উপন্যাস
গল্প

কালো গোলাপ

কালো গোলাপ

শেষরাত থেকে টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে একটানা। জানালার ভারী পরদাটা টেনে দিয়ে টেবল-ল্যাম্প জ্বেলে বিকাশ মিত্র একটা বই নিয়ে টেবিলের ধারে বসে ছিলেন। সামনে ধূমায়মান চায়ের কাপ। হাতে পাইপ। মাঝে মাঝে মুখ তুলে পরদার ফাঁক দিয়ে বাইরের দুর্যোগের চেহারাটা দেখবার চেষ্টা করছিলেন।

হঠাৎ দরজায় খুটখুট শব্দ।

বিকাশ মিত্র ফিরে চাইলেন, কে?

সন্তর্পণে দরজা ঠেলে প্রৌঢ় ভৃত্য রাইচরণ ঘরে ঢুকল।

বাবু, একটি মেয়েছেলে দেখা করতে চান।

মেয়েছেলে? বিকাশ মিত্র ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন। তাঁর কাছে লোক আসার একটি অর্থই হয়। ঘোরতর বিপদে পড়েছে, সাহায্যের প্রয়োজন। তা না হলে গল্পগুজব করতে কে আসবে শহরের বিখ্যাত শখের গোয়েন্দা বিকাশ মিত্রর কাছে।

ওপরে নিয়ে এসো। আদেশ দিয়ে বিকাশ মিত্র বইটা সরিয়ে চেয়ার ঘুরিয়ে বসলেন।

একটি সুশ্রী তরুণ ঘরের মধ্যে ঢুকল। পরনের শাড়ি-জামা বেশ ভিজে গিয়েছে। মাথার চুলেও ফোঁটা ফোঁটা জল।

কী ব্যাপার? পাইপে টান দিয়ে বিকাশ মিত্র গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন।

প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে তরুণী আঁচল মুখে দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, তারপর একটু সামলে নিয়ে বলল, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে!

বিকাশ মিত্র কোনও কথা বললেন না। দুটি চোখ কুঁচকে তরুণীর আপাদমস্তক দেখতে লাগলেন। সেই তীক্ষ্ন দৃষ্টির সামনে মেয়েটি যেন আরও সংকুচিত হয়ে পড়ল।

অনেকক্ষণ পরে বিকাশ মিত্র একটু ঝুঁকে পড়ে বললেন, সবকিছু খুলে বলুন।

তরুণী খুব মৃদু গলায় বলল, আমার বাবা আজ ভোরে মারা গেছেন।

মারা গেছেন? গম্ভীর গলায় বিকাশ মিত্র প্রশ্ন করলেন।

মেয়েটি একটু বিব্রত হয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে বলল, মারা গেছেন মানে সম্ভবত কেউ মেরে ফেলেছে তাঁকে।

বিকাশ মিত্র আড়চোখে একবার দেয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে দেখলেন। প্রায় ন-টা বাজে। তারপরে চেয়ারে হেলান দিয়ে দুটো চোখ বন্ধ করে বললেন, সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলুন। কোনও কথা চাপবার চেষ্টা করবেন না।

মেয়েটি অল্প কেশে গলাটা একটু ঠিক করে নিল, তারপর খুব আস্তে আস্তে বলতে শুরু করল।

রোজকার মতন আজকে ভোরেও বাবাকে ডাকতে গিয়েছিলাম। ঘরের পরদাটা সরিয়ে দেখলাম বাবা টেবিলের ওপর মাথা দিয়ে বসে আছেন। সামনে একটা বই খোলা। বই পড়া বাবার একটা বহু পুরোনো নেশা, বাতিকও বলতে পারেন। প্রায়ই ভোররাতে উঠে পড়াশোনা করতেন। মা মারা যাবার পর থেকে এ অভ্যাসটা আরও যেন বেড়ে উঠেছিল। কাছে গিয়ে ডাকলাম। কোনও সাড়া নেই। ভাবলাম ঘুমিয়ে পড়েছেন। আরও কাছে গিয়ে অল্প ধাক্কা দিতেই—

কথাটা শেষ হবার আগেই মেয়েটি কেঁদে উঠল। সমস্ত ঘটনা ছবির মতন ভেসে উঠল মেয়েটির সামনে।

খুব শান্ত গলায় বিকাশ মিত্র জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার নামটা কী জানতে পারি?

কান্না-ভেজা গলায় মেয়েটি বলল, মিনতি, মিনতি রায়।

চেয়ারের হাতলে পাইপটা ঠুকে ছাইগুলো ফেলতে ফেলতে বিকাশ মিত্র সান্ত্বনার সুরে বললেন, কেঁদে আর কী লাভ বলুন মিনতিদেবী। কাঁদলে কি আর মরা মানুষ ফিরে আসে? তার চেয়ে সবকিছু খুলে বলুন, দেখি কতদূর কী কিনারা করতে পারি।

মিনতি আঁচল দিয়ে চোখ দুটো মুছে নিয়ে ধরা গলায় বলতে আরম্ভ করল, একটু ধাক্কা দিতেই বাবা হেলে পড়লেন। শরীর বরফের মতন ঠান্ডা। নাকের দুটো পাশ লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। সামনে একটা কাগজ। তার ওপরে পেনসিল দিয়ে শুধু একটি অক্ষর লেখা— ‘চ’।

বিকাশ মিত্র বাধা দিলেন, মাপ করবেন, হাতের লেখাটা কার?

মিনতি বলল, বাবারই হাতের লেখা, একটু দূরে টেবিলের ওপর একটা কালো রঙের গোলাপ ফুল। আমাদের বাগানে ও ফুলের গাছ নেই। এ ফুলটা কোথা থেকে এল বুঝতে পারছি না। তখনই আমাদের বাড়ির ডাক্তার সেনকে ফোন করে দিলাম। তিনি এসে পরীক্ষা করে বললেন, ঘণ্টা দুয়েক আগে সব শেষ হয়ে গেছে। কীসে মৃত্যু হয়েছে সে কথাটা তিনি পোস্টমর্টেম না হলে বলতে পারবেন না। তারপরই আপনার কথা মনে হল। মনীষাদির জড়োয়া নেকলেসটা আপনিই উদ্ধার করেছিলেন। একবার ভাবলাম আপনাকে ফোন করি, তারপর একেবারে সোজা চলেই এলাম আপনার কাছে।

বিকাশ মিত্র কিছুক্ষণ ভাবলেন, তারপর বললেন, পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে?

হ্যাঁ, ডাক্তার সেনই থানায় ফোন করে দিয়েছেন। মিনতি খুব আস্তে বলল।

পুলিশ এসেছে?

না, আসেনি। অন্তত আমি বেরোবার সময় পর্যন্ত তো নয়।

বিকাশ মিত্র দাঁড়িয়ে উঠলেন। হাত বাড়িয়ে কোটটা টেনে নিতে নিতে বললেন, পুলিশ আসবার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের গিয়ে পৌঁছাতে হবে, নয়তো ওদের খানাতল্লাশির পর আমাদের দেখবার মতন আর কিছু থাকবে না।

বাড়িতে পা দিতেই মিনতি চমকে উঠল। সামনে পুলিশের ভিড়। ভীষণ গোলমাল। পাড়া-প্রতিবেশীও অনেকে এসে জুটেছে।

একটু এগিয়ে গিয়েই মিনতি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। বহুদিনের পুরোনো চাকর চন্দ্রনাথকে পিছমোড়া করে বাঁধা হয়েছে।

মিনতিকে দেখেই চন্দ্রনাথ হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, দেখুন দিদিমণি, আমার অবস্থা! আমি নাকি বাবুকে—কথা শেষ হবার আগেই চোখের জলে বুড়োর দুটো গাল ভেসে গেল।

সে আর-একবার কথা বলার চেষ্টা করতেই ইনস্পেকটর সায়েব ধমক দিয়ে উঠলেন, চোপরাও, খুনে কোথাকার! তোমার হয়েছে কী, ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হবে সে খেয়াল আছে?

এবার বিকাশ মিত্র এগিয়ে এলেন, কী ব্যাপার মিস্টার নাগ, আসামিকে পাকড়াও করেছেন নাকি?

বিকাশ মিত্রকে দেখে মিস্টার নাগ সসম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে উঠলেন, তারপর বললেন, হ্যাঁ, স্যার, আর-একটু দেরি হলেই ঝানু বুড়ো কেটে পড়ত। খুব সময়ে এসে পড়েছি।

প্রমাণ পেয়েছেন এর বিরুদ্ধে?

প্রমাণ? রায়বাহাদুর নিজে এর নাম লিখে গেছেন। এই দেখুন-না কাগজটা।

সঙ্গে সঙ্গে ইনস্পেকটর নাগ একটা কাগজ বিকাশ মিত্রর সামনে ধরলেন।

বিকাশ মিত্র কাগজটার ওপর আলগোছে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, চলুন, ঘরের মধ্যেটা একবার দেখে আসি।

ছোট্ট ঘর। একপাশে একটি টেবিল, খান দুয়েক চেয়ার, একটি নাতিদীর্ঘ খাট। ঘরে জানালা দুটি। একটি দরজা, সেটি ভিতরের দিকে। সেই দরজা দিয়ে বাইরে যাবার কোনও উপায় নেই। কেবল পাশে মিনতির ঘরে যাওয়া চলে। মিনতির ঘরটিও ছোটো। আসবাবপত্র বেশি নেই।

বিকাশ মিত্র ঘরের মাঝখানে একটা চেয়ারে বসে বললেন, কিন্তু একটা কথা মিস্টার নাগ, আপনার আসামি রায়বাহাদুরের ঘরে ঢুকল কী করে?

ইনস্পেকটর নাগের মুখে বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠল। ভাবটা যেন শখের গোয়েন্দা আর সরকারি পুলিশে আকাশ-পাতাল প্রভেদ। মুখে বললেন, ঘরের মধ্যে ঢুকেছে এ কথা আপনাকে কে বললে?

মানে? বিকাশ মিত্র একটু আশ্চর্য হয়ে গেলেন।

ঢোকেনি, আগে থেকেই ঢুকে বসে ছিল। কাল সন্ধ্যা থেকে কিংবা রাত থেকে খাটের তলায় লুকিয়ে ছিল।

ও, তাহলে বেরোল কোথা দিয়ে?

মিনতিদেবী যখন এ ঘরে ঢুকলেন তখন ঘরে কোনও লোক ছিল না, আর মিনতিদেবীর ঘরের দরজাও ভিতর থেকেই বন্ধ ছিল। তা-ই না?

মিনতি ঘাড় নাড়ল।

তা ছাড়া, এত নিচু খাটের তলায় লোক ঢুকবেই বা কী করে। আধুনিক ডিজাইনের খাটের এই একটা মস্ত সুবিধা।

ইনস্পেকটর নাগের মুখটা একটু যেন বোকা-বোকা দেখাল। তারপরই তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ওসব ভেবে আর লাভ কী? বদমাইশের অসাধ্য কাজ দুনিয়ায় কিছু আছে নাকি! সবচেয়ে বড়ো কথা, রায়বাহাদুর নিজের হাতে ‘চ’ অক্ষর লিখে গেছেন। ‘চ’ মানেই চন্দ্রনাথ, এ তো একটা শিশুও বুঝতে পারে। পুরোনো চাকরগুলোই তো শয়তান। আমার বিশ বছরের পুলিশের চাকরিতে এই ধরনের কম কেস ঘাঁটলাম! হুঁ!

বিকাশ মিত্র কোনও উত্তর দিলেন না। ইতিমধ্যেই তিনি তন্ন তন্ন করে ঘরটা পরীক্ষা করতে শুরু করেছিলেন। ঘরের মেঝের ওপর চোখ বোলাতে বোলাতে তিনি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে নিচু হয়ে সবুজ রঙের রেশমি সুতোর টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে রাখলেন। টেবিলের ওপর থেকে কালো গোলাপটা রুমালে জড়িয়ে তিনি আগেই তুলে নিয়েছিলেন।

চৌকাঠ পার হয়ে মিনতির সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, একবার হাসপাতালের দিকে যাচ্ছি। মর্গেও যাব আর পোস্টমর্টেম রিপোর্টটাও জোগাড় করতে হবে। নমস্কার।

তারপর সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ইনস্পেকটর নাগের দিকে ফিরে বললেন, চলি মিস্টার নাগ। একটা কথা, ‘চ’-এর জন্য যদি চন্দ্রনাথকে গ্রেপ্তার করা হয়ে থাকে, তাহলে তো আপনাদের বড়োকর্তা চণ্ডীবাবুকেও হাতকড়ি লাগানো উচিত, কী বলেন?

মাসখানেক পরের কথা।

দুটি চেয়ারে মুখোমুখি বসে বিকাশ মিত্র আর মিনতি রায়।

হঠাৎ একটু দাঁড়িয়ে বিকাশ মিত্র বললেন, আপনি বোধহয় একটু আশ্চর্যই হয়ে গেছেন মিনতিদেবী। এত শীঘ্র যে কেসটার কিনারা হবে, আমিও ভাবিনি।

মিনতি বলল, কেসটার সম্বন্ধে জানবার জন্য আমি খুবই উদগ্রীব হয়ে রয়েছি মিস্টার মিত্র।

বিকাশ মিত্র চেয়ারে বসে পাইপে বার দুয়েক টান দিয়ে বললেন, শুনুন তাহলে।

আপনার ঘরটা দেখেই বুঝতে পারলাম যে বাইরে থেকে কেউ ভিতরে আসেনি। এলে অন্তত আপনি জানতে পারতেন। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ থাকায় কেউ যে ঘরে ঢুকে আবার বেরিয়ে গেছে, এও সম্ভব নয়। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে দেখলাম যে তীব্র বিষে আপনার বাবার মৃত্যু হয়েছে। কালো গোলাপটি পরীক্ষা করে জানলাম যে গোলাপে বিষ মাখানো ছিল। সে বিষ যে কত তীব্র তা আপনি ধারণাও করতে পারবেন না। শুধু শুঁকলেই, দু-সেকেন্ডের মধ্যে যে-কোনও জোয়ান লোকের মৃত্যু হতে পারে। এ পর্যন্ত সবই ঠিক হল, কিন্তু এই বিষ-মাখানো গোলাপ এল কোথা থেকে? আপনার বাবা কাগজে ‘চ’ লিখে গেছেন বলেই বাড়ির পুরোনো চাকর চন্দ্রনাথকে গ্রেপ্তার করা হবে এ ধারণাটা এত মামুলি যে এতে আমি মোটেই আমল দিইনি। শুধু শুধু একটা মানুষ আর-একটা মানুষের মৃত্যু ঘটায় না। তার একটা কারণ থাকে। খোঁজ করে জানলাম, আপনার বাবার কোনও শত্রু ছিল না। ব্যাপারটা একটু ঘোরালো বলেই মনে হল। আপনি প্রথম যেদিন আমার কাছে এলেন, সেদিন লক্ষ করলাম আপনার দু-হাতে পাঁচটি আংটি আর প্রত্যেক আংটিতেই খুব দামি পাথর বসানো। আজকালকার কম অলংকারের যুগে এটা অস্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছিল। আপনার বাবার আঙুলেও, রিপোর্টে দেখলাম, অনেকগুলো দামি পাথর-বসানো আংটি ছিল। আপনাদের ঘরের আলমারির মধ্যে কাঠের একটা হরিণের চোখেও দেখলাম মূল্যবান পাথর। দামি পাথরের যেন ছড়াছড়ি বলেই মনে হল। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম আপনার বাবার দামি পাথর কেনার খুব বাতিক ছিল। এজন্য উনি একবার বর্মা দেশেও পাড়ি দিয়েছিলেন। যে আপনার বাবাকে মেরেছে সে একটিও দামি পাথর সরায়নি। কাজেই বোঝা যাচ্ছে পাথর চুরি করা তার উদ্দেশ্য ছিল না। কিংবা পাথর সরাবার সুযোগ সে পায়নি। মানুষকে হত্যা করার সাধারণত দুটি উদ্দেশ্য থাকে, একটি লোভ আর একটি প্রতিহিংসা।

আপনাদের বুড়ো চাকর চন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ করে জানলাম যে মংপু বলে একটা বর্মি মাঝে মাঝে আপনার বাবার কাছে আসত। আপনার বাবা মারা যাবার দিনকয়েক আগে আপনাদের বাড়ির পিছনে খালি জমিতে মংপুর থাকার জন্য একটি চালাঘরও তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন। আপনারা জানতেন যে মংপু আপনার বাবার বাতের জন্য বাঘের চর্বি নিয়ে আসত, কিন্তু আসল ব্যাপার তা নয়।

কী তাহলে আসল ব্যাপার? উদবিগ্ন গলায় মিনতি জিজ্ঞাসা করল।

পাইপটা নিভে গিয়েছিল। বিকাশ মিত্র দেশলাই জ্বালিয়ে সেটা ধরিয়ে নিলেন, তারপর বললেন, আসল ব্যাপার, মংপু দামি পাথরের ব্যাবসা করত। মংপুর সঙ্গে ভাব জমাতে বেশি দেরি হল না। সে তো আপনিও দেখেছেন, কতদিন ওর চালাঘরের দাওয়ায় বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি। বেশ কয়েক ভাঁড় তাড়ির বদলে মংপুর মনের অনেক গোপন কথা জানতে পেরেছি। সে খুব ভালো সাপের খেলা দেখাতে পারত। তার চালাঘরের কোণে বেতের ঝাঁপি-চাপা অনেক রকমের সাপ ছিল। আপনার বাবার সঙ্গে মংপুর আলাপ হয়েছিল বর্মা দেশের মেমিও শহরে। পাহাড় থেকে মংপু অনেকগুলো পাথর সংগ্রহ করেছিল। তখন সে ওগুলোর দাম সম্বন্ধে কিছুই জানত না। আপনার বাবা মংপুকে বুঝিয়েছিলেন ওসব ঝুটো পাথর। নামমাত্র দামে তার কাছ থেকে ওসব কিনে নিয়েছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই মংপু আসল ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল। কতকগুলো পাথর তার নিজের কাছে ছিল, সেগুলো সে এক জহুরির কাছে নিয়ে যেতে ঠিক দাম জানতে পারে। বর্মিরা ভীষণ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়। আপনার বাবার ঠিকানা তার কাছে ছিল। আপনার বাবাই দিয়েছিলেন। যদি ভালো পাথর আরও জোগাড় করতে পারে তাহলে তাঁকে যাতে পাঠিয়ে দিতে পারে।

সুদূর বর্মা থেকে মংপু বাংলা দেশে এসেছিল। আপনার বাবার সঙ্গে দেখা করে আগের পাথরগুলোর ন্যায্য দাম চেয়েছিল।

আপনার বাবা বোধহয় তাকে মিষ্টি কথায় ভোলাতে চেয়েছিলেন। তাকে ঠান্ডা করার জন্য নিজের জমিতে চালাঘরও তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু বর্মি জাতকে তিনি ঠিক বুঝতে পারেননি। প্রতিহিংসা নেবার জন্য এরা বছরের পর বছর অপেক্ষা করে।

একদিন মংপু সুযোগ পেল এবং সহজেই কাজ শেষ করল।

কিন্তু বন্ধ ঘরে সে ঢুকল কেমন করে?

বিকাশ মিত্র মুচকি হাসলেন, ঘরে সে ঢোকেনি। কোনও মানুষই ঢোকেনি সে ঘরে।

তবে?

আপনার বাবা কোনও মানুষের হাতে মারা যাননি।

সে কী? আশঙ্কায় মিনতির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল।

পরের ব্যাপারটা অবশ্য আমাকেই অনুসন্ধান করে বার করতে হয়েছে। মংপুর কাছ থেকে আর কিছুই জানা যায়নি। আমি দেখলাম ঘরের দরজা-জানলা সব যদি বন্ধ থাকে, তবে একমাত্র আসার পথ ভেন্টিলেটার দিয়ে। কিন্তু সেখান দিয়ে মানুষের আসা সম্ভব নয়। একমাত্র আসতে পারে সরীসৃপজাতীয় কিছু। যে সাপগুলো মংপুর ঘরে ছিল, সেগুলো সবই বিষদাঁত ভাঙা, নয়তো তাদের নিয়ে খেলা করা মংপুর পক্ষে সম্ভব হত না। কিন্তু রেশমি সুতো দিয়ে সাপের শরীরের সঙ্গে বিষ-মাখানো কালো গোলাপ বেঁধে দিয়ে অনায়াসেই সেটাকে ভেন্টিলেটার দিয়ে ঘরের মধ্যে চালান দেওয়া যায়। এই কালো গোলাপ মেমিওর পাহাড় অঞ্চলে ফোটে এবং বহুদিন অবিকৃত অবস্থায় থাকে। মংপুকে সন্দেহ করার এও আমার একটা কারণ। মংপু এটা বেশ জানত, একবার কালো গোলাপটি ঘরের মধ্যে ফেলতে পারলে, কৌতূহলবশত আপনার বাবার পক্ষে ফুলটি তুলে নিয়ে শুঁকতে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। কিন্তু আপনার বাবা সাপটাকেও দেখতে পেয়েছিলেন, সম্ভবত ফুলটা শোঁকার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। সেইজন্য হাতের কাগজ পেয়ে শেষ মুহূর্তে লিখতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তীব্র বিষের প্রকোপে একটি অক্ষর লিখেই মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েছিলেন।

বাবা শুধু লিখেছিলেন ‘চ’। মিনতি অস্ফুটকণ্ঠে বলল।

হ্যাঁ, সাপটার নাম লিখতে যাচ্ছিলেন। চন্দ্রবোড়া সাপ। মংপু নিজের সম্বন্ধে এত নিশ্চিন্ত ছিল যে সে কোথাও পালিয়ে যাবার চেষ্টা পর্যন্ত করেনি। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও পাপীরা কিছুতেই নিজেদের নাশকতা লুকোতে পারে না। কেমন করে দু-একটা চিহ্ন পিছনে ফেলে রেখে যায়। এই কালো গোলাপ আর রেশমি সুতোই মংপুকে গারদে পাঠাল। কথাটা বলে নিজের হাতঘড়ির দিকে নজর পড়তেই বিকাশ মিত্র দাঁড়িয়ে উঠলেন। রাত আটটা বাজে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বিকাশ মিত্র হাসলেন। একদিন বরং নিমন্ত্রণ খাইয়ে দিন। আচ্ছা আসি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *