেরকে ভেতরে খানিকটা ঘুরে আবার সূর্যাস্তের আগেই চলে যেতে হয়েছিল চট্টগ্রামে।
বিএনপি সরকারের আমলে একবার গিয়েছিলাম রাঙ্গামাটি, লংগদু প্রভৃতি জায়গায়। তখন রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় সেনাবাহিনীর চৌকি। আমার ভাইরা (বর্তমানে ওয়ার্কস-এর চীফ ইঞ্জিনিয়ার) জনাব মুকিতুর রহমান তখন ছিলেন চট্টগ্রামে। তাঁর সুবাদেই রাঙ্গামাটি, লংগদু যাওয়া। সে সময় রাঙ্গামাটির দেয়ালে সচিত্র চিকা দেখেছি, দেখেছি হিল উইমেন্স ফেডারেশনের দাবিনামা লাল কালিতে ফুটে আছে দেয়ালে দেয়ালে। লংগদুতে দেখেছি পাহাড়ি মানুষরা অবাক চোখে আমাদেরকে দেখছে। তাদের এক চোখে জিজ্ঞাসা, অন্য চোখে অবিশ্বাস।
চতুর্থবার যাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তখন একবার সেনাবাহিনী থেকেই উদ্যোগ নেয়া হল, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশ্নে তাঁদের সম্পর্কে জনমনে যে ধারণার সৃষ্টি হয়েছে সেটা অপনোদনের জন্য সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে যাবেন তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে। সম্ভবতঃ দিন তিনেকের ভ্রমণ। হেলিকপ্টারে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় গোটাটাই ঘুরে বেড়ালাম আমরা। কোন কোন জায়গায় স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গেও আমাদের কথা বলার ব্যবস্থা করা হল। কিন্তু তখন তাদের কথাবার্তায় কোন হৃদয়ের ছোঁয়া পাইনি। না পাওয়ার কারণটিও অনুমান করতে বিলম্ব হয়নি। আমরা সেনাবাহিনীর অতিথি এবং সেনাবাহিনীকে তারা নির্মম প্রতিপক্ষ মনে করে। সেই কারণে আমরাও তাদের চোখে সেনাবাহিনীর ভাড়াটিয়া পর্যবেক্ষক ছাড়া আর কিছু নয়। অতএব সেই ভ্রমণটিও ছিল অর্থহীন এক বিলাসবহুল ভ্রমণ।
পঞ্চমবার যাই ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পর খাগড়াছড়ির সেই অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে। আমি, আলী যাকের, শাহরিয়ার কবীর, যাকের-এর ফোর হুইলারে প্রায় মধ্যরাতে চলেছি পাহাড়ি পথে মাইলের পর মাইল। খাগড়াছড়ি থেকে রাঙ্গামাটি গেছি কোনরকম বিপত্তির মুখে না পড়েই। পরদিন সকালে যখন রাঙ্গামাটি থেকে খাগড়াছড়ি গেছি তখন রাস্তার দুপাশে আদিবাসীদের চোখেমুখে যে প্রশান্তি এবং উৎসব মুখরতা দেখেছি সেটা কিছুতেই ভোলার নয়। এর আগে যতবার গেছি প্রতিবারই মনে হল, দেশটা আমাদের এবং এখানকার সৌন্দর্য্য সুধা প্রাণভরে পান করার পরিপূর্ণ অধিকার আমার আছে।
ষষ্ঠবার যাই, আদিবাসীদের একটি উৎসবে। অনন্য সাধারণ সেই আতিথেয়তা এবং অপরিসীম সারল্যের কোন উপমা আমি দিতে পারব না। তেহাত্তর সালের মানবেন্দ্ৰ লারমার কাছ থেকে যখন পার্বত্যবাসীদের সমস্যার কথা শুনি তখন মনে হয়েছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে লারমা আর একটু ধৈর্য্য ধরলেই পারতেন। লারমার অন্তরে ক্ষত যে কত গভীর সেটা সে সময় উপলব্ধি করিনি। সেদিক থেকে আমার সবচাইতে বড় উপার্জন ঐ ষষ্ঠবারের পার্বত্য চট্টগ্রাম গমন। কারণ আমার স্বল্পকালীন অবস্থানে আমি ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হতে পেরেছি আদিবাসীদের শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে, জেনেছি তাদের বিশ্বাস, সামাজিক রীতিনীতি এবং জীবনবোধের কিছু কিছু কথা।
ষষ্ঠবার অর্থাৎ শেষবার যখন খাগড়াছড়ি যাই আদিবাসী উৎসবে তখন দূর যাত্রায় ক্লান্ত হয়ে বসে ছিলাম চেয়ারে। পড়ন্ত বিকেল। আকাশে লাল রং ছিটিয়ে সূর্য যাচ্ছে অস্তাচলে। পাহাড়গুলো দাঁড়িয়ে আছে নিস্তব্ধ প্রহরীর মত। ঠিক তেমনি সময় দেখলাম, দূর পাহাড়ের গা বেয়ে নামছে এক পাহাড়ি তরুণী। বোধহয় বাড়ি ফিরছে। বনহরিণীর মত ছন্দিত পায়ে। কখনও গভীর অরণ্যে ডুবে যাচ্ছে আবার কখনও ভেসে উঠছে। তখনই মনে হয় কল্পনা চাকমার কথা। কল্পনা চাকমা নামের সেই পাহাড়ি মেয়েটি কোথায় আছে? আছে তো? কল্পনা চাকমারও তো এখন উৎসবমুখর হবার কথা, এই অনুষ্ঠানে আসার কথা। সে যে এলো না, একথা কি মনে পড়ছে উৎসবের কারও? শংকামুক্ত পার্বত্যভূমিতে কল্পনা চাকমার স্মৃতিচারণ করছেন কি কেবলমাত্র তার বৃদ্ধা মাতা বাঁধুনি চাকমা? দু’একজনকে একথা জিজ্ঞেসও করলাম। তাতে আমার ভুল ভাঙল। পাহাড়ের মানুষরা কল্পনাকে অতি সন্তর্পণে তাদের হৃদয়ের মাঝখানে স্থান করে দিয়েছে।
আজ আমি কল্পনা চাকমাকে নিয়ে লিখছি এই কারণে যে, ঠিক তিন বছর আগে এই তেইশ বছরের সংগ্রামী তরুণীটিকে ১৯৯৬ সালের ১১ জুন দিবাগত রাত একটা-দেড়টার দিকে অপহরণ করা হয় অস্ত্রের মুখে। তারপর আর সে ফেরেনি। অপহরণকারীরা গভীর রাতে কল্পনাদের বাসগৃহে এসে দরজার দড়িটি কেটে ফেলে। সে সময় কল্পনার বৌদি বাতি জ্বালাতে গেলে তারা ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়। অপহরণকারীরা প্রথমে কল্পনার ভাই ক্ষুদিরামের চোখ বাঁধে, তারপর বাঁধে বড় ভাই কালিন্দীকুমারের চোখ। সেই রাত্রে তাদেরকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়ার একপর্যায়ে গুলি করার নির্দেশ শুনে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং কালিন্দীকুমার বোনের হাত ছেড়ে প্রাণপণে পালাতে থাকেন। সে সময়ই কালিন্দী শুনতে পান তার বোনের কণ্ঠের ‘দাদা দাদা’ আর্তনাদ। সেই রাতেই কালিন্দীকুমার গ্রামবাসীদের নিয়ে মশাল জ্বালিয়ে খুঁজেছিলেন বোনকে। কিন্তু তিনি পেয়েছিলেন একটা গোলাগুলির থলি। সেই ধরনের থলি সাধারণত সেনা বাহিনীই ব্যবহার করে থাকে। বিলের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল ক্ষুদিরামের লুঙ্গি। ক্ষুদিরাম প্রাণভয়ে বিবস্ত্র হয়ে পানিতে ঝাঁপ দেন এবং সাঁতরে পার্শ্ববর্তী লাম্বার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। পরদিন সকালে ক্ষুদিরাম প্রাক্তন ইউপি চেয়ারম্যান সম্রাটসুর চাকমার সঙ্গে কজইছড়ি সেনাক্যাম্পে যান। কজইছড়ি সেনাক্যাম্পে তিনি এ জন্যেই যান যে অপহরণের সময় তার চোখে ফেলা টর্চের আলো আড়াল করতে গিয়ে কজইছড়ি ক্যাম্প কমান্ডারকে তিনি চিনতে পেরেছিলেন। ক্ষুদিরাম ঐ ক্যাম্প কমান্ডারকে বোনের খবর জিজ্ঞেস করতে গিয়ে ধমক খান। এরপর পাহাড়ের কোন মানুষ আর কল্পনা চাকমার কোন খোঁজ পায়নি।
সেনাবাহিনীর আয়োজনে এবং আমন্ত্রণে আমি যখন পার্বত্য চট্টগ্রামে যাই তখন কল্পনা চাকমার ইস্যু বেশ টাটকা ছিল। আমি একজন সেনা কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কল্পনা চাকমা বেঁচে আছে কি না। উক্ত কর্মকর্তা আমাকে জবাব দিয়েছিলেন, কল্পনা চাকমা অবশ্যই বেঁচে আছে। তিনি নিশ্চিতভাবে জানেন যে, কল্পনা চাকমা ত্রিপুরা রাজ্যে আছে এবং শান্তিবাহিনীরই একটি অংশ কল্পনা চাকমাকে আটকে রেখে একটা ইস্যু তৈরি করার চেষ্টা করছে। সেনাবাহিনীর কোন গুপ্তচর নাকি স্বয়ং ত্রিপুরার কোন এক গণ্ডাছড়া গ্রামে ঘরের মধ্যে বন্দিপ্রায় কল্পনা চাকমাকে দেখে এসেছে। তিনি একথাও বললেন যে, কল্পনা চাকমাকে যে উদ্ধার করে দিতে পারবে তাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে এই ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। যদি সেনাবাহিনীর কোন ইউনিট বা কোন দল তাকে অপহরণই করবে তাহলে আর পুরস্কার ঘোষণা করতে যাবে কেন? জবাবে আমি হেসে বলেছিলাম, আপনারা পঞ্চাশ কোটি টাকা পুরস্কার ঘোষণা করলেই পারতেন। অংক যত বড়ই হোক, ও টাকা যে দিতে হবে না তা আপনারা বোধহয় নিশ্চতভাবেই জানেন। আমার এই কথায় কর্মকর্তাটি যথেষ্ট অখুশি হয়েছিলেন কিন্তু অতিথির প্রতি কোনরকম অসৌজন্য প্রকাশ না করে তিনি বলেছিলেন, যে ছেলেটির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে সে সত্যিই অত্যন্ত নিরীহ। আমি আর কথা বাড়াইনি। মনে মনে বলেছিলাম, সুদূর প্রবাসে রাতের অন্ধকারে, পাহাড়ি ভূমিতে, আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত সামরিক বাহিনীর কতিপয় তরুণ যদি কোন অপারেশনে যায় এবং সেই অপারেশনের লক্ষ্য যদি থাকে কোন পাহাড়ি তরুণী, তা হলে সেই নিরীহ চেহারার মানুষটি কি বদলে যেতে পারে না?
কল্পনা চাকমা নিখোঁজ হবার পর একটি উল্লেখ করার মত ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন ১৯৯৬ সালের ৮ আগস্ট জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত একটি সাংবাদিক সম্মেলনের দাবি করে যে, কল্পনা চাকমা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে নিজ লোকজনের সহায়তায় নিখোজ রয়েছেন। লেঃ ফেরদৌস অথবা সামরিক বাহিনীর কোন সদস্যই এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। বলা হয়, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চাকমা কমিশনকে একথাও জানিয়েছে কল্পনা চাকমা ত্রিপুরা রাজ্যের গণ্ডাছড়া মহকুমার চার মাইল পূর্বে শুক্রে নামক জায়গায় অবস্থান করছেন (ভোরের কাগজ ৯-৮-১৯৯৬)। পত্রিকায় বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন এই দাবি করার পর পরই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অন্যতম মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যানিটি প্রোটেকশন ফোরাম বিবিসির মাধ্যমে এক বিবৃতি দিয়ে বলেছেন যে, কল্পনা চাকমার ত্রিপুরায় অবস্থানের সংবাদটি ভিত্তিহীন। তাদের একটি তদন্তকারী দল কল্পনা চাকমাকে ত্রিপুরার গণ্ডাছড়া অঞ্চলে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে। কিন্তু কোন সন্ধান পায়নি। বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থার সেই অনুসন্ধান অভিযান ও তড়িঘড়ি সাংবাদিক সম্মেলনে সে সময় একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। এরপর বাংলাদেশ সরকার একটি তদন্ত কমিশন করেছিলেন। বিচারপতি আবদুল জলিলের নেতৃত্বে গঠিত সেই তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট কি এখন হিমাগারে চলে গেছে? সেই তদন্ত কমিশন নাকি কল্পনার মা বাঁধুনি চাকমার সাক্ষাৎকার নেননি। কোন কোন পত্রিকায় বেরিয়েছিল তদন্ত কমিশন নাকি সন্দেহ করেন কল্পনা চাকমা জীবিতই আছে। কিন্তু কোথায় কীভাবে আছে সে সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ধারণা নেই কমিশনের রিপোর্টে। এই খবরটি পত্রিকায় বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে কল্পনা চাকমা অপহরণ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী সব মহলই কমিশনের এই পর্যবেক্ষণ প্রত্যাখান করে। তারপর সব চুপচাপ।
এখন পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্ত। আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন শান্তিবাহিনীর নেতা সন্তু লারমা। ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পর দেশত্যাগী আদিবাসীরা ফিরে এসেছে স্বদেশভূমিতে। তারা এখন ঘর গোছানো শুরু করেছে। কল্পনা চাকমা যদি বেঁচেই থাকে তবে তাকে দেখছি না কেন? কল্পনা যদি ত্রিপুরাতেই থাকবে তাহলে সবাই ফিরে এলেও সে কেন এলো না? তার কি ফিরে পেতে ইচ্ছে করে না তার দেশকে, এই পাহাড়ি জীবনকে, তার প্রিয় পরিবারকে? এ জন্যই তো সে লড়াই করেছিল। এই সরকারের উচিত হবে কল্পনা চাকমার মত যারা হারিয়ে গেছে তাদের অনুসন্ধান করার উদ্যোগ নেওয়া, উচিত হবে সামরিক অভিযানের নামে সুদীর্ঘকাল আদিবাসীদের ওপর যে অত্যাচার হয়েছে, অরণ্যের ওপর যে নির্মম নির্যাতন হয়েছে তার একটা খতিয়ান তুলে ধরা। শান্তিচুক্তি শুধু নয়, অশান্তির উৎসকেও উপড়ে ফেলতে হবে।
প্রথম আলো : সোমবার ১৪ জুন ১৯৯৯