কল্পনা চাকমার ডায়েরি, চিঠিপত্র ও ছবি
কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচারের দাবি : রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও প্রতিরোধ
কল্পনা চাকমা অপহরণের প্রতিক্রিয়া : বিভিন্ন লেখকদের লেখা

কল্পনা চাকমা অপহরণ প্রসঙ্গে অধিপতি জাতির আমরা – সায়দিয়া গুলরুখ

কল্পনা চাকমা অপহরণ প্রসঙ্গে অধিপতি জাতির আমরা – সায়দিয়া গুলরুখ

কল্পনা চাকমার সাথে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ওর লেখা ডায়েরী পড়ে, সহযোদ্ধাদের কাছে লেখা ওর চিঠিগুলো এই সংকলনের জন্য টাইপ করতে করতে। তারও আগে থেকে আমি ওকে চিনি, কিন্তু এতো আগে নয় যখন ওর সাথে আমার যোগাযোগ হওয়া সম্ভব। ততদিনে বাংলাদেশের বীর সেনারা কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করেছে। কল্পনা চাকমার সাথে আমার পরিচয় জাতীয় দৈনিকে ওর অপহরণের খবর পড়ে। পাঠকরা নিশ্চয়ই ভাবছেন, আমার সাথে কল্পনা চাকমার পরিচয় নিয়ে এত বাগাঢ়ম্বরের কি আছে? আছে কারণ, এর সূত্র ধরেই কয়েকটা কথা বলতে চাই।

কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে কায়েম বাংলাদেশের শাসন ব্যবহার বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখার অপরাধে। কল্পনা চাকমা সজাগ ছিলেন, পাহাড়ে শাসক জাতির ‘অন্য’ জাতি নিধনের ব্যবস্থা সম্পর্কে। পার্বত্য চট্টগামে বাঙালী অভিবাসন, সামরিক শাসন বসানো, পরিবার পরিকল্পনার নামে বলপূর্বক বন্ধ্যাকরণ কার্যক্রম, পাহাড়ি নারীদের অবৈধ অভিবাসি বাঙালি এবং বাংলাদেশ সামরিক সদস্য কতৃক ধর্ষণ, গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে বাস্তচ্যুত করা, ইচ্ছে হলেই গণহত্যা, যখন তখন পাহাড়ি গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে মাথা সমান কাদার জোকের গর্তে ফেলে রাখা, সামরিক পুরুষদের মন চাইলেই বিজু উৎসবকে শোকে সপ্তাহে পরিণত করা—এগুলো পাহাড়ে বহাল বাঙালী শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। যা এই নিধন ব্যবস্থাকে কায়েম রাখে। কল্পনা চাকমাদের লড়াই এই আধিপত্যবাদী প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে। কল্পনার ডায়েরীর পরতে পরতে তা রচিত।

যা বলতে চাইছিলাম। বলতে চাইছিলাম আমাদের পরিচয়হীনতা নিয়ে। আমি ব্যক্তিগতভাবে কল্পনাকে চিনি না সে কথা বলছি না, বলছি কল্পনার এই লড়াইয়ের জমিনটার সাথে পরিচয়হীনতার কথা। এই অপরিচয় জাতিগত। এই অজ্ঞাতযাপন বাঙালি আধিপত্যের প্রতীক। এই আড়ালযাপন আধিপত্যের সম্মতিদানকারী। পাহাড়ে যা ঘটছে, যে শাসন প্রক্রিয়াটা বলবৎ তার শাসক বৈশিষ্ট্যগুলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নতুন করে উদ্ভাবন করতে হয়নি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক প্রবর্তিত যে প্রশাসনিক এবং সামরিক কৌশল, ‘অন্য’ জাতি নিধন প্রশ্নে তারই একটা পরিবর্ধিত-পরিমার্জিত রূপ প্রযুক্ত হয়, নানাভাবে পরাধীন এবং স্বাধীন শাসনামলে। অনেকে রাগ হতে পারেন, ‘স্বাধীন’ এবং ‘পরাধীন’ আমলের পার্থক্য টানছি না বলে। পার্থক্য থাকলে তবেই না টেনে আনবো। এর সবচাইতে কাছের এবং দৃশ্যমান উদাহরণ কাপ্তাই বাঁধ, পরিকল্পনা করেছিলো ব্রিটিশ শাসকেরা, বাস্তবায়ন করেছে পাকিস্তানি শাসকেরা, আর এর বিস্তার ঘটানোর (কাপ্তাই লেকের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির মাধ্যমে) বৃহত্তর পরিকল্পনা নিয়েছে পাহাড়ে ‘শান্তি (?!)’র প্রতিষ্ঠাতা বর্তমান সরকার। এই যোগসূত্রগুলো আমাদের আর স্থাপন করার প্রয়োজন পড়ে না, দরকারইবা কি? যদি কাপ্তাই লেকে পানির উচ্চতা বাড়ালে, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পায় আর ‘গ্রাম বাংলা’র আরও কিছু ঘর আলোকিত হয়, ক্ষতি কি তাতে। না হয় আরও হাজার খানেক পাহাড়ি বেঘর হলোই বা এর জন্য। আমাদের বিনোদন নিশ্চিত করার জন্য যদি পাহাড়িদের বসতভিটায় শিশু পার্ক হয় তাহলেই বা কি আসে যায়, রাষ্ট্রতো বাঙালিদের সুবিধা নিশ্চিত করতেই এহেন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছে। আমাদের জন্য যা রাষ্ট্র প্রদত্ত সুবিধা পাহাড়িদের জন্য সেটাই নির্যাতন। আর কল্পনা তার জীবনে এই নির্যাতন ব্যবস্থা নিয়েই কথা বলে, গেছেন, তার সহযোদ্ধাদের সাথে।

পাহাড়ি বন্ধুদের শুনেছি কল্পনা চাকমার উপর সেই সেনা সদস্যের (লেফটেন্যান্ট ফেরদৌসের) ক্রোধের কারণ ছিলো, সামরিক বাহিনীর নির্দেশে বাঙালিদের পাহাড়ি বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা। যার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে লেফটেন্যান্ট ফেরদৌসকে কল্পনা কিছু কথা শুনিয়ে এসেছিলো মুখের উপর। কিন্তু সবুজ উর্দি পরা নাক উচু জাতির পুরুষেরা তা বরদাস্ত করবে কেন? তাই কল্পনা অপহরণ হলো। কল্পনার ডায়েরী আর চিঠিতে উল্লেখ আছে সামরিক বাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ হয়রানির ঘটনা। সামরিক শাসনের এ হত্যা- ধর্ষণ-নির্যাতনের চেহারা আমাদের ইতিহাসে কিন্তু অপরিচিত নয়। আমরা ৭১’র এর গণহত্যা, নারী নির্যাতনের কথা শুনে, পড়ে বার বার শিহরিত হই। কিন্তু আমরা শিহরিত হই না আমাদের স্বজাতি ভাইদের দ্বারা সংঘটিত একই নির্যাতনের কথা শুনে ( যেমন পারেনি ৭১-এ পাকিস্তানের মানুষজনেরা)। পাহাড়ে আমাদের জাত ভাইয়েরা তো যা কিছু করছে আমাদের ‘সিকিউরিটি/নিরাপত্তা’র জন্যই করে যাচ্ছেন- বিশেষজ্ঞ বিদ্যজনেরা তাই বলেন। আমাদের নিরাপত্তা পাহাড়িদের বিপদের নাম। কল্পনা চাকমারা সেই কথাই বলে যাচ্ছেন।

এ অজ্ঞাতবাস তাই নির্দোষ নয়। বাঙালি আধিপত্য নির্মাণকারী। তা বলার জন্যই এ প্রসঙ্গ তুললাম। কল্পনা চাকমা যখন অপহৃত হলেন, পত্র পত্রিকাতে খবর হলো তখন অনেককেই বলতে শুনেছি “পাহাড়ে কি হচ্ছে এসবতো আমরা জানি না, কখনও শুনি ও নি।” কিংবা “যে অন্যায় জানি না তার প্রতিবাদ করবো কিভাবে।” অথবা “সব সামরিক সদস্যরাতো আর এসব করে না।” আমাদের এই না জেনে জীবনযাপনতো শাসনে সম্মতি দিয়ে আসছে, বাঁধাহীন করছে নির্যাতনকে। ১৯৭১-এ পশ্চিম পাকিস্তানিরাও নাকি জানতো না পূর্ব পাকিস্তানে কি হচ্ছে। এ কথা তারা এখনও বলেন। বিভিন্ন সভা সেমিনারে এই ধরণের উচ্চারণের বিরূদ্ধে আমরা এখনও প্রতিবাদ করে যাচ্ছি, যাবো। কিন্তু নিজ দেশে ‘অন্য’ জাতির প্রসঙ্গে সেই একই ‘না জানা’র অনুশীলন। দুধ কলা আর ইংরেজী অক্ষর গিলে বড় হওয়া মানুষজনের এই অজানা দশা প্রথমত: অধিপতি জাতি এবং শ্রেণীর জন্য আত্মরক্ষাকারী, পক্ষান্তরে অন্য ‘জাতি’র জন্য ভীষণ বিপদজনক।

কল্পনা যখন অপহৃত হলো, তখন আমরা সোচ্চার হলাম, আমরা মানে আমরা কেউ কেউ। অধিপতি জাতির বিরাট অংশ কিন্তু সম্মতির প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখলেন। আমরা সোচ্চার হলাম কল্পনার অপহরণ প্রশ্নে, আন্দোলন গড়ে উঠলো জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই চরম দৃষ্টান্ত আমাদেরকে প্রতিবাদ করতে তৎপর করলো, আর এই উদ্বেগ, কল্পনার আগে এবং পরে পাহাড়ি নারীদের অপহরণ, ধর্ষণের শিকারের অন্য আর পাঁচটা ঘটনার মতন প্রতিবাদহীনভাবে কল্পনা অপহরণের প্রসঙ্গকে হারিয়ে যেতে দেয়নি। এই আন্দোলনকে এর থেকে বড় করে দেখার আর আজ আমাদের সুয়োগ নেই। যে কোন অপহরণ মানবাধিকার লঙ্ঘন সেই বিবেচনাবোধই মূলত: আমাদের তাড়িত করলো। কিন্তু কল্পনা অপহরণকে এত সাদামাটাভাবে বোঝা যায় না। অপহরণের এই শাস্তি তাঁকে সামরিক সদস্যরা দিয়েছে, একটা দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য “দেখো, প্রতিবাদ করলে এই হবে তার ফল।” এই অপহরণ তাই ‘অন্য’ জাতি নিধন প্রক্রিয়া সহজীকরণের/ প্রতিবাদহীন করার একটি উদ্যোগ।

আমরা কল্পনা লড়াইয়ের ক্ষেত্রটা সম্পর্কে একই ‘না জানা’ ভাব বজায় রেখেই উদ্বেগ প্রকাশ করলাম আবার ভুলেও গেলাম। এক বছর দু বছর করে ৫ বছর হতে চললো। অপহরণ তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশিত হলো না। রিপোর্ট প্রকাশিত হলেতো আর বাঙালি গরিমা নিষ্কন্টক উপভোগ্য থাকবে না। হিল উইমেন্স ফেডারেশনের বন্ধুরা জানিয়েছিলো তাও বছর দুয়েক আগে, কল্পনাকে যে সেনাসদস্য (লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস) অপহরণ করেছে তার পদোন্নতিও হয়েছে। এর মধ্যে শান্তি চুক্তি হয়েছে। আরও ধর্ষণ নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সামরিক সদস্য কতৃক পাহাড়ি নারী ধর্ষণের বিচারের দাবী উত্থাপিত হয়নি। উপরন্তু আমাদের মনোভাব এমন যে “দুষ্টু ছেলেতো সবজায়গাতেই থাকে। সামরিক বাহিনীর কতিপয় দুষ্টু ছেলেরা এমন করেছে, আর অন্যরাতো সবাই সবার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।” প্রেক্ষিত থেকে ঘটনাকে বিযুক্ত করে দেখার এই কৌশল মূল প্রসঙ্গগুলোকে অনালোচিত রাখারই প্রয়াস, আর প্রসঙ্গটা হলো : পাহাড়ে শাসক বাঙালির শ্রেষ্ঠত্ব ও আভিজাত্য রক্ষা করে সামরিক শাসন। সকলে মিলে এ অনুল্লেখের চর্চার ফলে কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচার না হয় না হোক, আরও অপহরণ ঘটে যাক। অধিপতি জাতির কি বা এসে যায়!

অপ্রকাশিত, জুন ২০০১

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *