কল্পনা চাকমা, তুমি কোথায় আছো, কেমন আছো? – এ.এন. রাশেদা
কল্পনা,
শুভেচ্ছা জেনো আমার। তোমার কাছে আমার অপরাধের শেষ নেই। ক্ষমাও নেই। ঝকঝকে চমৎকার হাতের লেখার সুন্দর এই চিঠিটা পেয়ে বিস্মিত হয়েছিলাম একদিন। তারিখ মনে নেই। তবে চিঠিতে লেখা ৪-৩-৯৫। আজ ১১ই জুলাই’ ৯৬। ঠিক একমাস আগে ১১জুন রাতে অস্ত্রের মুখে দুবৃত্তরা ধরে নিয়ে গেছে তোমাকে। পত্রিকায় লোমহর্ষক খবরটি পড়ার পর থেকেই আতংকিত হয়ে আছি- তুমি কেমন আছো ভেবে। তারপর থেকেই তোমার লেখা চিঠিটি আমি খুজঁছি যা অনেক যত্ন করে রেখেছিলাম উত্তর দিব বলে, আরও কিছু চিঠির সঙ্গে। কিন্তু একবার বইপত্র গুছানোর ফলেই হয়তবা ফাইলটা চলে গিয়েছিল স্মৃতির আড়ালে। অবশেষে আজই সকালে তা পেলাম একেবারে হাতের কাছেই।
কল্পনা, এখন তুমি কোথায় আছো- জানি না। বেঁচে আছো কিনা তাও না। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে যাই- তোমার কোন শুভ সংবাদ আছে কিনা, কেউ তোমার মুক্তি দাবী করলো কি না? শক্তিশালী জনমত গড়ে উঠেছে কি না? এ পর্যন্ত চোখে পড়েছে গুটিকয়েক বিবৃতি মহিলা পরিষদ, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদ, এবং তোমাদেরই পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ প্রভৃতির। ব্যারিস্টার শাহজাহানের সভাপতিত্বে প্রেসক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত সভার খবর দেখেছি পত্রিকায় পড়ে। আগে জানলে সভায় যেতাম।
কল্পনা, তোমর সাথে আমার অল্প সময়েরই পরিচয়। আলাপের সময়কাল খুব বেশী ছিলো না। তবে চিঠির মাঝে তুমি তোমার পরিচয় ফুটিয়ে তুলেছ। চট্টগ্রামের মাটি সহস্র বীরের রক্তে সিক্ত। এখানেই মাস্টারদা সূর্যসেন, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস, অম্বিকা চক্রবর্তী, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, সরোজিনী পাল, নলীনি পাল, কুমূদিনী রক্ষিতসহ হাজার হাজার বিপ্লবী। বৃটিশ খেদাও আন্দোলনই পরবর্তীতে আমাদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রামে। তাইতো সেদিন লাখো জনতার কণ্ঠে শ্লোগান উচ্চারিত হয়েছিলো “ সূর্যসেনের পথ ধর—বাংলাদেশ স্বাধীন কর।”
কল্পনা, যে কোন অপহরণই নিষ্ঠুরতম, বর্বরতম অপরাধ। সুস্পষ্ট মানবাধিকার লংঘন। কোন অপহরণকে ‘সাধারণ’ অপরাধ বা কোন অপহরণকে ‘ক্ষমাহীন’ ক্ষমাহীন বলব না। তবে ‘তুমি’ সাধারণ নও। দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ি জনগনের ওপর পাকিস্তানী শাসক শ্ৰেণী ও বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী যে নিপীড়ন-নির্যাতন এসেছিলো তুমি তার বিরূদ্ধে ভিতরে ভিতরে ফুঁসে উঠেছিলে। তা না হলে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের দায়িত্ব তোমাকে দিয়ে হলো কিভাবে? তোমার শিক্ষা জীবন তো এখনও শেষ হয়নি। তোমার চিঠিতে শিক্ষাজীবন শেষ করার দৃঢ় অঙ্গীকার তুমি ব্যক্ত করেছ।
কল্পনা, ষাট দশকে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণকালে প্রায় একলাখ পাহাড়িকে ঘরছাড়া করার ঘটনাকি কেউ অস্বীকার করতে পারে? লাখো প্রাণের বিনিময়ে যে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ১০টি জুম্ম জাতিসত্তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ওক্ষার চেষ্টা ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূল ধারণার সাথে সঙ্গতিবিহীন বলে যে বাতিল করা হয়েছিল- তাকে কিভাবে অস্বীকার করা যাবে? পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতির বিকাশের পথ উম্মুক্ত না করে তাদের নিজস্ব গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষানুযায়ী প্রয়োজনীয় আইনগত, প্রশাসনিক ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ না নিয়ে ১৯৭৯ সালে প্রায় ১ লাখ ছিন্নমূল বাঙালিকে পুর্নবাসন করা যে সেদিন সঠিক পদক্ষেপ ছিলো না আজও কি নানারূপ হত্যাকাণ্ড, লাঞ্চনা, ঘাত-প্রতিঘাত, নির্যাতন নানাবিধ ঘটনার মধ্য দিয়ে তা প্রমাণ হয়নি? আর সে কারণেই তো ১৯৮৫-৮৬ সালে পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতির ফলেই ৩০ হাজার পাহাড়িকে তাদের প্রাণপ্রিয় মাটি-আবাস ছেড়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল সেদিন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে; যা পরবর্তীতে ৫৬ হাজারে পৌঁছেছিল।
পাহাড়ি জনগণ কি ভুলে গেছে কল্পনা, ১৯৮০ সাল থেকে পর্যন্ত সংঘটিত নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞগুলো। যাদের মধ্যে উল্লেখ করা যায় সেই লোগাং হত্যাকাণ্ডের কথা, কলমপতি ইউনিয়ন, বেলতুলি, বেলছড়ি, ফেনীভ্যালি, পানছড়ি, তবলছড়ি, খাগড়াছড়ি, মহালছড়ি, চঙরাছড়িসহ আরও অনেক অঞ্চলের ঘটনা, নির্যাতন ও নিধনযজ্ঞের কথা।
তুমি যে ভোলনি তার প্রমাণ তোমার এই চিঠি। পাহাড়ি জনগণের নির্যাতনের প্রতিবাদে তুমি বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলে। তাতেই বুঝি ওরা তোমায় অপহরণ করেছে? তোমাকে যেই অপহরণ করুক- তারা কাপুরুষ। আর তোমার চিঠির সত্যাসত্য প্রমাণ যে তুমি নিজেই আজ কল্পনা।
আগেই বলেছি তোমার কাছে আমি অপরাধী। তবুও তোমার কাছে আমার কৈফিয়ত দেয়ার কিছু আছে। আমি সমাজের কেউকেটা কোনো ব্যক্তিত্ব নই। পেশায় শিক্ষক শিক্ষকতার পাশাপাশি যে অতি সামান্য কাজগুলো সারাক্ষণ করি তা সময়সাপেক্ষ। বড় মাপের কেউ না বলেই নানা কাজ করতে হয় নিজ হাতেই। সমাজে কারও কারও কাছে হয়তবা নিতান্তই মূল্যহীন, আমার কাছে যাই মনে হোক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুয়েত- মৈত্রী হলের এক সাংস্কৃকিত অনুষ্ঠানে পরিচয়ের সূত্রে বর্তিকা চাকমা, ঊষা চাকমাসহ কয়েকজন আমার বাসায় এসে হাজির। এতগুলো প্রাণবন্ত সজীব মেয়ের হাসিগল্পে আমার ড্রয়িংরুম ভরে উঠেছিলো যেন। তাদের সবার আবদার আমাকে যেতে হবে খাগড়াছড়িতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের প্রথম সম্মেলনে। আমি বিব্ৰত। এদেশে মহিলা আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন- নিয়মানুসারে তাদেরই যাওয়ার কথা। হয়ত কোন কারণে তাদের কাঙ্ক্ষিত কেউ যেতে পারছেন না তাই আমাকে যাওয়ার অনুরোধ। একেবারেই অযোগ্য হওয়া সত্বেও তোমাদের ডাক সেদিন অবহেলা করতে পারিনি। তোমাদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে তোমাদের আনন্দ দিতে পেরেছিলাম কি না সে মূল্যায়নের এখতিয়ার আমার নয়। পরবর্তীতে তুমি অবশ্য তা জানিয়েছ। আমি আনন্দিত হয়েছিলাম উজ্জ্বল রঙের ঘরে বোনা তোমাদের পোশাক দেখে। প্রখর রোদের মাঝেও এত উজ্জ্বল রঙের পোশাক তোমাদেরকে পাহাড়ের গায়ে যেন এক প্রস্ফুটিত ফুলের মতই মনে হচ্ছিল। তবে ব্যথিতও হয়েছিলাম—প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য হারানো উদাম চেহারা এই পার্বত্য এলাকাকে দেখে। গাছপালা পাখির কলকাকলিতে ঘেরা যে পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ার কথা—আজ তার অবশিষ্টও এ অঞ্চলে নেই। মাইলের পর মাইল বৃক্ষরাজি নিধন করে গড়ে উঠেছে বসতবাড়ি, আবাদি জমি আর মাঝে মাঝে সেনাবাহিনীর টহলরত ক্যাম্প।
কল্পনা, তোমাকে আমি লিখতে পারিনি তা শুধু সময়েরআবরণেই নয়—তা আমার চিঠি লিখতে পারার অপটুতার কারণেও। চিঠি লিখতে বসলে ভাষা আমি হারিয়ে ফেলি। কাজের কথাটি ছাড়া কিছুই মনে আসে না। আজ আমার হাজারো দুর্বলতা সত্ত্বেও লিখতে বসেছি। আমাকে যে লিখতেই হবে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নির্যাতনমুক্ত এলাকার যে আকাঙ্ক্ষা, তোমার জীবন দিয়েই যার প্রমাণ তুমি দিলে—সে কথাগুলো দুর্বল ভাষাতেই হোক, যত সীমিত ভাবে হোক আমাকে জানাতেই হবে। এদেশের সরকারী দল, বিরোধীদল, বিগত দিনে যারা শাসন করেছেন—তাদের কাছে তোমার খবর পৌঁছে দিয়ে আমি একটু হলেও অপরাধমুক্ত হতে চাই—তাই আজ তোমার চিঠির উত্তর দিতে বসেছি। কল্পনা, তোমার মুক্তি কামনায় আমি উদগ্রীব। দেশবাসী তোমাকে জানুক, তোমার মুক্তির দাবীতে প্রবল জনমত গড়ে উঠুক—সেই কামনা করছি।
ইতি
তোমারই শ্রদ্ধেয় আপা
দৈনিক সংবাদ, ৩০ শে আষাঢ়, ১৪ই জুলাই ৯৬
.