কল্পনা – প্রিসিলা রাজ
১
১২ জুন ১৯৯৬ রাতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমা অপহরণের পর আজ পাঁচ বছর পার হলো। কল্পনা চাকমার আর কোনো খোঁজ মেলেনি। এই মামলাটি শেষ পর্যন্ত ধামাচাপা পড়ায় অভিযুক্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেফটেনেন্ট ফেরদৌস ও তার কতিপয় সহযোগী জড়িত থাকার বিষয়টি আর জনসমক্ষে প্রমাণিত হয়নি। তবে এও ঠিক, সরকারী সেনাবাহিনী যখন এ ধরনের ঘটনায় জড়িত থাকে তখন অপহৃত ব্যক্তির উদ্ধার পাওয়া এখনও পর্যন্ত সারা পৃথিবীতেই মোটামুটি একটা অসম্ভব ব্যাপার। তবে কল্পনার অপহরণের পর পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ঘটে যার সাথে এই অপহরণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পর্ক রয়েছে।
অপহরণ ঘটেছিল যেদিন রাতে, সেদিন সকালেই অর্থাৎ ১২ জুন হয়েছিল ‘৯৬ সালের নির্বাচন। কেউ কেউ ধারণা করেছিলেন পার্বত্য এলাকায় নির্বাচন বিঘ্নিত করার একটি কৌশল ছিল এই অপহরণ। যাই হোক, সেই প্রথম সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো অপহরণ বা হত্যাকান্ড তদন্তে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে, যার প্রধান ছিলেন বিচারপতি আব্দুল জলিল। এর আগে পাহাড়ে সংঘটিত অনেকগুলো গণহত্যার দুয়েকটির জন্য সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল, কিন্তু সেগুলো সবই ছিল এক সদস্য বিশিষ্ট। আবার সেবারই প্রথম সেনাবাহিনীকে তার কর্মকান্ডের ব্যাপারে একটু উতলা হতে দেখা গিয়েছিল। তাঁরা হেলিকপ্টারে করে কল্পনার সন্ধানদাতাকে পুরস্কৃত করার লিফলেট বিলি করেছিলেন।
অন্যদিকে, এই ঘটনার দেড় বছরে মাথায় ১৯৯৭ এর ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলো জনসংহতি সমিতি এবং আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে। এই চুক্তিতে পাহাড়ে এ পর্যন্ত সংঘটিত পাহাড়িদের বহু গণহত্যা ও অপহরণ তদন্ত, অপরাধীদের বিচার বা শাস্তি নিয়ে কোনো কথা ছিল না। এখানে আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করা দরকার, কল্পনা অপহরণের কয়েক মাসের মাথায় যখন তাঁর অপহরণ নিয়ে দেশে ও বিশ্বে একটা তোলপাড় চলছে ঠিক তখন লংগদুর গহীন বনে আঠারো জন বাঙালী কাঠুরিয়া হত্যার ঘটনা ঘটে। এই বাঙালি নিধন ছিল সম্ভবতঃ গত এক দশকেরও বেশি সময়ে পাহাড়ে সবচেয়ে বড় সাধারণ বাঙালি হত্যাকান্ড। কারা এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিল সে বিষয়ে নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি। সরকার স্বাভাবিকভাবেই জনসংহতির ওপর দোষ চাপিয়েছিল। জনসংহতিও অস্বীকার করেছিল। অনেকেই সেই সময়ে এই কাঠুরিয়া হত্যার নানা ব্যাখ্যা করেছিলেন। তবে যতদূর জানা যায়, এর পরে দেশীয় বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মহলে কল্পনার অপহরণের আলোচনায় ভাটা পড়ে। অনেকেই জনসংহতিকে কাঠুরিয়া হত্যার জন্য দায়ী মনে করে ক্ষুণ্ণ হন এবং কল্পনা উদ্ধারে নিজের চেষ্টাটুকু বন্ধ রাখেন।
কল্পনা চাকমার অপহরণ তদন্তে যে সমস্ত দল গিয়েছিল, বর্তমান লেখকের অন্তর্ভুক্তি ছিল তার দ্বিতীয়টিতে। মানবাধিকার ও সংবাদকর্মী মিলিয়ে এটি ছিল চারজনের একটি দল। এই দল সাক্ষাৎ করে কল্পনার পরিবার, স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিবর্গ এবং সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে। তবে এ দল সাক্ষাৎ করতে পারেনি অভিযুক্ত লেফটেনেন্ট ফেরদৌসের সঙ্গে। যতদূর খেয়াল আছে দলটিকে জানানো হয়েছিল যে অভিযুক্তকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তদন্ত শেষে ঢাকায় ফিরে বিভিন্ন সংবাদপত্রে এই দলটি তাদের প্রতিবেদন ছাপে।
এরপরই সরকার তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে এবাং বেশ ঘটা করে রাঙ্গামাটি সার্কিট হাউসে এই অপহরণের ব্যাপারে জনগণের সাক্ষ্য গ্রহণ করে। সেই তদন্ত রিপোর্ট পরে হিমঘরে ঢোকে, আর বের হয়নি। শোনা যায় এটি রাখা হয়েছিল স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ে, এমনকি সরকারের স্পেশাল এফেয়ার্স ডিভিশনেও নয়, যা তখন পার্বত্য বিষয়ক ইস্যুগুলো নিয়ে কাজ করত। কারণ হিসেবে যেটা জানা যায় তা হচ্ছে পাহাড় বিষয়ে আগ্রহী সাংবাদিকদের এই ডিভিশনেই আনাগোনা বেশি ছিল। ফলে কোন গতিতে রিপোর্টটি তাদের হাতে চলে যেতে পারত।
এর ফলে সরকারের এই ঘটা করে তদন্ত কমিশন বসানো ও গণসাক্ষ্য নেওয়া যে একটা লোক দেখানো ব্যাপার ছিল তা আরো পরিষ্কার হয়ে যায়। কল্পনার অপহরণের সাথে অভিযুক্ত লেফটেনেন্টের জড়িত থাকার সন্দেহ আরো প্রগাঢ় হয়। এর সাথে সাথে এই সন্দেহের ভাগিদার হয় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পুরো সেনাবাহিনীই।
২
প্রশ্ন হচ্ছে, লেফটেনেন্ট ফেরদৌস অথচ সেনাবাহিনীকে এই অপহরণ ঘটালো। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে আসলে অনেকগুলো প্রসঙ্গ একসাথে এসে পড়ে। প্রথমত: নারী অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যা, জোরপূর্বক পাহাড়ী মেয়ে বিবাহ ও তাঁদের নিয়মিতভাবে উত্যক্ত করা পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর (শুধু সেনাবাহিনী নয়, বিডিআর, আনসার ও ভিডিপি এবং পুলিশও রয়েছে এর মধ্যে। আর রয়েছে পাহাড়ে সরকারের জোচ্চুরি করে নিয়ে যাওয়া বাঙালিরাও) বিরুদ্ধে এ অভিযোগ অনেক পুরনো। পাহাড়ী পরিবারগুলোতে একটু হাঁটাহাঁটি করলে এ ধরনের বহু ঘটনার সন্ধান পাওয়া যাবে। এদিক থেকে শুধু পাহাড়ী নারী নয়, সারা দেশের নারীরাই আজ বহুদিন যাবৎ দেশের নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত সরকারী মাস্তান বাহিনীর হাতে জিম্মি।
সেদিক থেকে পাহাড়ী নারীদের বিপদ ঘটানো বাহিনীর সংখ্যা একটি বেড়েছিল মাত্র। ক্ষমতার জোরও যে তাদের পার্বত্য এলাকার যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে বেশী ছিল সন্দেহ নেই। পাহাড়ে সরকার ও তার আইন শৃংখলা বাহিনীর বর্গীরূপ কল্পনা অপহরণের আগে এভাবে দেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি। এ প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করা যাক। ১৯৯৩ কি ‘৯৪ এর শরৎকালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি নারী নির্যাতনের সংবাদ পেয়ে তদন্তের জন্য একটি দল উদ্যোগী হয়। এটিও ছিল চারজনের একটি এবং সেখানে এই লেখকেরও অন্তর্ভুক্তি ঘটেছিল। খাগড়াছড়ির গুইমারা ও দীঘিনালা এবং রাঙ্গামাটির মহালছড়ি এলাকায় সংঘটিত এইসব ঘটনার তদন্তে গিয়ে দেখা গেল, ঘটনার শিকারদের কেউ সরাসরি ধর্ষিত হননি, কিন্তু সকলেই শারীরিকভাবে বর্বর যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সেবারও তদন্তকারী দল প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে কথা বলে এবং তাঁরা অভিযোগ অস্বীকার করেন। সে সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর দুর্দান্ত দাপট ও পদে পদে গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারীদের প্রশ্নবাণ ও অনুসরণ ছিল স্বাভাবিক ঘটনা যা আজকে যারা সেখানে যাচ্ছেন তারা কল্পনাও করতে পারবেন না। যাই হোক, ফিরে এসে সেই তদন্ত প্রতিবেদন হাজার চেষ্টা করেও কোথাও ছাপানো যায়নি। এভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রামে লোকচক্ষুর অন্তরালে ঘটে গেছে হাজার নির্মমতার কাহিনী যা বাড়িয়ে দিয়েছে সংগঠনকারীদের স্পর্ধা। সেই স্পর্ধাতেই হয়তো ঘটে গেছে কল্পনার ট্র্যাজেডি।
গত কয়েক বছরে ঢাকায় বেশ কয়েকটি আদিবাসী ও সংখ্যালঘু জাতিসত্তার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার এলাকার আদিবাসীরা একত্র হয় যখন তাঁদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন সেখানে অনেকটাই জুড়ে থাকে সেইসব জাতিসত্তার নারীদের প্রশাসন ও সংখ্যাগুরু বাঙালিদের হাতে ধর্ষিত ও আরো নানা স্থূল ও সূক্ষ্ম উপায়ে নির্যাতিত হওয়ার কথা।
সংখ্যালঘু নারীদের ওপর নির্যাতন যখন এদেশের প্রেক্ষিতে আলোচিত হয় তখন তার কয়েকটি বিশেষ দিক খেয়াল রাখতে হয়। ভারত উপমহাদেশের প্রায় সব সংখ্যাগুরু জাতিগুলোর মতো বাংলাদেশেও একটা চূড়ান্ত পুরুষতান্ত্রিক জাতি শাসিত একটি সমাজ। এই জাতির নারীরা নিজেদেরই পুরুষ বা পুরুষতন্ত্রের হাতে বন্দী। আগে যে অবদমন চলতো গৃহে, তা নগরায়নের ফলে ও পেটের তাগিদে বাইরে বেরিয়ে আসা নারীদের ওপর ভিন্নভাবে ও ভিন্ন আঙ্গিকে প্রয়োগ হচ্ছে। আগে যে পুরুষটিকে নিজের স্ত্রী পিটিয়ে বা গৃহভৃত্য মেয়েটির ওপর যৌন নিপীড়ন করে সন্তুষ্ট থাকতে হত, সে এখন রাস্তায় বের হলেই পেয়ে যায় বহু পথচলতি কর্মোম্মুখ নারীকে। সে তখন অবলিলায় হাত চালায় এদের শরীরে। তাকে খুব একটা প্রতিবাদের সম্মুখীন হতে হয় না। কারণ মেয়েটি মরমে মরে থাকে অথবা প্রতিবাদ করলেই পুরুষটির সাহায্যে হাঁ হাঁ করে ছুটে আসে তারই মতো আরো বহু পুরুষ এবং অনেক সময় নারীরাও।
এদেশের জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু নারীদের নির্যাতিত হওয়ার সাথে দেশের অবশিষ্ট বাঙালি নারীদের অবস্থার মিল এখানেই। আর পার্থক্য হচ্ছে সংখ্যালঘুতা তাঁদের আরো অসহায় করে। নিজেদের সমাজও প্রয়োজনের মুহূর্তে তাঁদের পেছনে দাঁড়াতে পারে না সেই একই কারণে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষিতে এই কথা লিখতে হল এই কারণে যে, এই সেনাবাহিনী এই সংখ্যাগুরু বাঙালি সমাজেরই সন্তানদের নিয়ে গঠিত। বাঙালি মানসের পুরুষানুক্রমিক চর্চা তাঁরা ছাড়বেন কি করে?
আবার যুদ্ধে নারী নির্যাতন সেনাবাহিনীর একটা কৌশল হিসাবেও ব্যবহৃত হয়। আজ সারা বিশ্বে বিভিন্ন জাতিগত লড়াই ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও এর ব্লকভুক্ত দেশগুলোর ভাঙনের ফলে। এই সব যুদ্ধে একটি প্রক্রিয়ার কথা আজ বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে। সেটা হচ্ছে আক্রমণকারী সেনাবাহিনী কর্তৃক শিকার জনগণের বাছবিচারহীন ধর্ষণ। কারণ হিসাবে দুটি বিষয় উল্লেখ করেন পর্যবেক্ষকেরা। একটি নারী ধর্ষণের মাধ্যমে জাতিটির মর্যাদাবোধ গুঁড়িয়ে দেয়া, দ্বিতীয়টি, শিকার জনগণের শরীরে নিজেদের বীজ বপন করে একটি পৈশাচিক আনন্দ পাওয়া এবং একই সাথে তাদের জনগোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্য পাল্টে দেওয়া। এ প্রসঙ্গে ১৯৭১ এ পাকবাহিনীর এদেশে নারী নির্যাতনের ব্যাপকতা আমরা মনে করতে পারি।
নারী ধর্ষণ ও নির্যাতন বর্তমানে বিশ্বে যে কোনো সেনাবাহিনীরাই একটি নিয়মিত হাতিয়ার হয়ে উঠেছে বলেই মনে হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ঠিক কিভাবে এই অস্ত্রটি কাজে লাগিয়েছে সে বিষয়ে ব্যাপক তথ্য আমাদের হাতে নেই।
৩
জনসংহতি সমিতির সাথে বাংলাদেশ সরকারের যে শান্তিচুক্তি হয়েছে তাতে খুব সম্ভবত দীর্ঘ পঁচিশ বছরে যুদ্ধে যেসব পাহাড়ী জনগণ শহীদ হয়েছেন তাদের স্বীকৃতি বিষয়ে কোনো কথা নেই। চুক্তির কোথাও একথা বলা নেই যে এই চুক্তিতে পাহাড়ী জনগণের যে অধিকার স্বীকার করা হলো তা এইসব প্রাণের বিনিময়েই সম্ভব হলো। যুদ্ধে প্রাণ হারানো অপর পক্ষ অর্থাৎ সরকারি সেনা সদস্যদেরই বা কি মূল্যায়ন হবে তারও উল্লেখ নেই চুক্তিতে। এই ব্যাপক অস্বীকৃতি বা অনুপস্থিতির একটি ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া অপেক্ষা করছে যার প্রভাব পড়বে পরবর্তী প্রজম্মের পাহাড়ী ও বাঙালি উভয়েরই ওপর।
চুক্তির ফলে পাহাড়ীদের কি লাভ হয়েছে বা হয়নি এই ব্যাপক ও প্রয়োজনীয় তর্ককে পাশে সরিয়ে রেখে আমরা যদি এটাও বলি চুক্তির ফলে পাহাড়ীদের যা কিছু অর্জন তা তাঁদের আড়াই দশকের অবিরাম সংগ্রাম ও রক্তের ফসল, তবে সেই সব ঝরে যাওয়া প্রাণের স্বীকৃতি কোথায়, সে প্রশ্নটা কিন্তু রয়েই যায়। আজ থেকে দশ বছর পরে দেশের কচিকাঁচারা পাহাড়ীদের অবিসংবাদিত নেতা এমএন লামাকে কিভাবে জানতো? বা আদৌ কি জানবে? পাহাড়ের এবং সমতলের শিশুরা কখনও কি পাঠ্যপুস্তকে পড়তে পারবে পাহাড়ের বুকে ঘুমিয়ে থাকা অজস্র প্রাণের কথা যারা জীবন দিয়েছিলেন ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে? কল্পনা চাকমা কখনও কি ঠাই পাবেন এদেশের সরকারি ইতিহাসের লিস্টিতে এক প্রতিবাদী কণ্ঠ হিসেবে? চুক্তির যা অবয়ব এবং এখনও পর্যন্ত দেশের যা পরিস্থিতি, তাতে মোটামুটি স্পষ্টভাবেই বলা যায়, দেশের সার্বজনীন ইতিহাসে পাহাড়ী শহীদ ও তাঁদের সংগ্রামের রূপকারদের ঠাঁই হবে না। তাঁরা আরো বহুদিন পর্যন্ত সমান্তরাল ইতিহাসেরই নক্ষত্র হয়ে থাকবেন।
অনুমান করা যায় পরবর্তী প্রজম্মের বাঙালি ও পাহাড়ীদের ওপর এই অস্বীকৃতির প্রভাব হবে ভিন্ন। পাহাড়ী শিশুরা জানবে না তাদের ইতিহাসের প্রকৃত রূপকার কারা। তারা মানুষ হবে এক ধরনের শিকড়হীন অজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে। এর সবচেয়ে ভয়ানক শিকার হবে বাঙালি প্রজন্ম কেননা পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মের ভুল ধারণাই তারা বহন করবে।
এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কি শিক্ষিত, কি অশিক্ষিত-পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে একটি তথ্যই খুব ভালভাবে জানেন আর তা হচ্ছে সেখানকার পাহাড়ী বিদ্রোহীদের সাথে সরকারের চুক্তি হয়েছে। তাঁরা জানেন এই চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে স্বাধীন না হলেও প্রায় স্বাধীন করে দিয়েছে। সরকার সেখানে বাঙালিদের জন্য কিছু না রেখে পাহাড়ীদের সব দিয়ে দিয়েছে। সমতলের বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে দুইভাবে সম্পর্কিত। প্রথমটি একটি বিমূর্ত তথ্যের মাধ্যমে, পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আরেকটি, সেখানে কয়েক লক্ষ বাঙালি রয়েছেন। সমতলের লক্ষ লক্ষ বাঙালি আত্মীয়তা সূত্রে পাহাড়ের এসব বাঙালির সাথে যুক্ত। এটাই পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে তাঁদের তুলনামূলক প্রত্যক্ষ সম্পর্কটি রচনা করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও এর পাহাড়ী অধিবাসীদের যে একটি পৃথক ইতিহাস রয়েছে সে বিষয়ে তাঁরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। পরবর্তী প্রজন্ম এই অজ্ঞতাকেই বহন করবে এবং যখন স্বার্থে আঘাত লাগবে তখনই এই অজ্ঞতা তাদের মধ্যে পাহাড়ীদের প্রতি ভয়ঙ্কর হিংস্রতা ও নিষ্ঠুরতা জন্ম দেবে।
কিছুটা দূর প্রসঙ্গ হয়ে যাবে তবুও এর উল্লেখ হয়তো বাহুল্য হবে না। মার্কিন দেশে ভিয়েতনাম যুদ্ধের ওপর বা এর সাথে সংযোগ রেখে যে কয়েকটি সিনেমা এই লেখকের চোখে পড়েছে তার একটিতেও সেদেশে মার্কিন বর্বরতার সরাসরি প্রতিবাদ দেখানো হয়নি। আবার এদের অনেকগুলিতে মার্কিন দেশের ভিয়েতনাম অভিযানের সরাসরি সমর্থনও নেই। এর প্রত্যেকটিতেই যা দেখা যায় তা হলো মার্কিন জনগণকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে পাঠানোর প্রতিবাদ। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত সেই মার্কিন জনগণেরই কষ্টের গান। সে দেশের মূল ধারার মিডিয়ার এই ভূমিকার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের চেতনায় ভিয়েতনামে মার্কিনী বর্বরতার বিষয়টি সত্যিকার দাগ কাটতে পেরেছে বলে মনে হয় না বা যতটুকু কেটেছিল তা সময়ের সাথে সাথে দ্রুত মুছে গিয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে সে ধরণের কোনো ব্যাপক প্রচেষ্টার অবকাশ হয়তো নেই। কারণ ভিয়েতনাম যুদ্ধ আমেরিকার মাথা সারা বিশ্বে যেভাবে হেঁট করেছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামের কোণায় অখ্যাত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভিযান তার কাছে কিছুই না। কিন্তু তারপরও দেশীয় প্রেক্ষাপটে মার্কিন মিডিয়ার মতই কিছু কিছু আলামত চোখে পড়ে বৈকি! চুক্তি হওয়ার অব্যবহিত আগে ও পরে কোনো কোনো মহল পাহাড়ীদের সাথে যুদ্ধে সেনাসদস্য ও বাঙালি মৃত্যুর একটা হিসাব দিতেন। কেউ কেউ আরেকটু এগিয়ে পাহাড়ী- বাঙালি মৃত্যুর সাথে একটা হিসাব দিতেন যেন এই যুদ্ধে ন্যায্য ও অন্যায্য পক্ষ বলে কিছু ছিল না। যেন বাঙালি ও পাহাড়ী উভয়ে প্রাণ দিয়েছেন নিজের নিজের অধিকার রক্ষায়!
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী অধিবাসীদের নিজেদের বীর ও শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় জোর তৎপর হওয়ার সময় হয়েছে। আর সেটাও যে কোনো সংক্ষিপ্ত লড়াই নয় সেটা বলাই বাহুল্য।
৪
কল্পনা অপহরণের সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর ঢাকা থেকে মানবাধিকার কর্মী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, উকিল ইত্যাদি সমন্বয়ে আরেকটি দল বাঘাইছড়ি, কল্পনা চাকমার বাড়ী যান। শোনা যায় সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে চেপে ঘুরেছিলেন এই দলটি এবং সেনা সদস্যদের প্রহরায় কল্পনার পরিবার ও গ্রামের অধিবাসীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। এরপর ঢাকার সংবাদপত্রে তাঁরা লেখেন যে কল্পনার মা জানিয়েছেন কল্পনা ভারতে আছে। এই সংবাদ সে সময় কি উত্তেজনা তৈরি করেছিল অনেকেরই মনে আছে। তার কয়েকদিনের মধ্যে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের উদ্যোগে কল্পনার মাকে ঢাকায় এনে প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের মুখোমুখি করা হয়। কল্পনার মা চাকমা ভাষা ছাড়া আর কিছুই বলতে পারেন না। আমাদের চোখে ভাসে সাংবাদিকদের ‘কল্পনা কি সত্যিই ভারতে আছে’ প্ৰশ্ন অনুবাদের উত্তরে এই দরিদ্র, সন্তান বেদনায় আর্ত বৃদ্ধা বার বার বলছিলেন, “মিছা কথা, মিছা কধা”।
মোটামুটি সারা পৃথিবী জুড়েই আজকাল মানবাধিকার একটা লাভজনক ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা মানবাধিকার তৎপরতায় যারা প্রাণের তাগিদে যুক্ত তাঁরা যেমন স্বীকার করেন, যারা এ নিয়ে ব্যবসা করেন তাঁরাও অনেকে স্বীকার করেন। বিশ্বের অনেক বড় বড় মানবাধিকার সংস্থা এদিয়ে বেশ দুপয়সা কামাই করছে। পার্বত্য সমস্যায় এদের অনেকেরই বেশ মালকড়ি হস্তগত হয়েছে, সন্দেহ নেই। কল্পনাকে কেন্দ্র করে গুজব সৃষ্টিকারী এই শেষোক্ত দলটি সেই সব ন্যাক্কারজনক ব্যক্তিদের দ্বারাই গঠিত ছিল, সন্দেহ নেই।
আমাদের ভয় বা আপত্তি শুধু সেটা নিয়ে নয়। ভয়টা হল পেশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা মানবাধিকার সংস্থার আইনজীবী বা নিছক মানবাধিকার কর্মী পরিচয়ে এরাই বড় বড় আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে যুক্ত। দেশের গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার কর্মী বিষয়ক খবর এদের হাত হয়েই সে সব বড় সংস্থায় যায়। জাতিসংঘের মত প্রতিষ্ঠানও কখনও লতায় পাতায়, কখনো সরাসরি এদের সাথেই যুক্ত। জাতিসংঘের নীতিগত অবস্থান প্ৰকৃত অর্থে কতটা মানবাধিকারকে রক্ষা ও সমর্থন করে-এই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আলোচনার জায়গা অবশ্য এটা নয়। বাস্তব হল, এখনও বিশ্বের ক্ষুদ্র সব জনগোষ্ঠীরই আশ্রয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা এই জাতিসংঘই।
পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি রক্ষা ও সাহায্যে এখন দেশের মানুষের রাজনৈতিক চেতনায় এর খারাপ ও ভালো দুই ধরণের প্রভাবই পড়ার কথা তবে সেটাও অন্যত্র আলোচনার বিষয়। দেশের সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোর জন্য যারা লড়াই করবেন এসব সুযোগসন্ধানী ছদ্মবেশী বুদ্ধিজীবীদের মোকাবেলা করাটাও এই লড়াইয়েরই অংশ।
এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দুমুখো, আরো স্পষ্ট করে বললে “চোরকে বলে চুরি কর, গৃহস্থকে বলে সাবধান হ”, নীতি সম্পর্কে দুটো কথা বলতেই হয়। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক সংস্থাই আজ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকারে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদের অধিকার বিষয়ে এসব সংস্থা তৈরি করেছে নানান প্যাঁচালো পথে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোয় ক্ষুদ্র জাতিসত্তা নিপীড়নের কাজে লাগানো হচ্ছে।
কল্পনা চাকমা এসেছিলেন রাঙ্গামাটির প্রত্যন্ত এলাকা বাঘাইছড়ি গ্রাম থেকে। তাঁর অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সম্বল ছিল একখন্ড জমি। প্রায় নিরক্ষর দাদারা জীবন পণ করে বোনকে পড়তে পাঠান। তাঁদের আশা ছিল বোন লেখাপড়া শিখে সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু কল্পনার ক্ষুরধার চেতনায় ও মেধায় নিজের মানুষের দুর্দশা যে ছাপ ফেলেছিল তাতে তিনি নিশ্চুপ থাকতে পারেননি বা সম্পূর্ণ পরিবারমুখী হয়ে থাকতে পারেননি। তাঁকে রাজপথে নামতে হয়েছিল পাহাড়ি জাতিসত্তার অধিকার আদায়ে। কল্পনা এমন একটি সমাজে জন্মেছিলেন, পাহাড়ি মানুষের অধিকারের লড়াইয়ের পাশাপাশি।
সাংগঠনিক দক্ষতাতেও তিনি ক্রমশ: গড়ে তুলছিলেন নিজেকে। তার প্রমাণ খুব প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসা সত্ত্বেও খুব দ্রুত সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি পরবর্তীতে নিজেকে কিভাবে প্রমাণ করতেন তা এখন শুধুই অনুমানের বিষয়।
কল্পনার অপহরণের পাঁচ বছর পর এই আশঙ্কাই হয় যে, তিনি শহীদ হয়েছেন। বৃদ্ধা মা, অসহায় দরিদ্র ভাইদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তাঁকে যারা হয়তো অমানুষিক যন্ত্রণায় হত্যা করেছে তারা কোনোদিনই বিচারের সম্মুখীন হবে না। তিনি জন্মেছিলেন এমনই এক অভাগা দেশে।
তাঁর পঞ্চম অপহরণ দিবসে কল্পনা চাকমাকে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।
অপ্রকাশিত, মে ২০০১