কর্ণসুবর্ণর কড়ি

কর্ণসুবর্ণর কড়ি

এই প্রাচীন প্রত্নস্থল থেকে ছাত্রছাত্রী আর মজুরদের দল চলে যাবার পরই জায়গাটা কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। একাই এ জায়গাতে রয়ে গেছেন মানববাবু। আজ দশমী। কালই অবশ্য পুজোর ছুটি কাটিয়ে এখানে ফিরে আসবে সবাই।

জায়গাটাতে একলা দাঁড়িয়ে ছিলেন মানববাবু। চারদিকে যতদূর চোখ যায় অনাবাদি পতিত জমি। আর তারই মাঝে কচ্ছপের পিঠের মতো এই জায়গাটা। যার ভিতর থেকে বহু শতাব্দী ধরে মাটির নীচ থেকে উঁকি মারছে এক প্রাচীন কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ। ইটের তৈরি দেওয়াল, ছাদহীন কক্ষ, ইট বিছানো উঠানের মতো অংশ। মানববাবুর নেতৃত্বেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাততত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে খনন কার্যের ফলে গত একমাসে ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করেছে অতি প্রাচীন এই স্থাপত্য কীর্তি। বছর দশেক আগে একটু কাকতালীয় ভাবেই এ জায়গাতে মাটির নীচে যে এমন ধরনের কিছু আছে তার সন্ধান মিলেছিল। আশেপাশের পতিত জমিকে চাষযোগ্য করে তোলার জন্য সেচ দপ্তর এখানে কূপ খননের কাজ শুরু করেছিল। কিন্তু মাটি খুঁড়তেই নীচ থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে ছোট ছোট প্রাচীন ইটের টুকরো। সঙ্গে সঙ্গে সেচ দপ্তর কাজ থামিয়ে খবর দেয় পুরাতত্ত্ব বিভাগকে। কারণ, এ অঞ্চল সুদূর অতীতে ছিল বাংলার রাজধানী। যার নাম ছিল কানাসোনা বা কর্ণসুবর্ণ।

বাংলার প্রথম স্বাধীন শাসক শশাঙ্কদেব এখানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এক সমৃদ্ধ নগরীর। দেড় হাজার বছরের প্রাচীন সেই নগরীর কিছু কিছু নিদর্শন মাটির নীচ থেকে উঠে এসেছে এ অঞ্চলের নানা জায়গাতে। তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার। কাজেই কূপ নির্মাণের সময় পোড়ামাটির ইটের টুকরো মাটির নীচ থেকে উঠে আসাতে এমনই কিছু থাকতে পারে। এই অনুমানের ভিত্তিতে সেচ দপ্তর তাদের কাজ থামিয়ে স্বাভাবিক কারণেই খবরটা পাঠিয়েছিল পুরাতত্ত্ব বিভাগকে। সে সময় কিছুটা খনন কার্য হয়েও আবার তা বন্ধ হয়ে যায়।

সরকার বর্তমানে আবার উদ্যোগী হয়ে এ কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান মানববাবুর ওপর। বিভাগের কিছু ছাত্রছাত্রী আর লোকজন নিয়ে এখানে ক্যাম্প খাটিয়ে কাজে নেমে পড়েছেন মধ্যবয়সি পুরাতত্ত্ববিদ মানব চক্রবর্তী। উৎখননের ফলে বেশ কিছু প্রাচীন জিনিসও উদ্ধার হয়েছে মাটির নীচ থেকে। পোড়ামাটির তৈরি পাত্র, প্রদীপ। আর আজ সকালেই একটা কুলুঙ্গি থেকে মানববাবু খুঁজে পেয়েছেন কড়ি ভর্তি একটা মাটির ঘট। তবে এ জায়গাটা আসলে কী ছিল এখনও তা ঠিক ভাবে বুঝে উঠতে পারেননি মানববাবু। তবে খনন কার্য এখনও অনেকটা বাকি। তা সম্পন্ন হলে হয়তো এ জায়গার পরিচয় উন্মোচিত হবে। হতে পারে এ জায়গাতে কোনো মঠ ছিল, অথবা কোনও ধনীর বাসগৃহ কিম্বা কোনও দেবদেউল। অনেক কিছু হতে পারে।

আগামী কাল দুর্গা পুজোর পঞ্চমী। তাই সবাই চলে গেল। মানববাবু রয়ে গেলেন কারণ তিনি নির্জনতা উপভোগ করতে চান। কলকাতায় তার ফ্ল্যাটের গায়েই একটা দুর্গাপুজো হয়। পুজোর ক’টাদিন সর্বক্ষণ সেখানে মাইক বাজে। দরজা-জানলা বন্ধ করে রাখলেও সেই শব্দাসুরের থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। ফ্ল্যাটে একাই থাকেন অকৃতদার মানববাবু। পরিবার নিয়ে ঠাকুর দেখতে বেরোবার ব্যাপারও নেই তার। কাজেই তিনি একাই এখানে রয়ে গেছেন। যতটা পেরেছেন একলা-একলাই কাজ করেছেন একটা দিন।

দিনের শেষ আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে প্রাচীন কাঠামোর ওপর। কত যুগ মাটির নীচে ঘুমিয়ে থাকার পর আবার সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখছে এই অতি প্রাচীন স্থাপত্যগুলো। মানববাবু মনে মনে ভাবতে লাগলেন, কোন এক সুদূর অতীতে এই সূর্যাস্তের সময় এখান থেকে হয়তো ঘণ্টাধ্বনি ছড়িয়ে পড়ত চারপাশে, দিবাবসানে সন্ধ্যার আগমন বার্তা ধ্বনিত হত শঙ্খনাদের মাধ্যমে, হয়তো বা নারীর দল অবগাহন সেরে পট্টবস্ত্রে, ফুলমালায় সজ্জিত হয়ে প্রদীপ জ্বালাবার জন্য প্রস্তুতি শুরু করত। এমনকী এটা হয়তো ছিল কোনও নৃত্যশালা। হয়তো ঠিক এই সময়েই তার সামনের ওই ছাদহীন কক্ষে বসে পায়ে ঘুঙুর বাঁধত কোনও নর্তকী, অথবা বাদ্যযন্ত্রের তার বাঁধত কোনও প্রাচীন বাদ্যকার।

জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে অতীত প্রসঙ্গে নানা কথা ভাবতে লাগলেন মানববাবু। আর এসব ভাবতে ভাবতেই এক সময় সূর্য ডুবে গেল দিকচক্রবালে। মৃদু ঠান্ডা বাতাসও বইতে শুরু করল। মানববাবু এগোলেন কিছুটা তফাতে ওই প্রাচীন কাঠামোর মধ্যে তার থাকার জায়গার দিকে। এই প্রাচীন কাঠামোর খানিক তফাতে তাঁবু খাটিয়ে মজদুর ও ছাত্রছাত্রীরাও রাত্রিযাপন করে। সে সব তাঁবু অবশ্য এখন গুটিয়ে রাখা হয়েছে। আর মানববাবু থাকেন এই ধ্বংসস্তূপের ভিতরেই ছাদহীন এক প্রাচীন কক্ষের ভিতর মাথার ওপর একটা ত্রিপল টাঙিয়ে। জায়গাটাকে একটা ঘরের মতো করে নিয়েছেন তিনি।

ঘরের ভিতর একটা লোহার ক্যাম্পখাটে মানববাবুর শোবার ব্যবস্থা। মানববাবুর কাজের জন্য একটা টেবিল আর দুটো চেয়ারও আছে ঘরে। খননকার্যের ফলে যে সব জিনিস পাওয়া গেছে, সেগুলোও ও ঘরে রাখা আছে। আর আছে তার নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস। মানববাবু সেখানে প্রবেশ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝুপ করে বাইরে অন্ধকার নামল। তেলের বাতিটা জ্বালিয়ে নিলেন তিনি। তার পর ষ্টোভ জ্বেলে প্রথমে দুপুরে রান্না করা খাবার গরম করে খাওয়া সেরে নিলেন। তার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে তিনি টেবিলে বসে কাজে লেগে পড়লেন।

কড়ি ভর্তি মাটির ঘটটা রাখা আছে টেবিলের ওপরই। কড়িগুলোকে প্রথমে টেবিলের ওপর ঢাললেন তিনি। মোট ষোলোটা মাঝারি আকৃতির কড়ি। তার আটটার রং সাদা, বাকি আটটা কালচে বাদামি রঙের। তাদের গাগুলো এখনও খুব মসৃণ। সময় যেন তার উজ্জ্বল্য এখনও কেড়ে নিতে পারেনি। মানববাবু জানেন ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দীর বাংলাতে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন ছিল। তারপর সমুদ্র বাণিজ্যে অধোগতির জন্য অষ্টম শতকে প্রায় উধাও হয়ে যায় স্বর্ণ মুদ্রা। সমতট হরিকেল অঞ্চলে স্বর্ণমুদ্রার বদলে ধনীরা দ্বাদশ শতক পর্যন্ত ব্যবহার করতেন রৌপ্য মুদ্রা। তবে দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ মানুষরা কড়ি ব্যবহার করতেন মুদ্রার বিকল্প হিসাবে। এ কড়ি কিন্তু বাংলাদেশে পাওয়া যেত না। কড়ি আসত সুদূর মালদ্বীপ থেকে।

মানববাবু প্রথমে কড়িগুলো হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন। প্রত্যেকটা কড়ির পিঠে সূক্ষ্ম একটা ছিদ্র আছে। সে যুগে কড়ি শুধু বিনিময়ের মাধ্যমই ছিল না, অলঙ্কার হিসাবেও ব্যবহৃত হত। ছিদ্রগুলো দেখে মানববাবু ভাবলেন, এ কড়িগুলো কি তবে কোনও ছিন্ন মালার অংশ ছিল? যা শোভিত থাকত কোনো নারীর কণ্ঠে, অথবা তার কটিদেশ আবৃত করে? ইতিহাসের সেই ছিন্ন সুতোয় মালা গাঁথা ছিল, একদিন তা ছিন্ন হয়ে হারিয়ে গেছে? এমনটা তো হতেই পারে।

কড়িগুলো দেখার পর তিনি ঘটটা পরীক্ষা করতে বসলেন। পোড়া মাটির তৈরি একটা ঘট, তার গা আর মুখের কানা খুব মসৃণ। যে প্রাচীন কুম্ভকারের চাকে এই ঘটটা তৈরি হয়েছিল তার হাতের কাজের প্রশংসা করতেই হয়। নরম ব্রাশ দিয়ে ঘটটার বহিঃপৃষ্ঠ ভালো করে পরিস্কার করে আতস কাচের সাহায্যে তিনি দেখার চেষ্টা করতে লাগলেন তার গায়ে কোথাও হারিয়ে যাওয়া সূক্ষ্ম অলঙ্করণ, লিপি বা চিহ্ন আছে কিনা? যার থেকে হয়তো ইঙ্গিত মিলতে পারে ইতিহাসের কোনও অজানা অধ্যায়ের, হয়তো বা মিলে যেতে পারে এ জায়গায় কোনও পরিচয়।

মানববাবু কাজ করছিলেন। হঠাৎ এক অস্পষ্ট শব্দ শুনে মুখ তুললেন তিনি। ঘরটার প্রবেশমুখের বাইরে যেন একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে! মানববাবু সেদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কে ওখানে?’

এবার ঘরে প্রবেশ করল একজন মাঝবয়সি লোক। তার পরনে ধুতির মতো একটা বস্ত্র জড়ানো, গায়ে একটা সাদা উড়নি। ঘরের ভিতর প্রবেশ করে একটু জড়োসড়ো হয়েই সে দাঁড়াল। কাছের গ্রামটা এখান থেকে পাঁচ মাইল দূরে। এখানে লোক এল কোথা থেকে? তাই মানববাবু মৃদু বিস্মিত ভাবেই প্রশ্ন করলেন, ‘কে আপনি?’ লোকটা প্রণামের ভঙ্গিতে হাত দুটো জড়ো করে মাথাটা মৃদু ঝুঁকিয়ে বলল, ‘আমি স্থানীয় মানুষ আমার নাম মার্তণ্ড। ব্রাহ্মণ। সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়েছিলাম। আলোক শিখা দেখতে পেয়ে কৌতূহলবশত এখানে এলাম।’ মানববাবু এবার খেয়াল করলেন লোকটার মস্তক মুণ্ডিত হলেও তার মাথার পিছনে একটা শিখা বা টিকি আছে। আর তাতে একটা ফুল বাঁধা আছে। ফুল বাঁধা শিখার প্রান্তদেশ লোকটার কাঁধের এক পাশে ঝুলছে। লোকটা এরপর তার পরিচয় নিশ্চিত করার জন্যই তার উড়নিটা বুকের কাছ থেকে একটু সরালো। মানববাবু দেখতে পেলেন তার বুকে একটা উপবীত বা পৈতাও আছে।

অনেক সময় স্থানীয় লোকজনের মুখ থেকেও এসব জায়গার ইতিহাস সম্বন্ধে কিছুটা আভাস মেলে। কারণ, অনেক সময় লোককথা বা উপকথার মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে স্থানীয় মানুষের কাছে রয়ে যায় ফেলে আসা ইতিহাসের কিছু সত্য। অনেক সময় এমনও হয় যে স্থানীয় মানুষের মুখে প্রচলিত গল্প কাহিনির ক্ষীণ সূত্র ধরে ইতিহাস গবেষকরা পৌঁছে যান হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাসের দোরগোড়াতে। উন্মোচিত হয় সে জায়গার ইতিহাস। বাংলার অন্যতম প্রাচীন স্থাপত্য স্থল চন্দ্রকেতুগড়ের ক্ষেত্রেও এমনই হয়েছিল। লোকটাকে দেখে আর যাই হোক চোর-ডাকাত বলে মনে হচ্ছে না মানববাবুর। ভদ্রসন্তান বলেই মনে হচ্ছে। লোকটার কাছ থেকে যদি এ জায়গার সম্বন্ধে কোনও প্রাচীন গল্পকাহিনি জানা যায়, সেজন্য মানববাবু তার উদ্দেশে বললেন, ‘দাঁড়িয়ে কেন? চেয়ারে এসে বসুন। আপনি স্থানীয় মানুষ, একটু গল্প করি আপনার সঙ্গে।’

লোকটা যেন প্রসন্ন হল তার কথায়। আবছা হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। লোকটার পায়ে কোনও চটি জুতো নেই। লোকটা নিঃশব্দে এগিয়ে এসে দাঁড়াল টেবিলের সামনে। তারপর টেবিলের অন্য পাশে মানববাবুর মুখোমুখি বসল। মানববাবু এবার কাছ থেকে লোকটাকে ভালো করে দেখলেন। তার গাত্রবর্ণ গৌরব। একটু বিষণ্ণতা জেগে থাকলেও দাড়িগোঁফহীন মুখমণ্ডলে তার টিকালো নাকটা বেশ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ব্রাহ্মণের চোখদুটোও বেশ উজ্জ্বল। চেয়ারে বসার পর লোকটা একটু ইতস্তত করে মানববাবুকে প্রশ্ন করল, ‘আপনার পরিচয়টা?’

মানববাবু বললেন, ‘আমার নাম মানব চক্রবর্তী।’

নাম বলার পর মানববাবু তার বাকি পরিচয়টা দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু নামটা শোনা মাত্রই মার্তণ্ড নামের সেই ব্রাহ্মণ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘মানব! কর্ণসুবর্ণ অধিপতি শশাঙ্কদেবের পুত্র মানবদেব? রাজচক্রবর্তী মানব?’

মানববাবু মনে মনে ভাবলেন, লোকটার বেশ রসবোধ আছে তো! এক সময় এই কর্ণসুবর্ণর প্রথম বাঙালি অধিপতি ছিলেন শশাঙ্ক। সম্রাট শশাঙ্ক। আর তাঁর মৃত্যুর পর বাংলার সিংহাসনে বসেছিলেন তার পুত্র মানবদেব। এ লোকটার তবে সে যুগের ইতিহাস সম্পর্কেও কিছুটা জানা আছে।

মার্তণ্ডর কথায় মানববাবু হেসে বললেন, ‘না, আমি সম্রাট শশাঙ্কের পুত্র মানবদেব নই। আর রাজচক্রবর্তীও নই। চক্রবর্তীটা আমার উপাধি নয় পদবি। দাঁড়ালেন কেন? বসুন।’

মার্তণ্ড বললেন, ‘আমি আপনার নাম শুনে ভাবলাম, আপনি রাজা মানব। রাজার সামনে তো বসা উচিত নয়, তাই উঠে দাঁড়ালাম।’ কথাগুলো বলে চেয়ারে বসে পড়লেন তিনি।

মানববাবু মৃদু হেসে বললেন, ‘বেশ মজা করে কথা বলতে পারেন তো আপনি! আমি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করি। এই প্রাচীন জায়গাতে যে খনন কার্য চলছে তা আমার নেতৃত্বেই চলছে।’

মার্তণ্ডর এবার চোখ পড়ল টেবিলের ওপর রাখা ঘট আর ছড়ানো কড়িগুলোর ওপর। কড়িগুলো দেখেই তার চোখ দুটো যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মৃদু বিস্মিত ভাবে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘এ কড়িগুলো আপনি কোথায় পেলেন?’

মানব জবাব দিলেন, ‘এখানে আজ সকালে একটা দেওয়ালের গা থেকে দুটো ইট খসে পড়তেই একটা ছোট কুলুঙ্গির মতো জায়গা বেরিয়ে পড়ল। তার ভিতর এই ঘটটা রাখা ছিল আর ঘটের মধ্যে কড়িগুলো। আপনি জানেন হয়তো যে এক সময় ওই প্রাচীন বঙ্গদেশে মানুষ কড়ি ব্যবহার করত পয়সা হিসাবে, আর মেয়েরা কড়ির মালাও পরত। এই কড়িগুলোর পিঠে ছিদ্র আছে। তা দেখে আমার মনে হচ্ছে এ কড়িগুলো দিয়ে মালা গাঁথা ছিল।’

কড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে ব্রাহ্মণ প্রথমে বললেন, ‘হ্যাঁ, এই কড়িগুলো এক সময় মালাদেভিপ থেকে এই কর্ণসুবর্ণে আসত…।’

গ্রাম্য ব্রাহ্মণের মুখে ‘মালাদেভিপ’ শব্দটা শুনে মানব একটু অবাকই হয়ে গেলেন। সংস্কৃত পুঁথিতে মালদ্বীপকে ‘মালাদেভিপ’ নামেই উল্লেখ করা হত প্রাচীন কালে। তার মানে এ লোকটার পড়াশোনা আছে সে যুগ সম্বন্ধে। লোকটাকে মানব যত সাধারণ মানুষ ভেবেছিলেন সে তত সাধারণ নয়। মানব তার উদ্দেশে প্রশংসাসূচকভাবে বললেন, ‘বাঃ, আপনি অনেক কিছু জানেন দেখছি! আপনি কি এসব নিয়ে লেখা পড়া করেন?’

মার্তণ্ড বললেন, ‘হ্যাঁ জানি। এই কড়িগুলোর সম্বন্ধেও জানি। এ কড়িগুলো মালায় গাঁথা ছিল না। এ কড়িগুলো হল ফুটো কড়ি বা কানা কড়ি।’

মানব বললেন, ‘তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, এগুলো হল অচল কড়ি। পয়সা হিসাবে যার কোনও দাম ছিল না।’

ব্রাহ্মণ সম্মতিসূচক মথা নেড়ে বললেন, ‘পয়সা হিসাবে অচল হলেও এই কড়িগুলো কিন্তু ভিক্ষুককে রাজন, আর রাজনকে ভিক্ষুক বানিয়ে দিতে পারত।’

মানব জানতে চাইলেন, ‘তার মানে?’

মার্তণ্ড উত্তর দিলেন, ‘এই কানা কড়ি দিয়ে জুয়া খেলা হত। কর্ণসুবর্ণর কানা কড়ি। এ কড়ি যে কত মানুষের সর্বস্ব লুটে নিয়েছে, আবার কোনো মানুষকে জালা ভরা স্বর্ণমুদ্রা পাইয়ে দিয়েছে তার হিসাব নেই।’

মানব বললেন, ‘সে যুগে জুয়া খেলার প্রচলন ছিল জানি, কিন্তু এই কানা কড়িগুলো দিয়ে যে জুয়া খেলা হত তা জানতাম না।’

মার্তণ্ড বললেন, ‘হ্যাঁ, হত। আর এ জায়গাতেই ছিল কর্ণসুবর্ণর সবচেয়ে বড় কড়ি-জুয়ার আড্ডা। শ্বেততারার প্রাসাদ। জুয়ার আড্ডা, আর তার সঙ্গে গণিকালয়।’

কথাটা শুনে মানববাবু বেশ বিস্মিতভাবে বললেন, ‘এ গল্প আপনি জানলেন কীভাবে? শ্বেততারা কে?’

মার্তণ্ড বললেন, ‘তার সঠিক পরিচয় জানা যায় না। অসীম রূপবতী এক কন্যা। কেউ বলে সে ব্রাহ্মণ কন্যা, নইলে এত গৌরবর্ণ সে হত না। আবার কেউ বলে সে নাকি আসলে ছিল বৌদ্ধ। শ্বেততারা নাম সে সময় বৌদ্ধদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। শ্বেততারার শৈশবে তার পিতা-মাতাকে নাকি রাজা শশাঙ্ক হত্যা করেছিলেন। আবার তার ক্ষীণ কটিদেশ, শঙ্খের মতো স্তন, আর মৃগনয়ন দেখে কেউ কেউ বলত সে আসলে ছিল সেই কড়ির দেশের মেয়ে, অর্থাৎ মালদেভিপের মেয়ে। তার পরিচয় যাই হোক না কেন, সে ঠিক এ জায়গাতে একটা তালপাতার কুটির বানিয়ে প্রথমে একটা জুয়ার আসর খুলে বসেছিল। যা পরবর্তীকালে রূপান্তরিত হয়েছিল ইষ্টক নির্মিত প্রাসাদে। সেদিনের ঘটনা আমি জানি।’

মানববাবু বললেন, ‘বাঃ বেশ ভালো গল্প তো! বলে যান।’

মার্তণ্ড বললেন, ‘না, না, এ গল্প নয়, সত্যি ঘটনা। আচ্ছা, আপনাকে আমি একটা জিনিস দেখাব। তাহলেই আমার কথার সত্যতা বুঝতে পারবেন আপনি। কড়িগুলোকে ঘটের মধ্যে নিয়ে একটু বাইরে চলুন।’

লোকটা হঠাৎ এসে উপস্থিত হলেও তাকে খারাপ লোক বলে মনে হচ্ছে না। স্থানীয় মানুষ এ লোকটা। হয়তো সত্যি তার কিছু দেখানোর থাকতে পারে। এ কথা ভেবে তার কথামতো কড়িগুলোকে ঘটের মধ্যে ভরে ঘটটা নিয়ে লোকটার সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এলেন মানববাবু।

বাইরে চাঁদ উঠেছে। আধফালি চাঁদ হলেও ধুলো ধোঁয়াহীন আকাশ বলে চাঁদের আলো বেশ উজ্জ্বল। আর তা ছড়িয়ে পড়েছে মাটির গভীর থেকে জেগে ওঠা চারপাশে ছড়িয়ে থাকা প্রাচীন ইটের কাঠামোগুলোর ওপর। অতীতের ওপর যেন আলো ছড়াচ্ছে চাঁদ। বলছে ‘জেগে ওঠো, জেগে ওঠো’। চারপাশে তাকিয়ে বেশ ভালো লাগল মানববাবুর। তার মনের ভাষা যেন পড়তে পারল লোকটা। তিনি বললেন, ‘পূর্ণিমা না হলেও আলোটা বেশ সুন্দর। জানেন, এক সময় সারা রাত প্রদীপের আলোতে উজ্জ্বল হয়ে থাকত এ প্রাসাদ। সারা রাত ধরে কত মানুষের আনাগোনা হত এখানে। ওই যে আপনার ডান পাশে যে সমতল জায়গাটা দেখছেন, ওখানে অতিথিদের অশ্ব বাঁধা থাকত, আর তারও কিছুটা তফাতে যে অনুচ্চ প্রাচীর দেখতে পাচ্ছেন তার গায়ে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকত জুয়াড়ি খদ্দেরদের আশায় রূপজীবীদের দল। কড়ির জুয়ায় জিতে মুদ্রার থলি নিয়ে কেউ বাইরে বেরোলেই মধুমক্ষিকার মতো ছেঁকে ধরত ওই বারবণিতার দল। ভাঁড়ের দলও এখানে আসত রঙ্গ তামাশা দেখাবার জন্য। বেতের ঝুড়ি নিয়ে পিষ্টক বিক্রেতা আর পিঠে চামড়ার থলেতে মদ্য নিয়ে প্রাসাদের বাইরে ঘুরে বেড়াত ভ্রাম্যমান মদ্য বিক্রেতা। তাছাড়া আসত জুয়াড়িদের পাওনাদারের দলও। তাদের ফাঁকি দেবার জন্য জুয়াড়িরা অনেক সময় আপনার পশ্চিম দিকে ওই যে খিড়কির দরজা—ওখান দিয়ে পালাত। ওদিক দিয়ে নদীর দিকে যাবার রাস্তা ছিল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেরে যাওয়া সেই সব জুয়াড়িরা পাওনাদারের হাত থেকে বাঁচবার জন্য নৌকা নিয়ে কর্ণসুবর্ণ ত্যাগ করত…।’

মানববাবুকে নিয়ে সেই প্রাচীন ইতিহাসের চিহ্নগুলোর মধ্যে দিয়ে এগোতে এগোতে লোকটা এমনভাবে কথাগুলো বললেন যে যেন তিনি নিজের চোখেই দেখেছেন সে সব দিন।

লোকটা এসে থামল চারপাশে ছড়ানো এই প্রাচীন স্থাপত্যের ঠিক মাঝখানে একটা ইট বিছানো জায়গাতে। দৈর্ঘ্য প্রস্থে হাত কুড়ি মতো হবে জায়গাটা। তার চারপাশে খনন কার্যের ফলে দেওয়ালের ক্ষীণ চিহ্ন জেগে আছে। সম্ভবত এ জায়গাতে কোনও একটা ঘর ছিল। মানববাবুর অনুমান সত্য করে মার্তণ্ড বললেন, ‘ঠিক এ জায়গাতেই বসে কড়ির জুয়া খেলত শ্বেততারা। প্রাসাদের নানা ঘরেই জুয়ার আড্ডা বসত, কিন্তু শ্বেততারা জুয়া খেলত এ কক্ষে বসেই। সাধারণ মানুষরা অবশ্য এ কক্ষে প্রবেশের অনুমতি পেত না। সে সামর্থও তাদের ছিল না। কারণ, শ্বেততারার সঙ্গে প্রতিবার খেলার জন্য একশো স্বর্ণমুদ্রা বাজি রাখতে হত। একমাত্র রাজপুরুষ, অভিজাত বণিক আর ধনী ব্রাহ্মণদের সঙ্গেই এ কক্ষে বসে জুয়া খেলত শ্বেততারা।’

কথাগুলো বলে মাটির ওপর উবু হয়ে বসে পড়লেন মার্তণ্ড। তারপর সেই ইট বিছানো মেঝের ওপর হাত ঘষে ঘষে ধুলো সরাতে লাগলেন। তিনি ব্যাপারটা কী করতে চাইছেন তা বোঝার জন্য মানববাবুও ঝুঁকে বসলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই ধুলোর আস্তরণের আড়াল থেকে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হল মেঝের গায়ে খোদিত একটা ছক। সেই ছকটা দেখতে অনেকটা বাঘবন্দি খেলার ছকের মতো। কিছুটা স্পষ্ট হলেও ছকটা মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে। ছকটার মধ্যে সমান্তরাল খোপ আছে, সেগুলো আবার কোনাকুনি ভাবে বিভক্ত। হাজার বছরের সেই প্রাচীন জুয়ার ছকটা দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলেন মানববাবু। লোকটা এ ছকের কথা জানল কীভাবে? আর এরপরই মানববাবুর খেয়াল হল, বছর দশেক আগে খনন কার্য শুরু হবার পর প্রথম উন্মোচিত হয়েছিল এই জায়গাটাই। তারপর মাঝের দশবছর অরক্ষিত অবস্থায় পড়েছিল এ জায়গা। কোনও সময় এসে হয়তো সন্ধান পেয়েছিল এই ছকের আর এটা দেখেই এখন সে মানববাবুকে চমক দেবার চেষ্টা করছে। জুয়ার আড্ডা সম্বন্ধে গল্প ফাঁদছে। তবে এই ছকের ব্যাপারটা যে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ইতিপূর্বে এই প্রত্নস্থলে ওই ছকটা ছাড়া মানববাবু অন্য কোনও চিহ্ন বা ছবি খুঁজে পাননি। লোকটার মাধ্যমে এটার খোঁজ পেলেন তিনি। হয়তো এর সূত্র ধরেই ভবিষ্যতে এ জায়গার আসল পরিচয় জানা যাবে। তবে আপাতত লোকটার কথাতে বিশ্বাস দেখানো ভালো। লোকটা হয়তো তাকে আরও এমন কিছুর সন্ধান দিতে পারে। এ সব ভেবে নিয়ে মানববাবু লোকটা এরপর কী বলে বা কী করে তার প্রত্যাশায় রইলেন।

মার্তণ্ড ধুলো ঝেড়ে ছকটা ভালো করে পরিষ্কার করে বললেন, ‘কড়িগুলো আমাকে দিন। খেলাটা আপনাকে বোঝাই।’

মানববাবু ঘটটা তার হাতে দোবার পর মার্তণ্ড কড়িগুলোকে বার করে প্রথমে মাটিতে রাখলেন। তারপর কড়িগুলো সাদা আর কালোতে ভাগ করে আটটা করে কড়ি ছকটার দু-পাসে সাজিয়ে মানববাবুকে বললেন, ‘নিন ভালো করে বসুন। খেলাটা প্রথমে আপনাকে একবার ভালো করে বুঝিয়ে দিই তারপর এক হাত খেলাও যেতে পারে।’

মানববাবু লোকটার কথায় আপত্তি করলেন না। খেলুড়েদের মতোই কালের গর্ভ থেকে জেগে ওঠা সেই প্রাচীন ছকের দু-পাশে বাবু হয়ে তারা দুজন বসলেন ঠিক বহু শতাব্দী আগে এই ছকের দু-পাশে বসা মানুষদেরই মতো।

মানববাবুকে প্রথমে খেলাটা বুঝিয়ে দিলেন মার্তণ্ড। খেলাটা সরল, অনেকটা বাঘবন্দি খেলার মতোই। কোনাকুনি টপকে অপরের কড়ি গিলতে হয়। শেষ পর্যন্ত যে অপর পক্ষের কড়ি খেয়ে ফেলতে পারে তার জিত হয়।

খেলাটা বুঝে নেবার পর মানববাবু বললেন, ‘আপনি তো বলছেন এ জায়গা ওই সুন্দরী নারী শ্বেততারার জুয়ার আড্ডা ছিল। এই ছকটাতে কড়ির জুয়া খেলত শ্বেততারা। এ জায়গা সম্বন্ধে আপনি আর কী জানেন?’

লোকটা বললেন, ‘অনেক কিছু জানি। আসুননা এক হাত খেলতে খেলতে সে গল্প আপনাকে করি।’

মানববাবু হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, তা খেলা যেতেই পারে। আপনার কথা শুনতে চাই আমি। বেশ লাগছে কিন্তু।’

মার্তণ্ড বললেন, ‘কী বাজি রেখে খেলবেন বলুন। বাজি ছাড়া তো খেলা যাবে না। এ ছক শ্বেততারার জুয়ার ছক বলে কথা।’

মানববাবু এবার কিন্তু লোকটার কথা শুনে থমকে গেলেন। তিনি কোনও দিন কারো সঙ্গে বাজি ধরেন না। জুয়া খেলার তো কোনো প্রশ্নই নেই। বাজি ধরে মানববাবুর কাছ থেকে টাকা পয়সা হাতিয়ে নেবার মতলব নেই তো লোকটার। এ কথা ভেবে লোকটার দিকে মৃদু সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেন মানববাবু।

লোকটা মনে হয় তার মনের ভাব পাঠ করতে পারলেন। তিনি বললেন, ‘না, না বেশি টাকা-পয়সার ব্যাপার নয়। একটা মাত্র মুদ্রা, অর্থাৎ একটা টাকা বাজি ধরে খেলব আমরা। হাজার হোক এক সময় এটা শ্বেততারার জুয়ার আড্ডা ছিল। এই কড়ি আর এই ছকে জুয়া খেলা হত একদিন। বাজি ধরে খেললে এ জায়গার স্থান মাহাত্ম্য উপভোগ করতে পারবেন।’

লোকটা অবশ্য এ কথাটা মিথ্যে বলেনি। রেসের মাঠে যারা জীবনে এক দিনের জন্য রেস দেখতে যায়, অথবা নেপালে বেড়াতে গিয়ে ক্যাসিনো দেখতে যায়, তারা সেখানে গিয়ে জুয়াড়ি না হয়েও অল্প পয়সা বাজি ধরে সে জায়গার উত্তেজনা, স্থান মাহাত্ম্য উপভোগ করার জন্য।’

মার্তণ্ডর কথা শুনে মানববাবু বললেন, ‘ঠিক আছে আপনি যখন বলছেন এখন বাজি ধরেই খেলব। তবে ওই একটা টাকাই কিন্তু, তার বেশি নয়।’—এ কথা বলে পকেট থেকে হাতড়ে তিনি একটা কাঁচা টাকা অর্থাৎ একটা কয়েন বার করে ছকের পাশে রাখলেন।

মার্তণ্ডও এরপর তার কোমরের ভাঁজ থেকে একটা কাঁচা টাকা বার করে ছকের অন্য পাশে রাখলেন।

কিন্তু মার্তণ্ডর রাখা কয়েনটার আকৃতি বাজারে প্রচলিত এক টাকার কয়েনের থেকে কেমন যেন অন্যরকম মনে হল মানববাবুর। একটু ইতস্তত করে মুদ্রাটা তিনি হাতে তুলে নিতেই বুঝতে পারলেন তার অনুমান সঠিক। লোকটার মুদ্রাটা নকল নাকি। কিন্তু চাঁদের আলোতে মুদ্রাটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেই অবাক হয়ে গেলেন তিনি। মুদ্রার একপাশে ফুল পাতার অলঙ্করণ আর অন্যপাশে খোদিত আছে ষণ্ড বা ষাঁড়ের ছবি। এই প্রাচীন মুদ্রা মানববাবু মিউজিয়ামে দেখেছেন!

ভালো করে মুদ্রাটা দেখার পর বিস্মিত মানববাবু প্রশ্ন করলেন, ‘এ মুদ্রা আপনি কোথায় পেলেন? এ যে ষণ্ড প্রতীক খোদিত সম্রাট শশাঙ্কের মুদ্রা! স্বর্ণ বা রৌপ্য মুদ্রা না হলেও টাকার হিসাবে ওর দাম নির্ধারণ করা যাবে না। অমূল্য ঐতিহাসিক জিনিস!’

মার্তণ্ড হেসে জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। এটা রাজাধিরাজ শশাঙ্কের মুদ্রা। এখান থেকেই পাওয়া।’

মানববাবু বলে উঠলেন, ‘তার মানে এই ধ্বংসস্তূপ থেকেই মুদ্রাটা পেয়েছেন আপনি? তার মানে এ জায়গা যে শশাঙ্কের আমলের বা তার পরবর্তীকালে শশাঙ্কের কাছাকাছি সময়ের সে ব্যাপারে আর কোনও সন্দেহই রইল না।’

মার্তণ্ড বললেন, ‘খেলায় যদি আপনি জিতে যান তবে এই মুদ্রাটা আপনারই হবে। নিন, এবার খেলা শুরু করা যাক। খেলতে খেলতে কথা বলি।’

মানববাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে এবার সত্যি বিস্মিত বোধ করছি আমি। খেলতে খেলতে এ জায়গা সম্বন্ধে যে সব গল্প জানেন তা বলুন। আচ্ছা, এ খেলার চাল দেবার জন্য কি নির্দিষ্ট সময় আছে?’

তিনি জবাব দিলেন, ‘তা নেই। তবে রাতের মধ্যে খেলা শেষ করতে হবে। যার দিকে সাদা কড়ি থাকে সে প্রথম চাল দেয়। আর তারপর যার হাতে কালো কড়ি থাকে সে প্রথমবার পর পর দুবার চাল দেবার সুযোগ পায়। আপনার কাছে সাদা কড়ি। আপনিই চাল দিন প্রথমে।’

মানববাবু প্রথম চাল দিলেন, ‘খেলা শুরু হয়ে গেল।’

নিয়মমতো মার্তণ্ডও ধীরে সুস্থে দুটো কড়ি এগিয়ে দিলেন।

মানববাবু এরপর কী চাল দেবেন ভাবতে ভাবতে মার্তণ্ডকে বললেন, ‘নিন, শুরু করুন আপনার কথা—’

মার্তণ্ড বলল, ‘হ্যাঁ, একটু দাঁড়ান। আপনার কাছে আগুন আছে? আমার আবার তামাকের নেশা।’

তার কথা শুনে পকেট থেকে দেশলাই বার করলেন মানব। লোকটাও তার ট্যাঁক হাতড়ে কয়েকটা লম্বা কাঠির মতো জিনিস বার করলেন। দেখতে সেগুলো বিড়ির মতো হলেও আকারে বেশ লম্বা। সেগুলোর একটা মানববাবুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মার্তণ্ড বলল, ‘আপনার একটা চলবে নাকি? তামাক কাঠি। খেয়ে দেখুন বেশ লাগবে।’

মানববাবু ধূমপান করলেও, বিড়ি খান না। তবে লোকটা সেটা দিচ্ছে দেখেই ভদ্রতাবশত তিনি সেটা হাতে নিয়ে একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঠোঁটে দিলেন। মার্তণ্ডও একটা তামাক কাঠি মুখে গুঁজল। তারপর দেশলাই দিয়ে প্রথমে নিজেরটা জ্বালিয়ে সেটা মানববাবুর মুখে ধরল। আগুনটা ধরার পর মানববাবু দুটো টান দিতেই তার মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করে উঠল। ঠোঁট থেকে তামাক কাঠিটা নামিয়ে মানববাবু বললেন, ‘বেশ কড়া তামাক তো।’

মার্তণ্ডও তামাক কাঠিতে বেশ লম্বা দুটো টান দিয়ে এক মুখ ধোঁয়া ছাড়ল। কেমন যেন নীলচে ধোঁয়া।’ ছকের দিকে তাকিয়ে মার্তণ্ড শুরু করল তার কথা—

‘হ্যাঁ, আমরা তবে সে সময়ে ফিরে যাই। বাঙালির গৌরব কর্ণসুবর্ণর গৌরব তখন অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে বলা চলে। রাজাধিরাজ শশাঙ্কের মৃত্যুর পর তদীয় পুত্র মানব কিছুদিনের জন্য সিংহাসনে বসে নিহত হলেন। আর তার মৃত্যুর সঙ্গে অন্ধকার নামল বঙ্গদেশে। মালবরাজের পর বেশ কয়েকজন রাজা এলে গেল কিন্তু কেউই ধরে রাখতে পারল না এ রাজ্যকে। উত্থান হল ছোট ছোট গোষ্ঠীপতির। তারা নিজেরাই নিজেদেরকে ‘রাজা’ ঘোষণা করে টুকরো টুকরো করে ফেলল এ দেশটাকে। যে ভূখণ্ডের ওপর যে নরপতির অধিকার সেখানেই সে অত্যাচার নামিয়ে আনল। আইনের শাসন মানে তখন শুধু ধনীর শাসন, তাদের অত্যাচারে গরিবের প্রাণের মূল্য কানাকড়ি। রোজ কত মানুষের যে প্রাণ যেত আর কত স্ত্রীলোক যে ধর্ষিতা হত তার কোনও হিসাব ছিল না। আর বিচারের তো কোনও প্রশ্নই নেই। শাসক, ধনাঢ্য, ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের ভয়ে ফাঁকা হতে লাগল কর্ণসুবর্ণর সাধারণ পল্লীগুলো। শৃগাল, কুকুর, সর্পের আস্তানায় পরিণত হতে লাগল সেসব ধীরে ধীরে।

নগরীর বাইরে আশেপাশে যেসব গ্রাম ছিল, যেখানে ধানের গোলাতে গোধূলি বেলায় শঙ্খধ্বনি শোনা যেত, সেখানে দিনমানেও শোনা যেতে লাগল শৃগালের চিৎকার। সোনার ধানের ক্ষেতগুলো ঘন জঙ্গলে ভরে গেল। এক অদ্ভুত আঁধার নেমে এল এ বাংলাতে। লোকে বলে ‘মাৎসন্যায়’।

কাহিনির ভূমিকা বলে মৃদু হেসে তামাক কাঠিতে টান দিল মার্তণ্ড।

মানববাবু একটা চাল দিয়ে তামাক কাঠিতে আবার একটা টান দিলেন। এবার আর তার মাথা ঝিমঝিম করল না। বরং যেন এক অদ্ভুত আবেশ লাগল তার।

মার্তণ্ড আবার শুরু করল, ‘হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম। অনেকেই এ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও সবাই তো আর পালিয়ে যেতে পারে না। তাই বহু মানুষ এখানেও রয়ে গিয়েছিল। যখন কোনও রাজ্যে অন্ধকার নেমে আসে তখন তার সঙ্গে সঙ্গে মাথা চাড়া দেয় মানুষের মনের অন্ধকার প্রবৃত্তিগুলো। কারণ মানুষ তখন আর মানুষ থাকে না। হয়তো বা পরিস্থিতিই তখন মানুষকে এমন করে তোলে। এই কর্ণসুবর্ণে যত অন্ধকার নামতে শুরু করল তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলল জুয়ার আড্ডা আর বেশ্যালয়ের রমরমা। মানুষ সহজেই ধনী হতে চায়, আর ধনী হলেই তো সব কিছু তার হাতের মুঠোতে। ক্ষমতা, নারী সবকিছুই। আর সে জন্যই দিনে দিনে ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগল শ্বেততারার জুয়ার আড্ডার আলো। সাধারণ ভিক্ষু থেকে শুরু করে, অভিজাত মানুষ তাদের ভাগ্য ফেরাবার জন্য অথবা আরও ধনাঢ্য হবার জন্য আসা-যাওয়া করত এই জুয়ার আড্ডাতে। এমনকী ভিনদেশী বণিকরাও ভাগীরথীর বুক বেয়ে ময়ূরপঙ্খীতে উপস্থিত হত এখানে।

আগেই আপনাকে বলেছি শ্বেততারা কোথা থেকে এখানে এসেছিল, কেন এখানে এসেছিল, তার বংশপরিচয় কী ছিল তা কেউ জানে না। তাকে এসব ব্যাপারে কেউ জিগ্যেস করলে সে শুধু সেই উৎসুক মানুষটাকে হেসে বলত, ‘আমার নাম শ্বেততারা। কড়ির জুয়া খেলি। ভিক্ষুককে রাজা বানাই, রাজাকে ভিক্ষুক। আমার এই পরিচয় যথেষ্ট নয় কি?’

জুয়ার আড্ডায় যারা আসে তাদের মনোরঞ্জন করার জন্য এই বাটিকা সংলগ্ন অঞ্চলে শ্বেততারা একটা গণিকালয় স্থাপন করলেও শ্বেততারা নিজে কিন্তু বেশ্যাবৃত্তি করত না। এই ছকে বসে কড়ির জুয়া খেললেও সে তার শরীর স্পর্শ করতে দিত না কাউকে। মাথার ওপর ঝুলন্ত প্রদীপের আলোতে ঈষৎ ঝুঁকে পড়ে ছকে চাল দেবার সময় অনেক সময়ই সামনে বসে থাকা খেলুড়ের চোখের সামনে প্রস্ফুটিত হত শ্বেততারার গভীর বক্ষবিভাজিকা। তা হয়তো, হয়তো কেন নিশ্চিত ভাবেই প্রলুব্ধ করত, কামের উদ্রেক ঘটাত খেলুড়ের মনে। কিন্তু ব্যাস এ পর্যন্তই। কিন্তু শ্বেততারাকে স্পর্শ করার অধিকার তার ছিল না। বরং ওই শ্বেতশুভ্র বক্ষবিভাজিকার দিকে তাকিয়ে কোনও সময় ভুল চাল দিয়ে হেরে বসে থাকত সেই মূর্খ জুয়াড়ি। কেউ কেউ অবশ্য বলত যে এটাও নাকি শ্বেততারার একটা চাল ছিল বিপক্ষকে তার মনোসংযোগ নষ্ট করানোর জন্য। যে কারণে এই জুয়ার ছকে বসার সময় উড়নি দিয়ে বক্ষ বিভাজিকা আড়াল করার চেষ্টা করত না সে। তবে যে যাই বলুক শ্বেততারাকে কড়ির জুয়াতে কেউ কোনওদিন হারাতে পারত না। এভাবেই সময় এগিয়ে চলছিল।

রোজ দ্বিপ্রহরে ভাগীরথীতে শিবিকা চেপে স্নানে যেত শ্বেততারা। ভাগীরথী তখন এ বাটিকার খুব কাছেই ছিল। ওই যে পশ্চিম দিকে কিছুটা এগোলেই ছিল নদী। স্নানের সময় শ্বেততারা কিন্তু পালকি বা শিবিকা থেকে নামত না। বেহারার দল জলে নেমে শ্বেততারা সমেত পালকি জলে চুবিয়ে আবার উঠিয়ে আনত। একদিন হঠাৎ একটা ঘটনা ঘটল। ভরা আষাঢ়ে নদী ফুঁসছে কদিন ধরে। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে সকাল থেকে। প্রতিদিনের মতোই চারজন বেহারা এ প্রাসাদ থকে দুপুরবেলা শ্বেততারার শিবিকা নিয়ে রওনা হল নদীর দিকে। নদীর পাড়ে যখন তারা উপস্থিত হল তখন মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। শিবিকাটাকে কয়েক বার জলে চুবিয়েই রোজকার মতো উঠে আসবে বেহারারা। তারা পাল্কিসমেত জলে নামল। ঠিক সেই সময় ঘটনা বা দুর্ঘটনাটা ঘটল।

প্রচণ্ড জলস্রোতের ধাক্কাতে অথবা জলের নীচের কাদামাটিতে হড়কে গেল কোমর সমান জলে নামা বেহারাদের পা। জলে ছিটকে পড়ল কাঠের পালকি তারপর তীব্র জলস্রোতে সেই পালকি শ্বেততারাকে নিয়ে ছুটতে শুরু করল নদীবক্ষে। কিছুটা দূরেই একটা ঘূর্ণি আছে। পালকিটা ছুটে চলল সেদিকেই। আর সে ঘূর্ণিতে পড়লে মুহূর্তের মধ্যে তলিয়ে যাবে পালকি।

নদীর তখন উন্মাদিনী রূপ। শ্বেততারা সাঁতার জানত না। যে কারণে সে পালকি সমেত স্নান করত। পালকির ভিতর থেকে আতঙ্কে চিৎকার করতে লাগল শ্বেততারা। পালকি বেহারারা তখন নিজেদের বাঁচাতেই ব্যস্ত। আর ওই পালকি ধরার জন্য সাঁতার দেওয়া মানে তো নির্ঘাত মৃত্যু। যে ওর পিছু ধাওয়া করবে তাকেও টেনে নেবে ঘূর্ণি। শ্বেততারার পালকি তখন ঘূর্ণির প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। শ্বেততারার চোখের সামনে স্পষ্ট ঘূর্ণিটা। পাক খেতে খেতে পাটকিলে রঙের জল সেখানে পাতালে নেমে যাচ্ছে।

পালকি সমেত শ্বেততারাও হয়তো পাতালে নেমে যেত। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে শ্বেততারার পালকির সামনে ঘোলা জলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল একটা মাথা আর একটা হাত। সেই হাতটা হ্যাঁচকা টানে শ্বেততারাকে পালকির ভিতর থেকে টেনে বার করে আনল। আর এর পরমুহূর্তেই শূন্য পালকিটা ঘূর্ণির মধ্যে গিয়ে পড়ল। বারকয়েক পাক খয়ে চোখের নিমেষে পালকিটা হারিয়ে গেল নদী গর্ভে পাতালের দিকে। আর সেই হাতটা প্রবল জলস্রোতের মধ্যে দিয়েও শ্বেততারাকে নিয়ে চলল পাড়ের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিশ্চিত মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে পাড়ে উঠে এল শ্বেততারা। পাড়ে সে উঠল ঠিকই তবে তখন তার সংজ্ঞাহীন অবস্থা।

নিশ্চিত মৃত্যুকে চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করে আতঙ্কে উত্তেজনাতে হাতটা ধরে তাকে টানার মুহূর্তেই সে অজ্ঞান হয়ে গেছিল। যে লোকটা তাকে উদ্ধার করেছিল সে শ্বেততারাকে পাড়ে উঠিয়েই বুঝতে পারল শ্বেততারা জ্ঞান হারিয়েছে। ভালো করে সে তাকাল শ্বেততারার দিকে। জলে ভেজা শ্বেততারার শরীর। উদ্ধারকর্তার চোখের সামনে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে সিক্ত-সংজ্ঞাহীন শ্বেততারার যৌবন। সিক্ত কাঁচুলির ভিতর থেকে প্রকাশিত তার বৃন্ত যুগল, বসন সরে গেছে শ্বেততারার কোমর থেকে। আকাশ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টির জল যেন শুষে নিচ্ছে শ্বেততারার গভীর নাভিকূপ, কদলীবৃক্ষের মতো শ্বেততারার উরুদুটো স্পষ্ট ফুটে উঠেছে চোখের সামনে। শ্বেততারার সিক্ত যৌবনের দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন হতবাক হয়ে গেল লোকটা। এত সৌন্দর্য ওই শরীরে! কিন্তু এরপরই লোকটা নিজেকে সংযত করে ফেলল। শ্বেততারার উদরের দিতে তাকিয়ে সেটা কিছুটা স্ফিত মনে হল লোকটার।

নদীতে পড়ে কিছুটা জল খেয়েছে শ্বেততারা। একটু ইতস্তত করে লোকটা শ্বেততারার জ্ঞান ফেরাবার জন্য তার বুকে পিঠে চাপ দিতে শুরু করল। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই একরাশ জল বমন করে শ্বেততারা উঠে বসল। তার সামনে বসে আছে অপরিচিত একজন লোক। শ্বেততারার কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল নিজের ভাবনা-চিন্তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে। তারপর সে দ্রুত তার সিক্ত স্খলিত বসন যথাসম্ভব ঠিক করে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াল সেই লোকটাও। তার কোমর সিক্ত শুভ্র বস্ত্রখণ্ড দিয়ে আচ্ছাদিত। গলায় উপবীত আছে তা দেখে শ্বেততারা অনুমান করল লোকটা ব্রাহ্মণ। শ্বেততারা তাকে প্রশ্ন করল, ‘তুমি কে?’

লোকটা জবাব দিল, ‘আমি কাশ্যপ। ব্রাহ্মণ। অনেক দূর থেকে ভাগ্য অন্বেষণে বেরিয়ে আমি এখানে এসে উপস্থিত হয়েছি। নদীতে অবগাহন করতে নেমেছিলাম। দেখলাম পালকিটা ঘূর্ণির দিকে ছুটে যাচ্ছে। আর তাই…’

শ্বেততারা জানতে চাইল, ‘দূর দেশ মানে কোন দেশ?’

‘কামরূপের সীমানাতে রূপনগর নামে ছোট্ট এক জনপদ থেকে। নরেন্দ্রদেব শশাঙ্কের রাজত্বে ওই গ্রামই ছিল বঙ্গদেশের শেষ সীমানা।’ জবাব দিল কাশ্যপ।

‘তুমি যে ওই ঘূর্ণিস্রোতে ঝাঁপ দিলে তাতে তোমার ভয় করল না?’ প্রশ্ন করল শ্বেততারা।

কাশ্যপ হেসে বলল, ‘পথে নেমে বুঝতে পেরেছি আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে মৃত্যু সব সময় অনুসরণ করে চলেছে। অরণ্য পথে ব্যাঘ্র বা সর্প রূপে, গলি পথে তস্কর, দস্যু রূপে আর রাজপথে রাজা বা ভূস্বামীর সেনা রূপে। যে কোন সময় নানা রূপে মৃত্যু এসে হানা দিতে পারে। পদব্রজে আসার সময় আমি বেশ কয়েকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি। তাই আর কোনও কিছু না ভেবেই এগিয়ে গিয়েছিলাম ঘূর্ণির দিকে।’

শ্বেততারা কাশ্যপের কথা শুনে বলল, ‘এবার তোমার গন্তব্য কোথায়?’

কাশ্যপ বলল, ‘এই অপরিচিত জায়গাতে আমার বর্তমানে একটা আশ্রয় দরকার। যেখানে বিনা পয়সাতে থাকা যাবে ও ক্ষুন্নিবৃত্তি করা যাবে। বর্তমানে আমি কপর্দকহীন। সামান্য সে ক’টা কড়ি আমার কাছে ছিল, এমনকী আমার প্রাচীন বস্ত্র সমেত পুটুলিটা পর্যন্ত গত রাতে কেড়ে নিল একদল লোক! এখানে যে এত অরাজক পরিস্থিতি তা আমার জানা ছিল না!’

কাশ্যপের কথা শুনে শ্বেততারা বুঝতে পারল যে তার উদ্ধারকর্তা এই অচেনা পরিবেশে যথেষ্ট বিপদের মধ্যে আছে। কাশ্যপ তার প্রাণরক্ষাকারী। তাই একটু ভেবে নিয়ে শ্বেততারা ব্রাহ্মণ কাশ্যপকে বলল, ‘আমার নাম শ্বেততারা। আমার এখানে একটা প্রাসাদোপম বাটিকা আছে। সেখানে একটা জুয়াখানা চালাই আমি। তোমার ইচ্ছা হলে তুমি আমার বাটিতে গিয়ে থাকতে পারো। আহারের ব্যবস্থাও আমিই করব। যাবে?’

এই সুন্দরী রমণী জুয়ার আড্ডা চালায় শুনে বেশ অবাক হয়ে গেল কাশ্যপ। তবে কাশ্যপের তখন নিঃস্ব অবস্থা। আশ্রয় পাবার ক্ষেত্রে স্থান-কাল বিচার করলে চলবে না। রাস্তায় থাকলে হয়তো পরনের বসনটাও কেউ খুলে নিয়ে যাবে! মুহূর্ত খানেক ভেবে নিয়ে কাশ্যপ বলল, ‘হ্যাঁ, আমি যাব।’

ভার্গব শ্বেততারাকে নদী থেকে তুলে যে জায়গাতে উঠিয়েছিল সে জায়গা স্নান ঘাট থেকে বেশ কিছুটা তফাতে। জায়গাটা হোগলা পাতার জঙ্গলে পরিপূর্ণ। সেই জঙ্গল ভেঙে শ্বেততারা কাশ্যপকে নিয়ে এগিয়ে চলল তার প্রাসাদের উদ্দেশে। কিন্তু ব্রাহ্মণ কাশ্যপকে নিয়ে এই প্রাসাদে ফিরে এসেই এক অদ্ভুত দৃশ্যের সম্মুখীন হল শ্বেততারা। পালকি বেহারার দল ফিরে এসে খবর দিয়েছে যে পালকি সমেত শ্বেততারা ঘূর্ণিতে ডুবে গেছে। আর খবরটা শোনা মাত্রই তার কিছু কর্মচারীরা লুঠপাট শুরু করেছে প্রাসাদে। কেউ আসবাবপত্র টেনে বার করার চেষ্টা করছে, কেউ বা আবার অনুসন্ধান করছে কোথায় রাখা আছে শ্বেততারার হিরা-জহরত-সোনার মোহর। শ্বেততারাকে বাটিকাতে প্রবেশ করতে দেখে তারা সবাই ভূত দেখার মতো চমকে উঠে এদিক-ওদিক পালাবার চেষ্টা করতে লাগল, আবার কেউ তার পা জড়িয়ে তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করতে লাগল। লাথি মেরে তাদের হটিয়ে দিয়ে শ্বেততারা এগোল তার শয়নকক্ষের দিকে। সেখানে সিন্দুকের ভিতর বেশ কিছু অলঙ্কার ছিল তার। আসল সম্পদ অবশ্য সে লুকিয়ে রাখে অন্য এক গোপন স্থানে। তার হদিস লুণ্ঠনকারীরা পাবে না।

শয়ন কক্ষে প্রবেশ করে শ্বেততারা দেখতে পেল তার সেই লৌহ সিন্দুকটাকে খোলার চেষ্টা করছে একজন। সে লোকটাকে শ্বেততারা সব থেকে বেশি বিশ্বাস করে জুয়োর আড্ডাতে কড়ি রক্ষক আর মুদ্রা সংগ্রাহকের কাজ দিয়েছিল। লোকটার নাম কুক্কুট। আর সেই কিনা শ্বেততারার মৃত্যুর খবর পেয়ে তার সিন্দুক ভাঙছে! এ দৃশ্য আর সহ্য করতে পারল না শ্বেততারা। একটা পিতলের ভারী প্রদীপদণ্ড রাখা ছিল কক্ষের ভিতর। সেটা সে ছুড়ে মারল কুক্কুটকে লক্ষ্য করে। সেটা আছড়ে পড়ল কুক্কুটের মাথায়। রক্তাক্ত অবস্থায় কুক্কুট কোনওরকমে সেই কক্ষ ত্যাগ করে পালালো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রাসাদের সব কর্মচারীদের এক জায়গাতে সমবেত করল সে। কুক্কুটসমেত সেই পালকিবেহারারা ও আরও কিছু লোককে সেই মুহূর্তেই এ বাটিকা ও তার জুয়ার আড্ডার পরিধি থেকে বহিষ্কার করল শ্বেততারা। তারপর শ্বেততারা একজন লোককে নির্দেশ দিল ব্রাহ্মণ কাশ্যপের থাকার ব্যবস্থা করতে। এ প্রাসাদেরই এক কক্ষে স্থান হল ব্রাহ্মণ কাশ্যপের। প্রাসাদের এই আকস্মিক অব্যবস্থার জন্য সেদিন রাতে প্রাসাদে জুয়ার আড্ডা বন্ধ রইল।

তবে এ ঘটনা থেকে শ্বেততারা একটা জিনিস উপলব্ধি করতে পারল যে তার একজন বিশ্বাসী লোকের প্রয়োজন। যদি কোনও সময় শ্বেততারার কোথাও যাবার প্রয়োজন হয় তবে সে যার হাতে প্রাসাদ আর জুয়ার আড্ডার দায়িত্ব দিয়ে যেতে পারবে, এমন একজন লোক। কিন্তু এই অন্ধকারের রাজত্বে শ্বেততারা কোথায় খুঁজে পাবে তেমন লোক? ভাবতে ভাবতে হঠাৎই তার মনে পড়ল নবাগত কাশ্যপের কথা। লোকটা তার জীবন রক্ষা করেছে। তাকে দেখে খারাপ লোক বলে মনে হয়নি শ্বেততারার। মানুষের জীবনটাই তো জুয়ার ছকের মতো। কখন তাতে কোন বাজি লাগিয়ে জিতে যায় তা কেউ বলতে পারে না। লোকটা যদি রাজি থাকে তবে তাকে দায়িত্ব দিয়ে পরখ করে দেখা যেতে পারে। এ কথা ভেবে নিয়ে শ্বেততারা পরদিন সকালে ডেকে পাঠাল কাশ্যপকে।

শ্বেততারা কাশ্যপকে প্রথমে জিগ্যেস করল, ‘ব্রাহ্মণ তুমি হিসাব জান? মুদ্রা, কড়ি এসবের হিসাব?’

কাশ্যপ জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, জানি। আঁক কষতেও জানি, লিখতেও জানি।’

শ্বেততারা বলল, ‘শোনো ব্রাহ্মণ। আমার একজন কড়ি রক্ষক ও মুদ্রা রক্ষকের প্রয়োজন। যার কাজ হল, যে জুয়াড়িরা এখানে খেলতে আসে তাদের খেলার কড়ি বণ্টন করা এবং খেলা শেষে সেই কড়ি আর প্রাপ্য অর্থ বুঝে নেওয়া। জুয়াতে যে পরিমাণ অর্থ কেউ জেতে তার এক পঞ্চমাংশ তাকে এখানে আমাকে দিয়ে যেতে হয়। অনেক সময় জুয়াড়ি নগদ অর্থ নিয়ে এখানে খেলতে না এসে অলঙ্কার নিয়ে আসে। সেই অলঙ্কার জমা রেখে তার মূল্যের পাঁচ শতাংশ কেটে তাকে মুদ্রা মূল্য প্রদান করা হয়। এটাও একটা কাজ। সর্বোপরি এই জুয়ার আড্ডার যাবতীয় হিসাব রাখতে হবে। এ কাজ তুমি করবে? মাসিক দশ রৌপ্য মুদ্রা তোমাকে বেতন দেব আমি। তোমার আহার আর আশ্রয় যে বিনামূল্যে তা বলাই বাহুল্য। তাছাড়া অনেক সময় যখন কোন জুয়াড়ি বিপুল পরিমাণ অর্থ লাভ করে তখন সে খুশি হয়ে কড়ি রক্ষককে মুদ্রা প্রদান করে, সে মুদ্রা তোমারই থাকবে।’

কাশ্যপের কোনও পিছুটান ছিল না। পরিবার, বাপ-মা কেউ ছিল না। অনেক দূর দেশে ফেলে আসা গ্রামে তার একটা ভাঙা কুঁড়ে ছিল মাত্র। কাজেই সে শ্বেততারার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। কাশ্যপ বহাল হয়ে গেল কাজে। শ্বেততারাই তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিল সব কাজ। রোজ সন্ধ্যায় সে উপস্থিত জুয়াড়িদের কড়ি বন্টন করে, তাদের থেকে শ্বেততারার প্রাপ্য গ্রহণ করে, তার পরদিন দ্বিপ্রহরে শ্বেততারা যখন স্নান সেরে ফিরে আসে তখন সে আগের দিনের হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বুঝিয়ে দেয় শ্বেততারাকে। সময় এগিয়ে চলল, বছরও এগিয়ে চলল আর তার সঙ্গে প্রত্যহ কড়ির জুয়া দেখতে দেখতে খেলাটাকেও বেশ রপ্ত করে ফেলল কাশ্যপ। কখনও কখনও সে নিজেই জুয়ার ছকে বসত এবং সে বসত অন্য জুয়ারিদের মতো শ্বেততারাকে তার ন্যায্য পাওনা দিয়েই। কোনওদিন এক পয়সা ঠকাত না শ্বেততারাকে। এই সময়ের আরও একটা ব্যাপার ঘটতে শুরু করেছিল সেই ব্রাহ্মণ কাশ্যপের মনে। সে যেন ভিতরে ভিতরে ক্রমশ অনুরক্ত হয়ে পড়ছিল শ্বেততারার প্রতি। দ্বিপ্রহরে সে যখন শ্বেততারাকে হিসাব বোঝাতে যেত ঠিক তার কিছু পূর্বেই শ্বেততারা ফিরত নদীতে অবগাহন করে। তার সিক্ত কেশের দিকে তাকালেই কাশ্যপের কেন জানি মনে পড়ে যেত সেই প্রথম দিনের কথা। নদীর পাড়ে তার সামনে পড়ে আছে সিক্ত, স্খলিত বসনা এক নারী। শ্বেততারা কি কিছু অনুমান করতে পেরেছিল কাশ্যপের ভাবনার ব্যাপারে? এ পর্যন্ত গল্প বলে থামল মার্তণ্ড। মানববাবুর দিকে তাকিয়ে তিনি জানতে চাইলেন, ‘কি আমার কথা কেমন লাগছে?’

মার্তণ্ডর দেওয়া তামাক কাঠিটা শেষ করার পর কেমন যেন একটা ঝিম ভাব লাগছে মানববাবুর। তিনি বললেন ‘বেশ লাগছে!’

মার্তণ্ড খুশি হয়ে হাসলেন মানববাবুর জবাবে। বেশ কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কড়ির চাল দিলেন তারা। দুজনেই দুজনের কয়েকটা কড়ি খেলেন। চাঁদের আলোতে সেই প্রাচীন ইতিহাসের এক টুকরো চিহ্নের ওপর বসে মার্তণ্ড আবার শুরু করলেন তার কথা।

‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম। কাশ্যপের এমন ভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল কর্ণসুবর্ণর এই জুয়ার আড্ডাতে। দিন কাটছিল শ্বেততারারও। জুয়ার ব্যবসা দিন দিন আরও ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগল তার। আগের কড়ি রক্ষক সেই কুক্কুট নামের লোকটা পয়সা সরাত, কিন্তু কাশ্যপ প্রত্যেকটা কড়ি বুঝিয়ে দেয় শ্বেততারাকে। কাজেই শ্বেততারার মুনাফা চলল বেড়ে চলল আরও।

এটা যে সময়ের ঘটনা সে সময় এ অঞ্চল শাসন করছিলেন রাজা শ্যেন নামের এক ব্যক্তি। লোকটা ‘শ্যেন পক্ষী’ অর্থাৎ বাজ পাখির মতোই হিংস্র, ধূর্ত ছিল। তার প্রশ্রয়েই যেন আরও আঁধার নেমেছিল কর্ণসুবর্ণর বুকে। বেশ্যালয় থেকে জুয়ার আড্ডার মালিকরা সবাই নিয়মিত অর্থ পঠাত তাকে। শ্বেততারাও পাঠাতো। তাই তার দিক থেকে বিপদের আশঙ্কা ছিল না শ্বেততারার। তবে একটা ব্যাপার অজ্ঞাত ছিল শ্বেততারার। সেই কুক্কুট কী ভাবে যেন গিয়ে ভিড়েছিল সেই অন্ধকারের রাজা শ্যেনের কাছে। রতনে রতন চেনে। অচিরেই সে শ্যেনের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠতে শুরু করল।

যে কোনও জুয়ার আড্ডাতেই ছোটখাটো ঝামেলা ঝঞ্ঝাট মাঝে মধ্যেই হয়। খেলাতে চুকি অর্থাৎ জুয়াচুরি নিয়ে ঝগড়া, তর্কাতর্কি, পাওনাদারের সঙ্গে হাতাহাতি, বেশ্যাদের সঙ্গে গোলোযোগ এসব হয়েই থাকে।

সেবার তখন জষ্টিমাস চলছে। একদিন সকালে এক অন্যরকম উপদ্রব এসে উপস্থিত হল শ্বেততারার দরজাতে। এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ এসে উপস্থিত হলেন। তার জিজ্ঞাস্য গত রাতে তার পুত্র এই জুয়ার আড্ডাতে এসেছিল কিনা? বৃদ্ধের মুখ থেকে তার পুত্রের বিবরণ শুনে বোঝা গেল গতরাতে সে আড্ডাতে এসেছিল। বছর পনেরোর এক বালক। এক থলে রৌপ্য মুদ্রা নিয়ে সে এসেছিল এবং একজন পাকা জুয়াড়ির সঙ্গে খেলতে বসে সে জুয়াতে হেরে পুরো মুদ্রাগুলি খুইয়ে বসেছে। ব্যাপারটা জানানো হল সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে। জুয়ার আড্ডাতে এসব ঘটনা তো প্রায়শই ঘটে থাকে। খবরটা শুনে ব্রাহ্মণ হায় হায় করে উঠে বললেন, ‘আমার সব গেল! আমি এখন কী করব? ওটুকুই যে আমার সারা জীবনের সঞ্চয় ছিল। দেখি ছেলেটা কোথায় গেল?’ এই বলে ব্রাহ্মণ তার উড়নির খুঁট দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন।

অন্যদিনের মতোই সেদিন সকাল দুপুরটাও একইভাবে কেটে গেল। যথারীতি নদীতে স্নান করতে গেল শ্বেততারা। সে ফিরে আসবার পর কাশ্যপ তাকে আগের দিনের মতোই টাকা কড়ির হিসাব বোঝাতে বোঝাতে কল্পনা করল নদীতীরে দেখা শ্বেততারার সেই সিক্তবসনা শরীর। বিকাল হল এক সময়। তারপর শুরু হল রাতের জন্য প্রস্তুতি। প্রদীপের সলতে পাকাতে শুরু করল দাসীর দল, মশালে পাট জড়িয়ে তেলের পাত্রে নিমজ্জিত করা হল। সূর্য ঢলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই দু-চার জন করে জুয়াড়িরা হাজির হতে শুরু করল শ্বেততারার এই প্রাসাদের বাইরে।

মশাল আর প্রদীপের আলো জ্বলে উঠতে লাগল প্রাসাদে। কড়ি রক্ষক কাশ্যপ স্নান সেরে প্রস্তুত হল তার কানাকড়ির থলেগুলো নিয়ে। নতুন পট্টবস্ত্র আর অলঙ্কারে সজ্জিত হল শ্বেততারাও। এদিন এক ধনাঢ্য শ্রেষ্ঠীর জুয়া খেলতে আসার কথা।

অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে কাশ্যপ তার কানাকড়ির থলে নিয়ে এগোলেন প্রাসাদের বৃহৎ কক্ষটার দিকে। সেখানে সার বেঁধে বসে সারা রাত ধরে কড়ির জুয়া খেলে জুয়াড়িরা। সে কক্ষও তখন জুয়াড়িদের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। প্রতিটা ছকের দু-পাশে পাতা হয়েছে তালপাতার যামল। একটা করে বড় তেলের প্রদীপ রাখা হয়েছে প্রতিটা ছকের পাশে। কুন্দ ফুলের মালা আর মদিরা, তাম্বুলের পাত্র নিয়ে জুয়াড়িদের আমন্ত্রণের জন্য প্রস্তুত দাসী আর ভৃত্যরা। সে কক্ষে প্রবেশ করতে যাবে কাশ্যপ, এমন সময় বাইরে থেকে একটা গোলোযোগের শব্দ কানে এলো! কী ব্যাপার? খেলা শুরুর আগেই জুয়াড়িদের মধ্যে কোন গোলোযোগ শুরু হল নাকি? ব্যাপারটা দেখার জন্য কাশ্যপ এগোল প্রবেশ তোরণে দিকে।

তোরণ খুলে দেওয়া হয়েছে তখন। তোরণের কিছুটা তফাতে জুয়াড়িরাও সমবেত হয়েছে প্রাসাদে প্রবেশ করার জন্য। কিন্তু তারা এগোতে পারছে না। তোরণের সামনের অংশ সামান্য অপরিসর। সেখানে দু-হাত দু-পাশে ছড়িয়ে একজন শিখাধারী জুয়াড়িদের উদ্দেশে বলছে, ‘তোমরা ফিরে যাও, ফিরে যাও। নইলে তোমরা একদিন ধ্বংস হবে, ধ্বংস হবে।’ লোকটাকে চিনতে পারল কাশ্যপ। এই সেই ব্রাহ্মণ, যে প্রাতঃকালে তার পুত্রের সন্ধানে এসেছিলেন। দেউড়িতে যে প্রহরী দাঁড়িয়ে ছিল তাকে কাশ্যপ ব্যাপারটা জিগ্যেস করতেই সে বলল, ‘ব্রাহ্মণের পুত্র নাকি জুয়াতে হেরে গিয়ে আত্মঘাতী হয়েছে রজ্জুর ফাঁসে। আর এ ঘটনা শোনা মাত্রই ব্রাহ্মণের স্ত্রীও নাকি আত্মহনন করেন। স্ত্রী-পুত্র বিয়োগে উন্মাদ হয়ে গেছেন ব্রাহ্মণ। জুয়ার আড্ডাতে তিনি কাউকে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না।’

ঘটনাটা যে দুর্ভাগ্যজনক তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে জুয়ার ধর্মই এই। কানাকড়ি কাউকে ধ্বংস করে তেমনই কাউকে রাজা বানায়। এইতো ক’দিন আগে একজন ভিক্ষুক খেলতে এসেছিল ভিক্ষালব্ধ কয়েকটা মাত্র কড়ি নিয়ে। কিন্তু ফিরে গেল অগাধ সম্পত্তির মালিক হয়ে। এ ব্যাপারে বিশেষ কিছু করার থাকে না শ্বেততারা বা কাশ্যপদের।

জুয়াড়িদের উদ্দেশে চিৎকার করছিল ব্রাহ্মণ। কিন্তু এরপর হঠাৎ করে নজর পড়ল তোরণে দণ্ডায়মান কাশ্যপের দিকে।

উদভ্রান্ত, পাগলের মতো চেহারা তার। কাশ্যপকে তিনি বললেন, ‘বন্ধ করো, বন্ধ করো এই জুয়ার আড্ডা। এই অন্ধকার বঙ্গদেশের আরও অন্ধকার নামিয়ে এনোনা তোমরা। বন্ধ করো শ্বেততারার জুয়ার আসর। এখনও যে ক’জন মানুষ এই অন্ধকারের রাজত্বে কোনওরকমে বেঁচে আছে তাদেরকে তোমরা বাঁচতে দাও। তোরণ বন্ধ করো বন্ধ করো।’

কাশ্যপ, ব্রাহ্মণকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘শ্বেততারার এ প্রাসাদের জন্য আমার সব কিছু ধ্বংস হল! আরো কতজন নিঃস্ব হবে, ধ্বংস হবে কে জানে? তোমার শরীরে ব্রাহ্মণের উপবীত আছে। এ পাপের অংশীদার তুমি হয়ো না।’

ঠিক এই সময় শ্বেততারাও চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শুনে নিজের কক্ষ থেকে হাজির হল সেখানে। তাকে দেখেই তিনি আরও উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করতে লাগলেন, ‘সর্বনাশিনী, হয় আমার পুত্র আর ব্রাহ্মণীকে ফিরিয়ে দে, নইলে বন্ধ কর তোর জুয়ার আড্ডা। বন্ধ কর, বন্ধ কর…।’

যাই ঘটুক না কেন, জুয়ার আড্ডা কি বন্ধ করা যায়? তবে এই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে কীভাবে শান্ত করা যায় বুঝতে না পেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল শ্বেততারা। ঠিক এমন সময় একদল পাইক নিয়ে সেখানে উপস্থিত হল সেই শ্রেষ্ঠী। যার আসার প্রতীক্ষাতে ছিল শ্বেততারা। শ্রেষ্ঠী বয়সে তরুণ। তাকে দেখে ব্রাহ্মণ বলে উঠলেন, ‘তুমি এ প্রাসাদে প্রবেশ কোরো না। এ প্রাসাদ সর্বনাশের পথে নিয়ে যায় মানুষকে। এ প্রাসাদে প্রবেশ করার আগে তুমি একবার তোমার পিতামাতার কথা ভাবো। স্ত্রী-পুত্র-কন্যার কথা ভাবো। যুবক শ্রেষ্ঠী এই প্রথম পা রাখতে চলেছে শ্বেততারার প্রাসাদে। বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের কথা শুনে সে থমকে গেল। ব্রাহ্মণের কথা শুনে সে হয়তো ভাবার চেষ্টা করতে লাগল যে সত্যি সে কাজটা ঠিক করতে চলেছে কিনা। শ্বেততারা এবার প্রমাদ গুনল। যুবক যদি ফিরে যায় তবে সে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। যুবকের উদ্দেশে সে বলল, ‘আপনি ভিতরে প্রবেশ করুন।’—কথাগুলো বলে সে চোখের ইশারা করল দ্বার রক্ষকদের। অমনি তারা বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে জাপটে ধরে এক পাশে সরিয়ে দিল। ব্রাহ্মণ চিৎকার করতে থাকলেন, ‘বন্ধ করো, বন্ধ করো এই কড়ির জুয়া।’

সেই তরুণ শ্রেষ্ঠীকে এরপর প্রায় হাত ধরেই প্রাসাদের ভিতর ঢুকিয়ে নিল শ্বেততারা। তোরণ উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় এরপর সাধারণ জুয়াড়িরাও প্রবেশ করতে লাগল প্রাসাদে। ব্রাহ্মণের চিৎকারে কি আর কড়ির জুয়ার অমোঘ আকর্ষণ থামানো যায়? এখন আর সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় ছিল না কাশ্যপের। প্রাসাদের ভিতরে ঢুকে নিজের কাজে মনোনিবেশ করল কাশ্যপ। সারা রাত ধরে প্রতি রাতের মতোই জুয়া খেলা চলল। নিজের কক্ষে বসে সেই ধনাঢ্য যুবকের সঙ্গে জুয়া খেলে বিপুল অর্থ লাভ হল শ্বেততারার। শেষ রাতে খেলা শেষে সেই যুবক আর অন্য জুয়াড়িরা প্রাসাদ ত্যাগ করল।

সূর্যের আলো তখন ফুটব ফুটব করছে। সদর দরজাতে খিল দিয়ে এসে এক দ্বাররক্ষী শ্বেততারাকে জানালো সেই ব্রাহ্মণ নাকি স্থান ত্যাগ করেননি। দেউড়ির চাতালে শুয়ে আছেন। শ্বেততারা ঘটনাটা শুনে কাশ্যপকে নির্দেশ দিলেন ব্রাহ্মণকে কিছু মুদ্রা আর আহারাদি দিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে ফেরত পাঠাবার জন্য। তার নির্দেশ পালন করার জন্য একটু বেলার দিকে দেউড়ির বাইরে বেরিয়ে এল কাশ্যপ। চাতালে শুয়ে আছেন সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ। কাশ্যপ তাকে বোঝানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সেই ব্রাহ্মণ বললেন, ‘অর্থ সাহায্য গ্রহণ করার তো কোনও প্রশ্নই নেই, জুয়ার আড্ডা যদি বন্ধ না হয় তবে তিনি কোনওরূপ খাদ্য বা পানীয় স্পর্শ করবেন না। অনাহারে এই স্থানেই প্রাণ ত্যাগ করবেন। কাশ্যপ ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে শ্বেততারাকে খবরটা জানাতে সে বলল, ‘ঠিক আছে সে যখন শুয়ে আছে থাক। কাউকে যদি প্রাসাদে ঢুকতে সে বাঁধা দান না করে তবে তাকে এখন জোর করে সরাবার দরকার নেই, পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে।’

সেই বৃদ্ধ জুয়ার আড্ডাতে এরপর যেমন কাউকে ঢুকতে বাঁধা দিলেন না তেমনই সেই দেউড়ির চাতাল ছেড়ে নড়লেন না। খাদ্য পানীয় কিছুই স্পর্শ করলেন না। তিনটে রাত কেটে গেল এ ভাবেই। যে সব জুয়াড়িরা আসা যাওয়া করল তাদের মধ্যে অনেকেই পরিহাস করে নানা কথা বলল বৃদ্ধকে। কেউ আবার তাকে ভিক্ষুক ভেবে উচ্ছিষ্ট খাবার ছুড়ে মারল তার গায়ে। সব কিছুই নীরবে হজম করলেন সেই ব্রাহ্মণ। চতুর্থ দিন সূর্যাস্তের কিছু আগে দ্বার রক্ষক এসে খবর দিল, ‘ওই বৃদ্ধ মনে হয় মরতে চলেছে।’

কথাটা শুনে কাশ্যপ গিয়ে উপস্থিত হল বৃদ্ধের কাছে। ব্রাহ্মণের তখন প্রায় শেষ সময়। কাশ্যপকে দেখে তিনি নিজের উপবীতটা ধরে বললেন, ‘আমি যদি সত্যি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ হয়ে থাকি, জীবনে যদি কোনও অসৎ আচরণ না করে থাকি, তবে আমি বলে যাচ্ছি এ জুয়ার আড্ডা, এ প্রাসাদ সব কিছু ধ্বংস হবে। আর তুমি ব্রাহ্মণ হয়ে এই পাপ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছ! তুমি এখন পতিত হয়ে গেছ। এ জায়গা থেকে এ পাপপুরী থেকে কোনও দিন মুক্তি ঘটবে না তোমার। আমি তোমাকে অভিশাপ দিলাম।’—এ কথা বলার পরই পট করে ছিঁড়ে গেল উপবীত আর ব্রাহ্মণের কণ্ঠস্বর চিরদিনের মতো থেমে গেল।

কাশ্যপ এসে খবরটা দিল শ্বেততারাকে। ব্যাপারটা শুনে শ্বেততারা বলল, ‘ব্রাহ্মণের মড়া বাসি করা চলে না। তাছাড়া কিছুক্ষণের মধ্যেই জুয়াড়িরা আসতে শুরু করবে। মৃতদেহ দর্শন করলে সংস্কারবশত ফিরে যেতে পারে। আজ রাতে জুয়াড়িদের ব্যাপারটা আমি সামলে নিচ্ছি।’ শ্বেততারার কথামতো কাশ্যপ কয়েকজন লোককে সাথে নিয়ে ব্রাহ্মণের মৃতদেহ দাহ করতে চলল।

নদীতীরে তারা যখন পৌঁছল তখন অন্ধকার নেমে গেছে। কাঠ ইত্যাদি জোগাড় করতে কিছুটা সময় লাগল। তারপর চিতাতে সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের দেহটাকে শুইয়ে তাতে অগ্নি সংযোগ করা হল। পুড়তে লাগল দেহটা। যাদের কাঠের চিতাতে মৃদদেহ দাহ করার অভিজ্ঞতা আছে তারা জানেন যে পুড়তে পুড়তে অস্থি মজ্জাতে টান ধরাতে অনেক সময় জ্বলন্ত মৃতদেহ উঠে বসে। চিতার খুব কাছে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটার তদারকি করছিল কাশ্যপ। হঠাৎই ব্রাহ্মণের জ্বলন্তদেহ উঠে বসল চিতাতে। কাশ্যপের মনে হল আগুনে মাংস খসে পড়া ব্রাহ্মণের মুখটা যেন দন্ত বিকশিত করে হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। তার একটা হাত যেন উত্থিত হল নদীর দিকে। আর এরপরই অবশ্য একজন লোক কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে আঘাত করে ব্রাহ্মণের জ্বলন্ত দেহটাকে আবার শুইয়ে দিল। দাহকাজ সম্পন্ন করে কাশ্যপ মধ্যরাতে শ্বেততারার প্রাসাদে ফিরে এল।’—এ পর্যন্ত বলে আবারও থামলেন মার্তণ্ড। একটা চাল দিয়ে তিনি মানববাবুকে বললেন, ‘ব্রাহ্মণের কাহিনিটার সঙ্গে আমার কাহিনির বিশেষ একটা সম্পর্ক আছে তাই বললাম।’

মানববাবুও নিঃশব্দে একটা চাল দিলেন। ইতিমধ্যে মানববাবু আর মার্তণ্ড দুজনেই অপরপক্ষের বেশ কয়েকটা কড়ি গিলেছেন। মানববাবুর চাল দেবার পর মার্তণ্ড আবার বলতে শুরু করলেন।

পরদিন একটু বেলার দিকে শ্বেততারার কাছে সংবাদ এল নদীর পাড়ে নাকি একটা বড় ময়ূরপঙ্খী এসেছে। কার ময়ূরপঙ্খী? এদিকে সচরাচর নাও বা বাণিজ্য তরী আসে না লুঠ হয়ে যাবার ভয়ে। উত্তর থেকে যারা নদীপথে দক্ষিণে সমুদ্র মোহনার দিকে যায় তারা গঙ্গার আর এক শাখা পথ ধরে যায়। ভাগীরথীর দু-পাশের গ্রামগুলো তো এখন অধিকাংশই জনশূন্য, জঙ্গলাকীর্ণ, তস্কর-দস্যুর আশ্রয় স্থল। তাই এ পথ মাড়ায় না কোনও বাণিজ্যও তরী। খবরটা কৌতূহলের উদ্রেক ঘটালো শ্বেততারার মনে।

বিশস্ত সহযোগী কাশ্যপকে নিয়ে সে উপস্থিত হল নদীর তীরে। হ্যাঁ, বেশ বড় একটা ময়ূরপঙ্খী দাঁড়িয়ে আছে মাঝনদীতে। ময়ূরপঙ্খী থেকে ছিপ নৌকা নিয়ে ইতিমধ্যে পাড়েও নেমেছে বেশ কিছু লোকজন। শ্বেততারা ও কাশ্যপ সেখানে উপস্থিত হতেই একজন লোক তাদের দিয়ে এগিয়ে এল। তার পরনে জরিবোনা মখমলের পোশাক, মুক্তাহার শোভিত মস্তকবন্ধনী। দিনের আলোতে ঝলমল করছে তার হাতের বহুমূল্য পাথর শোভিত স্বর্ণাঙ্গুরীয়গুলো। তাকে দেখে শ্বেততারা ও কাশ্যপও যেমন বিস্মিত হল তেমনই সেই গৌরবর্ণের যুবকও সম্ভবত বেশ বিস্মিত হল অতীব সুন্দরী ললনা শ্বেততারাকে সেই প্রায় জঙ্গলাকীর্ণ নদীতটে দেখে। কয়েক মুহূর্ত পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকার পর সেই সম্ভ্রান্ত যুবক প্রশ্ন করল, ‘এ কোন জায়গা?’

শ্বেততারা জবাব দিল, ‘কর্ণসুবর্ণর তট।’

কথাটা শুনে যুবক মৃদু চমকে উঠে বলল, ‘কর্ণসুবর্ণ! তাই গত দু’দিন দূরে নদীতটের দু-পাশে কোনও জনবসতি চোখে পড়েনি। এ পথে আমার আসার কথা ছিল না।’

যুবকের মৃদু চমকে ওঠা দেখে কাশ্যপ আর শ্বেততারা দুজনেই অনুমান করল যে আগন্তুক কর্ণসুবর্ণর বর্তমানে ‘সুখ্যাতি’র কথা শুনেছে। শ্বেততারা তাকে প্রশ্ন করল, ‘তবে এ পথে এলে কেন? তোমার পরিচয় কী?’

যুবক জবাব দিল, ‘আমার নাম রৈবতক। কাশী নগরীর বাসিন্দা। দক্ষিণ সমুদ্র থেকে বাণিজ্য করে ঘরে ফিরছিলাম। চারদিন আগে ঝড়ের কবলে পড়ে রাস্তা ভুল করে ভাগীরথীর নদীখাতে প্রবেশ করেছিলাম। গত তিনদিন আশপাশে কোনও জনমানব চোখে পড়েনি। নদী থেকে যে দু-চারটে গ্রাম চোখে পড়েছে তা সবই জনশূন্য। গত রাতে দূর থেকে এখানে একটা আলোক বিন্দু দেখতে পেলাম। ভাবলাম এখানে কোনও বন্দর আছে। অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে নৌকাকে তার উপস্থিতি জানানো হচ্ছে যেমন জানানো হয়ে থাকে। কিন্তু এসে দেখলাম তেমন কিছু নয়, উল্টে বিপদগ্রস্থ হলাম।’

কাশ্যপ বণিক রৈবতকের কথা শুনে অগ্নিকুণ্ডের রহস্য বুঝতে পারল। গতরাতে সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে দাহ করার জন্য যে চিতা জ্বালানো হয়েছিল সে আগুনই চোখে পড়েছিল ময়ূরপঙ্খীর নাবিকের।

নাবিক আবার বলল, ‘তোমাদের পরিচয়?’

শ্বেততারা জবাব দিল, ‘আমি শ্বেততারা। এখানে আমার প্রাসাদ আছে। কড়ির জুয়ার আড্ডা চালাই। আমার সঙ্গী এই ব্রাহ্মণের নাম কাশ্যপ। আপনি এখন কী করবেন? পুনরায় যাত্রা শুরু করবেন?’

রৈবতক বলল, ‘তাই তো করতাম। কিন্তু বিপদগ্রস্থ হয়ে পড়েছি আমি। নদীর এ অংশে বর্তমানে নাব্যতা যে এত কম তা অন্ধকারে ঠাহর করতে পারিনি। আমার ময়ূরপঙ্খী আটকে পড়েছে বিশাল পাথরখণ্ডের মতো। জোয়ারের জলেও নড়ছে না।’

শ্বেততারা বলল, ‘গ্রীষ্মে এবার এক বিন্দু বৃষ্টি হয়নি তাই নদীর এই হাল।’

রৈবতক বলল, ‘বর্ষা নামতে তো এখনও অন্তত এক পক্ষকাল দেরি। নদীর জল না বাড়লে আমি ফিরতে পারব না। একগণ্ডা মানুষ আমরা। যদি ক’টা দিনের জন্য এখানে কোনও আশ্রয় পাই তার জন্য উপযুক্ত মূল্য প্রদান করতে আমি রাজি আছি। পান্থশালা গোছের কিছু একটা।’

তার কথা শুনে শ্বেততারা হেসে বলল, ‘নগরী বেশি দূর নয়, তবে যে কর্ণসুবর্ণ নগরীর কথা তোমরা শুনে এসেছ তা আজ প্রায় জনমানবহীন। যে মন্দির, বৌদ্ধ মঠ, রাজকীয় পান্থ নিবাসগুলিতে পথিক-বণিকদের আশ্রয় দেওয়া হত সে সবই আজ শৃগাল-কুকুরের আবাসস্থল।’

‘তবে কী করা যায়?’ চিন্তার স্পষ্টভাব ধরা দিল যুবকের গৌরবর্ণের মুখমণ্ডলে।

শ্বেততারা প্রথম দর্শনেই যুবকের প্রেমে পড়েছিল কিনা জানা নেই। সে রৈবতকের উদ্দেশে বলল, ‘তুমি ইচ্ছা করলে ক’টা দিন আমার বাটিকাতে কাটাতে পারো। তবে একগণ্ডা লোকের স্থান সঙ্কুলান সেখানে হবে না।’

শ্বেততারার প্রস্তাব শুনে যুবক প্রথমে বলল, ‘জুয়ার আড্ডাতে! না, না, আমি জুয়া খেলি না। আমি তবে নাওতেই রাত্রিবাস করব।’

তার আশঙ্কা বুঝতে পেরে শ্বেততারা মৃদু হেসে বলল, ‘জুয়ার আড্ডা চালালেও আমি দস্যু বা তস্কর নই। তোমাকে জুয়া খেলতে আমি সেখানে আহ্বান জানাচ্ছি না। তুমি বিপদগ্রস্থ তাই প্রস্তাবটা দিলাম। তুমি তোমার নাওতে রাত্রিবাস করতে পারো ঠিকই তবে সেটা তোমার পক্ষে সুরক্ষিত নাও হতে পারে। বিশেষত যখন তুমি একজন বণিক এবং বাণিজ্য সেরে ফিরছ, তোমার কাছে অর্থ সম্পদ থাকবে তা যে কোনও লোকের পক্ষেই অনুমেয়। তোমার হাতের ওই একটি অঙ্গুরীয় অপেক্ষা অনেক কম মূল্যের, সামান্য কয়েকটা রৌপ্য মুদ্রার জন্য মানুষের প্রাণ যায় এখানে। এখানে আইনের কোনও শাসন নেই, অভিযোগ জানাবার কোনও স্থান নেই, কোথাও জনসাধারণকে রক্ষা করার জন্য প্রহরীর ব্যবস্থা নেই। যার হাতে ক্ষমতা আছে, অস্ত্র আছে সে যে-কোনও মানুষকে হত্যা করতে পারে, নারী বা অর্থ যে-কোনও কিছু লুণ্ঠন করতে পারে। এবার ভেবে দেখো তুমি কী সিদ্ধান্ত নেবে?’

শ্বেততারার কথা শুনে বণিক রৈবতক বলল, ‘ব্যাপারটা আমি কিছুটা শুনেছিলাম বটে। যে কারণে সমুদ্রযাত্রা করা বণিকরা ভাগীরথীর পথ ধরে না। তবে ব্যাপারটা সত্যি যে এমন ভয়াবহ তা জানা ছিল না।’

শ্বেততারা বলল, ‘হ্যাঁ, এখন এখানে দিনের বেলাতেও অন্ধকারের রাজত্ব বিরাজমান। লোকে বলে—মাৎসন্যায়!’

বণিক একবার মনে হয় কিছুক্ষণ চিন্তা করল তার বর্তমান দুরবস্থা নিয়ে, তারপর শ্বেততারাকে বলল, ‘তোমার বাটিকা কতদূরে?’ একবার দেখে আসা যেতে পারে?’

শ্বেততারা বলল, ‘কাছেই। ওই যে দেখো ওই গাছের মাথার ওপর দিয়ে আমার বাটিকার শীর্ষদেশের কিয়দংশ দেখা যাচ্ছে। অবশ্যই দেখে আসতে পারো।’

বণিক রৈবতক দুজন সঙ্গীকে নিয়ে শ্বেততারা আর কাশ্যপের সঙ্গে রওনা হল শ্বেততারার প্রাসাদ অভিমুখে। শ্বেততারার বাটিকাতে কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রবেশ করল সকলে। শ্বেততারা দই ও পিষ্টক দিয়ে আপ্যায়ন করল রৈবতককে। দুরাগত অতি ধনাঢ্য জুয়ারিদের রাত্রিবাসের জন্য শ্বেততারার প্রাসাদ সদৃশ বাটিকাতে একটা কক্ষ আছে। সেটি দেখানো হল বণিককে। সেই কক্ষ প্রাকার বেষ্টিত, দেউড়িতে রক্ষক শোভিত বাটিকা বাসস্থান হিসাবে নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য বলে মনে হওয়াতে শ্বেততারার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল বণিক। সে নিজেই বলল সপ্তাহ শেষে সে দশটি করে রৌপমুদ্রা দেবে বাটিকাতে থাকার জন্য।

বণিক রৈবতক এরপর প্রাসাদ ছেড়ে নদীর দিকে ফিরে চলল তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র প্রাসাদে আনার জন্য। তার সঙ্গে কাশ্যপ আর একজন লাঠিধারী রক্ষককে পাঠাল শ্বেততারা।

বণিক রৈবতক কিন্তু বেশি সামগ্রী বহন করে আনল না তার ময়ূরপঙ্খী থেকে। সে আনল একটা পোশাকের গাঁটরি আর দুটো মখমলের মেটাসোটা থলে। গাঁটরিটা সে লাঠিধারী রক্ষকের কাছে দিলেও থলে দুটোকে সে তার নিজের কাছেই রাখল। তা দেখে কাশ্যপ অনুমান করল যে বণিকের বাণিজ্য লব্ধ অর্থ সম্পদ তার বুকে আগলে রাখা ওই মখমলের থলের মধ্যেই আছে। জুয়ার আড্ডাতে ফেরার পথে রৈবতকের সঙ্গে আলাপচারিতাতে কাশ্যপ জানতে পারল যে রৈবতক সমুদ্রতে মৃগনাভি আর পট্টবস্ত্র নিয়ে চম্পা নগরীর বণিকদের সঙ্গে বাণিজ্য করতে গিয়েছিল। সমুদ্র যাত্রা তার ফলপ্রসূ হয়েছে। বণিক রৈবতক অবিবাহিত। কাশী নগরীতে তার শ্বেততারার প্রাসাদ অপেক্ষা অনেক বড় উদ্যান শোভিত বাটিকা রয়েছে গঙ্গানদীর তীরে।

বণিক রৈবতকের এ ভাবেই প্রবেশ ঘটল শ্বেততারার জুয়ার আড্ডাতে। বর্ষা নামার প্রতীক্ষাতে সেখানে বাস করতে শুরু করল রৈবতক। সকাল বেলা উঠে নদীর পাড়ে ময়ূরপঙ্খীতে থাকা তার লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যেত রৈবতক। তারপর বিকালের আগেই আবার শ্বেততারার প্রাসাদে ফিরে আসত।

শ্বেততারার আশঙ্কা যে সত্যি ছিল তা কিছুদিনের মধ্যেই প্রমাণিত হল। এক রাতে ছিপ নৌকা নিয়ে সেখানে হানা দিল একদল সশস্ত্র লোক। বাণিজ্য লব্ধ অর্থ ময়ূরপঙ্খীতে কিছু না থাকলেও নাবিকদের কাছে তাদের ব্যক্তিগত সামান্য অর্থ যা ছিল তা লুঠপাট করল তারা। তাদের অভীষ্ট সম্পদ আর ময়ূরপঙ্খীর ‘অধিকারী’ অর্থাৎ রৈবতককে না পেয়ে নাবিকদের প্রচণ্ড মারধর করত তারা। শ্বেততারার বুদ্ধিমত্তা ও আশ্রয়দানের ফলেই যে রৈবতক রক্ষা পেয়েছে তা বুঝতে পেরে শ্বেততারার ওপর আস্থা বেড়ে গেল রৈবতকের।

আর শ্বেততারা? কাশ্যপ কিছু দিনের মধ্যেই লক্ষ করল যে শ্বেততারা যেন বেশি যত্নবান হয়ে পড়েছে রৈবতকের প্রতি। মিষ্টান্ন বিক্রেতাদের কাছ থেকে নানা ধরনের মিষ্টান্ন কিনছে নাবিকের জন্য। কখনও বা নিজ হাতে পরমান্ন রন্ধন করছে নাবিকের জন্য। শ্বেততারা যখন নদীতে অবগাহন করে ফেরে তখন রৈবতকও তার পালকির সঙ্গেই ফেরে নদীতট থেকে। রৈবতককে প্রশ্রয় দেবার পিছনে শ্বেততারার কি কোনও অভিসন্ধি আছে? নাকি নাবিকের প্রেমে পড়েছে শ্বেততারা। কাশ্যপ একদিন শ্বেততারার জীবন রক্ষা করেছে ঠিক কিন্তু কোনও নারীর কাছে যে মধ্যবয়সি ব্রাহ্মণ কাশ্যপ অপেক্ষা যুবক রৈবতক বেশি আকর্ষণীয় হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্যাপারটা কাশ্যপের মনে মৃদু ঈর্ষার জন্ম দিলেও সে ভাবল, ‘আরতো মাত্র ক’টাদিন। বর্ষা নামলে নদীতে জল বাড়লে তো ময়ূরপঙ্খী ভাসিয়ে দেবে নাবিক রৈবতক। আর রৈবতকের সঙ্গে শ্বেততারার যদি ক্ষণিকের জন্য প্রেমের সম্পর্ক গড়েও ওঠে তবে শ্বেততারা নিশ্চয় তিল তিল করে গড়ে ওঠা এই জুয়ার আড্ডা ছেড়ে ময়ূরপঙ্খীতে চেপে বসবে না? আর রৈবতক নিশ্চয়ই শ্বেততারার টানে এই অন্ধকারের দেশে রয়ে যাবে না?

দিন কাটতে লাগল নিজের নিয়মে। শ্বেতাতারার জুয়ার আড্ডা যেমন চলছিল তেমন চলতে লাগল। আষাঢ় মাসের প্রথম দিনেই ঠিক বর্ষা নামল।

এ পর্যন্ত বলে থামলেন মার্তণ্ড কারণ, হঠাৎই মানববাবুদের চারপাশে কেমন যেন অন্ধকার নেমে এল! একখণ্ড মেঘ এসে ঢেকে দিয়েছে চাঁদটাকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে মার্তণ্ড হেসে বললেন, ‘দেখলেন যেই বর্ষার কথা বললাম, অমনি কেমন মেঘ এসে গেল! এ মেঘ কিন্তু জলভরা মেঘ। নইলে এমনভাবে চাঁদকে ঢাকতে পারত না।’

মানববাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, আজকাল তো প্রতিবছর দুর্গা পুজোর সময় বৃষ্টি নামে।’

মেঘটা চাঁদটার ওপর থেকে সরে যাবার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল মানববাবুদের। তারপর মেঘটা চাঁদের ওপর থেকে সরে গেল। আবার আলোকিত হয়ে উঠল ছকটা। বেশ কয়েকটা চাল খেলার পর মানববাবু বললেন, ‘নিন আবার শুরু করুন। বর্ষা নামার পর কী হল?’

সেই ধ্বংসস্তূপের কোথা থেকে যেন একপাল শেয়াল ডেকে উঠে প্রহর ঘোষণা করল। মার্তণ্ড বললেন, ‘হ্যাঁ, বলছি। এই প্রাচীন প্রাসাদের আসল কাহিনি এবার শুরু হবে—

আষাঢ়ের প্রথম দিনই সকাল থেকে এমন বৃষ্টি শুরু হল যে মধ্যরাতে গিয়ে থামল। সে রাতে জুয়ার আড্ডা তেমন জমল না। পরদিন সকালে নাবিক রৈবতক নদীর অবস্থা দেখে বেশ খুশি মনেই প্রাসাদে ফিরে এল। কাশ্যপের সঙ্গে দেখা হওয়াতে সে বলল, ‘আর সাতদিন এমন বৃষ্টি হলেই ময়ূরপঙ্খী ভাসাতে পারব।’

কথাটা শুনে কাশ্যপ তাকে বলল, ‘হ্যাঁ, বেশ ভালো খবর। ফিরে যেতেই হবে তোমাকে। এ জায়গার পরিবেশ, পরিস্থিতি তো তুমি জেনেই গেছ। যত তাড়াতাড়ি ফিরতে পারো ততই মঙ্গল। হয়তো তাতে আমাদের খারাপ লাগবে। কিন্তু কী আর করা যাবে?’ আর মনে মনে কাশ্যপ বলল, ‘যত তাড়াতাড়ি আপদ বিদায় হয় ততই ভালো। শ্বেততারা যেন তোমার প্রতি একটু বেশিই আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল।’

কাশ্যপের অনুমান মিথ্যা ছিল না। সে খেয়াল করে দেখেছিল এত দিন পর বর্ষা নামাতে শ্বেততারার মুখমণ্ডলে আনন্দের পরিবর্তে কেমন যেন একটা বিষণ্ণতার আভাস।

এই দ্বিতীয় দিন বিকাল থেকেই আবার প্রবল বেগে বর্ষণ শুরু হল। এমন বর্ষণ যে একজন জুয়াড়িও সেদিন উপস্থিত হল না জুয়ার আড্ডাতে। অন্য রাতগুলো জেগেই কাটাতে হয় কাশ্যপকে। শেষ রাতে জুয়ারিরা ফিরে গেলে কাশ্যপ তখন নিদ্রা যায়। দ্বিপ্রহরে সে ঘুম থেকে উঠে শ্বেততারাকে পূর্বদিনের হিসাব বোঝাতে যায়। এ কাজের মাধ্যমে তার দিন শুরু হয়। বর্ষা নামাতে আর রৈবতকের ফিরে যাবার সংবাদে মনটা বেশ খুশি ছিল কাশ্যপের। বহু দিন বাদে সে রাতে ঘুমাতে গেল। বাইরে থেকে ভেসে আসা বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ আর ভেকের কলতান ঘুম নামিয়ে আনল কাশ্যপের চোখে।

শেষ রাতের দিকে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল কাশ্যপ। সে প্রথমে দেখল নদী তটে তার সামনে শুয়ে আছে এক সিক্তবসনা নারী শ্বেততারা। প্রস্ফুটিত তার অঙ্গসৌষ্ঠব। সিক্তবসনের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে তার গভীর অতলান্ত নাভিকূপ। বৃষ্টির ফোঁটাকে শুষে নিচ্ছে সেই নাভি। সুডৌল স্তন যুগল ও তার জামফলের মতো স্তনবৃন্ত দুটো যেন চেয়ে আছে কাশ্যপের দিকে। কদলি কাণ্ডের মতো দেখতে মসৃণ উরু দুটো গিয়ে মিশেছে শ্বেততারার অনন্ত যৌবনের আধারে।

ঘুমের মধ্যে কাশ্যপ কিন্ত শ্বেততারার জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা করল না। সে চেয়ে রইল তার দেহের দিকে। উত্তেজিত হয়ে উঠতে শুরু করল কাশ্যপের শরীর। কামনার আগুন ছড়িয়ে পড়তে লাগল তার রক্তে। সে আগুন আর এক সময় সহ্য করতে পারল না কাশ্যপ। সে আলিঙ্গন করতে উদ্যত হল শ্বেততারাকে। কিন্তু হঠাৎই যেন চারপাশে অন্ধকার নেমে এল, আর তারপরই জ্বলে উঠল অন্য এক আগুন। কাশ্যপ দেখল তার সামনে থেকে উধাও হয়েছে শ্বেততারা, আর তার কিছুটা তফাতেই একটা চিতা জ্বলছে! আর সেই চিতার মধ্যে জ্বলন্ত শরীর নিয়ে বসে আছে সেই স্ত্রী-পুত্রহারা ব্রাহ্মণের শব। কাশ্যপের দিকে তাকিয়ে তিনি বলছেন, ‘তুই পতিত হয়েছিস। তোর কোনওদিন মুক্তি হবে না এ নরক থেকে। মুক্তি হবে না, মুক্তি হবে না…।’

এ পর্যন্ত স্বপ্নটা দেখেই ঘুম ভেঙে গেল কাশ্যপের। সকাল হয়েছে। মেঘ সরে গেছে, বৃষ্টি আপাতত বন্ধ। ঘুম থেকে উঠে কাশ্যপ বেশ কিছুক্ষণ ধরে চিন্তা করল সেই অদ্ভুত স্বপ্নের কথা। তারপর সে নিজের কাজে মন দিল। আগের দিন কোনও জুয়াড়ি না এলেও পুরোনো একটা হিসাব বাকি ছিল। শ্বেততারা স্নান সেরে ফেরার পর মুদ্রার থলি আর হিসাব নিয়ে শ্বেততারার কক্ষে পৌঁছল কাশ্যপ।

মাটিতে বিছানো মাদুরে থলি থেকে মুদ্রা ঢেলে কাশ্যপ, শ্বেততারার মুখোমুখি বসল। সদ্য স্নান সেরে এসেছে শ্বেততারা। তখনও ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরছে তার কেশদামের প্রান্তদেশ বেয়ে। শ্বেততারার মুখমণ্ডলে কেমন যেন একটা বিষণ্ণতার ছাপ। শ্বেততারা টাকা গুনছে, কিন্তু কেমন যেন অন্যমনস্ক লাগছে তাকে। হয়তো বা বণিক এবার দেশে ফিরে যাবে বলে সত্যি বেশ কাতর সে। আর এরপরই হঠাৎ একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করল সে। শ্বেততারার নিমাঙ্গের বস্ত্র এক পাশের হাঁটুর অনেকটা ওপরে উঠে গেছে। দুধের মতো সাদা মসৃণ উরু প্রায় পুরোটাই দৃশ্যমান কাশ্যপের চোখের সামনে। এমনকী শ্বেততারার সব থেকে গোপনাঙ্গের মৃদু আভাসও যেন বর্তমান তার বস্ত্রের ফাঁক গলে! শ্বেততারা ইতিপূর্বে কোনওদিন কাশ্যপকে ইচ্ছাকৃতভাবে শরীর প্রদর্শন করেনি।

কাশ্যপ বুঝতে পারল শ্বেততারার অসতর্কতার কারণেই ব্যাপারটা ঘটেছে। কাশ্যপের মনে পড়ে গেল প্রথম দিন দেখা, গতরাতে দেখা শ্বেততারার সেই সিক্তদেহ। কাশ্যপ কিছুতেই চোখ সরাতে পারল না শ্বেততারার সেই উন্মুক্ত উরু থেকে। কাশ্যপের শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল আদিম রিপুর বাসনা। দুর্বার এক কাম তাড়না যেন তাকে আচ্ছন্ন করে তুলল। কাশ্যপের হাত কি তার নিজের অজান্তেই স্পর্শ করতে যাচ্ছিল শ্বেততারার মাখন সদৃশ সেই উরু? ব্যাপারটা জানা নেই কাশ্যপের। কিন্তু হঠাৎই শ্বেততারা এরপর এক ঝটকাতে বস্ত্রখণ্ড দিয়ে তার উরু আবৃত করে বলে উঠল, ‘আমার মুদ্রা গণনা শেষ।’

কথাটা শুনে সম্বিত ফিরে পেয়ে কাশ্যপ চমকে উঠে তাকাল শ্বেততারার দিকে। শ্বেততারার মুখ গম্ভীর। শ্বেততারার কাছে যে সে ধরা পড়েছে তা বুঝতে পারল কাশ্যপ। হিসাব বোঝানো হয়ে গেছে তাই শ্বেততারার কক্ষ ত্যাগ করল কাশ্যপ। সেদিনও দ্বিপ্রহরের পর থেকে আগের দিনের মতনই কালো মেঘে ঢেকে যেতে লাগল আকাশ। তারপর বৃষ্টি নামল। জুয়ার নেশাতে এদিন দু-পাঁচ জন জুয়ার আড্ডাতে এল ঠিকই, কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়াতে মাত্র কয়েকদান জুয়া খেলেই তারা ফিরে গেল।

আকাশ যেন ভেঙে পড়েছে। বাতি নিভে গেল শ্বেততারার প্রাসাদে। নিজের কক্ষে শুয়ে পড়ল কাশ্যপ। কিন্তু ঘুমে জাগরণে কাশ্যপের চোখের সামনে শুধু ভেসে উঠতে লাগল শ্বেততারার সেই ধবল উরু, আর তারও গভীরে শ্বেততারার একান্ত গোপন স্থানের আহ্বান। কাশ্যপের মনে হতে লাগল যে কোনও মূল্যে তাকে স্পর্শ করতে হবে শ্বেততারার ওই উরু, তাকে পেতেই হবে, পেতেই হবে শ্বেততারার শরীর। নইলে কাশ্যপের পুরুষ জন্ম বৃথা।

পর দিন সকালে কাশ্যপ যখন শয্যা ত্যাগ করল তখন সারারাত বর্ষণ সমাপ্ত করে শান্ত হয়েছেন বরুণদেব। রোজই এমন হচ্ছে গত ক’দিন ধরে। সকাল থেকে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত আকাশ পরিষ্কার থাকছে। তারপর আকাশের দখল জল ভরা মেঘের দলের। ক’দিন ধরে টানা বৃষ্টিপাতের ফলে শ্বেততারার বাটিকার ভিতর কেমন যেন একটা আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তার থেকে মুক্ত হবার জন্য একটু বেলার দিকে কাশ্যপ দেউড়ির বাইরে সূর্য কিরণে এসে দাঁড়াল। তবে তার স্বপ্নর রেশ যেন কিছুতেই কাটছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে দেখল নদীর দিক থেকে রৈবতক আসছে। রোজ প্রত্যুষে সে নদীর জল দেখতে যায়। কাশ্যপের সামনে এসে বণিক রৈবতক হাসি মুখে বলল, ‘নদীর জল হু-হু করে বাড়ছে। আমার ময়ূরপঙ্খী নাও মৃদু মৃদু কাঁপতে শুরু করেছে। জলের তোড়ে নদীর তলদেশের পলি খসতে শুরু করেছে। আর দু-রাত এমন বর্ষণ হলেই আমার নাও ভেসে উঠবে। যাত্রা শুরু করব আমি।’

কাশ্যপ বলল, ‘ভগবান বিষ্ণুর কাছে প্রার্থনা করি, বরুণদেবের কাছে প্রার্থনা জানাই তোমার মনস্কামনা যেন পূর্ণ হয়।’

কাশ্যপের কথা শুনে প্রাসাদে প্রবেশ করার আগে রৈবতক বলল, ‘ব্রাহ্মণের মুখনিঃসৃত বাণী ফলবে বলেই আমার মনে হয়।’

বণিক রৈবতক ‘ব্রাহ্মণ’ বলতে কাশ্যপকে বোঝালেও কথাটা শুনে কাশ্যপ মৃদু চমকে উঠল। তার হঠাৎই মনে পড়ে গেল সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের কথা! ওই যে দেউড়ির গায়ের চাতালে শুয়ে মৃত্যুর আগের মুহূর্তে যে কাশ্যপকে অভিশাপ দিয়েছিল তার মুক্তি ঘটবে না বলে! কথাটা মনে পড়তেই কাশ্যপের মনটা একটু তেতো হয়ে গেল। সত্যি কি নিষ্ঠাবান কোনও ব্রাহ্মণের অভিশাপ ফলে? এ নিয়ে ভাবতে লাগল কাশ্যপ।

সূর্যের তাপে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার ফলে ঘর্মপাত হবার উপক্রম হল কাশ্যপের। সে আবার দেউড়ির ভিতর প্রবেশ করতে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময় অশ্বখুরধ্বনি কানে এল তার। কারা যেন অশ্বপৃষ্ঠে ছুটে আসছে প্রাসাদের দিকে। শব্দটা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল কাশ্যপ। কিছুক্ষণের মধ্যে অশ্বপৃষ্ঠে শ্বেততারার প্রাসাদের সামনে আবির্ভূত হল পাঁচজন লোক। চর্ম বর্মে আবৃত তাদের দেহ। কারো কোমরে তলোয়ার বা কিরিচ গোঁজা, কারও বা হাতে ধরা বল্লম। একটা লোক, সেই মনে হয় অশ্বারোহীদের দলপতি। কৃষ্ণবর্ণের চেহারা, চোয়ালের হাড়টা বেশ উঁচু, কপালে একটা কাটা দাগ আছে। সে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে কাশ্যপকে ঘোড়ার পিঠ থেকে পর্যবেক্ষণ করে কর্কশ কণ্ঠে বলল, ‘প্রভু শ্যেনের সেবক আমরা। শ্বেততারা কোথায়?’

কাশ্যপ জবাব দিল, ‘সে নিজের কাজে ব্যস্ত আছে। কী প্রায়োজন?’

লোকটা বলল, ‘প্রয়োজন আছে। প্রভু একটা পত্র দিয়েছেন তার উদ্দেশে। পত্রও বলতে পারো, আবার নিদের্শও বলতে পারো।’ এই বলে ধূর্ত চাহনিতে হেসে লোকটা তার কোমরবন্ধ থেকে তালপাতার একটা পত্র বার করল। পত্রটা কাশ্যপের দিকে হাত বাড়িয়ে দেবার সময় বলল, ‘তুমি তো সেই ব্রাহ্মণ যে কড়ি রক্ষকের কাজ করো তাই না? কী যেন নাম তোমার?’

পত্রটা হাতে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি সেই কাশ্যপ।’

লোকটা হেসে বলল, ‘পত্রটা খুব জরুরি। এটা এখনই গিয়ে তোমার প্রিয়তমাকে দাও। তাকে বলো কুক্কুট এই পত্র নিয়ে এসেছে। রাজনির্দেশ পালন না করলে বিপদ ঘটবে।’

লোকটার কথা শুনে একসঙ্গে হেসে উঠল তার সঙ্গীরা। কাশ্যপকে এরপর আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সঙ্গীদের নিয়ে রওনা হয়ে গেল লোকটা।

কুক্কুটকে একবারই রক্তাক্ত অবস্থায় এ প্রাসাদ ছেড়ে পালাতে দেখেছিল কাশ্যপ। সেই প্রথম দিনের পর সে কোনওদিন কুক্কুটকে দেখেনি। তাই সে প্রথম দর্শনে তাকে চিনতে পারেনি। তার পরিচয় জানার পর কাশ্যপের মনে পড়ল বণিক রৈবতকের ময়ূরপঙ্খীতে যারা লুঠপাট চালিয়েছিল তাদের দলপতির কপালেও নাকি একটা কাটা দাগ ছিল। তবে প্রভু শ্যেনই কি তার অনুচর কুক্কুটকে ময়ূরপঙ্খী লুণ্ঠনের জন্য পাঠিয়েছিল?

অশ্বখুরের শব্দ মিলিয়ে গেল। কাশ্যপ দেউড়ির ভিতর ঢুকে এগোল শ্বেততারার কক্ষের দিকে।

শ্বেততারা তখন নদীতে স্নান করতে যাবার জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছিল। কাশ্যপ তার দরজার কপাটে গিয়ে ঘা দিতেই দরজা খুলে এই অসময়ে কাশ্যপকে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল। তালপাতার পত্রটা সে শ্বেততারার হাতে দিয়ে বলল, ‘প্রভু শ্যেনের কাছ থেকে ওই কুক্কুট এসেছিল। সে ওই পত্র দিয়ে গেছে।’

কুক্কুটের নাম শুনেই শ্বেততারা বলল ‘সেই পামর, তস্কর কুক্কুট। যাকে আমি প্রদীপদণ্ড দিয়ে আঘাত করে বিতাড়িত করেছিলাম?’

কাশ্যপ জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, সে এসেছিল। তার কপালে একটা শুষ্ক কাটা দাগ আছে।’

কথাটা শুনেই সুতো দিয়ে বাঁধা তালপাতার বাঁধন খুলে সেটা নীরবে পাঠ করতে শুরু করল শ্বেততারা। কাশ্যপ খেয়াল করল পত্রটা পাঠ করতে করতে কেমন যেন একটা শঙ্কার ভাব নেমে এল তার মুখমণ্ডলে। পত্র পাঠের পর সেটা আবার গুটিয়ে ফেলে নিশ্চুপ ভাবে চৌকাঠের দিকে তাকিয়ে রইল সে। শ্বেততারার মুখমণ্ডলে স্পষ্ট দুশ্চিন্তার ভাব লক্ষ করে কাশ্যপ একটু ইতস্ততভাবে জানতে চাইল ‘পত্রে কী লেখা আছে?’

শ্বেততারা জবাব দিল ‘দু-রাত পর অর্থাৎ পরশু সূর্যাস্তের পর রাজা শ্যেন তার প্রতিনিধি হিসাবে কুক্কুটকে আমার এখানে জুয়া খেলতে পাঠাবেন আমার অথবা আমার কোনও প্রতিনিধির সঙ্গে। জুয়ার শর্তও তিনি ঠিক করে দিয়েছেন।’

‘কী শর্ত?’ জানতে চাইল কাশ্যপ।

শ্বেততারা চিন্তাক্লিষ্টভাবে বলল, ‘কুক্কুট যদি পরাজিত হয় তবে আমি পাব মাত্র একশো রৌপ্য মুদ্রা। আর আমি যদি পরাজিত হই তবে এই প্রাসাদ, জুয়ার আড্ডা সব তুলে দিতে হবে রাজপ্রতিনিধি কুক্কুটের হাতে। সেদিন প্রাসাদে অন্য জুয়াড়িদের প্রবেশ বা রক্ষীদের উপস্থিতিও নিষেধ বলে পত্রে জানানো হয়েছে!’

শ্বেততারার কথা শুনে কাশ্যপ বলল, ‘কিন্তু শর্ত দেখে মনে হচ্ছে এই জুয়ার আড্ডার দখল নিতে চাচ্ছেন শ্যেন। কুক্কুট যে প্রভু সেনের আশ্রয়ে গিয়ে উঠেছিল তা আমার জানা ছিল না। সেই নিশ্চয় প্ররোচিত করেছে শ্যেনকে। আমি এতদিন ধরে শ্যেনকে নিয়মিত ভাবে তার প্রণামী পাঠিয়ে আসছি। তিনি হঠাৎ আমাকে বিব্রত করতে জুয়া খেলার জন্য কুক্কুটকে পাঠাবেন কেন? কুক্কুটের কপালের ওই ক্ষতচিহ্ন আমার আঘাতেই সৃষ্ট। সম্ভবত কুক্কুটই হানা দিয়েছিল ময়ূরপঙ্খীতে।’ কাশ্যপও এবার অনুমান করল রাজা শ্যেনের এই পত্রের মধ্যে কোনও একটা দুরভিসন্ধি আছে। কুক্কুট কোনওভাবে হয়তো শ্বেততারার ওপর তার আঘাতের বদলা নিতে চায়। কুক্কুটের মুখমণ্ডলে যেন তেমনই কিছুর একটা আভাস ছিল। শ্বেততারা এরপর কাশ্যপকে বলল, ‘ঠিক আছে তুমি এখন যাও। পালকি বেহারাদের জানিয়ে দাও আমি আজ আর ভাগীরথীতে যাব না।’

শ্বেততারার কক্ষ থেকে নিজের কক্ষে ফিরে এল কাশ্যপ। সে ভাবতে লাগল প্রভু শ্যেনের সত্যি কি এই জুয়ার আড্ডার দখল নেবার উদ্দেশ্য আছে?

শ্বেততারা আর কাশ্যপ, দুজনেরই অনুমান সত্যি ছিল। শ্বেততারা কুক্কুটের আচরণে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রদীপ দণ্ডের আঘাতে তাকে বিতাড়ণের কিছু দিনের মধ্যেই কুক্কুট এক পরিচিত জুয়াড়ির মারফত গিয়ে হাজির হয়েছিল প্রভু শ্যেনের কাছে। রাজা শ্যেনের নিজস্ব এক বাহিনী আছে। যাদের কাজ হল দস্যুবৃত্তি, গুপ্তহত্যা, লুণ্ঠন এসব করা। লুণ্ঠনের বৃহদংশ তারা জমা দেয় রাজকোষে। প্রভু শ্যেনের মনোরঞ্জনের জন্য তারা নারী হরণও করে। নারী হরণের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ, শুদ্র, কোনও ভেদাভেদ থাকে না। শুধু সুন্দরী নারী হলেই হল। পুরুষের কাছে নারী শরীর শুধুমাত্র সম্ভোগের আধার। নারী শরীরের কোনও জাত হয় না।

প্রভু শ্যেনের সেই লুণ্ঠন বাহিনীতেই প্রথমে গিয়ে যোগ দিয়েছিল কুক্কুট। সে খেয়াল করে দেখেছিল অর্থ অপেক্ষা সুন্দরী সদ্য-যৌবনে পদার্পণ করা নারী পেলেই বেশি আনন্দ লাভ করেন প্রভু শ্যেন। আর ব্যাপারটা খেয়াল করে কয়েক বছর ধরে কুমারী, যুবতী-সুন্দরী নারীদের হরণ করে কুক্কুট তাদের তুলে দিয়েছে প্রভু শ্যেনের কাছে। আর এছাড়া লুণ্ঠিত অর্থ তো আছেই। প্রভু শ্যেনের বড় বিশ্বাসের পাত্র হয়ে উঠেছে কুক্কুট। আর সেই সঙ্গে কুক্কুট তীব্র ঘৃণা পুষে রেখেছিল শ্বেততারার প্রতি। শ্বেততারার প্রতি তার ঘৃণা ক্রমশ বেড়েই চলছিল।

বণিক রৈবতকের ময়ূরপঙ্খীতে হানা দিয়ে প্রায় কিছুই পায়নি কুক্কুট। চর মারফত সে জানতে পারল ময়ূরপঙ্খীর অধিকারী বণিক রৈবতক শ্বেততারার জুয়ার আড্ডাতে নিরাপদ আশ্রয়ে আছে। ময়ূরপঙ্খীতে যখন বাণিজ্যলব্ধ কোনও ধনসম্পদ পাওয়া যায়নি তখন নিশ্চয়ই বণিক তার সম্পদ স্বর্ণমুদ্রা বা দুর্মূল্য রত্নরাজি নিয়ে শ্বেততারার প্রাসাদের ঠাঁই নিয়েছে। এ ব্যাপারটা বুঝতে কোনও অসুবিধা হয়নি কুক্কুটের। সে যখন সঙ্গীদের নিয়ে ময়ূরপঙ্খীতে হানা দিয়েছিল তখন একজন নাবিক আতঙ্কে বলে ফেলেছিল যে চম্বা নগরীদের সঙ্গে বাণিজ্য করে মৃগনাভির বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে দুর্মূল্য কিছু রত্ন সংগ্রহ করেছে বণিক।

মুখের গ্রাস শ্বেততারার প্রসাদে চলে যাওয়াতে শ্বেততারার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল কুক্কুট। তাছাড়া শ্বেততারার প্রতি তার পুরোনো অপমানের জ্বালা তো আছেই। সে তার প্রভুর কাছে গিয়ে বুঝিয়েছিল যে প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে শ্বেততারার প্রাসাদে অবস্থান করছে নাবিক। আর শ্বেততারার জুয়ার আড্ডারও এবার দখল নেওয়া প্রয়োজন। বহু সম্পদ লুকানো আছে শ্বেততারার কাছে। রাশি রাশি স্বর্ণমুদ্রা, হিরা, জহরত দীর্ঘ দিন ধরে উপার্জন করে এসেছে শ্বেততারা। কুক্কুট যেহেতু শ্বেততারার কড়ি রক্ষক ছিল তাই সে এ ব্যাপার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অবগত। জুয়াড়িদের থেকে প্রাপ্ত বহু সম্পদ সে নিজেই তুলে দিয়েছে শ্বেততারার হাতে। প্রভুকে শ্বেততারা যে উপঢৌকন পাঠায় তা শ্বেততারার উপার্জনের কণা মাত্র। শ্বেততারা কোনওদিন সে সম্পদ নিয়ে কর্ণসুবর্ণ পরিত্যাগ করার আগেই তার প্রাসাদের দখল নিতে হবে।

প্রাথমিক অবস্থাতে রাজা শ্যেন মৃদু ইতস্তত করছিলেন কুক্কুটের প্রস্তাবে। শ্বেততারা নিয়মিত ভাবে অর্থ দেয় প্রভু শ্যেনকে। কিন্তু শ্যেন যখন এরপর কুক্কুটের কাছে শুনল যে শ্বেততারার জুয়ার আড্ডার দখল নেবার পর সেটা কুক্কুটই পরিচালনা করতে সমর্থ এবং তার জন্য সে শ্বেততারার তিনগুণ অর্থ প্রদান করবে প্রভুকে তখন শ্যেন রাজি হয়ে গেল ধূর্ত কুক্কুটের প্রস্তাবে। রাজা শ্যেন পরিকল্পনা রূপায়ণের দায়িত্ব দিলেন কুক্কুটের ওপরই। কিন্তু তিনি তাকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন যে ‘দেখতে হবে শ্বেততারার প্রাসাদ দখল করলে তাদেরও প্রাসাদ দখল হতে পারে এই আশঙ্কাতে অন্য জুয়ার আড্ডার অধিকারীরা রাজ্য ছেড়ে না পালায়।’

কুক্কুট বলল, ‘তা হবে না। আমি আপনার প্রতিনিধি হয়ে সেখানে জুয়া খেলতে যাব। আমি শুধু শ্বেততারার কড়ি রক্ষকই ছিলাম না, কড়ির জুয়াতে আমারও হাত বেশ পাকা। বাজির শর্তটা শুধু আপনি ঠিক করে দেবেন শ্বেততারাকে। তাতে বলা থাকবে শ্বেততারা পরাজিত হলে সে প্রাসাদ ছেড়ে দেবে।’

কথাটা শুনে প্রভু শ্যেন বললেন ‘কিন্তু আমি তো শুনেছি শ্বেততারা কোনও দিন কড়ির জুয়াতে হারে না?’

কুক্কুট বলল ‘সে জন্যই তো আমি খেলতে যেতে চাইছি। শ্বেততারা আমার সঙ্গে খেলতে চাইবে না বলেই মনে হয়। শ্বেততারা তার নিজের কড়ি ওন্য কাউকে দেয় না। সে যদি আমার সঙ্গে খেলতে না চেয়ে অন্য কাউকে খেলতে বসায় তবে তাকে আমি পরাজিত করতে পারব বলেই আমার ধারণা। আর, শ্বেততারা বা তার প্রতিনিধি যেই খেলতে বসুক না কেন, শেষ পর্যন্ত যদি আমি পরাজিত হই তখন বলপূর্বক প্রাসাদের দখল নেব। অন্য জুয়ার আড্ডার অধিকারীদের কাছে জানানো হবে শ্বেততারা জুয়ার বাজিতে পরাজিত হয়ে প্রাসাদ ছাড়তে না চাওয়ার কারণে বলপূর্বক প্রাসাদের দখল নেওয়া হয়েছে।’—এ কথাগুলো বলে মার্তণ্ড বললেন, ‘কুক্কুটের কড়ির জুয়া খেলতে আসার পিছনে যা বললাম তা একটা অনুমান মাত্র। নইলে প্রভু শ্যেন তো সৈন্য পাঠিয়েই প্রাসাদের দখল নিতে পারতেন।’

মানববাবু বললেন, ‘আচ্ছা এমনও তো হতে পারে যে, ফাঁদে পড়া মূষিককে মারার আগে মার্জার যেমন তাকে অনেক খেলিয়ে খেলিয়ে মারে তেমনই শ্বেততারাকে প্রাসাদ থেকে উৎখাত করার আগে তাকে একটু খেলিয়ে নিতে চেয়েছিল কুক্কুট, তার অপমানের বদলা নেবার জন্য?’

মানববাবুর কথা শুনে ব্রাহ্মণ মার্তণ্ড তার মুখের দিকে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বললেন ‘বাঃ। এ কথাটা তো আগে কোনওদিন আমার মাথায় আসেনি! আপনার মাথায় এল কীভাবে?’

মানববাবু বললেন, ‘আপনার কাহিনি শুনতে শুনতে আমার মনে হচ্ছে যে আমিই যেন সেই সময়তে পৌঁছে গেছি! এ কাহিনি যেন আমারও চেনা!’

কথাটা মিথ্যা বললে না মানববাবু। কেন জানি তার মনে হচ্ছে এ কাহিনি তার জানা। অবশ্য অনেক সময় অচেনা কাহিনিও চেনা লাগে মানুষের।

ব্রাহ্মণ মার্তণ্ড কড়ির ছকের দিকে তাকিয়ে রইলেন নিশ্চুপভাবে। তারপর একটা চালে মানববাবুর একটা কড়ি খেলেন। মানববাবুও পাল্টা চালে মার্তণ্ডর একটা কড়ি গিললেন। দীর্ঘক্ষণ খেলা চলছে। উভয়ই বিপক্ষের অনেকগুলো করে কড়ি খেয়েছেন। মাত্র চারটে কড়ি আছে ছকে। মাঝে-মাঝেই আলো কমে যাচ্ছে। খণ্ড খণ্ড মেঘ চাঁদের গায়ের ওপর দিয়ে ভেসে গিয়ে জমা হচ্ছে আকাশের এক কোণে। সেদিকে তাকিয়ে মানববাবু বললেন ‘বৃষ্টি আসবে নাকি?’ কথাটা শুনে মার্তণ্ড বললেন, ‘হতে পারে। খেলাও শেষ হতে চলল। আমার গল্পটা শেষ করি—

শ্বেততারা তো সেদিন আর স্নানে গেল না। কাশ্যপও ফিরে এসেছিল তার কক্ষে। গত ক’দিনের মতোই বিকাল হতেই মেঘে ঢাকতে শুরু করল আকাশ। তারপর সন্ধ্যার আগেই বৃষ্টি শুরু হল। বরুণদেব যেন ঠিকই করে ফেলেছেন বণিক রৈবতকের ময়ূরপঙ্খীকে ভাসিয়ে তুলবেনই। এমন বর্ষণ কোনওদিন দেখেনি কেউ। আকাশ যেন ভেঙে পড়ছে! আর তার সঙ্গে বাতাসের ঝাপটা। প্রদীপ জ্বালানো যাচ্ছে না। অন্ধকারে নিমজ্জিত শ্বেততারার জুয়ার আড্ডাতে সেদিনও একজনও জুয়াড়ি এল না। শ্বেততারাও নিজের কক্ষ ত্যাগ করল না।

রাতে বিছানাতে শুয়ে আগের দিনের মতোই কাশ্যপের মনে পড়তে লাগল শ্বেততারার উন্মুক্ত উরু, নদী তীরে সিক্ত বস্ত্রের আড়াল থেকে প্রস্ফুটিত স্তনবৃন্তের কথা। বেশ কয়েকবছর হয়ে গেল শ্বেততারার প্রাসাদে কাটিয়েছে কাশ্যপ, কিন্তু এতদিন শ্বেততারার শরীরের প্রতি এমন তীব্র আকর্ষণ অনুভব করেনি কাশ্যপ। শ্বেততারার শরীর পাবার জন্য যেন পাগল হয়ে যাচ্ছে সে। যাইহোক সারা রাত কখনও জেগে কখনও তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবে শ্বেততারার শরীরের কথা ভেবে কাটিয়ে দিল কাশ্যপ। ভোরের আলো ফুটল এক সময়। তবে কাশ্যপ তার কক্ষ ত্যাগ করল আরও বেশ কিছু সময় পর। আগের দিনের মতোই বাটিকার বাইরে গিয়ে সে দাঁড়াল সূর্যের উত্তাপ গ্রহণের জন্য। কুক্কুটের জুয়া খেলতে আসার অভিসন্ধির ব্যাপারে ভাবতে শুরু করল কাশ্যপ। তার ওপরও নিশ্চয়ই কুক্কুটের ক্রোধ আছে। শ্বেততারা কুক্কুটকে বিতাড়িত করে কাশ্যপকেই স্থলাভিষিক্ত করেছিল তার জায়গাতে। কাশ্যপের ওপরও কোনও দুর্যোগ নেমে আসবে না তো? কর্ণসুবর্ণতে পদার্পণ করার পর শ্বেততারার এ প্রাসাদেরই অঙ্গ হয়ে গেছে কাশ্যপ। শ্বেততারার ওপর যদি সত্যি কোনও দুর্যোগ নামে তবে কাশ্যপের ওপর সেই দুযোÅগ নেমে আসবে।

নানা কথা ভাবছিল কাশ্যপ। আগের দিনের মতোই হঠাৎ সে দেখতে পেল নদীর দিক থেকে রৈবতক আসছে। তার চোখ মুখ বেশ উজ্জ্বল। দেউড়ির ভিতর প্রবেশ করার আগে একটু দাঁড়িয়ে সে কাশ্যপকে বলল, ‘যাক, ব্রাহ্মণের বলা কথা শেষ পর্যন্ত ফলেছে। ময়ূরপঙ্খী ভেসে উঠেছে। কোনও চিন্তা নেই। পাল তুলে নোঙর ওঠালেই তরতর করে নাও ভেসে যাবে।’

কাশ্যপ তার কথা শুনে বলল, ‘আপনার যাত্রা যেন শুভ হয়।’

বেশ কিছুক্ষণ দেউড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে রৌদ্রকিরণ গায়ে মেখে কক্ষে ফিরে এল কাশ্যপ।

কাশ্যপের এদিন আর শ্বেততারার কাছে দৈনন্দিন হিসাব বোঝাবার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু দ্বিপ্রহরে একজন খবর দিল শ্বেততারা তাকে ডাকছে। কাশ্যপ মৃদু বিস্মিত হয়ে শ্বেততারার কক্ষের সামনে গিয়ে হাজির হয়ে দেখল দুয়ারের সামনেই শ্বেততারা দাঁড়িয়ে আছে। আজও সে নদীতে যায়নি। কাশ্যপকে তার কক্ষের ভিতর প্রবেশ করিয়ে ভিতর থেকে খিল তুলে দিল শ্বেততারা। মুখোমুখি বসল শ্বেততারা ও কাশ্যপ।

শ্বেততারা কিছু সময় কাশ্যপের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বলল, ‘শোন কাশ্যপ, কুক্কুটের মনে যে একটা দুরভিসন্ধি আছে সে ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আমার ওপর তার প্রচণ্ড ক্রোধ আছে। এক সঙ্গে খেলতে বসলে বিপত্তি ঘটতে পারে। আবার রাজা শ্যেনের নির্দেশ অমান্য করলে ভয়ঙ্কর বিপদ নেমে আসতে পারে।’—এই বলে থামল শ্বেততারা।

কাশ্যপ বলল, ‘তবে কী করবে তুমি?’

একটু চুপ করে থেকে কাশ্যপের কথার জবাবে শ্বেততারা বলল, ‘আমি চাই আমার হয়ে কুক্কুটের সঙ্গে তুমি কড়ির জুয়া খেলতে বসবে।’

‘আমি খেলব?’ বিস্মিত ভাবে বলে উঠল কাশ্যপ।

শ্বেততারা শান্ত ভাবে বলল, ‘হ্যাঁ, তুমি। ইতিমধ্যে এ কয় বছরে কড়ির জুয়াতে বেশ পটু হয়ে উঠেছ তুমি। তাছাড়া আমার কড়ি আমি দিয়ে যাব তোমাকে। আমার খেলার কক্ষে বসে আমার কড়ি দিয়ে কুক্কুটের সঙ্গে খেলবে তুমি। এ কড়ি কোনও দিন হারে না। শুধু তুমি যখন খেলবে তখন কালো কড়ি নিয়ে খেলবে। বিপক্ষকে সাদা কড়ি দেবে।’ কাশ্যপ তার কথা শুনে আরও বিস্মিত হয়ে বলল, ‘তোমার কড়ি আমাকে দেবে! কড়ি দিয়ে তুমি কোথায় যাবে?’

শ্বেততারা বলল, ‘আমি প্রাসাদ ছেড়ে আশ্রয় নেব বণিক রৈবতকের ময়ূরপঙ্খীতে। এ প্রাসাদ থেকে নদী তীর পর্যন্ত একটা ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ আছে। খেলা শুরু করার পূর্ব মুহূর্তে সুড়ঙ্গ পথে আমি নদী তীরে পৌঁছে নাও-এ গিয়ে উঠব। খেলা শেষে যদি তুমি জয়ী হও তখন পরিস্থিতি বুঝে ওই সুড়ঙ্গ পথে গিয়ে আমার সঙ্গে মিলিত হবে। আর যদি কোনও কারণে পরাজিত হও তবে কুক্কুটের হাতে প্রাসাদ তুলে দিয়ে ও পথেই আমার সঙ্গে মিলিত হবে। আমার সঙ্গে বণিকের পরামর্শ হয়েছে। সে আমাদের কর্ণসুবর্ণর সীমানার বাইরে কোনও নিরাপদ বন্দরে পৌঁছে দেবে।’

কাশ্যপ বলল, ‘কিন্তু এমনও তো হতে পরে যে জুয়াতে আমার হার বা জিত যাই হোক না কেন কুক্কুট আমাকে বন্দি করল বা হত্যা করল?’

শ্বেততারা বলল, ‘আমার ধারণা প্রাসাদ হস্তগত করার পরই কুক্কুট প্রথমেই খুঁজে দেখার চেষ্টা করবে কোথায় কী ধন সম্পদ আছে। সে লোভী। কুক্কুট চেষ্টা করবে তার একটা অংশ প্রভু শ্যেনের হাতে তুলে না দিয়ে আলাদা করে সরিয়ে ফেলার। তবে সেসব সে পাবে না। তার আগেই আমি সেসব সরিয়ে ফেলব বণিকের ময়ূরপঙ্খীতে। তবে তোমার আশঙ্কাও আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না। সেটুকু ঝুঁকি অবশ্য তোমাকে নিতে হবে। কিন্তু মনে রেখো যদি তুমি কুক্কুটের সঙ্গে জুয়া খেলাতে অংশ নাও, ফলাফল যাই হোক না কেন, আমার কাছে ফিরে গেলে তুমি যা পুরষ্কার পাবে তা এই কর্ণসুবর্ণর বহু ধনাঢ্য মানুষ কামনা করেই পায়নি। স্বয়ং রাজা শ্যেনও পাবেন না।’

‘কী পুরস্কার?’ জানতে চাইল কাশ্যপ।

একটু চুপ করে থেকে কাশ্যপকে চমকে দিয়ে শ্বেততারা বলল, ‘আমার এই শরীর।’

কাশ্যপ যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। সে বলে উঠল, ‘আবার বলো, কী বললে তুমি?’

শ্বেততারা বলল, ‘তুমি ঠিকই শুনেছ। আমি জানি তুমি প্রবল ভাবে কামনা করো আমাকে। তোমার চোখের দৃষ্টি বলে দেয় সে কথা। আমার অনুরোধ রক্ষা করলে এ শরীর তুমি পাবে। এমন হতে পারে যে কুক্কুট পরাজিত হবার পর রাজা শ্যেন এ পরাজয় মেনে নিলেন, আমরা আবার এ প্রাসাদে ফিরে এলাম, জুয়ার আড্ডা আবার চালু হল তবে সে ক্ষেত্রে এ প্রাসাদ ও আয়ের অর্ধাংশও তোমার হবে। ভেবে দেখো কাশ্যপ, তোমার মতো একজন ব্রাহ্মণের পক্ষে এত সব পাওয়া কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। এত কিছু পাওয়ার জন্য একটা ঝুঁকি তুমি নিতে পারবে না কাশ্যপ? একদিন তো তুমি এর থেকে বড় ঝুঁকি নিয়ে ভাগীরথীর ঘূর্ণী থেকে আমাকে বাঁচাবার জন্য জলে ঝাঁপ দিয়েছিলে।’

শ্বেততারার প্রাসাদের অংশীদার হওয়াটা কাশ্যপের কাছে বড় ব্যাপার ছিল না। অর্থ-সম্পদের ওপর বড় একটা লোভ কাশ্যপের কোনও দিনই তেমন ছিল না। কিন্তু শ্বেততারার শরীর? যে শরীরকে দিন রাত কামনা করে চলেছে কাশ্যপ। যে শরীর বসে আছে তার সামনে। একটা ঝুঁকি নিলেই কাশ্যপ স্পর্শ করতে পারবে সে শরীরকে। শেষ পর্যন্ত আর শ্বেততারার এ আহ্বান অস্বীকার করতে পারল না কাশ্যপ। তার উদগ্র কামনা তাকে দিয়ে বলিয়ে নিল, ‘হ্যাঁ, আমি কুক্কুটের সঙ্গে জুয়া খেলতে বসব।’

কথাটা শুনে হাসি ফুটে উঠল শ্বেততারার মুখে। সে বলল, ‘আমি জানতাম তুমি আমার প্রস্তাবে সম্মত হবে। কথা রাখব আমি। এখন আমাদের বেশ কিছু জরুরি কাজ করতে হবে। তার জন্য প্রাসাদ থেকে আজই সবাইকে সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। বৃষ্টি হোক বা না হোক আজ আর কাল জুয়ার আড্ডা বসবে না। তোমাকে আমি প্রথমে সুড়ঙ্গটা দেখাই।’

এ কথা বলার পর দরজার খিল খুলে শ্বেততারা, কাশ্যপকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে উপস্থিত হল ঠিক এই স্থানে অর্থাৎ শ্বেততারা যে কক্ষে বসে জুয়া খেলত। সেই বিরাট কক্ষের ঠিক মাঝখানে মেঝেতে খোদাই করা শ্বেততারার এই জুয়ার ছক। শ্বেততারা কাশ্যপকে দেখাল সুড়ঙ্গতে প্রবেশ করার গোপন পথ। এ দেখে বেশ অবাক হল কাশ্যপ। বহুবার শ্বেততারার জুয়া খেলার এ কক্ষে প্রবেশ করেছে কাশ্যপ। কিন্তু সে কোনওদিন ভাবতেই পারেনি এ কক্ষে এ ভাবে একটা সুড়ঙ্গ থাকতে পারে! সেই গুপ্ত পথটা দেখাবার পর শ্বেততারা বলল, ‘খেলাতে যদি কুক্কুট জয় লাভ করে তবে সে নিশ্চয়ই প্রথমে আমার শয়নকক্ষের দিকে ছুটবে আমার সিন্দুক লুঠ করার জন্য। সেই সুযোগটাই পালাবার জন্য কাজে লাগাবে তুমি। খেলার পরিণাম যাই হোক না কেন তুমি কুক্কুটকে এ কক্ষ ছেড়ে যাবার জন্য বাধ্য করবে। আর কুক্কুট যদি এ কক্ষে তোমাকে বন্ধ করে রেখে আমার শয়ন কক্ষ বা প্রাসাদের অন্যত্র ধনরত্নের সন্ধানে যায় তবে পালানোর ব্যাপারটা আরও সহজ হবে তোমার পক্ষে।’

সুড়ঙ্গ পথটা দেখে আর শ্বেততারার কথা শুনে কাশ্যপের মনে হল, পালানোর ব্যাপারটা যতটা কঠিন বলে মনে হচ্ছিল হয়তো তা নয়। মনের শঙ্কা অনেকটাই দূর হয়ে গেল কাশ্যপের।

১০

কাশ্যপকে সুড়ঙ্গ দেখাবার পর সে কক্ষ থেকে বাইরে বেরিয়ে অন্য কাজের জন্য প্রস্তুতি শুরু করল শ্বেততারা। প্রথমে সে তার প্রাসাদের সবাইকে এক জায়গায় ডেকে তাদের পাওনা মিটিয়ে জানিয়ে দিল, বিশেষ কারণবশত তাদের সূর্যাস্তের পূর্বেই প্রাসাদ ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে হবে। তিনদিন পর তারা যেন আবার প্রাসাদে আসে। আপাতত জুয়ার আড্ডা বন্ধ থাকবে। ব্যাপারটা শুনে তার বিস্মিত হলেও শ্বেততারাকে তার কারণ জিগ্যেস করার সাহস পেল না। অনেকে আবার আনন্দিতও হল। কারণ, ছুটি বিশেষ মেলে না তাদের। শুধু একজন লোককে দেউড়ির বাইরে মোতায়েন করা হল জুয়াড়িদের সেই সংবাদ জানানোর জন্য।

বিকালের মধ্যেই শ্বেততারার প্রাসাদ ফাঁকা হয়ে গেল। নিজের হাতে সদর দরজা বন্ধ করল শ্বেততারা। এরপর প্রথম যে কাজটা শ্বেততারা করল তা হল কাশ্যপকে ডেকে তার হাতে সে তার কড়ির ভাণ্ড তুলে দিল। ভাণ্ডটা হাতে নিয়ে বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করল কাশ্যপ। এই সেই কড়ি। লোকে বলে এ কড়ি নাকি মন্ত্রপুতঃ। এ কড়ি নিয়ে খেলতে বসলে কেউ কোনওদিন হারে না। শুধু নিজের দিকে রাখতে হয় কালো কড়ি। শ্বেততারার এই কড়ির ঘটই তো তার যাবতীয় সম্পদের আধার!—মার্তণ্ডর এ কথা শুনে মানববাবু হেসে বললেন, ‘ও এ জন্য আপনি আমাকে সাদা কড়ি দিয়ে নিজে কালো কড়ি খেলছেন বুঝি।’

মার্তণ্ড মৃদু হেসে বললেন, ‘হয়তো তাই। জিততে কে না চায়? আমি দেখতে চাই হাজার বছর পরও শ্বেততারার কড়ির সে অদ্ভুত ক্ষমতা আছে কিনা?’

মানববাবুর কথার জবাব দিয়ে মার্তণ্ড আবার ফিরে গেলেন তার কাহিনিতে—

কাশ্যপের কাছে কড়িভাণ্ড সমর্পণ করে শ্বেততারা শুরু করল তার আসল কাজ। বণিক রৈবতককেও ডেকে আনা হল। কাশ্যপ আর রৈবতককে সঙ্গে নিয়ে প্রাসাদের নানান গুপ্ত স্থান থেকে নানা স্বর্ণালঙ্কার, হিরা জহরত দুর্মূল্য রত্ন উদ্ধার করে এক কক্ষে জমা করতে লাগল শ্বেততারা। তার এই সম্পদ দেখে কাশ্যপ এমনকী ধনাঢ্য রৈবতকও প্রচণ্ড বিস্মিত হয়ে গেল। এত সম্পদ রৈবতক নিজেও কোনওদিন চাক্ষুস করেনি। জুয়ার আড্ডা থেকে সংগৃহীত শ্বেততারার সারা জীবনের সম্পদ। অলঙ্কারগুলো এক জায়গাতে জড়ো করার প্রথমে তাদের গা থেকে দুর্মূল্য পাথরগুলো আলাদা করে একটা থলেতে রাখা হল। এরপর একটা বিশেষ পাত্র আনল শ্বেততারা। তার মধ্যে রয়েছে ‘ভীষণ অম্ল’। যার স্পর্শে সোনা, রূপা, লোহা যে কোন ধাতু গলে যায়। কোনও মানুষের মাথায় যদি সেই ‘ভীষণ অম্ল’ এক ফোঁটা দেওয়া যায় তবে তা তার দেহ ফুঁড়ে মাটিতে পৌঁছে যাবে, এমনই তার তেজ। সোনা গলাবার পদ্ধতি জানা ছিল শ্বেততারার। বাইরে ততক্ষণে অঝোরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। সঙ্গী দুজনকে নিয়ে সোনা গলাতে বসল শ্বেততারা। কাজ শেষ হতে হতে মধ্যরাত হয়ে গেল। বেশ কয়েকটা স্বর্ণ গোলক তৈরি হল। সেগুলোকেও আবার অন্য একটা থলের মধ্যে রাখা হল। পরদিন ভোরে সেগুলো রেখে আসা হবে ময়ূরপঙ্খীতে।

কাজ মেটার পর যে যার শয়নকক্ষে ফিরে গেল তারা। কাশ্যপ শয়ন করল ঠিকই, কিন্তু কিছুতেই তার ঘুম আসছে না। উত্তেজনা চেপে ধরতে লাগল তাকে। পরদিন কুক্কুটের সঙ্গে কড়ির জুয়াতে কী হবে? শেষ পর্যন্ত শ্বেততারার শরীর পাবে তো? বিছানাতে শুয়ে উত্তেজনাতে ছটফট করতে লাগল কাশ্যপ। এক সময় তার মনে হল বাইরে গিয়ে একটু পায়চারী করে এলে হয়তো বা তার উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হবে। এই ভেবে শয্যা ত্যাগ করে বাইরে বেরিয়ে এল কাশ্যপ।

নিঝুম রাত্রি, নিস্তব্ধ প্রাসাদ। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় বণিক রৈবতকের অতিথিশালার কাছাকাছি নিজের অজান্তেই পৌঁছে গেল কাশ্যপ। হঠাৎ সে দেখতে পেল একটা ছায়ামূর্তি আসছে শ্বেততারার শয়নকক্ষের দিক থেকেই। হ্যাঁ, সে শ্বেততারাই! শ্বেততারা কোথায় যাচ্ছে? কাশ্যপ একটা থামের আড়ালে এসে দাঁড়াল। শ্বেততারা কাশ্যপকে অন্ধকারে খেয়াল করল না। সে এসে সোজা প্রবেশ করল রৈবতকের কক্ষে। অস্পষ্ট একটা শব্দ হল। আর সে শব্দ শুনে কাশ্যপ বুঝতে পারল কক্ষে প্রবেশ করে দোর বন্ধ করে দিল শ্বেততারা।

কিন্তু এত রাতে শ্বেততারা বণিকের কক্ষে প্রবেশ করে দ্বার বন্ধ করল কেন? তবে কি শ্বেততারা বণিকের সঙ্গে সম্ভোগে লিপ্ত হতে এসেছে? নাকি কোন গোপন শলা করতে এসেছে? প্রাসাদে তো এই মুহূর্তে তারা তিনজন ছাড়া অন্য কেউ নেই। দ্বার বন্ধ করার অর্থ কি তবে কাশ্যপের থেকে নিজেদের গোপন করা? ব্যাপারটা দেখে প্রচণ্ড কৌতূহল জেগে উঠল কাশ্যপের মনে। মার্জারের মতো নিঃশব্দে লঘু পায়ে গিয়ে উপস্থিত হল সেই কক্ষের সামনে। তারপর কান পাতল বন্ধ দরজার কপাটে। সে শুনতে পেল শ্বেততারা আর বণিকের কথোপকথন—

বণিক রৈবতক বলছে, ‘তোমার ওই অমূল্য কড়িগুলো তুমি কেন কাশ্যপের হাতে তুলে দিলে? ধরো যদি কুক্কুট ওই কড়ি কেড়ে নেয় কাশ্যপের থেকে? ওই কড়ির ক্ষমতা নিশ্চয়ই কুক্কুট জানে। যদি সে চিনে ফেলে কড়িগুলো?’

রৈবতকের কথা শুনে শ্বেততারা যেন মৃদু হাসল। তারপর বলল, ‘প্রাণ থাকতে এ কড়ি আমি কাউকে কোনওদিন দেব না, দিতে পারব না। ওই কড়িগুলো দিয়েই তো আমি সামান্য পর্ণ কুটির থেকে এত বড় প্রাসাদ বানিয়েছি। এত সম্পদ সঞ্চয় করেছি যে তা নিয়ে এমন আরও একশত প্রাসাদ তৈরি করা যায়। কাশ্যপকে যে কড়ি আমি দিয়েছি তা আসল কড়ি নয়। হুবহু একইরকম দেখতে অন্য কড়ি। তবে কুক্কুটের কড়ি চেনার কথা নয়। ও কড়ি কোনওদিন তাকে দেখাইনি।’

বণিক বলল, ‘তবে আসল কড়িগুলো কোথায়?’

শ্বেততারা বলল, ‘যথাস্থানেই আছে। আমার শয়নকক্ষে বৃষমূর্তির পটের আড়ালে কুলুঙ্গিতে। সে মূর্তিকে আমি নিত্য পূজা করি। কাল প্রাসাদ ত্যাগ করার সময় কুলুঙ্গি থেকে কড়ির ক্ষুদ্র থলেটা আমি বুকে করে নিয়ে যাব। কাশ্যপ আর কুক্কুটের খেলাতে কাশ্যপ যদি জয়লাভ করে, যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় তবে আবার এ প্রাসাদে ফিরে এসে আড্ডা চালু করব। আর পরিস্থিতি যদি অনুকূল না হয় তবে তোমার সঙ্গে ভেসে গিয়ে ওই কড়িগুলো দিয়ে নতুন ভাবে আবার জুয়ার আড্ডা খুলব। আমার ওই কড়ির দৌলতে ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠতে বেশি সময় লাগবে না।’

এরপর আরও বেশ কিছু আলোচনা হল তাদের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত রৈবতক এক সময় বলল, ‘দেখা যাক কাল কী হয়। অযথা দুশ্চিন্তা করে বাকি রাতটা নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। এসো আমরা রাতটা উপভোগ করি।’

শ্বেততারা আর বণিকের কথোপকথন শোনার পর হতভম্ব হয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কাশ্যপ। তারপর সে তার কর্তব্য ঠিক করে নিল। সারা রাত জেগেই কাটিয়ে দিল কাশ্যপ।

সূর্যদেব উদয় হলেন এক সময়। ভোর হল। শেষ রাতে বৃষ্টি থেমেছে। সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ল প্রাচীন কর্ণসুবর্ণ নগরীর ভাগীরথীর সন্নিকটে শ্বেততারার প্রাসাদের গায়ে। দিনের আলো ফোটার কিছুক্ষণের মধ্যে তারা তিনজন নদীর উদ্দেশে রওনা হল শ্বেততারার সব সম্পদ নিয়ে। বণিক রৈবতক আর ফিরবে না, সে তার ময়ূরপঙ্খীতেই থেকে যাবে। তাই সেও তার সম্পদ সঙ্গে নিল।

নদী তীরে পৌঁছল তারা। ক’দিনের তুমুল বর্ষণে প্রাণ ফিরে পেয়েছে ভাগীরথী। ভরা যৌবনবতী হয়ে উঠেছে সে। চর মুছে গিয়ে স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। স্রোতের তালে দুলছে ময়ূরপঙ্খী। পাল তোলারও হয়তো দরকার হবে না। নোঙর তুললেই বাঁধনহারা হয়ে ছুটে চলবে ময়ূরপঙ্খী। একজন লোক ছোট ডিঙি নিয়ে পাড়ে অপেক্ষা করছিল বণিক রৈবতকের জন্য। সেই ডিঙিতে চেপে তারা তিনজন গিয়ে উঠল বণিকের নাওতে। বেশ বড় ময়ূরপঙ্খী। রৈবতক তার সঙ্গীদের বলল, ‘আজ রাতেই হয়তো যাত্রা শুরু করতে হবে, প্রস্তুতি শুরু করো।’

অধিকারীর নির্দেশমতো তার অনুচররা, কেউ পাল ঠিক করতে, দড়িদড়া গোটানোর কাজে নেমে পড়ল। নাবিক শ্বেততারাকে তার সম্পদ সহ নিয়ে চলল তার শয়নকক্ষের দিকে। সেখানে সিন্দুকের মধ্যে রাখা হবে স্বর্ণপিণ্ড, হিরা জহরত। তারা সেদিকে যাবার আগে কাশ্যপ বলল, ‘আমি কোনওদিন ময়ূরপঙ্খীতে উঠিনি। ময়ূরপঙ্খীটা একবার ঘুরে দেখব।’

বণিক রৈবতক হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, দেখো, আমার কোনও আপত্তি নেই,’ হয়তো বা সে মনে মনে হেসে বলেছিল, ‘হ্যাঁ, দেখে নাও, আর তো সুযোগ হবে না দেখার।’

বণিকের সম্মতি পেয়ে হয়তো বা মনে মনে হেসেছিল কাশ্যপও। শ্বেততারাকে নিয়ে রৈবতক চলে গেল তার কক্ষের দিকে। আর কাশ্যপও ঘুরে বেড়াতে শুরু করল। ওপরটা দেখা হয়ে যাবার পর ময়ূরপঙ্খীর খোলে নেমে এল কাশ্যপ। সেখানে আর কেউ নেই। ওপরে কাজে ব্যস্ত সবাই। বিশাল খোল। তার নিচের অংশটা অর্থাৎ জলের ওপর ভেসে থাকা অংশটা লৌহ চাদরে মোড়া। এই খোলেই পণ্য নিয়ে বাণিজ্যতে যায় ময়ূরপঙ্খী। এখনও বেশ কিছু পণ্য ঠাসা চটের বস্তা রাখা আছে লৌহপাতে মোড়া মেঝেতে। তারই একটা বস্তা একবার সরাল কাশ্যপ। কিছুক্ষণের মধ্যে কাশ্যপ বস্তাটা আবার ঠিক করে রেখে খোল ছেড়ে ওপরে উঠে এল। সূর্য যখন মাথার ওপর উঠল তখন শ্বেততারা নাবিকের কক্ষ থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। ডিঙিটা এরপর শ্বেততারা আর কাশ্যপকে নিয়ে পৌঁছে দিল পাড়ে। প্রাসাদে ফিরে এল তারা দুজন।—এ কথা বলে থামলেন মার্তণ্ড।

গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে। আকাশে মেঘ ডাকতে শুরু করেছে! চাঁদ যেন অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মানববাবু বললেন, ‘ও মশাই এ যে বৃষ্টি নামবে দেখছি। উঠে পড়তে হবে যে।’

মার্তণ্ড বললেন, ‘আর একটু দাঁড়ান। খেলা তো শেষের মুখে। আর আমার গল্পও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।’—কথাগুলো বলে মার্তণ্ড একটা চাল দিলেন। মানববাবুও চাল দিলেন। দ্রুত দুজনেই বেশ কয়েকটা চাল দিয়ে পরস্পরের একটা করে কড়ি গিললেন। ছকের ওপর রইল শুধু মানববাবুর একটা সাদা কড়ি আর মার্তণ্ডর একটা কালো কড়ি। হ্যাঁ, খেলার ফয়সলা হতে বেশি দেরি নেই। জুয়ার ছকের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ দুজনেরই। শেষ কড়িটা খাবার জন্য চাল দিতে শুরু করলেন দুজনেই। আর তার সঙ্গে সঙ্গে মার্তণ্ড শুরু করলেন তার কাহিনির অন্তিম অংশ—

১১

প্রাসাদে ফিরে কাশ্যপ আর শ্বেততারা দুজনেই তাদের নিজেদের কক্ষে ফিরে গেল বিশ্রাম নেবার জন্য। কেউ কাউকে বুঝতে দিল না তাদের মনের ভাবনা। সময় এগিয়ে চলল বিকালের দিকে। এদিনও বিকালে বৃষ্টি নামল। সূর্য ডোবার কিছু আগে নিজেদের কক্ষ থেকে বাইরে বেরিয়ে মিলিত হল শ্বেততারা আর কাশ্যপ। তারা কুক্কুটের আগমনের প্রতীক্ষা করতে লাগল। ঠিক যখন অন্ধকার নামল তখন প্রত্যাশা মতোই দেউড়ির বাইরে শব্দ শোনা গেল। তারপর কে যেন ঘা দিল সদর দরজাতে। একটা মশাল নিয়ে গিয়ে সদর দরজা খুলল কাশ্যপ। তার পিছনে শ্বেততারা। তোরণের মুখে দাঁড়িয়ে আছে কুক্কুট। তার সঙ্গে আরও দুজন লোক। তাদের একজন তালপাতার ছত্র ধরে আছে কুক্কুটের মাথাতে। লোকগুলো সশস্ত্র। কোমরবন্ধ থেকে তলোয়ার ঝুলছে। সঙ্গীদের নিয়েই প্রাসাদে প্রবেশ করতে উদ্যাত হল কুক্কুট। কিন্তু শ্বেততারা বলল, ‘প্রভু শ্যেনের পত্রে লেখা আছে শুধুমাত্র তুমি জুয়া খেলতে আসবে। তুমি নিশ্চই জানো যে জুয়াড়ি ছাড়া অন্য কাউকে প্রাসাদে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না?’

শ্বেততারার কথা শুনে ধূর্ত কুক্কুটের ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। সে বলল, ‘আচ্ছা তাই হবে। ইশারাতে তার সঙ্গীদের থেমে যেতে বলে একাই দেউড়ির ভিতর প্রবেশ করল কুক্কুট। এ সময় তার হাতে ধরা চর্ম থলিটা বেজে ওঠাতে কাশ্যপ আর শ্বেততারা দুজনেই অনুমান করল বাজির সেই একশ রৌপ্য মুদ্রা সঙ্গে করেই এনেছে কুক্কুট। সে ভিতরে প্রবেশ করার পর ভিতর থেকে দেউড়ির খিল তুলে দিল কাশ্যপ। শ্বেততারা এরপর কুক্কুটকে বলল, ‘শোন কুক্কুট, তোমার সঙ্গে আমি জুয়া খেলতে বসব না। তুমি যেমন প্রভু শ্যেনের প্রতিনিধি হিসাবে খেলতে এসেছ তেমনই আমার প্রতিনিধি হিসাবে খেলবে এই ব্রাহ্মণ কাশ্যপ।’

শ্বেততারার কথা শুনে কুক্কুট বিস্মিত হল ঠিকই, কিন্তু সে প্রতিবাদ করল না। কারণ সে মনে করল কাশ্যপের সঙ্গে খেললে তার জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। কাশ্যপ তো শ্বেততারার কড়ি নিয়ে খেলবে না। গুণ নষ্ট হবার ভয়ে ও কড়ি কাউকে স্পর্শ করতে দেয় না শ্বেততারা। কাশ্যপের সঙ্গে খেলতে হবে শুনে মনে মনে খুশিই হল কুক্কুট। সে কাশ্যপের উদ্দেশে বলল, ‘হ্যাঁ, চলো তবে খেলায় বসা যাক?’

শ্বেততারা কুক্কুটকে বলল, ‘সামান্য সময় তুমি কাশ্যপের সঙ্গে এখানে অপেক্ষা করো, তারপর এসো। কক্ষের আলোগুলো আমি জ্বালিয়ে নিই। তারপর এসো।’ কথাগুলো বলে শ্বেততারা চলে গেল প্রাসাদের দিকে।

কিছু সময়ের মধ্যেই কাশ্যপ কুক্কুটকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হল সেই কক্ষে। শ্বেততারা তখন সেখানে নেই। আলো জ্বালিয়ে সে এই কক্ষ থেকেই সুড়ঙ্গে অন্তর্হিত হয়েছে। নীচে নেমে সুড়ঙ্গর মুখটা আবার বন্ধ করে দেওয়া যায়। ওপর থেকে দেখে কেউ বুঝতেই পারে না সুড়ঙ্গের অবস্থান। দেওয়ালের গায়ে গোঁজা বেশ কয়েকটা মশালের আলোতে আলোকিত কক্ষ। তার ঠিক মাঝখানে মেঝেতে খোদিত শ্বেততারার এই জুয়ার ছক। তার দু-পাশে দুটো রেশমের আসন পাতা। কড়ির ঘটটাও রাখা আছে সেখানে। কাশ্যপ আগেই সেটা সেখানে এনে রেখেছিল। আর দেরি না করে কাশ্যপ আর কুক্কুট ছকের দু-পাশে আসন গ্রহণ করল। হ্যাঁ, ঠিক এই ছকের দু-পাশে যেমন ভাবে রয়েছি আমরা..।

মুহূর্তের জন্য থামলেন মার্তণ্ড। মেঘ ডাকছে। মানববাবুর মনে হল তার ঘাড়ে এক বিন্দু জল পড়ল। বৃষ্টি শুরু হল বলে! ছকের দিকে তাকিয়ে মার্তণ্ড আবার শুরু করলেন—

খেলা শুরু হয়ে গেল কড়ি সাজিয়ে। সময় এগোতে লাগল। নির্জন প্রাসাদে এ কক্ষে বসে কড়ি খেলাতে নিমগ্ন হয়ে গেল কাশ্যপ আর কুক্কুট। খেলোয়াড় দুজনেই পাকা। খেলা প্রথমে স্বাভাবিক নিয়মে তার পক্ষতেই ছিল। হাসি ফুটে উঠছিল কুক্কুটের ধূর্ত ঠোঁটে। কিন্তু এর পরই খেলাটা যেন ঘুরতে শুরু করল। কালো কড়ি দিয়ে টপাটপ বেশ কয়েকটা কুক্কুটের সাদা কড়ি খেল কাশ্যপ। তার যেন কেমন মনে হতে লাগল সে নিজে চাল দিচ্ছে না। কালো কড়িগুলোই তাকে দিয়ে চাল দেওয়াচ্ছে! কুক্কুটের সাদা কড়িগুলো শেষ হয়ে যেতে লাগল। রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে যখন শেয়াল ডেকে উঠল ঠিক সেই মুহূর্তে কুক্কুটের শেষ কড়িটা খেয়ে খেলা সাঙ্গ করল কাশ্যপ!

বিস্মিত কুক্কুট বেশ কিছুক্ষণ হতভম্বর মতো চেয়ে রইল কাশ্যপের দিকে। কাশ্যপ ভেবেছিল এরপর এখনই হয়তো কুক্কুট ক্ষিপ্ত হয়ে আক্রমণ করে বসবে তাকে। কিন্তু কুক্কুট সেই মুহূর্তে তেমন কিছু করল না। মুদ্রার থলিটা সে কাশ্যপের দিকে ছুড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সদর দরজা খুলবে চলো। আমি এবার ফিরব।’

কাশ্যপ কুক্কুটকে নিয়ে কক্ষ ত্যাগ করে সদর দরজাতে উপস্থিত হল। দরজা খোলার পর কুক্কুট তার অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করে দ্রুত অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল। কুক্কুট কি তবে পরাজয় স্বীকার করে নিল?

কুক্কুট চলে যাবার পর দোর বন্ধ করে কাশ্যপ দ্রুত ফিরে এল জুয়ার কক্ষে। কড়িগুলো ঘটে পুরে বাইরে বেরিয়ে প্রাসাদের দেওয়ালের গোপন একটা গহ্বরে সেগুলো রেখে আবার জুয়া খেলার কক্ষে ফিরে এল। সুড়ঙ্গের মুখ সরিয়ে সুড়ঙ্গ পথে একটা মশাল হাতে নেমে সে রওনা হল নদীর দিকে।

স্যাঁতস্যাঁতে সুড়ঙ্গ। ক’দিন ধরে প্রবল বর্ষণের ফলে ওপরের জল চুঁইয়ে নামছে ছাদ আর দেওয়ালের গায়ে। ভিজে মাটিতে শ্বেততারার পদচিহ্ন দেখতে পেল সে। সেই পদচিহ্ন অনুসরণ করে কাশ্যপ এক সময় নদীতটে উঠে এল। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে বেশ হতাশ হল কাশ্যপ। বণিক রৈবতকের ময়ূরপঙ্খী সেখানে নেই। তার তো জলে দাঁড়িয়ে থাকার কথা। তবে কি ব্যাপারটা কারো চোখে ধরা পড়ে গিয়েছিল? জায়গাটা মেরামত করে ময়ূরপঙ্খী নদীতে ভেসে পড়েছে?

ব্রাহ্মণ মার্তণ্ডর কথা এ পর্যন্ত শুনে মানববাবুর ছকের দিকে চোখ রেখেই বললেন, ‘কোন ব্যাপারটা ধরা পড়ার কথা বলছেন?’

মার্তণ্ড বললেন, ‘আগের দিন রাতে শ্বেততারা আর বনিক রৈবতকের কথা শুনে কাশ্যপ অনুমান করেছিল যে তাকে ফেলে শ্বেততারা আর রৈবতক চলে যেতে পারে। তাই ময়ূরপঙ্খীতে কাশ্যপ একটা কারসাজি করেছিল। শ্বেততারা আর রৈবতকের সঙ্গে ময়ূরপঙ্খীতে যাবার সময় গোপনে সে সঙ্গে করে নিয়ে গেছিল ধাতু গলাবার সেই ‘ভীষণ অম্ল’। তার কয়েক ফোঁটা সে ঢেলে দিয়ে এসেছিল খোলের মেঝেতে। সে ভেবেছিল খোলের ছিদ্র দিয়ে ধীরে ধীরে জল প্রবেশ করে ভারী হয়ে আটকে যাবে ময়ূরপঙ্খী। ময়ূরপঙ্খী হয়তো ডুববে না কিন্তু জলেও ভাসতে পারবে না।

ময়ূরপঙ্খীটা না দেখতে পেয়ে বেশ হতাশ হল কাশ্যপ। পরবর্তী কর্তব্য স্থির করে নিল সে। প্রাসাদে ফিরে গিয়ে পরিস্থিতি বিচার করে সে প্রাসাদেই রয়ে যাবে অথবা কড়ির ঘট আর মুদ্রার থলি নিয়ে ওই সুড়ঙ্গ পথেই প্রাসাদ ছেড়ে পালাবে। এ কথা ভেবে নিয়ে আবার সে সুড়ঙ্গ পথে প্রবেশ করল। জল জমতে শুরু করেছে সুড়ঙ্গের মেঝেতে। সেই কর্দমাক্ত সুড়ঙ্গ অতিক্রম করে কাশ্যপ আবার এসে উপস্থিত হল শ্বেততারার প্রাসাদে। সুড়ঙ্গের মুখ সরিয়ে জুয়া খেলার কক্ষে উঠে এল কাশ্যপ। কুক্কুটের মুদ্রার থলিটা সেখানেই ছিল। সেটা উঠিয়ে নিয়ে সে যখন বাইরে বেরিয়ে কড়ির ঘটটা আনতে যাচ্ছে ঠিক সেই সময় মড়মড় করে সদর দরজা ভেঙে পড়ার আর অনেক লোকের হিংস্র চিৎকার শুনতে পেল। কুক্কুট তার দলবল নিয়ে হাজির। ব্যাপারটা বোঝামাত্রই কাশ্যপ আবার সেই সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ল। তার মুখটাও সে টেনে দিল। ওপর থেকে ভেসে আসা নানা শব্দ শুনে কাশ্যপ অনুমান করতে পারল কুক্কুটের বাহিনী তছনছ করছে শ্বেততারার প্রাসাদ। এক সময় কুক্কুট তেমন কিছু মূল্যবান জিনিস খুঁজে না পেয়ে শ্বেততারা বা কাশ্যপকে না পেয়ে ছাদের কড়িবরগাতে আগুন ধরিয়ে দিল। কাশ্যপ সুড়ঙ্গ পথে পালাতে উদ্যত হল, কিন্তু তার আর পালানো হল না। কড়িবরগাতে আগুন লাগাতে হুড়মুড় করে ধসে পড়ল শ্বেততারার প্রাসাদ। আর সেই অভিঘাতে সুড়ঙ্গেরও একটা অংশ ধসে পড়ল। ওপর ও নীচে দুটো পথই বন্ধ হয়ে গেল। বাইরে বেরোতে পারল না কাশ্যপ। সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের কথাই সত্যি হল। যুগ যুগ ধরে এখানেই আটকে পড়ে রইল কাশ্যপ। তার আর মুক্তি ঘটল না। ধ্বংস স্তূপের আড়ালে চাপা পড়ে গেল কাশ্যপ আর এই কড়িগুলো।

—একথা বলেই একটা মোক্ষম চালে মানববাবুর শেষ কড়িটা খেয়ে নিয়ে মার্তণ্ড উৎফুল্ল ভাবে বলে উঠল, ‘আছে! আছে! শ্বেততারার কড়ির গুণ হাজার বছর পরও নষ্ট হয়নি। তাই আমি জিতে গেলাম।’

মানববাবু বললেন, ‘এ কড়িগুলো তো ঠিক সে অর্থে শ্বেততারার কড়ি নয়! শ্বেততারা তার কড়িগুলো সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল।’

মার্তণ্ড কড়িগুলো ঘটে ভরতে ভরতে বললেন, ‘না, এগুলোই শ্বেততারার আসল কড়ি। শ্বেততারা তার কড়ি নিয়ে যেতে পারেনি। কুক্কুটের সঙ্গে খেলার আগের দিন রাতে শ্বেততারা আর রৈবতকের কথা শোনার পর কাশ্যপ আর একটা কাণ্ড করেছিল গোপনে। শ্বেততারা তাকে যে কড়িগুলো দিয়েছিল সেগুলো নিয়ে শ্বেততারার কক্ষে প্রবেশ করে শ্বেততারার থলি থেকে আসল কড়িগুলো নিয়ে সেখানে শ্বেততারা দেওয়া কড়িগুলো রেখে এসেছিল। পরদিন কুক্কুটের সঙ্গে শ্বেততারার আসল কড়িগুলো নিয়ে খেলতে বসার কারণেই জয়লাভ করেছিল কাশ্যপ। শ্বেততারা ময়ূরপঙ্খীতে উঠেছিল নকল কড়ি নিয়ে।’

সত্যিই বৃষ্টি পড়তে শুরু করল এবার। তার সঙ্গে মেঘের গর্জন। কড়িগুলো ঘটে ভরে, আর সেই প্রাচীন মুদ্রাটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মার্তণ্ড। উঠে দাঁড়ালেন মানববাবুও। ঘরের মতো আস্তানাটাতে গিয়ে ঢুকতে হবে। নইলে ভিজে যাবেন দুজনেই। মার্তণ্ডকে নিয়ে সেদিকে এগোতে এগোতে মানববাবু বললেন, ‘বেশ লাগল আপনার কথা। শ্বেততারার শেষ পর্যন্ত কি হয়েছিল? সে কি বণিক রৈবতকের সঙ্গে ঘর বেঁধেছিল?’

মার্তণ্ড বলল, ‘না, সে বা বণিক কেউ আর কোথাও ফিরতে পারেনি। সেই ‘ভীষণ অম্ল’ ছিদ্র করেছিল নাওয়ের তলদেশে। যে-কোনও কারণেই হোক তার ভিতর দিয়ে প্রথম অবস্থাতে তেমন জল প্রবেশ করেনি খোলে। কিন্তু ময়ূরপঙ্খী স্রোতে ভেসে পড়তেই হু-হু করে জল প্রবেশ করে খোলে। তারপর জলের চাপে খোল ফেটে যায়। প্রবল বর্ষণের মধ্যে কর্ণসুবর্ণর সীমানা অতিক্রম করার আগেই শ্বেততারা আর রৈবতককে নিয়ে সলিল সমাধি ঘটে ময়ূরপঙ্খীর।’

মানববাবু বললেন, ‘বেশ লাগল আপনার কাহিনি। কিন্তু কোথা থেকে এ কাহিনি পাঠ করেছেন বলুন তো? উৎসটা জানতে পারলে ভবিষ্যতে আমার কাজের সুবিধা হতে পারে।’

প্রশ্নটা শুনে মার্তণ্ড দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, ‘পড়ব বা শুনব কেন? এ তো আমারই জীবন কাহিনি।’

এই অদ্ভুত কথা শুনে মানববাবুও অবাক হয়ে বললেন, ‘এ কথার মানে?’

আধো অন্ধকারে মার্তণ্ডর ঠোঁটের কোণে যেন একটা হাসি ফুটে উঠল। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, এ আমারই জীবন কথা। এ কাহিনির কিছুই মিথ্যা নয়। আমার পুরো নাম মার্তণ্ড কাশ্যপ। আমার গোত্র হল কাশ্যপ। সে যুগে ব্রাহ্মণদের কর্ণসুবর্ণতে গোত্র ধরে সম্বোধন করা হত। সে জন্যই আমিও আমার কথাতে ”কাশ্যপ” শব্দটাই নাম হিসাবে ব্যবহার করেছিলাম।’

কথাটা শুনে মানববাবু বললেন, ‘কী যা তা বলছেন! আপনার তামাক কাঠিতে কোনও মাদক মেশানো ছিল নাকি? চলুন তাড়াতাড়ি ঘরের ভিতর যাই। ভিজে যাচ্ছি।’

মার্তণ্ড এ কথার কোনও জবাব দিলেন না। হঠাৎই পিছন ফিরে চারপাশে তাকাতে তাকাতে বললেন, ‘সে আসছে! শ্বেততারা আবার হাজার বছর পর তার কড়ি ফেরত নিতে আসছে! আমি তার পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি।’

মানববাবু অজান্তেই বলে ফেললেন, ‘আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন?’

কিন্তু ঠিক সেই সময় মার্তণ্ড আঙুল তুলে বলে উঠলেন, ‘ওই তো ওই যে শ্বেততারা আসছে।’

মার্তণ্ড যে দিকে আঙুল তুলে দেখালেন সেদিকে তাকিয়ে মানববাবু বিস্মিত হয়ে গেলেন। সত্যিই ধ্বংসস্তূপের আড়াল থেকে প্রবল বর্ষণের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করছে এক ছায়ামূর্তি—নারীমূর্তি!

মানববাবু তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। সেই নারী মূর্তি এসে দাঁড়াল কড়ির ছকটা যেখানে আঁকা আছে, মানববাবু এতক্ষণ মার্তণ্ডর সঙ্গে যেখানে বসে খেলছিলেন ঠিক সেই স্থানে। মার্তণ্ড তাকে দেখে বলে উঠলেন, ‘তুমি এসেছ শ্বেততারা! আমি কত জন্ম ধরে তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছি। আমি জানতাম কর্ণসুবর্ণর এই কড়ি তোমাকে আবার এখানে ফিরিয়ে আনবে।’—এই বলে কড়ির ঘটটা নিয়ে মার্তণ্ড কাশ্যপ এগোতে লাগলেন তার দিকে। আর সেই নারী মূর্তি তার একটা হাত প্রসারিত করল সামনের দিকে, হয়তো বা কড়ির ঘটটা ফিরিয়ে নেবার জন্যই। আর ঠিক সেই মুহূর্তে পরপর বিদ্যুৎচমকে আকাশ ফালা ফালা হয়ে বাজের প্রচণ্ড গর্জনে কেঁপে উঠলে লাগল চার দিক। উপর্যুপরি বিদ্যুৎচমকে মানববাবু স্পষ্ট দেখতে পেলেন সেই অতি সুন্দর যৌবনবতী নারীকে। মাথার চুল তার চুড়ো করে বাঁধা, গলায় সাতনরি হার, বাহুতে বাজুবন্ধ, পায়ে মল। বক্ষ থেকে হাঁটু পর্যন্ত জড়ানো শুভ্র বস্ত্র। ঠিক যেন সুদূর অতীত থেকে আসা কোনও অপ্সরা। তার সিক্ত বক্ষের ভিতর থেকে প্রস্ফুটিত হয়ে আছে সুডৌল স্তন, নাভিকুন্দ। কদলী কাণ্ডের মতো মসৃণ উরু বেয়ে নামছে বৃষ্টির বারি। যৌনতার প্রতিমূর্তি এক নারী!

মার্তণ্ড গিয়ে দাঁড়াল সেই সুন্দরীর সামনে। মুর্হুমুর্হু কান ফাটানো বাজের গর্জন চারপাশে! এই আলোকিত হয়ে উঠছে চারদিক, পরমুহূর্তেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকার নেমে আসছে। তারই মাঝে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে মূর্তি দুটো। যেন এই মিলনের জন্যই তারা হাজার হাজার বছর ধরে প্রতীক্ষায় ছিল।

প্রবল বর্ষণ আর বিদ্যুৎচমকের মধ্যে শেষ পর্যন্ত পরস্পরকে আলিঙ্গন করল মূর্তি দুটো। কয়েক মুহূর্ত সে ভাবেই দাঁড়িয়ে রইল তারা। যেন প্রস্তরীভূত যুগল মূর্তি। জল নামছে তাদের শরীর বেয়ে। কিন্তু এরপরই হঠাৎ মার্তণ্ড যেন চিৎকার করে বললেন, ‘ওই দ্যাখো মনে হয় কুক্কুট তার সঙ্গীদের নিয়ে আমাদের ধরতে আসছে। শ্বেততারা আমাদের পালাতে হবে!’

মানববাবু এবার খেয়াল করলেন ব্যাপারটা! অন্ধকার মাঠ পেরিয়ে বিন্দু বিন্দু আলো সত্যিই যেন ধেয়ে আসছে শ্বেততারার প্রাসাদের দিকে! হতভম্ব হয়ে গেলেন মানববাবু! সত্যিই কি তবে বহু শতাব্দী ঘুমিয়ে থাকার পর জেগে উঠেছে আঁধারে ঘেরা এই কর্ণসুবর্ণ। সত্যি কি ওই আলোকবিন্দুগুলো রাজা শ্যেনের বাহিনী? ধরতে আসছে মার্তণ্ড আর শ্বেততারাকে? ক্রমশ এগিয়ে আসছে আলোকবিন্দুগুলো! প্রবল এক আতঙ্ক যেন পেয়ে বসল মানববাবুকে।

আর এরপরই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। আকাশ থেকে একটা নীল আলোক শিখা নেমে এল সেই যুগল মূর্তির ওপর। তাদেরকে আবৃত করে সেই আলোকস্তম্ভ পাক খেতে শুরু করল। সেই আলোক স্তম্ভর মধ্যে হারিয়ে গেলেন মার্তণ্ড আর শ্বেততারা। আর তার পরই সেই আলোক স্তম্ভ যেন তাদের দুজনকে নিয়ে হারিয়ে গেল মাটির গভীরে। বাজের প্রচণ্ড গর্জনে থরথর করে কেঁপে উঠল মানববাবুর পায়ের তলার মাটি, চারপাশে ছড়িয়ে থাকা প্রাচীন ধ্বংসস্তূপ! কিন্তু আলোক বিন্দুগুলো তখনও এগিয়ে আসছে। অতীতের অন্ধকার থেকে উঠে আসা ওই হিংস্র বাহিনী কি মার্তণ্ড আর শ্বেততারাকে না পেয়ে ছেড়ে দেবে মানববাবুকে? আতঙ্কিত মানববাবু প্রবল বৃষ্টির মধ্যে হোঁচট খেতে খেতে ছুটলেন দেওয়াল ঘেরা মাথায় ত্রিপলের ছাউনি দেওয়া ঘরের মতো তার থাকার জায়গাটাতে। মানববাবু অবশেষে ঢুকে পড়লেন সেখানে। তেলের বাতিটা তখনও জ্বলছে। আলোটা যেন মৃদু ভরসা দিল মানববাবুকে। কিন্তু বাইরে থেকে অস্পষ্ট কোলাহল ভেসে এল মানববাবুর কানে। এসে পড়েছে তারা!

১২

লোকগুলো এসে পড়ল মানববাবুর ঘরের সামনে। জনা পনেরো লোক। বাইকে একটু থমকে দাঁড়াবার পর দু-তিনজন প্রবেশ করল মানববাবুর ঘরে। মানববাবু ক্যাম্প খাটে বসে। তার মুখমণ্ডলে আতঙ্কের ছাপ লক্ষ করে একজন বলল, ‘ভয় পাবেন না স্যার। আমরা একজনকে খুঁজতে এসেছি।’

মানববাবু কথাটা শুনে ভালো করে তাকালেন লোকগুলোর দিকে। না তারা কেউ সেই প্রাচীন কর্ণসুবর্ণর অন্ধকার জগতের বাসিন্দা নয়, স্থানীয় গ্রামবাসী। যে লোকটা কথা বলল তাকেও চিনতে পারলেন মানববাবু। লোকটাকে একবার তিনি এখানে মাটি খোঁড়ার কাজ দিয়েছিলেন। লোকগুলোর হাতে টর্চ আছে। তবে এই টর্চের আলোগুলোকেই এগিয়ে আসতে দেখেছিলেন তিনি। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মৃদু ধাতস্থ হয়ে তিনি জানতে চাইলেন, ‘কাকে খুঁজতে এসেছ তোমরা?’

লোকটা জবাব দিল, ‘মাঝবয়সি একজন লোক স্যার। মাথায় টিকি, গলাতে পৈতে আছে। আমাদের গ্রামের স্কুলের সংস্কৃত পণ্ডিতমশাই। নাম মধুসূদন বিদ্যাবিনোদ।’

কথাটা শুনে মানববাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, এমন একজন এসেছিলেন বটে, কিন্তু তিনি তো তার নাম বললেন, ‘মার্তণ্ড—মার্তণ্ড কাশ্যপ।’

মানববাবুর কথা শুনে একজন গ্রামবাসী বলল, ‘এখানে এসেছিলেন! আমরা তবে ঠিকই অনুমান করেছিলাম। পণ্ডিতমশাইয়ের মাথাটা একদম গেছে। হ্যাঁ, এখন তিনি ওই নামেই নিজের পরিচয় দেন—মার্তণ্ড কাশ্যপ।’

মানববাবু জানতে চাইলেন, ‘ভদ্রলোক কি অসুস্থ?’

লোকটা বলল, ‘অসুস্থ মানে মাথার গন্ডগোল। ওনার সম্ভবত আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। বছর পাঁচেক আগে এসে কাজ নিয়েছিলেন গ্রামের স্কুলে। নিরীহ লোক। বিকাল বেলা বেড়াতে বেড়াতে মাঝে মাঝে চলে আসতেন এখানে। কিন্তু একদিন হঠাৎই কেন জানি মাথাটা বিগড়ে গেল তার। তিনি বলতে লাগলেন তার নাম নাকি মার্তণ্ড কাশ্যপ! তিনি নাকি হাজার বছর আগে কর্ণসুবর্ণতে এসেছিলেন, এখানে নাকি একটা প্রাসাদ ছিল যেখানে তিনি থাকতেন এসব নানা কথা। মাঝে-মাঝেই তিনি চলে আসতেন এখানে আর কিছুতেই বাড়ি ফিরতে চাইতেন না। ডাক্তার দেখিয়েও ওনার মাথা ঠিক হল না। পাগলামী বেশি বাড়লে ওকে আমরা ঘরে আটকে রাখি কোনও বিপদ হবে বলে। ক’দিন ধরেই ওর মাথাটা আবারও বড্ড বেশি খারাপ যাচ্ছে। আজ সকাল থেকেই পণ্ডিত মশাই চিৎকার করছিলেন, ”কড়ি পাওয়া গেছে! কড়ি পাওয়া গেছে! আমাকে প্রাসাদে যেতে হবে” বলে। তাই তাকে ঘরে আটকে রেখেছিলাম। কিন্তু সন্ধ্যা নামার পর কীভাবে যেন বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিলেন দরজা খুলে। ওর কেউ নেই। নিরীহ ভদ্র মানুষ। গ্রামের সবাই পণ্ডিত মশাইকে ভালোবাসে। তাই এই বর্ষা মাথায় নিয়েও তাকে খুঁজতে বেরিয়েছি।’

মানববাবু লোকটার কথা শুনে বেশ আশ্চর্য হয়ে গেলেন। একটানা কথাগুলো বলে লোকটা জানতে চাইল, ‘পণ্ডিত মশাই এখন কোথায় জানেন?’

মানববাবুর একটু চুপ করে থেকে জবাব দিলেন, ‘একটু আগে পর্যন্ত তিনি বাইরে আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন, তারপর হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেলেন তা বুঝতে পারলাম না।’ মানববাবু বুঝে উঠতে পারলেন না তিনি যা দেখেছেন তা লোকগুলোকে বলা ঠিক হবে কিনা। হয়তো যে দৃশ্য তিনি দেখেছেন পুরোটাই তার কল্পনা। গ্রামের লোকদের কথাগুলো বললে তাকেও তারা পাগল ভাবতে পারে! হয়তো তাকে গল্প শুনিয়ে কড়ির ঘট নিয়ে কোথাও উধাও গেছেন খ্যাপাটে লোকটা।

মানববাবুর কথা শুনে একজন লোক তার সঙ্গীদের উদ্দেশে বলল, ‘চল তবে খুঁজি তাকে। আশেপাশেই কোথাও তিনি আছেন মনে হয়।’

তার কথায় অপর একজন বলল, ‘চল বাইরে গিয়ে দাঁড়াই। তবে যা বৃষ্টি হচ্ছে আর বাজ পড়ছে তাতে ভোরের আলো না ফুটলে এই সাপখোপের আড্ডায় আর তাকে খোঁজা যাবে না। পণ্ডিত মশাইয়ের কোনও বিপদ না হলেই বাঁচি।’

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষাতে রইল লোকগুলো। মানববাবু চুপ করে বসে রইলেন। তার মাথার ভিতর কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। তিনি যা দেখেছেন তা যদি চোখের ভুলও হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু তিনি যে কড়ি খুঁজে পেয়েছেন তা মধুসূদন বিদ্যাবিনোদ জানলেন কীভাবে?

রাত কেটে গেল। পাখির ডাকে ভোরের আলো ফুটল এক সময়। আলো ফোটার বেশ কিছু সময় পর বাইরে বেরিয়ে এলেন মানববাবু। সকালের আলো তখন ছড়িয়ে পড়েছে কর্ণসুবর্ণর প্রাচীন ধ্বংসস্তূপের ওপর। লোকগুলো তার আনাচেকানাচে খোঁজা শুরু করেছে তাদের পণ্ডিতমশাইকে। মানববাবু ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়ালেন ঠিক সেই জায়গাতে, যেখানে ছকটা আঁকা আছে। বৃষ্টিতে ধুয়ে সকালের সূর্যকিরণে ছকটা আরও বেশি স্পষ্ট। মানববাবু দেখলেন ছকটার গায়েই মাটির ওপর লম্বাটে একটা পোড়া দাগ। মেঝের ওপর বাজি পোড়ালে যেমন দাগ হয় তেমন একটা দাগ, আর মাটিও অনেকটা ফেটে গেছে। গত রাতে এখানে সত্যিই বাজ পড়েছিল। আকাশ থেকে নেমে আসা ওই নীল আলোক শিখা তবে মিথ্যা ছিল না!

আর এরপরই মানববাবু আরও একটা জিনিস খেয়াল করলেন—সম্ভবত বাজের প্রচণ্ড অভিঘাতেই মাটিতে আঁকা ছকটা চারদিকে বেশ কিছুটা জায়গা নিয়ে যেন একটু ওপর দিকে উঠে এসেছে! ব্যাপারটা দেখেই মানববাবু কয়েকজন লোককে ডাকলেন। তিনি যা অনুমান করেছিলেন তা সত্যি। পোড়া মাটির তৈরি বেশ বড় একটা টালি বসানো ছিল মাটিতে। যার ঠিক মাঝখানে আঁকা আছে কড়ির জুয়ার ছকটা। ধরাধরি করে সেই টালিটা সরাতেই হাজার বছর পর সূর্যালোক প্রবেশ করল সেই প্রাচীন সুড়ঙ্গে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েকজন লোক নিয়ে মানববাবু প্রবেশ করলেন সেই সুড়ঙ্গে। দেখেই বোঝা যায় বেশ লম্বা সুড়ঙ্গ ছিল সেটা। কিন্তু কিছুটা এগিয়েই মাটি ধসে বন্ধ হয়ে গেছে সুড়ঙ্গ। ভাগীরথী নদী এখন এ জায়গা থেকে অনেকটা দূরে সরে গেলেও এই বন্ধ সুড়ঙ্গের মুখের দিকেই ভাগীরথীর অবস্থান। মানববাবুদের পায়ের নিচের কাদামাটি হাজার বছর পর আজ পাথরের রূপ নিয়েছে। মাথার ওপর থেকে বজ্রপাতের ফলে ফাটল বেয়ে আলো ঢুকছে ভিতরে।

মানববাবু দেখতে পেলেন কিছুটা তফাতে সুড়ঙ্গের মধ্যে পড়ে আছে পণ্ডিতমশাইয়ের দেহ! তিনি এখানে ঢুকলেন কীভাবে? লোকজন সমেত মানববাবু গিয়ে দাঁড়ালেন সেই মরদেহের সামনে। না সে দেহে বাজ পড়ে পুড়ে যাবার কোনও চিহ্ন নেই। মানববাবুর দিকেই যেন চোখ খুলে তাকিয়ে আছেন মধুসূদন বিদ্যাবিনোদ নামের কোনও গ্রাম্য সংস্কৃত শিক্ষক অথবা কোনও এক জন্মের শ্বেততারার জুয়ার আড্ডার ব্রাহ্মণ মার্তণ্ড কাশ্যপ। ঠোঁটের কোণে তার যেন একটা আবছা হাসি লেগে আছে। পরিতৃপ্তি অথবা কৌতুকের হাসি। কড়ির ঘটটা সেখানে না থাকলেও দেহটার চারপাশে ছড়িয়ে আছে অনেক রৌপ্যমুদ্রা। কুক্কুটের দেওয়া সেই একশ রৌপ্যমুদ্রা? আর এরপর আরও একটা জিনিস চোখে পড়ল মানববাবুর। ছাদের ফাটল বেয়ে একটা আলোকরেখা লম্বালম্বি ভাবে সুড়ঙ্গের মেঝেতে এসে পড়েছে। সেই আলোতে মানববাবু দেখতে পেলেন সেখানে মেঝের ওপর জেগে আছে ছোট আকৃতির প্রস্তরীভূত পায়ের ছাপ। সে ছাপগুলো এগিয়েছে সুড়ঙ্গ যেদিকে ধসে পড়েছে সেদিকে। শ্বেততারার পায়ের ছাপ? হাজার বছর পর তার কড়ির টানে ফিরে এসে কাশ্যপকে তৃপ্ত করে শ্বেততারা হয়তো আবার তার কড়ি নিয়ে এ পথেই ফিরে গেছে মাটির গভীরে সেই প্রাচীন কর্ণসুবর্ণতে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *