কাকোলূকীয়

কাকোলূকীয়

মেঘবর্ণ ও অরিমর্দন

দক্ষিণ ভারতে মহিলারোপ্য নামে এক নগর ছিল। তার কাছে ছিল এক বিরাট বটগাছ। ঘন পাতায় ঢাকা। তার ডালে বাস করত এক কাকরাজ। নাম মেঘবর্ণ। মেঘের মতো গায়ের রং তো। তাই এ নাম।

বটগাছটা ছিল আসলে মেঘবর্ণের দুর্গ। আত্ম-পরিজন, সাঙ্গোপাঙ্গ সকলকে নিয়ে সে ঐ দুর্গে বাস করত। বিশাল তার রাজত্ব। কিন্তু একটা কষ্ট ছিল। কষ্টের কারণ এক উলূক। মানে পেঁচা। নাম অরিমর্দন। শত্রু পেলে আর ছাড়ত না। যেমন নাম, তেমন কাম।

অরিমর্দন থাকত এক পাহাড়ের গুহায়। বটগাছের অদূরে। গুহার সে রাজা। লোকজনের অভাব নেই। তাদের আহার জোগানো তার দায়িত্ব। রাজা তো। তাই। এমনিতে কাকের সঙ্গে পেঁচার জাতশত্রুতা। তাই অরিমর্দন রোজ রাতে বটগাছের চারপাশে চক্কর দিত। যাকে পেত তাকেই ধরত। তার তো সুবিধা। সে রাতে চোখে দেখে। কিন্তু কাক দেখে না। তাই রোজ রাতে মারতে মারতে দুর্গের বাইরেটা একেবারে কাকশূন্য করে ফেলল। এসব দেখে মেঘবর্ণ একদিন ভাবল

শত্রু কিংবা ব্যাধিকে যে আসতে দেখে চুপ থাকে।
যমের বাড়ি যাবে না সে, তাহলে আর যাবে কো।।
জন্মমাত্র শত্রু কিংবা ব্যাধিকে যে না মারে।
তারাই পরে বড় হয়ে সবংশেতে মারে তারে।।

এসব ভেবে মেঘবর্ণ একদিন মন্ত্রীদের ডেকে বলল: মহাশয়েরা, আমাদের তো চরম বিপদ উপস্থিত হলো! পেঁচারা আমাদের শেষ করে ফেলল! এভাবে চলতে থাকলে আমাদের বংশ যে ধ্বংস হয়ে যাবে! একে তো শত্রু বিশালদেহী। তার ওপর ভীষণ সাহসী ও উদ্যমী। কৌশলীও। সে দিনে আসে না। আসে রাতে। আমরা আবার রাতে দেখিনা। তাই এর প্রতিবিধান কি? এমন অবস্থায় রাজনীতিতে ছয়টি করণীয় আছে–সন্ধি (সন্ধি), বিগ্রহ (যুদ্ধ), যান (অভিযান বা পলায়ন), আসন (বসে থাকা); সংশয় (কারো আশ্রয় নেয়া) এবং দ্বৈধীভাব (ছলনা)। আমাদের কোনটি করণীয়?

মেঘবর্ণের ছয়জন মন্ত্রী ছিল–উজ্জীবী, সঞ্জীবী, অনুজীবী, প্রজীবী, চিরঞ্জীবী ও স্থিরজীবী। তারা বলল: মহারাজ, রাজ্যের এমন বিপদে মন্ত্রীদের আপনা থেকেই কিছু বলা উচিত। তা আপনি নিজে যখন জিজ্ঞেস করলেন, তখন প্রিয় হোক অপ্রিয় হোক, আমাদের তো কিছু বলতেই হবে। তবে সদুপদেশ কিন্তু হিতকর তেতো ওষুধের মতো অপ্রিয় হতে পারে। তা-সত্ত্বেও আমাদের বলতে হবে। কারণ, যে কেবল অহিতকর প্রিয়কথা বলে, তার মতো শত্রু আর নেই।

মন্ত্রীদের কথা শুনে মেঘবর্ণ আশ্বাসের সুরে বলল: অবশ্যই, আপনারা অপ্রিয় হলেও সত্য কথাই বলবেন।

মন্ত্রিবর্গ: তাহলে মন্ত্রণাকক্ষে চলুন। গোপন কথা সবার সামনে প্রকাশ্য নয়।

এই বলে মেঘবর্ণ এবং মন্ত্রিবর্গ মন্ত্রণাকক্ষে গেল। সেখানে উজ্জীবী প্রথমে বলল: রাজন, রাজনীতিশাস্ত্রে আছে বলবানের সঙ্গে যুদ্ধ করা উচিত নয়। তার সঙ্গে হয় সন্ধি করতে হয়, নতুবা প্রথমে নত থেকে পরে সময় বুঝে মারতে হয়। সত্যবাদী, ধার্মিক, চরিত্রবান, বহুভ্রাতা, মস্ত জোয়ান, বহুযুদ্ধজয়ী—এরা শত্রু হলে এদের সঙ্গে সন্ধি করাই শ্রেয়। অসৎ ব্যক্তির সঙ্গেও অনেক সময় সন্ধি করতে হয়। কেননা, প্ৰাণ রক্ষা পেলে সবই রক্ষা পায়। তাছাড়া বলবান কিংবা বহুযুদ্ধজয়ীর সঙ্গে সন্ধি করলে শত্রুরা এমনিতেই বশীভূত হয়। শক্তিতে সমান হলেও তার সঙ্গে সন্ধি করা বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ, সমানে-সমানে যুদ্ধজয় অনিশ্চিত। পরস্পরের আঘাতে দুটি কাঁচা কলসির দুটিই যেমন ভেঙে যায়, তেমনি সমানে-সমানে যুদ্ধ হলে, উভয়েরই বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। আর পাথরের সঙ্গে আঘাতে মাটির কলসি যেমন গুঁড়িয়ে যায়, সবলের সঙ্গে যুদ্ধে দুর্বলেরও তেমনি অবস্থাই হয়। তাছাড়া যুদ্ধের উদ্দেশ্য থাকে তিনটি—রাজ্য, মিত্র কিংবা সোনা। যেখানে এর কোনোটিই প্রাপ্য নয়, সেখানে যুদ্ধে জড়ানো বৃথা লোকক্ষয়। ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে হাতি কি পায়? বড়জোর একমুঠো ধান। তাতে তার লাভ কি? বরং দাঁত ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কাজেই যেখানে অধিক লাভের আশা নেই, সেখানে যুদ্ধে জড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বরং বলবানের কাছে প্ৰথমে যারা বেতস-লতার মতো অবনত থাকে এবং সুযোগ বুঝে ভুজঙ্গের ন্যায় ফণা তোলে, তারাই বিজয়ী হয়, লাভবান হয়। তাই শাস্ত্রকারেরা বলেছেন প্রথমে কচ্ছপের মতো গুটিয়ে থেকে মার খাবে। পরে কালকেউটের মতো উঠে দাঁড়াবে। যুদ্ধ এসে পড়েছে দেখলে সামের মাধ্যমে তাকে শান্ত করবে। বেপরোয়া আক্রমণ করতে গেলে বিপদের আশঙ্কা। কারণ, জয়-বিজয় তো অনিশ্চিত। দেখুন—

এমন বিধান শাস্ত্রে নেই যে, বলীর সঙ্গে যুঝতে হবে।
হাওয়ার উল্টো মেঘ ছুটে যায়—একথা কে শুনছে কবে।।

এমনিভাবে নানান যুক্তি দিয়ে উজ্জীবী মেঘবর্ণকে পরামর্শ দিল অরিমর্দনের সঙ্গে যুদ্ধের পরিবর্তে সন্ধি করতে। মেঘবর্ণ এবার জিজ্ঞেস করল সঞ্জীবীকে। সে বলল: মহারাজ, যার সঙ্গে বিরোধ আছে–সে শত্রুই হোক আর মিত্রই হোক তাকে বিশ্বাস করার কোনো যুক্তি নেই। আর জাতশত্রুর সঙ্গে সন্ধি? সে আমার বিবেচ্য নয়। দেখুন, যে আগুনে জল গরম হয়, সুযোগ পেলে সে-ই তাকে নেভায়। কাজেই শত্রুর সঙ্গে যতই সন্ধি করুন, সুযোগ পেলে সে ছাড়বে না। তাছাড়া নিষ্ঠুর, লোভী ও অধার্মিকের সঙ্গে সন্ধির কোনো মূল্য নেই। কারণ, মুহূর্তে সে ঘুরে যায়। তার ওপর ওর কাছে আমরা হেরে আছি। এ অবস্থায় সন্ধির প্রস্তাব দিলে ওর স্পর্ধা আরো বেড়ে যাবে। রাজনীতিতে সাম, দান, ভেদ, দণ্ড এই চারটি নীতি আছে। যার ক্ষেত্রে দণ্ড প্রযোজ্য, তার সঙ্গে সাম-এর (সন্ধি) কোনো স্থান নেই। যে-জ্বর ঘাম দিয়ে ছাড়াতে হবে, তাতে ফোটা কয়েক জল ছিটোলে কি হবে? তপ্ত ঘি-এ জলের ছিটা দিলে তা যেমন চড়াৎ করে লাফিয়ে ওঠে, তেমনি ক্রুদ্ধ শত্রুকে শান্তিবচন শোনালে, সে আরো ক্ষেপে যাবে। আর বলছেন শত্রু বলবান? কিন্তু মহারাজ, হাতি তো দেহে ঢের বড় এবং শক্তিশালী। অথচ সিংহ? এক লাফে তার মাথায় উঠে কাবু করে ফেলে। তাই শাস্ত্রকারেরা বলেন সাহসই হচ্ছে আসল শক্তি। বলে না হলে ছলে শত্রুকে মারতে হবে। যেমন মেরেছিলেন ভীম—স্ত্রীবেশে কীচককে। তাছাড়া, রাজা যদি শক্ত হন, দুর্জনকে কঠিন শাস্তি দেন, তাহলে শত্রুরা দ্রুত তার বশীভূত হয়। আর নরম হলে তাকে তারা শুষ্ক তৃণের মতো মনে করে। যার তেজ তেজস্বীদের দমন না করে, তার জন্ম কেবল মায়ের যৌবনই হরণ করে। এমন জন্ম বৃথা। শত্রুর রক্তে যার মাটি রঞ্জিত না হয়, শত্রুরমণীর অশ্রুতে যার রাজ্য সিক্ত না হয়, সেই রাজা রাজাই নন। তাই আমার মতে সন্ধি নয়, যুদ্ধই একমাত্র সমাধান

সঞ্জীবীর কথায় মেঘবর্ণ দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। সন্ধি, না যুদ্ধ কোনটি কর্তব্য, সে বুঝে উঠতে পারছে না। তাই অনুজীবীকে বলল: ভাই অনু, এবার তুমি বলো আমার কি করা উচিত।

অনুজীবী বিজ্ঞের মতো বলল: মহারাজ, শত্রু ভীষণ পাজি। তদুপরি কৌশলী, আর শক্তিধর। ন্যায়-নীতির কোনো বালাই নেই তার। ও চুক্তিভঙ্গ করবেই। তাই ওর সঙ্গে সন্ধি কিংবা যুদ্ধ কোনোটাই সমীচীন নয়। এক্ষেত্রে যানই উত্তম পন্থা। যান দু-রকম পালানো অথবা অভিযান। শত্রু দুর্ধর্ষ হলে পালিয়ে প্রাণ ও অর্থ বাঁচানোই শ্রেয়। আর যদি জয়ের সম্ভাবনা থাকে, তাহলে যুদ্ধেচ্ছ রাজার উচিত কাৰ্ত্তিক অথবা চৈত্রমাসে অভিযান চালানো। তবে শত্রু বিপন্ন হলে, কিংবা তার কোনো ছিদ্র পাওয়া গেলে, যেকোনো সময়েই অভিযান চালানো যায়। অবশ্য অভিযানের কতগুলো পূর্বশর্ত আছে। শত্রুর রাজ্য যদি আগে থেকেই গুপ্তচররা ঘিরে রাখে। বিশ্বাসী মহাবল সৈন্যরা যদি নিজরাজ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করে। তবেই রাজা অভিযানে যেতে পরেন। রাস্তা, রসদ, মিত্ররাজা, জল ও শস্য এসব নিশ্চিত না করে যে-রাজা অভিযানে যায়, সে আর নিজ-রাজ্যে ফিরে আসে না। যারা বুদ্ধিমান, তারা অনেক সময় মনোভাব চেপে রেখে সবকিছু সহ্য করে। সময়মতো জবাব দেয়। যেমন যুধিষ্ঠির সব বেদনা সহ্য করে বনবাসী হয়েছিলেন। পরে শত্রুকে বিনাশ করে রাজ্য, ধন সবই লাভ করেছিলেন। আর যারা বোকা, তারাই যখন-তখন বলবানের সঙ্গে যুঝতে গিয়ে সবংশে নিধন হয়। তাই আমার মতে বলবানের আক্রমণে এটা আপনার যান, অর্থাৎ অপসারণের সময়, যুদ্ধ বা সন্ধির সময় নয়।

অনুজীবীর পরামর্শের পর এবার মেঘবর্ণ জানতে চাইল প্রজীবীর মত। সে বলল: মহারাজ, সন্ধি, বিগ্রহ, যান কোনোটাই আমার পছন্দ নয়। আমার মতে আসনই (স্বস্থানে থাকা) হচ্ছে শ্রেষ্ঠ পন্থা। দেখুন—কুমির যদি স্বস্থানে (জলে) থাকে, তাহলে গজরাজকেও টেনে নিতে পারে। কিন্তু অস্থানে থাকলে কুকুরও তাকে কাবু করে ফেলে। তাই আমার মতে দুর্গ ত্যাগ করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। শত্রু আক্রমণ করলে দুর্গে থেকেই বন্ধুর সাহায্য চাওয়া যেতে পারে। শত্রু আসছে শুনে একবার দুর্গ ত্যাগ করলে, পুনরায় সেখানে আর ঢোকা যাবে না। তাইতো শাস্ত্র বলেছে:

দাঁতহীন সর্প আর মদমত্ত হাতি
রাজ্যভ্রষ্ট রাজা—সব হয় আত্মঘাতী।
শক্তি যত থাকে থাক, কি-বা আসে যায়
অবহেলে এ-সবেরে ঠেলে লোকে পায়।।

তাই দুর্গ সুদৃঢ় করে, ভালো-ভালো যোদ্ধা ও মিত্রদের রেখে, চারদিকে পরিখা ও প্রাকার নির্মাণ করে এবং নানাবিধ যন্ত্রে সুসজ্জিত করে দুর্গের মধ্যে বসেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া উচিত। বাঁচলে রাজ্য, মরলে স্বর্গ। নীতিবিদরা তাই বলেছেন—

এককাট্টা হয় যদি অনেক দুর্বল
পারে না দমাতে শত্রু—হলেও প্রবল।
একত্র অনেক লতা হয় যদি জড়ো
পারে না উড়াতে তারে ভয়ঙ্কর ঝড়ও॥
বনস্পতি একা যার গভীরে শেকড়
অনায়াসে ভাঙে তারে সাধারণ ঝড়।
মিলেমিশে হয় যারা অতিশয় দৃঢ়
পারে না ভাঙিতে তারে প্রবল ঝড়ও॥
অনুরূপ বীরপুরুষ থাকে যদি একা।
শত্রু হেসে বলে—ওকে যায় না আর রাখা।।

এরপর মেঘবর্ণ চিরঞ্জীবীকে বলল তার মতামত ব্যক্ত করতে। সে বলল: মহারাজ, আমার মতে ছয় গুণের মধ্যে সংশয়ই শ্রেষ্ঠ। বিপদে কারো আশ্রয় নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। দেখুন, আগুনের যতই তেজ থাকুক, বায়ুর আশ্রয় না পেলে সে নিভে যায়। সুতরাং আপনি এখানে থেকেই সমর্থ কাউকে আশ্রয় করুন, যিনি বিপদে আপনার সহায় হবেন। কিন্তু স্বস্থান ছেড়ে অন্যত্র গেলে আপনাকে মুখের কথায়ও কেউ সাহায্য করবে না। দাবানল যখন বন পোড়ায়, বাতাস তখন তার বন্ধু হয়। কিন্তু সে-ই আবার ক্ষুদ্র প্রদীপকে নিভিয়ে দেয়। তাই দুর্বলের কেউ বন্ধু হয় না। আবার এটাও ঠিক যে, কেবল বলবানকেই আশ্রয় করতে হবে তা নয়, অনেক দুর্বল এক হলেও বিপদ এড়ানো যায়। বাঁশবনে চারদিকে বাঁশে-বাঁশে ঘেরা দুর্বল বাঁশটিকেও ঝড় হেলাতে পারেনা। আবার মহৎ জনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনেও অবস্থার উন্নতি হয়, যেমন পদ্মপাতায় জল রাখলে তা মুক্তার আকার ধারণ করে। সুতরাং আমার অভিমত, এমন কোনো মহৎ ব্যক্তির আশ্রয় গ্রহণ করাই উত্তম।

একে-একে পাঁচজন মন্ত্রীর পরামর্শ শোনা হলো। এবার স্থিরজীবীর পালা। মেঘবর্ণ বলল: ভদ্র, আপনি সবচেয়ে প্রবীণ মন্ত্রী। সর্বশাস্ত্রে পারঙ্গম। এবার আপনি বলুন, এখন আমার কি করা উচিত।

স্থিরজীবী গম্ভীরভাবে বলল: মহারাজ, এরা সকলে নীতিশাস্ত্রসম্মত কথাই বলেছে। এদের পরামর্শ সবকটিই খাটে। তবে ঠিক ঠিক সময়ে। কিন্তু এখন হলো দ্বৈধীভাব, অর্থাৎ ছলনার সময়। শুনুন, শত্রু যদি দুষ্ট আর বলবান হয়, তাহলে তার সঙ্গে মনে এক, মুখে আর এরূপ ব্যবহার করণীয়। তাকে কখনোই বিশ্বাস করবেন না। সামনা—সামনি সন্ধি করবেন, কিন্তু পেছনে থাকবে বিগ্রহের ভাব। নিজে বিশ্বাস না করে যারা শত্রুকে প্রলোভন দেখিয়ে বিশ্বাস করায়, তারা অনায়াসেই শত্রুর মূলোচ্ছেদ করতে পারে। বুদ্ধিমানরা শত্রুকে প্রথমে বাড়তে দেয়, পরে সমূলে বিনাশ করে। যেমন বৈদ্যরা ওষুধ প্রয়োগে প্রথমে রোগের বৃদ্ধি ঘটায়, পরে সেই ওষুধেই তা নিবারণ করে। স্ত্রীলোক, শত্রু, দুষ্টবন্ধু আর বারাঙ্গনা এদের যারা বিশ্বাস করে, তাদের জীবন-সংশয় ঘটে। বিশ্বাস যদি করতে হয় তাহলে করবেন কেবল নিজেকে, ব্রাহ্মণকে, গুরুকে, ব্রহ্মজ্ঞানীকে আর দেবতাকে। বাকিদের বেলায় মুখে এক, মনে আর। নারীলুব্ধ পুরুষ আর রাজাকে বিশ্বাসের তো প্রশ্নই ওঠেনা। কাজেই দ্বৈধীভাব আশ্রয় করলে আপনি স্বস্থানে থাকতে পারবেন এবং প্রলোভন দেখিয়ে শত্রুকেও মারতে পারবেন। শত্রুর কোনো ছিদ্র দেখতে পেলে তার গুহায় গিয়ে তাকে মেরেও ফেলতে পারবেন। স্থিরজীবীর কথা শুনে মেঘবর্ণ বলল: কিন্তু আমরা তো শত্রুর থাকার জায়গাই জানি না। তাই কি করে ছিদ্র জানব?

স্থিরজীবী: এটা কোনো ব্যাপারই নয়। গুপ্তচরের সাহায্যে সবই জানা যায়। শাস্ত্রে আছে–গরু দেখে গন্ধ দিয়ে, ব্রাহ্মণ দেখে বেদ দিয়ে, রাজা দেখে চর দিয়ে, আর সাধারণ মানুষ দেখে চোখ দিয়ে। যারা গুপ্তচর দিয়ে নিজের এবং শত্রুর তীর্থসমূহ ভালো করে জেনে নেয়, তাদের কোনো দুর্গতি হয় না।

মেঘবর্ণ: মহোদয়, তীর্থ কি? তা কয়টি ও কি কি? আমায় খুলে বলুন।

স্থিরজীবী: তীর্থ হলো রাজকার্যে নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ। শত্রুপক্ষের তীর্থ আঠারো প্রকার–মন্ত্রী, পুরোহিত, সেনাপতি, যুবরাজ, দৌবারিক (দারোয়ান), আন্তবাসিক (অন্তঃপুর রক্ষক), প্রশাসক (প্রধান পরামর্শদাতা), সমাহর্তা (উৎসব-অনুষ্ঠানাদির ব্যবস্থাপক), সন্নিধাতা (সভাসদদের পরিচয়দানকারী), প্রদেষ্টা (প্রধান বিচারক), জ্ঞাপক (অনুরোধ—আবেদনের ব্যবস্থাপক), সাধনাধ্যক্ষ (সৈন্যাধ্যক্ষ), গজাধ্যক্ষ, কোশাধ্যক্ষ, দুর্গপাল, করপাল (কালেক্টর), সীমাপাল ও প্রোকটভৃত্যবর্গ (পদস্থ কর্মচারিগণ)। গুপ্তচরের মাধ্যমে এদের হাত করতে পারলে যুদ্ধজয় অনিবার্য।

আর নিজপক্ষের তীর্থ হলো পনেরো প্রকার–পাটরানি, রাজমাতা, কঞ্চুকী, মালী, শয্যাপালক, স্পশাধ্যক্ষ (প্রধান গুপ্তচর), সাংবাৎসরিক (দৈবজ্ঞ), ভিষক (চিকিৎসক), জলবাহক, তাম্বুলবাহক, আচার্য, অঙ্গরক্ষক, স্থানচিন্তক, ছত্রধর এবং বিলাসিনী। গুপ্তচর দ্বারা এদের সম্পর্কে জানতে হবে। কারণ, এদের শত্রুতায় স্বপক্ষের ধ্বংস ত্বরান্বিত হয়।

মেঘবর্ণ: তীর্থ তো বুঝলাম। কিন্তু গুপ্তচর কারা?

স্থিরজীবী: ভালো কথা। মন দিয়ে শোনো। আচার্য, দৈবজ্ঞ ও বৈদ্য—এরা হলো স্বপক্ষের গুপ্তচর। এরা অবিশ্বাসী হলে এদের মাধ্যমে স্বপক্ষের কথা শত্রুর কাছে পৌঁছায়। আর সাপুড়ে এবং পাগল এরা হলো শত্রুপক্ষের গুপ্তচর। এদের মাধ্যমে শত্রুর খবর জানা যায়। রাজনীতিশাস্ত্রে বলা হয়েছে শত্রু হলো গভীর জল। তীর্থ তার সিঁড়ি। নিপুণ চরেরা এই সিঁড়ি বেয়ে গভীরে নেমে তলার সব খবর সংগ্রহ করে। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো প্রবীণ মন্ত্রী স্থিরজীবীর কথা শুনছিল। কিছুক্ষণ পরে মেঘবর্ণ বলল: মহোদয়, অনেক কিছুই তো জানলাম। আমার আরেকটা বিষয় জানার খুব আগ্রহ। এই যে কাক ও পেঁচায় চিরশত্রুতা—এর কারণ কি? একটু খুলে বলুন না।

স্থিরজীবী হেসে বলল: শুনবেন? তবে শুনুন। একদিন বক-পেঁচা, ময়ূর-ঘুঘু, হাঁস-টিয়া, কোকিল-মোরগ সবাই একত্র সমবেত হয়েছে। সবার কপালে দুশ্চিন্তার রেখা। তাদের কি হবে! তাদের রাজা গরুড় কোনো খোঁজ-খবর নিচ্ছে না। সে কেবল বিষ্ণুর ধ্যানে মগ্ন। পাখিরা নিত্য ব্যাধের জালে আটকা পড়ছে। খাবার খেতে গেলেই ধরা পড়ছে। বাঁচার কোনো উপায় নেই। তাই তারা বলাবলি করছে এমন রাজা থেকেই বা কি? শাস্ত্রে আছে যে-রাজা শত্রুর হাত থেকে প্রজাদের রক্ষা না করে, যমে আর তাতে পার্থক্য কি? রাজা যদি প্রজাদের সঠিকভাবে না চালায়, তাহলে তারা মাঝিহীন নৌকার মতো অগাধ জলে ডুবে মরে। যে-গুরু বাগ্মী নয়, যে-ব্রাহ্মণ বেদাধ্যয়ন করে না, যে—রাজা প্রজাদের রক্ষা করে না, যে-স্ত্রীর মুখে কেবল অপ্রিয় বচন, যে-রাখাল কেবল গ্রাম ভালোবাসে, যে-নাপিত কেবল বন ভালোবাসে, তারা এবং সাগরপাড়ের ভাঙা নৌকা এ-ছয়টি সর্বদা পরিত্যাজ্য। তাই পাখিরা ঠিক করল নতুন কাউকে রাজা করবে।

এরূপ সিদ্ধান্তের পর সবাই সবাইর দিকে তাকাতে লাগল। কেউ কোনো কথা বলছে না। সভার এক কোণে চুপটি করে বসে ছিল এক পেঁচা। সবাই বলে উঠল—পেঁচাই হবে আমাদের নতুন রাজা। দিনের বিপদ তবু দেখা যায়। কিন্তু রাতের বিপদ? পেঁচা রাতে দেখে। আর কেউ না। অতএব, তাকেই রাজা করা হোক।

সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে সবাই অভিষেকের আয়োজন করতে লাগল। নানান তীর্থের জল আনল। একশ আট রকমের ওষধি আনল। রাজার দীর্ঘায়ু কামনায়। সাত মহাদেশের মাটি আনল। সাত সমুদ্রের বালি আনল। সাত পাহাড়ের বৃক্ষ এনে মণ্ডপ সাজালো। বাঘের চামড়া বিছালো। তার উপর সিংহাসন সাজালো। শত সোনার কলসিতে জল ভরল। সহস্র প্রদীপে দশদিক উদ্ভাসিত করল। বাদ্যি-বাজনায় সমুদ্র গর্জে উঠল। বৈতালিকের স্তুতিপাঠে বাতাস প্রকম্পিত হলো। ব্রাহ্মণদের বেদপাঠে বনে-বনে মর্মর ধ্বনি উঠল। যুবতীদের গানের তালে অপ্সরীরা নাচতে লাগল। এমনিভাবে যখন অভিষেকের আয়োজন চলছিল, তখন সেখানে উপস্থিত হলো এক কাক। সে চারদিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে জানতে চাইল: এ কিসের আয়োজন?

তাকে দূর থেকে আসতে দেখে পাখিরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল—পাখিদের মধ্যে সবচেয়ে চালাক-চতুর হচ্ছে কাক। কথায় বলে—

নরের মধ্যে নাপিত ধূর্ত, পাখির মধ্যে কাক।
দন্তীর মধ্যে শেয়াল ধূর্ত, মুনীষু দুর্বাক।।

তাছাড়া অনেকের সঙ্গে আলোচনা করে কোনো পরিকল্পনা করলে তা ব্যর্থ হয় না। তাই ওকেও ব্যাপারটা বলা উচিত। এরূপ সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা বলল: শোনো ভাই, আমাদের রাজা থেকেও নেই। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি পেঁচাকে রাজা করব। তারই অভিষেক হচ্ছে। তা তোমার মতটাও বল।

কাক অট্টহাসি হেসে বলল: ময়ূর, হাঁস, কোকিল ইত্যাদি থাকতে ঐ দিন-কানাটা হবে রাজা! তার আবার ঘটা করে অভিষেক! ছ্যাঃ! আমার এতে মত নেই। যাকে দেখলে ভয় করে। যার নাক ব্যাঁকা, চোখ ট্যারা। না-রাগতেই যাকে ভয়ঙ্কর লাগে। তাকে রাজা করে কি লাভ? তাছাড়া রাজা তো আমাদের আছে। এক দেশে দুই রাজা ভালো নয়। শাস্ত্রে আছে—

রাজ্যে যদি বলবান এক রাজা হয়
থাকে সেথা সব প্রজা হয়ে নির্ভয়।।
বহু রাজা হলে তথা ধ্বংস নিশ্চয়
একাধিক সূর্যে যেমন সঙ্ঘটে প্রলয়।।

তাছাড়া, রাজা যদি শক্তিমান হয়, তাহলে শত্রুর সামনে তার নামটি নিলেই সুফল পাওয়া যায়, যেমন শুধু চাঁদের নামটি নিয়েই খরগোসরা সুখে আছে।

পাখিরা: সে কি রকম?

কাক: শোনো তাহলে ..

হাতি ও খরগোস

এক বনে থাকত এক হাতির দল। দলপতির নাম বৃহদ্দন্ত। দাঁতদুটি বিশাল তো। তাই এ নাম। তবে দেহখানাও প্রকাণ্ড।

ঐ এলাকায় একবার ভীষণ খরা দেখা দিল। বহু বছর বৃষ্টি হয় না। সবকিছু শুকিয়ে কাঠ। ডোবা, পুকুর, দিঘি—সব ফেটে চৌচির। তেষ্টায় সব ছটফটিয়ে মরছে। এমন অবস্থায় হাতির দল একদিন বৃহদ্দন্তের কাছে গিয়ে বলল: মহারাজ! তেষ্টায় সব মারা যাচ্ছে। একটা কিছু করুন। যেভাবেই হোক একটা জলাশয় যে খুঁজে বের করতেই হয়। নইলে অন্যদের মতো হাতির দলও আর থাকবে না। বিপদে আপনি না বাঁচালে আর কে বাঁচাবে আমাদের?

বৃহদ্দন্ত কিছুক্ষণ ভেবে বলল: উপায় একটা আছে। তবে বেশ দূর।

সকলে: কোথায়, মহারাজ?

বৃহদ্দন্ত: পাঁচদিনের পথ। এক নির্জন জায়গায় এক প্রকাণ্ড ঝিল আছে। পাতালগঙ্গার সঙ্গে তার যোগ। ফটিকের মতো স্বচ্ছ জল। টলটল করছে।

হাতির পাল যেন প্রাণ ফিরে পেল। তারা সোৎসাহে বলল: তবে সেখানেই চলুন। তা-ই হলো। হাতির দল পাঁচদিন হেটে সেই ঝিলে গিয়ে পৌঁছল। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই টলটলে জলে। আকণ্ঠ জলপান করল। তৃষ্ণা মেটাল তৃপ্তি ভরে। মনের আনন্দে গা ডুবিয়ে থাকল অনেকক্ষণ। বাচ্চা হাতিগুলো স্বভাববশে ছোটাছুটি শুরু করল। ঝিলের পার দিয়ে অন্যরাও আনন্দে মেতে উঠল। চারপাশের কচিকচি ঘাস ও লতাপাতা খেয়ে খিদে মেটাল। এ যেন মৃতদেহে জীবন ফিরে পাওয়া। কেউ কেউ বলল: এখানেই থাকব। স্থায়ীভাবে। দলপতিও সায় দিল।

কিন্তু সমস্যা হলো খরগোসদের। ঝিলের চারপাশে গর্তে থাকত একদল খরগোস। তাদের বহুদিনের বাস। বংশপরম্পরায়। এতদিন তাদের এক নিশ্চিন্ত জীবন ছিল। হাতির পায়ের চাপে তাদের জীবন এখন বিপন্ন। অনেকেই মারা গেছে। অনেকের হাত-পা ভেঙ্গে গেছে। কেবল প্রাণে বেঁচে আছে। এ অবস্থায় তারা মন্ত্রণায় বসল। হাতিরা তখন বনের ধারে বিশ্রাম নিচ্ছে। খরগোসদের একজন দলপতিকে বলল: প্রভু! এর একটা বিহিত না করলে পৃথিবী যে খরগোসশূন্য হয়ে পড়বে।

দ্বিতীয়: প্রভু! এ হাতির দল এখান থেকে যাবে না। কারণ, এ বনের আর কোথাও জল নেই। তার মানে, আমরা সবাই মারা পড়ব। কথায় বলে না—

সাপ মারে নিঃশ্বাসে, হাতি মারে পিষ্টে।
রাজা মারে হাসতে হাসতে, মাথায় তুলে দুষ্টে।।

সুতরাং, একটা উপায় করুন।

তৃতীয়: প্রভু! আমার মতে দেশ ছেড়ে যাওয়াই ভালো। কারণ, মনু ও মহর্ষি ব্যাস বলেছেন—বংশের স্বার্থে কুলাঙ্গারকে ছাড়বে। গ্রামের স্বার্থে বংশ ছাড়বে। দেশের স্বার্থে গ্রাম ছাড়বে। আর নিজের স্বার্থে জগৎ ছাড়বে।

এতক্ষণ দলপতি খরগোসদের কথা শুনছিল। এবার সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল: তোমাদের সব কথায়ই যুক্তি আছে। কিন্তু বাপ-পিতামো’র ভিটে ছেড়ে চাইলেই কি যাওয়া যায়? না-কি যাওয়া উচিত? বরং এমন কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি-না, যাতে ওরা আর এখানে না আসে?

সবাই একটু নীরব থেকে বলল: কি ব্যবস্থা?

দলপতি: ওদের এমন ভয় দেখাতে হবে, যাতে আর এদিকে আসার সাহস না পায়। খরগোসরা: কিন্তু আমাদের সে শক্তি কোথায়?

দলপতি: সব সময় শক্তি দিয়ে কাজ হয়না। বুদ্ধিও খাটাতে হয়। দেখ—নির্বিষ সাপ ও যদি ফণা তোলে, তাহলে তাতেও লোকে ভয় পায়। সুতরাং আমরা ক্ষুদ্র হলেও ওদের ভয় দেখাতে দোষ কি? তাতে কাজ না হলে তখন না হয় দেশ ছাড়ব।

দলপতির প্রস্তাব সবার পছন্দ হলো। তারা সায় দিয়ে বলল: তবে তা-ই হোক।

দলপতি: কিন্তু এর জন্য আমার একজন বুদ্ধিমান ও চতুর লোকের দরকার, যাকে দূত করে ওদের কাছে পাঠানো যায়। রাজনীতিশাস্ত্রে আছে—যে সাজিয়ে-গুছিয়ে কথা বলতে পারে, দেখতে সুন্দর, সর্বশাস্ত্রে অভিজ্ঞ, বিশ্বস্ত, নির্লোভ, অন্যের মন বুঝতে পারে এমন লোককেই দূত করা যায়। তাহলে বিজয় অবশ্যম্ভাবী। মূর্খ, মিথ্যেবাদী, লোভী—এমন কাউকে দূত করলে সেই রাজার পরাজয় কেউ ঠেকাতে পারে না।

কিছুক্ষণ চিন্তা করে খরগোসদের একজন বলল: মহারাজ! এমন একজন আছে। লম্বকর্ণ। আপনি যেমনটি বললেন, ঠিক তেমনটি।

দলপতির আদেশে লম্বকর্ণকে হাজির করা হলো। দলপতি তাকে সবকিছু বুঝিয়ে বৃহদ্দন্তের কাছে পাঠালো। তখন রাত নেমে এসেছে। চারদিকে দুধরং জোছনা। হাতির পাল তখনও বিশ্রাম নিচ্ছে। দীর্ঘদিন পরে তেষ্টা আর খিদা মেটানোর তৃপ্তি। তাই এক ধরনের ক্লান্তিতে তারা আচ্ছন্ন। লম্বকর্ণ একটা উঁচু টিলার উপরে উঠে বৃহদ্দন্তকে উদ্দেশ্য করে বলল: ওহে গজরাজ! বলা নেই কওয়া নেই, একেবারে চন্দ্রঝিল জুড়ে বসেছ দেখছি। প্রভুর আদেশ—জীবন বাঁচাতে হলে পালাও এখান থেকে।

বৃহদ্দন্ত তাকিয়ে বলল: তুমি কে হে? তোমার এত সাহস যে, আমাকে শাসাচ্ছ? কে তোমার প্রভু?

আমি লম্বকর্ণ। থাকি চন্দ্রমণ্ডলে। আমার প্রভু চন্দ্রদেব। আমি তাঁর দূত। তিনি আমায় পাঠিয়েছেন। তুমি নিশ্চয়ই জান যে, দূতরা অবধ্য। তাই আমার কথা বলতে কোনো ভয় নেই।

লম্বকর্ণের মুখে চন্দ্রদেবের কথা শুনে বৃহদ্দন্ত একটু ভয় পেয়ে গেল। সে কিছুটা কম্পিত কণ্ঠে বলল: তা ভগবান চন্দ্রদেব এখন কোথায়? তাঁর সংবাদ বলো।

বৃহদ্দন্তের কণ্ঠ কাঁপছে দেখে লম্বকর্ণের মনে সাহসের সঞ্চার হলো। ওষুধে কাজ হয়েছে। সে দৃঢ় কণ্ঠে বলল: দিনের বেলা তোমাদের পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে অনেক খরগোস মারা গেছে। খরগোসরা প্রভুর লোক। এ খবর শুনে তিনি ওদের দেখতে এসেছেন। তিনি এখন চন্দ্রঝিলে আছেন। আর আমাকে পাঠিয়েছেন তোমার কাছে। বৃহদ্দন্ত এবার সত্যিই ভয় পেয়ে গেল। সে লম্বকর্ণকে বলল: বন্ধু! আমাকে প্রভুর কাছে নিয়ে চল। আমি তাঁকে প্রণাম করে এ বন ছেড়ে চলে যাব।

লম্বকর্ণ: তা-ই হোক। তবে তুমি একা এস। প্রভুর মেজাজ এমনিতেই তুঙ্গে উঠে আছে।

এই বলে লম্বকর্ণ বৃহদ্দন্তকে সঙ্গে নিয়ে ঝিলের পারে গেল। ঝিলের জলে তখন চাঁদের আলো পড়ে ঝিকমিক করছে। লম্বকর্ণ চুপিচুপি বলল: প্রভু ধ্যানস্থ আছেন। তুমি নীরবে প্রণাম করে সরে পড়।

বৃহদ্দন্ত: তা-ই হোক।

এই বলে শুঁড় তুলে প্রণাম জানিয়ে দলবল নিয়ে অন্যত্র চলে গেল। আর খরগোসরাও সপরিবার পূর্বের ন্যায় নিশ্চিন্তে জীবন কাটাতে লাগল।

কাক সবার দিকে তাকিয়ে বলল: তাই বলছিলুম, রাজা শক্তিমান হলে, তাঁর নাম নিলেই শত্রুরা ভয়ে পালায়। তাই যারা বাঁচতে চায় তারা কখনো নীচ, কাপুরুষ, নেশাগ্রস্ত, অকৃতজ্ঞ, নিন্দুক, বিশ্বাসঘাতক কিংবা দুর্বলকে রাজা অথবা বিচারক করেনা। সেটা করতে গিয়েই শশক এবং কপিঞ্জল দুজনেই প্রাণ হারাল।

পাখিরা: কিভাবে?

কাক: এভাবে …

চড়ুই খরগোস বেড়াল

অনেক দিন আগের কথা। গঙ্গার ধারে ছিল এক বিশাল বটগাছ। তার ডালে ছিল আমার বাসা। নিচে কোটরে থাকত এক চড়ুই। নাম কপিঞ্জল। দুজনে বেশ ভাব। এক সঙ্গে সকালে বেড়িয়ে যেতাম। আবার সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতাম।

বেশ কাটছিল আমাদের দিন। কত গল্পগুজব করতাম। দেবর্ষি, রাজর্ষি, ব্ৰহ্মর্ষি প্রভৃতি আদ্যিকালের মনীষীদের কথা বলতাম। সারাদিন কে কি দেখেছি—তাও বাসায় এসে বর্ণনা করতাম।

একদিন কপিঞ্জল আমাকে ছাড়াই আহারে গেল। অন্য চড়ুইদের সঙ্গে। পাকা শালিধানে ভর্তি ভিন্ন এক গাঁয়ে। কিন্তু ভাবনায় পড়ে গেলাম সে ফিরে না আসায়। রাত হয়ে এল। তবুও সে ফিরল না। আমার ভীষণ চিন্তা হলো। কষ্টও হচ্ছিল। তার বিরহে। মনে শঙ্কা জাগল। তাহলে কি জালে ধরা পড়ল? না-কি কেউ মেরে ফেলল? তা নাহলে আমাকে ছেড়ে থাকার পাত্র সে নয়। তবে কি হলো? আবার ভাবলাম হয়তো সে সঙ্গীদের সঙ্গে ভালই আছে। ভালোবাসার পাত্র দূরে থাকলে অকারণেই এমন শঙ্কা জন্মায়। এমনি ভাবতে ভাবতে কেটে গেল অনেক দিন।

হঠাৎ একদিন দেখি এক খরগোস এসেছে। সুয্যি তখন পাটে বসেছে। খরগোসটি কপিঞ্জলের কোটরে ঢুকে পড়ল। আমি ততদিনে কপিঞ্জলের আশা ছেড়েই দিয়েছি। তাই খরগোসকে আর বাধা দিলাম না।

এর কয়েকদিন পর। আমি তো অবাক! কপিঞ্জল এসে হাজির! আসবে না? কথায় বলে—বিদেশ যতই মধুর হোক, স্বর্গে যতই সুখ থাকুক, আপন দেশে গরিব লোকও যা পায়, তার কোনো জুড়ি নেই। তাই বাড়ির কথা মনে পড়তেই কপিঞ্জলও ছুটে এসেছে। দিনের পর দিন শালিধান খেয়ে-খেয়ে কপিঞ্জলের চেহারা হয়েছিল একেবারে শিবের ষাঁড়ের মতো। চেনাই যাচ্ছিল না। দূরের কেউ হলে চিনতেই পরতাম না। নিকটের বলেই চিনেছিলাম।

কপিঞ্জল কোটরে খরগোসকে দেখে চটে লাল। সুর পঞ্চমে তুলে বলল: কোন সাহসে তুমি আমার বাসায় ঢুকেছ? বের হও! এক্ষুণি!

খরগোস নির্বিকারভাবে বলল: কে বললে এটা তোমার বাসা? এটা আমার বাসা। মিছেমিছি ঝামেলা করো না। তুমি জাননা—

পুকুর কুয়া দিঘি দেউল গাছ কিংবা পাহাড়।
একবার কেউ ছেড়ে গেলে ফিরে পায় না আর।।

তাছাড়া, স্মৃতিকারেরা বলেছেন ক্ষেত-খামার, ঘর-বাড়ি ইত্যাদি কেউ একটানা দশ বছর ভোগ করলে তার স্বত্ব তারই হয়ে যায়। এ-ক্ষেত্রে আর সাক্ষী কিংবা দলিল লাগে না। ভোগস্বত্বই প্রমাণ। কিন্তু এ নিয়ম মানুষের বেলায়। পশু-পাখিদের বেলায় যে যতদিন থাকে। কাজেই এ বাড়ি আমার।

কপিঞ্জল একটু ভেবে বলল: ঠিক আছে। তুমি যদি স্মৃতিই মানো, তাহলে চল কোনো স্মৃতিবিশারদের কাছে যাই। তিনি যা বলবেন, তা-ই হবে।

খরগোস: বেশ তো, চল।

এরপর দুজনে চলল স্মৃতিবিশারদের কাছে। বিচারের জন্য। আমার ভীষণ কৌতূহল হলো। বিচারে কি হয় তা দেখার জন্য। তাই আমিও ওদের পেছনে পেছনে চললাম। এদিকে কপিঞ্জল এবং খরগোসের মধ্যে যখন কথা কাটাকাটি হচ্ছিল, তখন দূর থেকে এক বনবিড়াল তা শুনছিল। তার নাম তীক্ষ্ণদন্ত। সে চুপিচুপি দ্রুত সরে পড়ল। পথে নদীর ধারে এক জায়গায় কুশহাতে করজোড়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে ধর্মোপদেশ দিতে লাগল। সে বলছে—এ-জগৎ মিথ্যা। প্রাণ আছে-কি-নেই। আত্মীয়-পরিজন সব ইন্দ্রজাল। স্বপ্নমাত্র। ধর্মই হচ্ছে একমাত্র সত্য। ধর্মহীন ব্যক্তি কামারের হাপরের মতো। কেবল শ্বাস নেয়, কিন্তু নিষ্প্রাণ। কুকুরের লেজ যেমন মশা-মাছি তাড়াতে পারে না, কিংবা মলদ্বারও ঢাকতে পারে না, ধর্মহীন পাণ্ডিত্যও তেমনি। তা কোনো কাজে লাগে না। বৃক্ষের সার যেমন ফল, দুধের সার যেমন ঘি, তিলের সার যেমন তেল, তেমনি মানুষের সার হলো ধর্ম। যাদের ধর্ম নেই, তারা কেবল খায়-দায় আর মলমূত্র ত্যাগ করে। অন্যের সেবার জন্যই তাদের জন্ম।

তার এই ধর্মোপদেশ শুনে খরগোস বলল: ওহে কপিঞ্জল, ঐ তো একজন তপস্বী বসে আছেন। চলো না ওঁর কাছে যাই। ধার্মিক মানুষ। মিথ্যে বলেন না। তাই ওঁকেই জিজ্ঞেস করি।

কপিঞ্জল বলল: দেখো, ও কিন্তু আমাদের জাতশত্রু। বিশ্বাস করা কঠিন। তাই দূর থেকেই জিজ্ঞেস কর। আমাদের কাছে পেয়ে হঠাৎ যদি ওর ব্রত ভঙ্গ হয়ে যায়! তাহলে ওর পেটেই আমাদের ঠাঁই হবে।

খরগোস মাথা নেড়ে বলল: ঠিক বলেছ, ভাই। তবে তা-ই করি।

এই বলে খরগোস দূর থেকেই জিজ্ঞেস করল: ওহে তপস্বী ঠাকুর, পেন্নাম হই। আমরা আপনার পরামর্শ চাই। আমাদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে। আপনি স্মৃতি অনুসারে বিচার করে দিন। যে মিছে বলছে, তাকে আপনি খাবেন।

তীক্ষ্ণদন্ত জিভ কেটে বলল: এমন কথা বোলো না, ভাই। প্রাণিহত্যা মহাপাপ। নরকের রাস্তা। আমি ওসব ছেড়ে দিয়েছি। অহিংসাই পরম ধর্ম। যারা অহিংস, তারা মশা-মাছি কিংবা উকুন-ছারপোকাও মারে না। তোমাদের মতো এমন সুন্দর প্রাণী মারার তো প্রশ্নই ওঠে না।

কপিঞ্জল বলল: কিন্তু যজ্ঞে যে পশুবলি দেয়া হয়। তাতে কি ধৰ্ম হয় না?

তীক্ষ্ণদন্ত: ও পাপকথা আর মুখে এন না। পশুহত্যা মূর্খদের কাজ। ওরা বেদের সত্যিকার অর্থ জানে না। বেদে আছে ‘অজ’ দিয়ে যজ্ঞ করবে। ‘অজ’ শব্দের একটি অর্থ ছাগল। অপর অর্থ সাত বছরের পুরনো ধান যা থেকে আর অঙ্কুর গজায় না। এটা না জেনেই মূর্খরা পশু হত্যা করে। তাই—

গাছ কেটে পশু মেরে রক্তে করে কাদা।
স্বর্গে যদি যাবে, তবে নরক কেন দাদা??

অতএব, আমি ওসব খাওয়া-টাওয়ার মধ্যে নেই। তবে তোমাদের বিবাদ মেটানোর কথা হলে সে অন্য ব্যাপার। যদি আমাকে সত্যিই বিশ্বাস করো, তাহলে বল, তোমাদের কি সমস্যা?

কপিঞ্জল ও খরগোস উভয়ই এক সঙ্গে বলল: তবে শুনুন।

তীক্ষ্ণদন্ত: দেখো, আমার বয়স হয়েছে। কানে কম শুনি। মামলার ব্যাপার। ভালোভাবে না শুনে ভুল রায় দিলে, আমার পরকালের দরজা যে বন্ধ হয়ে যাবে। শাস্ত্রে আছে না—

অহঙ্কারে লোভে কিংবা ভয়ে কিংবা রাগে।
মিথ্যা রায় দিলে সে-জন কঠিন নরক ভোগে।।

কাজেই তোমরা আমাকে নরকে পাঠিও না। কাছে এসে স্পষ্ট করে বলো তোমাদের কি নিয়ে বিবাদ হয়েছে। আমি যথার্থ রায় দেব।

তীক্ষ্ণদন্তের কথায় কপিঞ্জল ও খরগোস উভয়ই নরম হয়ে গেল। প্রথমে তাদের যে অবিশ্বাস জন্মেছিল, তীক্ষ্ণদন্তের মধুর কথায় তা দূর হয়ে গেল। তারা যেই কাছে গিয়ে কানে-কানে বলতে লাগল, অমনি দুজনকে ধরে খেয়ে ফেলল।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে কাক পাখিদের উদ্দেশে বলল: তোমরাও যদি ঐ দিনকানাটাকে রাজা করো, তাহলে ঐ কপিঞ্জল আর খরগোসের মতোই প্রাণ হারাবে। এখন যা ভালো বোঝ, করো।

কাকের কথা শুনে পাখিরা সব বলে উঠল: তুমি ঠিকই বলেছ। আমরা আবার বসে রাজার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।

এই বলে পাখিরা সব যার-যার বাসায় চলে গেল। বাকি রইল শুধু দিনকানা পেঁচা। অভিষেকের আশায়।

কিছুক্ষণ পরে পেঁচা হাঁক দিয়ে বলল: কৈ হে, তোমরা অভিষেকের আয়োজন করছ না কেন?

পাশে বসা ক্ষুদে শালিক বলল: মহাত্মন, অভিষেক কে করবে? সবাই তো ঐ কাকের কথায় চলে গেছে। সব ভণ্ডুল করে দিয়ে কাকটাই বা কেন বসে আছে কে জানে। তা চলুন, আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি

পেঁচা তখন দুঃখের সঙ্গে কাককে বলল: ওহে কাক, আমি তো তোর কোনো ক্ষতি করিনি। তবে তুই কেন আমার অভিষেকে বাগড়া দিলি? ঠিক আছে, আজ থেকে তোতে-আমাতে জাতশত্রুতা হলো। আর কোনোদিন কাকে-পেঁচায় মিল হবে না। কারণ, তীরের ঘা এক সময় সেরে যায়। ভাঙ্গা তলোয়ারও এক সময় জোড়া লাগে। কিন্তু কথার ঘা এত গভীর হয় যে, তা কখনো সারে না।

এই বলে পেঁচা শালিকের সঙ্গে নিজের বাসায় চলে গেল।

একে একে সবাই চলে যাওয়ার পর কাক ভাবল: কাজটা ভালো হলো না। মিছেমিছি কেন ওর সঙ্গে লাগতে গেলাম? ওতো আমার কোনো ক্ষতি করেনি। জ্ঞানীরা বলেন—অকারণে কেউ যদি কারো সম্পর্কে অপ্রিয় কথা বলে, যা ভবিষ্যতে ক্ষতিকর, তা বিষের চেয়েও ভয়ানক হয়। গায়ে শক্তি থাকলেই বুদ্ধিমানেরা যেচে কারো সঙ্গে শত্রুতা করে না। কিংবা ঘরে ডাক্তার আছে বলেই বিচক্ষণ ব্যক্তি অকারণে বিষপান করে না। যাঁরা প্রকৃত পণ্ডিত, তাঁরা সভার মধ্যে পরনিন্দা করেন না। অপ্রিয় কথা সত্য হলেও তা তাঁরা বলেন না। বিশ্বস্ত বন্ধুদের সঙ্গে বহুবার আলোচনা করে এবং নিজে যুক্তি দিয়ে বিচার করে, তবেই বুদ্ধিমানেরা কাজ করেন। এরূপ চিন্তা করতে করতে কাকও এক সময় বাড়ি চলে গেল।

স্থিরজীবী মেঘবর্ণকে বলল: এই হচ্ছে কাকের সঙ্গে পেঁচার জাতশত্রুতার কারণ।

কিছুক্ষণ পরে মেঘবর্ণ বলল: তা তো বুঝলুম। কিন্তু অরিমর্দনকে দমন করার উপায় কি?

স্থিরজীবী: উপায় আছে। আর কোনোভাবে না হোক, চাতুর্যের আশ্রয়ে ওকে হত্যা করব। তুমি ভেব না। কথায় বলে না—

শত্রু যতই প্রবল হোক      প্রতিপক্ষ দুর্বল হোক
ফন্দি করে মারে তারে।
তিনঠগে তাই যুক্তি করে       কাবু করে বামুনেরে
নিল যে তার ছাগলাটারে।।

মেঘবর্ণ: সে কি রকম?

স্থিরজীবী: শুনুন তাহলে

ব্রাহ্মণ ও তিনঠগ

এক নগরে থাকতেন এক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ। তাঁর ছিল অনেক যজমান। একদিন এক যজমানের বাড়ি গিয়ে তিনি বললেন, তাঁর একটি ছাগলের প্রয়োজন। যজ্ঞ করবেন। যজমান গুরুদক্ষিণা হিসেবে একটি নাদুস-নুদুস ছাগল দান করল। ব্রাহ্মণ হৃষ্টচিত্তে ছাগল নিয়ে রওনা দিলেন।

বেলা তখন যায় যায়। অনেকটা পথ হাটতে হবে। তাই ছাগলটাকে কাঁধে নিয়ে তিনি ছুটলেন।

দূর থেকে তিন ঠগ এ দৃশ্য দেখতে পেল। সারাদিন না খাওয়া। ব্রাহ্মণের কাঁধে এমন একটি নাদুস-নুদুস ছাগল দেখে আর লোভ সামলাতে পারল না। তাই তিনজন ফন্দি করল, যেভাবেই হোক ছাগলটাকে হাত করতে হবে।

এরূপ সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনজন ভিন্ন পথে দ্রুত এগিয়ে গেল। তিনজন তিন জায়গায় ব্রাহ্মণের পথে দাঁড়াল।

ব্রাহ্মণ এক মনে হাটছেন। হঠাৎ প্রথম ঠগ এগিয়ে এসে বিস্ময়ের সঙ্গে বলল : ঠাকুরমশাই, এ কি করছেন? আপনি শাস্ত্র জেনেও অশাস্ত্রীয় কাজ করছেন! একটা গাধাকে কাঁধে নিয়েছেন! ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ! আপনি জানেন না, ব্রাহ্মণের পক্ষে কুকুর, মোরগ, চণ্ডাল, গাধা ও উট স্পর্শ করা নিষেধ?

ব্রাহ্মণ ক্ষেপে গিয়ে বললেন: তুমি কি কানা, যে ছাগলটাকে গাধা বলছ?

ঠগ: আপনি শুধুশুধু ক্ষেপছেন কেন? আমি যা সত্যি তা-ই বললাম। আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি যদি ওটাকে ছাগল মনে করেন, তাহলে নিয়ে চলে যান। আমার কি? ব্রাহ্মণ বিরক্তি প্রকাশ করে বাড়ির দিকে জোর পায়ে হাটতে লাগলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর দ্বিতীয় ঠগ সামনে এসে বলল: হায় হায়! ঠাকুরমশাই, এ কি করেছেন? একটা গাধাকে আপনি কাঁধে নিয়েছেন কেন? আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আপনি জানেন না যে, ব্রাহ্মণ গাধা স্পর্শ করলে তার মাথা মুড়িয়ে চান্দ্রায়ণ করতে হয়? কেউ দেখে ফেললে আপনার সর্বনাশ হবে যে!

ব্রাহ্মণ এবার ধান্দায় পড়ে গেলেন। একই কথা এ-ও বলছে। কারণ কি? তিনি ছাগলটাকে নামিয়ে ভালো করে দেখলেন। তারপর ক্রোধের সঙ্গে বললেন—এটা গাধা নয়, ছাগল। এই বলে আবার কাঁধে নিয়ে হাটতে লাগলেন।

কিছুদূর যেতে-না-যেতেই তৃতীয় ঠগ সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল: ঠাকুরমশাই, আপনার তো সর্বনাশ হয়ে গেল! কেউ যদি দেখে ফেলে যে, আপনি একটা গাধা কাঁধে নিয়ে হাটছেন, তাহলে আপনার যজমান কেউ আর থাকবে না। তাছাড়া শাস্ত্রে আছে না—

বামুন যদি গাধা ছোঁয় জ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে।
তাহার পাপ যায় না কভু নিত্য গঙ্গাস্নানে।।

এবারে ব্রাহ্মণের মতিভ্রম ঘটল। তিনি ভাবলেন, একই কথা তিনজনই বলছে। তাহলে এটা কি সত্যিই গাধা? আমারই কি ভুল হচ্ছে? হবে হয়তো। এই ভেবে তিনি ছাগলটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। আর তিন ঠগ মনের আনন্দে তার মাংসে ভুরিভোজ করল।

স্থিরজীবী একটু বিরাম নিয়ে মেঘবর্ণকে পুনরায় বলল: দেখুন মহারাজ, নতুন চাকর, অতিথির মধুর বচন, যুবতীর কান্না, আর ধূর্তের বাগাড়ম্বরে ভোলেনি—জগতে এমন কে আছে?

মেঘবর্ণ গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলল: যথার্থ বলেছেন।

স্থিরজীবী: আরো শুনুন— একা যতই শক্তিমান হোক, বহু ক্ষুদ্রের সঙ্গে লড়তে গেলে জীবননাশের সম্ভাবনাই বেশি, যেমন হয়েছিল পিপিলিকার সঙ্গে কালকেউটের।

মেঘবর্ণ: কি করে?

স্থিরজীবী: শুনুন সে-কথা …

কেউটে ও পিঁপড়েরা

নদীর ধারে ছিল এক উইয়ের ঢিবি। তার ভেতরে থাকত এক মস্তবড় কালকেউটে। অনেক অহঙ্কার তার। তাই নাম হয়েছিল অতিদৰ্প।

প্রশস্ত প্রবেশদ্বার দিয়ে সে আসা-যাওয়া করত। সচ্ছন্দে। একদিন কি খেয়াল হলো কে

জানে! বরাবরের পথ ছেড়ে সে ঢুকে পড়ল এক সরুপথে। আর যায় কোথা? মাথার দিকটা কিছুটা বের হয়ে দেহটা গেল আটকে। না পারছে সামনে যেতে। না পেছনে। জোরাজুরি করতে গিয়ে চামড়া গেল উঠে। রক্ত ঝরছে। কাঁচা রক্তের গন্ধে কিলবিল করে ছুটে এল পিঁপড়ার দল। চারদিক থেকে। লক্ষ, কোটি, অর্বুদ…। সমস্ত শরীর ছেয়ে ফেলল। লেজ দিয়ে আর কয়টা মারবে? দেখতে দেখতে ঘা ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে। তারপর এক সময় অক্কা পেল অতিদর্প। তাই বলছিলাম—বহুর সঙ্গে একার লড়তে যাওয়া ঠিক নয়।

স্থিরজীবীর মুখে অতিদর্পের করুণ মৃত্যুকাহিনী শুনে মেঘবর্ণ কিছুক্ষণ নীরব থাকল। তারপর স্থিরজীবীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল: তাহলে এখন উপায়? অরিমর্দনের হাত থেকে বাঁচার উপায় কি?

স্থিরজীবী: উপায় আছে, মহারাজ। সাম-দান-ভেদ-দণ্ডের বাইরে পঞ্চম একটি উপায় আছে।

মেঘবর্ণ সোৎসাহে বলল: কি উপায়? খুলে বলুন।

স্থিরজীবী: আপনার-আমার মধ্যে একটা কৃত্রিম কলহ সৃষ্টি করতে হবে। স্বপক্ষ কিংবা বিপক্ষের কেউ জানতে পারবে না। আপনি আমায় অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল দেবেন। আমিও তাই করব। আপনি আমাকে আহত করে রক্তাক্ত অবস্থায় এই বটগাছের নিচে ফেলে দেবেন। এটা জানতে পেরে নিশ্চয়ই অরিমর্দন আমাকে তার দলে টেনে নেবে। কারণ, শত্রুর মন্ত্রীকে হাত করতে পারলে শত্রুকে জয় করা সহজ হবে। এভাবে আমি অরিমর্দনের দুর্গে ঢোকার সুযোগ পাব। তাদের সব গোপন খবর জেনে একযোগে আক্রমণ করব। এছাড়া আর উপায় নেই ওদের হাত থেকে বাঁচার।

মেঘবর্ণ কিছুক্ষণ চিন্তা করে উদ্বেগের সঙ্গে বলল: কিন্তু আপনার সঙ্গে এমন দুর্ব্যবহার আমি করব কি করে? তাছাড়া ধরা পড়লে আপনাকে তো ওরা মেরে ফেলবে!

স্থিরজীবী হাসতে হাসতে দৃঢ়কণ্ঠে বলল: মহারাজ! যারা রাজার চাকরি করে, তারা রাজার জন্য জীবন উৎসর্গ করেই আসে। রাজা এবং রাজ্যের মঙ্গল ছাড়া রাজকর্মচারীদের অন্য কোনো আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারেনা। তাই আমার কথা ভেবে আপনি কাতর হবেন না। রাজনীতিশাস্ত্রে রাজার উদ্দেশে বলা হয়েছে:

ভৃত্যবর্গে পালন করো নিজের মতো।
যুদ্ধ বাঁধলে তারাই হবে হতাহত।।

তাই এ ব্যাপারে আপনি আর আপত্তি করবেন না।

স্থিরজীবীর যুক্তির কাছে মেঘবর্ণ হার মানল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে তার কথায় সম্মত হলো। তারপর পরিকল্পনা অনুযায়ী সবার সামনে একদিন দুজনে কলহ শুরু করল। অন্য ভৃত্যরা স্থিরজীবীকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলো। ওর এতবড় স্পর্ধা যে মহারাজের সঙ্গে বেয়াদপি করে! কিন্তু মেঘবর্ণ সকলকে শান্ত করে বলল: ওকে আমার হাতে ছেড়ে দাও। শত্রুর দালালটাকে আমিই শায়েস্তা করব।

এই বলে মেঘবর্ণ স্থিরজীবীর উপর চড়াও হলো। ঠোঁট দিয়ে হালকাভাবে ঠুকরে ঠুকরে সামান্য আহত করল। আর গোপনে আনা রক্ত লাগিয়ে তাকে নিচে ফেলে দিল। এদিকে দিন গড়িয়ে রাত এল। অরিমর্দনের চর তখন সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। স্থিরজীবীর কাতরানো শুনে কাছে গেল। স্থিরজীবী সব খুলে বলে অরিমর্দনের আশ্রয় চাইল। চর তাকে আশ্বস্ত করে ছুটে গেল অরিমর্দনের কাছে। অরিমর্দন সব শুনে মন্ত্রীদের ডেকে বলল: শত্রুকে আক্রমণ করার এটাই সময়। অন্তর্কলহ হচ্ছে ধ্বংসের মূল কারণ। মেঘবর্ণের রাজভৃত্যরা এখন কলহে লিপ্ত। তাইতো প্রধানমন্ত্রীকে তারা বের করে দিয়েছে। দেখ— কোনো ছিদ্র ছাড়া শত্রুকে ঘায়েল করা যায় না। এ ক্ষেত্রে প্রথম ছিদ্র হলো শত্রুপক্ষের কাউকে হাত করা। আর দ্বিতীয় ছিদ্র হলো সুকৌশলে শত্রুর আশ্রয় লাভ করা। কারণ—

ছিদ্র ছাড়া দেবশত্রুও হয়না কভু জব্দ।
ছিদ্র পেয়েই দিতির উদর চিড়েছিলেন ইন্দ্ৰ।।

অরিমর্দনের কথা শুনে জনৈক মন্ত্রী বলল: মহারাজ, দিতির ঘটনাটা কি রকম?

অরিমর্দন: শুনবে? তবে শোনো। ইন্দ্রের মা অদিতি। তাঁর বিমাতা ছিলেন দিতি। দিতিও চাইতেন ইন্দ্ৰতুল্য তাঁরও এক পুত্র হোক। কালক্রমে তিনি গর্ভবতী হলেন। এ খবরে অদিতি ঈর্ষান্বিত হলেন। তাঁর সপত্নীহিংসা ছিল অত্যন্ত প্রবল। তিনি চাইতেন না, দিতিও তাঁর মতো সৌভাগ্যবতী হোক। কিংবা ইন্দ্রের জায়গা অন্য কেউ দখল করুক। তাই পুত্রকে আদেশ দিলেন দিতির গর্ভ নষ্ট করতে। মায়ের আদেশে ইন্দ্ৰ সুযোগ খুঁজতে থাকেন। এক সময় তিনি অসুস্থ বিমাতার শুশ্রূষার ভার নিলেন। একদিন দিতি যখন ঘুমিয়েছিলেন, তখন যোগবলে তাঁর উদরে ঢুকে তিনি গর্ভের সন্তান নষ্ট করেন।

মন্ত্রী: কিন্তু এ তো অন্যায়, মহারাজ!

অরিমর্দন: লৌকিক বিচারে এ অন্যায় বটে, কিন্তু রাজনৈতিক বিচারে অন্যায় নয়। ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’—এ হচ্ছে রাজনীতির কথা। যাহোক, বিলম্ব না করে চলো আমরা মেঘবর্ণের দুর্গে যাই। কারণ সময়ের কাজ সময়ে না করলে অসময়ে তা সম্ভব হয়না।

এই বলে অরিমর্দন সদলবল গিয়ে মেঘবর্ণের দুর্গ ঘিরে ফেলল। কেউ একজন স্থিরজীবীকে দেখিয়ে বলল: বুড়োটাকে মেরে ফেলি। কেউ বলল: ও এমনিতেই মরবে। বরং আমরা একযোগে ওদের আক্রমণ করি।

এরূপ যখন বলাবলি হচ্ছিল, তখন স্থিরজীবী মনে-মনে ভাবল: আমার মৃত্যু কিংবা দুর্গ আক্রমণ এর যে-কোনটা হলেই আমাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। উপরন্তু কাকের বংশ ধ্বংস হয়ে যাবে। তাহলে এসব করে আর কি লাভ হলো? শাস্ত্রে আছে—বুদ্ধিমানের প্রথম লক্ষণ হঠাৎ কাজ শুরু না করা। দ্বিতীয় লক্ষণ শুরুকরা কাজ শেষ করা। শুরু করে শেষ না করা—এর চেয়ে মূর্খতা আর কি হতে পারে?

এসব ভেবে স্থিরজীবী অরিমর্দনের উদ্দেশে বলল: মহারাজ, আমার মৃত্যু কোনো ব্যাপার নয়। এতদিন যার সেবা করলুম, সে-ই আমার এই দশা করল! কাজেই মরতে আমার কষ্ট নেই। তবে যা করবেন ভেবে-চিন্তে করবেন। মরার আগে আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই। যদি সুযোগ দেন।

অরিমর্দন কাছে গিয়ে বলল: বলো, তোমার কি কথা আছে।

স্থিরজীবী: মহারাজ, অগুণিত কাক আপনাদের হাতে মারা পড়েছে। সেই শোকে ক্ষেপে গিয়ে মেঘবর্ণ কাল আপনাদের আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিল। আমি বললাম বলবানের সঙ্গে যুঝতে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাতে বিপদ বাড়ে। দুর্বল ব্যক্তি মনে-মনেও সবলের সঙ্গে বিরোধ করেনা। বরং বেতসলতার মতো নত হয়ে চলে। আর পতঙ্গের ন্যায় করলে পুড়ে মরে। রাজনীতির নিয়ম হচ্ছে— শত্রু বলবান হলে সর্বস্ব দিয়ে হলেও তার সঙ্গে সন্ধি করতে হবে। কারণ, প্রাণ থাকলে ধন হবে। একটু দম নিয়ে পুনরায় বলল: মেঘবর্ণ হয়তো আমার কথা মানত। কিন্তু অন্যরা তা হতে দেয়নি। তারা তাকে সত্যি-মিথ্যা বুঝিয়ে আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলল। তাই মেঘবর্ণ নিজে আমার এই দশা করল। এখন আপনিই ভরসা। যদি অভয় দেন তবে সেরে উঠে মেঘবর্ণকে ধ্বংস করব। এই আমার প্রতিজ্ঞা।

অরিমর্দন ভাবল প্রস্তাবটা মন্দ নয়। শত্রুর ঘনিষ্ঠজনকে হাত করা মানে শত্রুকেই মুঠোয় পাওয়া। এর দ্বারা অনায়াসেই মেঘবর্ণকে ঘায়েল করা যাবে। কাকের বংশও ধ্বংস করা যাবে।

এরূপ চিন্তা করে অরিমর্দন মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শে বসল। তার মন্ত্রী ছিল পাঁচজন রক্তাক্ষ, ক্রূরাক্ষ, দীপ্তাক্ষ, বক্রনাস এবং প্রাকারকর্ণ। রক্তাক্ষকে বলল: ভদ্র, শত্রুর মন্ত্রী আমাদের হাতের মুঠোয়। এখন আমাদের কি করা উচিত?

রক্তাক্ষ দৃঢ়কণ্ঠে বলল: মহারাজ, এতে আর ভাবনার কি? ওকে নির্বিচারে হত্যা করতে হবে। কারণ, দুর্বল থাকতেই শত্রুকে মারতে হয়। পরে বলবান হলে আর পারা যায় না। আর যুদ্ধের ব্যাপারে বর্তমানই সত্য, ভবিষ্যৎ অজ্ঞেয়। তাছাড়া কোনো ব্যাপারে অধিক লোভ করতে নেই। তাতে কার্যসিদ্ধি হয়না। যেমন—

দিনার লোভে শোক ভুলিয়া হয়ে বেজায় মত্ত।
পুত্রখেকো সাপকে দুধ খাওয়ায় হরিদত্ত।।

অরিমর্দন: সে আবার কি?

রক্তাক্ষ বলতে লাগল : …

হরিদত্ত ও গোখরো

কোনও এক গ্রামে থাকত এক ব্রাহ্মণ। নাম হরিদত্ত। কুলবৃত্তি ছেড়ে সে চাষাবাদ করত। চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। কিন্তু তাতে কি হবে? ভাগ্য খারাপ। তাই জমিতে ফসল ফলত না। এ নিয়ে তার মনে বড় দুঃখ! কি করবে সে?

একদিন দুপুর বেলা। গ্রীষ্মের রোদ খাঁ-খাঁ করছে। ক্ষেতের মধ্যে ছিল এক বিশাল গাছ। তার নিচে হরিদত্ত। ভাবছে। কি করবে? এমনি সময় দেখে এক অবাক কাণ্ড! ক্ষেতের অদূরে উইয়ের ঢিবির উপর এক গোখরো সাপ! বিশাল ফণা উঁচিয়ে!

হরিদত্ত ভাবল: নিশ্চয়ই এ ক্ষেত্রদেবতা। কোনও কারণে তার ওপর রুষ্ট। তাই ক্ষেতে ফসল ফলছে না। একে তুষ্ট করতেই হবে।

এই ভেবে হরিদত্ত বাড়ি গেল। বাটিতে দুধ এনে সাপের সামনে রাখল। তারপর হাত জোড় করে বলল: প্রভু, আমায় ক্ষমা কর! আমি বুঝতে পারিনি যে তুমি এখানে আছ। তাই তোমায় পুজো দেইনি। আর ভুল হবে না। এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। এই বলে হরিদত্ত বাড়ি চলে গেল। পরের দিন সকালে এসে দেখে বাটিতে দুধ নেই। আছে একটি দিনার। হরিদত্ত মহাখুশিতে দিনারটি নিয়ে বাড়ি গেল। এরপর থেকে অতিশয় ভক্তির সঙ্গে সাপটাকে দুধ খাওয়ায়। আর প্রত্যেকদিন একটি করে দিনার পায়।

একদিন ছেলের ওপর দায়িত্ব দিয়ে হরিদত্ত গেল গ্রামান্তরে। ছেলে দুধ দিয়ে যায়। পরের দিন গিয়ে দেখে বাটিতে একটি দিনার। সে তো বিশ্বাসই করতে পারছিল না! দিনারটাকে নেড়ে-চেড়ে বাজিয়ে দেখল। তারপর আপন মনে বলল হ্যাঁ, দিনারই তো!

আনন্দে একেবারে আটখানা! একশ্বাসে বাড়ি চলে গেল। সারাদিন ভাবল। নিশ্চয়ই উইয়ের ঢিবিতে দিনারের ভাণ্ড আছে। সাপটাকে মেরে এক সঙ্গে সব নিয়ে নিলেই তো হয়। রাতে সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু রাতটা যে খুব লম্বা মনে হচ্ছে। অবশেষে কাকের প্রথম ডাকেই সে উঠে পড়ল। আজ আর তাকে বলতে হয়নি। আগ বাড়িয়ে বাটি নিয়ে ছুটল সাপের উদ্দেশে। পথ থেকে তুলে নিল এক শক্ত কাঠ। দুধের বাটি রেখে একটু সরে দাঁড়াতেই সাপ দুধে চুমুক দিল। ওমনি ফণার উপর দিল এক বাড়ি। ভাগ্যিস পুরোটা লগে নি। বাটির উপর দিয়ে গেছে। তাই আহত সাপ লাফ দিয়ে পড়ল বেইমানের ওপর। তার করাল দংশনে ব্রাহ্মণপুত্র অক্কা পেল। বিলম্ব দেখে বাড়ির লোকজন খুঁজতে বেরুল। যখন খুঁজে পেল, তখন তার সমস্ত শরীর বিষে নীল। অগত্যা তারা তার সৎকার করল। পরের দিন ব্রাহ্মণ ফিরে এসে সব শুনে বলল:

আশ্রিতকে যে দয়া না করে
না করে রক্ষণ।
পদ্মবনের হাঁসদের মতো
হারায় সে তার ধন।

সবাই উৎসুক নয়নে তাকিয়ে রইল হরিদত্তের দিকে। বলল: ঘটনাটা কি? খুলে বল। হরিদত্ত: শোন তাহলে …

রাজা ও সোনার হাঁস

মধ্য ভারতের কোনও এক রাজ্যের রাজা ছিলেন চিত্ররথ। তাঁর ছিল একটি সরোবর। নাম পদ্মপুকুর। টলটলে জলে বিশাল এক পদ্মবন। তাই এ নাম।

সরোবরে থাকত একদল সোনার হাঁস। তারা প্রতি ছমাসে একটি করে সোনার পালক দিত। এ দিয়ে রাজার ভাণ্ডার পূর্ণ হতে লাগল। রাজার নির্দেশে তাই সৈনিকরা কড়া পাহাড়া দিত সরোবরের চারপাশে।

একদিন সেখানে এল এক সোনার পাখি। তাকে দেখে হাঁসেরা বলল: তোমার এখানে থাকা চলবে না। কারণ, আমরা ছমাস অন্তর একটি করে পালক দিয়ে এর দখল নিয়েছি। তুমি অন্য কোথাও যাও।

এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিবাদ দেখা দিল।

সোনার পাখি তখন রাজার কাছে গিয়ে বলল: মহারাজ, হাঁসেরা বলে— ছমাসে তারা একটি করে সোনার পালক দেয়। তাই পদ্মপুকুর কেবল তাদেরই।

আমি বললাম: কথাটা ভালো বললে না। আমি মহারাজকে বলে দেব।

তারা বলে: রাজা আমাদের করবেটা কি? আমাদের সোনার পালকে তার রাজকোষ পূর্ণ হচ্ছে। তাই আমরা যা বলব তা-ই হবে।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে সোনার পাখি পুনরায় বলল: মহারাজ, আপনি যদি অভয় দেন তাহলে আপনাকে আমি প্রতিদিন একটি করে সোনার পালক দেব। এতে হাঁসদের দেমাক ভাঙবে। এবার আপনি যা ভালো মনে হয় করুন।

রাজা ভাবলেন—ছমাসে একটার চেয়ে প্রতিদিন একটা পাওয়া বহুগুণ লাভজনক। তাই তিনি পেয়াদাদের হুকুম দিলেন হাঁসগুলোকে ধরে আনতে। পেয়াদারা হন্তদন্ত হয়ে ছুটল সরোবরের দিকে। তা দেখে হাঁসদের দলপতি সকলের উদ্দেশে বলল: তোমরা সবাই উড়াল দাও। অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না।

দলপতির নির্দেশে সকলে একযোগে আকাশে উড়ে গেল। শূন্য থেকে দেখল পেয়াদারা তাদের ধরার জন্য জাল-দড়ি নিয়ে ছুটে আসছে।

দু-একদিন পরে সোনার পাখিও চলে গেল। কারণ একার কাছে স্বর্গ-নরক একই। রাজা তখন আক্ষেপ করে বললেন: আশ্রিতদের তাড়িয়ে দিলাম। যাকে আশ্রয় দিলাম, সেও গেল। নিশ্চিতও গেল, অনিশ্চিতও গেল। একেই বলে লোভের ফল। এই বলে হরিদত্ত পরের দিন ভোরবেলা আবার বাটিতে দুধ নিয়ে সাপের কাছে গেল। অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর সাপ বের হলো। কিন্তু কাছে এল না। দরজার আড়াল থেকে বলল: লোভে পড়ে তুমি পুত্রশোক ভুলে এখানে এসেছ। তোমার ছেলে যৌবনের নেশায় আমায় মেরেছে। আমিও কামড়েছি। আমি যেমন সেই লাঠির আঘাত ভুলতে পরবনা, তুমিও পুত্রশোক ভুলতে পারবে না। তাই তোমাতে-আমাতে আর প্রীতি সম্ভব নয়। তুমি ফিরে যাও।

এই বলে সাপ হরিদত্তকে একটি বহুমূল্য মোহর দিয়ে গর্তে ঢুকে গেল। হরিদত্তও ছেলের হঠকারী বুদ্ধিকে ধিক্কার দিতে দিতে বাড়ি গেল।

রক্তাক্ষ অরিমর্দনের উদ্দেশে এবার বলল: মহারাজ, তাই আমি বলছিলুম ওর কথায় বিশ্বাস করা ঠিক নয়। ওকে দিয়ে মেঘবর্ণকে মারার লোভ না করে ওকে মেরে ফেলাই মঙ্গল। অরিমর্দন এবার ক্রূরাক্ষকে বলল তার মতামত দিতে। সে বলল: মহারাজ, ওর কথা বড় নিষ্ঠুর। শরণাগতকে কখনো মারতে নেই। শুনেছি—

ক্ষুদ্র এক পায়রা, অতি বড় হৃদয় তার।
নিজের মাংস দিয়ে করে অতিথি সৎকার।।

অরিমর্দন: তাই নাকি? খুলে বলতো ঘটনাটা!

ক্রূরাক্ষ: শুনুন তাহলে …

ব্যাধ ও কপোত

প্রকাণ্ড এক বন। সেখানে থাকত এক ব্যাধ। তার না ছিল আত্মীয়। না ছিল বন্ধু। একেবারে একা। কি করে থাকবে? অমন নিষ্ঠুর আর ভয়ঙ্করের সঙ্গে কেউ থাকে? ব্যাধের কাজ ছিল জাল আর ফাঁদ নিয়ে ঘুরে বেড়ান। পশু-পাখি ধরত। তাই খেয়ে বাঁচত।

একদিন ব্যাধের জালে ধরা পড়ল এক কপোতী। তাকে খাঁচায় পুরে কুটিরের দিকে রওনা দিল। হঠাৎ কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল। শুরু হলো ঝড়বৃষ্টি। বজ্রপাত। যেন প্রলয়কাল উপস্থিত। বাতাসের হুঁ-হুঁ ধ্বনি যেন রুদ্রদেবের শিঙা। ব্যাধ তো ভিজে একেবারে বেড়াল! শীতে দাঁতদোপাটি ঠকঠক করছে। অনেক দৌড়ে এক বটগাছের নিচে আশ্রয় নিল।

এক সময় বৃষ্টি থামল। সে চিৎকার করে বলতে লাগল: কেউ কি আছ? আমায় বাঁচাও! বটগাছের কোটরে ছিল এক কপোত। স্ত্রীর বিরহে বিলাপ করছে। কপোতী সেই সকালে বের হয়েছে। এখনো ফেরেনি। প্রলয়ঝড়ে হয়তো মারাই গেছে। তাই স্ত্রীবিহনে তার ঘর আজ শূন্য। কপোত বলছে: তার মতো সতী-সাধ্বী স্ত্রীর পতি হওয়া পরম সৌভাগ্যের বিষয়। শাস্ত্রে আছে—

শুধু ঘর ঘর নয় ঘরণীই ঘর।
ঘরণী বিহীন ঘর অরণ্যের পর।।

খাঁচায় বসে কপোতী স্বামীর এই করুণ বিলাপ শুনতে পেল। তার অন্তর ভরে গেল। স্বামী যাকে এত ভালোবাসে, তার আর অভাব কিসে? জীবনে তার আর পাওয়ার কিছু নেই। মেয়েদের স্বামী তুষ্ট হলে সব দেবতা তুষ্ট। পিতা-মাতা-ভাই-বোনের আদরের সীমা আছে। কিন্তু স্বামীর আদরের সীমা নেই। এমন স্বামীকে কে-না মাথায় করে রাখে?

কপোতী এবার কপোতের উদ্দেশে বলল: স্বামিন্! আমি ব্যাধের খাঁচায় আবদ্ধ। কিন্তু সে এখন শীতার্ত। ক্ষুধার্ত। ক্লান্ত। তোমার শরণার্থী। কাজেই তুমি তাকে যথাসাধ্য আপ্যায়ন কর। পণ্ডিতেরা বলেন: অতিথি বিমুখ হলে গৃহস্থের অমঙ্গল হয়। সে নিজের পাপ গৃহস্থকে দিয়ে গৃহস্থের পুণ্য নিয়ে যায়। কাজেই আমাকে বন্দী করেছে বলে তুমি ওর প্রতি বিমুখ হয়োনা। তাতে তোমার অমঙ্গল হবে। সে আমি সইতে পারব না।

স্ত্রীর মিনতি শুনে কপোত ব্যাধের কাছে গিয়ে বলল: ভাই, তোমার জন্য আমি কি করতে পারি, বল? দ্বিধা করো না। মনে কর এ তোমার নিজের বাড়ি।

ব্যাধ: ভাই, শীতে আমি মরে যাচ্ছি। যদি পার আমায় বাঁচাও।

কপোত তাকে আশ্বস্ত করে বলল: একটু দাঁড়াও। ব্যবস্থা করছি।

এই বলে সে নিজের কোটর থেকে শুকনো পাতা এনে জড় করল। তারপর দূর গৃহস্থের বাড়ি থেকে আগুন এনে পাতায় আগুন ধরাল। ব্যাধ আগুনে সমস্ত শরীর গরম করে শক্ত হলো। এবার তার অনুভূতি ফিরে এল। সে যে ক্ষুধার্ত, এতক্ষণে তা টের পেল। তাই করুণ সুরে বলল: ভাই কপোত, তুমি তো আমায় শীতের হাত থেকে বাঁচালে। কিন্তু খিদায় যে আমার প্রাণ যায়!

কপোত বিনয়ের সঙ্গে বলল: ভাই, আমি এক হতভাগা। কতজনে কত লোককে খাওয়ায়। কেউ সহস্ৰ জনকে। কেউ লক্ষ জনকে। কিন্তু আমার একজনকেও অনুদানের সামর্থ্য নেই। কেবল নিজের ভরণ-পোষণ ছাড়া। ধিক এ গার্হস্থ্য জীবনে! এমন জীবন দিয়ে কি হবে?

কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার বলল: তবে তুমি কিছু ভেব না। শরণাগতকে রক্ষা করা আমাদের ধর্ম। আমার স্ত্রীরও একই মত। তাই তুমি একটু অপেক্ষা কর। আমার জীবন দিয়ে হলেও আমি তোমার সেবা করব। তুমি আমাদের অতিথি।

এই বলে কপোত অগ্নিকে প্রদক্ষিণ করে প্রফুল্ল মনে তাতে ঝাঁপ দিল। তা দেখে ব্যাধের মন করুণায় ভরে উঠল। নিজের প্রতি তার তীব্র ধিক্কার এল। সে ভাবল: আমি মহাপাপী। সর্বদা পাপ করে চলেছি। যে পাপ করে, সে নিজেকে ভালোবাসে না। কারণ পাপের ফল নিজেকেই ভোগ করতে হয়। এই মহাত্মা কপোত আমার মতো পাপীর জন্য হাসতে হাসতে প্রাণ দিল। এ থেকে আমার শিক্ষা নিতে হবে। সমস্ত হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-মোহ আমি ত্যাগ করব। গ্রীষ্ম যেমন নদীকে শুকিয়ে ফেলে, আমিও তেমনি আমার দেহকে শুকিয়ে ফেলব।

এই বলে ব্যাধ খাঁচা ভেঙে কপোতীকে মুক্তি দিল। সে স্বামীকে আগুনে পুড়তে দেখে করুণ সুরে বলল: স্বামিন্! তোমা বিনে এ জীবনে আর কি লাভ?

এই বলে সেও আগুনে ঝাঁপ দিল। পরপারে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে মিলিত হলো। কপোত তাকে কাছে পেয়ে পরমানন্দে বলল: প্রিয়ে, তোমাকে ছাড়া আমার সব শূন্য মনে হচ্ছিল। এখন বুকটা ভরে গেছে। আর আমরা ভিন্ন হবনা।

এরপর থেকে কপোত-দম্পতি দিব্যবস্ত্র ধারণ করে সুখে বসবাস করতে লাগল।

এদিকে লোভ-মোহ ত্যাগ করায় ব্যাধের জীবন খাঁটি হলো। সে দিব্যদৃষ্টিতে কপোত—দম্পতির সুখ দেখতে পেল। তাই প্রাণিহিংসা ত্যাগ করে সে গভীর অরণ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগল। একদিন দাবানল জ্বলতে দেখে তাতে আত্মবিসর্জন দিয়ে দিব্যধামে চলে গেল।

ব্যাধ ও কপোতের কাহিনী শেষ করে ক্রূরাক্ষ বলল: তাই বলছিলুম—শরণাগতকে হত্যা করতে নেই। তার রক্ষা মহাপুণ্যের কাজ।

অরিমর্দন এবার দীপ্তাক্ষকে বলল: ভদ্র, এ ব্যাপারে তোমার কি মত?

দীপ্তাক্ষ: মহারাজ, আমারও তা-ই মত। দেখুন, চোরও যদি উপকার করে, তাহলে তার মঙ্গল চিন্তা করতে হয়। তাহলে শরণাগতকে কেন নয়? তাছাড়া, এ ওদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছে। তাই ওদের ছিদ্র দেখাতে ও দ্বিধা করবে না। এ কারণেও ওকে মারা উচিত হবেনা।

অরিমর্দন এবার অপর মন্ত্রী বক্রনাসকে বলল: ভদ্র, তোমার মতামতটা জানাও। এ অবস্থায় আমাদের কি করা উচিত?

বক্রনাস: মহারাজ, ক্রূরাক্ষ আর দীপ্তাক্ষ যথার্থই বলেছে। আমার মতেও একে মারা ঠিক নয়। কারণ—

শত্রুও উপকার করে, ঝগড়া হলে পরস্পর।
রাক্ষস তাই দিল গরু, প্রাণটা দিল ঐ যে চোর।।

অরিমর্দন: সেটা আবার কি?

বক্রনাস: শুনুন তাহলে…

ব্রাহ্মণ রাক্ষস ও চোর

এক গাঁয়ে থাকতেন এক ব্রাহ্মণ। সম্পদ বলতে তাঁর কিছুই ছিলনা। যজমানরা যা দিত, তাতেই তাঁর দিন কাটত। কোনরকমে।

একবার এক যজমান তাঁকে একজোড়া বাছুর দিল। ব্রাহ্মণ অতিযত্নে সেদুটোকে মানুষ করলেন। দেখতে একেবারে শিবের জোড়া-ষাঁড়ের মতো হয়েছে। নাদুস-নুদুস তেল—চকচকে। যে-কারো চোখ পড়ে।

একদিন এক চোর যাচ্ছিল গরুদুটির পাশ দিয়ে। চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়াল। ভাবল: ছবি! না বাস্তব! ভালো করে দেখে বলল: বাস্তবই তো! ঐ যে লেজ নাড়ছে! মাছিও মারছে!

সঙ্গে-সঙ্গে সিদ্ধান্ত হয়ে গেল: আর দেরি নয়। আজই ব্যবস্থা করতে হবে। বিলম্বে কার্য নষ্ট। পণ্ডিতদের কথা।

এই ভেবে চোর বাড়ি ফিরে গেল। অনেক কষ্টে দিনটা কাটল। কিন্তু রাতটা যেন বুড়ি হয়ে গেছে। মোটে চলতে পারছে না। উঃ!

তারপর রাত দু-প্রহর হতেই সে বেড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ মাঝপথে ওটা কি! জিভটা লকলক করছে! চোখদুটো লাল। দাঁতগুলো লম্বা! মাথায় পিঙ্গল জটা! ও রে বাবা!

চোরের মুখ শুকিয়ে গেল। প্রাণটা যায় যায় ভাব। কিন্তু এ অবস্থায় দুর্বল হলে চলবে না। তাই সে সাহস করে জিজ্ঞেস করল: কে যায়?

রাক্ষস: আমি সত্যবাদী ব্রহ্মদৈত্য। পনেরদিন অন্তর নরমাংস খাই। তারই সন্ধানে যাচ্ছি। কিন্তু তুমি কে হে? এত রাতে যাচ্ছই বা কোথায়?

রাক্ষসের কথা শুনে চোরের হৃৎকম্প শুরু হয়ে গেল। এ-রাতই বোধ হয় তার শেষ রাত। তারপরেও সাহস করে বলল: আমি চোর। যাচ্ছি এক বামুনের গরু চুরি করতে। ব্রাহ্মণের কথা শুনে রাক্ষসের জিভটা লকলক করে উঠল। সে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বলল: বামুন! আঃ! কতকাল বামুনের মাংস খাইনা! শিষ্যবাড়ি গিয়ে ওরা দধি-দুগ্ধ—মণ্ডা-মিঠাই কত কি খায়! ওদের মাংসের স্বাদই আলাদা!

রাক্ষসের কথা শুনে চোরের ধড়ে প্রাণ এল। সে এগিয়ে গিয়ে বলল: ভাই, এক যাত্রায় দুজনের উদ্দেশ্য সফল হবে। তুমি বামুন খাবে। আমি তার গরু নেব।

রাক্ষস: তবে তা-ই হোক।

এই বলে দুজন চলল ব্রাহ্মণের বাড়ির দিকে। তারা যখন পৌঁছল, তখন কাক-পক্ষি ও জেগে নেই।

রাক্ষসের আর ধৈর্য ধরছে না। সে সোজা চলল বামুনকে খেতে। কিন্তু চোর বাধা দিয়ে বলল: এ কি করছ? আমি আগে গরুদুটো নেই। তারপর তুমি বামুনকে খেও।

রাক্ষস রেগে বলল: তা হবে না। গরুর আওয়াজে বামুন জেগে উঠলে আমায় উপোস থাকতে হবে যে। আমি আগে বামুন খাই। পরে তুমি গরু নিও।

চোর: কিন্তু বামুনকে খেতে গিয়ে যদি কোন বাধা আসে, তাহলে আমার গরু চুরি হবেনা। তাই আমি আগে।

রাক্ষস: আমি আগে।

এভাবে দুজনের মধ্যে ঝগড়া বেঁধে গেল। ঝগড়ার শব্দে ব্রাহ্মণ বাইরে এসে ব্রহ্মদৈত্য আর চোরকে দেখে ভরকে গেলেন। তিনি বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে ব্রহ্মমন্ত্র জপ করতে লাগলেন। মন্ত্রের তাপ সহ্য করতে না পেরে ব্রহ্মদৈত্য পালাল। আর ব্রাহ্মণের লাঠির আঘাতে চোর প্রাণ হারাল। ব্রাহ্মণের দুটি গরুই রক্ষা পেল।

তাই বলছিলুম—শত্রুরাও অনেক সময় উপকার করে, যদি তাদের মধ্যে ঝগড়া বাঁধে।

বক্রনাসের বক্তব্য শেষ হলে অরিমর্দন অপর মন্ত্রী প্রাকারকর্ণকে বলল: ভদ্র, এ ব্যাপারে তোমার মতামত বলো।

প্রাকারকর্ণ বলল: মহারাজ, একে মারবেন না। কারণ একে বাঁচালে হয়তো আমাদের মধ্যে পরস্পর ভাব হতে পারে এবং তার ফলে আমরা সুখে দিন কাটাতে পারব। কথায় বলে—

পরস্পরের ভাব রক্ষা নাহি করে যারা।
ঢিবি-পেটের সাপের মতো মরে তারা।।

অরিমর্দন: সে কেমন?

প্রাকারকর্ণ: শুনুন তাহলে

রাজপুত্র রাজকন্যা দুই সাপ

এক নগরে ছিলেন এক রাজা। তাঁর নাম দেবীশক্তি। তাঁর ছেলের পেটে বাসা বানিয়ে থাকত এক সাপ। কত ডাক্তার-বদ্যি, ওষুধ-পত্তর। কিন্তু কিছুতেই তাকে মারা যাচ্ছিল না। ফলে দিন-কে-দিন রাজপুত্রের প্রতিটি অঙ্গ শুকিয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে মনের ঘেন্নায় রাজপুত্র একদিন দেশান্তরী হলো। এক নগরে গিয়ে ঘুরে-ঘুরে ভিক্ষে করত, আর এক ভগ্ন দেউলে থাকত। এভাবে তার দিন কাটছিল।

সেই নগরের যিনি রাজা— তাঁর নাম বলি। বলির ছিল দুই তরুণী কন্যা। অপরূপ সুন্দরী।

প্রতিদিন ভোরে উঠে কন্যারা পিতাকে প্রণাম করত। প্রণাম করার সময় বড় কন্যা বলত: মহারাজের জয় হোক। আপনার দয়ায় আমরা কত সুখে আছি I

ছোট কন্যা বলত: কর্মফল ভোগ করুন, মহারাজ।

মেয়ের মুখে এই অপ্রিয় কথা শুনতে শুনতে রাজা একদিন ক্ষেপে গেলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ মন্ত্রীদের ডেকে বললেন: এই দুষ্টভাষিণীকে আজই কোনো বিদেশীর হাতে তুলে দাও। ও নিজেই নিজের কর্মফল ভোগ করুক।

রাজার কথা শুনে মন্ত্রীরা ‘যে আজ্ঞা’ বলে বেরিয়ে পড়ল। তাদের বেশি খুঁজতে হয়নি। নগরের দেউলে ঐ অসুস্থ রাজপুত্রকে দেখে তাকে রাজসমীপে নিয়ে এল। ক্রুদ্ধ রাজা তার সঙ্গেই মেয়ের বিয়ে দিলেন। সেও মহানন্দে স্বামীকে দেবতা জ্ঞান করে ভিন দেশে চলে গেল।

অনেক দূরের এক নগর। রাজকন্যা এক দিঘির পাড়ে রাজপুত্রকে রেখে লোকালয়ে গেল খাবারের সন্ধানে। ততক্ষণে রাজপুত্র এক উইয়ের ঢিবির উপর মাথা রেখে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। এমন সময় তার মুখ দিয়ে ভেতরের সাপটা ফণা তুলে বেরিয়ে এসে হাওয়া খেতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে উইয়ের ঢিবির ভেতর থেকে আরেকটি সাপ বেরিয়ে এসে সেও হাওয়া খেতে লাগল। দুজনে চোখাচোখি হতেই দুজনে রেগে লাল! ঢিবির সাপ বলল: ওরে দুরাত্মা! কেন তুই এই রাজপুত্রকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছিস?

পেটের সাপ পাল্টা বলল: তুই-ই বা কেন ঢিবির ভেতরের মোহরভরা কলসিটাকে দূষিত করছিস?

এভাবে ঝগড়া করতে করতে এক সময় পরস্পর পরস্পরের গোপন কথা ফাঁস করে দিল। ঢিবির সাপ বলল: ওরে পাপিষ্ঠ! এ কথা কে না জানে যে, অনেক দিনের বাসি টকের সঙ্গে সরষে ফুটিয়ে খাওয়ালে তুই অক্কা পাবি?

পেটের সাপ বলল: আর এ কথাই বা কে না জানে যে, গরম তেল বা জল ঢেলে দিলে তোর দফায় ঠাণ্ডা?

এভাবে দুই সাপ যখন ঝগড়া করছিল এবং পরস্পর পরস্পরের মৃত্যুর উপায় বলে দিচ্ছিল, তখন আড়ালে থেকে রাজকন্যা সব শুনছিল। সে বাসি টকে সরষে ফুটিয়ে স্বামীকে খেতে দিল। ফলে পেটের সাপ মারা গেল। এতে রাজপুত্র সুস্থ হয়ে গেল। তারপর একদিন গরম জল ঢেলে দিয়ে উইয়ের ঢিবির সাপটাকে মেরে সমস্ত গুপ্তধন নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সকলে তার বুদ্ধির তারিফ করতে লাগল। সেও স্বামীর সঙ্গে সুখে বাস করতে লাগল।

তাই বলছিলুম, পরস্পর ভাব রক্ষা করে চললে সকলেরই মঙ্গল হয়, নইলে অমঙ্গলের শেষ নেই।

প্রাকারকর্ণের যুক্তি অরিমর্দনের পছন্দ হলো। সে সবার উদ্দেশে বলল: এ যথার্থই বলেছে। স্থিরজীবী এখন আর আমাদের শত্রু নয়, মিত্র। তাই তাকে রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য।

রাজার আদেশ অনুসারে স্থিরজীবীকে রক্ষা করা হলো। অরিমর্দনের প্রধানমন্ত্রী রক্তাক্ষ তখন মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়ে বলল: এদের কুপরামর্শে মহারাজের সর্বনাশ হলো। কথায় বলে—

অ-মানী যেখানে পায় মান, মানী অপমান।
সেখানে সর্বদা থাকে দুর্ভিক্ষ ভয় ও মরণ॥

চাণক্য বলেছেন—হিতবাক্য ছেড়ে যে তার বিপরীত আচরণ করে, তার মরণ নিশ্চিত। আর যারা তাকে এরূপ পরামর্শ দেয়, তারা বন্ধু নয়, চরম শত্রু। অপণ্ডিত মন্ত্রীদের কথায় যে রাজা স্থান-কালের বিপরীত আচরণ করে, তার যা-ও আছে তা-ও হারায়, যেমন অন্ধের চোখে দিনের আলো হারায়।

কিন্তু তার কথায় কেউ কান দিল না। রাজার আদেশে সবাই স্থিরজীবীকে দুর্গের দিকে নিয়ে গেল। যেতে যেতে স্থিরজীবী অরিমর্দনের উদ্দেশে বলল: মহারাজ, আমায় কেন বাঁচালেন? আমি তো আপনার কোনো কাজে লাগব না। আমি তো জ্বলন্ত অগ্নিতে ঝাঁপ দিতে চাই। আপনি আমায় আগুন দিয়ে উদ্ধার করুন।

অরিমর্দনের সবচেয়ে বুদ্ধিমান মন্ত্রী রক্তাক্ষ কিন্তু স্থিরজীবীর অভিসন্ধি বুঝতে পেরেছিল। সে একটু ক্রূর হাসি হেসে বলল: তা তুমি আগুনে ঝাঁপ দিতে চাইছ কেন? স্থিরজীবীও কম নয়। রক্তাক্ষের মনের কথা বুঝতে পেরে সে বলল: মেঘবর্ণ আমার যা হাল করেছে, তাই প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আমি পেঁচা হয়ে জন্মাতে চাই।

রাজনীতিকুশল রক্তাক্ষ বলল: তুমি যে খুব কুটিল এবং কথা বানাতে ওস্তাদ, তা দেখেই বুঝেছিলাম। পেঁচা হয়ে জন্মালেও কাক-জন্মটাই তুমি বড় করে দেখবে।

কিন্তু রক্তাক্ষের কথা অন্যরা শুনল না। নিজেদের বংশ ধ্বংস করার জন্য তারা স্থিরজীবীকে দুর্গে নিয়ে গেল। স্থিরজীবী তখন মনে মনে বলল: পেঁচাদের মধ্যে একমাত্র রক্তাক্ষই রাজনীতিশাস্ত্রের অর্থ ও তত্ত্ব বোঝে। সে-ই রাজার হিতাকাঙ্ক্ষী। তাই আমাকে মেরে ফেলতে বলেছিল। ওর কথা যদি রাজা শুনত, তাহলে পেঁচাদের কোনো অনিষ্টই হতো না।

এরূপ ভাবতে ভাবতে স্থিরজীবী এক সময় পৌঁছে গেল অরিমর্দনের দুর্গে। অরিমর্দন সবাইকে ডেকে বলল: আমাদের হিতৈষী বন্ধু স্থিরজীবীকে দুর্গের মধ্যে সবচেয়ে ভালো জায়গায় থাকতে দাও, যাতে কোনো অসুবিধা না হয়।

একথা শুনে স্থিরজীবী ভাবল আমার তো ওদের বধ করার উপায় খুঁজতে হবে। কিন্তু দুর্গের মধ্যে থাকলে তা তো হবে না। ওরা আমার হাবভাব দেখে বুঝে ফেলবে। সতর্ক হয়ে যাবে। আমিও ধরা পড়ে যেতে পারি। তাই দুর্গের দরজায় ডেরা গাড়তে হবে। যাতে সচ্ছন্দে আমার কাজ করতে পারি

এরূপ চিন্তা করে সে অরমির্দনকে সবিনয়ে বলল: মহারাজ, আপনি আপনার উপযুক্ত কথাই বলেছেন। অতিথির প্রতি সজ্জনদের এটাই হচ্ছে সর্বোত্তম আচরণ। কিন্তু আমি যে রাজনীতিজ্ঞ। তাই আমাকে সেভাবেই চলতে হবে। আমি হচ্ছি আপনার শত্রুপক্ষের লোক। এখন না হয় আমাকে আপনার অনুরক্ত ও বিশ্বস্ত মনে হচ্ছে। কিন্তু দুদিন পরে তো এর বিপরীতও হতে পারে। তাই আমাকে দুর্গের ভেতরে স্থান দেয়া ঠিক হবেনা। তার চেয়ে বরং আমি এই দরজার বাইরেই থাকি। প্রতিদিন আপনার চরণধুলা পাব। স্থিরজীবীর কথায় অরিমর্দন ভীষণ খুশি হলো। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিশ্বস্ততায় মুগ্ধ হলো। সবাইকে ডেকে বলল: এর কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। এই বলে অরিমর্দন ভৃত্যদের আদেশ করল স্থিরজীবীর যথাযথ সেবা-যত্ন করার জন্য। রাজার আদেশ পেয়ে তারাও প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে খাবার তাকে দিতে লাগল। ফলে অল্পদিনেই সে একেবারে ময়ূরের মতো তাগড়াই হয়ে উঠল। এসব দেখে বিরক্ত ও বিস্মিত রক্তাক্ষ একদিন রাজাকে বলল: মহারাজ, আপনার মন্ত্রীরা যেমন মূর্খ, আপনিও তেমনি। সেই যে সিম্মুখ পাখি বলেছিল—

পয়লা নম্বর মূর্খ আমি, ব্যাধ দুই নম্বর।
রাজা মূর্খ মন্ত্রী মূর্খ, সবই অতঃপর।।

সকলে: তাই নাকি?

রক্তাক্ষ: তা-ই। শুনুন তাহলে…

সিম্মুখ পাখি ও সোনার পুরীষ

এক পাহাড়ে ছিল এক প্রকাণ্ড গাছ। তাতে থাকত এক সিম্মুখ পাখি। তার পুরীষে সোনা হতো।

একদিন এক ব্যাধ সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। তার সামনেই পাখিটা পুরীষ ত্যাগ করল। আর অমনি তা সোনা হয়ে গেল। ব্যাধ তো অবাক। একি! পুরীষ সোনা হয়! একি সত্যি? সত্যিই তো! তার সামনেই তো হলো! কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? আজ আশি বছর ধরে সে পাখি ধরছে। এমনটি তো আগে কখনো দেখেনি। যাহোক। ওকে ধরতেই হবে। এই ভেবে ব্যাধ গাছের নিচে ফাঁদ পাতল। আড়ালে গিয়ে ওৎ পেতে রইল। কখন পাখিটা জালে আটকা পড়ে। কিছুক্ষণ যেতে-না-যেতেই পাখিটা খাবার খেতে নিচে নামল। আর অমনি ব্যাধের জালে ধরা পড়ল। ব্যাধ মুহূর্তের মধ্যে তাকে খাঁচায় পুরে বাড়ি চলে গেল।

কিন্তু বাড়ি গিয়ে সে ভাবনায় পড়ে গেল। এমন আশ্চর্য পাখি। একে নিয়ে সে এখন কি করবে? কেউ যদি টের পেয়ে যায় এবং রাজাকে বলে দেয়, তাহলে তার মৃত্যুদণ্ড ঠেকাবে কে? তার চেয়ে ভালো নিজেই গিয়ে রাজাকে দিয়ে আসা।

এই ভেবে ব্যাধ পাখিটাকে নিয়ে গেল রাজবাড়ি। রাজা সব শুনে পদ্মের পাপড়ির মতো মুখ-চোখ বিকশিত করে খুশিতে একেবারে ডগমগ। রক্ষীদের ডেকে বললেন: পাখিটাকে সাবধানে পাহারা দাও, আর ভালো ভালো খাবার-দাবার দাও।

রাজার আদেশ পেয়ে রক্ষীরা কাজে লেগে গেল।

এমন সময় এক মন্ত্রী বলল: মহারাজ, সামান্য এক ব্যাধের কথায় আপনি বিশ্বাস করলেন? পাখির মলে কখনো সোনা হয়? না-কি হওয়া সম্ভব? একথা শুনলে অন্য রাজারা আপনাকে ছিঃ-ছিঃ করবে।

মন্ত্রীর কথায় রাজার যেন সম্বিৎ ফিরে এল। তিনি রক্ষীদের আদেশ দিলেন পাখিটাকে ছেড়ে দিতে। রক্ষীরা যেই খাঁচার দ্বার খুলে দিল, অমনি সে ঘরের চালায় বসে সোনার পুরীষ ত্যাগ করে বলল: প্রথম মূর্খ আমি, দ্বিতীয় মূর্খ ব্যাধ, তৃতীয় মূর্খ রাজা-মন্ত্রী, আর চতুর্থ মূর্খ এ রাজ্যের সব। এই বলে উড়ে গেল।

কিন্তু রক্তাক্ষের এত কথায়ও কোনো কাজ হলো না। তার কোনো হিতকথাই অরিমর্দন কিংবা তার অন্য মন্ত্রীরা কানেই তুলল না। বরং স্থিরজীবীকে তারা আরো বেশি করে মাছ-মাংস খাওয়াতে লাগল। তখন রক্তাক্ষ একদিন নিজের পরিবারবর্গকে ডেকে বলল: এ রাজ্যে আর থাকা যাবেনা। যে-রাজা মূর্খ মন্ত্রীদের কথায় চলে, সে-রাজা এবং তার রাজ্যের অমঙ্গল অবধারিত। এই দুর্গও আর বেশিদিন নেই। কুলমন্ত্রীর যেভাবে বলা উচিত, আমি সেভাবেই তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার কথায় তিনি কান দেন নি। মদ্যপ যেমন হিতবাক্য শোনেনা, তেমনি তিনিও আমার কথা শুনলেন না। কাজেই, চলো আমরা অন্য কোথাও চলে যাই। শাস্ত্রে আছে—ভবিষ্যৎ ভেবে যে কাজ করে, তার বৃদ্ধি নিশ্চয়; আর তা যে না করে, তার ধ্বংস অনিবার্য? তাই তো শেয়াল বলছিল:

এতটা বয়স কাটাইনু কত বনে বনে।
গুহা নাকি কথা বলে শুনিনি তা কানে।.

পরিবারবর্গ: ব্যাপারটা কি, খুলে বলো না?

রক্তাক্ষ: শোনো…

সিংহ শেয়াল গুহা

এক বনে থাকত এক সিংহ। নাম খরনখর। হাতে-পায়ে খর (তীক্ষ্ণ) নখ। তাই নাম হয়েছে খরনখর।

কিন্তু নামটি জব্বর হলে কি হবে? গায়ে আর শক্তি নেই। বয়স হয়েছে তো। তাই। কিন্তু পেটের খিদা তো আর কমেনি। তাই খাবারের সন্ধান করতেই হচ্ছে।

একদিন সারাদিন ঘুরেও কিছু মিলল না। তখন সূর্যমামা পাটে বসেছে। খরনখর সামনে দেখল এক বিশাল পাহাড়ি গুহা। ঢুকে পড়ল তার মধ্যে। ভাবল, নিশ্চয়ই রাতের বেলা এখানে কোন-না-কোন জন্তু ঘুমাতে আসবে। তখন ধরে খাবে। এই ভেবে সে চুপটি করে পড়ে রইল।

ঐ গুহায় থাকত এক শেয়াল। খানিকক্ষণ পরে এসে দেখল—সিংহের পদচিহ্নের সারি গুহার মধ্যে ঢুকেছে। কিন্তু বেরোয় নি। তখন সে ভাবল, মরছি! নিশ্চয়ই গুহার মধ্যে সিংহ আছে। এখন কি করি? কিভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়?

কিছুক্ষণ চিন্তা করে তার মাথায় এক বুদ্ধি এল। সে দরজা থেকেই জোরে জোরে ডাকতে লাগল: অ গুহা, গুহা।

একটু নীরব থেকে আবার ডাকতে লাগল। তারপর গুহার উদ্দেশে বলল: তুমি উত্তর দিচ্ছ না কেন? তোমার মনে নেই আমাদের শর্তের কথা? আমি বাইরে থেকে এলে তোমায় ডাকব। আর তুমিও আমায় ডাকবে। তুমি যদি আমায় না ডাক, তাহলে আমি অন্য গুহায় চললাম। তুমি একাই থাক।

শেয়ালের কথা শুনে সিংহ ভাবল, রোজ এ যখন ফিরে আসে, তখন নিশ্চয়ই গুহা একে ডেকে নেয়। আজ হয়তো আমার ভয়ে গুহা চুপ করে আছে। তা আমিই ডাকি। ভেতরে এলেই ওকে ধরব।

এই বলে সিংহ দিল ডাক। তার ডাকের প্রতিধ্বনিতে গুহা গমগম করে উঠল। সারা পাহাড় কেঁপে উঠল। দূরের জন্তু-জানোয়ার পর্যন্ত ভয়ে কাঁপতে লাগল। শেয়াল তো দূরের কথা। সে তখন পালাতে পালাতে ঐ কথাগুলো বলছিল।

রক্তাক্ষ এবার সকলের দিকে তাকিয়ে বলল: আমাদেরও এ দুর্গ ত্যাগ করা উচিত। এটি আর নিরাপদ নয়।

এই বলে পরিবার-পরিজন নিয়ে সে অন্যত্র চলে গেল।

রক্তাক্ষ চলে গেলে স্থিরজীবী অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে ভাবল: আঃ, বাঁচলুম! এ দুর্গে একমাত্র রক্তাক্ষই ছিল বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী। আর তো সব হাঁদারাম। এদের অনায়াসেই কাবু করা যাবে। কথায় বলে না— যে-রাজার মন্ত্রীরা দূরদর্শী নয়, তার রাজ্য থাকে অরক্ষিত। ঐ রাজা কিংবা তার রাজ্যকে জয় করা বালখিল্যের কাজ। তাছাড়া মন্ত্রীরা যদি সৎ নীতি পরিহার করে অসৎ নীতির সেবা করে, তাহলে বিচক্ষণ ব্যক্তিরা তাদের মন্ত্রিরূপ শত্রু বলে মনে করে।

মনে মনে এসব চিন্তা করে স্থিরজীবী এক সময় গোপনে একটা একটা করে শুকনো কাঠ তার বাসায় জড়ো করতে লাগল। পেঁচারা তা দেখেও দেখেনি। দেখলেও ভেবেছে, স্থিরজীবী তার বাসা বানাচ্ছে। এভাবে যখন শুকনো কাঠের এক বিশাল স্তূপ হয়ে গেল, তখন একদিন গোপনে স্থিরজীবী চলে গেল মেঘবর্ণের কাছে। বলল: মাহারাজ, সময় আগত। এবার আপনারা মুখে করে আগুন নিয়ে অরিমর্দনের গুহার মুখে আমার বাসায় ফেলুন। যাতে পেঁচার বংশ সমূলে ধ্বংস হয়।

দীর্ঘকাল পরে স্থিরজীবীকে কাছে পেয়ে মেঘবর্ণ আবেগাপ্লুত হয়ে বলল: ভদ্র, আগে বলুন আপনি কেমন ছিলেন? আপনার প্রতি আমরা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছি। স্থিরজীবী: মহারাজ, সে কথা পরে হবে। এখন ওসব বলার সময় নয়। সুযোগ পেলে শত্রু পালিয়ে যেতে পারে। কিংবা ওদের গুপ্তচর আমায় ধরে ফেলতে পারে। জরুরি কাজে গড়িমসি করতে নেই। তাতে দেবতারাও রুষ্ট হন। আগে শত্রু নিপাত যাক। পরে সব বলব।

একথা বলে স্থিরজীবী দ্রুত চলে গেল তার আস্তানায়। আর মেঘবর্ণের নেতৃত্বে কাকেরা মুখে জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে ফেলতে লাগল সেই কাঠের স্তূপে। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল অরিমর্দনের দুর্গ। মুহূর্তেই পুড়ে সব শেষ। এভাবে শত্রুদের ধ্বংস করে স্থিরজীবী যখন নিজেদের দুর্গে ফিরে এল, তখন সকলে সসম্মানে তাকে অভ্যর্থনা জানাল। রাজসভার মাঝখানে তাকে বসিয়ে মালায় মালায় ভরে তুলল তার গলা।

সকলের আবেগ একটু শান্ত হলে মেঘবর্ণ বলল: ভদ্র, এবার বলুন কি করে আপনি এতদিন শত্রুর মধ্যে কাটালেন। আর কিভাবেই বা এই অসম্ভবকে সম্ভব করলেন? স্থিরজীবী গম্ভীর কণ্ঠে বলতে লাগল: মাহরাজ, মূর্খরা শত্রুকে বন্ধু করে, বন্ধুকে শত্রু করে। সুতরাং এদের মৃত্যু ঠেকায় কে? এরা নিজেদের ভুলের জন্যই মরে। আর আমার কথা জানতে চাচ্ছেন? কিভাবে শত্রুর মধ্যে এতদিন ছিলাম? শুনুন, যারা রাজার চাকরি করতে আসে, তারা জীবনের মায়া ত্যাগ করেই এ কাজে ব্রতী হয়। তাছাড়া ভবিষ্যৎ সাফল্যের আশায় বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা সাময়িক কষ্টকেও সহ্য করেন। ভেবে দেখুন পঞ্চপাণ্ডবের কথা। মহারাজ যুধিষ্ঠির হয়েছিলেন বিরাটরাজের নর্মসহচর মহাবীর ভীম হয়েছিলেন রন্ধনশালার পাঁচক। মহাধনুর্ধর অর্জুন হয়েছিলেন নৃত্যশিক্ষক। নকুল-সহদেব হয়েছিলেন গো-অশ্ব-রক্ষক। আর রাজকন্যা অনিন্দ্যসুন্দরী দ্রৌপদী সৈরিন্ধ্রী নামে সহচরীর কাজ করেছেন না? সে তুলনায় আমি আর কি করেছি? মেঘবর্ণ অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে বলল: তাহলেও শত্রুর দুর্গে এতদিন বাস করা, সে তো তরবারির ধারের উপর দিয়ে হাটা। একটু অসাবধান হলেই দু-ভাগ!

স্থিরজীবী: তা বটে। তবে আমি একসঙ্গে এতগুলো গণ্ডমূর্খ আর দেখিনি। একমাত্র বুদ্ধিমান ছিল রক্তাক্ষ। কিন্তু তাকে ওরা থাকতে দিলনা। বাকিরা রাজনীতির র-ও বুঝত না। অথচ তারা ছিল মন্ত্রী। তাদের বোঝা উচিত ছিল, আমি তাদের শত্রুপক্ষের। যেচে তাদের আশ্রয় নেয়ার মানেই আমি গুপ্তচর। এ-কথাটা একমাত্র রক্তাক্ষ বুঝেছিল। এ ধরনের ব্যক্তির যেকোন আচরণে সন্দেহ হলে তৎক্ষণাৎ তাকে মেরে ফেলা উচিত। কিন্তু ওরা তা বুঝতে পারেনি। অখাদ্য খেলে যেমন শরীর নষ্ট হয়, তেমনি মূর্খ বা অসৎ মন্ত্রীদের দ্বারাও রাজার রাজ্য নষ্ট হয়। তাই শাস্ত্র বলছে:

বিদ্যা হারায় নেশাখোর, কৃপণ হারায় সুখ।
রাজ্য হারায় সেই রাজা, যার মন্ত্রীরা গোমুখ।।

আর যাঁরা প্রাজ্ঞ ব্যক্তি, তাঁরা স্বার্থসিদ্ধির আশায় প্রয়োজনে সম্মানকে পেছনে রেখে অসম্মানকেও কখনো কখনো গ্রহণ করেন। কথায় বলে:

বইবে কাঁধে শত্রুকেও সময় বুঝে বুদ্ধিমান।
সেই করে ঐ মস্ত কেউটে সাবার করল অনেক ব্যাঙ।।

মেঘবর্ণ: বলেন কি?

স্থিরজীবী: শুনুন তাহলে…

কেউটে ও ব্যাঙেরা

এক পাহাড়ে থাকত এক কেউটে। বয়স হয়েছে অনেক। বিষের তীব্রতাও গেছে কমে। তাই নাম হয়েছে মন্দবিষ।

মন্দবিষ একদিন ভাবল: কিভাবে অল্প আয়াসে খাবার জোগাড় করা যায়। ভেবে-চিন্তে সে এক হ্রদের পাড়ে গেল। সেখানে থাকত অনেক ব্যাঙ।

মন্দবিষ দূরের পানে তাকিয়ে স্থির হয়ে বসে আছে। ভাবান্তরহীন। ব্যাঙদের দিকে তাকিয়েও দেখছে না। ব্যাঙ সাপের প্রিয় খাদ্য। তা সত্ত্বেও ব্যাঙের প্রতি তার এই উদাসীনতা দেখে সকলের সন্দেহ হলো। তখন একটা ব্যাঙ কাছে এসে জিজ্ঞেস করল: কি মামা, আজ যে খাওয়া-দাওয়ায় মন নেই?

কেউটে হতাশ কণ্ঠে বলল: আর ভাই বলো না! দৈবের ফাঁদে পড়েছি! খাওয়া-দাওয়া আমার চুলোয় গেছে!

ব্যাঙ: কি হয়েছে? খুলে বলো না?

কেউটে: এই তো কাল সন্দে বেলা। খাবার জন্য একটা ব্যাঙকে তাক করেছি। অমনি সে মরণভয়ে ছুটে পালাল। ব্রাহ্মণরা বেদ পড়ছিল। একেবারে তাদের মধ্যে ঢুকে পড়ল। আর খুঁজে পেলাম না। ফিরে এলাম হ্রদের ধারে। সেখানে জলের মধ্যে এক ব্রাহ্মণকুমারের আঙুল দেখে অবিকল ব্যাঙ মনে হচ্ছিল। কামড় দিতেই সে মারা গেল। তার শোকার্ত পিতা আমায় অভিশাপ দিল: ওরে শয়তান! বিনাদোষে তুই আমার পুত্রকে মারলি! এই অপরাধে তুই ব্যাঙদের বাহন হবি। তাদের দয়ায় তোর জীবন বাঁচবে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কেউটে আবার বলল: তাইতো তোমাদের বাহন হবার জন্য এখানে এসেছি। এখন তোমরা দয়া করলে আমার জীবন বাঁচে। নতুবা মরণ নিশ্চিত কেউটের কথা শুনে ব্যাঙ তো মহাখুশি। সে গিয়ে অন্যদের কথাটা বলল। অদ্ভুত কথা শুনে তারাও আনন্দে লাফাতে লাগল। তারা গিয়ে তাদের রাজা জলপাদকে ঘটনাটা খুলে বলল। জলপাদ বলল: তা-ই যদি হয়, তাহলে আমাদের আর ভাবনা কি? সাপের ভয়ে সর্বদা তটস্থ থাকতাম। এখন সে যদি হয় আমাদের বাহন, তাহলে ভয় করব আর কাকে?

এই বলে জলপাদ তার দলবল নিয়ে হুড়মুড়িয়ে উঠে এল হ্রদ থেকে। মন্দবিষের মস্ত ফণায় চড়ে বসল। বাকিরাও তার সমস্ত শরীরে জেঁকে বসল। যারা জায়গা পেল না, তারা মন্দবিষের পেছনে পছনে দৌড়াতে লাগল। মন্দবিষ হেলে-দুলে, আস্তে-জোরে বিভিন্নভাবে চলতে লাগল। ব্যাঙেরা এতে খুব আনন্দ পেল।

পরের দিন মন্দবিষ ইচ্ছে করেই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল। এমন ভাব যেন চলার শক্তি নেই। ব্যাঙরাজ জলপাদ বলল: কি ভাই, আজ যে আগের মতো হাঁটছ না? মন্দবিষ দুর্বলতার ভাব দেখিয়ে বলল: মহারাজ, খিদেয় শরীরটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। আর পারছি না। একটু জিরিয়ে নেই।

জলপাদ: তা খাদ্যের অভাব কি? ছোট ছোট কয়েকটা ব্যাঙ ধরে খেয়ে নাও না।

মন্দবিষ: কিন্তু আমার ওপরে যে বামুনের অভিশাপ রয়েছে। বিনা অনুমতিতে ব্যাঙ খেতে পারব না।

এ-কথায় মন্দবিষের প্রতি জলপাদের বিশ্বাস বেড়ে গেল। সে বলল: আমি বলছি, তুমি কয়েকটা ব্যাঙ টপাটপ গিলে ফেল।

মন্দবিষ তো তা-ই চায়। তাজা তাজা ব্যাঙগুলো দেখে তার আর তর সইছিল না। সে কেবল সুযোগ খুঁজছিল। এবার জলপাদের কথায় সে-সুযোগ মিলে গেল। তাই সে মনে মনে খুশি হয়ে প্রকাশ্যে বলল: যথাজ্ঞা, মহারাজ।

এই বলে সে ঘপাঘপ কয়েকটা ব্যাঙ গিলে ফেলল। তারপর আবার নানা ভঙ্গিতে চলতে লাগল। এভাবে প্রত্যেকদিন ব্যাঙরাজের অনুমতি নিয়ে সে ব্যাঙগুলোকে সাবার করতে লাগল। জলপাদ মন্দবিষের কথায় ভুলে বোকা হয়ে আছে। কিছু বুঝতে পারছে না।

একদিন সেখানে এল এক মস্তবড় কেউটে। সে মন্দবিষকে ব্যাঙ বইতে দেখে তো অবাক! বলল: ভায়া, যাদের পেটে যাওয়ার কথা, তাদের তুমি পিঠে নিয়ে বইছ কেন? ব্যাপারখানা কি, বলো তো দেখি?

মন্দবিষ তখন বিজ্ঞের মতো বলল:

ব্যাঙগুলোকে ধৈর্য ধরে বইছি কেন শোনো।
যেমন ধৈর্য ধরেছিল বামুন যে এক কোনো।।

কেউটে: তার মানে?

মন্দবিষ: শোনো তাহলে…

ব্রাহ্মণ ও দুষ্টা ব্রাহ্মণী

এক গ্রামে থাকত এক ব্রাহ্মণ। তার স্ত্রী ছিল পরকীয়ায় আসক্ত। প্রত্যেকদিন সে ঘি আর চিনি দিয়ে সুস্বাদু ঘৃতপুর তৈরি করত। এবং স্বামীকে আড়াল করে তা নিয়ে যেত তার প্রেমিকের জন্য।

একদিন ব্রাহ্মণের সন্দেহ হলো। সে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল: কি বানাচ্ছ, গো? এসব নিয়ে নিত্য নিত্য তুমি কোথায়ই বা যাও?

ব্রাহ্মণীর ছিল অসাধারণ উপস্থিত বুদ্ধি। সে চট করে বলল: চৌমাথায় মায়ের মন্দিরে ভোগ দিতে যাই। ভোগ দিয়ে মায়ের কাছে তোমার মঙ্গল কামনা করি।

এই বলে সে ঐদিন সত্যিই খাবারগুলো নিয়ে মন্দিরে গেল। ভাবল, তার স্বামী যাতে বুঝতে পারে যে, সে রোজই মায়ের মন্দিরে যায়।

কিন্তু ব্রাহ্মণের সন্দেহ কাটছে না। সে গোপনে অন্যপথে মন্দিরে গেল। ব্ৰাহ্মণী খাবারগুলো রেখে নদীতে গেল স্নান করতে। এই সুযোগে ব্রাহ্মণ ঘরে ঢুকে দেবীমূর্তির পেছনে লুকিয়ে রইল।

ব্রাহ্মণী ফিরে এসে দেবীকে ভোগ দিয়ে কাতর সুরে বলছে: মা, কি করলে আমার স্বামী অন্ধ হবে, বলো না?

স্ত্রীর কথা শুনে ব্রাহ্মণের মাথায় যেন বজ্রপাত হলো! সে ভাবল— যার জন্য এত করি, সে আমার অন্ধত্ব কামনা করছে! হায় রে জগৎ! কাকে বিশ্বাস করব? কিন্তু সে সংযত হয়ে কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করে বলল: তাকে যদি রোজরোজ ঘৃতপুর খাওয়াতে পার, তাহলে সে অন্ধ হবে।

দেবী কথা বলছে! আমার প্রার্থনা শুনেছে! আমাকে আশীর্বাদ করেছে!—এরূপ ভেবে ব্রাহ্মণী আহ্লাদে একেবারে আটখানা হয়ে গেল। প্রফুল্লমনে সে বাড়ি ফিরে এল। এবারে সে তার প্রেমিকের সঙ্গে মনভরে বিহার করতে পারবে। এই আনন্দে সে প্রতিদিন স্বামীকে ঘৃতপুর খাওয়াতে লাগল। সে যে স্বামীর বুদ্ধির কাছে হেরে গেছে, তা সে বুঝতে পারল না।

এদিকে কয়েকদিন ঘৃতপুর খাওয়ার পর ব্রাহ্মণ একদিন স্ত্রীকে বলল: ওগো, আমি যে কিছু দেখতে পাচ্ছি না!

স্বামীর কথা শুনে ব্রাহ্মণী তো মহাখুশি। দেবী তাহলে সত্যিই প্রসন্ন হয়েছেন! আনন্দে তার যেন চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে। হৃদয়বল্লভের সঙ্গে মিলিত হতে আর কোনো বাধা নেই।

এরপর থেকে ব্রাহ্মণী আর বাইরে যায় না। তার প্রেমিকই চলে আসে বাড়িতে। দুজনে রঙ্গরসে দিন কাটায়। ব্রাহ্মণ গোপনে তা অবলোকন করে।

তারপর একদিন হাতেনাতে ধরে ফেলে দুজনকে। পুরুষটি যখন ঘরে ঢুকছিল, তখন তার চুলের মুঠি ধরে মারল এক ঘা। এতে তার ভবলীলা সাঙ্গ হলো। আর দুষ্টা ব্রাহ্মণীর নাক কেটে দিল তাড়িয়ে।

মন্দবিষ এবার মুচকি হেসে কেউটের উদ্দেশে বলল: এবার বুঝতে পেরেছ, কেন আমি এদের বহন করছি?

মন্দবিষের কথা শুনে ব্যাঙরাজ জলপাদের কেমন যেন সন্দেহ হলো। সে উদ্বেগের সঙ্গে বলল: ভাই, তোমার কথা যেন কেমন উল্টোপাল্টা মনে হচ্ছে! তোমার মনে কি কিছু আছে?

মন্দবিষ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল: না, মহারাজ। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

এভাবে ব্যাঙরাজকে ভুলিয়ে মন্দবিষ একে একে সবকটা ব্যাঙকেই সাবার করল। স্থিরজীবী এবার মেঘবর্ণের উদ্দেশে বলল: মহারাজ, মন্দবিষ যেমন বুদ্ধিবলে ব্যাঙগুলোকে শেষ করল, আমিও তেমনি বুদ্ধিবলে পেঁচার বংশ ধ্বংস করেছি। মেঘবর্ণ স্থিরজীবীর এই অভিযানের বিবরণ শুনে অত্যন্ত প্রীত হলো। সে স্থিরজীবীর বুদ্ধির প্রশংসা করতে করতে বলল: ভদ্র, শুনেছি, মহাত্মাদের মনোবলও হয় অনেক। তাঁরা একবার যা ধরেন, শত বিপদের মধ্যেও তা ছাড়েন না। তাই তো শাস্ত্র বলছে: সমাজে তিন শ্রেণীর মানুষ আছে—অধম, মধ্যম ও উত্তম। যারা বাধার ভয়ে কোনো কাজ শুরুই করে না, তারা অধম। যারা কাজ শুরু করে বাধা এলে ছেড়ে দেয়, তারা মধ্যম। আর যারা বারবার বাধা এলেও আরব্ধ কাজ শেষ না করে ছাড়ে না, তারা উত্তম। আপনি এই উত্তম শ্রেণীর। এতদিন শুনে এসেছি। আজ প্রত্যক্ষ করলাম। বুদ্ধিবলে আপনি একেবারে ঝাড়েমূলে শত্রুকে বিনাশ করলেন।

স্থিরজীবী গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বলল: এ আপনার প্রসাদেই, মহারাজ। তবে, সব সময় অস্ত্র আর শৌর্য দিয়ে সবকিছু হয় না। দেখুন—অস্ত্রের আঘাতে শত্রু মরেও মরে না, কিন্তু প্রজ্ঞার আঘাতে একেবারে মরে। অস্ত্র শত্রুর দৈহিক মৃত্যু ঘটায়, কিন্তু প্রজ্ঞা তার বংশ, খ্যাতি ও সম্পদ সব ধ্বংস করে। সুতরাং শৌর্য আর প্রজ্ঞার যেখানে মিলন ঘটে, সেখানে তো কথাই নেই।

একটু বিরাম নিয়ে স্থিরজীবী পুনরায় বলল: মহারাজ, যারা সঙ্কল্পে অটল নয়, অধ্যবসায়ে ভয় পায়, পদে পদে দোষ খোঁজে, তারা কখনো সফল হতে পারে না। বরং তারা সমাজে হাসির পাত্র হয়। যারা ভাবে—এ সামান্য কাজ, চিন্তা কি? করে ফেলব; এ অনায়াসে হয়ে যাবে—তারা পরিণামে দুঃখ ভোগ করে। তাই যতই তুচ্ছ হোক, বুদ্ধিমানেরা কোনো কাজে অবহেলা করেন না। যাঁরা নীতিবান, সাহসী, আত্মাভিমানী, পরাক্রমী তাঁরা আরব্ধ কাজের শেষ না দেখা পর্যন্ত স্বস্তি পান না। আমারও মনটা আজকে সুস্থ হয়েছে। কারণ, যে কাজের দায়িত্ব আমায় দিয়েছিলেন, তা সুসম্পন্ন হয়েছে। এবারে আপনি পুত্রপৌত্রাদিক্রমে নিষ্কণ্টক রাজ্যশ্রী ভোগ করুন। আপনার রাজচ্ছত্র, সিংহাসন আর শ্রী অচলা হোক। তবে মনে রাখবেন—

রক্ষণাদি গুণে যিনি কাড়েন প্রজা-মন।
গুণে অনুরাগী আর নেশায় বিরাগন।।
সুভৃত্যে ভালোবাসা দুষ্টে বিতাড়ন।
সেই রাজা ভুঞ্জে রাজ্য সত্যি আমরণ॥

মেঘবর্ণ বিনয়ের সঙ্গে বলল: ভদ্র, আপনার মতো রাজনীতিজ্ঞ যার মন্ত্রী, তার রাজ্য নিষ্কণ্টক হবেই। মন্ত্রী হচ্ছে রাজার মস্তকস্বরূপ। মস্তক ঠিকমতো কাজ করলে সর্বাঙ্গ সুস্থ থাকে।

স্থিরজীবী: মহারাজ, যে-রাজা রাজ্য পেয়ে ঐশ্বর্যগর্বে গর্বিত হয়, তার রাজ্য স্থায়ী হয় না। কারণ রাজ্যলক্ষ্মী হচ্ছে খুবই চঞ্চল। তাকে পাওয়া বাঁশে চড়ার মতো কঠিন। এ হচ্ছে পদ্মপাতায় জলের মতো। একটু অসাবধান হলেই পড়ে যাবে। রাজ্যলক্ষ্মী হচ্ছে বানরের মন কিংবা হাওয়ার মতো চঞ্চল। কেবল এদিক-ওদিক ছুটতে চায়। অনার্যের বন্ধুত্বের মতো, এই আছে এই নেই। একেবারেই অনিশ্চিত। তাই তো দেখুন—অভিষেকের দিন রামকে বনবাসে যেতে হলো। এমন যে মহাপরাক্রমশালী দৈত্যরাজ বলি, তাকেও পাতালে যেতে হলো। পঞ্চপাণ্ডবকে এক যুগের জন্য বনবাসে যেতে হলো। ভগবান কৃষ্ণের বংশও ধ্বংস হলো। নিষধরাজ নলকে রাজ্যভ্রষ্ট হতে হলো। দেবগণ যার দাসত্ব করত, সেই লঙ্কারাজ রাবণেরও পতন হলো। কোথায় রাজা দশরথ? কোথায় মহারাজ সগর? ত্রিভুবনজয়ী মান্ধাতা কোথায়? কোথায় দেবরাজ নহুষ? কারো রাজ্যলক্ষ্মীই স্থায়ী হয়নি। কাজেই একে ধরে রাখতে হলে সদা সতর্ক থাকতে হবে। প্রজাপালন, নীতি-অবলম্বন, ধৈর্য ও সাহস ধারণ, কঠোর পরিশ্রম ও সৎ জীবন যাপন—সংক্ষেপে এই হচ্ছে রাজধর্ম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *