কল্পনা চাকমা ও পাথর-মা’র গল্প – সঞ্জীব দ্রং
কল্পনা চাকমা নামের পাহাড়ি মেয়েটিকে আমি কোনোদিন দেখিনি। তার জন্মভূমি লাল্যাঘোনা গ্রাম, বাঘাইছড়ি থানা, আমার যাওয়া হয়নি কখনো। তার মা, ভাইবোন কাউকে দেখিনি আমি। অথচ যতোবার রাঙ্গামাটি গেছি, আমি খোঁজ করেছি বাঘাইছড়ির পথ কতোদূর! কিন্তু যাওয়া হয়নি কোনোদিন। সে কষ্ট আজো বুকে বাজে।
আজ ১২ জুন, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমা নিখোঁজ হওয়ার দিন। ১৯৯৬ সালের ১১ জুন আনুমানিক রাত একটা/দেড়টার দিকে রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি থানার লাল্যাঘোনা গ্রামে কল্পনাদের নিজ বাড়িতে ঢুকে কতিপয় সশস্ত্র দুষ্কৃতকারী এই পাহাড়ি মেয়েটিকে অপহরণ করে নিয়ে যায় রাতের অন্ধকারে। অপহরণকারীরা প্রথমে কল্পনার ভাই ক্ষুদিরাম চাকমার চোখ বেঁধে ফেলে এবং তারপর বাঁধে অপর ভাই কালিন্দি কুমারের চোখ। অপহরণকারীরা পরে চোখ বাঁধা অবস্থায়ই তিনজনকে স্নান করার ঘাট পেরিয়ে রাতের অন্ধকারে বিলের পথে নিয়ে যায়। এ সময় বড়ো ভাই কালিন্দি কুমারের হাত ধরে হাঁটছিল কল্পনা। তখনই ক্ষুদিরাম গুলির নির্দেশ শুনে প্রাণপণে বিলের জলে ঝাঁপ দেয়। কালিন্দি কুমার পরক্ষণে গুলির শব্দ শুনতে পায় এবং ছোট ভাইকে মেরে ফেলেছে এবং তাকেও মারবে ভেবে অন্ধকারে মরণপণ দৌড় দেয়।
প্রিয় বোনটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ভাইদের থেকে রাতের আঁধারে। তারপর শেষবারের মতো কালিন্দি কুমার ছোট কল্পনার ‘দাদা দাদা’ চিৎকার ও গুলির শব্দ শুনতে পায়। সে রাতেই গ্রামবাসী পাহাড়িদের নিয়ে কালিন্দি কুমার বোনের খোঁজে বেরিয়েছিল। বোনকে খুঁজতে গিয়ে বিলের জলের ধারে ক্ষুদিরামের লুঙ্গি ও অপহরণকারীদের গুলি রাখার থলি পাওয়া যায়। ক্ষুদিরাম সে রাতে বিল সাঁতার দিয়ে বিবস্ত্র অবস্থায় পার্শ্ববর্তী প্রিয়রঞ্জন চাকমার বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিল। থানার এজাহারের সময় খয়েরি রঙের গুলির থলিটি থানায় জমা দেওয়া হয়। তারপর থেকে আজ অবধি পুরো তিনটি বছর পার হয়ে গেলো, কল্পনা চাকমা আর পাহাড়দেশে ফিরে এলো না। পাহাড়ি সংগঠনগুলো এই অপহরণের জন্য সেনাবাহিনীর একজন অফিসারকে অভিযুক্ত করে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে এবং হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালনকালে পুলিশের গুলিতে নিহত ও নিখোঁজ হয়েছে রূপন চাকমাসহ চারজন পাহাড়ি
কল্পনা চাকমাকে নিয়ে জাতীয় পত্র-পত্রিকায়, দেশে ও বিদেশে তুমুল হৈচৈ হয়। এই ভোরের কাগজে টক অফ দ্য টাউন কলামে সাংবাদিক ও কলামিষ্ট আবেদ খান প্ৰশ্ন করেন, ‘কোথায় কল্পনা চাকমা? কোথায় হারিয়ে গেলো আমাদের সেই পাহাড়ি মেয়েটি। কতোদিন হয়ে গেলো সে তো আর ফিরলো না।’ এমনকি কল্পনা চাকমার ডায়েরিও ধারাবাহিক প্রকাশ করেছিল ভোরের কাগজ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত কল্পনার বিষয়টি গড়ায়। অবশেষে বিচারপতি আ. জলিলের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটির গঠন করা হয়, কিন্তু আজও সে তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। তবে মার্চ ২৯, ১৯৯৭ তারিখে তদন্ত কমিটি রিপোর্ট নিয়ে পত্রিকায় খবর বেরোয়। তাতে বলা হয়, কল্পনা অপহৃত হয়েছে কিন্তু বেঁচে আছে। কিন্তু কোথায়, কিভাবে বেঁচে আছে তার কোনো উল্লেখ ছিল না সে রিপোর্টে। সম্মিলিত নারী সমাজ থেকে শুরু করে সকল পাহাড়ি সংগঠন প্রত্যাখান করেছিল সেই অসম্পূর্ণ ও অদ্ভুত রিপোর্ট। তদন্ত কমিটির সদস্যবৃন্দ রাঙ্গামাটিতে গিয়েও কল্পনার মা বাঁধুনি চাকমর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে বাঘাইছড়ি যাননি। সেই সময় বাঁধুনি চাকমা খুব অসুস্থ ছিলেন এবং তার দুই ছেলের মাধ্যমে তাকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সুযোগদানের জন্য তদন্ত কমিটির কাছে আবেদন করেছিলেন। এই হলো তদন্ত কমিটির কাজের নমুনা। সরকারি পয়সা এভাবেই ব্যয় হয়, পাহাড়ি মেয়ের আর খোঁজ মেলে না। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন তো তদন্তের নামে বিভ্রান্তিকর রিপোর্ট প্রদান করেছিল। হেলিকপ্টারে করে ২০ জন বিডিআরসহ এই মানবাধিকারের কর্মীরা(?) কল্পনাদের বাড়ি গিয়েছিলেন এবং একজন বাঙালি দোভাষীর মাধ্যমে কল্পনার বাংলা না জানা মা বাঁধুনি চাকমার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। পরে অসত্যের আশ্রয় নিয়ে বলেছিলেন, তারা পায়ে হেঁটে কল্পনা চাকমার বাড়িতে গিয়েছেন।
অনেক কিছুই হয়েছিল এই হতভাগ্য চাকমা মেয়েটিকে নিয়ে। ২৪ পদাতিক ডিভিশন ৫০ হাজার টাকা ঘোষণা দিয়েছিল কল্পনাকে খুঁজে দেওয়ার জন্য। কেন তারা এই ঘোষণা দিয়েছিল সে রহস্য আমি আজও জানি না।
আজ কেমন আছেন বাঁধুনি চাকমা, কালিন্দি কুমার ও ক্ষুদিরামরা লাল্যাঘোনা গ্রামে তাদের মেয়ে, বোন হারিয়ে যাওয়ার ঠিক তিন বছর পর? পার্বত্য শান্তিচুক্তি হলো, শান্তিবাহিনী ও শরণার্থী পাহাড়িরা ফিরে এলা নিজ দেশে। কল্পনার চাকমার মতো অনেকের ত্যাগ, কষ্ট, স্বপ্ন ও জীবনের বিনিময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আজ পাহাড়ি জনগণের জীবনে নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছে। পাহাড়ের মানুষ নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে সবে। আঞ্চলিক পরিষদের দায়িত্ব নিয়েছে জনসংহতি সমিতি। কিন্তু প্রশ্ন তো রয়েই যায়, পাহাড়ের চোখ দিয়ে পাহাড় দেখার দৃষ্টিভঙ্গি কি গড়ে উঠবে সবার মধ্যে? পাহাড়ি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি কি ফুটবে আবার? তাদের জায়গা-জমি-পাহাড়-অরণ্যের অধিকার কি তারা বুঝে পাবে? হারানো সবকিছু কি নিজের মতো ফেরত পাবে তারা? ক্রমবর্ধমান নোংরা রাজনীতির কি অবসান হবে পাহাড়িদের জীবন নিয়ে? হয়েছে কি? তাদের নিজস্ব জীবন-ভাষা-সংস্কৃতি কি সত্যি বিকশিত হবে? তাদের সঙ্গীত, জীবন ব্যবস্থা, গেংগুলি শিল্পীরা কি ফিরে আসবে আবার? অতীতে প্রত্যেক পাহাড়ি পরিবারে হস্তশিল্প কারখানা বা তাঁত ছিল, এখন সবই ধ্বংসপ্রাপ্ত, সেগুলো কি জেগে উঠবে আবার হাজার-হাজার কোটি টাকা ব্যয়-বিনিয়োগ হবে পার্বত্য চট্টগ্রামে, তার সুফল কি সত্যি পাবে পাহাড়ি জনগণ?
কি চেয়েছিল কল্পনা চাকমা, পাহাড়দেশের অতোটুকু মেয়ে? স্বাধীন দেশে একটুখানি জমির ওপর বাঁশের মাচাং ঘর করার স্বপ্ন, পাহাড়ের ভোরে প্রিয় গ্রামে অগণন জুমিয়া কৃষকের মুখে হাসি ফোটাবার স্বপ্ন, সাংগ্রাই-বৈসুক-বিজুতে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে একটু নির্মল আনন্দ করার স্বপ্ন কি ছিল মনে? আত্মবিশ্বাসী কোনো পাহাড়ি যুবকের হাত ধরে শ্রাবণের বিকালে বাঘাইছড়ি বনের পথে পথ চলার সাধ কি ছিল? অথবা শীতের কোনো সন্ধ্যায় বাড়ির পাশে লেকের ধারে দুজনে বসে জীবনের গল্প করার, প্রাণের কথা বলার স্বপ্ন কি ছিল মনে? অথবা পাহাড়-অরণ্য-নদী-সাগু-মাইনী-চেংগী-কাচালং গ্রামকে ভালোবেসে নিজের মতো করে পাওয়ার বাসনা কি ছিল?
আজ ১২ জুন। এ দিনেই কতো সহজে একটি সুন্দর পাহাড়ি মেয়েকে ধরে নিয়ে গেলো দুস্কৃতিকারীরা। মেয়েটি আর ফিরে এলো না কল্পনার মা বাঁধুনি চাকমা এখন বোবা ও পাথর। এ যে পাথর মা’র গল্প আছে আদিবাসী সমাজে। দেশে আড়াকাঠি এসেছিল মানুষ ধরার জন্য। বনের এক ছেলে মাকে বলেছিল, তুই ভাত রাঁধ, আমি শিকার পেলে চলে আসবো। কিন্তু ছেলেটি আর ফিরলো না। মা তার অপেক্ষায় ছেলের পথপানে চেয়ে থাকতে থাকতে নদীর ধারে পাথর হয়ে গিয়েছিল। রাঙ্গামাটি গেলেই কল্পনা চাকমার কথা মনে পড়ে আমার।
ভোরের কাগজ : ১২ জুন ১৯৯৯