কল্পনা চাকমার ডায়েরি, চিঠিপত্র ও ছবি
কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচারের দাবি : রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও প্রতিরোধ
কল্পনা চাকমা অপহরণের প্রতিক্রিয়া : বিভিন্ন লেখকদের লেখা

কল্পনা চাকমার চিঠিপত্র

কল্পনা চাকমার চিঠিপত্র

নিউলাল্যাঘোনা
তাং-২৮-১১-৯৩ইং

রূপক’ দা

আমার সংগ্রামী শুভেচ্ছা এবং বিপ্লবী অভিনন্দন নিবেন। দীর্ঘদিন ধরে আপনার পত্রের অপেক্ষায় রয়েছি যেহেতু আপনাকে ঠিকানা দিয়েছিলাম। এতদিন খাগড়াছড়ি দীঘিনালার খবর শুনে খুব খারাপ লেগেছে। খারাপ লেগেছে সংগ্রামী সহযোদ্ধাদের আহত খবর শুনে, তার অধিক খারাপ লেগেছে নানিয়াচরের মৃতের সংখ্যা শুনে, এমনি মুহূর্তে আপনার পত্র পেয়ে কিছুটা আনন্দবোধ করছি। তাতেও দেখি আপনার মনটা ভালো নেই। যাক তবুও মন খারাপের মধ্যে লিখলেও আপনার উপদেশ আমাকে যথেষ্ট প্রেরণা যুগিয়েছে।

রূপক’দা আপনি লিখেছেন, আমার কার্যক্রম আপনাদের সফরকারী দলটির সবায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আমি মনে করি এ আপনার বদান্যতা আমি এ প্রশংসার যোগ্য নই। যেহেতু প্রশংসা পাওয়ার মত কাজ আমি আপনাদেরকে দেখাতে পারিনি।

হ্যাঁ, যতদূর সম্ভব নারী সমাজের, দেশ ও জাতির কাজে এ যাবৎ পর্যন্ত কাজ চালিয়ে আসতেছি এবং নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছি। এ ব্যাপারে আপনারাই সাহায্য সহযোগিতা করবেন জেনে খুবই আনন্দিত হয়েছি। তাই রূপকা’দা আপনি জানেন, আমাদের নারী সমাজ পুরুষদের চেয়ে বহু পিছিয়ে তাই আমি আশা করছি এ ব্যাপারে আপনার কাছ থেকে চিঠির মাধ্যমে বহু মূল্যবান উপদেশ এবং পরামর্শ পাব।

রূপক ‘দা আপনি হয়ত শুনেছেন, আপনারা এখানে থেকে যাওয়ার সপ্তাহ খানেকের পরই এক পাহাড়ি মেয়েকে বাঙ্গালী নরপশু কর্তৃক হত্যা করা হয়। এরই প্রতিবাদে আমরা নবগঠিত কমিটি মিছিল করেছি এবং স্মারকলিপিও পেশ করেছি। কিন্তু ফল এখনও পাওয়া যাই নাই। যদিওবা O.C এবং T. N. O তদন্ত করার আশ্বাস দেন। সেই কুখ্যাত নরপশুটি এখনো গ্রেফতার হয়নি এ ব্যাপারে আপনার পরামর্শ দিতে পারেন কি?

রূপক’দা আপনি জেনে হয়ত খুশি হবেন যে, নানিয়াচরে হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে যদিওবা এখানে, মিছিল নিষিদ্ধ করা হয়, তবু ও আমরা বাঘাইছড়িতে এরই পরিবর্তে ২ দিন ব্যাপী যথাক্রমে ২৩- ২৪ তারিখ পর্যন্ত ধর্মঘট পালিত হয়। অফিস হইতে যাবতীয় দোকান পাঠ পর্যন্ত বন্ধ ছিল। তবে অফিস ১ দিন পর খুলে দেওয়া হয়। এরপর ২৫-২৭ তারিখ পর্যন্ত বাঘাইছড়ি এলাকার বাঙালী ছাত্র গণ পরিষদ ৩ দিনব্যাপী হিংসাত্মকভাবে ধর্মঘট পালন করে। এরপর আমরা আরো মারিশ্যা বাজারসহ ২টি হাট অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করেছি। বর্তমানে এখানের পরিস্থিতি খুবই প্রতিকূল। আজ আর নয়। সংগ্রামী শুভেচ্ছাসহ কোম্‌পানায়-

কল্পনা চাকমা
মহিলা সম্পাদিকা ও
আহ্বায়িকা HWF
বাঘাইছড়ি শাখা

বি: দ্র:- প্রত্যুত্তর করবেন। আগের ঠিকানায় অথবা এ ঠিকানায় লিখুন। আপনার সঙ্গী পুলকা’দা কোথায়? তিনিতো এখনও লিখেন নাই। তাঁকেও ঠিকানা দিয়েছি।

.

বাঘাইছড়ি
তাং-২০-০৯-৯৪ইং

রূপক ’দা

শুভেচ্ছা জানবেন। আমার পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে লেখা আপনার পত্র হস্তগত হয়েছে। আমার পরীক্ষার আগে আপনাকে একটি পত্র লিখেছি পেয়েছেন কি?

আমরা গত ১৩ তারিখ শিক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষে বিশাল ছাত্র সমাবেশের মাধ্যমে স্মারকলিপি পেশ করেছি এবং উক্ত সমাবেশে সম্প্রতি আমাদের গ্রামে কুখ্যাত সেনারা নারী নির্যাতন চালিয়েছিল তার প্রতিবাদও করা হয়।

পরীক্ষা কেমন দিলাম জানতে চেয়েছেন পরীক্ষার কথা বলতে গেলেতো আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। কাচালং কলেজের অবস্থাতো হয়তো এতদিনে জেনে গেছেন। গতবারের মত এবারেও রেজাল্ট হয় কিনা সন্দেহ। প্যানেলে যারা এসেছেন তাদের সাথে প্রিন্সিপালের রিপোর্ট কড়াকড়ি হয়। শেষ পর্যন্ত তারা ছাত্রদের উপর রিপোর্ট করেছিল। অথচ ছাত্ররা এসব কিছু জানতে পারেও না। তবে এগুলি শুনা কথা। কতদূর সত্য মিথ্যা এখনও জানতে পারছিনা আমার English 2nd paper অত্যন্ত খারাপ হয়েছে। তাই পাশের আশা করতে পারছি না। জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে না পেরে আমি এখন কি করব ভেবে পাচ্ছি না। ভেবেছি, পরীক্ষায় পাশ না করা পর্যন্ত সংগ্রাম স্থগিত রাখব কিন্তু নেহাত অন্যায় আমার সামনে ঘটে যাচ্ছে কিছুতেই সহ্য করতে পারি নাই। প্রতিবাদ করতে হয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে।

বর্তমানে বাঘাইছড়িতে ঝুঁকিপূর্ণ কার্যক্রম চলছে লেজুড়দের নিয়ে। গত ১৩ তারিখ সমাবেশ শেষে এক লেজুড় পি.সি.পি কে মাস্তানী ডাকাত বলে অপদস্ত করায় তাকে উত্তম মধ্যম দিতে বাধ্য হয়েছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে চাইলে কর্মীদের কাছ থেকে জানতে পারবেন। বিশেষ আর নয়, সেখানকার খবর জানিয়ে লিখবেন।

ধন্যবাদান্তে
কল্পনা চাকমা

বি:দ্র: তাড়াতে লেখা হলো ভুল হলে শুদ্ধ করবেন।

.

চলার পথে
তাং ২৯-১২-৯৪ইং

রূপক ’দা

সংগ্রামী শুভেচ্ছা ও বিপ্লবী অভিনন্দন আপনাকে এবং আপনার মাধ্যমে সেখানকার সকল সহযোদ্ধাদের।

আজ অনেকদিন পর লেখা আরম্ভ করছি। কি খবর? কেমন আছেন? ধরে নিচ্ছি কুশলেই থাকবেন। আপনার অনেক পূর্বে লেখা পত্র পেয়ে এতদিন উত্তর করতে পারিনি বলে প্রথমে ক্ষমা চয়ে নিচ্ছি।

রূপক’দা আমি আশা করেছিলাম আমাদের থানা সম্মেলনে আপনিও আসবেন। কিন্তু আসলেন না। কোমলদার কাছে জানতে পেরেছি আপনি খাগড়ার H. W. F এর সম্মেলনে আসবেন বিধায় আসা সম্ভব হয়নি। খাগড়ার সম্মেলনে আসছেন তো?

হ্যাঁ, সম্মেলনের পর থেকেই আমাদের এখানে সেনাবাহিনীরা ছাত্র/গণ পরিষদের কর্মীদের উপর বিভিন্ন নির্যাতন মারধর চালাচ্ছে। বর্তমানে বাঘাইছড়ির পরিস্থিতি মোটামুটি বলা যায় অশান্ত। গত ৭ তারিখে সহ-সভাপতি বীরকে বেপরোয়া মারধর এবং ৮ তারিখে সাংস্কৃতিক সম্পাদক রতনকে হয়রানি এবং তার কাছ থেকে পি.সি.পি-র রশিদ বই ১ টি রেখেছে এবং সাংগঠনিক সীল। এরপর ১৯ তারিখে গণ-পরিষদের তথ্য গবেষণা সম্পাদকের নিজ বাড়ীতে রাতে মারধর করে চলে যায় সেনারা। তাছাড়া শীতের রাত্রিতে গ্রামে ঘুরে ঘুমন্ত লোকজনকে জাগিয়ে তুলে শান্তিবাহিনীর অজুহাতে বাড়ী বাড়ী তল্লাসী চালাচ্ছে। যাক এসব। যতই ঘাত প্রতিঘাত আসুক না কেন সহজেই প্রতিহত করতে পারবে না, এখন আমাদের H. W. F এর সম্মেলন সফল করার জন্য প্রস্তুতি চলছে। ও হ্যাঁ, সঞ্চিতাদের খবর শুনেছেন কি? অর্থাৎ বুবংকুদের খবর। না শুনলে দেখা হলে বিস্তারিত আলাপ হবে।

আজ তাড়াতে আর নয়। সেখানকার খবরাখবর জানিয়ে লেখার আমন্ত্রণ রইলো।

আবারো সালাম এবং শুভেচ্ছা জানিয়ে—

ইতি আপনার পরিচিতা
কল্পনা

বিঃদ্রঃ আমি আজ খাগড়ায় যাচ্ছি। মিটিং-এ যোগদান করতে। দিলীপদার ছবিটা একটু দিয়ে দিবেন।

.

বাঘাইছড়ি
তাং ২৫-০৮-৯৫ইং

রূপক ’দা

আন্তরিক শুভেচ্ছা জানবেন। অনেকদিন হলো আপনাকে লেখা হচ্ছে না। হয়ত অভিমান হয়ে থাকবেন তাই না? যা কিছু বলেন না কেন সবই মেনে নেব। কারণ আমি লিখতে পারিনি।

গতবারে আপনার লেখা চিঠি দিলীপদার মাধ্যমে পেয়েছি। চিঠিতে আমার দৃষ্টিকোণ থেকে সাজেক সফরের কথা জানতে চেয়েছেন। তবে আমি বলবো দিলীপদার মাধ্যমে অনেক শুনেছেন মনে হয়। তাই নতুন করে বলার প্রয়োজন মনে করছি না। তারপর ও সেই সফরটি অনেক পুরনো হয়ে গেছে। এখন বললে হয়ত ইন্টাররেষ্ট লাগবে না তাই না? সে জন্য জানালাম না। তারপর ও যদি শুনার ইচ্ছা থাকে লিখবেন। আজ আপনাকে সাজেকের বর্তমান পরিস্থিতি সমন্ধে জানাব।

গত ১০ই জুলাই সাজেকের আমতলা নামে একটি হাটে সেনাবাহিনীর দেয়া অস্ত্র দিয়ে সেখানকার পাংখু এবং ভারতের মিজোরামের মিজোদের যৌথভাবে গোলা বর্ষণ করে ১জন পাবলিক নিহত হয়। মূলত S. B-দের মারার জন্য সেনাবাহিনীরা পাংখুদেরকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখাচ্ছে। বর্তমানে সাজেকের ইউ. পি চেয়ারম্যান (পাংথু) মিজোদের বলে S. B দের সাথে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। অপরদিকে আমাদের সশস্ত্র ভাইয়েরাও নাকি ভাবাকুল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে সেখানকার জনগণ ভয়শঙ্কুল জীবন কাটাচ্ছে। এ খবরটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। এবার কাচালং পরিস্থিতি—এতদিন নিশ্চয় শুনেছেন গণশত্রু পারিজাতকে হামলা করার পর বেশ কয়েক জনের উপর কেইস করা হয়েছে। সেটার মকদ্দমা নাকি আগামী ৩০ শে আগস্ট রাঙ্গামাটিতে হবে। তাতে যাদের উপর কেইস করা হয়েছে তারা যাবে না। এখানকার চেয়ারম্যান যোগদান করবে। যাক আজ আর নয়, পরিশেষে আবারো শুভেচ্ছা জানিয়ে এখানে শেষ করছি।

ধন্যবাদান্তে
কল্পনা

বিঃ দ্রঃ ও হ্যাঁ, রূপক’দা আপনার ঠিকানাটা হারিয়েছি। ঠিকানা জানাবেন।

.

বাঘাইছড়ি
তাং ৩/২/৯৪

সহযোদ্ধা রূপক ’দা

আপনার পাঠানো পত্র গতমাসের ৯ তারিখ হস্তগত হয়। বিস্তারিত অবগত হলাম। এতদিন কিছু ঝামেলার কারণে উত্তর করতে দেরী হলো। সেজন্য দুঃখিত এবং তারপরে আপনাদের পরীক্ষা চলছে। আপনি জেনে হয়ত আনন্দিত হবেন যে, আমাদের এখানে যুগ যুগ ধরে ঝিমিয়ে থাকা নারী সমাজকে সচেতন করার লক্ষ্যে গত ৩০শে জুন হইতে শাখা কমিটি গঠন আরম্ভ করেছি।

এবং সম্ভব হলে রমজানের পর একটি সম্মেলন করার কর্মসূচী রয়েছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপট মূল্যায়ন করে আমাদের নারী সমাজকে আরো দ্রুত অগ্রগতির লক্ষ্যে আমরা গত ২৬শে জানুঃ আমাদের কমিটি পূর্ণাঙ্গ করেছি।

জুম্ম জাতির সংকট মুহূর্তে একদিকে যেমনি ছাত্র পরিষদের কার্যক্রম শক্তিশালী হচ্ছে অপরদিকে তেমনি তারই পাশাপাশী H. W. F নতুন আর্বিভাবে আমাদের আন্দোলন হচ্ছে আরো বলিয়ান তাইনা? হয়ত আর বেশী দেরী নেই আমাদের সেই বহুদিনের প্রশ্নের উত্তর পাবার।

হ্যাঁ, আপনার পত্রপাঠ করে জানতে পারলাম World এ H. W. F এর পরিচিতির কথা। জানেন, এটি আমি শাখা কমিটি করার সময় প্রতিটি স্কুলে ও জানিয়ে দিচ্ছি। বেশ আনন্দ লাগছে। এভাবে সেখানকার খবর জানাবেনতো। হ্যাঁ বিজয়াদির কাছ থেকে শুনলাম সেখানে বই মেলার H. W. F এর পক্ষ থেকেও একটি দোকান দিবে। বেশ খুশী হয়েছি। বিস্তারিত জানাবেন।

আজ আর নয়। সময়ও সংকীর্ণ। পরিশেষে শুভ নববর্ষ হোক আমাদের মুক্তির বছর। এই কামনা রেখে আপনাকে নববর্ষে সংগ্রামী রক্তিম শুভেচ্ছা জানিয়ে

কল্পনা চাকমা

বি : দ্রঃ আপনার পরীক্ষা কেমন হচ্ছে? আপনি কোন বিষয় নিয়ে পড়ছেন? আশা করি জানাবেন। সময় সংকীর্ণতার কারণে পুলকদাকে লিখতে পারলাম না। বন্ধের সময় সেখানে আপনারা থাকবেন কি?

নিউলাল্যাঘোনা
বাঘাইছড়ি
তাং-১৪-১১-৯৩ইং

.

প্ৰদীপন ’দা

আমার সংগ্রামী শুভেচ্ছা নিবেন। ইতিমধ্যে সেখানকার অবস্থা কেমন আছে জানিনা। শুনেছি সেখানে গণ্ডগোল হয়েছে। কেমন আছেন জানাবেন তো? আপনার লেখা পত্র গত ৮ তারিখ হস্তগত হয়েছে। তাতে আমাদের নারী সংগঠনের যে ব্যাখা দিয়েছেন তৎজন্য আমার ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে এবং H. W. F এর পক্ষ থেকে জানাচ্ছি ধন্যবাদসহ সংগ্রামী রক্তিম শুভেচ্ছা এবং বিপ্লবী অভিনন্দন। আপনার পত্র পেয়ে এবারে বেশ H. W. F সম্বন্ধে বুঝতে পেরেছি এবং পারছি। যেহেতু কমিটি গঠন করার আগে লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তেমন কিছু ধারণা ছিল না।

হ্যাঁ, না দেখাকে দেখা অজানাকে জানা অবশ্যই প্রয়োজন। এখানে আসলে আমার সহযোগীতা অবশ্যই থাকবে। তবে H. S. C পরীক্ষার ভিতর দিয়ে তেমন দীর্ঘ সময় নিয়ে ঘুরা সম্ভব হবেনা মনে হয়। কেননা পরীক্ষার জন্য ঝামেলায় রয়েছি। সে জন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত। যদি পরীক্ষার পরে হয় তাহলে মোটামুটি আশ্বাস দিতে পারি। তাই আপনার ইচ্ছা এর ভিতর আসবেন কিনা? আসলেও পারবেন। হ্যাঁ, আমারও বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখার একান্ত ইচ্ছা তবে আমাদের জেলা বাদে অন্য কোথাও যাইনি, তাই পরবর্তীতে আপনাদের এলাকায় আসব বলে মনস্থ করেছি। তবে পরীক্ষার পরে।

এবারে আপনি যে কতগুলি প্রশ্ন করেছেন সেদিকে আসা যাক আপনি জানেন আমাদের কমিটি এখনো পূর্ণাঙ্গ হয়নি। এবং তার সাথে আমরা এখনো আন্দোলনে নতুন। ১ বৎসর হলো পাহাড় ছাত্র পরিষদে সহযোগীতা দিয়ে আসছি। সে আন্দোলনে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, সে অভিজ্ঞতায় আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান দিয়ে সংক্ষেপে আপনার প্রশ্নের জবাব দিতে চললাম। প্রথমত আপনি জানতে চেয়েছেন-আমি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কি ভাবছি? উত্তরে আমি বলবো সেটা সময়েই জবাব দিবে। কেননা যেটা স্থির করা হয়, সময়ের প্রয়োজনে অনেক কিছু পরিবর্তন ঘটতে পারে। আর দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে সমাজ ব্যবস্থা কিভাবে পরিবর্তন করা যায়? উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে এ প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হলে নারী পুরুষকে সুশিক্ষিত হতে হবে। কেননা যে জাতির নারী সমাজ অনুন্নত সে জাতিতে উন্নত সমাজ ব্যবস্থা আদৌ সম্ভব নয়।

তৃতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে—অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আমি ভূমিকা রাখতে পারি কিনা? যতদূর সম্ভব অবশ্যই থাকবে। অধিকার আদয়ের লক্ষ্য ১ বছর যাবৎ আন্দোলন করে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছি এবং সবাইকে অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্যও জনসমাবেশে ডাক দিয়েছি।

চতুর্থ প্রশ্নটি হচ্ছে—নারীদের কি ভূমিকা নেয়া দরকার? আমি মনে করি, পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের ভূমিকাও থাকতে হবে। বিশেষ করে নারী নির্যাতন, হত্যা ধর্ষণ ইত্যাদির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে এবং প্রত্যেককে স্বাবলম্বী হতে হবে।

পঞ্চম প্রশ্নটি হচ্ছে পুরুষরা নারীদের কোন কোন ক্ষেত্রে সহযোগীতা দেবে? আমি পূর্বে বলেছি, আমাদের কমিটি এখনও পূর্ণাঙ্গ কমিটি নয় এবং আমরা এখনও নতুন। সে ক্ষেত্রে আপনিই জানাবেন কোন ক্ষেত্রে সহযোগীতা দেবেন। আমার মতে, যতদিন পর্যন্ত নারীরা অগ্রসর হয়ে থাকবে ততদিন পর্যন্ত সচেতন প্রগতিশীল পুরুষরা আমাদের নারীদেরকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা দেওয়া প্রয়োজন। কেননা আপনি জানেন আমাদের নারী সমাজ যদিওবা পুরুষদের পাশাপাশি শিক্ষিত হয়ে উঠে তবুও বিভিন্ন কাজ কর্মে এখনো অনগ্রসর। ভাই প্রগতিশীল শিক্ষিত মহলকে সবক্ষেত্রে নারী সমাজকে জাগিয়ে তুলতে হবে। দেখিয়ে দিতে হবে পাহাড়ি সমাজ ব্যবস্থায় কি করার প্রয়োজন। এখানেই শেষ করলাম আপনার প্রশ্নের উত্তর। জানি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে অনেকাংশে ভুল হয়েছে। আশা করি আপনি আরও বিস্তারিত বুঝিয়ে লিখবেন। পরিশেষে আপনার সংগ্রামী চেতনা আরো সুদৃঢ় ও উজ্জ্বল হোক এই কামনান্তে-

কল্পনা চাকমা
আহবায়িকা, HWF, বাঘাইছড়ি শাখা।

বি:দ্র: এবারে পত্র লিখলে শ্রদ্ধেয়া গৌরী C/O-এ লিখবেন।

.

বাঘাই ছড়ি
তাং ০৭-১১-৯৫ইং

প্ৰদীপন’দা

অনেক অনেক রক্তিম শুভেচ্ছা। আপনার ২৮-১০-৯৫ এ লেখা চিঠি ০৬-১১-৯৫ ইং পেলাম তুলনামূলক ভাবে চিঠি দেরীতে পৌঁছায়। তার কারণটি হচ্ছে এখানে বেশী দেৱী পড়ে যায়। আমি পোষ্টের সীল দিয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম আপনার ২৮শে অক্টোবর লেখা ১লা নভেঃ পৌঁছেছে। আরো অনেক সময় দেখি সপ্তাহ খানেক লেগেছে। সেটা বাদে আমার হাতে পৌঁছেতে সময় লাগে ৩-৬ দিন। এই অবস্থায় বেশী দেরী হয়ে যায়। অপরদিকে লোকের হাতে পাঠালে সেটা হয়ে যায় অনিশ্চিত। যাক্ তবুও দেরীতে পৌঁছলেও খবরাখবর জানাশুনার তো প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে আপনার ভূমিকা থাকবে বেশী। কারণ এখানকার কোন জরুরী কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কথা না থাকলে আমি তখন লিখবো না, তারপরও জানাবার থাকলে অবশ্যই জানাব। আর আপনি সকল বিষয় সম্বন্ধে অবগত করবেন।

হ্যাঁ, এ সমস্ত কথা আপনি না জানতেন তা, অবশ্যই আমি জানতাম না। সেজন্য আপনি ধন্যবাদ পাবার যোগ্য।

JSS লেজুরদের প্রশ্রয়ের ব্যাপারে আপনার পত্র পাওয়ার আগেই সেকথা শুনেছি। বর্তমানে সঠিক পরিস্থিতিসহ এলাকার প্রতিক্রিয়াশীলদের ব্যাপার নিয়ে এখানকার তিন শাখা মিলে বৈঠক চলছে। এখানকার একজন লেজুরকে কি করা যায় সে বিষয়ে আগামীকাল সিদ্ধান্ত হবে। আজ অতি সংক্ষিপ্ত সময়ে লিখছি। আমি সেখানে না আসলে তো আপনার সাথে দেখা হচ্ছে না। চেষ্টা করবো আসতে। আজ আর নয়।

আমি দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেছি।

শুভেচ্ছাসহ
কল্পনা

.

বাঘাইছড়ি হইতে
তাং ০৫-০৯-৯৪ইং

প্ৰদীপন’দা

অজস্র সংগ্রামী শুভেচ্ছা এবং বিপ্লবী অভিনন্দন আপনাকে এবং সেখানের সকল সহযোদ্ধাদের। নিশ্চয় ভালো আছেন।

আজ অনেকদিন হলো আপনার সাথে যোগাযোগ নেই। তাই আজ পরীক্ষার শেষ মুহূর্তে লিখা আরম্ভ করছি। কবিতা’দির মাধ্যমে জানতে পারলাম আগামী ডিসেম্বরের শেষের দিকে Hill Women Federation এর কেন্দ্রীয় কমিটি (নতুন) গঠন করা হবে। জেনে বেশ খুশি হয়েছি।

কারণ বর্তমানে যারা কেন্দ্রে রয়েছেন নির্যাতিত শোষিত জনতাকে সংগঠিত করার ব্যাপারে তাঁদের কোন ভূমিকা দেখা গেল না বা কেন্দ্র হতে কোন নির্দেশও আসল না। চট্টগ্রামে পি.সি.পি-র কাউন্সিলে অনেক আশা ভরসায় গেছি H. W. F-এর কেন্দ্রীয় নেত্রীদের সাথে কথা বলব, মত বিনিময় করব। বিভিন্ন বিষয় আলোচনার কথা বাদই দিলাম, কেউ H. W. F-এর নেত্রী হিসেবে পরিচিত হলো না।

আজ যারা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন তারাই যদি এর ভূমিকা না রাখেন তাহলে আমাদের আর কি করার আছে?

বর্তমানে আপনাদের কর্মসূচী কি কি রয়েছে? চিটাগাং এর দালালদের খবর কি? তাদের গ্যাং কতদূর শক্ত করলো?

শুনেছি বিজয়াদি নাকি কর্মজীবনে প্রবেশ করেছেন। তাঁর ঠিকানাটি পাঠাতে বলবেন।

হ্যাঁ, আপনি মারিশ্যায় সফর করার কথা ছিল, কবে আসবেন? সময় নিয়ে অবশ্যই আসবেন। বিজয়াদিও মারিশ্যায় সফর দেয়ার কথা বলেছেন, কবে আসবেন অবশ্যই জানাবেন। আজ আর নয়।

সংগ্রামী রক্তিম শুভেচ্ছান্তে
আপনারই পরিচিত
কল্পনা চাকমা
বাঘাইছড়ি

বি:দ্র: H. W. F-এর কি কি দফা বা কর্মসূচী হতে পারে এ বিষয়ে আপনার মতামত জানিয়ে লিখুন। কবিতাদির চিঠিটা একটু পৌঁছে দেবেন। সেখানকার খবর জানিয়ে লিখুন।

.

তাং ২৮-০৬-৯৫ ইং

সহযোদ্ধা “কবিতাদিদি”

শুরুতেই সংগ্রামী শুভেচ্ছাসহ আন্তরিক প্রীতি অভিনন্দন তোমাকে এবং তোমার মাধ্যমে সকল শুভার্থী শুভাকাংখীদের। আশাতে ভালো থাকবে নিশ্চয়। আর এদিকে আমিও সমাগত অগ্নিপরীক্ষার জন্য ব্যস্ত।

কেন্দ্রীয় সফরকারী দীপ্তি’দার কাছ থেকে জানলাম তোমরা বান্দরবনে সফরে গেছো। শুনে বেশ আনন্দিত হয়েছি। আর অন্য জায়গায় কেউ গেছে কি? H. W. F থেকে? এখানে আমিও উপস্থিত ছিলাম কেন্দ্রীয় পক্ষ হয়ে। আমাদের আরো বিভিন্ন ভাবে সফর করা উচিত। কেননা আমি অনেক দিন হতে লক্ষ্য করছি আমাদের নারীদেরকে বিভিন্ন মিটিং সমাবেশে (কেন্দ্র ব্যতীত) সমান মর্যাদা দেয়া হয় না অর্থাৎ গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয় না। ইদানিং আমাদের থানায় বেশী পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে সাক্ষাতে আলোচনা হবে। আসলে সচেতন পুরুষ সমাজ নারীদের ব্যাপারেটা অনুভব না করার ফলে এখনো অবহেলিত বিষয় হিসেবে রয়েছে।

কবিতাদি, বেইজিং Conference এ যোগদান করার ব্যাপারে বর্তমানে কি চিন্তা ভাবনা করতেছ? জানাবে। আজ কালাবাবুর কাছ থেকে জানলাম তুমি নাকি ঢাকায় গেছ। তার কাছ থেকে শুনলাম একটু করে তোমার পাসপোর্টের কোন কিছু ভেজাল হয়েছে কিনা? তবে সে কিন্তু কিছুই বলেনি। বিস্তারিত তোমার কাছ থেকে জেনে নেয়ার কথা বললো। তাই তুমি সেসব বিস্তারিত লিখে জানাবে। বেইজিং Conference-এ যদি যাওয়া সম্ভব হয় তাহলে আমাদের ১৩ জাতির ঐতিহ্য সংস্কৃতি সম্বন্ধে ধারণা থাকতে হবে। তবে এ ব্যাপারে আমার যদি যাওয়া হয় পরীক্ষার শেষে চাকমাদের ঐতিহ্য সংস্কৃতি নিয়ে এখানকার বুদ্ধিজীবীদের সাথে আলোচনায় বসার কথা রয়েছে। যদি সম্ভব হয় তখন তুমি আসলেও ভালো হবে। আর এখানকার শাখার প্রোগ্রাম আমাদের পরীক্ষার শেষে স্কুল এবং আঞ্চলিক শাখাগুলোতে কাউন্সিল করা। পারলে তখন দু’তিন জন এসো। আমাদের সফরসঙ্গী হওয়া যাবে। তোমরা যদি আসো তাহলে আমাদের পরীক্ষার ভিতরে লিখে জানাবে পরে আমরা দিন তারিখ জানাতে পারবো।

ও হ্যাঁ, দি, আমাদের Wall Mat বুনার কাজ কতদূর এগোলো? এখানকার বুদ্ধিজীবীদের সাথে বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে সেই Wall Mat এর শ্লোগানের কথা অবতারণা হয়। তাতে বুদ্ধিজীবীরা আমাকে পরামর্শ দেয় সেই শ্লোগানটা অর্থাৎ “শান্তির জন্য চাই স্বায়ত্তশাসন” এটা এভাবে না হয়ে “বাঁচার জন্য চাই স্বায়ত্বশাসন” এভাবে নাকি হওয়া উচিত। তবে আমি সেটাতেও একমত কারণ মূলত আমরা বেঁচে থাকার তাগিদে সংগ্রাম আন্দোলন করছি। তাই বেচে থাকতে পারলে স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হলে শান্তি আপনা আপনি এসে যাবে। তাই আমি সেই শ্লোগানটার সাথে একমত। তাই যদি বুনন কাজ বাকী থাকে তাহলে এটা দিলে মনে হয় ভালো হবে। সে ব্যাপারে বর্তিকাদির সাথে যোগাযোগ করো। তবে তাকে আমি চিঠি লিখেছি। তারপরও তোমার মতামতের প্রয়োজন রয়েছে।

কবিতাদি, সেখানকার খবর তো একদিনও আমাকে জানালে না। দালালদের অবস্থা নাকি করুণ হয়েছে। প্রদীপন’দাকেও নাকি শ্রীঘরে যেতে হয়েছে। প্রদীপন’দার ব্যাপার নিয়ে কি কর্মসূচী নেয়া হচ্ছে জানাবে।

হ্যাঁ, শুনলাম সেখানে H. W. F নাকি নারীদের নির্যাতনের বিরু দ্ধে মিছিল করবে। এখানে ঘটে যাওয়া রিপোটিগুলো হয়ত দীপ্তিদার কাছ থেকে ইতিমধ্যে পেয়েছে। তবে ৬৫ বছরের বৃদ্ধা মহিলাকে ধর্ষণের চেষ্টা, এটা দীপ্তিদার হাতে পৌঁছেছে কিনা জানিনা তাই সেটা পাঠালাম। আজ অতি স্বল্প সময়ে লিখলাম, ভুল হতে পারে শুদ্ধ করিও।

আবারো শুভেচ্ছান্তে
কল্পনা

.

রিপোর্ট

১. তারিখ – ০৮/০৬/৯৫ইং রোজ বৃহস্পতিবার।

২. স্থান – বনবিহার সংলগ্ন এরিয়া, বাঘাইছড়ি রাবার বাগান।

৩. ঘটনাকারী – আতাউল হক তালুকদার (২০) এস.এস.সি ১৯৯৫ (অবসর)
পিতা: আবুল কাসেম তালুকদার, সদস্য
৩২ নং বাঘাইছড়ি ইউ.পি
গ্রাম: উগলছড়ি।

৪. ঘটনার স্বীকার — সূর্যমুখী চাকমা (৬৫)
স্বামী: চন্দ্ৰ মোহন চাকমা
গ্রাম: বাঘাইছড়ি রাবার বাগান।

৫. ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ—উক্ত তারিখে মিসেস সূর্যমুখী চাকমা তার মেয়ের বাড়ী হতে সকাল আনুমানিক ৭টার সময় নিজ বাড়ীতে যাওয়ার সময় কাচালং বনবিহার এর সংলগ্ন স্থান থেকে উক্ত যুবকটি ধরা দেয়। কিছু কথাবার্তা আলাপের মধ্য পথে চলে যাওয়ার সময় এর সামান্য পাশে জমিতে দ্বারস্থ জঙ্গলে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। ৬৫ বছরের বুড়ীটি আত্মসম্মান বাঁচানোর জন্য মরণপণ চেষ্টা চালায় কিন্তু যুবকের শক্তির সঙ্গে পাল্টা দিতে না পেরে বুড়ীটি শারিরীকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। তারপরও কঠোর চেষ্টা করেও ধর্ষণ করতে না পেরে অবশেষে বুড়ীর সর্বমোট টাকা ৩০০/- নিয়ে পালিয়ে যায়।

উল্লেখ্য যে, আত্মইজ্জত বাঁচানোর জন্য বুড়ী প্রচেষ্টা চালালে উক্ত যুবকটি তাকে কিল ঘুষি মারে। ফলে বুড়ি আহত হয়।

এটি ১৫/৬/৯৬ ইং এ আমাদের সাক্ষাৎকারের রিপোর্ট মূলে লিখিত।

.

হতে-নিউ লাল্যাঘোনা
তাং ১৬-০৭-৯৪

রূপক’দা

আপনার পত্র যথাসময়ে হস্তগত হল। অনেক দিন হলো লিখছি না বলে পরীক্ষার সন্নিকটে হলেও লিখতে বসেছি। আশাকরি ইতিমধ্যে ভালো রয়েছেন। আমি কিন্তু তেমন ভালো নেই। তাই মানসিকভাবে খুবই দুর্বল হয়েছি। গতবারে আমাদের রেজাল্ট না হওয়াতে এবারে মানসিকভাবে তেমন উৎসাহ বোধ হচ্ছে না।

হ্যাঁ, যদিও পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত চিন্তায় রয়েছি তবুও এর মাঝে আপনার পত্র পেয়ে আনন্দ লাগছে কারণ আমি আরো একজন বড় ভাই পেয়েছি। যদিওবা পিতা বেঁচে না থাকেন তবুও বড় ভাই কয়েক জনকে পেয়েছি। মাঝে মাঝে নিজেকে অসহায় ভাবি কিন্তু আসলে অসহায় নই। যদিও আপনি বা অন্যান্যরা থাকেন এককোণে এবং আমি থাকি আরেক কোণে তবুও চিঠিপত্রের মাধ্যমে ভাব প্রকাশের ফলে অতি নিকটে আছেন বলে মনে হয়। অপরদিকে একসাথে একই সংগঠন করছি বলে অতি কাছের এবং আপন মনে হয় যারা সংগ্রামী চেতনাশীল তাদের সাথে পরিচয় হলে সহজে আন্তরিক ভেবে নিই। তাই আপনাকেও আপন ভাই মনে করি।

হ্যাঁ, রূপক’দা যদিও এতোদিন অনেক পত্র লেখালেখি হয় এবং সাক্ষাৎ হয় কিন্তু ব্যক্তিগত পরিচয় এবং সংগঠনের কথাবার্তা ছাড়া কোন আলোচনা হয়নি। হ্যাঁ, এখন তবে জানলাম আপনার ছোট বোন নেই। আগামী পত্রে আপনাদের বিস্তারিত পরিচয় দেবেন আশা করি। আপনার ছোট বোন বলে এসব জানবার আগ্রহ প্রকাশ করছি। আমার সম্পূর্ণ পরিচয় জানতে ইচ্ছে করলে পরবর্তীতে জানাব।

এবারে বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে লিখবেন। এবং সাথে সেখানকার খবরাখবর জানাবেন। পরিশেষে সংগ্রামী রক্তিম অভিবাদন আপনাকে এবং আপনার মাধ্যমে সেখানকার সকল সংগ্রামী যোদ্ধাদের।

আপনার সংগ্রামী জীবন উত্তরোত্তর সাফল্য ও অগ্রগতি কামনান্তে

কল্পনা চাকমা
(বিপ্পো)

.

বাঘাইছড়ি
তাং-২৮-১০-৯৫

কবিতাদি

অনেক অনেক আন্তরিক শুভেচ্ছা তোমাকে এবং তোমার মাধ্যমে সেখানকার সকল সাথীদের। কেমন আছ? এবং সেখানকার পরিস্থিতি?

বর্তমানে CHT-র নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন খুবই সংকটাপন্ন। বিশেষ করে যা শুনলাম তোমাদের খাগড়ার অবস্থা। সে যাই হোক আমি আশা করি তোমরা যখন আছ ষড়যন্ত্র যতই করা হোক না কেন সুকৌশলে সবই উৎখাত হবে। সাথে আমরাও আছি।

আমদের H. W. F-এর Central committee-র বৈঠক হচ্ছে কি? সম্ভব হলে নেত্রীদের অর্থাৎ সুচরিতাদিদের সাথে পরামর্শ করে বৈঠকের আয়োজন করা হোক, কেননা আমাদের অনেক আলাপ আলোচনা করা উচিত। প্রচুর পরিমাণে আলোচনার শূণ্যতা অনুভব করছি। যা গতবারে তোমার পত্রেও উল্লেখ করেছ। এখন আমার তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার খুব ইচ্ছে হচ্ছে।

বেশ কদিন আগে প্রদীপনদার ঠিকানায় একখামে তোমাকে চিঠি লিখেছি। আশাকরি এতদিন পেয়ে থাকবে। তোমাকে লিখার কয়েকদিন পরে তোমাদের Gift করা কলম দুটি পেয়েছি সাথে জ্যোৎস্নারটাও দিয়ে আসি। সে জন্য ধন্যবাদ তোমাকে এবং তোমার মাধ্যমে বর্তিকাদিকেও।

কবিতাদি হয়ত এতদিন শুনে থাকবে এখানকার H. W. F-এর কর্মীরা প্রায়ই এবারে পাশ করেছে। আমিও দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ। এখন BCom নেবো? নাকি B. S. C নেবো ভাবছি।

পরিশেষে এখানকার কার্যক্রম সমন্ধে দু’একটি কথা উল্লেখ করি। সেনাবাহিনীর মদদে টাকাখোর ছাত্রদের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে এখানকার PCP শাখা আজ অনেকদিন ধরে সফর করছে। গতকালই তা শেষে করলো সাফল্যজনকভাবে। আগামী মাসে প্রথম সপ্তাহে আমাদের তিন কমিটির উদ্যোগে এলাকার বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ মিটিং হতে যাবে। তাতে আমিও উপস্থিত থাকবো।

আর নয়। আবারো শুভেচ্ছাসহ

কল্পনা
২৮-১০-৯৫

বিঃ দ্রঃ আগামী ৩০শে অক্টোবরতো অশুভ শক্তির প্রতিরোধ দিবস পালন হবে তাই না? সফলতা কামনা করি। বৈঠকে বসা সম্ভব হলেও লিখে জানাবে না হলেও লিখে জানাবে। পোস্টে লিখলে ৮/১০ দিনের মধ্যে পেয়ে থাকি।

.

বাঘাইছড়ি
তাং-১২-১০-৯৫ইং

কবিতাদি

আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন তোমাকে ও তোমার মাধ্যমে সেখানকার সব সাথীদের। অনেক দিন হলো তোমাদের বেইজিং সফরের অভিজ্ঞতা এবং সফলতা সমন্ধে জানার জন্য আগ্রহভরে অপেক্ষা করছিলাম, কিন্তু কারোর কাছ থেকে জানতে পারিনি। বিশেষ করে সফরকারী দল থেকে। অবশেষে গতকাল একগাদা চিঠি আসল। তাতে দেখি তোমার লেখা ২০-০৯-৯৫ এবং ০১-১০-৯৫ ইং তারিখের চিঠি। বেশ আনন্দিত বোধ করছি। এরই আগে বেইজিং-এর সফলতার কথা রিপুদির কাছ থেকে শুনেছি। এবার তোমার দৃষ্টিকোণ থেকে জানিয়েছ বলে ধন্যবাদ। তারপরও কিছুটা অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। যেহেতু বিস্তারিত সকল বিষয়ে জানাওনি। সে থাক পৃথকভাবে জানাবার প্রয়োজন নেই। কারণ তোমরা গিয়েছো আমাদের প্রতিনিধি হয়ে। কাজেই এইসব ব্যাপার স্যাপার কি হয়েছে না হয়েছে এসব কিছুই অত্র কমিটির জানা প্রয়োজন আছে। সেজন্য Central committee-র একটা বৈঠক বসা জরুরী। শুধু তাই নয় আগামী দুমাস পরে আসছে কেন্দ্রীয় কাউন্সিল ও সম্মেলন। তাই এখন বিভিন্ন কর্মসূচী নেয়া প্রয়োজন কাজেই বৈঠক Call করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়ছে আমার এখন সেখানে আসা সম্ভব হচ্ছে না। বৈঠকের চিঠি পেলে চলে আসব। ১৩ই অক্টোবরে দীঘি নালা আসা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ তোমার চিঠি দেরীতে পৌঁছার কারণে এই সংকীৰ্ণ সময়ে আসা সম্ভব হয়নি।

আর তোমাদের পাঠানো কলমগুলো বর্তমানে আমার হাতে হস্তগত হয়নি। তুমি কার হাতে পাঠিয়েছ? এবং কত তারিখ পাঠিয়েছ তোমার চিঠি দুটোতে একই কথা উল্লেখ থাকায় কোন তারিখে পাঠিয়েছ বুঝে উঠতে পারছি না।

কবিতাদি বেশ মাস কয়েক হলো আমি বেশ উদ্ধিগ্ন অবস্থায় রয়েছি এখানকার PCP শাখা আর H. W. F-এর মধ্যে মতাদর্শগত অথবা মতবিরোধের কারণে। সেজন্য আমি আগামীতে অথবা বর্তমানে আন্দোলনে সক্রিয় কিংবা একনিষ্ট থাকবো কিনা তাও বর্তমানে ভাবাকূল। যাক্ সাক্ষাতে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

আবারো আন্তরিক শুভেচ্ছায়

ইতি
কল্পনা চাকমা

.

হতে মিতিঙ্গাছড়ি
বরকল
তাং-১১/৩/৯৬

কবিতাদি

সংগ্রামী শুভেচ্ছা। তোমার চিঠি যথাসময়ে হস্তগত হয়েছে। যে বিষয়ে লিখেছ তা আদৌতে আমার পক্ষে সম্ভব হবে কিনা সন্দেহ। তারপর সময়ও খুব সংকীর্ণ। এই সংকীর্ণ সময়ের মধ্যে যে প্রাণবন্ত কিছু লিখতে পারব তা আশা করা যাচ্ছে না কারণ আমি লেখার বিষয় এখনো হাত দেইনি। তাই সম্ভব হলে যে বিষয়টি পাঠিয়েছ সেটা আমার আশায় না থেকে অন্য একজনকে লেখার কথা বলো। আমি ব্যক্তিগত এবং সাংগঠনিক ঝামেলার কারণে লিখতে পারি কিনা সন্দেহ। লিখতে পারলেও নির্দ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেখানে পৌঁছাবে কিনা অনিশ্চিত। যাক তবুও সময় পেলে প্রচেষ্টা চালাব লেখার।

আমার বর্তমানে সেখানে আসা সম্ভব হচ্ছে না। তুমি নিজেই জান সেখানে আসতে সমস্যা অনেক। তোমরা আমার অবর্তমানেও সব কাজ গুছিয়ে নিতে পারবে আশা করি। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে তোমাদেরকে সহযোগিতা করতে কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না আসার। জানি তোমরা অনেক ব্যস্ততায় রয়েছ।

আমি এখন বরকল থানার মিতিঙ্গাছড়ি গ্রামে বরকল শাখার সম্মেলনে যোগদান করতে এসেছি। আজ আমরা জ্যোৎস্না, মুজ, সম্প্রীতি, তিরোহিত— মোট পাঁচজন বাঘাইছড়ি থেকে এসেছি। ঐ দিকে আমাদের এলাকার পরিস্থিতি বর্তমানে অস্বাভাবিকতা বিরাজমান। বিশেষ করে আমাদের গ্রামসহ ৩/৪ টি গ্রামে। অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় দিনাতিপাত করছি। এই ঘটনাসহ বিস্তারিত সমাবেশে আমার বন্ধুদের কাছ থেকে শুনতে পারবে। তাছাড়া আর নয়। এখন যাবার মুখে আছি। শেষান্তে আবারো শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানিয়ে।

ইতি
কল্পনা

বি:দ্র: সময় পেলে যোগাযোগ রেখো।

.

নিউ লাল্যাঘোনা
১/৪/৯৬

সৈকত’দা,

শুভেচ্ছা নিবেন। গতকালই আপনার চিঠি হস্তগত হল। আমরা এখন শারীরিকভাবে সুষ্ঠ আছি। কিন্তু হঠাৎ কখন যে কি হয় তার জন্য মানসিকভাবে একটু চিন্তিত।

এখানকার খবর হলো—গত ২৮/২/৯৬ ইং তারিখে দুষ্কৃতিকারী ইসহাককে ধরে নিয়ে গেলে এলাকার বাঙালীরা পাহাড়িদেরকে আক্রমণ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এমনি উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে PCP শাখার ৩য় বার্ষিক সম্মেলন (পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী) গত ৭/৩/৯৬ ইং তারিখে সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো। এতে পূর্ব রঞ্জনকে সভাপতি, ধরণীময়কে সম্পাদক এবং প্রবীরকে সাংগঠনিক সম্পাদক নিযুক্ত করে ১৯ সদস্য বিশিষ্ট থানা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। বাঘাইছড়ি শাখা এবারে প্রথম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছিল। এতে ‘৮৮-র নরক নাট্যও পরিবেশন করা হয়।

ঐদিকে ১১/৩/৯৬ ইং তারিখ হতে বাঙালীদের উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে। মিটিং মিছিল করতেছে। সেদিনে থেকে পাহাড়িদের “ধাও পালাও” অবস্থা। তবে তখন আমি উপস্থিত ছিলাম না। সাংগঠনিক সফরের জন্য বরকল ছিলাম। সেখান থেকে খবর পেয়ে ১৩ তারিখ ফিরে বিস্তারিত জানলাম। তখন বাঙালীরা পাহাড়িদেরকে বাজারে যাওয়া, বাঙালী পাড়ায় ঢুকা, তাদের সাথে কথা বলা সম্পূর্ণ নিষেধ করে দিয়েছে। তারপর শুরু হলো পাহাড়িদের ঐক্য করার কাজ। অর্থাৎ আক্রমণে প্রতিরোধ ব্যবস্থা সমগ্র কাচালং ব্যাপী। দিবারাত্রি পাহারা দেয়ার ব্যবস্থা হলো। ঐদিকে আমাদের গ্রামের সেনাবাহিনীর ক্যাম্প কমান্ডার দুষ্কৃতিকারী লেঃ ফেরদৌস মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে গ্রামের মুরুব্বীদের সাথে বৈঠকে বসে। সে থেকে ছোটোখাটো বহু ঘটনা ঘটে চলছে। বিশেষ করে বাঙালীদের টার্গেট হচ্ছে ঘটনাস্থল বটতলাসহ আমাদের পাশাপাশি ৪টি গ্রাম।

এই অবস্থায় ১৯ মার্চ রাতে সমগ্র কাচালং ব্যাপী চিৎকার পড়লে কুখ্যাত ফেরদৌস আমাদের নিউলাল্যাঘোনা গ্রামে এসে ৭টি পরিবারের মোট ৯টি বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় এবং পাহাড়ি পাহারাদারদেরকে ব্যাপক মারধর করেছে। এরপর DC, SP এবং যোগাযোগ কমিটির (JSS) সদস্য মথুরা লাল চাকমাসহ মিটিং-এ বসে বর্তমান কয়েকদিনের জন্য পরিস্থিতি শান্ত হয় এবং আগামী ৫ই মার্চের মধ্যে ইসহাককে ছেড়ে না দিলে বাঙালীরা আরো পরিস্থিতি ঘোলাটে করবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। DC, SP-ও বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। বর্তমানে এলাকার জনগণের আতঙ্ক ৫ তারিখের পর পরিস্থিতি কি হয়। প্রায় অনিশ্চিত জীবন কাটাতে হচ্ছে।

এবারের উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মূলে উত্তেজিত বাঙালীদেরকে একটা শিক্ষা দেয়া হলো। তা হচ্ছে আগে পাহাড়িরা গ্রাম ছেড়ে পালাতো কিন্তু বর্তমানে পাহাড়িরা দলবদ্ধভাবে যেদিকে চিৎকার পড়বে সেদিকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এই সংঘবদ্ধতা দেখে কিছুটা হলেও উচ্ছৃঙ্খল বাঙালীরাসহ সবাই ভয় পাচ্ছে। যে ঐক্য প্রশাসনসহ সবাই স্বচক্ষে দেখেছে।

বর্তমান সর্বশেষ পরিস্থিতি হচ্ছে—বাঘাইছড়িকে সবদিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। চাকমাদের টেলিফোনের লাইনও কেটে দিয়েছে আর অন্যান্য টেলিফোনগুলোও পাহাড়িদের দেয়া নিষেধ। আমরা এখন হাটে নগরে কোথাও যেতে পারি না। হয়ত পরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত চিঠির যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কারণ পোষ্টেও যেতে পারবো না।

আজ আর নয়। পরিশেষে বৈসাবি’র আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে শেষ করছি।

ইতি
কে, সি
১/৪/৯৬

বি:দ্র: তাড়াতাড়িতে লেখা হলো। বাক্য উল্টাপাল্টা হলে শুদ্ধ করবেন।

.

নিউ লাল্যাঘোনা
তাং- ১৫ই ফেব্রুয়ারি ‘৯৬

সৈকত’দা,

অশেষ প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানবেন। ধরে নিচ্ছি এতদিন রা.বি থেকে খাগড়ায় এসেছেন। তাই খাগড়ার ঠিকানায় লিখলাম। আশাকরি ভালো আছেন।

কিছুদিন হলো আপনার লেখা চিঠি হস্তগত হয়ে জানতে পেরেছি কমলের হাতে পাঠানো চিঠি

পাননি। আর এরই ভিতর তার সাথেও আমার কোন যোগাযোগ নেই। জানিনা ঐ চিঠিগুলো কোথায় আছে এতদিন। হয়ত তার সাথে দেখা হলে পেতে পারেন। সে থাক।

বর্তমানে দেশের রাজনীতির পাশাপাশি আমাদের CHT-র সংকটাপন্ন রাজনীতিও কোনদিকে মোড় নিতে যাচ্ছে জানি না। গত ৯ই ফেব্রু: খাগড়াতে যে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে আমরাও যোগদান করতে এসেছি কিন্তু কি আর করা যায় বাস্তবতার প্রেক্ষিতে সমাবেশের পূর্ণাঙ্গ অবলোকন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সেদিন খাগড়ার সার্বিক পরিস্থিতি কেমন ছিল তা এতদিন শুনেছেন নিশ্চয়। তারপরও উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করে আমাদের সমাবেশ সফলতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে।

সৈকতদা, এবারের সমাবেশে আমরা কিভাবে যোগদান করেছি তা আপনাকে না জানিয়ে পারছি না। সেদিন ৯ তারিখে আমরা দু’ঘন্টা পথ দ্রুত বেগে অতিক্রম করে বাঘাইহাটে গাড়িতে উঠি। আমরা ছিলাম ৩২ জন সহযোদ্ধা। আমরা দীঘিনালা পৌঁছে জানতে পারলাম খাগড়ায় মুখোশদের নিয়ে বিভিন্ন ঝামেলার কথা।

এদিকে আমাদের প্রতিরোধ করার মত ব্যবস্থা তেমন ছিলনা। দীঘিনালা স্টেশন থেকে প্রয়োজনীয় ইট পাটকেল নিয়ে দীঘিনালা সহযোদ্ধাদেরসহ একসাথে রওনা হলাম। সেখান থেকে ৫ গাড়ি এবং আমরা এক গাড়ি মোট ৬টি গাড়ি শ্লোগান দিয়ে এগিয়ে চলল। মনে হয় যেন কোন এক যুদ্ধক্ষেত্রে গমন করছি। যেতে যেতে আধপথে শুনি পুলিশের ব্যরিকেড এবং ১৪৪ ধারা জারি। কাজেই রীতিমত একটু শংকিত হয়ে পড়লাম। না! তবুও যেতে হবে আমাদের এই মানসিকতা নিয়ে আবারো গাড়ি এগোল। খাগড়াছড়ি পৌর এলাকায় পৌঁছতে না পৌঁছতেই পুলিশের ব্যরিকেডের সামনে মুখোমুখি হলাম। কিছুতেই যেতে দিল না এরা। বাধ্য হয়ে ফিরতে হল আমাদের। এদিকে তখনই সমাবেশের সময় পেরিয়ে গেছে। তারপরও আমাদের সমাবেশে যোগ দিতে হবে। তাই আবারো পায়ে হাঁটা আরম্ভ করলাম এক ঘন্টার পথ। আমাদের সহযোদ্ধারা প্রায়ই অনাহারে দুর্বল হয়ে পড়েছে। অবশেষে পেরাছড়া গ্রামে পৌঁছলাম। সেখান থেকে আবার গাড়িতে করে সমাবেশে যোগ দিলাম। আমরা পৌঁছা মাত্রই সমাবেশ শেষ হয়। শুধুমাত্র বাকি ছিল র‍্যালী। অবশেষে র‍্যালী শেষ হয়ে আমাদের সাথীরা আবারো হাঁটা আরম্ভ করল। আমরা পেরাছড়া থেকে গেলাম ৪ জন। জ্যোৎস্না, সুমিতা, জেমি আর আমি। তারপরদিন আমরা নিরাপদে মারিশ্যায় পৌঁছেছি গাড়ি করে। যদিও আমাদেরকে এক বুক শংকা নিয়ে রওনা দিতে হয়েছে।

এবার এখানকার প্রসঙ্গ—আজ ১৫ তারিখ এখানকার মুখোশ অনিদত্ত’কে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা ধরে এনেছে। শুনলাম এখানকার PGP-কে হস্তান্তর করবে। আজ নির্বাচনের তারিখ। আমাদের ভোট কেন্দ্র থেকে শূন্য ভোটে পরাজিত হয়েছে। অন্যান্যদের এখনো জানি না। হয়ত একিই অবস্থা হবে। আপনাদের সেখানে কেমন হলো?

এখানকার PCP-র কাউন্সিল আগামীকাল হতে যাচ্ছে। দক্ষ কর্মির অভাবে এবারের কমিটি কেমন হবে এখনো জানা যাচ্ছে না। বিশেষ করে সভাপতির পদে দক্ষ কর্মীর অভাব রয়েছে। যাক এ বিষয়ে পরবর্তীতে জানতে পারবেন।

বিশেষ আর নয়। সেখানকার বিস্তারিত খবর জানিয়ে লিখুন সময় করে। জানি সেখানে নেতাদের অবস্থা সম্বন্ধে। আড়ালে আড়ালে থাকতে হচ্ছে। আর নৈরঞ্জনা এতদিন যদি ঢাকায় না যেয়ে থাকে তাহলে তাকে একটু খবরটা দিয়ে দেবেন আমরা নিরাপদে পৌঁছেছি।

আবারো ফাল্গুনী শুভেচ্ছা জানিয়ে-

K. C.

বি: দ্র: c/o পোষ্টারের ঠিকানায় লিখলে কোন অসুবিধা হবে না। লম্বালম্বি চিঠিও লিখতে পারেন ইচ্ছা করলে। সঙ্গে প্রতিকার দার চিঠিটা একটু দিয়ে দেবেন।

N.B. চিঠির উত্তর করা দেরী হলো বলে রাগ করবেন না।

সৈকত ‘দা, এখনিই জানলাম আপনি নাকি বাড়ি আসতেছেন না তাই আবারো রাজশাহীর ঠিকানায়।

.

বাঘাইছড়ি হইতে
তাং—৪/৩/৯৬ ইং

শ্রদ্ধেয়া আপা

আমার সংগ্রামী সালাম এবং বিপ্লবী অভিনন্দন নিবেন। আশা করি ভালো রয়েছেন। আর এদিকে আমিও প্রতিনিয়ত জাতিগত নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে কোনমতে রয়েছি।

সংবাদ এই—আপা আপনার সাথে পরিচয়ের পর হতে আজ অনেকদিন হয়ে গেলো, তারি মাঝে গত ২২শে জানুঃ ঢাকায় আমাদের মহাসমাবেশে এসেছিলাম। সময় স্বল্পতার কারণে আপনার সাথে দেখা করতে পারিনি। পি.সি.পি-র প্রতিনিধি সম্মেলন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্বারকলিপি পেশ ইত্যাদি ঝামেলায় ৪/৫ দিন সেখানে অবস্থান করেছি।

আপা, আপনার সাথে পরিচয় হতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত। Hill Women’s Federation এর প্রথম সম্মেলনে আপনি শুভ উদ্বোধন করেছেন বিধায় অবহেলিত পাহাড়ি নারী সমাজ আপনাকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছে। আপনার মত শিক্ষিকা এবং হৃদয়বাণ ব্যক্তিদের উপদেশ পরামর্শ সাহায্য সহযোগীতা আশা করি। সেদিন আপনাকে বিদায়ের প্রাক্কালে আপনার উপদেশ আমাকে সবসময় অনুপ্রাণিত করে তোলে। কিন্তু খুবই দূঃখের সাথে জানাতে হয় আমাদের পার্বত্য এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ঠিকমতো পড়ালেখা করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। জাতিগত নিপীড়নের কারণে প্রতিনিয়তই পাহাড়ি নারী পুরুষ নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে। যেমনটি গত ২৮শে ফেব্রুয়ারী হঠাৎ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। অনুপ্রবেশকারী বহিরাগত বাঙালীরা কোন কারণ ছাড়াই বাঙালী পাড়ায় কোন পাহড়িকে না ঢুকার বিজ্ঞপ্তি দেয়। তা অজ্ঞাত কারণে কয়েকজন পাহাড়ি থানা সদর হাট বাজারে গেলে বহিরাগতরা তাদের উপর আক্রমণে ঝাপিয়ে পড়ে। অপরদিকে প্রায় সময় গ্রামের অত্যন্ত প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে সহজ সরল পাহাড়িদের উপর সেনাবাহিনীর ব্যাপক ধরপাকড় নির্যাতন ধর্ষণ নিত্যদিনের ঘটনা। এই হলো আমাদের এখানকার পরিস্থিতি। এই অবস্থায় সহজে অনুমেয় আমাদের শিক্ষার পরিবেশ। তারপরেও যতদূর সম্ভব চেষ্টা চালিয়ে নিচ্ছি ভালো রেজাল্ট করার। আর্শিবাদ করবেন আপা যেন সার্বিক সাফল্য লাভ করতে পারি।

পরিশেষে, আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করছি এবং লেখার আহবান থাকলো। আবারও নমস্কার জানিয়ে।

ইতি
আপনারই পরিচিত
কল্পনা চাকমা

.

বাঘাইছড়ি
তাং- ১৪/৮/৯৫

প্রিসিলা আপা

শুরুতেই সংগ্রামী শুভেচ্ছাসহ বিপ্লবী অভিনন্দন জানবেন। আশাকরি কুশলে থাকবেন। আর এদিকে আমরাও অশান্ত পার্বত্য অঞ্চলে প্রতিনিয়ত জাতিগত নিপীড়নের মধ্যেও কোনমতে রয়েছি।

আপা, সেদিন এইচ ডব্লিউ এফ ১ম কেন্দ্রীয় সম্মেলনে আপনার সাথে পরিচয় হতে পেরে খুবই খুশী হয়েছি। আপনাদের সেদিনের পরামর্শ আমাকে অনুপ্রাণিত করে। তখন থেকেই আপনাদের সমাজচেতনার সাথেও পরিচয় ঘটলো।

হ্যাঁ আপনার পাঠানো গত ফেব্রুয়ারীর ২৭ সংখ্যা ‘সমাজচেতনা’ যথাসময়ে হস্তগত হয়েছে। বিভিন্ন ঝামেলা এবং ব্যস্ততাই এতদিন প্রাপ্তি স্বীকার জানাতে পারিনি। সেজন্য আমি নিজেই অনুতপ্ত। আপনার সাথে যদি সেদিন পরিচয় না হতো তাহলে হয়ত ‘সমাজচেতনা’ আমার হাতে পরত না। কারণ এ সমস্ত ম্যাগাজিন বা পত্রিকা আমাদের মত প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাওয়া যায়না। তাই আগামী সংখ্যা থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্তত পাঠাবেন। সত্যি কথা বলতে কি আপনাদের পত্রিকায় আমাদের খাগড়াছড়ির সম্মেলন এবং ঢাকার মহাসমাবেশের কথা দেখে বেশ ভালো লাগলো। পার্বত্য অঞ্চলের নির্যাতনের কথা সরকারী পত্রিকায় স্থানই পায়না। সেজন্য আপনাদের সার্বিক সহযোগিতা একান্ত কামনা করি।

পরিশেষে এই অশান্ত এলাকার কথা আপনাকে না জানিয়ে থাকতে পারছি না। বর্তমান সরকারের হীনমুখোশ আবারও পরিলক্ষিত হচ্ছে নতুনভাবে। অতি সম্প্রতি ভারতের মিজোরাম হতে ভারতীয় মিজো (কুকী) গোপনভাবে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে পাহাড়িদেরকে ধ্বংস করার পায়তারা চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে কিছুসংখ্যক কুকী বাংলাদেশ সরকারের দেয়া অস্ত্র দিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকা সাজেকের ‘আমতলা’ নামে একটি হাটে গোলাবর্ষণ করে ১ জন পাহাড়ি মারা যায়। বর্তমানে সীমান্ত এলাকা সাজেক উত্তপ্ত অবস্থায়। আজ এই পর্যন্ত। এ সম্বন্ধে আরো জানতে চাইলে পরবর্তীতে জানাব। সংগ্রামী শুভেচ্ছান্তে

কল্পনা চাকমা
(বিপ্য)

বি:দ্র: খামের উপর কল্পনা চাকমা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ‘বিপ্য’ দিলে চলবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *