কবি উমাপতি চাকলাদারের জীবনচরিত

কবি উমাপতি চাকলাদারের জীবনচরিত

নামটি দেখেই বেশ বোঝা যাচ্ছে এই গল্পের নায়ক উমাপতি চাকলাদার এবং তিনি একজন কবি। কিন্তু তাঁর কথা বলার আগে কল্পতরু সমাদ্দার সম্বন্ধে দু’চার কথা বলে নিতেই হবে। কারণ কল্পতরু না থাকলে উমাপতি চাকলাদারের সঙ্গে কোনওদিনই আমার দেখা হতো না। এ গল্পে কল্পতরুর ভূমিকা অনেকটা যোগাযোগকারীর।

সাতান্ন আটান্ন বছর আগে, আমার বয়স তখন সতেরো আঠারো, কলেজে পড়ি, সেইসময় কল্পতরু সমাদ্দারের সঙ্গে আমার আলাপ। কীভাবে আলাপটা হয়েছিল, এ গল্পে তার প্রয়োজন নেই। তবে একটা কথা জানানো দরকার কল্পতরু সেই সময় ছিলেন একজন নামকরা লেখক। বাংলা সাহিত্যের খোঁজখবর যাঁরা রাখেন কল্পতরুর নামটা তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন।

কল্পতরু সমাদ্দারের দেশ ছিল অখণ্ড বাংলার (বর্তমানে বাংলাদেশ) বরিশালে। দেশভাগের পর পর তাঁরা কলকাতায় চলে আসেন। গড়িয়ার কাছাকাছি একটা জবরদখল উদ্বাস্তু কলোনিতে থাকতেন। দাঙ্গা, পার্টিশন আর রিফিউজিদের নিয়ে লেখা তাঁর কয়েকটি উপন্যাস আর গল্প তখন বেশ নাম করেছিল।

আমার সঙ্গে কোথাও দেখা হলে তাঁদের বাড়িতে যেতে বলতেন। অনেকবার বলার পর একদিন বিকেলে খুঁজে খুঁজে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। সঙ্গে আমার কলেজের এক বন্ধু কল্যাণ।

উদ্বাস্তু কলোনির বর্ণনা দেবার দরকার নেই। আমার ধারণা এই গল্পের পাঠকেরা প্রায় সবাই কলকাতার আশপাশে উদ্বাস্তুদের অগুনতি উপনিবেশ স্বচক্ষে দেখে থাকবেন।

কল্পতরুর বাড়িটা সেকালের পূর্ব বাংলার বাড়িঘরের চেহারা মনে করিয়ে দিয়েছিল। মাথায় ছিল ঢেউখেলানো টিনের চাল, চারপাশে চেরা বাঁশের দেওয়াল, মেঝে লাল সিমেন্টের।

আমাদের দেখে কল্পতরু সমাদ্দার ভীষণ খুশি হলেন। হাত ধরে সামনের শেড—দেওয়া ঢালা বারান্দায় নিয়ে গেলেন। সেখানে শতরঞ্চি পাতা ছিল। বোঝা গেল এটিই তাঁর বৈঠকখানা। বললেন, ‘বোসো বোসো’—

আমরা বসে পড়লাম।

ছাপার অক্ষরে নাম এবং গল্প টল্প বেরোয়, কল্পতরু সমাদ্দার ছাড়া অন্য কারওকে আমাদের সেই বয়সে দেখিনি। তিনি ছিলেন আমাদের স্বপ্ন জগতের বাসিন্দা।

আমাদের পেয়ে কল্পতরু নানারকম গল্প জুড়ে দিলেন। সবই সাহিত্য আর সাহিত্যিকদের অন্দর মহলের গল্প। কোন লেখক ভালো লিখছে, কোন লেখক জঘন্য, কে সারাজীবন কাগজের ওপর কলম ঘষে গেলেও লেখক হতে পারবে না, কে পুরস্কারের জন্য পুরস্কার—কমিটির মেম্বারদের বাড়িতে দিনের পর দিন হানা দিয়ে জুতোর তলা ক্ষইয়ে ফেলছে, ইত্যাদি।

মানুষটি এমনিতে চমৎকার, স্নেহপ্রবণ কিন্তু একবার কথা বলতে শুরু করলে সহজে থামেন না। যেন একটি টকিং মেশিন।

ঘণ্টাখানেক পর দম ফেলার জন্য তিনি একটু থামতেই সেই ফাঁকে বললাম, ‘আপনি এখন নতুন কিছু লিখছেন?’

‘হ্যাঁ, লিখছি তো—’কল্পতরু বললেন, আমাদের এই গড়িয়া নাকতলা এলাকার জবরদখল কলোনিগুলো নিয়ে একটা উপন্যাস শুরু করেছি।’

‘কতটা লেখা হয়েছে?’

‘খুব বেশি না। এই পঁচিশ তিরিশ পাতার মতো।’

লেখকের মুখ থেকে তাঁর লেখা শুনতে আমার আর কল্যাণের খুব ভালো লাগে। আগ্রহের সুরে বললাম, ‘লেখাটা পড়ে শোনান না। আমাদের শুনতে ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে।’ মনে হয়, দারুণ একটা উপন্যাস হবে।’

এই গল্পটা যাঁরা পড়ছেন তাঁরা এতক্ষণে নিশ্চয়ই অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। যাঁকে নিয়ে এই গল্প এখনও তাঁর আবির্ভাব হচ্ছে না, ধৈর্য হারানোর তো কথাই। আরেকটু অপেক্ষা করুন, উমাপতির দর্শন পাবেন।

এদিকে আমাদের আবদার শুনে একটু ভেবে কল্পতরু সমাদ্দার বললেন, ‘মানে পাণ্ডুলিপি থেকে টাটকা শুনতে ইচ্ছে করছে? আমি যেটা লিখেছি, একটা ম্যাগজিনের লোকেরা এসে তা নিয়ে গেছে। তারা এই উপন্যাসটা ধারাবাহিকভাবে মাসে মাসে ছাপবে। কিন্তু তোমাদের ইচ্ছেটা পূরণ না করলেই নয়। চলো আমার সঙ্গে—’

‘কোথায় যাব!’ আমরা অবাক।

‘সেখানে গেলেই দেখতে পাবে। উঠে পড়ো—’

কল্পতরু আমাদের সঙ্গে করে খানিকটা দূরে কলোনিরই অন্য একটা বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এই বাড়িটা মোটামুটি তাঁর বাড়ির মতোই। সেইরকম টিনের চাল, চেরা বাঁশের দেওয়াল, সিমেন্টের মেঝে, সামনের দিকে শেড—লাগানো প্রশস্ত বারান্দা।

বারান্দায় গদি—পাতা বড় তক্তপোশে একজন গোলগাল ভারী চেহারার মাঝবয়সি ভদ্রলোক বসে ছিলেন। প্রায় পুরো মাথা জুড়ে চকচকে টাক; সেই টাকের তলা দিয়ে কাঁচাপাকা চুলের ঘের। গোল গোল চোখের ওপর রোমশ ভুরু। চৌকো ধরনের মুখ, ঘন রোমশ ভুরু। হাইট খুব একটা বেশি হবে না, বড় জোর পাঁচ ফিট তিন কি চার ইঞ্চি। গায়ে প্রচুর মেদ, থুতনির তলাতেও তিন থাক চর্বি।

তাঁর পরনে ধুতি এবং হাফ—হাতা ফতুয়া। শরীরের যে অংশগুলো ঢাকা পড়েনি, সেই সব জায়গার অজস্র ঘন লোম বেরিয়ে আছে। চোখে নিকেল ফ্রেমের গোলাকার বাইফোকাল চশমা। ঝুঁকে কিছু একটা দেখছিলেন। উঠোনে পায়ের শব্দ কানে যেতেই মুখ তুলে তাকালেন। তারপর হাসিমুখে বললেন, ‘আসুন কল্পতরুবাবু, আসুন। বলতে বলতেই তাঁর নজর এসে পড়ল আমাদের দিকে। গোল চশমার তলা দিয়ে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমাকে এবং কল্যাণকে যেন জরিপ করে নিলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই শাবক দু’টি কারা?’

বুঝতে পারলাম আমাদের অল্প বয়স, তাই আমরা শাবক।

কল্পতরুবাবু রহস্যময় হেসে বললেন, ‘এ দুটিকে আপনার শিকারও বলতে পারেন আবার খাদ্যও বলতে পারেন।’ বলে চোখ ছোট করে কী ইশারা যেন করলেন।

ভদ্রলোকের দু’চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেল। দারুণ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন তিনি। আমাদের দিকে তাকিয়েই ছিলেন। বললেন, ‘বোসো বোসো। তোমাদের নাম দুটি কী ভাই। নিশ্চয়ই পড়াশোনা করছ?’

আমরা বারান্দায় উঠে তক্তপোশে তাঁর কাছাকাছি বসে পড়ি। ভদ্রলোকের প্রশ্নের উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই কল্পতরু সমাদ্দার আমাদের নাম, কোন কলেজে কোন ইয়ারে পড়ছি, সব জানিয়ে দেন। এবং ভদ্রলোকের পরিচয়টাও আমাদের জানানো হয়। তাঁর নাম উমাপতি চাকলাদার।

উমাপতি ভীষণ খুশি হয়ে বললেন, ‘তোমরা এসেছ। খুব ভালো লাগছে। সাহিত্যের চুলকুনি শুরু হয়েছে বুঝি?

উমাপতির কথাগুলো এরকম ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিয়ে কল্পতরু সমাদ্দার চোখ টিপে বললেন, ‘চুলকুনি বলে চুলকুনি। সেটি না হলে এই গড়িয়া পর্যন্ত দৌড়ে আসে।’

উমাপতি ধীরে ধীরে মাথা নাড়েন। ‘খুব ভালো খুব ভালো।’ বলেই শরীরটাকে হেলিয়ে বাঁ দিকের একটা ঘরের দিকে তাকিয়ে ডাকলেন, ‘চারু, চারু—’

একটি কুড়ি বাইশ বছরের রোগাটে চেহারার তরুণী ভেতর দিক থেকে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। নীচু গলায় বলল, ‘ডাকলে কেন বাবা, কিছু দরকার আছে?’

‘হ্যাঁ। খুব ভালো করে ময়ান দিয়ে পরোটা আর আলুর দম বানিয়ে ফেল। আর ঝানুকে পাঠিয়ে দে—’

চারু চলে গেল। মিনিট দুয়েক বাদে টিনটিনে ফড়িঙের মতো চেহারার চোদ্দো পনেরো বছর বয়সের একটি ছেলে সামনে এসে দাঁড়াল। চোখ পিট পিট করে আমাদের পা থেকে মাথা অবধি নিরীক্ষণ করার পর আস্তে আস্তে ঘাড় ফিরিয়ে উমাপতির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবা, আজ বুঝি এই দু’জনকে পাকড়েছ?’

উমাপতি গর্জে উঠলেন, ‘হারামজাদা, বাঁদরামো হচ্ছে? যাও,দিদির কাছ থেকে টাকা নিয়ে ‘গৌরহরি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ থেকে রাজভোগ আর ল্যাংচা নিয়ে এসো। পনেরোটা পনেরোটা করে।’

কানু চলে যাবার পর কল্যাণ আমার কানে মুখ ঠেকিয়ে ফিস ফিস করে বলল, ‘লোকটার কী মতলব বল তো—’

আমি অবাক।—’কীসের আবার মতলব?’

‘উমাপতি চাকলাদার আজ প্রথম আমাদের দেখল। নাম টাম কী পড়ছি, ব্যস এটুকুই জানে। কিন্তু পরোটা রাজভোগ, টাজভোগ খাওয়াতে চাইছে। ব্যাপারটা সুবিধের মনে হচ্ছে না।’

উমাপতি যাতে শুনতে না পান, গলা অনেকটা নামিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলাম, ‘তোর ভীষণ খুঁতখুঁতুনি। সব কিছুতেই সন্দেহ। আদর করে খাওয়াতে চাইছে। ভালোই তো।’ বলতে বলতে আমার মনে একটা খটকা দেখা দিল। সত্যিই তো এই প্রথম এখানে আসা, তাও কল্পতরু সমাদ্দার নিয়ে এসেছেন বলে। উমাপতি চাকলাদার আমাদের খাওয়ার কথা বলেননি। আমরাই বেশি বেশি ভেবে ফেলেছি। এবার বললাম, ‘দেখা যাক—’

কল্যাণের সন্দেহটা কাটছে না। স্বগতোক্তির মতো সে বলল, ‘প্রথম দর্শনেই ল্যাংচা পরোটা টরোটা দিয়ে জামাই আদর করতে চাইছে। আমার মন বলছে লোকটা আমাদের কোনও ঝামেলায় ফেলে দেবে।’

কল্যাণ ধরেই নিয়েছে, খাবার দাবারের এত আয়োজন আমাদের জন্যই। আমি জবাব দিতে যাচ্ছিলাম, আচমকা আরও দু’জন ভদ্রলোক এসে হাজির। তাঁদের একজনের চেহারা বিলকুল কুস্তিগীরদের মতো। পেটানো স্বাস্থ্য। হাইট ছ’ফিটের কাছাকাছি। ছাতি কম করে পঞ্চান্ন ছাপ্পান্ন ইঞ্চি। মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা। বয়স পঞ্চাশের নীচেই, পরনে প্যান্টশার্ট।

দু’নম্বর ব্যক্তিটির চেহারা খানিকটা বোতলের মতো। বয়স এক নম্বরের চেয়ে অনেকটাই বেশি। ষাট ছুঁই ছুঁই। শজারুর কাঁটার মতো খাড়া খাড়া চুলের চারভাগের তিনভাগ সাদা, একভাগ কালো। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। পরনে ধুতি পাঞ্জাবি।

এই দু’জনকে দেখে উমাপতি বেশ সমাদরের সুরে বললেন, ‘আসুন রামবাবু, আসুন নরেশ্বরবাবু—’

রামবাবুরা এসে আমাদের গা ঘেঁষে বসে পড়লেন। তাঁদের দু’জনের সঙ্গে আমাদের দু’জনের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল। ধুতি—পাঞ্জাবি পরা বয়স্ক লোকটি হলেন রামগোপাল দত্ত। তিনি একটা স্কুলে ভূগোলের টিচার। পালোয়ানের মতো নিরেট, জবরদস্ত চেহারা যাঁর তিনি একটা আখড়ায় কুস্তি সেখান। তা ছাড়া গড়িয়া বাজারের কাছে একটা বড় জামাকাপড়ের দোকান আছে। নাম নরেশ্বর নন্দী। দু’জনেই নাকি বইয়ের পোকা। সাহিত্যপাগল মানুষ।

রামগোপালবাবুরা আসতেই মজলিশ বেশ জমে উঠল। আর তার মধ্যেই উমাপতিবাবুর মেয়ে চারু প্লেটে প্লেটে পরোটা, আলুর দম এবং রসগোল্লা সাজিয়ে সবাইকে দিয়ে চলে গেল।

তখন বিকেল ফুরিয়ে এসেছে। আকাশের গড়ানে পাড় বেয়ে সূর্যটা কিছুক্ষণ আগেই পশ্চিম দিকের বাড়িঘর আর উঁচু উঁচু গাছপালার আড়ালে নামতে শুরু করেছে। পাখিরা সারাদিন খাবারের খোঁজে ঘোরাঘুরির পর এখন নিজেদের আস্তানায় ফিরে যেতে শুরু করেছে। রোদের দাপট আর আগের মতো নেই, দ্রুত ম্যাড়মেড়ে হয়ে যাচ্ছে। কতক্ষণ আর? খুব বেশি হলে ঘণ্টাখানেক। তারপরই ঝপ করে সন্ধে নেমে যাবে। চারিদিকে তারই তোড়জোড় চলছে।

আমাদের খাওয়া শেষ হয়ে এসেছে। চারু চা নিয়ে এল।

চা খাওয়া যখন শেষ ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণে উমাপতি চাকলাদার তাঁর প্রথম ব্যালিস্টিক মিসাইলটি আমাদের দিকে তাক করে ছাড়লেন। ‘তোমাদের সবাইকে পাওয়া গেছে। আজ তা হলে সাহিত্যের আসর বসানো যাক। তোমরা কী শুনতে চাও—কবিতা, ছোট গল্প, বড় গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, রম্যরচনা, নাকি উপন্যাস?’

আমার মুখটা পাক্কা তিন মিনিট হাঁ হয়ে রইল। তারপর জোরে দম নিয়ে বললাম, ‘আপনি এত সব লিখেছেন?’

উমাপতি ভারিক্কি চালে মিটিমিটি হেসে বললেন, ‘সাহিত্যের হেন শাখা নেই যা নিয়ে কলম চালাইনি। ষোলোশো পাতার উপন্যাস লিখেছি সাঁইত্রিশখানা। মহাকাব্য লিখেছি ছ’টা, প্রবন্ধ দেড় হাজার, গল্প সাড়ে সাত শো, নাটক তিনশো একটা, কবিতা রম্যরচনা যে কত লিখেছি তার হিসেব নেই। হেঁ—হেঁ—’ নেই।

কল্পতরু সমাদ্দার টিপ্পনি কাটলেন, ‘উমাপতিদার বয়েস মাত্র পঞ্চান্ন। এর মধ্যেই লেখে লিখে দেড় টন কাগজ ভরে ফেলেছেন! একটা বড় পেপার মিলকে আরও দেড় টন কাগজ সাপ্লাই করার জন্যে অর্ডার দিয়েছেন।’

উমাপতি হেঁ হেঁ করে আরও একটু হেসে আমাদের দিকে ফিরে বললেন, ‘কই, বললে না তো কী শুনবে?’

আমরা পাণ্ডুলিপি থেকে নতুন টাটকা লেখা শুনতে ভালোবাসি ঠিকই কিন্তু সেসব নামকরা লেখকের। উমাপতি চাকলাদারের নাম আমাদের চোদ্দো পুরুষে কেউ কখনও শোনেনি। দেড় টন কাগজ লিখে লিখে যিনি ভরিয়ে ফেলেছেন তাঁর লেখার একটি বর্ণও কোনও পত্র—পত্রিকায় চোখে পড়েনি। তিনি কীরকম লেখেন, ধারণাই নেই। কল্পতরু সমাদ্দার এ কার কাছে আমাদের নিয়ে এসেছেন! ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে, একটু একটু ভয়ও। উঠে যে চলে যাব তারও উপায় নেই। পরোটা আলুর দম টম আগেই খাইয়েছেন। হাজার হোক, ভদ্রতা বলে একটা কথা তো আছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য বললাম, ‘কবিতা শুনব।’ মনে মনে ভাবলাম, একটা কবিতা শুনতে কতক্ষণই বা লাগবে। বড় জোর পাঁচ কি সাত মিনিট। তারপরই এই জবরদখল কলোনি থেকে কল্যাণকে সঙ্গে নিয়ে চম্পট।

উমাপতি চাকলাদার বেশ মনমরা হয়ে গেলেন যেন। ‘কবিতা! একটা জব্বর সামাজিক উপন্যাস লিখেছি। এই তোমাদের বয়সি আজকালকার যুবক যুবতীদের নিয়ে। দারুণ জমে গেছে। সেটা শোনো—’

ভীষণ ভড়কে গেলাম। কী উত্তর দেবো, ভেবে পাচ্ছি না, আকাশ পাতাল হাতড়াচ্ছি, পাশ থেকে কল্যাণ বলে উঠল, ‘আমরা দু’জনে কবিতা সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। কবিতার মতো জিনিস হয় না।” আহা তিন চার মিনিটে মন ভরে যায়।’

উমাপতি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর মাথাটা অল্প অল্প নাড়তে লাগলেন, ‘বেশ’ কবিতাই যখন শুনতে চাইছ, তাই হোক।’ বলেই গলা চড়িয়ে হাঁক হাঁক দিলেন, ‘ঝানু’—

তৎক্ষণাৎ সেই রোগা ডিগডিগে ছেলেটি এসে দর্শন দিল। খুব সম্ভব কাছাকাছি কোথাও ছিল। উমাপতি তাকে বললেন, ‘যা, ভাঙা মসজিদটার সামনে একখানা শতরঞ্চি বিছিয়ে রেখে চলে আয়।’ তারপর আরও কাজ আছে।’

আমরা যেখানে বসে আছি সেখান থেকে ডান দিকে তাকালেই রাস্তা। রাস্তার ওধারে একটা অনেক কালের পুরনো ভাঙা মসজিদ চোখে পড়ে। সেটার সামনে সবুজ কার্পেটের মতো খানিকটা ঘাসের জমি। ঝানু সেখানে পরিপাটি করে একখানা বেশ বড় সাইজের শতরঞ্চি পেতে রেখে ফিরে এসে পিতৃদেবের দু’নম্বর হুকুমের জন্য দাঁড়িয়ে রইল।

উমাপতি এবার বললেন, ‘এখন আমার এপিকের তোরঙ্গখানা নিয়ে আয়।’

হুকুম অচিরেই তামিল হল। ঝানু ডান দিকের বড় ঘরখানায় ঢুকে তক্তপোশের তলা থেকে কালো রঙের ঢাউস একটা টিনের বাক্স বের করে আনল। সেটা বইতে তার পিঠ ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছে; গলার শিরগুলো দড়ির মতো ফুলে উঠেছে; হাতদু’টো মনে হচ্ছে বাক্সর ভারে আরও দেড় ফুট লম্বা হয়ে যাবে। আমাদের সামনে দিয়ে সে যখন গেল, চমকে উঠে দেখলাম, বাক্সটার গায়ে একটা সাদা কাগজ আঠা দিয়ে সাঁটা রয়েছে। কাগজটার ওপর কালো কালিতে লেখা—’সেনাপতি রোমেলের মহাসমর (EPIC = মহাকাব্য। আন্দাজ করা গেল আজ প্রচুর দুর্ভোগ আছে।

কল্যাণ আমার কানে মুখ গুঁজে ফিসফিস করে বলল, ‘পরোটা রসগোল্লার ঠ্যালা এবার সামলা।’

‘আমি উত্তর দিলাম না।

ঝানু ইতিমধ্যে বাক্সটা মসজিদের সামনে রেখে ফিরে এসেছিল। উমাপতি তাকে বললেন, ‘যা, এবার একটা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে ওখানে রেখে আয়।’

চার নম্বর হুকুমটি সুচারু রূপে পালন করার পরঝানু চলে গেল। উমাপতি চাকলাদার এতক্ষণে আমাদের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। ‘এবার একটু কষ্ট করে ওখানে যাওয়া যাক। কিছুক্ষণ কাব্যচর্চা করে সন্ধেটা কাটাই।’

বধ্যভূমিতে পশুদের যেভাবে নিয়ে যাওয়া হয়, অবিকল সেইভাবে উমাপতির পেছন পেছন শোভাযাত্রা করে আমরা ভাঙা মসজিদের সামনের ঘাসের জমিটায় চলে এলাম। কে জানত এটাকে শোভাযাত্রা নয়, শোকযাত্রা বলাই ভালো।

উমাপতি আমাদের দু’জনকে বললেন, ‘বোসো, বোসো—’কল্পতরু সমাদ্দারদেরও হাত নেড়ে বসতে বললেন।

এর মধ্যে সূর্য ডুবে গেছে। সন্ধে নামতে শুরু করেছে। চারিদিক ঝাপসা ঝাপসা।

প্রকাণ্ড বাক্সটার ওপর হ্যারিকেনটা জ্বলছে। উমাপতি সেটার ওধারে বেশ আসনপিড়ি জাঁকিয়ে বসলেন। এধারে একপাশে কল্পতরু সমাদ্দার আর আমি বসলাম। আরেক পাশে বসলেন রামগোপালবাবু আর নরেশ্বর বাবু।

উমাপতি চাকলাদার কল্যাণ আর আমাকে তাক করে বললেন, ‘আমি তোমাদের এখন যা বলব সেসব কল্পতরুবাবুরা জানেন। তোমরা মন দিয়ে শোনো। সবাই বলে এই যুগটা হল লিরিক মানে গীতিকবিতার যুগ। ছোট ছোট প্যানপেনে সব কবিতা। আজকাল নাকি মহাকাব্য লেখা সম্ভব নয়। তার কারণ একালে রাম রাবণের যুদ্ধ, কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ, ট্রোজান ওয়ার—এইরকম মহা মহা যুদ্ধ হয় না। কিন্তু আমি বলি মহাকাব্য লেখার মতো প্রচুর মালমশলা আমাদের এযুগেও রয়েছে এই তো কয়েক বছর আগে সারা পৃথিবী জুড়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ হয়ে গেল। তাতে পাঁচ কোটি মানুষ মারা গেছে। রামরাবণের যুদ্ধ বা কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ এর তুলনায় তুচ্ছ। রামের মতো, অর্জুনের মতো বীর একালেও রয়েছে।’ বলতে বলতে ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে গলার পর্দার কণ্ঠস্বর কয়েক পর্দা চড়িয়ে দিলেন, ‘যেমন ধর, সেকেন্ড গ্রেট ওয়ারে জার্মান সেনাপতি রোমেল। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সে যে লড়াইটা করেছিল তা অমর করে রাখার জন্যে আমি একটা এপিক লিখেছি। এই মহাকাব্য একশো আট ক্যান্টোতে সাড়ে তিন হাজার পাতায় শেষ হবে। তার মধ্যে আটাত্তরটা ক্যান্টো শেষ করেছি। এখন পর্যন্ত দু’হাজার সাতশো পাতা লেখা হয়েছে। জোর দিয়ে বলছি, পুরোটা লেখা হলে রামায়ণ মহাভারত ইলিয়াড অডিসির মতো শত শত বছর ধরে লোকে তা পড়বে। তা হলে শুরু করা যাক।’ কবিতা শুনতে চেয়েছিলাম। উমাপতি চাকলাদার কিঞ্চিৎ গাঁইগুঁই করে তাতেই রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু কবিতা মানে যে সাড়ে তিন হাজার পাতার গন্ধমাদন পাহাড়, তা দেখার মতো দূরদৃষ্টি আমাদের ছিল না। বুকের ভেতর হৃদপিন্ডটা দুরু দুরু করতে লাগল।

কল্পতরু সমাদ্দার প্রবল উৎসাহে বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, শুরু করে দিন। শুভকাজে দেরি করতে নেই।’

উমাপতি টিনের তোরঙ্গটা খুলে মহাকাব্যের ঢাউস পান্ডুলিপি বের করে সেটার ওপর রেখে হ্যারিকেনের তেজ বাড়িয়ে পড়তে শুরু করলেন :

‘রোমেলের তুল্য বীর ধরাতলে নাই।

মহাকাব্যে তার কথা লিখে দিয়ে যাই।

এমন বীরের কথা যে জন শুনিবে,

দেহে আর মনে সে জন শক্তি লভিবে।

রোমেলের কথা ভাই অমৃত সমান।

দীন উমাপতি ভনে, শুনে জ্ঞানবান।

পাঁচ ছয় পাতা পড়ার পর আচমকা কল্পতরু সমাদ্দার চিড়িক মেরে উঠে পড়লেন। বললেন, ‘মাপ করবেন উমাপতিদা, আমি আর বসতে পারছি না। আসানসোল থেকে আমার মেজো জামাইয়ের আসার কথা। এতক্ষণে হয়তো চলেও এসেছে। এমন অমৃতসমান মহাকাব্য শোনা হল না। বড় আপশোশ হচ্ছে। কী আর করব, উপায় নেই। জামাই বলে কথা। যাচ্ছি—’ উমাপতিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে তিনি বিদায় নিলেন।

কিছুক্ষণ মুহ্যমানের মতো বসে রইলেন উমাপতি। তারপর নতুন উদ্যমে মহাকাব্য পাঠ শুরু হল।

আরও দশ বারো পাতা পড়ার পর হঠাৎ ভূগোলের টিচার রামগোপাল বাবুর কিছু মনে পড়ে গেল। হাঁটুতে ভর দিয়ে হাঁকপাঁক করতে করতে উঠে দাঁড়ালেন। কাঁচুমাচু মুখে বললেন, ‘এই রে, ছেলের জন্যে ওষুধ কিনতে বেরিয়েছিলাম। এমন চমৎকার মহাকাব্য শুনতে শুনতে একেবারেই মনে ছিল না, আজ আমাকে ছেড়ে দিন উমাপতিদা—’

লক্ষ করলাম পরোটা আলুর দমটম খাওয়ার সময় জামাইয়ের আগমন, ছেলের জন্য ওষুধ ইত্যাদি জরুরি ব্যাপারগুলো কারও মাথায় ছিল না।

যাই হোক পাঁচ শো গ্রাম চিরতার জল খাওয়ার মতো মুখ করে উমাপতি বললেন, ‘আপনিও তা হলে চললেন। ঠিক আছে, যান। ছেলের অসুখ হলে কী আর করা যাবে—’

রামগোপালবাবু কী যেন আন্দাজ করে দ্রুত পকেট হাতড়ে দলাপাকানো কাগজ বের করলেন। তাতে কী লেখা আছে, কে জানে। উনি বললেন, ‘আপনি হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করলেন না কিন্তু এই দেখুন প্রেসক্রিপশন।’

উমাপতি বেজায় বিরক্ত হয়ে বিড় বিড় করতে লাগলেন, ‘কবেকার প্রেসক্রিপশন, কে জানে। দেখতে চেয়ে আপনাকে বিপদে ফেলব না। আচ্ছা, যান—’

রামগোপাল আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ালেন না। সট করে সরে পড়লেন।

উমাপতির বিড়বিড়ানি চলছিল। আপন মনেই বললেন, ‘দু’জন খসে গেল। যাক, আরও তিনজন তো আছে। কিন্তু নরেশ্বরটা বদ্ধ কালা, কিছুই শুনতে পায় না। না শুনতে পাক, সে চলে গেলে আসরটা ফাঁকা ফাঁকা হয়ে যাবে। বলেই আবার শুরু করলেন।

‘রোমেলের কথা ভাই মহিমায় ভরা

যেজন শুনিতে চাও, চলে এসো ত্বরা।’

শুনতে শুনতে আমার দিকে ঘন হয়ে এসে আবার ফিস ফিস করতে লাগল, ‘রোমেলের মহিমা আর কত শুনবি! পরোটা রসগোল্লা টোল্লার মহিমা কেমন সেটা বুঝতে পারছিস।’

কী উত্তরই বা দেব। যা ফাঁদে পড়ে গেছি, কখন যে মুক্তি পাব, কে জানে। চুপ করে রইলাম।

ঝড়ের বেগে মহাকাব্য পাঠ চলছে। চোখে পড়ল বদ্ধ কালা নরেশ্বর নন্দী তারিফের ভঙ্গিতে সমানে মাথা নেড়ে চলেছেন। মহাকাব্য পড়ার শুরু থেকেই তাঁর মাথা ডাইনে—বাঁয়ে সমানে নড়ে চলেছে। তিনি কী শুনতে পাচ্ছেন, তিনিই জানেন। উমাপতি চাকলাদার একজন সমঝদার জুটিয়েছেন বটে।

আশি নব্বই পাতা পড়া হয়ে যাবার পর কলাণ আর আমি উসখুস করতে লাগলাম। এদিকে বেশ রাত হয়ে গেছে। নতুন রক্তের স্বাদ পেয়ে গড়িয়ার দেড় দু’কোটি মশা তখন আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

খুব সহজে উমাপতি চাঁকলাদারের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। আমরা উঠে দৌড় লাগাব কিনা তার প্ল্যান করছি।

উমাপতি বোধ হয় মুখ দেখে মনের কথা পড়তে পারেন। মহাকাব্য পড়তে পড়তেই নিজের দুই হাত দু’দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আমার আর কল্যাণের হাত বজ্রমুষ্টিতে ধরে ফেললেন। আমরা হাত ছাড়িয়ে নেবার জন্য টানাটানি করতে লাগলাম। কিন্তু ছাড়ানো যাচ্ছে না। উমাপতির হাত আমাদের কবজির ওপর সাঁড়াশির মতো চেপে বসেছে। আমরা প্রাণপণে হাত ছাড়াতে চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছি। এই অবস্থাতেই জেট প্লেনের গতিতে রোমেল চরিত পড়া চলছে।

টানাটানিতে কিভাবে যেন উমাপতির মুঠোটা একটু আলগা হয়ে গিয়েছিল। তারপরেই দেখলাম কল্যাণ আমার পাশে নেই। একটা সাদা ট্রাউজার সামনের কালভার্টের ওপর দিয়ে উল্কার গতিতে উধাও হয়ে গেল। উমাপতি পড়তে পড়তেই বললেন, ‘আরও একজন খসে পড়ল।’

আমি এবার কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললাম, ‘দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন। অনেক রাত হয়ে গেছে।’

উমাপতি আমার কান্নাকাটি উড়িয়ে দিলেন, ‘কোথায় রাত? সবে সাড়ে সাতটা। এই ক্যান্টোটা শেষ করে নিই। তারপর তোমাকে ছেড়ে দেবো।’

‘বাড়িতে খুব বকাবকি করবে। কাল কলেজ আছে।’

‘আমি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসব। কেউ বকবে না।’

‘আপনার সামনে কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু চলে এলেই একটানা বকুনি চলবে। আপনি আমাদের বাড়ির লোকজনকে চেনেন না।’

ঘোর অনিচ্ছায় বেজার মুখে উমাপতি আমাকে ছেড়ে দিলেন। আমি এক দৌড়ে বড় রাস্তায় এসে দেখলাম কল্যাণ দাঁড়িয়ে আছে। সে বলল, ‘কলকাতার এদিকটায় আর কখনও আসবি?’

তখন আমি হাঁপাচ্ছি। বললাম, ‘নেভার।’

‘সব সময় মনে রাখবি, মহাকবি উমাপতি চাকলাদার এখানে থাকেন।

ছ’নম্বর বাস চলে এসেছিল। আমরা উঠে পড়লাম।

এরপর ছ’সাত বছর কেটে গেছে। আমি তখন লেখালেখি শুরু করে দিয়েছি। নামকরা পত্রপত্রিকায় গল্প—উপন্যাস বেরোচ্ছে। দু’তিনটে বইও বাজারে বেরিয়ে গেছে। এই সময় একদিন সার্দান অ্যাভেনিউতে এক বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি, হঠাৎ পেছন দিক থেকে কাঁধের ওপর কার হাত পড়তেই ঘুরে দাঁড়িয়ে চমকে উঠলাম। অন্য কেউ নয়, স্বয়ং উমাপতি চাকলাদার। হেসে হেসে তিনি বললেন, ‘অনেকদিন পর তোমার সঙ্গে দেখা হল। তবে তোমার সব খবরই আমি রাখি। তুমি তো এখন ফেমাস লোক একটু থেমে শুরু করলেন, ‘যেখানে যে লেখা তোমার বেরোয়, খুঁজে খুঁজে সব পড়ি। তুমি আমাদের গর্ব।’

বিব্রতভাবে বললাম, ‘এসব বললে আমি কিন্তু খুব লজ্জা পাবো।’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। সেই যে আমার মহাকাব্য শুনতে শুনতে পালালে, তারপর কতদিন পার হয়ে গেছে বল তো?’

‘ছ’সাত বছর হবে।’

‘এতকাল পর দেখা। আজ কিন্তু তোমাকে ছাড়ছি না।

আঁতকে উঠলাম। মেরুদন্ডের ভেতর দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল যেন। বুকের ভেতর ধাঁই ধাঁই হাতুড়ির ঘা পড়তে লাগল। উমাপতি যখন আমাকে ধরতে পেরেছেন তখন নিশ্চয়ই গল্প উপন্যাস বা মহাকাব্যের বাকি অংশটা শোনাবার মতলব করছেন। চোখের পলকে সারা মুখে অসহ্য যন্ত্রণার ছাপ ফুটিয়ে বললাম, ‘ক’দিন ধরে পেটে অসহ্য পেইন হচ্ছে।’ মাঝে মাঝে একটু কমে, তারপরেই চাড়া দিয়ে ওঠে।’

উমাপতি করুণ হেসে বললেন, ‘আমাকে দেখলেই সবার মুখে প্রায় এক কথা। তোমার মতো কারও পেটের যন্ত্রণা, কারও বাতের ব্যথা চাড়া দিয়ে ওঠে, কারও গা ম্যাজমেজ, নার্ভের পেন। আরে বাবা, আমি তোমাকে কিছু শোনাতে চাই না। শুধু তোমার সঙ্গে একটু পরামর্শ করতে চাই।’

এক হিসেবে এটা মন্দের ভালো। অন্তত উমাপতির ভয়াবহ মহাকাব্য বা মহা উপন্যাস শুনতে হবে না। বললাম, ‘আচ্ছা একদিন আপনার বাড়ি যাব।

‘তোমাকে ছেড়ে দিলে আর গেছ আমার বাড়ি। পরামর্শটা আজই করে নিতে চাই। খুব জরুরি ব্যাপার। চল, চল, লেকের ধারে গিয়ে জুত করে বসা যাক।’

একরকম টেনে হেঁচড়ে উমাপতি আমাকে লেকের পাড়ে নিয়ে গেলেন। পাশে বসে বললেন, ‘ছ’সাত বছর পর তোমার দর্শন পেলাম। এর মধ্যে কী কী করেছি সেই খবরটা আগে দেওয়া যাক। আরও ষোলোটা উপন্যাস, তিনটে মহাকাব্য দেড়শো ছোটগল্প লিখেছি। তা ছাড়া আগে যা লিখে রেখেছি তুমি তা জানো।’

তাঁর কথা শুনতে শুনতে চমকে চমকে উঠছিলাম। ঢোঁক গিলে বললাম, ‘জানি তো।’

আরেকটু ঘন হয়ে এলেন উমাপতি।’ ‘তোমার তো অনেকের সঙ্গে জানাশোনা। পাবলিশার আর পত্র—পত্রিকার সম্পাদকরা তোমাকে কত খাতির করে। তাদের বলে কয়ে আমার মহাকাব্য, উপন্যাস, গল্পগুলোর একটা হিল্লে করে দাও।’ তুমি তাঁদের বললেই কাজটা হয়ে যাবে।’

তাঁর অমর সৃষ্টিগুলো চোখে দেখামাত্র সম্পাদক আর প্রকাশকদের যে হিক্কা উঠে যাবে তা কি আর জানি না। কিন্তু উমাপতি চাকলাদারের হাত থেকে রক্ষা তো পেতে হবে। চোখ বুজে কয়েকজন বাঘা বাঘা সম্পাদক আর প্রকাশকের নাম গড়গড় করে বলে দিলাম। ‘এঁদের সঙ্গে দেখা করবেন—’

‘তুমি আমাকে তাঁদের কাছে পাঠিয়েছ, এটা বলব তো? ব্যাকুলভাবে উমাপতি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

আমি একেবারে মরিয়া। ‘তাই বলবেন।’

‘কাজটা ঠিক হয়ে যাবে তো?’

‘গিয়ে দেখাই করুন না।’

‘তুমি যখন ভরসা দিয়েছ আর চিন্তা নেই। হা—হা—’ উমাপতি চাকলাদার দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে দিয়ে হেসে উঠলেন।

‘আমার একটা আর্জেন্ট কাজ আছে’, বলে চোখের পলকে উঠে পড়লাম।

পরে ওই সব পত্রপত্রিকার সম্পাদক আর প্রকাশকদের সঙ্গে যখন দেখা হল, তাঁদের সবার গলায় এক সুর—’আপনার সঙ্গে আমাদের তো কোনও শত্রুতা ছিল না ভাই। তা হলে উমাপতি চাকলাদারকে আমাদের পেছনে লেলিয়ে দিলেন কেন?’

উমাপতি চাকলাদারের যাবতীয় কীর্তিকাহিনি জানিয়ে দিয়ে বললাম, ‘নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে এছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না।’

সম্পাদক এবং প্রকাশকরা হো হো করে হাসতে লাগলেন। হাসির তোড় কমে এলে একে একে সবাই জানিয়ে দেন উমাপতির বিশাল বিশাল পান্ডুলিপি দেখে তৎক্ষণাৎ তাঁকে বিদায় করে দিয়েছেন।

দেখতে দেখতে আরও কয়েকটা বছর কেটে যায়। আমি এখন একটা নামকরা দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যবিভাগের সম্পাদক। সারাদিন ঘাঁড় গুঁজে নানারকম লেখা পড়ে সেসবের ভেতর থেকে আমাদের কাগজের ছাপার যোগ্য গল্প প্রবন্ধ ইত্যাদি বেছে নিয়ে বাকি সব বাতিল করে দিই।

একদিন অফিসে আমার দপ্তরে বসে কাজ করছি, উমাপতি চাকলাদারের আবির্ভাব ঘটল। এখন তাঁর বেশ বয়স হয়েছে। প্রায় চুয়াত্তর পঁচাত্তর হবে। তাঁর টাকের চারপাশে রেলিংয়ের মতো যেসব চুলের ঘের ছিল তার একটিও কালো নেই। শরীরের চামড়া কুঁচকে গেছে। ছানি কাটানো চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা।

উমাপতি খুশিতে ডগমগ হয়ে বললেন, ‘খবর পেলাম তুমি ডেইলি ‘নতুন বাংলা’ পত্রিকার রবিবারের ম্যাগাজিনের এডিটর হয়েছ। শুনেই লাফাতে লাফাতে চলে এলাম। আহা, ইহ জীবনে এর চাইতে ভালো খবর দু’একটার বেশি পাইনি।’

আমার বুকের ভেতরটা মহা আশঙ্কায় কাঁপতে লাগল। ঢোঁক গিলতে গিলতে বললাম, ‘আপনি ভালো আছেন তো?’

‘সম্পাদকের দপ্তর, প্রকাশকদের অফিসে লাস্ট পঁঞ্চাশ বছর ঢুঁ মারতে মারতে জীবনী শক্তি প্রায় ক্ষয়ে গিয়েছিল। বড়ই কাহিল হয়ে পড়েছিলাম। মনে হচ্ছিল অনন্ত হতাশা নিয়ে শেষ নিশ্বাসটি ত্যাগ করে এই পৃথিবী থেকে চলে যাব। আজ তোমাকে এখানে পেয়ে বয়েসটা এক ধাক্কায় চল্লিশ বছর কমে গেছে। কী আনন্দ যে হচ্ছে, বলে বোঝাতে পারব না। টগবগে ইয়াং ম্যানদের মতো উৎসাহ পাচ্ছি।’

ওঁর বয়স চল্লিশ বছর কমে গেছে কিন্তু উনি কি টের পাচ্ছেন আমার বয়েসটা হঠাৎ ষাট বছর বেড়ে গেছে? নির্জীব গলায় বললাম, ‘বসুন। চা আনাই?’

ঝপ করে আমার টেবিলের ওধারে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন উমাপতি। বললেন, ‘শুধু চা কেন, যা খাওয়াবে তাই খাব।’

বেয়ারাকে দিয়ে চা এবং কাঁচাগোল্লা আনালাম। কলকাতার যে এলাকায় আমাদের অফিস সেটা হল নানা ধরনের মিষ্টির জন্য বিখ্যাত। সন্দেশ, রসগোল্লা, চমচম, কাঁচাগোল্লা, ছানার গজা ইত্যাদি ইত্যাদির নন্দন কাননই বলা যায়।

খেতে খেতে বিপুল উৎসাহে গল্প জুড়ে দিলেন উমাপতি। তিনিই তোড়ে বলে যাচ্ছেন। আমি মরণাপন্ন রোগীর মতো ক্ষীণ গলায় হুঁ হাঁ করে যাচ্ছি।

প্রায় ঘণ্টাখানেক কথার তুবড়ি চালাবার পর একটু থেমে নতুন এনার্জি নিয়ে উমাপতি বললেন, ‘তোমার কাছে ভাই অনন্ত আশা নিয়ে এসেছি। তিয়াত্তর বছর বয়েস হল। বিয়ের ক’টা পদ্য ছাড়া আমার লেখা একটি শব্দও ছাপা হয়নি। আমার পাঁচটা লেখার ম্যানাসক্রিপ্ট নিয়ে এসেছি। একে একে আরও নিয়ে আসব। একটু গতি করে দাও ভাই।’

তিনি যে সঙ্গে করে পেল্লায় চটের ব্যাগে তাঁর গল্প উপন্যাস নিয়ে এসেছিলেন আগে লক্ষ করিনি। এবার তিনি ব্যাগটার ভেতর থেকে এক গোছা কবিতা, একটা দেড় কেজি ওজনের উপন্যাস আর কেজি পাঁচেক ওজনের মহাকাব্যের পান্ডুলিপি বের করে হাসি হাসি মুখে টেবিলের ওপর রেখে বললেন, ‘এগুলো ধারাবাহিক ভাবে তোমাদের কাগজে ছেপে দিও। দেখবে কী আলোড়নটা না পড়ে যায়—’ বলে হেলেদুলে তিনি চলে গেলেন।

উমাপতিকে টানা কয়েক বছর পর দেখেই আমার হৃৎকম্প শুরু হয়েছিল। ধাতস্থ হতে পাক্কা আধঘণ্টা সময় লাগল। পাহাড়প্রমাণ পাণ্ডুলিপিগুলোর দিকে আঙুল বাড়িয়ে বেয়ারাকে বললাম, ‘এগুলো ডান দিকের আলমারির মাথায় তুলে রাখো।’

মাস দেড়েক বাদে ফের আমার হৃদকম্পন দশগুণ বাড়িয়ে উমাপতি চাকলাদারের ফের আবির্ভাব ঘটল। বললেন, ‘কী হল, আমার লেখা একটা অক্ষরও তো ছাপা হয়ে বেরুল না।’

ইশারা করতে বেয়ারা আলমারির মাথা থেকে সেইসব অবিনশ্বর সৃষ্টি নামিয়ে এনে টেবিলের ওপর রেখে দিল। স্থির দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ সেগুলো দেখলেন উমাপতি। তারপর মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। ‘এগুলো মানে—’

কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, মানে—মানে—

‘বুঝতে পেরেছি।’ আজও তিনি একটা চটের ব্যাগ নিয়ে এসেছিলেন। মহাকাব্য মহাউপন্যাস ব্যাগে পুরে দরজার দিকে কয়েক পা গিয়ে ফিরে এলেন। বললেন, ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব। ঠিক ঠিক উত্তর দেবে?’

‘কী কথা?’

‘আমার এই লেখাগুলোর একটা অক্ষরও ছাপার যোগ্য নয়—কী বল?’

কী জবাব দেব, ভেবে পেলাম না। মাথা নীচু করে বসে রইলাম।

‘সারা জীবন বোধহয় দিস্তা দিস্তা কাগজ লিখে পণ্ডশ্রমই করে গেলাম।’ উমাপতি চাকলাদারের কথাগুলো এবার হাহাকারের মতো শোনালো।

আমি নিরুত্তর। হেঁটমুন্ডেই বসে থাকি। যখন মুখ তুললাম উমাপতি চাকলাদার ঘরে নেই। কখন অদৃশ্য হয়ে গেছেন টের পাইনি। এ জীবনে তাঁর সঙ্গে আর দেখা হয়নি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *