করিন্থিয়ান থিয়েটারে দুর্ঘটনা
নিজস্ব সংবাদদাতা: আপনারা সকলেই অবগত আছেন যে বিশ্ব প্রসিদ্ধ জাদুকর রবার্ট কার্টার বেশ কিছুকাল হইল কলিকাতায় তাঁহার অদ্ভুত জাদুবিদ্যা প্রদর্শন করিতে আসিয়াছিলেন। গত শনিবার, ১৭ ডিসেম্বর তারিখ করিন্থিয়ান থিয়েটারে এই শোয়ের অন্তিম দিনে দুইটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটিয়া গিয়াছে। ওইদিন জাদু প্রদর্শনকালে ‘ভারতীয় দড়ির জাদু’ দেখাইবার সময় জাদুকরের সামান্য ভুলে তাঁহার সহযোগী জাদুকর চিন-সু-লিনের মৃত্যু ঘটে। জাদুকর কার্টার এই শোক সহিতে না পারিয়া এবং এই দুর্ঘটনার জন্য নিজেকে দায়ী মনে করিয়া খানিক বাদেই নিজ মস্তকে পিস্তলের গুলি ক্ষেপণ করিয়া আত্মহত্যা করেন। বড়োলাট ল্যান্সডাউন এই জাদুর অনুষ্ঠানে স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। তিনি জানাইয়াছেন ঘটনাটি দুঃখজনক এবং ইহার সম্পূর্ণরূপে তদন্ত হইবে যাহাতে এইপ্রকার মৃত্যু আর না ঘটে। করিন্থিয়ান থিয়েটার পরবর্তী ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকিবে।
খবর দেখে কেমন দমে গেল তারিণী। কেউ যেন প্রবল প্রচেষ্টা চালাচ্ছে গোটা ব্যাপারটা ধামাচাপা দেবার। কিন্তু কে আর কেন? ভাবতে ভাবতে গণপতির ঘরের সামনে পৌঁছে গেল তারিণী। ঘর বলতে ম্যাজিক সার্কেলের অফিসেরই একটা ছোট্ট অংশ। তাতেই কোনওমতে মাথা গুঁজে থাকে গণপতি। দরজায় ঘা দিতে ভিতর থেকে কোনও আওয়াজ এল না। জোরে জোরে কড়া নাড়ল তারিণী। এবার জড়ানো গলায় উত্তর এল, “কে? কে এসেছিস?”
গণপতি নেশা করে আছে। গলার আওয়াজেই বুঝল তারিণী। গণপতির সব ভালো, এই মদের নেশাটা ছাড়া। অল্প বয়েসে বিবাগি হয়ে যাওয়া থেকে সুরা তার সঙ্গী। কোনও দিন নেশা করে মাতলামো করে না, কিন্তু নেশা করতে পারে অঢেল। তারিণী বহুবার বলেও কিছু করতে পারেনি। শুধু বলে, “এই কারণবারি সাক্ষাৎ মা কালীর প্রসাদ হে। এঁকে তুশ্চু করতে আছে? তুমিও নাও”, বলে তারিণীর হাতেও গেলাস ধরিয়ে দেয়। তারিণীর প্রবৃত্তি হয় না। “না হে, গোয়েন্দাদের এসব খেলে চলে না। বুদ্ধিতে মরচে পড়ে যায়”, বলে কাটিয়ে দিয়েছে কতবার।
আজকে সকাল সকাল গণপতি নেশা করেছে? না কালকের নেশার খোঁয়ারি কাটেনি এখনও?
“আমি তারিণী। দরজা খোলো”, বলার খানিক বাদেই গণপতি দরজা খুলল। তাকে দেখে চমকে গেল তারিণী। চোখ জবাফুলের মতো লাল। মুখ থেকে ভকভক করে দেশি মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। খালি গা। একটা ময়লা ধুতি কোনওক্রমে জড়ানো কোমরে।
“এ কী অবস্থা তোমার?” বলে ভিতরে ঢুকে তারিণীর চোখ কপালে উঠে গেল। মেঝেতে সারি সারি মদের বোতল সাজানো একের পর এক। প্রায় সবকটাই খালি। পাশে খাটের ওপর একতাড়া সাদা কাগজ আর তাতে কী সব আঁকিবুঁকি কাটা। পাশে একটা মোমবাতি জ্বলে জ্বলে প্রায় নিভে গেছে।
“গত দুইরাত ঘুমোইনি ভায়া।”
“কেন? কী হয়েছে?”
“কার্টারের জাদু আমায় ঘুমোতে দিচ্ছে না। যে জাদু আমার গুরু অবধি অসম্ভব বলেছেন, সেটা কার্টার দেখাল কীভাবে? সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে অবধি শান্তি পাচ্ছি না। চেষ্টা করছি ম্যাজিকটাকে ধরার। দিনরাত খাতায় নকশা বানাচ্ছি। কিন্তু ধরতে পারছি না। হাতে এসেও যে সুড়ুৎ করে পালিয়ে যাচ্ছে।”
“এতে কোনও তন্ত্র মন্ত্র নেই বলছ?”
“বিন্দুমাত্র না। কার্টার সবাইকে ফাঁকি দিতে পারবে। আমাকে না। সেদিন যে মন্ত্র পড়েছিল সেই রাখহরি, তার সঙ্গে ম্যাজিকের কোনও সম্পর্ক নেই। ও লোক ভোলানো মন্ত্র।”
“ভালো কথা, রাখহরি নিয়ে তোমায় একটা কথা জানাই”, বলে গতকালের গোটা ঘটনাটা বলল তারিণী। সে জানে যতই মদ খাক, গণপতি মাতাল হয় না, তার মাথা পরিষ্কার থাকে।
সব শুনে গম্ভীর হয়ে গেল গণপতি। “তুমি নিশ্চিত? ওটা রাখহরিই?”
“আমি মুখ দেখলে ভুলি না গণপতি। রাতারাতি দাড়িগোঁফ কামিয়েছে, কিংবা সেদিনেরটা নকলও হতে পারে। প্রথমে কিছুটা সন্দেহ হচ্ছিল, পরে হাঁটা দেখে নিশ্চিত হলাম ওটা রাখহরি।”
“তুমি আগে রাখহরিকে হাঁটতে দেখলে কখন?”
“কেন মঞ্চে! ও যখন সেই পর্দাঢাকা ঘরে ঢুকল। হাঁটার সময় রাখহরির ডান হাতটা স্থির থাকে, বাঁ হাতটা ক্রমাগত সামনে পিছনে দুলতে থাকে।”
“ঠিক বলেছ। কার্টারের দড়িতে কিছু সমস্যা ছিল। যখন আবার নিয়ে ফিরল, তখন আমিও দেখলাম। ডান হাত স্থির। বাঁ হাত দুলে যাচ্ছে।”
“হ্যাঁ, কিন্তু দড়ি নিয়ে যাবার সময় হাত দোলেনি কেন?” তারিণীর মাথায় চিন্তার ছাপ।
“মানে? কী বলতে চাইছ তুমি?”
“এখন আমার মনে পড়ছে। স্পষ্ট মনে পড়ছে। মন্তর পড়া হল। কার্টার দড়ি ছুড়তে গেলেন। দড়িতে কিছু সমস্যা হল। কার্টার সেই কাপড়ের ঘরে মুখ বাড়িয়ে রাখহরিকে ডাকলেন। রাখহরি ডান হাতে দড়ির বান্ডিল দিয়ে পিছন ফিরে ভিতরে ঢুকে গেল… না হে গণপতি। তখন তার বাঁ হাত কেন, কোনও হাতই দুলছিল না।”
“তুমি নিশ্চিত?”
“নিশ্চিত। মজার ব্যাপার, ও যখন দড়ি হাতে ফিরে এল তখন ওর বাঁ হাত আবার দুলছিল।”
“কী বলতে চাও তুমি?”
“একটাই সিদ্ধান্তে আসা যায় এ থেকে। যে গেছিল সে রাখহরি না, যে ফিরেছে সে রাখহরি। এখন আমার পরিষ্কার মনে পড়ছে দুজনের হাঁটার ধরন একেবারে আলাদা।”
“তাহলে বেরোল কে?”
“একটু ভেবে দ্যাখো গণপতি। চিন-সু-লিন আর রাখহরির মধ্যে তফাত কোথায়? দুজনেই ছিপছিপে, দুজনেই খাটো, দুজনেই চটপটে…”
“পোশাক পরিবর্তন”, চেঁচিয়ে উঠল গণপতি। “আমি কী গাধা! আমার নিজের ম্যাজিক আমি নিজে চিনতে পারলাম না। মঞ্চের মধ্যে পর্দাঢাকা ঘরে ঢুকে চিন-সু-লিন দ্রুত রাখহরির পোশাক পরে নেয়। গালে দাড়ি গোঁফ সহ, যাতে তাকে কেউ চিনতে না পারে। সে জানত মঞ্চের আলোতে পিছন ফিরে যাওয়া চিন-সু-লিনকে সবাই রাখহরিই ভাববে। আরও বড়ো কথা, এই দড়ির পালটানোটা যে ম্যাজিকের আসল ভাঁওতা, সেটা কেউ ভাবতেই পারবে না।”
“ঠিক তাই। এবার দড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল চিন-সু-লিন। ফেরত নিয়ে এল রাখহরি।”
“কিন্তু রাখহরি ভিতর থেকে বেরোল কোন পথে?”
“সেটা তো তুমি আমায় বলবে ভাই। শুধু আমি একটা জিনিস জানি, যে পথে তৈমুর মঞ্চে ঢুকেছে, সেই পথেই রাখহরি বেরিয়েছে।”
গণপতির চোখ গোল গোল হয়ে উঠল। এক লাফে খাটের ওপর উঠে হিজিবিজি কাটা কাগজগুলো নিয়ে এল। উত্তেজনায় তার গলার স্বর কাঁপছে, “আর… আর তুমি কী দেখেছ বলো তো ভাই?”
“ও হ্যাঁ। আর-একটা ঘটনা। সেই কাপড়ের পর্দা প্রথম যখন খসে পড়ল, তখন ধোঁয়ার মধ্যেই দেখলাম তৈমুরের পুতুল মঞ্চের মাঝে বসানো। কিন্তু যদি তাই হয়, চিন-সু-লিনের দেহ ছাদ ভেঙে ঠিক মাঝখানেই এসে পড়ল। পুতুল তখন অনেকটা পিছনে প্রায় পর্দার কাছে। অনেক ভেবেও বুঝিনি পুতুলটা অতটা সরে গেল কীভাবে?” বলতে বলতে আঁতকে উঠল তারিণী। গণপতি এতক্ষণ ভুরু কুঁচকে শুনছিল, আচমকা সে তার দুই শক্ত হাতে তারিণীকে জাপটে ধরেছে। তার মুখ দিয়ে বাংলা মদের গন্ধ আসছে ভকভক করে। তারিণীর গালে চকাস করে একটা চুমু খেয়ে গণপতি বললে, “হয়ে গেছে… হয়ে গেছে… কার্টারের জাদুর রহস্য সমাধান হয়ে গেছে”…
। তিন।
“সেদিন আমি যতক্ষণ মঞ্চে ছিলাম, খুব মন দিয়ে মঞ্চটা খেয়াল করেছি”, গণপতি বললে। “তোমার মনে থাকবে হয়তো, মঞ্চে ওঠার সময় আমি সামান্য হোঁচট খেয়েছিলাম।”
“হ্যাঁ। অনেকে হেসেও উঠেছিল। আমি তো ভাবলাম তুমি ঘাবড়ে গেছ।”
“ঘাবড়ে যাইনি। আসল স্টেজ আর নকল স্টেজের মাঝে বুটজুতো ঢুকে গেছিল।”
“নকল স্টেজ?”
“করিন্থিয়ান থিয়েটারের স্টেজ কাঠের তৈরি। মজবুত কাঠের। কিন্তু কাল স্টেজে উঠে আমি পরিষ্কার বুঝেছি এই স্টেজ সদ্য বানানো। তাও হালকা নরম কাঠের। ঠিক যে কাঠ দিয়ে ওপরের ছাউনি বানানো হয়েছিল। আর…”
“বুঝেছি, যা ভেঙে পড়ে চিন-সু-লিন মারা যায়।”
“ঠিক তাই।”
“কিন্তু আসল মঞ্চের ওপর আবার একটা স্টেজ বানাতে হল কেন?”
“ম্যাজিকে ততটাই দর্শক দেখেন, যতটা তাঁকে ম্যাজিশিয়ান দেখাতে চান। গোটা ম্যাজিকে সব বেরোনো বা ঢোকা হয়েছে পাশের উইংস দিয়ে। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে হবে মঞ্চে ঢোকার রাস্তা শুধু দুই পাশেই আছে। ঠিক এখানেই কার্টার বাজিটা মেরেছেন। আসল মঞ্চের ওপরে আরও একটা নকল মঞ্চ তৈরি করেছেন কাঠ দিয়ে, যার একটা অংশ খোলা বা বন্ধ করা যায়। মঞ্চের নিচ থেকে কোনও জিনিস ওপরে ওঠানো অথবা নিচে নামানো যাবে সেই দরজা দিয়েই। তাই ম্যাজিকের মঞ্চের সেই লাল পর্দার ঘরের পর্দা খসে পড়লে যখন তৈমুরকে দেখা গেল, তখন সবাই অবাক হলেও আমি হইনি। কারণ বুঝেছিলাম নিচে কোনও গোপন দরজা দিয়ে পুতুলটাকে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে একটা ঘটনার হিসেব কিছুতেই মিলছিল না। তৈমুরের ম্যাজিক তো প্রথমেই হয়ে গেছে। আবার একই ম্যাজিক, একই প্রপস মঞ্চে আনার কারণ কী? কোনও ভালো জাদুকর এক মঞ্চে এক ম্যাজিক দুবার দেখায় না। কিন্তু ভেবে দ্যাখো সেদিন কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা তৈমুরকে দুবার দেখেছি, যেখানে দ্বিতীয়বার না দেখা গেলেও চলত।”
“হ্যাঁ, রোপ ট্রিকে তো তৈমুরের কোনও ভূমিকাই নেই! তাও সে ছিল কেন?”
“ঠিক এই প্রশ্নটাই গত দুদিন ধরে নিজেকে করছি ভাই। উত্তর পাচ্ছিলাম না। তুমি এসে আমার চোখ খুলে দিলে।”
“কিছুই বুঝতে পারছি না। শুরু থেকে বলো।”
“রোপ ট্রিকের ঠিক আগে মঞ্চে যে লাল পর্দার ঘরটা বানানো হয়েছিল, সেটার নিচেই ছিল গোপন দরজাটা। কার্টার প্রথমে বুকনি শুরু করে। তারপর রাখহরি আর চিন-সু-লিন, যারা অনেকটা চেহারাগতভাবে এক, ভিতরে ঢুকে যায়। কার্টার এবার দড়ি পালটানোর নামে রাখহরিকে ডাকে। কিন্তু ভিতরে ততক্ষণে পোশাক বদলে বেরিয়ে এসেছে চিন-সু-লিন। সে দড়ি নিয়ে উইংসের ভিতরে চলে যায়। ঠিক একই সময় নিচ থেকে তৈমুরের পুতুল তুলে দেওয়া হয়, আর সেই পথেই নিচে নেমে যায় রাখহরি। এটা আমি বুঝতে পারিনি, তোমার কথায় মাথায় এল।”
“মানে সেসময় মঞ্চে মাত্র দুইজন? কার্টার আর তৈমুর?”
“না না, আর-একজন ছিলেন। পুলিশের ইনস্পেক্টর জেনারেল, যাঁকে শুরুতেই কার্টার বেশ দূরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে তিনি এই বদলটা না বুঝতে পারেন। যাই হোক, রাখহরি সোজা দৌড়ে চলে এল ডানদিকের উইংসে। চিন-সু-লিন ওখানেই দড়িটা রেখে গেছিল। সেটা নিয়েই রাখহরি মঞ্চে এল, কার্টারকে দড়ি ছুড়ে দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে গেল। ভেবে দ্যাখো তারিণী, কী দারুণ প্ল্যান। এবার চিন-সু-লিন পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবে, আর ঘুরে এসে সদর দরজা খুলে ঢুকবে। সবাই ভাববে সে ভ্যানিশ হয়ে আবার দেহ ধারণ করেছে। একেবারে নিখুঁত। এমনকি পুলিশের বড়কর্তা হাতের ছাপ পরীক্ষা করেও কিছু করতে পারবেন না, কারণ মানুষ তো বদলাচ্ছে না।”
“তাহলে দড়ি সোজা দাঁড়াল কীভাবে? বেয়ে ওপরে উঠল কে? রাখহরি?”
“দড়ি বেয়ে কেউ ওঠেনি তো!”
“মানে? কী বলতে চাও?
“তোমাকে একটা গল্প বলি। সেটা শোনো আগে। আমার গুরুদেবের থেকে শোনা। একবার এক কারাগারে একজন অপরাধীকে বেঁধে রাখা হয়। জানালার ছিদ্র এত ছোটো যে তা দিয়ে গলে বেরোনো অসম্ভব। অপরাধী জানতেন তাঁর সঙ্গীরা নিচেই আছে। বিছানার চাদর ছিঁড়ে, পাকিয়ে তিনি দড়িও বানালেন। কিন্তু সে দড়ি নিচ অবধি বয়ে নিয়ে যাবে কে? একটা পুরুষ্টু দেখে গুবরে পোকা ধরে সেটাকে সরু সুতো দিয়ে বাঁধলেন। সরু সুতোর শেষে ছিল তাঁর দড়ি। পোকার মাথার কাছে একটু খাবার লাগিয়ে দিলেন। পোকা গন্ধে ভাবল খাবার সামনেই আছে। এই ভেবে গুড়গুড় করে দড়ি বয়ে নিয়ে সে কারাগারের নিচে চলে এল। কার্টার সেই কায়দাটাই করেছেন।”
“কিচ্ছু বুঝলাম না…”
“কার্টার একটা ধাপ্পা দিয়েছেন। মঞ্চের ওপরে আড়াআড়ি কালো শক্ত সুতো টাঙানো ছিল। খালি চোখে দেখা অসম্ভব। কার্টারের সাদা পাকানো দড়ির ডগাতেও একইরকম সরু কালো সুতো ছিল। তার ডগায় আবার একটা হুক জাতীয় কিছু। কার্টার মন্ত্র পড়ে দড়ি ছোড়ার নাম করে হাতের দড়িটা শুধু সেই টাঙানো কালো সুতো টপকে দেন। দড়ির সামনে হুকসহ কালো সুতো গিয়ে পড়ল লাল পর্দাওয়ালা ঘরে। যে ঘরে দাঁড়িয়ে আছে রাখহরি। রাখহরি সেই কালো সুতোর ডগা ধরে ধীরে ধীরে টানতে থাকে। দর্শক দেখতে পায় দড়ি সাপের মতো দুলছে। দড়ি টেনে একেবারে ওপরের সুতো অবধি নিয়ে এপারে সেটাকে কিছুর সঙ্গে বেঁধে দেয় রাখহরি। হয়তো তৈমুরের হাতের সঙ্গেই। ব্যস! হয়ে গেল ম্যাজিক!”
“কোথায় হল? দড়ি বেয়ে উঠল কে?”
“ও হরি, এটাও বোঝোনি? দড়ি বেয়ে ওঠার আগে কার্টার বাঁদিকের পকেট থেকে একটা বন্দুক বার করে ফাটালেন। ধোঁয়ায় ভরে গেল চারদিক। ওটা ব্ল্যাংক কার্টিজ। ওতে শুধু আওয়াজ আর ধোঁয়াই হয়। সেই ধোঁয়াতে সবাই দেখল কেউ একটা দড়ি বেয়ে উঠছে, তাই তো?”
“হ্যাঁ, দেখলাম তো।”
“কিন্তু নারকেল গাছ বা দড়ি বেয়ে মানুষ উঠতে তো তুমি দেখেছ। এই ওঠায় তোমার কিছু অস্বাভাবিক লাগেনি?”
“লাগেনি বলব না। চিন-সু-লিন, মানে যে-ই হোক না কেন, ঠিক যেন বেয়ে উঠছিল না। টিকটিকির মতো সরসর করে সোজা দড়ি বরাবর ভেসে উঠে যাচ্ছিল।”
“একদম ঠিক। যেন ভেসে ভেসে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছিল। যেতে যেতে এক জায়গায় থেমে গেল। তাই তো?”
“হ্যাঁ, তাই তো দেখলাম।”
“ঠিকই দেখেছ। কারণ কোনও মানুষ ওভাবে সরসরিয়ে দড়ি বেয়ে উঠতে পারে না। পারে একমাত্র হাওয়াভরা পুতুল। চিন-সু-লিনের মতো পোশাকপরা একটা হালকা হাওয়া-ভরা পুতুল রাখহরি বেঁধে দিয়েছিল দড়ির সঙ্গে। হাইড্রোজেন গ্যাস ভরা এমন পুতুল অনেক সাহেব ম্যাজিশিয়ান ব্যবহার করে থাকেন। তাই এত পলকা দড়ি বেয়ে উঠতেও পুতুলের কোনও অসুবিধাই হয়নি।”
“তারপর?”
“তারপর কার্টার ডান পকেট থেকে আর-একটা বন্দুক বার করলেন। এটা কিন্তু আসল বন্দুক। টোটা ভরা। সেই হাওয়া-ভরা বেলুন লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লেন। বেলুন ফেটে গেল। পোশাকআশাক সমেত ঝুপ করে মাঝে পড়ে গেল চিন-সু-লিনের পুতুল। পর্দা খুলে গেল। দেখা গেল মঞ্চে তৈমুর ছাড়া আর কেউ নেই।”
“রাখহরি গেল কোথায়?”
গণপতি এবার হেসে ফেলল, “তুমি কি এখনও বোঝোনি তৈমুরের ভিতরে মানুষ থাকে, যে ওকে চালায়? আমার ধারণা, অন্য সময় চিন-সু-লিন ভিতরে বসে থাকে। দাবার চালও দেয়। কিন্তু এক্ষেত্রে দড়িতে পুতুল বেঁধে দিয়েই রাখহরি তৈমুরের মধ্যে লুকিয়ে পড়েছিল। হাওয়া-ভরা পুতুলটাও সম্ভবত তৈমুরের ভিতরে করেই মঞ্চে আনা হয়েছে। বললাম না, এই ম্যাজিকে তৈমুরের ভূমিকা বড়ো সাধারণ না।”
“তারপর?”
“তারপরেই তো গণ্ডগোল শুরু হল। খেলা কার্টারের হাত থেকে বেরিয়ে গেল। অন্য কোনও বড়ো ম্যাজিশিয়ান কার্টারের ওপর এক দান নিলেন। কার্টার আশা করেছিলেন দরজা দিয়ে চিন-সু-লিন ঢুকবে। ঢুকল না। আমার যতদূর মনে হয় ম্যাজিকের শেষ অংশটা এইরকম হবার কথা ছিল… চিন-সু-লিন সদর দরজা দিয়ে ঢুকবে, মঞ্চ আবার ধোঁয়ায় ঢেকে যাবে। দেখা যাবে তৈমুর নেই। কিন্তু সেজন্য রাখহরি সহ পুতুলটাকে এই গোপন ট্র্যাপডোরের ওপরে থাকতে হবে, যাতে দরজা খুললেই সেটা নিচে নেমে আসে। কার্টার সভয়ে খেয়াল করেন পুতুল ঠিক মাঝখানে রাখা। ট্র্যাপডোরের ওপরে নেই। তিনি শুরু করলেন মন্ত্র উচ্চারণ আর তৈমুরকে হাতের লাঠি দিয়ে ঠেলা, যাতে সে ঠিক জায়গায় চলে আসে… কিন্তু তারপরেই তো ছাদ ভেঙে নিচে এসে পড়ল চিন-সু-লিন। বাকিটা তো সবাই দেখেছে।”
“চিন-সু-লিন ছাদে গেল কী করে?”
“তাকে কেউ মেরে ওই পাটাতনে শুইয়ে রেখেছিল।”
“সে কে?”
“তা আমি কী করে বলব? পুলিশ বলতে পারবে।”
“তোমার কী মনে হয় গণপতি?”
“একটাই ব্যাপার বুঝতে পারছি, কার্টারকে কেউ ব্যবহার করেছে। চিন-সু-লিন-কে খুন করার দরকার ছিল। কিন্তু এমনভাবে, যাতে কারও সন্দেহ না হয়। কার্টার অজ্ঞাতে সেই ফাঁদে পা দিয়েছেন।”
“কার্টার কিছু জানতেন না বলছ?”
“জানলে আর মনস্তাপে আত্মহত্যা করবেন কেন বলো? আমার কেন জানি না মনে হয়, জাদুকর কার্টার সূর্যতামসীর খেলায় মেতেছিলেন। নইলে এমন হবার কথা না। তোমায় বলিনি, সেদিন কিন্তু শুরু থেকেই আমার মন কু গাইছিল।”
“সূর্যতামসী কী?”
“এ এক ভয়ানক জাদুবিদ্যা। কালাজাদু। জাদুর জগতে এর নামও অনেকে মুখে আনে না। আমার গুরুর মুখে শোনা। ভারতীয় জাদু বড়ো সাধনার ধন। একে নিয়ে যা খুশি, যখন খুশি করা যায় না। সবার সামনে সব খেলা দেখানোও পাপ। আর যদি তা নিতান্ত করতেই হয়, তবে সূর্যতামসীর ব্রত নিয়ে খেলতে হয়। এ এক অদ্ভুত খেলা। বলা হয়, স্বয়ং শয়তান নাকি এই খেলা শেখান। শিখতে গেলে বাজি রাখতে হয় নিজের আত্মাকে। আত্মা বিকিয়ে দিতে পারলে শয়তান সব দেয়। খুব দ্রুত। যশ, খ্যাতি, ধন… সব। কিন্তু তার বদলে ধীরে ধীরে শয়তান খেলোয়াড়কে নিজের বশে নিয়ে আসবে। তখন শয়তান দিন বললে দিন, রাত বললে রাত। যা বলবে মানতেই হবে।”
“আর যদি কেউ তা না মানে?”
“তখন শয়তান তার আত্মাটাকে চুষে খেয়ে নেয়।”
। চার।
এক হপ্তার বেশি কেটে গেছে। কার্টারের কথা শহর ভুলে গেছে বোধহয়। এর মধ্যে বড়োদিন চলে গেছে। প্রতিবারের মতো এবারও ধুমধাম বড়ো কম হয়নি। ডালহৌসি আর চৌরঙ্গি অঞ্চলের প্রত্যেক সাহেব বাড়িই দেবদারু গাছের ডাল, ফুল লতাপাতা, রুপোলি ও নানা রঙের কাগজের চেন দিয়ে সাজানো হয়েছিল। চিনাবাজারের দোকান আর ইউরোপ শপগুলো আলোর মালায় সেজে উঠেছিল। সাহেব মেমরা ঘোড়ায় টানা বগি গাড়ি চেপে বেরিয়েছিলেন কেনাকাটা করতে। বড়োদিনের বড়ো দোকান হোয়াইটঅ্যাওয়ে লেডল আর হল অ্যান্ডারসন যেন স্বপ্নপুরী। তারিণী কিংবা গণপতির মতো লোকেদের সাহসই হয় না সেসব দোকানে ঢোকার। গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে নাকি বড়োদিন উপলক্ষ্যে বিদেশ থেকে নর্তকীরা এসেছিল। কলকাতার পাশাপাশি সুবে বাংলার বহু জায়গার রাজকর্মচারী ও সেনা কর্তারা এতে নিমন্ত্রিত ছিলেন। পরদিন পত্রিকাগুলো ফলাও করে তার বিবরণ ছেপেছিল।
নিজের ক্লাইভ স্ট্রিটের অফিসের চেয়ারে বসে বসে একগাদা পত্রিকা জোগাড় করে এইসবই পড়ছিল তারিণী। সেদিনের পর থেকে গণপতির সঙ্গেও আর দেখা হয়নি। ও নাকি বর্ধমানের দিকে কোথায় গেছে ম্যাজিক সার্কেলের সদস্যদের সঙ্গে খেলা দেখাতে। তারিণীর হাতেও কাজ নেই। কাল ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়েছে। হেডকোয়ার্টারে মিটিং ছিল। কার্টারের ম্যাজিক শো-র পরের দিনই চিঠি পেয়েছিল তারিণী। সে আহ্বান উপেক্ষা করা যাবে না।
তার চুঁচুড়া নিবাসকালে প্রায় না জেনেই এই ভ্রাতৃসংঘের সদস্য হয়েছিল তারিণী। এককালে এই চুঁচুড়া ছিল ওলন্দাজদের অধীনে। কিন্তু ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কিছু কর্মচারীর অসাধুতার জন্য রাজস্বের সব টাকা হল্যান্ডের রাজার কাছে পৌঁছোত না। তিনি বিরক্ত হয়ে ১৮২৪ সালে এক চুক্তির মাধ্যমে তাঁদের একশো আশি বছরের উপনিবেশ চুঁচুড়া ইংরেজদের দিয়ে বদলে ইংরেজদের থেকে সুমাত্রা দ্বীপের অধিকার নিয়ে নেন। সেই বছরই ৭ মে দুই ইংরেজ সাহেব বেলাই আর স্মিথ এসে চুঁচুড়ার অধিকার নিলেন। হল্যান্ডের পতাকা নেমে ইংল্যান্ডের ইউনিয়ান জ্যাক উঠল। চুঁচুড়া অধিকার করে ইংরেজরা প্রথমেই ১৬৯৭ সালে ওলন্দাজদের তৈরি গ্যাসটাভাস দুর্গ ভেঙে মাটিতে মিশিয়ে দিলেন। সেই দুর্গের কড়ি বরগা নিয়ে ১৮২৯ সালে ইংরেজদের ব্যারাক তৈরি হয়। এই ব্যারাক তৈরি করতে বহু ওলন্দাজ আর বাঙালি প্রজাদের উচ্ছেদ করা হল। তাঁরা তুমুল আন্দোলন করলেন, কিন্তু কোনও কাজ হল না।
ইংরেজদের এই দম্ভ আর প্রতিপত্তি মেনে নিতে পারলেন না চুঁচুড়াবাসী বহু ওলন্দাজ। তাঁরা খুব মিশুক প্রকৃতির ছিলেন। অনেকেই বাঙালি মহিলাদের বিয়ে করে, বাংলা ভাষায় কথা বলে প্রায় বাঙালি হয়ে গেছিলেন। তাঁরা এবং কিছু বাঙালি মিলে ফ্রি ম্যাসনদের একটি শাখা চুঁচুড়ায় স্থাপন করেন। তারিণীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, চুঁচুড়া বার্তাবহের সম্পাদক দীননাথ বাঁড়ুজ্জে তারিণীকে প্রায় জোর করেই এই দলের সদস্য করেন।
ঠিক এইখানে মধ্যযুগে স্থাপিত এই গোপন সমিতিকে নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। মধ্যযুগে ক্রুসেড শেষ হলে খ্রিস্টান নাইটদের বেশিরভাগ যুদ্ধের লুটের ধনে অত্যধিক সম্পদশালী হয়ে ওঠেন। এই সম্পদ এতটাই ছিল যে, একসময় তাঁরাই হয়ে ওঠেন গোটা ইউরোপের ব্যাংকার। ইউরোপ জুড়ে তাঁরা বানাতে থাকলেন একের পর এক দুর্গ, ভবন আর ক্যাথিড্রাল। আর সেসব বানাতে গিয়েই তাঁরা ম্যাসনদের সংস্পর্শে আসেন। ম্যাসন মানে গোদা বাংলায় রাজমিস্ত্রি। তাঁদের আবার একটা নিজস্ব গোষ্ঠী ছিল, যাঁরা নিজেদের বাইবেলে বলা সলোমনের মন্দিরের নির্মাতাদের বংশধর মনে করতেন। তাঁদের জ্যামিতির জ্ঞান ছিল অসামান্য আর এই জ্যামিতিক জ্ঞানকে তাঁরা ঈশ্বরের সমান বলে ভাবতেন। তাঁরা ছিলেন একেবারে স্বাধীন। গোটা ইউরোপে যেখানে খুশি তাঁরা যেতে পারতেন।
ম্যাসনরা নিজেদের মধ্যে ফ্রি ম্যাসন নামে এক গোষ্ঠী গড়ে তোলেন। তাঁদের নিজস্ব করমর্দনের পদ্ধতি তৈরি হয়, যেটা শুধু সভ্যরাই জানবে। আগে ফ্রি ম্যাসনদের বাস ছিল কুটিরে, যাদের ‘লজ’ বলা হত। তাঁরা ছিলেন দরিদ্র কিন্তু জ্ঞানী। এঁদের সবার ওপরে ছিলেন মাস্টার ম্যাসন। তাঁর লজে বসে সবাই গণিত আর ঈশ্বরের নানা অজানা দিক নিয়ে আলোচনা করতেন। তাই তাঁদের দলের চিহ্নে থাকত একটা স্কোয়ার আর একটা কম্পাস— রাজমিস্ত্রির অপরিহার্য দুই সঙ্গী। মাঝে লেখা G, মানে গড, আবার জিওমেট্রি।
মধ্যযুগে নাইটদের সঙ্গে ম্যাসনদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অবস্থাটা বদলাতে থাকে তখন থেকেই। নাইটদের দেখাদেখি ম্যাসনরাও তাঁদের সভায় নানা গোপন আলোচনা, গোপন আচার অনুষ্ঠান করা শুরু করলেন। শুধু ঈশ্বরের আলোচনায় আবদ্ধ না থেকে গোপন ষড়যন্ত্র, নাইটদের গুপ্তধনের ভাগবাঁটোয়ারা বা তাঁদের হদিসও পাওয়া যেতে থাকল ম্যাসনদের সভায়। আর যেই না এইসব গোপন ব্যাপারস্যাপার ঢুকল, ম্যাসনরা প্রায় নিজের অজান্তেই গোপন সমিতিতে পরিণত হতে লাগলেন। শুরুতে তাঁদের যে ব্রত ছিল গণতন্ত্র ও সাম্য, সেটা রইল, কিন্তু দলে তিনটে স্তর তৈরি হল। প্রথম স্তরে শিক্ষানবিশ, দ্বিতীয়তে ফেলো আর একেবারে শেষে মাস্টার ম্যাসন। মাস্টারের ওপরেই দলের পরিচালনার ভার। ঈশ্বরের আলোচনা গৌণ হয়ে গেল। ষড়যন্ত্র, নিষিদ্ধ মিটিং, রাষ্ট্রদ্রোহ, গির্জার বিরোধিতা, সবকিছুর আখড়া হয়ে উঠল ফ্রি ম্যাসন লজ। কোথাও কোথাও এদের নিষিদ্ধও ঘোষণা করা হল। ওলন্দাজ গভর্নর জ্যাকোয়া ভার্নেতের নাতি মার্কাস ভার্নেত চুঁচুড়ায় ফ্রি ম্যাসনদের একটি লজ স্থাপন করেন। নাম রাখেন কনকর্ডিয়া। নামে ফ্রি ম্যাসনদের আড্ডা, কিন্তু আলোচনা হত কীভাবে ইংরেজদের দাপটের অবসান ঘটানো যায়। যেহেতু অনেক ওলন্দাজ এই দলে ছিলেন, তাই ইংরেজরা এঁদের সন্দেহ করেননি। সাদা চামড়ার কী মাহাত্ম্য! মাঝে মাঝে ভাবে তারিণী। এটাই যদি কোনও নেটিভ সমিতি হত, তাহলে কবেই সরকার একে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিত! এর অবশ্য আর-একটা কারণ ছিল। বড়োলাট বেন্টিঙ্ক নিজে ফ্রি ম্যাসন ছিলেন। তিনি এককালে ‘গ্র্যান্ড মাস্টার অফ অল ইন্ডিয়া’ উপাধিও নিয়েছিলেন। তাই ইংরেজরা ফ্রি ম্যাসনদের সচরাচর ঘাঁটায় না। চুঁচুড়ার ফ্রি ম্যাসনদের দলে কিছু ইংরেজ আছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁরা ধোঁকার টাটি। তাঁদের সামনে প্রয়োজনীয় আলোচনা কিচ্ছু হয় না।
কলকাতায় বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে ফ্রি ম্যাসনদের একটা লজ আছে। তাতে নেটিভ প্রায় নেই বললেই চলে। সব ইংরেজ। কয়েক বছর আগে বাবু প্রসন্নকুমার দত্ত প্রথম বাঙালি, যিনি কলকাতার লজে শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। এখন তিনি ফেলো পদে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তবে মুখে যতই ভ্রাতৃত্বের কথা হোক, সবাই জানে বাবু প্রসন্নকুমার কোনও দিন মাস্টার হতে পারবেন না। সে অধিকার কেবল সাহেবদের জন্য বাঁধা। তারিণী চুঁচুড়ার ফ্রি ম্যাসন ফেলো, তাই স্বাভাবিকভাবেই তাকে বলা হয়েছে কলকাতায় ফ্রি ম্যাসনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। আরও একটা কারণ ছিল। ভার্নেত তাকে বলেছিলেন একটু চোখকান খোলা রাখতে, যদি চুঁচুড়ায় ইংরেজদের গতিবিধি সম্পর্কে জানা যায়।
সেদিন সকালে চিঠিটা পেয়ে তাই সে উপেক্ষা করতে পারেনি। ঠিক রাত নটায় পৌঁছে গেছিল ৫৫, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের হেডকোয়ার্টারে। দরজায় গোপন করমর্দন হল গেটপাস। সেটা সেরে ভিতরে গিয়ে দ্যাখে পরিবেশ থমথমে। সবাই কালো কোট পরে এসেছেন। যেন কারও শোকসভা। সামনে মঞ্চ। টেবিলে বসে আছেন গ্র্যান্ড মাস্টার হ্যালিফ্যাক্স। দুইপাশে দুটো মোটা মোমবাতি জ্বলছে। পিছনে লাল পর্দায় ম্যাসনদের চিহ্ন। সবাই যেন কারও জন্য অপেক্ষা করছেন। তারিণী ভাবল কাউকে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু তার আগেই সবাই উঠে দাঁড়াল, আর দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকলেন সস্ত্রীক বড়োলাট ল্যান্সডাউন। সেই কার্টারের ম্যাজিকের দিনই বড়োলাটকে প্রথমবার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল তারিণীর। এত তাড়াতাড়ি আবার দেখতে পাবে ভাবেনি। কিন্তু বড়োলাট এখানে কী করছেন? তাঁর স্ত্রীই বা সঙ্গে কেন? দুজনের পরনেই শোকের পোশাক। বড়োলাট মঞ্চে উঠলেন না। নিচেই একেবারে সামনের সারিতে বসলেন। হ্যালিফ্যাক্স উঠে দাঁড়ালেন, “আজ আমাদের এই সভার উদ্দেশ্য কোনও আলোচনা বা বিতর্ক নয়। আজ আমরা এক বিশেষ কারণে মিলিত হয়েছি। আমাদেরই এক ব্রাদার, ব্রাদার পল কিথ ফিসমোরিস ল্যান্সডাউন গত ১২ ডিসেম্বর নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। ব্রাদার পল চার বছর আগে এই দেশে আসেন। লন্ডনের ফ্রি ম্যাসনারির সদস্য আমাদের এই ব্রাদার কিছুদিনের মধ্যেই সবার অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। সংঘের যে-কোনো কাজে তিনি এগিয়ে আসতেন সবার আগে। তাঁর হাসিমুখ, মিষ্ট ভাষা আমাদের সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, খুব বেশিদিন সংঘ ব্রাদার পলকে কাছে পেল না। তিনি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভরতি হলেন। সেখান থেকে দুই বছর চিকিৎসার পরে সুস্থ হলেও তিনি গৃহবন্দিই থাকতেন। গত ১২ তারিখ সকালে কাউকে না বলে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। পুলিশ ও প্রশাসন তাঁকে খোঁজার বিস্তর প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেই রাতেই চিনা পাড়ায় তাঁর মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়। ব্রাদার পলের মতো সদাহাস্যময়, অজাতশত্রু মানুষকে কে হত্যা করল, আর কেনই বা করল তা আমাদের অজানা। বড়োলাট নিজে এখানে উপস্থিত। তিনিও শোকগ্রস্ত। তবু তাঁকে অনুরোধ করব কিছু বলার জন্য।”
বড়োলাট উঠে দাঁড়ালেন। তিনি রোগা মানুষ, তাই বেশ ঢ্যাঙাও লাগে। মাথার সামনের দিকে চুল উঠে গেছে। চেহারার মধ্যে চোখে পড়ে মোটা গোঁফখানা। তাঁকে দেখেই মনে হচ্ছে তিনি শোকাকুল। মাথায় যেন পাহাড় ভেঙে পড়েছে। মুখ ফ্যাকাশে। চোখ ছলছলে। এই রূপ তো সেদিন দেখেনি তারিণী! এ কোন বড়োলাট? যেন গোটা মানুষটাই পালটে গেছে। ধরা গলায় তিনি শুধু বললেন, “আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন। ব্রাদার পলের খুনি তার শাস্তি পাবেই, যদি না এতদিনে ঈশ্বর তাকে তার প্রাপ্য শাস্তি দিয়ে থাকেন।”
সভা আরও খানিক চলল। তারিণী বুঝতে পারল এই সেই খুন, যার খবর গণপতি এনেছিল। বিভিন্ন লোকের কথায় তারিণী পলকে বোঝার চেষ্টা চালাচ্ছিল। সবাই পলের প্রশংসাই করছে। এমন লোককে খুন হতে হল কেন? আর একটা কথা, পলের কী অসুখ হয়েছিল?
তারিণীর ভিতরে আবার জিজ্ঞাসা ছটফটাচ্ছে, কিন্তু কাকে জিজ্ঞেস করবে? সভা শেষে সবাই যখন নিজেদের মধ্যে মৃদু স্বরে কথা বলছে, বড়োলাট চলে গেছেন, তারিণী দেখল এক কোনায় চেয়ারে বসে আছেন বাবু প্রসন্নকুমার। বয়স হয়েছে। আজকাল নিয়মিত আসেন না সভায়। তবু আজকের সভার গুরুত্ব বুঝে এসেছেন। তারিণী গুটিগুটি পায়ে তাঁর কাছেই গেল। তারিণীকে দেখেই একগাল হাসলেন প্রসন্নকুমার, “এসো এসো হে আমার চুঁচুড়ার ব্রাদার। সেই যে কলকেতায় এসে দেখা করে আমার হাত ধরে এখেনে এসে ঢুকলে, তারপর তো বুড়োর কোনও খবরই নাও না।” তারিণী মাথা নিচু করে রইল। প্রসন্নকুমার বলে চললেন, “আমি অবশ্য সব খবর পাই। ড্রিসকল সাহেবের কাছে শিক্ষানবিশি করে এখন নিজে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হয়েচ। পশার বাড়চে… এখন আর বুড়োর কী দরকার?”
নিচু হয়ে পায়ের ধুলো নিয়ে তারিণী বলল, “কী যে বলেন কত্তা! আসলে আপনিও আসেন না, আমাকেও সাহেব পেঁচাপেঁচি নানা কাজে পাঠান। তাই…”
প্রণামে প্রসন্নকুমার স্পষ্টতই প্রসন্ন হলেন, “আরে কত্তা আবার কী? তুমিও ফেলো আর আমিও ফেলো। আমরা দুই ব্রাদার, নেটিভ ব্রাদার, কী বলো?”
“তা যা বলেছেন। আচ্ছা, এই ব্রাদার পলকে চিনতেন আপনি?”
“ওমা! তা চিনব না? বড়োলাটের আপন খুড়তুতো ভাই। রাইটার হিসেবে এসেছিল। কিন্তু রাইটার্স বিল্ডিং-এ থাকত না। বড়োলাটের সঙ্গেই থাকত। ছেলে ভালোই ছিল শুরুতে। হাসিখুশি। যে-কোনো কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ত… তারপর যে কী হল…”
“কী হল?”
“ওমা! তুমি জানো না? বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছিল তো! প্রথমে কিছুদিন চেপে রাখতে চেয়েছিল। লাভ হয়নি। তারপর দুই বছর ভবানীপুরের পাগলা গারদে ভরতি ছিল। সেখান থেকে ছাড়িয়ে এনে শেষ এক বছর লাটভবনে। কিন্তু লাটভবনে যা পাহারার কড়াকড়ি, সেখান থেকে পালাল কী করে সেটাই মাথায় ঢুকছে না। আর অমন বদ্ধ পাগলকে খুনই বা করবে কে?”
পরদিন সকালে বসে বসে প্রসন্নকুমারের করা প্রশ্ন দুটোই ভাবছিল তারিণী। এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। দরজা খুলে অবাক। বুড়ো ড্রিসকল সাহেব এসেছেন। সঙ্গে আরও দুজন। একজন দেশি, অন্যজন সাহেব। সেই সাহেবকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে গেল তারিণী। এ তো সেই সাইগারসন! কার্টারের ম্যাজিকের দলের লোক। অন্যজনকেও সে দেখেছে। এ পুলিশের লোক। চিন-সু-লিনের লাশ স্টেজে পড়ার পর টমসন সাহেব একেই ডেকেছিলেন মঞ্চে। তারিণী কারও মুখ ভোলে না।
সসম্মানে তিনজনকে নিয়ে অফিসে বসাল তারিণী। ড্রিসকল সাহেবই শুরু করলেন, “কেমন আছ তারিণী? কাজকর্ম সব চলছে তো?”
তারিণী বশংবদের মতো মাথা নাড়ল।
“ইনি মিস্টার সাইগারসন মোহেলস, লন্ডনের প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আর উনি আমাদের গোয়েন্দাবিভাগের অফিসার প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়। ওঁদের তোমাকে কিছু বলার আছে।”
অদ্ভুত এক হাসি ফুটে উঠল তারিণীর ঠোঁটে, “আমারও ওঁদের অনেক কিছু বলার আছে।”