কল্পনাকে মনে পড়ে ওর চিন্তাকে মনে পড়ে – জোবাইদা নাসরীন কনা
কল্পনা চাকমা। গত তিন বছর আগে হারিয়ে গেছে পাহাড়ের কোল থেকে। আশায় আশায় ছিলাম। কল্পনা ফিরে আসবে। আসেনি কল্পনা। কল্পনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল দুই কিংবা তিনবার। প্রথম দেখা হয়েছিল ১৯৯৫ সালে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের প্রোগ্রামে তারিখটা আজ আর মনে নেই। শেষ দেখা হয়েছিল নিখোঁজ হওয়ার দিন দশ-বারো আগে। একটি চাকরি ইন্টারভিউ দিতে কল্পনা এসেছিল সাভারে। কল্পনা নিখোঁজ হয়ে গেলো এই স্বাধীন বাংলাদেশ থেকেই। যতোবার কল্পনার ডায়েরি উল্টিয়েছি ততোবার মনে হয়েছে ডায়েরির লেখা নয়, কল্পনা যেন নিজেই কথা বলছে। কল্পনা কথা বলছে জাতিগত বিভেদ, ভেদাভেদের জটিল রাজনীতি প্রসঙ্গে। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের খাগড়াছড়ি জেলার নিউ লাল্যাঘোনা অঞ্চলের এক পাহাড়ি মেয়ে পাহাড়ের জীবনে বসে যেসব কথা লিখেছিল তার ডায়েরিতে, সাধারণভাবে একটু ভাবলেই বোঝা যায় কল্পনা সেই বোধ ছিল অসাধারণ।
কল্পনা শুধু নিপীড়ন-নির্যাতনের কথাই বলেনি। সে দেখেছিল ব্যক্তিগত জীবনে পুরুষতন্ত্রের স্বরূপ। তার ডায়েরিতে পুরুষতন্ত্রের স্বরূপ বর্ণনা করেছিল সে এভাবে-
১. সন্তানের ক্ষেত্রে মেয়ের চেয়ে ছেলে বেশি আকাঙ্ক্ষা করা। অনেক মেয়েই নিজের জীবনে অনুভব করেছে যে, মেয়ে হয়ে জন্ম হওয়ার কারণে বাবা মা, আত্মীয়-স্বজন তাকে আনন্দচিত্তে গ্রহণ করেনি। অনেকের মুখ কালো হয়েছে।
২. পরিবারের সম্পত্তির ওপর মেয়েদের ভাগ না থাকা বা অসম ভাগ থাকা, সম্পত্তির অধিকার ও বন্টনে অসাম্য পুরুষতন্ত্রের খুবই গোড়ার ব্যাপার।
৩. সংসারের দায়দায়িত্বের ক্ষেত্রে পুরুষের কাজ হচ্ছে আয় উপার্জন করা আর মেয়ের কাজ সন্তান লালন পালন করা। এরই নাম সংসার, পুরুষই পরিবার প্রধান, নারী নয়। নারী কোনো কারণে পুরুষের চেয়ে বেশি আয় উপার্জন করলেও পুরুষের বর্তমানে নারী কোনোদিন পরিবার প্রধান হিসেবে স্বীকৃতি পায় না। বাড়িতে কোনো পুরুষ না থাকলে তাকে পরিপূর্ণ পরিবার হিসেবে সমাজে স্বীকৃতি দেয়া হয় না।
৪. বাড়িতে মেয়েদের ঘরকন্নার কাজ করা, ঘরের কাজে ছেলেদের কোনো ভূমিকা না থাকা। ঘরে রান্নার কাজ মানেই মেয়েদের আর কোনো মেরামত, মেশিনপত্র নিয়ে কাজ বা ‘ভারী’ কাজ ছেলেদের কাজ বলে গণ্য করা। কিছু ‘রান্না’ করা মানেই নারীর কাজ আর ভারী কাজ মানেই পুরুষের ব্যাপারটি এতো সরল নয়। পুরুষতান্ত্রিক কাজের বিভাজনটা এর চেয়েও জটিল যেমন রেস্তোরা বা হোটেলে বাবুচিগিরি মেয়েরা করে না, করে পুরুষ। পুকুর থেকে কলসি করে পানি আনা যতোই ভারী কাজ হোক তাকে কিন্তু আবার ভারী কাজ বলে গণ্য করা হয় না। তাহলে দেখা যাচ্ছে কোথায় কেমন করে কিভাবে কাজ হচ্ছে তার মধ্যেই লিঙ্গভেদ করার একটা অলিখিত প্ৰথা আছে। নারী পুরুষ ভাগ আছে। আবার কোন কাজ ভারী আর কোন কাজ হালকা তারও লিঙ্গ স্থির করার একটা অলিখিত নিয়ম আছে।
প্রথম আলো : ১৬ জুন, ১৯৯৯