কান্যকুব্জের রাত্রি
[এই গল্পটি আমার দিল্লির জার্নালিস্ট বান্ধবী মাহ্মুদা আমাকে বলেছিল। বছর দশেক আগেকার কথা। মাহ্মুদার গল্প আমি তারই মুখে বসিয়ে দিলাম।]
মাহ্মুদার গল্প
আমরা কয়েকজন সাংবাদিক সেবারে গিয়েছি উত্তরপ্রদেশের ইলেকশন কভার করতে। আমরা যাবো লখনৌ থেকে ফারুকাবাদ। পথে চারটে মীটিং হবে। রাত্রিবাস কনৌজে। তিন ঘণ্টার স্টপ। নেতারা যাচ্ছেন হেলিকপ্টার করে। পেছু পেছু আমরা। ওঁরা আগে আগে পৌঁছে যাচ্ছেন, আমরা ঘণ্টাখানেক, ঘণ্টা দেড়েক বাদে। তারপর মীটিং হচ্ছে, সাংবাদিকরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে এক একটা গাড়ি ভাড়া করে যাচ্ছি, দু’তিনজন করে এক একটা গাড়িতে। আমি, আর ফোটোগ্রাফার প্রদীপ বাসু, আমরা একসঙ্গে যাচ্ছি। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার আব্দুর রহমানের বয়েস ত্রিশ—বত্রিশ হবে, খুব চমৎকার ছেলে। আমাদের সঙ্গে দিব্যি জমে গেছে। ঠিক ঠিক ধাবাতে গাড়ি থামাচ্ছে, আমার জন্যে সুন্দর চা, প্রতীপের ঠাণ্ডা বীয়ার, সব ঠিকঠাক পাওয়া যাচ্ছে, আর রহমান তো গল্প করেই আমাদের জমিয়ে দিচ্ছে। রহমান বলছে আজকাল এত হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা কেন হয়। হিন্দু মুসলমান তো সত্যিই ভাই ভাই হয়ে বাস করে আসছে জন্ম জন্ম ধরে। হিন্দু—মুসলমানের প্রেমপ্রীতির প্রয়োজন নিয়ে সর্বত্র নেতারা এত লম্বা লম্বা বক্তৃতা দিচ্ছেন, অথচ এই যে প্রেমপ্রীতির অভাব আজকাল দেখা দিয়েছে সে তো ঐ নেতাদের জন্যেই! রাজনীতির চাল চেলে মানুষের বুকে ঘৃণা বিদ্বেষ ঢুকিয়ে দিয়েছিল এই নেতারাই—নিজেদের সুবিধে হবে বলে। এখন সেই বিদ্বেষ এমনই মরণবাড় বেড়েছে, যে নেতারা নিজেরাই আর সামাল দিতে পারছে না। নিজেদেরও যখন ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, তখনই এসেছে ”প্যার করো” বলতে। অথচ প্যারের কোনো অভাব ছিল না একদিন। রহমান বলল—”এই যে গাড়িটা আমি চালাই, এ এক লখনৌয়ের হিন্দু রাজাবাবুর গাড়ি। তাঁর দয়াতেই আমি মানুষ। আমার যা কিছু সব তাঁর জন্যে। আমার বাবা তাঁর বাবার ঘোড়ার সহিস ছিলেন। আমার মা যখন অন্য একজনকে নিকাহ করে চলে যান লখনৌ ছেড়ে, আমি বাবার কাছেই বড় হচ্ছিলাম। সেই বাবাও হঠাৎ মারা গেলেন। গলায় ক্যানসার হয়েছিল বাবার। আমি তখনও নেহাৎ ছেলেমানুষ। রাজাবাবুই আমায় ছেলের মতো করে মানুষ করেছেন। ইস্কুলে দিয়ে পড়াশুনো শিখিয়েছেন, গাড়ি চালানো শিখিয়েছেন, এই গাড়িটা পর্যন্ত উনিই আমাকে দিয়েছেন। উনি আমার মা—বাপ—মনিব সব কিছু ছিলেন হিন্দু—মুসলমানের ফারাক কোনোদিন বুঝিনি, ওঁর কাছে সবাই সমান ছিল। এই যে আপনি মুসলিম, আর স্যার যে হিন্দু, আপনাদের কি কোনও অসুবিধে হচ্ছে, ম্যাডাম?”
আমি তাড়াতাড়ি বলি, ”আমি মুসলিম মেয়ে, প্রদীপ হিন্দু ছেলে কিন্তু আমরা কেউ কারোর আত্মীয় নই। আমরা সহকর্মী মাত্র। দিল্লিতে আমার স্বামী আছেন, তিনি শিখ পাঞ্জাবী, আর প্রদীপের এক বৌ আর দুটো ছেলে।”
—”তবে? তবে?” রহমান মহা উৎসাহে বলে উঠল—ওই তো একই হলো! আপনার স্বামী তো শিখ, সে ঐ হিন্দুই হলো—মুসলমান স্বামী তো নয়? এই তো আপনারা দিব্যি মিলেমিশে ঘর—সংসার করছেন? দেশটাও তো একটা বড় সংসারই ম্যাডাম—দেশের মানুষ মিলেমিশে ঘর করতে কেন পারবে না? দেশের মানুষের মধ্যে প্রেমপ্রীতির অভাব আসলে নেই। দরকার শুধু এই রাজনীতির নেতাদের মেরে ধরে তাড়িয়ে দেওয়া। এরাই যত নষ্টের মূলে।”
কথা বলতে বলতে পথ ফুরিয়ে যাচ্ছে। রাত হয়েছে, কনৌজ এখনো আসেনি। ক্লান্তিতে, ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। প্রদীপ একথা—ওকথা বলে বলে রহমানকে প্রাণপণ চেষ্টায় জাগিয়ে রাখছে। আমি মাঝে মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ছি। হঠাৎ শুনি হাসতে হাসতে রহমান বলছে—”স্যার, অপ ভি জরাসা সো যাইয়ে না? মুঝপর পুরা ভরোসা রাখিয়ে, মুঝে নিন্দ নহী আয়েগী ম্যাঁয় যবতক স্টিয়ারিং মে হুঁ—”
প্রদীপ বললে—”বাঃ এত রাত্রি হয়েছে, আপনি সারাদিন একটানা গাড়ি চালাচ্ছেন, ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, ঘুমিয়ে যে পড়বেন না, তার নিশ্চয়তা কী?”
রহমান একটু চুপ করে থেকে গম্ভীর গলায় বললে—”স্যার, এর উত্তরে আমি যা বলতে পারি, আপনি তা বিশ্বাস করবেন না। আপনি কেন, আজকালকার কোনও মানুষই একথা মানতে চাইবে না। আমি সেটা বুঝি। যে কথার প্রমাণ দেওয়া যায় না, দুয়িনাতে সে কথার কোনো মূল্য নেই। তাই নিশ্চয়তা যে কী, আপনাকে তা বোঝানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
আমার কৌতূহল হলো, আমি বলে উঠি,—”আমায় বলুন, আমায় বলুন, আমার কোনও প্রমাণ চাই না। আপনার মুখের কথাটাই যথেষ্ট।”
রহমান খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললে—”রাত্তিরবেলায় ঘুম পায় না ম্যাডাম, রাত্তিরে হেডলাইটের আলো চোখে বিঁধে যায়, সাবধানে গাড়ি চালাতে হয়। ঘুম আসে ঠিক সকালের দিকে। ভোরের দিকে যখন একটা আলগা হাওয়া দেয়, আঁধারটা কেটে যায়, ফর্সা হয়ে আসে চারিদিক, মুখে—চোখে ঠাণ্ডা বাতাসটা যেই লাগে, শরীরটা রিল্যাক্স করে যায়, রাত্রের অন্ধকারের টেনশনটা কেটে যায়, অমনি দু’চোখ ঘুমে ভারী হয়ে ওঠে—চোখের পাতা জড়িয়ে আসতে থাকে। ঐ সময়টাতেই বেশির ভাগ অ্যাকসিডেন্ট হয় এই সব হাইওয়েতে। ঐ সময়টায় খুব সাবধানে থাকতে হয়। একবার আমার একটা এক্সপিরিয়েন্স হয়েছিল। লখনৌ থেকে এই গাড়িতে কিছু মাল নিয়ে তিনজন বিজনেসমেনকে নিয়ে গিয়েছিলাম মেরঠে। ওদের আমি পৌঁছে দিলাম, মালপত্র নামিয়ে দিলাম, দিয়ে ফেরৎ রওনা হয়েছি। পথে ভোর হয়ে এল, আমার চোখও ঘুমে জুড়ে আসতে লাগল। সামনের ধাবাটা এলেই থামতে হবে, চা খেতে হবে, এই ভাবছি, আর ভাবতে ভাবতে ঘুমের সঙ্গে যুদ্ধ করছি, হঠাৎ মনে হলো আমাকে দু’হাতে ধরে কে যেন ভীষণ জোরে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে আমার শরীর থেকে ঘুম ছেড়ে গেল, আমি চেয়ে দেখি একটা প্রকাণ্ড গাছ ঠিক আমার গাড়ির দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে। প্রাণপণ জোরে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে তো কোনোরকমে বেঁচে গেলাম, ম্যাডাম, আপনি বললে বিশ্বাস করবেন না, স্পষ্ট শুনলাম রাজাবাবুর গলা—বলছেন, ”শাবাশ রহমান বেটা, জীতা রহো।” রাজাবাবু তার অল্প কিছুদিন আগেই মারা গেছে। এখনও তাঁরই বাড়ির কোয়ার্টারে আমার বিবি, বাচ্চারা, সবাই আছে। রাজাবাবুর তো বালবাচ্চা ছিল না। আমি কানে স্পষ্ট রাজাবাবুর গলা শুনেছিলাম ম্যাডাম। আমার বিশ্বাস রাজাবাবুই সেদিন আমাকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে দিয়েছিলেন, বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকেই আমার ভোররাত্রে ঘুম পায় না আর। কি স্যার, বিশ্বাস হলো?”
প্রদীপ বলল—”আমি আরও এরকম কহানী শুনেছি রহমানসাব, যাঁরা হাইওয়েতে গাড়ি চালান তাঁদের সত্যিই নানা ধরনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়।”
আমিও চুপ করে থাকি না। আমি এবার বলি—”এরকম মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী বন্ধু ভূতের কথা আমি শুনেছি আগে, আপনার কথা আমার খুবই বিশ্বাস হয়। আপনি মিছিমিছিই ভাবছিলেন যে আমরা বিশ্বাস করব না। পৃথিবীতে কত কিছুই তো ঘটে, আমরা যার সবটা বুঝি না।”
রহমান খুশি হয়ে বললে—”যাক, তবু ভালো আপনারা যে আমার কথাটা বুঝতে পারলেন! ওই যে কনৌজ এসে গেছে, চমৎকার একটা ডাকবাংলো জানি আমি এখানে—চলুন দেখি যদি ফাঁকা থাকে।”
ডাকবাংলো ফাঁকাই ছিল। দুটি মাত্র কামরা। একটায় আমি, একটাতে প্রদীপ। রহমান গাড়িতে থাকবে। গাড়ির পার্টস—টার্টসের জন্যে উদ্বেগে কিনা জানি না, সে গাড়িতেই শোবে। খালি কামরা না থাকলেও, ড্রয়িংরুমটা তো ছিল, সেখানে বড় একটা সোফাও আছে, তাতে দিব্যি একজন মানুষ শুয়ে থাকতে পারে। কিন্তু রহমান রাত্রে গাড়ি ছেড়ে থাকবে না। ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার আমাদের অতি চমৎকার রান্না করে দিল অত রাত্রে। লম্বা লম্বা দেরাদুন রাইসের ভাত, সরু সরু আলুভাজা পেঁয়াজ—লংকা দিয়ে ফার্স্টক্লাস ডিমের কারি। খেয়েদেয়ে শুতে না শুতেই ঘুম!
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। বাথরুমে কিসের শব্দ হচ্ছে। বাথরুমের ওপাশে প্রদীপের ঘর, এপাশে আমার। দুদিকে দুটো দরজা। যে যখন বাথরুমে যাবে, তখন অন্যদিকের দরজাতে ছিটকিনি লাগাবে, ফের বেরুবার সময়ে খুলে দেবে। এখানে এই নিয়ম। কেয়ার—টেকার ভাল করে দেখিয়ে দিয়েছে। বাথরুমের তো আলো জ্বলছে না, অথচ দিব্যি জল পড়ার শব্দ হচ্ছে। আমার বাথরুমে কী হচ্ছে জানা দরকার। ঘরের আলোটা জ্বেলে, বাথরুমের দরজাটা ঠেলে হাট করে খুলে ফেলে, আলো জ্বেলে ঢুকে দেখি কেউ নেই। বেসিনের কল থেকে জল পড়ছে। কল বন্ধ করে দিয়ে এসে শুয়ে পড়ি। বুকের মধ্যেটা অদ্ভুত ছমছম করতে থাকে।
আবার আমার ঘুম ভেঙে গেল। আবার বাথরুমে জল পড়ার শব্দ। এবার আরো জোরে। আবার ঘরময় আলো জ্বেলে, বাথরুমের আলো জ্বেলে ঢুকে দেখি এবারে স্নানের কল থেকে মোটা ধারায় জল পড়ছে বালতিতে। বালতি প্রায় ভরে এসেছে। কল বন্ধ করে এসে শুয়ে পড়ি। এবার বেশ ভয় ভয় করছে। গা ছম ছমের চেয়ে বেশি।
বাথরুমে জলের আওয়াজে ফের ঘুম ভেঙে গেল। তৃতীয়বার। এবার যেন খুব জোরে শব্দ হচ্ছে। ঢুকে দেখি বেসিনের কল, স্নানের কল, দুটো থেকেই জল পড়ছে তোড়ে। বালতি উপচে জল পড়ছে মেঝেতে। জোরে দুটো কলই বন্ধ করে দিই, আমার সমস্ত শরীরে কাঁটা দিচ্ছে। আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবি এত জোর শব্দ হচ্ছে আর প্রদীপ কিছু শুনতে পাচ্ছে না? ঘর থেকে বেরিয়ে যেই আলোটা নিবিয়েছি, অমনি স্পষ্ট শুনলাম—আবার জোরে জল পড়া শুরু হয়ে গেল। আমার বুকের মধ্যের ধড়ফড়ানি আর থামানো যাচ্ছে না, আমি আর এঘরে শুতে পারলাম না। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম ড্রয়িংরুমে আলো জ্বলছে। এবার দরজা খুলে ড্রয়িংরুমে যাই। দেখি যদি কেয়ারটেকারকে পাওয়া যায়—ওকে বলা দরকার। নইলে প্রদীপকে ডাকতে হবে। এ জিনিস আমি একা একা আর সইতে পারছি না।
ড্রয়িংরুমে ঢুকে আমি অবাক। এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক সোফাতে বসে আছেন। ঘরভর্তি দামী চুরুটের গন্ধ। ভদ্রলোকের পাশে একতাড়া ম্যাগাজিন—পুরনো ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একটা কপি পড়ছেন। ইনডিয়া স্পেশাল নাম্বার। ১৯৬৬—র। বলিষ্ঠ চেহারা, কাঁচাপাকা চুল, কাঁচাপাকা গোঁফ, টকটকে রং, কাটাকাটা নাক—চোখ, অত্যন্ত সুপুরুষ। আমার পরনে সালোয়ার কুর্তা ছিল, ভাগ্যিস নাইটি নয়! আমাকে দেখে উনি উঠে দাঁড়ালেন—ছ’ফুটের এক সেন্টিমিটারও কম হবেন না। পরনে সিল্কের শার্ট, কালো ট্রাউজার্স। যারপরনাই ভদ্র, সম্ভ্রান্ত চেহারা। ভদ্রলোক আমাকে দেখে সপ্রতিভ সুরে বললেন—’গুড মরনিং ম্যাডাম—তিনটে বেজে গেছে—আপনি কি রোজ এত ভোরবেলাতেই ওঠেন?” হঠাৎ ওঁকে দেখে তো আমি বেশ ঘাবড়ে গেছি। এ আবার কে? এল কখন।
—”আপনি কখন এলেন—” বলেই ফেলি।
—”এই তো সাড়ে বারোটা নাগাদ। আপনারা তখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। ঘর ছিল না বলে এখানেই বিশ্রাম নিচ্ছি। কেয়ারটেকারটি সত্যিই খুব ভালমানুষ—রামফল। রামফল আমাকে এখানে বিশ্রাম করতে অ্যালাও করে গেছে।”
—”আপনি তো বড় সোফাটায় শুয়ে কতক্ষণ একটু ঘুমিয়ে নিতে পারতেন। হাত—পা ছড়িয়ে।”
ভদ্রলোক হেসে বললেন—”থ্যাংকিউ। কিন্তু সত্যিই আমার ঘুম পায়নি। আমি একটু পত্রিকাটত্রিকাগুলো দেখছি। এখুনিতো সকাল হয়ে যাবে। বসুন?”
হঠাৎ খেয়াল হলো ভদ্রলোক এতক্ষণ দাঁড়িয়েই রয়েছেন। ”আপনি বসুন” বলে আমিও একটু বসি। ওর পাশেই একগাদা পুরনো ম্যাগাজিন। ১৯৬৪—র টাইম ম্যাগাজিন, মলাটে কেনেডির ছবি। ১৯৬৮—র টাইম ম্যাগাজিন, মলাটে মার্টিন লুথার কিং।
—”কোথায় যাচ্ছেন?”
—”এই এদিকেই একটু কাজ ছিল। সকাল হলে কনৌজ যাব। শহরে।”
—”কোথা থেকে আসছেন?”
—”লখনৌ।”
ভদ্রলোক বিজনেস করেন, ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা আছে লখনৌতে। পুরোপুরি গল্পের বইয়ের ”লখনৌয়ি সৌজন্যের” প্রতিমূর্তি যেন, অভিজাত পরিবারের মানুষ সন্দেহ নেই। ওঁকে বাথরুমে জলপড়ার সমস্যাটা বলা যায়। শুনে হেসে ফেললেন মিস্টার দুবে। ”এসব তো খুব পুরনো দিনের বাংলো, সেই সাহেবদের তৈরি। এখানে ওরকম হয়। ভয়ের কিছু নেই, ওসব ভৌতিক কাণ্ড নয়, নিশ্চয়ই ওয়াশারগুলো নষ্ট হয়ে গেছে, তাই কল যতবারই বন্ধ করেছেন, ততবারই খুলে যাচ্ছে। নিস্তব্ধ রাত্রে জল পড়ার শব্দ বড় ভয়ংকর শোনায়। জায়গাটা তো অপরিচিত।”
মিস্টার দুবের কথায় মনে ভরসা পেলাম। উনিও যেন আমার মনের কথাটা বুঝে বললেন, ”যান, এবার শুয়ে পড়ুন গে, ওই জলের শব্দটব্দ স্রেফ ইগনোর করে ঘুমিয়ে পড়ুন। সকালে তো আবার বেরুবেন।” মিষ্টি হেসে আমার মনে বল যোগালেন মিস্টার দুবে। এবার গিয়ে শুয়ে সত্যিই ঘুমিয়ে পড়লাম, যদিও তখনও বাথরুমে জলের অবিশ্রাম শব্দ।
সকালে উঠে দেখি মিস্টার দুবে নেই। প্রদীপ আমার আগে উঠে পড়েছে, কিন্তু সে ওঠার আগেই উনি চলে গেছেন। প্রদীপের সঙ্গে দেখা হয়নি ওঁর। উনি যেখানে বসেছিলেন সেখানে পুরনো ম্যাগাজিনগুলো খুঁজতে গিয়ে দেখি ম্যাগাজিনগুলো আর নেই। কি আশ্চর্য! ডাকবাংলোর ম্যাগাজিনগুলো মেরে দিলেন। এমন সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক? সত্যি, মানুষ বড় আশ্চর্য জীব। ভাবতেও পারিনি!
আমরা বেরিয়ে পড়লাম। যেতে যেতে রহমানকেই বলি—”রাত্রে এক ভদ্রলোক যে এসেছিলেন, তিনি কখন চলে গেলেন?”
রহমান বলল, ”কই কেউ তো আসেনি? আর কোনও গাড়ি তো ঢোকেনি বাংলোর কম্পাউন্ডে?” আমি বুঝলুম সব । প্রদীপ যেজন্যে জলের শব্দ শুনতে পায়নি, রহমানও সেই জন্যেই নিশ্চয় মিস্টার দুবের গাড়ি দেখেনি। সবই মদিরা দেবীর মায়া। রাত্রে ফিরে খুব মদ্যপান করা হয়েছে নিশ্চয়। গাড়ি যতক্ষণ হাইওয়েতে থাকে ততক্ষণ ড্রাইভাররা সব টীটোটলার। আর গাড়ি থামলেই অকূলে ঝাঁপ, অসীম তৃষ্ণা।
রহমান বলছে—”ফারুকাবাদের মীটিং ক’টার সময়ে ম্যাডাম?” কথা ছিল ভোর তিনটেয় হবে, সেটা এখন পেছিয়ে গেছে সকাল সাতটায়। মক্ষিরানীর পাখায় গোলমাল হয়েছে, নেতাদের থেমে পড়তে হয়েছে মাঝপথে। হেলিকপ্টার বিগড়েছে। অতিরিক্ত যাত্রীর ভার চাপিয়েছিল বোধহয়—ভক্তবৃন্দ সকলেই যে হেলিকপ্টারে চড়ে সঙ্গে যেতে চায়! ফলে দুটো মীটিং ক্যানসেল হলো, হোলনাইট প্রোগ্রামটা করা চলল না, আর আমরাও একটু বিশ্রাম পেলাম।
—”আমরা যখন মীটিং করি, আপনি তখন কী করেন রহমানসাব?”
প্রদীপের কথার জবাবে রহমান হেসে ওঠে—”আমিও তো মীটিং শুনলাম দু’একটা। তারপর দেখি ওঁরা একই কথা বলছেন সর্বত্র। তখন বোরড হয়ে ম্যাগাজিনগুলো পড়ি। আমার গাড়িতে অনেক পুরনো ম্যাগাজিন আছে, ভাল ভাল। সবই রাজাবাবুর ম্যাগাজিন।”
প্রদীপ বলল, ”পুরনো ম্যাগাজিন? কই, কই, দেখি?”
—”এই তো এখানেই কয়েকটা আছে”—বলতে বলতে বাঁহাতে গ্লাভ কম্পার্টমেন্টটা খুলে রহমান দু’একটা বই এগিয়ে দেয়। ১৯৬৪—র টাইম ম্যাগাজিন, মলাটে কেনেডির ছবি, ১৯৬৬—র ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, ইনডিয়া স্পেশাল নাম্বার, ১৯৬৮—র টাইম ম্যাগাজিন, মলাটে মার্টিন লুথার কিং।
—”রহমানসাব—” আমি শুনতে পেলাম আমি বলছি, ”আপনার রাজাবাবুর নাম কি মিস্টার দুবে?”
একগাল আহ্লাদ দিয়ে রহমান বলে উঠল—”আপনি ওঁকে চিনতেন নাকি, ম্যাডাম?”
নবকল্লোল, ডিসেম্বর ১৯৯৭