কল্পনা চাকমার ডায়েরি, চিঠিপত্র ও ছবি
কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচারের দাবি : রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও প্রতিরোধ
কল্পনা চাকমা অপহরণের প্রতিক্রিয়া : বিভিন্ন লেখকদের লেখা

কল্পনা চাকমার ডায়েরি থেকে – এফ.এম.এ. সালাম

কল্পনা চাকমার ডায়েরি থেকে – এফ.এম.এ. সালাম

অপহরণের ৪০ দিন পার হয়ে যাওয়ার পরেও কল্পনা চাকমা অপহরণ রহস্যের কোনো কূলকিনারা করা সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। প্রশাসনের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যও এতে ফুটে উঠেছে। লেখালেখির সুবাদে কল্পনার বাড়ি বাঘাইছড়ি যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।

গত ২১ জুন রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি থানার উদ্দেশ্যে আমি ও শিশির মোড়ল ঢাকা থেকে যাত্রা করি। খাগড়াছড়ি জেলা শহরে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। পরের দিন ২২ জুন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের দুজন সদস্যা ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের একজন সদস্যসহ বাঘাইছড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। বাসে দীঘিনালা হয়ে স্থানীয় সুপরিচিত চাঁদের গাড়িতে বাঘাইহাট। এখান থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় মারিশ্যা বাজার। স্থানীয় এক চাকমা ডাক্তারের বাড়িতে রাত্রি যাপন করে ২৩ জুন ৪ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে কল্পনার বাড়ি নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামে পৌঁছি।

গ্রামবাসী ইতিমধ্যে আমাদের আগমন বার্তা পেয়ে গেছে; তাই কল্পনার বাড়ির আঙ্গিনায় অনেক মানুষের ভিড় লক্ষ্য করলাম। কিন্তু সবাই নীরব বিহ্বল। মনে হলো এ স্তব্ধতা অমিলিত নীরব প্রতিবাদ।

কল্পনার মা ও ভাবীর সঙ্গে আলাপ শেষ করে শিশির মোড়ল যখন তাদের ক্যামেরাবন্দি করছিলেন, তখন আমি সুমিতা চাকমাকে (হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সদস্যা) কল্পনার কোন ছবি পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করলাম। কল্পনার ভাবী চারুবালার সাহায্য সুমিতা কল্পনার ব্যক্তিগত ব্যবহারের ব্যাগটি নিয়ে আসে। ব্যাগ হাতড়িয়ে কল্পনার দুকপি ছবি ও একটি নোট বুক পাওয়া যায়। প্রথমেই নোটবুকটি আমি হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতেই চোখে পড়লো কয়েকটি লাইন-

‘জীবন মানেই তো সংগ্রাম, আর সংগ্রামী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ নোটসমূহ’ এর ঠিক নিচে লেখা

১৪০২ বাংলায় যে কোনো সময়ে Note করা হয়েছে। পৃষ্ঠার ঠিক নিচে ইংরেজিতে লেখা- KALPANA CHAKMA NEW LALLY GHONA.

এসব কল্পনার নিজের হাতে লেখা। জানালেন কল্পনার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী জ্যোৎস্না চাকমা। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীরা অবহেলিত এ সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছিল কল্পনা মৰ্মে মর্মে। লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, অপমান, অসহায়ত্ব, শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন থেকে নারী সমাজেব মুক্তি কামনায় কল্পনা তার নোট বুকে লিখেছেন, ‘বোনেরা জেগে উঠুন, শৃঙ্খল ভেঙে ফেলুন’। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে অধিকার বঞ্চিত নারীসমাজের কথা বলতে গিয়ে কল্পনা লিখেছেন- প্রকৃতপক্ষে নারীকে জমিসহ কোন প্রকার সম্পদেই সমানাধিকার দেওয়া হয়নি।

পার্বত্য অঞ্চলের নারীদের জীবন চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে কল্পনা লিখেছেন ‘এদিকে সেনা ও বাঙালিদের কর্তৃক, ধর্ষণ-নির্যাতন-শ্লীলতাহানি, অপমান-অসহায়ত্বের নির্মম অত্যাচারের ষ্টিম রোলার, অন্যদিকে অসামাজিক বৈষম্য গণ্ডিবদ্ধ জীবনযাপন এবং নারীপুরুষের বিভেদ’।

এসব অবস্থার মধ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানো কঠিন জেনেও কল্পনা সহকর্মীদের নারী অধিকার আদায়ের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এভাবে- ‘আমাদের অগ্নিপরীক্ষার মধ্যদিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে হবে’।

নোট বুকের এক জায়গায় কল্পনা বেইজিং চতুর্থ বিশ্বনারী সম্মেলনে ‘দ্য প্লাটফরম ফর এ্যাকশন-এ নারী সমাজের অগ্রগতির পথে যেসব বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছে তা লিখে রেখেছেন। পরে বর্তিকা চাকমার কাছ থেকে জেনেছি, কল্পনারও এ সম্মেলনে যোগদানের কথা ছিল। কিন্তু রেজিষ্ট্রেশনের অর্থ সংগ্রহ করতে না পারায় তার যাওয়া হয়নি।

নোটবুকের এক জায়গায় কল্পনা বাংলাদেশের সংবিধানে নারীকে সম্পত্তির সমানাধিকার দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে, পারিবারিক সম্পর্ক এবং সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে ধর্ম’। বুঝতে পারলাম সংবিধানে ধর্মের দোহাই দিয়ে অধিকারকে শৃঙ্খলিত করাকে কল্পনা মেনে নিতে পারেননি।

কল্পনা, শুধু পাহাড়ি নারীদের কথা ভাবেননি, ভেবেছেন সমগ্র বাংলার নারী অধিকারের কথা। তাইতো তার স্বগতোক্তি- ‘আমি মনে করি আমাদের দেশের মেয়েরা বেশি নিপীড়িত’। শুধু বিভিন্ন সম্মেলনে কল্পনার কিছু বক্তব্য, নিজস্ব স্মৃতিচারণ ব্যতিত নোটবুকের অধিকাংশ লেখাই সংগৃহীত। কল্পনার নোটবুকটি নেহায়েতই সাধারণ। কিন্তু এ সাধারণের মাঝেই তার চিন্তাচেতনার কল্পনার অসাধারণত্ব ফুটে উঠেছে। কল্পনার নোটবুকের শেষের বাক্যগুলোতে রয়েছে অধিকার আদায়ের আন্দোলনের বিপ্লবী শ্লোগান হিল উইমেন্স ফেডারেশনের অঙ্গীকার আদায় করব অধিকার’।

ভোরের কাগজ ২৪ জুলাই ‘৯৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *