কল্পনা চাকমার ডায়েরি, চিঠিপত্র ও ছবি
কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচারের দাবি : রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও প্রতিরোধ
কল্পনা চাকমা অপহরণের প্রতিক্রিয়া : বিভিন্ন লেখকদের লেখা

কল্পনা চাকমার লেখা

কল্পনা চাকমার লেখা – রণাঙ্গনের সারিতে আমরা হবো সৈনিক – কল্পনা চাকমা

পশ্চাৎপদ দেশে এমনকি অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশেও নারী পুরুষের অধিকারের ক্ষেত্রে বাস্তবতা অনেক বৈষম্য আরও অনেক বেশি। বিশ্বের নারী সমাজ সুদীর্ঘকাল ধরে যে পুরুষ কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে আসছে, বঞ্চনা ও অবহেলার শিকার হয়ে আসছে সে সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশ্বজুড়ে পশ্চাৎপদ দেশেও সমাজে নারীদের পারিবারিক সামাজিক নিপীড়ন একই রকম। কিন্তু আমি মনে করি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি মেয়েরা বেশি নির্যাতিত। কেননা, দীর্ঘকাল ধরে চলছে পাহাড়িদের জাতীয় অস্তিত্ব বিলুপ্তি করে দেয়ার ষড়যন্ত্র। এই পার্বত্য অঞ্চলে সবুজ শ্যামল পাহাড়ের অন্তরালে রয়েছে বুকফাটা আর্তনাদ, গগণবিদারী আর্তচিৎকার, একদিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দশ ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণের জন্য গণসংগ্রাম এবং অন্যদিকে সেই সংগ্রামকে দমন করার জন্য সামরিক প্রচেষ্টা-পার্বত্য চট্টগ্রামকে পরিণত করেছে এক অগ্নিগর্ভ রণক্ষেত্রে। এখানে উগ্র বারুদ অত্যাচারে জনজীবন হয়েছে দুর্বিসহ। দীর্ঘ অত্যাচার নির্যাতন আর যন্ত্রণায় ক্ষত-বিক্ষত পার্বত্য জনতার আজ বেদনার্ত উচ্চারণ “জীবন আমাদের নয়।” এই অবস্থায় বাংলাদেশের অপরাপর নারী সমাজের চাইতে পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীদের অবস্থা করুণ। এরূপ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে নারীর ভূমিকা পালন অত্যন্ত কঠিন কাজ নিঃসন্দেহে। তারপরেও আমাদের অগ্নি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে হবে। রণাঙ্গনের সারিতে, মুক্তির মিছিলে সামিল হতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি নারীরা একদিকে সরকারি সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বে-আইনী অনুপ্রবেশকারীদের দ্বারা প্রতিনিয়ত ধর্ষণ, অপহরণ, শ্লীলতাহানি ও চরম লাঞ্চনার শিকার হচ্ছে। অন্যদিকে তাদেরকে সামাজিক বৈষম্য গণ্ডিবদ্ধ জীবন যাপন ও পুরোনো ধ্যান ধারণায় নিমজ্জিত করে রাখা হয়েছে।

আসলে পাহাড়িদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ব্যতীত পৃথকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি নারীদের মুক্তি হতে পারে না। কাজেই নারীকে শোষণ নির্যাতন থেকে মুক্ত করতে হলে বিচ্ছিন্নভাবে শুধু নারী মুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে সেটা সম্ভব নয়। এ মুক্তি পুরুষ ও নারী জাতির একে অপরের মুক্তির সাথে সম্পর্কিত। তাই নারী ও পুরুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে হবে, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। সেজন্য প্রত্যেক জুম্ম নারীকে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে প্রকৃত নারী মুক্তি আন্দোলনে তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এগিয়ে আসতে হবে। অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। অবশ্য ইতিমধ্যে স্বাধিকার আন্দোলনে সংগ্রামরত বিভিন্ন সংগঠনের সাড়া দিয়ে পাহাড়ি নারী সমাজ কিছুটা হলেও ঐক্যবদ্ধ। যেহেতু চূড়ান্ত বিজয় এখনো অর্জিত হয়নি সেহেতু বিজয়ের জন্য আরো বেশি ঐক্যবদ্ধ হওয়া বর্তমান অবস্থায় অত্যন্ত জরুরী

আমরা এখনো সামাজিকভাবে, ধর্মীয়ভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে ও রাজনৈতিকভাবে অবহেলিত। এদেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। এই বৃহত্তর অংশকে বাদ দিয়ে কোন উন্নয়নই সম্ভব নয়। আমরা চাই এমন একটা সমাজ ব্যবস্থা যেখানে নারী পুরুষের সমানাধিকার থাকবে। এক শ্রেণীর মানুষ অন্য শ্রেণীর মানুষকে শোষণ করতে পারবেনা। এক জাতি অন্য জাতির উপর শোষণ নির্যাতন চালাতে পারবে না। সব মানুষই মানবিক গুণাবলিতে সমৃদ্ধ হবে এবং জীবন জীবিকাসহ সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমান সুযোগ সুবিধা পাবে। এ ধরনের বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই একমাত্র পরিপূর্ণ নারী মুক্তি সম্ভব।

আমাদের সামাজিক এবং পারিবারিক অবকাঠামো এমনভাবে তৈরি যে, নারীরা সচেতন হবার চেষ্টা করলে অনেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। শৃ ংখল ভেঙ্গে আসার চেষ্টা করলে অনেকে তাকে উচ্ছৃঙ্খলতা হিসাবে আখ্যায়িত করেন। আন্দোলনে সামিল হলে তাকে চরিত্রহীন বলে মনে করা হয়। কিন্তু এসব কুপমণ্ডুকতায় আমরা বিচলিত নই। বেগম রোকেয়া যেভাবে ঘুণে ধরা সমাজ থেকে বেরিয়ে এসে নারী শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছিলেন, বীরকন্যা প্রীতিলতা যেমনি কাঁধে অস্ত্র তুলে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন জীবনকে উৎসর্গ করেছেন, সেভাবে জুম্ম নারী সমাজকে জাগাতে হবে। স্বাধিকার আদায়ের মহান সংগ্রামে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

নারী অধিকার এমনি এমনি আসবে না। অধিকার কারোর দয়ার সামগ্রী নয়, অনুদানের বিষয় নয়। এ অধিকার অর্জন করতে হয়, ছিনিয়ে আনতে হয়। অধিকার বঞ্চিত পাহাড়িরা স্বাধীন বাংলাদেশে স্বতন্ত্র নিয়ে বেঁচে থাকতে চায় যা একমাত্র স্বায়ত্তশাসন কায়েমের মাধ্যমেই সম্ভব।

“পুরুষ অবরুদ্ধ আপন দেশে নারী অবরুদ্ধ নিজ নিবাসে” এ অবস্থা আর কত দিন চলবে? আর আমাদের জুম্ম নারীদের অবস্থার বর্ণনা করার জন্য আমরা আর কতদিন বলব-

“সচল হয়েও অচল সে
যে বস্তার চেয়েও ভারী
মানুষ হয়েও সঙ-এর পুতুল
পার্বত্য কোলের নারী।”

প্রথম প্রকাশ, স্বাধিকার : বুলেটিং নং—সাত, ২০ আগস্ট ‘৯৭

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *