কল্পনা চাকমাকে খুঁজে বের করতেই হবে!! – ফরিদা আখতার
কল্পনা চাকমাকে কেউ সন্ধান দিতে পারলে তাকে ৫০,০০০ টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। এই ঘোষণা দিয়ে গত ১৮ জুলাই রাঙ্গামাটি জেলার বিভিন্ন স্থানে লিফলেট ছাড়া হয়েছে হেলিকপ্টার যোগে। এই লিফলেট পেয়ে কেউ দয়া করে কিংবা টাকার “লোভেও যদি কল্পনার খোঁজ দেয় আমরা সকলে তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো। আজ প্রায় দেড় মাস হতে চলেছে যে মেয়েটি নিখোঁজ হয়ে আছে সকল মহল থেকে এতো দাবী সত্ত্বেও সেই কল্পনার সামান্য খোঁজটুকুও পাওয়া যাচ্ছে না। কল্পনা কি বেঁচে আছে আমরা কেউ কিছু জানি না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সরকারের কোনো সূত্রই কল্পনার খোঁজ জানেন না বলে জানিয়েছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে উদ্যোগ নিয়েও কোন হদিস করতে পারেননি বলে জানিয়েছেন। এ অবস্থায় আমরা সকলে দারুণ অসহায় বোধ করছি। শুধু একটি খবর আমাদের জানা দরকার, কল্পনা কোথায় এবং কেমন আছে?
কল্পনা চাকমা হিল উইমেন্স ফেডারেশনের একজন সক্রিয় এবং প্রতিবাদী কর্মী, এ কথা সবাই জানেন। পড়াশোনার পাশাপাশি সাংগঠনিক কাজ দক্ষতার সঙ্গে করে যাচ্ছিল। কার স্বার্থে সে এতো বেশি আঘাত হেনেছে যে তাকে এভাবে উধাও হতে হবে? কল্পনাকে অপহরণ করার সময় কোনো রাখ-ঢাক করা হয়নি। অপহরণকারীরা তাকে নেয়ার সময় অস্ত্রধারী হিসেবে এসেছিলো সেসব ঘটনা এলাকার মানুষ জেনেছে। ঢাকা থেকে যতগুলো অনুসন্ধানী দল সেখানে গেছে সকলের তথ্য থেকেই এ কথা জানা যায়। ভাগ্য ভালো প্রথম এই তথ্যটি সকলের জানা হয়ে গিয়েছিলো না হলে আজ হয়তো কল্পনার সঙ্গে সঙ্গে তাকে কিভাবে অপহরণ করা হয়েছে সে তথ্যও গায়েব হয়ে যেত। চেষ্টা হয়েছিলো অপপ্রচার করার। সাধারণভাবে মহিলাদের নিয়ে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে যে রঙটি ঘটনার গায়ে মাখানো হয় সেই রঙটিও মাখানোর চেষ্টা কিছুটা হয়েছিল, কিন্তু জনগণের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি। তাই এখন আর সেই কথা বলা হচ্ছে না। কারণ সকলের একটি প্রশ্ন, যে কারণেই তাকে অপহরণ করা হোক না কেন, সে এতদিন উধাও হয়ে থাকবে? তার কেন হদিস পাওয়া যাবে না? আগে নিখোঁজ মানুষটির হদিস মিলুক তারপর কারণে ব্যাখ্যা করা যাবে।
এ প্রসঙ্গে বীর প্রতীক তারামন বেগমের একটি কথা মনে পড়ছে। তিনি বীর প্রতীক খেতাব পেলেও তাকে সরকার দীর্ঘ দিন খুঁজে পায়নি, এবং সে কারণে ১৯৯২ সালে যখন পদকপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ঢাকায় এসে পদক দেয়া হয় তখনো তারামনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আদৌ কি খোঁজার কোনো চেষ্টা হয়েছিলো কি না আমরা জানি না। গত বছর যখন বিমল কান্তি দে এবং সাংবাদিকদের লেখার মাধ্যমে তাঁকে শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেলো তখন তিনি ঢাকায় এলেন এবং শুনলেন এতদিন নাকি তাঁর খোঁজ কেউ পায়নি। এই কথা শুনে তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “আমি যদি কোন খুন-ডাকাতির আসামী হতাম তাহলে নিশ্চয় এতোদিন লাগতো না আমাকে খুঁজে পেতে। মুক্তিযুদ্ধ করেছি তাই খুঁজে পায়নি কেউ”। ঠিক তেমনি কল্পনা যদি নিজে একজন দুষ্কৃতিকারী হতো তা হলে তার হদিস আমরা এতদিন ঠিকই পেতাম, কিন্তু এখন সে কারো হাতে বন্দি হয়ে আছে বলে আমরা তার খবর পাচ্ছি না। আবার সে একজন সাধারণ অসহায় মেয়েও নয়। কল্পনা সচেতন এবং ন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী একজন নারী। কল্পনার উধাও হয়ে যাওয়া সহজ কোন ঘটনা নয়। স্রেফ মেয়ে বলেও তাকে তুলে নেয়া হয় নি। তার অপরাধ ছিলো সে ন্যায়ের পক্ষে সক্রিয় একজন কর্মী। আজ কল্পনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে যতোই বলা হোক না কেন এটা মেনে নেয়া যায় না। সেনাবাহিনী সে এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে
আছে এবং এতো ব্যাপকভাবে তাদের কাজ চলছে অথচ তারা এ ব্যাপারে এখন যখন মুখ খুলছেন তখন তাঁদের দায় দায়িত্ব আরো বেড়ে গেল যা বলেছেন তা সঠিক প্রমাণ করা দরকার। নইলে জনগণ বিভ্রান্ত হবে।
আমরা যদি খুব সাদামাটা ব্যাখ্যায় কল্পনা চাকমার অপহরণের ঘটনা মেনে নিই, তা হলে মনে রাখতে হবে আমরা নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করছি। আজ আমরা যার যার ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছি, শান্তিতে আছি। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন তো, কল্পনা যেখানেই আছে সেখানে তার প্রতিটি মুহূর্ত কিভাবে কাটছে? এতো দীর্ঘ সময় আমাদের জন্য পার হলেও কি তার জন্য কিভাবে পার হয়েছে? আমাদের জন্য দ্রুত দিন কাঁটে কিন্তু কল্পনা যদি এখনো বেঁচে থাকে তা হলে তার প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট এবং ঘণ্টা পার হয়ে তবে তার একটি পুরো দিন শেষ হচ্ছে। এই পুরোটা দিন তার আসলেই কিভাবে যাচ্ছে, আমরা কি জানি?
আরো ভাবুন তার মা বাঁধুনি চাকমার কথা। তার চোখের সামনে থেকে তুলে নেয়া মেয়েটির কথা ভেবে তিনি কিভাবে দিন কাটাচ্ছেন? আমরা এখানে থেকে যতই সহানুভূতি দেখাই না কেন, কল্পনাকে উদ্ধার করা ছাড়া তার প্রতি আমাদের কোন কর্তব্য পালনই যথেষ্ট নয়।
আরো কষ্ট পাই যখন দেখি সংসদে বসে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নিজেদের কিভাবে হাস্যকরভাবে তুলে ধরেছেন এবং একে অপরের প্রতি কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করে যাচ্ছে। মাননীয় স্পীকার বলেছেন, সংসদ অধিবেশন চালাতে প্রতি মিনিটে ১৫,০০০ টাকা খরচ হয়, অথচ এই সংসদে ক্ষমতাসীন দল এবং ক্ষমতাবহির্ভূত দল একে অপরের দোষ ধরতেই ব্যস্ত। আর জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় তা টেলিভিশনে প্রচার করে দেখানো হচ্ছে। টিভির সামনে বসে যার যার সমর্থক দল অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করছে। দেখে মনে হয় যে, আবাহনী-মোহামেডানের খেলা হচ্ছে, কে কাকে ঘায়েল করল এরই প্রতিযোগিতা চলছে। আমাদের মাননীয় সাংসদরা ভুলে গেছেন যে এই সংসদ ভবনে তাদের পাঠানো হয়েছে জনগণের কথা বলার জন্য, এক দল অন্য দলকে নিয়ে হাসাহাসি কিংবা মারামারি করার জন্য নয়। এটা তাঁরা করতে পারেন সংসদের বাইরে। আমি খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করছি, কোন দলের সাংসদরা কল্পনা চাকমার প্রসঙ্গ আনছেন না।
সংসদে যে কোন ঘটনা উপস্থাপনের ক্ষেত্রে দেখা হচ্ছে ঘটনাটি “কার আমলে” ঘটেছে? বিএনপি’র আমলে ঘটে যাওয়া প্রতিটি বিষয় আওয়ামী লীগ তুলছে আর একেবারে পুরনো হাঁড়ি ধরে ২১ বছর আগের ইতিহাস ফাঁদছে বিএনপি। কল্পনা চাকমার অপহরণ বর্তমানে সংসদে যে রাজনৈতিক দলগুলো আছে তাদের কারো “আমলে” ঘটেনি। কল্পনাকে অপহরণ করেছে ১১ জুন রাত ১-৩০ মিনিট আসলে হয় ১২ জুন, অর্থাৎ নির্বাচনের দিন। তখন ছিলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের “আমল”। আর যখন কল্পনার খবর ঢাকায় এসে পৌঁছালো এবং এ নিয়ে পত্রিকায় বিবৃতি আসতে শুরু করলো, নারী সংগঠনগুলো খোঁজ নেয়ার জন্য তৎপর হয়ে গেলো তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাঁপা ফুলের গাছ লাগিয়ে বিদায় নেয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। দেশের এতো বড় একটি নির্বাচন সফলভাবে অনুষ্ঠিত করতে পেরে তাঁরা সকলেই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন, এমন একটি আনন্দের সময় কল্পনার অপহরণের ঘটনা তাঁদেরকে খুব বিব্রত করতে পারেনি। ফলে তারা দ্রুত কোন ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কোন প্রকার দায়িত্ব বোধ করেননি। নতুন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তাঁরা চলে গেলেন স্ব স্ব স্থানে।
স্বাভাবিকভাবেই নতুন সরকার এসেই কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। কিন্তু এখন সমস্যা হচ্ছে কল্পনা চাকমার দায় কার ওপর বর্তাবে। এই প্রশ্ন নিয়ে আমরা ব্যস্ত হবো না কি কল্পনাকে খুঁজে বের করার জন্য মানবিক কারণে দলমত নির্বিশেষে একত্রে কাজ করবো? দুঃখজনক হচ্ছে কোন দলই বলতে গেলে আগ্রহী নয় কল্পনার ব্যাপারে। এখানে দোষারোপ করার জন্য কোন বিশেষ দল নেই, একমাত্র যারা তাকে অপহরণ করেছে সেই অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা ছাড়া? তারা কারা? এ প্রসঙ্গেও সরকারকে নিশ্চুপ দেখা যাচ্ছে।
যতদিন যাচ্ছে কল্পনাকে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে এবং পেলেও তার অবস্থা কেমন হচ্ছে তা নিয়ে আমরা সকলেই আশংকিত। আসুন, সকল প্রশ্নের উর্ধ্বে উঠে গিয়ে কল্পনা চাকমাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। এটা শুধুমাত্র একটি মেয়ের জীবন বাঁচার জন্যই নয়, দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্যও জরুরি। বিদেশে ইতিমধ্যে কল্পনা চাকমাকে উদ্ধারের জন্য প্রচার শুরু হয়েছে। সরকার সক্রিয় পদক্ষেপ না নিলে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার অধিকার খর্ব করার অভিযোগ উঠতে পারে। বাংলাদেশের সংবিধানে যারা বাংলাভাষী নয়, তাদের “বাঙালি” না বললেও এদেশের আদিবাসীরা পূর্ণমাত্রায় দেশের নাগরিক। তাঁদের অধিকার খর্ব করার কোন অধিকার আমাদের নেই। আদিবাসীরা সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য যে দাবী তুলছেন তা বিশ্বে সকলের সমর্থন পেয়েছে। কাজেই সাধারণ জনগণের মনে করার কোন কারণ নেই যে, কল্পনা চাকমার ব্যাপারটা শুধুমাত্র পাহাড়িদের ব্যাপার। নারী সংগঠনগুলো সকল নারী নির্যাতনের প্রশ্নে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেভাবেই এগিয়ে আসছে এবং আসবে। নারীদের মধ্যে বৈষম্যের কোন স্থান নেই। নারীরা সকল বৈষম্যের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেছে। তাই ইয়াসমীন ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে যেমন আমরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেছি তেমনি কল্পনা চাকমার অপহরণ ও আমাদের জন্য আন্দোলনের বিষয়। নারীরা যে যেখানেই থাকুক সকলেই নিরাপত্তা চায়। কল্পনার অপহরণকারী যেই হোক না কেন তাকে খুঁজে বের করতেই হবে।
আজকের কাগজ : ২৮ জুলাই ১৯৯৬