কালিম্পঙের স্মৃতি
কালিম্পঙের কথা এত শুনেছি, কিন্তু কেউ আমাকে কখনো কেন বলেনি যে এই একটা, একমাত্র শহর যেখানে যেতে গেলে ডান দিকে, শিলিগুড়ি থেকে ৩৫ মাইল জুড়ে, এবং ২০০, ৫০০ কখনও দুই কি চার হাজার ফিট নিচে, যখন যা, সারাটা পথ জুড়ে একটা গর্জনকারী নদী আমাদের বিপরীত দিকে একরোখা বয়ে যাবে, যার নাম তিস্তা? এবার ট্যুরিস্ট অফিস থেকে যে সব চটি বইপত্র বাবা এনেছিলেন, তাতে দূরবীন পাহাড়, অর্কিড হাউস, লাভা, লোলেগাঁও, বৌদ্ধ গুম্ভা—সবই ছিল, শুধু এই নদীটির কথা ছিল না।
মা বেঁচে থাকতে আমরা তিনজনে যথেষ্ট ঘুরেছি। সত্যি কথা বলতে কি, আমি যখন মার পেটে, মাত্র মাস তিনেকের, সবে প্লাসেন্টা ফর্ম করেছে আর কি, ঘোরাঘুরির তখন থেকেই শুরু। তখনই আমরা নাকি তাকদায়। তাকদা? কেউ কেউ বলতে পারেন, তাকদায় কেন, দার্জিলিং ত কাছেই। কেন দার্জিলিং নয়? যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন। আসলে, ট্যুরিস্ট ব্যুরোর কাগুজে বিজ্ঞাপনে থাকে এমন জায়গায়, যেমন পুরীটুরি, বাবা আমাদের কখনও নিয়ে যাননি। বাবা ছোট ছোট কাগজের ওপর সাইক্লো-করা যত রাজ্যের ম্যাপট্যাপ জোগাড় করে আনতেন, অধিকাংশই ছেঁড়াফোঁড়া। রানিক্ষেতে না থেকে আমরা তাই থেকেছি ৩০-৫০ মাইল দূরে জনহীন বিনসরে, দেরাদুন থেকে যাবার কথা ছিল মুসৌরী, গেলাম চাকরাতায়। তখন সন্ধেবেলা। কেউ কোতথাও নেই। ভাগ্যিস স্টেশন মাস্টার ছিলেন বাঙালি, উমেশবাবু, কী দুর্দশাই হত তা না হলে!
রানিক্ষেতে গিয়ে কচুপোড়া হোগা কেয়া? ফুটপাতে কেনা বই-এর ধুলো ঝেড়ে, হিন্দি ছেড়ে বীরভূমী ডায়ালেকট নকল করার চেষ্টা করে বাবা দেখাতেন, ‘দ্যাখো ক্যানে,’ এই শাহবটো কী বলছে। শাহেবটো বলছো কি, ‘বিনসর ইজ দ্য কোয়ায়েটেস্ট প্লেস ইন দা ওয়ার্ল্ড—আই হ্যাভ সিন।’
‘থাকব কোথায়?’ মা জানতে চাইছেন প্রশ্রয়ের হাসি হেসে।
‘থাক্যি ত ইখানে। থাইকব না বুলেই ত হুইখানডায় যাচ্ছি গ।’
তাই পুরী নয়, আমরা থেকেছি কাঁকিনাড়া থেকে অদূরে, গোদাবরি মোহনায়, কুমারী সমুদ্রবীচে। নাম নরসিংপুরম।
ডাক্তার হয়েও বাবা যে বারবার হুড-খোলা পুরু সোলের চপ্পল পরেন এর মধ্যেও তাঁর একটি চরিত্র-সূত্র পাওয়া যাবে। চেয়ারে বসে কোমর ভেঙে ওই সব ফিতে-টিতে বাঁধার মধ্যে আমার বাপি কোনোদিন নেই। বাবা বলতেন, ‘আধা মাঘে, কম্বল কাঁধে।’ বেড়াবার জন্যে ওঁর ফেভারিট ঋতু ছিল বসন্ত। চপ্পল গলাও আর বেরিয়ে পড়ো। তা সে ‘কল’-এই হোক বা ট্রেন ধরার জন্যেই হোক।
‘যখন কলেজে ঢুকি তখন ত চপ্পলও ছিল না রে। পায়ের চেটোয় পুরু করে লাগোনো থাকত সর্ষে, এই এমনি করে বেরিয়ে পড়তুম।’ বলে বাবা যখন মেঝেয় দুবার পা ঘষে দেখাতেন, তখন মনে হত ঢালু বরফ-উপত্যকার মাথায় বুঝি দাঁড়িয়ে একজন একা মানুষ, যার পায়ে স্কী। চুলে বরফ।
স্কুলে আমি কখনও ভাল রেজাল্ট করতে পারিনি, সে ওই বাপির জন্যে। বাঁ হাতে আমাকে, আর ডান হাতে মাকে ঝুলিয়ে ওই ‘অমনি’ করে বারবার বেরিয়ে পড়ার জন্যে। মাত্র সপ্তাহখানেকও বাকি নেই এমন অসময়ে, বেড়িয়ে ফিরে, কতবারপরীক্ষার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে আমাকে বলেছেন—’যাঃ!’
এদিক থেকে কালিম্পঙের মতো খোদ ট্যুরিস্ট শহরে বাবার সঙ্গে এই প্রথম। এই প্রথম মা সঙ্গে নেই। মা মারা যাবার পর একটানা আট বছর চুপচাপ। তারপর এই প্রথম এ রকম।
গত আট বছরে অবশ্য বাবা অনেক পালটে গেছেন। আমার সেই বাপি আর নেই যাকে ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় বাথরুম থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে হাসতে হাসতে আমি নাকি বলেছিলাম, ‘বাপ্পি, আমার হিসির সঙ্গে রক্ত বেরুচ্ছে’ অত তাড়াতাড়ি হবে মা হয়ত ভাবতেও পারেননি, তাই তখনও ও বিষয়ে কিছু বলেননি। আর আমি যে কিছুই জানতাম না, সে ত বোঝাই যাচ্ছে, ‘নিজের’ লিখে খুব ভাল লাগল। জীবনে ওই একটি জিনিস, যা ছিল আমার নিজের। আমার বাবা। বাপ্পি!
শুনে বাবা নাকি হো হো করে হেসে উঠেছিলেন। আমার বয়কাট চুল একটু নাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ও কিছু না, যাও গিয়ে মাকে বলো।’
মা নয়, মাসি নয়, এ সবই আমার বাবার কাছে শোনা। আমি পরে ভেবেছি, কিছুই যদি জানতাম না, তবে হাসতে হাসতে ও কথা বাবাকেই বলেছিলাম কেন। কত প্রিকসাস চাইল্ড ছিলাম, অত ছোটবেলাতেই, আজ বুঝতে পারি।
মা মারা যাবার পর, পীরিয়ডের গড়িমসির ব্যাপারে যদিও বাবার সঙ্গে এখনো ডিসকাস করতে হয়নি, তবে ওই সময় অ্যানাসিন না থাকলে বাবার কাছেই আজও চেয়ে নিয়ে থাকি, বা চাইতে লজ্জা হয় না। ‘আজ পায়খানা কেমন হয়েছে’—এর উত্তর এই ধেড়ে বয়সেও বাবাকে দিতে হয়।
এখানে ‘পায়খানা’ শব্দটি ব্যবহার করতে একটু লজ্জাই হল আমার। যদিও আমার বাবামায়ের প্রণয়পর্বের সূচনায় এই শব্দটির ছিল অত্যন্ত প্রধান ভূমিকা, প্রায় ম্যাচমেকার-এর। হয়েছিল কি, এম-ডি হয়ে বেরুবার পরে-পরেই, একদিন আউট-ডোরে বাবা মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। স্ট্রোকই, কিন্তু মাথায় আর অত অল্প বয়সে। জ্ঞান হল নিজেরই হাসপাতালে, লিউকিস ওয়ার্ডের কেবিনে। বাঁ হাত আর বাঁ পায়ে পার্শিয়াল প্যারালিসিস। একজন ট্রেনি নার্স গায়ত্রী চক্রবর্তী প্রথম দিন সকালে বাবার বেডের সামনে এসে দাঁড়ায় আর বেড থেকে টিকিটটা খুলে কলম হাতে রুটিন মাফিক জানতে চায়, ‘ডাঃ সোম, রাতে ঘুম হয়েছিল?’
বাবা (মুখে থার্মোমিটার)—’আঁ।’
তারপর অনেকগুলো রুটিন প্রশ্ন। এবং সবশেষে…
‘ডাঃ সোম?’
‘আঁ।’
‘পায়খানা হয়েছিল?’
উত্তর নেই।
‘ডাঃ! সোম?’
‘আঁ।’
‘পায়খানা হয়েছিল?’
তিন-তিনবার আমার বাবা এই প্রশ্নের উত্তর দেননি। তিনদিন দেননি। তারপর আর মা কোনোদিন ওই প্রশ্ন করেননি। বাবার মতে কোনো সুন্দরী যুবতীর মুখে এই প্রশ্ন মানায় না। কোনো নারীকে ও রকম প্রশ্নের উত্তর জানানো পুরুষোচিত নয়।
বাবা-মায়ের বিয়ের গল্পটাও এখানেই বলে নিই। আমার বাবা-মার আসল বিয়ে হয়েছিল লিউকিস ওয়ার্ডে ওই ২১৬ নম্বর কেবিনে। হয়েছিল কী, সন্ধেবেলা মা আর একদিন এসেছেন বাবাকে ইনজেকশন দিতে, তখন মায়ের ট্রেনিং পিরিয়ড চলছে আগেই বলেছি, বয়স ২০, আর বাবার কতই বা ৩০-৩১ হবে। দু’জনেরই কম বয়স হলেও অবশ্য ব্যবধান অনেকটাই।
ইন্ট্রাভেনাস ইনজেকশন, কিন্তু কী কাণ্ড! মা ঢুকিয়ে দিয়েছেন সিধে বাবার মাসল-এ। হেন অবিমৃশ্যকারিতা একজন এম-ডি’র পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হয়নি। নিডল-এ রক্ত দেখে মা তাড়াতাড়ি ‘ওমমা’ বলে সিরিঞ্জ তুলে নেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে ‘ইউ বীচ, ইউ ডু নট নো হাউ টু পুশ এ নিডল ইনটু দা ভেইন?’ এই বলে বাবা নার্স গায়ত্রী চক্রবর্তীর গালে সপাটে একটি থাপ্পড় মারেন।
এই গল্পটা কিন্তু মা-ই আমাকে বলেছিলেন। অত স্বামী-গরবিনী তাঁকে আর কখনও দেখিনি যখন মুসৌরির পথে, ট্রেনে, মা তাঁর এই ‘আসল’ বিয়ের গল্পটি আমাকে বলেন। না না, মুসৌরি ত নয়, চাকরাতা। মুসৌরি আমরা কখনও যাইনি।
বেডের পাশে দাঁড়িয়ে মা কাঁপছেন থরথর করে, থাপ্পড়ে লাল গাল বেয়ে গড়িয়ে আসছে অশ্রু, কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে মুখময় ফুটে রয়েছে একরাশ বিস্ময়—এই দৃশ্য কল্পনা করতে আমার কখনও অসুবিধা হয় না। অবিশ্বাস্যকে স্বচক্ষে দেখে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়ে ঠিক যেমনটা হবার কথা আর কি।
অবাক কেন, হতবুদ্ধিকর ব্যাপারই ত। আসলে বাবা চড় মেরেছেন বাঁ হাত দিয়ে আর বাঁ-দিকটাতেই ত হয়েছিল প্যারালিসিস। বিজ্ঞানে যার ব্যাখ্যা নেই, সেই অবিশ্বাস্যকে চোখের সামনে ঘটতে দেখে মানুষ অবাক হবে না? তাই কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ‘ডাঃ সোম, এবার আপনি বাঁ পা তুলে আমাকে একটা লাথি মারুন।’
বলা বাহুল্য, লাথি আর মারতে হয়নি। সাতদিন ধরে ওষুধ ইনজেকশনের গুণেই হোক বা মার ওপর ওই ফেটে-পড়া রাগের চোটেই হোক, বাবার বা পা-টিও তখন রোগমুক্ত।
২ মার্চে ১৯৬২। ১৮ ফাল্গুন। তখন সন্ধেবেলা। মাসল থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসা বাবার রক্তে মা-র অ্যাপ্রন বেশ খানিকটা ভিজে গেছে। মেডিকেল কলেজের লিউকিস ওয়ার্ডের ২১৬নং কেবিনে সেদিন গোধূলি লগ্নে বাবার নগ্ন হাতে মায়ের নগ্ন হাত। যেন একটা নগ্ন হাতের ওপর আর একট নগ্ন হাত—তাই না? আর…সত্যিই যেন রবি ঠাকুরের পদ্যের সেই ‘রক্তসূত্রগাছি দিয়ে বাঁধা’ তাই না? একে বিয়ে বলব না ত কাকে বলব। অবশ্য পরে রেজিস্ট্রি হয়। নইলে আর আমি বৈধ হলাম কী করে।
বাবার হেলথ ডিপার্টমেন্টের সূত্রে কালিম্পঙের বাংলোটি পাওয়া গেছে। রিংপিংটন রোড ধরে শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে আর উঁচুতে ছোট্ট বাংলোটি, দূরবীনদারা হিলের একাংশ। বাংলো না বলে রেস্ট শেড বলাই উচিত।
ওপর দুটো এক-কামরা সুইট, নিচে ডিপার্টমেন্টের শাখা অফিস, সুইটে ড্রেসিং টেবিল, ওয়ার্ডরোব, বাথরুমে গীজার, দেওয়াল জোড়া কাচের জানলা, পেলমেটে ভারি পরদা। পরদা সরাতেই অনেকটা নিচে রেলি নদী। জুন মাসের প্রথম। সবে বৃষ্টি নেমেছে। দূরে কোথাও। দুধ সাদা জলে রেলি ভরে উঠছে। ২-১ দিনের মধ্যেই বর্ষা নেমে যেতে পারে। যদি যায়, কুক নরবাহাদুর ছেত্রী আমাকে বলল, নদীর আওয়াজে সারা কালিম্পঙে শুধু এই ছোট্ট উপত্যকাটুকু নাকি সারারাত গমগম করবে। এই বাংলোটা নাকি থরথর করে কাঁপবে। আর জানলা দরজার সব কাচ বাজবে ঝনঝন ঝনাৎ করে।
ঘর জোড়া ডাবল বেড। খাটে ডানলোপিলো। ওয়ার্ডরোব থেকে বের করে বেড কভার পাততে পাততে হঠাৎ আবার আমি শুনতে পাই। নিচে কেয়ারটেকারের সঙ্গে ঝগড়ার সুরে বাবা কথা বলছেন। আজকাল এত সহজে বাবার ধৈর্যচ্যূতি হয়! কেন যে মা নেই? তা আমি কি মরে গেছি! ২৬ পেরিয়ে ২৭, এখনও কি তুমি ছাড়া আমি আর কারও দিকে তাকিয়েছি। কেউ কখনও আমাকে দেখেছে কারও সঙ্গে মেলামেশা করতে? সিনেমায় যেতে? রেস্তোরাঁ থেকে বেরুতে? মার কাছে যা পেতে, স-ব, সব কি তুমি আমার কাছে পাও না বাবা? পিলো কাভার পরাতে গিয়ে, না পরিয়ে, আমি বাবার তিক্ত, রূঢ়, বীতশ্রদ্ধ কণ্ঠস্বর শুনতে থাকি।
কী? না, গীজারের পানি কিঁউ ঠাণ্ডি হ্যায়। আরে বাবা লোডশেডিং ত এখানেও হয়। হয়েছে। কেয়ারটেকার করবেটা কী।
ধূসর পাপড়ি-ছড়ানো শার্টিনের শাদা চাদরে একটা ভাঁজ। আঙুল দিয়ে ঘষে সেটা মিলিয়ে দিতে গিয়ে অকারণে আমার চোখে জল এসে যায়। ওগো আমার নিজের বাবা, মা-র কাছে কী তুমি পেতে, যা আমার কাছে পাও না?
দুপুরে টানা ঘুম। দরজা খোলাই ছিল, কিন্তু বাবা ঘরে নেই। টানা বারান্দা দিয়ে হেঁটে গিয়ে দেখি, অনেক নিচে নদীর ওপর কাচে-মোড়া ‘রেলি ভিউ রুমে’ বাবা একটা সোফায় তখনো ঘুমিয়ে। মুখের ওপর খবরের কাগজ। এত দূর থেকে স্কুল-পালানো ছেলের মতো দেখাচ্ছে, আহা, পার্কে ঘুমিয়ে পড়েছে।
আমাদের বাংলোর মাথার ওপর দিয়ে রিংপিংটন রোড দূরবীন পাহাড়ের দিকে উঠে ও শহরের দিকে নেমে গেছে। বিকেলবেলা আমরা শহরে নেমে গেলাম।
যতটুকু দেখলাম কালিম্পঙ খুব তৃপ্তি দিল। লোকজন কম, ছাড়া ছাড়া বাড়ি সব, রাস্তায় একটাও কুকুর নেই। এখানে কেউ মাইকে ‘শুন সাবা শুন’ বাজায় না। স্থানীয় লোক সকলেই নত মাথায় চলছে, কেউ উঠছে, নামছে কেউ, কেউ কারও সঙ্গে নিষ্প্রয়োজনে কথা বলে না। চক-এ নেমেই প্রথম মানুষের গুঞ্জন শোনা গেল।
সবুজ সাইনবোর্ডের ওপর লাল রঙে লেখা ‘লী’। দূর থেকে দেখেই কাঠের দোতলা রোস্তোরাঁটি ভালো লেগেছিল। আমার পছন্দের রেস্তোরাঁয় বসে, আমার পছন্দমতো খাবার অর্ডার দেওয়া হল। বাবা অ্যাসপারাগাস স্যুপ খুব পছন্দ করেন। আমি করি না। কিছুতেই সেই অর্ডার করতে দিলেন না।
বাবা হঠাৎ বললেন, ‘হ্যাঁরে বুবলি, বিছানা ত একটা। তোর ঘুম হবে ত।’ প্লেট থেকে মুখ না তুলে আমি বললাম, ‘কেন হবে না?’
তালতলায় আমাদের আড়াই কামরার ফ্ল্যাটে বেডরুমের বিছানাটিও ছিল খুবই প্রশস্ত। জানলায় নেটের পরদা। ফ্রিজ, রেডিওগ্রাম, ড্রেসিং টেবিল—সবই সেখানে। জ্ঞান হবার পর থেকেই আমি আর মা ওই ঘরেই শুতাম। বাবা শুতেন পশ্চিমের আধখানা ঘরটিতে। মাঝেরটিকে লিভিং রুম বললে বলা যেতে পারে। দাম্পত্য প্রয়োজনে মা যে আমাকে একা রেখে মাঝের ঘর পেরিয়ে পশ্চিমের ঘরে যাতায়াত করতেন এটা আমি বহুকাল টের পাইনি। সেক্স ব্যাপারে তখন যা বিশ্বাস করতাম তা হল বাচ্চা হবার পরে ওই প্রয়োজনটি নারীর আর থাকে না। অর্থাৎ মা হবার পর।
ক্লাশ সেভেন কি এইটেই তখন, একদিন প্রথম রাতেই খুব ভয়ের স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে উঠি, তারপর মাকে পাশে না পেয়ে মাঝের ঘরে চলে যাই এবং ‘মা’ ‘মা’ ডাকতে থাকি। প্রথমে বাবার ঘরের ছিটকিনি ধরে ভেতর থেকে টানাটানি, তারপর দরজা দু’হাট করে খুলে মা চৌকাঠে এসে দাঁড়াল এবং বাবাও ঘাবড়ে গিয়ে, বেড সুইচ টিপে দিয়েছেন। একটিও বোতাম লাগাবার সময় হয় নি এমন ব্লাউজ বুকে লটকানো, পরনে শুধু কালো সিল্কের পেটিকোট—আই শ্যাডো, আই লাইনার, লিপস্টিক—সব সারা মুখে মাখামাখি— চুল খোলা-পিছনে বাবার ঘরের ফ্লুরোসেন্ট আলোর ব্যাকগ্রাউন্ডে মা-র সিলুয়েট মূর্তি, ওহো, সে যে কী বীভৎস দেখিয়েছিল! সেই ঘেন্না আমার মন থেকে কখনও যায় নি। মা-র মৃত্যুর পর আট বছর হয়ে গেল, মার প্রেতিনী মূর্তি আমি মুহূর্তের জন্যেও আজও মনে আনতে পারি না।
‘না মানে তোর ত আবার একা শোওয়া অভ্যেস।’ বাবা বললেন।
তালতলায় থাকতে খুব ছোটবেলায় এক মেমের কাছে প্রতি রবিবার সকালে পিয়ানো শিখতে যেতাম। বাবা আগাগোড়া চেয়ারে বসে থাকতেন। প্রথমদিন পিয়ানোর রিড আমি ত কিছুতেই আঙুল ছোঁয়াব না। অনেক সাধ্য সাধনার পর নাকি তর্জনী দিয়ে একটু রিড ছুঁয়েছিলাম। প্রথম দিনে তাই কোনো লেসনই হয়নি।
পিয়ানোর রিডে প্রথম আঙুল রাখার সেই অসম্ভব, কঠিন, অনতিক্রমণীয় বাধা যেন বাবার গলায় । কেন?
মা-র মৃত্যুর পর কিছুদিন ঝাড়গ্রামে মামার বাড়িতে, তারপর দীর্ঘ আট বছর ধরে সত্যিই আমি মার ঘরে একা শুই। ছিটকিনি দিয়ে শুতে আমি ত কোনোদিন ভুলি নি কেন?
রেস্তোরাঁয় জানলার পাশেই বিশাল গিরিখাদ। প্রায় ২০০০ ফিট নিচে উপতাকা দিয়ে ফেলে-আসা তিস্তা নদী বয়ে চলেছে। এত উঁচুতে তার গর্জন একটুও শোনা যায় না।
‘কেন, খুব ত চওড়া দেখলাম বিছানাটা’—সে দিকে তাকিয়ে আমি বলি। কয়েক হাজর ফিট নিচে তিস্তা বাজারের কাছে নদী পেরোবার জন্য পুরোনো ব্রিজটা ভেঙে পড়ে আছে। ১৯৬৮ সালে একমাস জুড়ে টানা বর্ষায় সেই একবারই তিস্তা শত শত ফিট ফেঁপে উঠে ব্রিজটি ভেঙে দেয়। আমার বয়স তখন চার-পাঁচ হবে।
বিকেল থেকেই মেঘ করেছিল। বাংলোর কাছাকাছি আসতে ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি। বাংলোয় ফিরে একটা মোটা পুলোভার গায়ে জড়িয়ে, ছাতা মাথায় আমি একবারটি নিচে ডাঃ রায়ের কোয়ার্টার থেকে ঘুরে আসতে গেলাম। রায়গিন্নির আজ লক্ষ্মীনারায়ণ পুজো। অনেক করে যেতে বলেছিলেন। রাত ৯টা হবে। তবে এখন লোডশেডিং নেই। বাংলোয় বারান্দায়, রেলি-ভিউ রুমে, সর্বত্র আলো জ্বলছে।
বৃষ্টি জোরে নামতে পারে বলে ওঁরা তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দিলেন। মাঝখানে মিনিট কুড়িও যায়নি। নিচে কোটইয়ার্ড থেকে দেখলাম আমাদের দোতলার ঘর অন্ধকার। বাবা কি শুয়ে পড়লেন? উঃ, কি কনকনে হাওয়া রে বাবা।
আলো জ্বালতেই, ওমমা একি কাণ্ড! বাবা সত্যিই কম্বল গলা পর্যন্ত টেনে পাশে ফিরে শুয়ে। তবে সেই ডাবল বেড আর নেই। পাশাপাশি দুটি সিঙ্গল বেড। পরিপাটি বিছানা।
‘আরে-এ, এটা টুইন বেড ছিল নাকি?’
‘হ্যাঁ’; সত্যিই ঘুমে জড়িয়ে এসেছে বাবার গলা, ‘আমি ভেবেছিলাম ডাবল। নরবাহাদুর বলতে…তখন দুজনে টানাটানি করে…আ-হাআ’ বাবা হাই তুললেন।
বাথরুম বাবার বিছানার ওপারে। বাথরুম সেরে সোজা আমার বিছানার দিকে যাচ্ছি, বাবা হাঁ হাঁ করে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন, বিছানায়, ‘আর-এ নান না, মাঝখান দিয়ে না, ওদিকে দিয়ে ঘুরে যা। মাঝখানে আধ ইঞ্চিটাক পুরু ধুলো। অনেককাল জোড়া ছিল ত খাটদুটো।’ দেখলাম ভল্লুকের বিস্ফারিত অসহায় চোখে বাবা আমার দিকে তাকিয়ে।
বেড সুইচ অফ করে আমরা শুয়ে পড়লাম।
পাশাপাশি আলাদা খাটে, তবু বহু রাত পর্যন্ত আমার ঘুম এল না। মাঝ রাতে ভীষণ মেঘ ডাকাডাকি শুরু হল। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। জানলা শার্শি ঝনঝন-ঝনাৎ করে বাজতে লাগল। রেলি নদীতে ঢল নেমেছে। সারা উপত্যকা গমগম করছে রেলির গাঁ-গাঁ ডাকে।
বাবা অকাতরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। মাঝে মাঝে নাকও ডাকছে। কিন্তু আমার ঘুম আসছে না। পরদা সরিয়ে খুব ইচ্ছে হল রেলিকে, গর্জনকারিনীকে একবার দেখি। কিন্তু, না, বাবার বিস্ফারিত, অসহায় ভল্লুক চক্ষুটি অন্ধকারে আবার ভেসে উঠল। বাবা নামতে বারণ করেছেন। মাঝখানে যা ধুলো।
১৯৮৬