কালো ঘুড়ি

কালো ঘুড়ি

বেশ কড়া মাঞ্জা হয়েছে৷ খাঁদু মল্লিক বলে লোকটা যত বড়ো ঘুড়িবাজ লোক হোক না কেন, তার চাপরাশ সে সহজে কাটতে পারবে না৷ খাটে বসে পাখার বাতাস খেতে খেতে বেশ আত্মতৃপ্তির সঙ্গে কথাগুলো ভাবলেন ফটিকবাবু৷

নিঝুম দুপুর৷ বাইরে কোথাও যেন একটা কাক ডাকছে৷ মাথার ওপর পাখার মৃদু ঘড়ঘড় শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই ফটিকবাবুর তিনতলার এই ঘরে৷

হঠাৎ দরজায় মৃদু কড়া নাড়ার শব্দ হল৷ ভরদুপুরে কে আবার এল? কোনো সেলসম্যান নাকি৷ ফটিকবাবু গিয়ে দরজা খুলতেই এক পাশের সিঁড়ির অন্ধকার থেকে একটা মোলায়েম কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘আপনি এ-বাড়ির নতুন ভাড়াটে বুঝি? অসময়ে একটু বিরক্ত করতে এলাম৷’

ফটিকবাবু দেখলেন সিঁড়ির প্রায় অন্ধকার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন একজন৷ ভদ্রলোক মাঝবয়সি, পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি৷ তাঁকে দেখে সেলসম্যান বলে মনে হচ্ছে না৷ সম্ভবত সিঁড়ি বেয়ে ওপর থেকে নেমে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি৷

ফটিকবাবু বললেন, ‘আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না?’

ভদ্রলোক দু-পা এগিয়ে এসে বললেন, ‘আমার নাম অবিনাশ হালদার৷ আমি ওই ছাদের কোনার ঘরটাতে থাকি৷ ছাদে আপনি ঘুড়ির মাঞ্জা দিচ্ছিলেন, আমার আবার এক সময় খুড়ি ওড়ানোর খুব শখ ছিল৷ তাই ভাবলাম একবার আপনার সঙ্গে পরিচয় করে আসি৷ দু-দণ্ড কী কথা বলা যাবে আপনার সঙ্গে?’

ছাদের কোনায় একটা ঘর আছে৷ লোকটা তাহলে হয়তো সত্যি সেখানে থাকেন৷ মাস তিনেক হল উত্তর কলকাতায় এই চারতলা পুরোনো বাড়িটায় ভাড়াটে হিসাবে উঠে এসেছেন ফটিকবাবু৷ বাড়িটায় অনেক খুপরি খুপরি ঘর৷ তবে এখানে যে যার মতো থাকে৷ কেউ কাউকে বিরক্ত করে না৷ ফটিকবাবু সকাল আটটাতে অফিস বেরিয়ে যান, ফেরেন রাত আটটায়৷ এ-বাড়িতে কারো সঙ্গেই পরিচয় নেই তাঁর৷ বাড়ির মালিক অন্যত্র থাকেন৷ ফটিকবাবু সেখানে গিয়ে ভাড়া মিটিয়ে আসেন৷ আগন্তুককে ভদ্রলোক বলেই মনে হচ্ছে, কাজেই ফটিকবাবু তাকে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আসুন, ঘরে আসুন৷’

ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে একটু জড়োসড়ো হয়ে ফটিকবাবুর মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসলেন৷ লোকটার মুখে কেমন যেন এক বিষণ্ণতার ছাপ আছে৷ লোকটাকে নিরীহ গোছেরই মনে হল ফটিকবাবুর৷

ফটিকবাবু জানতে চাইলেন, ‘আপনার কী করা হয়?’

ভদ্রলোক বিষণ্ণ হেসে জবাব দিলেন, ‘আগে একটা মার্চেণ্ট কোম্পানিতে চাকরি করতাম৷ এখন কিছুই করি না৷’

কথাগুলো বলার পর হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি পড়ল পাশের টেবিলটার ওপর৷ ফটিকবাবুর কেনা ঘুড়িগুলো রাখা সেখানে৷

ঘুড়িগুলো দেখেই ভদ্রলোক বলে উঠলেন, ‘আরে চারপাশ ঘুড়ি৷ বেশ ভালো ঘুড়িগুলো! আমারও প্রিয় ঘুড়ি ছিল চাপরাশ৷’

ঘুড়ির প্রসঙ্গে কেউ কোনো কথা বললে বেশ উৎসাহিত বোধ করেন ফটিকবাবু৷ তিনি বললেন, ‘কালতো বিশ্বকর্মা পুজো, ঘুড়ি ওড়াবার দিন৷ ওড়াব কাল৷ জানেন, আমি যখন গ্রামে থাকতাম তখন এটাই ছিল আমার একমাত্র নেশা৷ লোকে তো আমার নাম দিয়ে ফেলেছিল চাপরাশদা, কেউ কেউ ডাকত চাপরাশবাবু বলে৷ কলকাতায় আসার পর মাঝে অবশ্য বছর অটেক ঘুড়ি ওড়াবার সুযোগ হয়নি৷ দক্ষিণ কলকাতায় যে বাড়িতে থাকতাম, সে ভাড়া বাড়ির ছাদেও এক চিলতে জায়গা ছিল না, আশেপাশে কোনো মাঠও নেই, খুবই মুষড়ে পড়েছিলাম৷ এ-বাড়িটা আমার পছন্দ হয়ে গেল বিরাট ছাদটা দেখে৷ কাল মনের সুখে বহুদিন পর ঘুড়ি ওড়াব৷’

অবিনাশবাবু বললেন, ‘আজকালতো ঘুড়ি ওড়ানোর শখ দেখাই যায় না৷ এখনকার ছেলে-মেয়েদের শৈশবটাই কেমন বদলে গেল৷ তবে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন এখনও কিছু ঘুড়ি ওড়ে এ-পাড়াতে৷ বহু দিনের প্রথা বলেই হয়তো এখনও সেটা পুরোপুরি মুছে যায়নি৷ কিন্তু প্রতি বছরই আকাশে ঘুড়ির সংখ্যা কমছে৷’

ফটিকবাবু বললেন, ‘আমাদের ছেলেবেলায় ভিডিয়ো গেমস, কম্পিউটার এত সব ছিল না৷ পিঠে বইয়ের বস্তাও থাকত না৷ অবশ্য মাঠও এখন প্রায় নেই বললেই চলে৷ ছেলে-মেয়েদের আর দোষ কী?’

অবিনাশবাবু এরপর বললেন, ‘এ-পাড়াটা তো খুব পুরোনো৷ ঘুড়ি ওড়ানো এক সময় উৎসবের মতো ছিল এখানে৷ বিশ্বকর্মা পুজোর এক মাস আগে থেকেই ঘুড়ি ওড়াবার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত৷ বিরাট বিরাট ছাদগুলোতে মাঞ্জা দেওয়ার জন্য দখল নেওয়া হত৷ কত রকম গোপন ফর্মুলা ছিল সে সব মাঞ্জার৷ চন্দননগর থেকে কেউ নিয়ে আসত বেলোয়ারি কাচের মিহি গুঁড়ো, কেউ বা ছুটত ক্যানিং-এ কচ্ছপের ডিম খুঁজতে৷ সে ডিম মাঞ্জায় মেশানো হত৷

একবার কেদার ঘোষ বলে একটা লোক নববইটা ঘুড়ি কেটেছিল৷ পরে শোনা গেল সে নাকি শ্মশান থেকে মানুষের হাড়ের গুঁড়ো এনে মিশিয়েছিল মাঞ্জার সঙ্গে৷ আর ব্যারিস্টার নরেন মুখুজ্যে নাকি তাঁর নতুন কেনা অস্টিন গাড়িটাই হেরে বসেছিলেন বাজি ধরে ঘুড়ির লড়াইতে৷ সে সময় পয়সাওয়ালা লোকেরা বাজি ধরতেন ঘুড়ির লড়াইতে…৷ পুরোনো দিনের ইতিহাস বলতে বলতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ভদ্রালোকের মুখ৷

কিন্তু ‘বাজি’ শব্দটা কানে যেতেই একটু ইতস্তত করে ফটিকবাবু বলে ফেললেন, ‘জানেন কাল আমিও একটা বাজি ধরেছি ঘুড়ির লড়াইতে৷’

‘মানে?’ ভদ্রলোক যেন মৃদু চমকে উঠলেন তার কথা শুনে৷

ফটিকবাবু বললেন, ‘ইয়ে মানে, বাজি ধরাটা যে ঠিক নয়, তা আমি জানি, কিন্তু পরিস্থিতি হঠাৎ এমন হল যে বাজিটা ধরতেই হল৷ ব্যাপারটা খুলেই বলি৷ দিন পাঁচেক আগে শনিবার দুপুরে অফিস ফেরতা পাড়ার মোড়ে বুড়ো ঘুড়িওয়ালার দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুড়ি বাছছিলাম৷ পাড়ায় আমি নতুন, বুড়োটা আমায় আগে ঘুড়ি কিনতে দেখেনি৷ আমি কত বছর ঘুড়ি ওড়াই, কী ঘুড়ি পছন্দ করি, কেমন লড়াই এসব জিগ্যেস করছিল লোকটা৷ কথা প্রসঙ্গে আমি তাকে বলেছিলাম যে, ‘জানেন আমার ঘুড়ি কেউ কোনোদিন কাটতে পারেনি৷’ কথাটা আমি মিথ্যা বলিনি৷ ছেলেবেলায় দু-একবার ছাড়া আমার চাপরাশ কেউ কোনোদিন কাটেনি৷ কিন্তু বুড়োটাকে এ কথা বলা মাত্রই অমার পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘তাই নাকি? আমার ঘুড়িও কেউ কাটতে পারেনি৷ বিশ্বকর্মা পুজোর দিন একটা লড়াই হবে নাকি? কে কত ঘুড়িবাজ দেখা যাবে৷’

তাকিয়ে দেখি আমার ঠিক পিছনে মাঝবয়সি একজন লোক দাঁড়িয়ে৷ তার মাথায় কদমছাঁট চুল, পরনে রংচঙে শার্ট, আর রংচটা জিন্সের প্যান্ট৷ বোতাম খোলা বুকে সোনার চেনে একটা বাঘ নখের লকেট৷ লোকটার সঙ্গে আরও কয়েকজন যুবক৷

আমি তাকাতেই সে লোকটা এরপর হাত জোড় করে নমস্কার করে বলল, ‘আমার নাম খাঁদু মল্লিক৷ আপনার পাড়াতে থাকি৷ লোহালক্কড়ের কারবার আছে আমার৷ আপনি তো ওই গলির কোনায় পনেরো নম্বর বাড়িতে নতুন ভাড়া এসেছেন তাই না? হয়ে যাবে নাকি ওইদিন ঘুড়ির লড়াই?’

ঘুড়ির লড়াই অনেকটা প্রাচীন দিনের সাহেবদের ‘ডুয়েল লড়াইয়ের’ মতো৷ কেউ আহ্বান করলে তাতে সাড়া না দিলে মান-ইজ্জত থাকে না৷ কাজেই আমি বললাম, ‘আমার আপত্তি নেই৷ হতেই পারে৷’

খাঁদু মল্লিক বলে লোকটা এরপর বলল, ‘তবে একটা শর্ত আছে কিন্তু৷ কিছু নিয়মও থাকবে এ লড়াইতে৷ তিনবার খেলা হবে৷ যে দুবার ঘুড়ি কাটতে পারবে সে জিতবে৷ অন্যপক্ষ তাকে দশ হাজার টাকা দেবে৷ অর্থাৎ এ খেলায় দশ হাজার টাকা বাজি৷ আমার গায়ে জমিদারি রক্ত আছে৷ ঘুড়ির লড়াইতে বাজি ছাড়া আমি খেলি না৷

খেলায় বাজি ধরা ঠিক নয়, তাই আমি তাকে বললাম, ‘বাজি ধরে নয়৷ এমনি লড়াই হতে পারে৷ খুব বেশি হলে মোড়ের মাথায় ‘আবার খাব রেস্তোরাঁর’ মটন বিরিয়ানি বাজি হতে পারে৷’

খাঁদু মল্লিক শুনে বলল, ‘ছোঃ বিরিয়ানি আবার বাজি হল নাকি? আপনি কী ভয় পেলেন? ট্যাঁকে টাকা না থাকলে অবশ্য অন্য কথা৷’

আমি শুনে বললাম, ‘না, ও টাকা আমার কাছে কিন্তু বাজি ধরা আমার পছন্দ নয়৷’

লোকটা এরপর দাঁত বার করে হেসে বলল, ‘কেন ঘুড়িওয়ালার কাছে মিথ্যা গল্প করছিলেন দাদা৷ আপনার ঘুড়ি নাকি কেউ কাটতে পারে না৷ এসব গল্প আমার অনেক শোনা আছে৷’

আমি জবাব দিলাম, ‘আমি একদম সত্যি বলছি৷ দরকার হলে আপনি আমার গ্রামে চলুন, লোকেরা কী বলে শুনুন?’

খাঁদু মল্লিক বলল, ‘গ্রামে যেতে আমার বয়েই গেছে৷ সাহস থাকলে আমার সঙ্গে বাজিতে নামুন৷ এলেম বোঝা যাবে৷’

আমি চুপ করে রইলাম৷ তাই দেখে সে বলল, ‘ও বুঝেছি৷…এই যে বুড়ো, বাবুকে তুমি খোকা লাটিম আর ছোটো ঘুড়ি দাও৷ খবরদার, মাঞ্জা যেন কড়া না হয়, হাত কেটে যাবে৷ বাবা বিশ্বকর্মা পুজোয় খোকাবাবুদের সঙ্গে ঘুড়ির লড়াই খেলবে৷ মাঞ্জা, লাটাই, ঘুড়ির পয়সাও বরং তুমি আমার থেকেই নিও৷

খাঁদু মল্লিকের স্যাঙ্গাতরা তার কথা শুনে খ্যাঁ-খ্যাঁ করে অসভ্যের মতো হাসতে লাগল৷

যার খুড়ি কোনোদিন সত্যি কেউ কাটতে পারেনি, যে বোম্বাই লাটাই, ব্লেডের মতো ধারালো সুতোর মাঞ্জা ছাড়া কোনোদিন ঘুড়ি ওড়ায় না, তাকে নিয়ে এমন রসিকতা৷ এমন বিদ্রূপ৷ হঠাৎ যেন আমার মাথাটা কেমন বিগড়ে গেল৷ আমি বলে উঠলাম, ‘ঠিক আছে, কে কত বড়ো ঘুড়িবাজ বোঝা যাবে৷ আমি রাজি৷’

আমার কথা কানে যাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে খাঁদু মল্লিক আমাকে চমকে দিয়ে পকেট থেকে একটা একশো টাকার বান্ডিল বুড়ো দোকানির দিকে ছুড়ে দিয়ে আমার উদ্দেশ্যে বলল, ‘আমার আপনার দুজনের টাকাই ওর কাছে জমা থাকবে৷ আপনার কাছে এখন টাকা না থাকলে কাল-পরশু টাকাটা ওকে দিয়ে যাবেন৷ বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ঠিক পাঁচটায় আমার ঘুড়ি আকাশে উড়বে৷ মনে রাখবেন কালো ঘুড়ি৷’ আর একটা কথা, কথার খেলাপ আমি করি না, আর অন্য কেউ করলেও আমি তা পছন্দ করি না৷’

আমাকে আর কথা বলা সুযোগ না দিয়ে খাঁদু মল্লিক এরপর দলবল নিয়ে হাঁটতে শুরু করল৷ অগত্যা সোমবার অফিস ফেরত আমিও সেই বুড়োটার কাছে দশ হাজার জমা রেখে এসেছি৷ তবে আমি নিশ্চিত খাঁদু মল্লিক আমাকে হারাতে পারবে না৷ তবে বাজির টাকাটা আমি কোনো অনাথ আশ্রমকে দান করে দেব ভেবেছি৷’

অবিনাশবাবুর উদ্দেশ্যে একটানা কথা বলে থামলেন ফটিকবাবু৷

অবিনাশবাবুর মুখটা তার কথা শোনার পর কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল৷ তিনি যেন একটু চিন্তিত ভাবে বললেন, ‘খাঁদু মল্লিক৷ আবার সেই কালো ঘুড়ি৷’

ফটিকবাবু বললেন, ‘আপনি খাঁদু মল্লিককে চেনেন নাকি?’

অবিনাশবাবু চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, চিনি৷ বাজি ধরা ব্যাপারটা ভালো নয়৷ তবে ধরেই যখন ফেলেছেন তখন আর কী করবেন? তবে খাঁদু মল্লিক কিন্তু পাক্কা ঘুড়িবাজ লোক৷ সে-ও অনেকদিন বাজি হারেনি৷ আপনার জন্য শুভ কামনা রইল৷’

ভদ্রলোক এরপর বললেন, ‘ঠিক আছে আমি এখন আসি৷ পরিচয়টা সেরে গেলাম৷ আর একটা কথা, এ-বাড়ির ছাদের কার্নিশটা বেশ নীচু, একটু সাবধানে ঘুড়ি ওড়াবেন৷’

কথা শেষ করে আর দাঁড়ালেন না ভদ্রলোক৷ ফটিকবাবুকে একটা নমস্কার করে বাইরে সিঁড়ির অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন৷

ফটিকবাবুর মনে হল, লোকটা বেশ অদ্ভুত লোক৷ কেমন হুট করে এলেন, আবার তেমনই হুট করে চলে গেলেন৷

বিকালবেলা রোদ একটু কমলে ফটিকবাবু একবার ছাদে উঠলেন মাঞ্জা দেওয়া সুতো গোটাবার জন্য৷ তখনই ছাদের কোণে সেই ঘরটার দিকে নজর গেল তাঁর৷ দুপুরের লোকটাতো বলে গেল সে ওই ঘরটাতেই থাকে৷ ঘরটা অবশ্য এখন তালা বন্ধ৷ হয়তো ভদ্রলোক এখন বাইরে বেরিয়েছে— মনে মনে ভাবলেন ফটিকবাবু৷

আজ বিশ্বকর্মা পুজো৷ ফটিকবাবুর ঘুম ভাঙল পুজো প্যান্ডেলের মাইকের শব্দে৷ সকাল সকাল স্নান সেরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে টানা রিকশা চেপে তিনি ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে পুজো দিতে গেলেন৷ পুজো দিয়ে বেলা দশটা নাগাদ যখন তিনি বাড়ি ফিরলেন, তখন আকাশের দিকে তাকিয়েই মনটা নেচে উঠল তার৷ আকাশে ঘুড়ি উড়তে শুরু করেছে৷ কতরকমের ঘুড়ি৷ চাপরাশ, চাঁদিয়াল, পেটকাটি, বগ্গা, লোডশেডিং৷ নিজের ঘরে ঢুকে জানলা দিয়ে আকাশে ছেয়ে যাওয়া নানা রঙের ঘুড়ির খেলা দেখতে লাগলেন ফটিকবাবু৷ মাঝে-মাঝেই আশপাশের বাড়ির ছাদ বা নীচের রাস্তার গলির থেকে উল্লাসধ্বনি উঠছে— ‘ভোঁকাটটা! ভোঁকাটটা৷ কোনো ঘুড়ি হয়তো আকাশ থেকে কেটে নীচে নামতে শুরু করেছে, আর তার সুতো ধরার জন্য পিছু ধাওয়া করেছে ছেলের দল৷ বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা চাপা উত্তেজনা অনুভব করতে লাগলেন ফটিকবাবু৷ বিকাল ঠিক পাঁচটায় উড়বে সেই কালো ঘুড়িটা৷ তাঁর চাপরাশগুলো, সুতো-লাটাই সব তৈরি করে রেখেছেন তিনি৷ তাঁর ঘুড়ি কেউ কোনোদিন কাটতে পারেনি৷ তবুও…

দুপুর বেলায় খাওয়া সেরে একটা ঘুম দিয়ে তিনি যখন উঠলেন, তখন বিকাল চারটে বাজে৷ তার সাজসরঞ্জাম নিয়ে সাড়ে চারটে নাগাদ ছাদে উঠলেন ফটিকবাবু৷ আকাশে এখন আর খুব বেশি ঘুড়ি নেই৷ হয় তারা কেটে গেছে বা নীচে নেমে গেছে৷ দু-চারটে ঘুড়ি শুধু ক্লান্ত-অবসন্ন ভাবে আকাশে ভাসছে৷ ফটিকবাবুর অভিজ্ঞ চোখ বুঝতে পারল, ওসব ঘুড়িতে আর লড়াইয়ের দম নেই৷

ফটিকবাবুর একবার চোখ গেল ছাদের সেই ঘরটার দিকে৷ ঘরটা আগের দিনের মতোই তালাবন্ধ৷ শুধু অন্য একটা বাড়তি জিনিস আজ সেখানে চোখে পড়ল তার৷ একটা চাপরাশ ঘুড়ি ঘরের দরজায় মাথায় লোহার শিকে আটকে আছে৷ পুরোনো ঘুড়ি৷ হয়তো কোথা থেকে উড়ে এসে আটকে গেছে ওখানে৷ আকাশের দিকে তাকিয়ে পাঁচটা বাজার প্রতীক্ষা করতে লাগলেন ফটিকবাবু৷

ঠিক পাঁচটা৷ কিন্তু দূরে একটা বাড়ির ছাদের আড়াল থেকে ধীরে ধীরে আকাশে উঠতে শুরু করল একটা ঘুড়ি৷ অনেক ঘুড়ি দেখেছেন ফটিকবাবু৷ কিন্তু অমন মিশমিলে কালো ঘুড়ি তিনি জীবনে দেখেননি৷ আর কী আশ্চর্য, কালো ঘুড়িটা আকাশে ওঠার সঙ্গেসঙ্গে এ-কোণে সে-কোণে যে কয়েকটা ঘুড়ি আকাশে ভাসছিল, তাদের মধ্যে একটা প্রচণ্ড চঞ্চলতা শুরু হল৷ পড়িমড়ি করে নীচে নামতে শুরু করল তারা৷ শুধু সেই কালো ঘুড়িটা মাঝ আকাশের দিকে তরতর করে উঠে যেতে লাগল৷

চাপরাশ একবার কপালে ঠেকিয়ে ‘জয়মা’ বলে সেটাকে আকাশে ওড়ালেন ফটিকবাবু৷

মাঝ আকাশে দিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কালো ঘুড়িটা৷ যেন একটা কালো চিল আকাশে ভাসছে৷ ফটিকবাবুর চাপরাশ পৌঁছে গেল তার কাছে৷ সেও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল কিছুটা তফাতে৷ ঠিক যেন লড়াইয়ে নামার আগে ঘুড়ি দুজন প্রতিপক্ষকে জরিপ করে নিচ্ছে৷

কিছুক্ষণের মধ্যেই লড়াই শুরু হয়ে গেল৷ কখনো কালো ঘুড়িটা ছোঁ মেরে এগিয়ে আসে চাপরাশের দিকে, কখনো আবার ফটিকবাবুর চাপরাশ ধেয়ে যায় কালো ঘুড়ির দিকে৷ কিন্তু একজন এগোলেই অন্যজন স্যাঁত করে সরে যাচ্ছে এপাশ-ওপাশ ওপর-নীচে৷ প্যাঁচ লাগতে দিচ্ছে না৷ আকাশটা যেন একটা বিরাট বক্সিং রিং৷ সেখানে লড়াই করছে দুই বক্সার৷ কখনো আঘাত করতে এগিয়ে যাচ্ছে, কখনো বা আঘাত বাঁচাতে সরে আসছে৷ বেশ কিছুক্ষণ এ ভাবে চলার পর কীভাবে হঠাৎ পাঁচ লেগে গেল দুটো ঘুড়িতে৷ ফটিকবাবুর টানা মাঞ্জা৷ তিনি হ্যাঁচকা টান দিলেন সুতোয়৷ পরক্ষণেই কালো ঘুড়িটা সুতো কেটে ভাসতে শুরু করল৷ উল্লাসে লাফিয়ে উঠে ছাদের মধ্যে নাচতে শুরু করলেন ফটিকবাবু৷ ভোঁকাটটা, ভোঁ-কাটটা! তার ঘুড়িটাও ফটিকবাবুর লাটাই ধরা হাতে নাচতে লাগল মাঝ আকাশে৷

তবে ফটিকবাবুর নাচ কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না৷ কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই একইরকম মিশমিশে আর-একটা কালো ঘুড়ি অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় আকাশে উঠতে শুরু করল৷

আবার শুরু হল লড়াই৷ কালো ঘুড়িটা এবার যেন অনেক সতর্ক৷ চট করে চাপরাশের কাছে আসছে না৷ ফটিকবাবুর ঘুড়ি তার কাছে গেলেই সে সরে যাচ্ছে৷ দুটো ঘুড়ির চোর-পুলিশ খেলা শুরু হল মাঝ আকাশে৷ সূর্য ঢলতে শুরু করল৷ এক সময় বেশ অধৈর্য হয়ে পড়লেন ফটিকবাবু৷ কালো ঘুড়িটা কিছুতেই তার কাছে আসছে না৷ আর এর পরই তিনি খেয়াল করলেন, কালো ঘুড়িটা কেমন যেন নেতিয়ে পড়ছে৷ খুব ধীরে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে সে নীচে নামছে৷ ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্য ফটিকবাবু কয়েকবার চাপরাশটাকে তার দিকে নিয়ে গেলেন৷ কিন্তু কালো ঘুড়ির কোনো হেলদোল নেই৷

মাঝ আকাশে সূর্য ডোবার সময় শেষ বিকেলে ঘুড়ির সুতো ভিজলে অনেক সময় ঘুড়ির এমন হয়৷ ঠিক এমন ভাবেই নেতিয়ে পড়ে ঘুড়ি৷ ব্যাপারটা নিশ্চয় তাই৷ এখন প্যাঁচ লাগিয়ে টান দিলেই কালো ঘুড়ি ভোঁ-কাটটা৷ এ সুযোগ ছাড়া যাবে না— এই ভেবে ফটিকবাবু তাঁর চাপরাশ বাড়ালেন কালো ঘুড়ির দিকে৷ সে ঘুড়ি তখন আরও নেতিয়ে পড়েছে৷ প্রথম ঘুড়িটা কেটে ফটিকবাবুর আত্মবিশ্বাস তখন তুঙ্গে৷ তিনি প্যাঁচ লাগালেন ঘুড়িতে৷ কিন্তু তার পরমুহূর্তেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল৷ মৃতপ্রায় অবসন্ন কালো ঘুড়িটা হঠাৎই গোঁত্তা খেয়ে রকেটের বেগে আকাশে উঠে গেল, আর ফটিকবাবু অনুভব করলেন তাঁর লাটাইয়ে সুতোর টান আর নেই৷ সুতো ছেড়ে ভাসতে শুরু করেছে তাঁর চাপরাশ৷ সুতোয় নয়, হাওয়ায় ভাসছে চাপরাশ! ব্যাপারটা একটা ফাঁদ ছিল৷ কাটা পড়েছে ফটিকবাবুর ঘুড়ি৷ মাঝ আকাশে নাচছে খাঁদু মল্লিকের কালো ঘুড়ি৷

কিছুক্ষণ হতভম্ব ভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন ফটিকবাবু৷ তার পর অবশিষ্ট সুতো নামিয়ে নতুন একটা চারপাশ যখন তাতে লাগাতে যাচ্ছেন, ঠিক তখনই পিছন থেকে ভেসে এল একটা গলা, ‘আপনি ভালো ঘুড়ি ওড়ান ঠিকই, কিন্তু ধুর্ততায় খাঁদু মল্লিকের সঙ্গে পারবেন না৷ কীভাবে আপনাকে ঠকাল দেখলেন?’

গলা শুনে মৃদু চমকে উঠে ফটিকবাবু দেখলেন তাঁর কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে আছেন গতকাল দুপুরের সেই ভদ্রলোক— অবিনাশবাবু৷

তিনি এরপর বললেন, ‘প্রথম থেকেই লড়াইটা দেখছি আমি৷ প্রথমবার আপনি কালো ঘুড়িটা কাটতে পেরেছিলেন খাঁদু মল্লিক অসতর্ক ছিল বলে৷ বারবার ও জিনিস কিন্তু খাটবে না৷ এ লড়াইটা যে ভাবেই হোক জিতবে সে৷ দিন, লাটাইটা এবার আমাকে দিন৷’

ভদ্রলোকের কথা শুনে ফটিকবাবু বেশ অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, ‘লাটাইটা আপনাকে দেব কেন?’

‘দেবেন, কারণ, কালো ঘুড়ির সঙ্গে শেষ লড়াইটা আমিই লড়ব এই ঘুড়িটা দিয়ে৷’ অবিনাশবাবুর হাতে ধরা রয়েছে ছাদের মাথায় যে চাপরাশটা ছিল সেটা৷

ফটিকবাবু বললেন, ‘কিন্তু লড়াই তো আমার সঙ্গে৷ আপনি লড়বেন কেন? ব্যাপারটা অনৈতিক হবে৷ তা ছাড়া আপনি যদি…৷’

তাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে অবিনাশবাবু বললেন, ‘কী ভাবছেন আমি যদি হেরে যাই তবে আপনার টাকা যাবে? এই যে দশহাজার টাকা আমি আপনার হাতে দিচ্ছি৷ আর নৈতিকতার ব্যাপার বলছেন, সেটা আপনি পরে বুঝবেন৷ সম্ভবত অন্য একটা ঘটনা ঘটতে পারে এরপর৷ দিন লাটাইটা দিন, সময় বেশি নেই৷’

লোকটার কণ্ঠস্বরে এমন একটা কিছু ছিল যে ফটিকবাবু লাটাইটা লোকটার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘নিন তবে৷ আর টাকাটা আপনার কাছে রাখুন৷ তবে আমি কিন্তু ব্যাপারটার কিছুই বুঝতে পারছি না৷

লাটাইটা হাতে নিয়ে সেই পুরোনো চাপরাশটা সুতোয় বাঁধতে বাঁধতে ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন, ‘বুঝতে পারবেন৷ আপনি এখন আমার ওই ছাদের ঘরের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ান৷ কোনো পরিস্থিতিতেই আমি যতক্ষণ না বলব বাইরে বেরোবেন না৷ আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, খাঁদু মল্লিকের প্যাঁচ এবার আমি কাটবই৷’

ভদ্রলোকের কথা শুনে কিছুটা বিস্মিত ভাবেই তাঁর নির্দেশ মতো সেই ঘরটার আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালেন ফটিকবাবু৷ অবিনাশবাবু যখন ঘুড়ি ওড়ালেন তখন সূর্য ঢলে পড়েছে৷ ওপরে উঠতে লাগল তার ঘুড়ি৷ যে ভাবে তিনি লাটাই ধরে সুতো ছাড়তে লাগলেন, তা দেখেই ফটিকবাবু বুঝে গেলেন এ লোকটাও পাকা ঘুড়িবাজ৷

কালো ঘুড়ির কাছে পৌঁছে গেল অবিনাশবাবুর চাপরাশ৷ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কালো ঘুড়ি৷ অবিনাশবাবুর ঘুড়িটাও স্থির হল৷ এরপর বেশ কয়েকবার ঘুড়ি দুটো নিজেদের নিরাপদ এলাকাতে গোত্তা খেল ঠিকই, কিন্তু আবার নিজের জায়গাতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ মিনিটের পর মিনিট কেটে যাচ্ছে কিন্তু দুটো ঘুড়ি একদম স্থির৷ কেউ যেন আকাশের গায়ে আঠা দিয়ে আটকে রেখেছে ঘুড়ি দুটোকে৷

ঘরটার আড়াল থেকে ফটিকবাবু বুঝে উঠতে পারলেন না কী করতে চলেছে দুই ঘুড়িবাজ? অবিনাশবাবু তাঁর দিকে পিছন ফিরে ছাদের আলসের ধারে লাটাই ধরে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন৷ এদিকে অন্ধকার নামতে চলেছে৷

এক সময় বেশ অধৈর্য হয়ে ফটিকবাবু ঘরটার আড়াল থেকে বাইরে বেরুতে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় হঠাৎ একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়ল তাঁর৷ ছাদের কোনায় কার্নিশ বেয়ে বিড়ালের মতো নিঃশব্দে ছাদে উঠে এল একজন লোক৷ তাকে দেখেই চমকে উঠলেন ফটিকবাবু৷ আরে এ যে খাঁদু মল্লিক৷ তাহলে আকাশে কালো ঘুড়িটা ওড়াচ্ছে কে?

ছাদের চারদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে খাঁদু মল্লিক দু-হাত সামনে বাড়িয়ে এরপর পা টিপে টিপে এগোতে লাগলেন ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা অবিনাশবাবুর দিকে৷ অবিনাশবাবু পাথরের মূর্তির মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন৷ খাঁদু মল্লিকের চোখ দুটো জ্বলছে, ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেছে এক জান্তব হাসি৷ অবিনাশবাবুকে লক্ষ করে এগোচ্ছেন তিনি৷

আর মাত্র কয়েকটা পা, তাহলেই খাঁদু মল্লিক ছুঁয়ে ফেলবে অবিনাশবাবুকে, ঠিক এই সময় অবিনাশবাবু ঘুরে দাঁড়ালেন৷ তার মুখেও ফুটে উঠেছে একটা দুর্বোধ্য হাসি৷ তিনি খাঁদু মল্লিকের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তুমি আসবে আমি জানতাম৷ এসো আমাকে ধাক্কা দাও৷ এই তো ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছি আমি৷ এসো, এসো…৷ ক্রমশ চওড়া হচ্ছে অবিনাশবাবুর হাসি৷

খাঁদু মল্লিকের ঠোঁটের হাসিটা মুছে গেল৷ প্রথমে বিস্ময়, তারপর লোকটার মুখমণ্ডলে ফুটে উঠল প্রচণ্ড আতঙ্কের ছাপ৷ হাত দুটো আপনা থেকেই যেন গুটিয়ে গেল বুকের কাছে৷ যেন ভয়ঙ্কর কোনো আতঙ্কে চিৎকার করে উঠে খাঁদু মল্লিক দড়াম করে পড়ে গেল ছাদে৷ আর এর পর মুহূর্তেই আকাশের দিকে চোখ রেখে অবিনাশবাবু হাতের লাটাই নাড়তে শুরু করলেন৷ তাঁর চাপরাশ বাজপাখির মতো ধেয়ে কালো ঘুড়ির দিকে৷ তাকে পালাবার কোনো সুযোগ না দিয়ে প্যাঁচ লাগিয়ে লাটাইতে একটা হ্যাঁচকা টান দিলেন তিনি৷ কেটে গেল খাঁদু মল্লিকের কালো ঘুড়ি৷ আশপাশ থেকে শোরগোল শোনা গেল, ‘ভোঁকাটটা৷ অর্থাৎ আড়াল থেকে এ লড়াই অনেকেই এতক্ষণ দেখছিল৷ ধীরেসুস্থে তাঁর চাপরাশটাকে নীচে নামালেন৷ ঠিক এই সময় ঝুপ করে সন্ধ্যা নামল৷

ছাদের ওপর চিৎ হয়ে পড়ে আছে খাঁদু মল্লিক৷ তার চোখ বন্ধ৷ মুখ দিয়ে একটা গোঁ-গোঁ শব্দ বেরোচ্ছে, ঠোঁটের কষ বেয়ে চুঁইয়ে পড়ছে গ্যাঁজলা৷ প্রচণ্ড আতঙ্কে বাহ্যজ্ঞান লোপ পেয়েছে খাঁদু মল্লিকের৷ মাটিতে পড়ে থাকা খাঁদু মল্লিকের সামনে দাঁড়িয়ে ফটিকবাবু আর অবিনাশবাবু৷ অবিনাশবাবুর মুখে স্পষ্ট হাসির রেখা, তিনি তাকিয়ে আছেন মাটিতে পড়ে থাকা খাঁদু মল্লিকের দিকে৷ হতবাক ফটিকবাবু অবিনাশবাবুর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘ব্যাপারটা কী? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না?’

অবিনাশবাবু বললেন, ‘ও ছাদে উঠেছিল আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বাজিটা জেতার জন্য৷ ও এ তল্লাটের নামকরা গুণ্ডা৷ শেষ ঘুড়িটা ওর কোনো স্যাঙাতের হাতে দিয়ে এখানে এসেছিল৷ তারপর আমাকে দেখে…৷’

‘আপনাকে দেখে ওর এ অবস্থা হল কেন?’

অবিনাশবাবু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ঘুড়ির লাটাই ফটিকবাবুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘পাঁচবছর আগে এই বিশ্বকর্মা পুজোর বিকেলে এই ঘুড়িটা দিয়েই ওর সঙ্গে শেষ লড়াই হওয়ার কথা ছিল আমার৷ ওর বাজির ফাঁদে পড়ে গেছিলাম আমি৷ বিশ হাজার টাকা বাজি৷ একইরকম বিকাল, একই ঘটনা৷ প্রথমে আমি ওর ঘুড়ি কাটলাম, তারপর ও আমার৷ ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আমি যখন এই দ্বিতীয় ঘুড়িতে সুতো বাঁধতে যাচ্ছি তখন পিছন থেকে ছাদে উঠে এসেছিল খাঁদু মল্লিক৷ আমি ওর উপস্থিতি টের পাইনি৷ আর তারপর…৷ থেমে গেলেন অবিনাশবাবু৷

‘তারপর কী? তারপর কী?’ ব্যাগ্র ভাবে জানতে চাইলেন ফটিকবাবু৷

ফটিকবাবুর চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে অবিনাশবাবু বললেন, ‘তারপর আবার কী? এই গুণ্ডা খাঁদু মল্লিক আমাকে পিছন থেকে ধাক্কা মেরে চারতলার ছাদ থেকে নীচে ফেলে দিল৷ ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে ছাদের কার্নিশ থেকে পা পিছলে দুর্ঘটনায় কারো মৃত্যু অস্বাভাবিক নয়৷ এই ছাদ থেকে একটা ঘুড়ি উড়ল৷ তার কোনো স্যাঙাত কালো ঘুড়ি দিয়ে সেটা কাটল৷ সবাই দেখল বাজি জিতেছে খাঁদু মল্লিক৷’

তার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফটিকবাবু নিজের মনেই একবার বললেন, ‘চার তলার ছাদ থেকে নীচে ফেলে দিয়েছিল৷’

আর এর পরই ফটিকবাবুর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল, কেন খুনে গুণ্ডা খাঁদু মল্লিকের মতো লোকও ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল৷ ব্যাপারটা বুঝে উঠতেই একটা হিমেল স্রোত যেন ফটিকবাবুর পিঠ বেয়ে নামতে শুরু করল৷ তার সামনে এ কে দাঁড়িয়ে আছে? ফটিকবাবুর হাত থেকে ঘুড়ি লাটাই খসে পড়ল৷ স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি৷ অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে৷ এবার যেন কেমন একটা অস্পষ্ট মনে হচ্ছে অবিনাশবাবুর অবয়বটা৷ ফটিকবাবুর উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, ‘ঘুড়িটা আপনি ভালো ওড়ান ঠিকই৷ কিন্তু খোলা ছাদে একটু সাবধানে ওড়াবেন৷’ এই বলে ধীরে ধীরে অবিনাশবাবু অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *