কফিন

কফিন

গণেশ কানোরিয়া ছুরিটা শোকেসের বাইরে বের করে বললেন, এই দেখুন, এর হাতলে ফার্সি ভাষায় একটা শব্দ লেখা আছে, ‘বাবুর’। অর্থাৎ সম্রাট বাবরের নাম। বাবরের সেনাপতিরা তাঁর নামাঙ্কিত এই ছবি ব্যবহার করতেন। আর ওই যে, ওই পাশের বাক্সে লম্বা নলওয়ালা দোনলা পিস্তলটা দেখছেন, ওটা ক্লাইভের আমলের। এখনও কিন্তু কর্মক্ষম ওটা। অর্থাৎ গুলি ছোড়া যায়।

পীযূষ বলল, ‘ছুরিটা একটু হাতে ধরে দেখব?

কানোরিয়া ছুরিটা তার হাতে দিয়ে বললেন, তবে এগুলো সবই ইনসিওর করা অন্য কোম্পানির থেকে, চার লাখে।

ছুরিটা হাতে নিয়ে বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করল পীযূষ। কত প্রাচীন জিনিস! কে বলতে পারে, স্বয়ং বাবর-ই হয়তো এটা তুলে দিয়েছিলেন তার কোনও অনুচরের হাতে! ছুরিটা ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখে পীযূষ মিস্টার কানোরিয়ার হাতে ফেরত দিল সেটা। কানোরিয়া ছুরিটাকে যথাস্থানে রেখে পীযূষকে বললেন, চলুন, এবার যে-জিনিসটা দেখবেন বলে এসেছেন সেটা দেখাই।

দোতলাতে একটা কাঠের রেলিং ঘেরা লম্বা বারান্দা। সেই বারান্দা দিয়ে কানোরিয়ার পিছন পিছন গিয়ে একটা ঘরের সামনে হাজির হল পীযূষ। কানোরিয়া চাবি দিয়ে ঘরের দরজা খুলে দেওয়াল হাতড়ে খুট করে সুইচ টিপলেন। বড় ঘরটার মাথার ওপর থেকে একটা ঝুলন্ত বাতি জ্বলে উঠল, আর তার আলো এসে পড়ল ঘরের ঠিক মাঝখানে রাখা লম্বাটে ধরনের বিরাট একটা কাচের বাক্সর ওপর।

কানোরিয়ার সঙ্গে গিয়ে পীযূষ দাঁড়াল সেই কাচের বাক্সর সামনে। আর ভিতরে রাখা আছে মানবদেহাকৃতির একটা অতি প্রাচীন কাঠের কফিন। তার মধ্যে শায়িত বিবর্ণ ব্যান্ডেজ-মোড়া একটা মমি। তার মুখটা ঢাকা আছে বহু প্রাচীন এক কাঠের মুখোশে।

ছেলেবেলাতে কলকাতার জাদুঘরে ঠিক এমনই একটা মমি দেখেছিল পীযূষ। মমিটার দিকে তাকিয়ে পীযূষ প্রশ্ন করল, এটা কি ইজিপ্ট থেকে এনেছেন?

কানোরিয়া তাঁর টাইয়ের নট ঠিক করতে করতে বললেন, জিনিসটা ইজিপ্টের হলেও আমি এটা সংগ্রহ করেছি লন্ডনের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। ইজিপ্টে এখন এসব জিনিস বেচাকেনা নিষিদ্ধ। তবে ষাট-সত্তর বছর আগেও ইজিপ্ট থেকে মমি কিনে নিয়ে যাওয়া হত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, ঘর সাজাবার জন্য। বিশেষত, ফ্রান্স আর ইংলন্ডে। আমার এই বাগানের দার্জিলিং চা লন্ডনে যায়। তাই ব্যবসাসূত্রে আমাকে লন্ডনে যেতে হয়। সেখানেই এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের থেকে এক লাখ পাউন্ড, মানে সত্তর লাখ টাকায় কিনেছি এটা আমার এখনও পর্যন্ত সংগ্রহ করা সবচেয়ে বেশি দামের জিনিস। এই দার্জিলিং-এ তো বহু টুরিস্ট আসে। ভবিষ্যতে ভাবছি আমার সংগ্রহগুলো নিয়ে এখানে একটা মিউজিয়াম বানাব।

পীযূষের এই মমিটা দেখতে কলকাতা থেকে দার্জিলিং-এ ছুটে আসার পিছনে বিশেষ কারণ আছে। পীযূষ একটা ইনসিওরেন্স অর্থাৎ বিমা কোম্পানির অফিসার। কিছুদিন আগে টি এস্টেটের মালিক বিখ্যাত ব্যবসায়ী মিস্টার কানোরিয়া খবরের কাগজে এই মর্মে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন যে, তিনি তাঁর একটি ব্যক্তিগত জিনিস ইনসিওর করাতে চান।

বিজ্ঞাপনটা দেখে সাতদিন আগে পীযূষদের কোম্পানি আর একজন ইনসিওরেন্স অফিসার সান্যালবাবুকে পাঠিয়েছিল এখানে। তখন অবশ্য কোম্পানি বা সান্যালবাবু জানতেন না যে কি জিনিস বিমা করাতে চাইছেন মিস্টার কানোরিয়া। জিনিসটা দেখে কলকাতায় ফিরে যাবার পর তিনি আর এখানে আসতে চাননি। সান্যালবাবু একটু কুসংস্কারগ্রস্ত মানুষ। তিনি পীযূষকে বলেছিলেন, তুমি এ-ব্যাপারটা সামলাও। আমি শুনেছি এসব মমি-টমির সঙ্গে অনেক সময় নানা অভিশাপ জড়িয়ে থাকে। যারা এসব জিনিস নিয়ে কাজ করে তাদের ক্ষতি হয়। ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করি, শেষে কোথা থেকে কী হয়ে যাবে। তাছাড়া…

তাছাড়া কী? জানতে চেয়েছিল পীযূষ।

তার প্রশ্ন শুনে সান্যালবাবু বললেন, আমাকে নিয়ে তো কানোরিয়া মমিটার ঘরে ঢুকল। মমিটার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছি এমন সময় একটা ফোন এল কানোরিয়ার। কলটা রিসিভ করার জন্য আমাকে ঘরে রেখে বাইরে গেলেন তিনি। একলা ঘরে আমি। মাথার ওপর ঝুলন্ত বাতিটা দুলছে। তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না ভাই, আমি দেখলাম মমিটা নড়ে উঠল! একবার নয়, পরপর দুবার! কানোরিয়াকে কিছু না বললেও সেটা দেখেই সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেছিলাম।

সান্যালবাবুর কথা শুনে পীযুষ হেসে বলেছিল, ঠিক আছে, আপনাকে যেতে হবে না। আমিই সামাল দিচ্ছি ব্যাপারটা।

বলেছিল তার পিছনে কারণ আছে। দামি জিনিস বিমা করালে তার জন্যে মোটা অঙ্কের প্রিমিয়াম বা টাকা দিতে হবে কানোরিয়াকে। আর তার থেকে কমিশন বাবদ বেশ ভালোরকম টাকাও পাবে পীযূষ। তাদের কোম্পানি ব্যাপারটা নিয়ে আগ্রহী। যদিও ইতিপূর্বে এ ধরনের কোনও জিনিসের বিমা করায়নি কোম্পানি। এসব জিনিসের মূল্য নির্ধারণের জন্য বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হয়। তবে মমি তো আর ঘরবাড়ি-সোনা-জহরত নয়, তাই তার মূল্য নির্ধারণের জন্য লোক কোথায় পাওয়া যাবে সে ব্যাপারে খোঁজ চালাচ্ছে পীযূষের কোম্পানি।

মমিটার দিকে তাকিয়ে সান্যালবাবুর কথাটা আবার মনে পড়ে গেল পীযূষের, ‘আমি দেখলাম মমিটা নড়ে উঠল! একবার নয়, পরপর দু-বার!’

কথাটা মনে পড়তেই মনে মনে আরও একবার হাসল পীযূষ। তারপর আরো ভালো করে সেটা দেখার জন্যে কাচের আধারের ওপর ঝুঁকে পড়ল।

কানোরিয়া বললেন, এ জিনিসটা কিন্তু আপনাকে খুলে দেখানো যাবে না। কারণ, আপনি হয়তো জানেন যে, এসব জিনিস খোলা বাতাসে থাকলে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবে নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। তাই সিল করা কাচের বাক্সে রাখতে হয়।

মমিটাকে ওপর ওপর দেখে পীযূষ আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল। কানোরিয়া বললেন, এবার বলুন, আপনার কোম্পানি কি বিমা করবে ওটার? দশবছরের বিমার জন্য আ!মে এককালীন দু-লাখ টাকা দেব।

পীযূষ বলল, আমাদের কোম্পানি ব্যাপারটা নিয়ে আগ্রহী। কিন্তু মমিটার মূল্য নির্ধারণের জন্য আমাদের একজন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন। আমাদের একটু সময় দিতে হবে, অন্তত সপ্তাহখানেক।

কথাটা শুনে কানোরিয়া বললেন, অতটা সময় দেওয়া যাবে না আপনাদের। এমনিতে সপ্তাহখানেক সময় কেটে গেছে। পরশুই আমি ব্যবসার কাজে বিদেশে রওনা হব। ফিরতে দু-তিনমাসও লাগতে পারে। আপনি কালকের মধ্যে চুক্তি না করালে আমি আমার আগের ইনসিওরেন্স কোম্পানিকেই ডাকব। ওরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগও করেছে। বললেই চুক্তিপত্র নিয়ে চলে আসবে।

পীযূষ বললেন, কিছু না মনে করলে একটা প্রশ্ন করতে চাই। ওরা তো আপনার জন্য জিনিসগুলোর বিমা করেছে। তবে আপনি আবার বিমা করানোর জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিলেন কেন?

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে কানোরিয়া বললেন, ‘মাস দুয়েক আগে কলকাতায় আমার একটা গাড়ি চুরি হয়েছিল। সেটাও ওদের কাছে ইনসিওর করা ছিল। কিন্তু বিমার টাকাটা পেতে বেশ কিছুটা বেগ পেতে হয়েছিল আমাকে। তাই ওদের ওপর আমি একটু অসন্তুষ্ট। যদিও কোম্পানির পক্ষ থেকে পরবর্তীকালে আমার হয়রানির জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে এখন আপনারা যদি মমিটা বিমা করাতে রাজি না হন তবে তাদেরকেই ডাকতে হবে।

এবার ব্যাপারটা বোধগম্য হল পীযূষের। সে অবশ্য কানোরিয়ার কথা শুনে ধন্দের মধ্যেও পড়ল। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা হাতছাড়া হয়ে যাবে না তো? কোম্পানি অবশ্য তাকে বলে রেখেছে যে, ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হলে বিমার চুক্তিটা সে করতেই পারে। তাই সঙ্গে করে চুক্তিপত্র নিয়েও এসেছে পীযূষ। সে একটু ভেবে নিয়ে বলল, ঠিক আছে, কাল সকাল পর্যন্ত আমাকে সময় দিন। আপাতত কাছাকাছি একটা হোটেলের ঠিকানা দিন যেখানে রাতে থাকতে পারি।

কানোরিয়া হেসে বললেন, হোটেলের কী দরকার? এই দোতলাতেই আমার একটা গেস্টরুম আছে। সেখানেই রাত্রিবাস করতে পারেন। তবে খাবারটা এ-বাড়ি ছেড়ে কিছুটা দূরে একটা খাবার হোটেল আছে, সেখান থেকে খেয়ে আসতে হবে। কারণ এ-বাংলোর কেয়ারটেকার, দারোয়ান ওদের সবাইকে আমি দু-দিনের জন্যে ছুটি দিয়ে দিয়েছি। সারা বছর তো ওরাই আগলে রাখে বাড়িটা। কাজেই আমি যখন এখানে আসি তখন ওদের ছুটি দিই।

উত্তরে পীযূষ বলল, ঠিক আছে। আমার কোনও আপত্তি নেই।

কানোরিয়া এরপর দোতলারই একটা ঘরে নিয়ে গেলেন তাকে। বেশ ছিমছাম সাজানো ঘর। জানলা খুলতেই পীযূষের চোখে পড়ল চারপাশের ছোট-বড় পাহাড়শ্রেণি। তার ওপর মেঘ ভাসছে। বেলা দুপুর হলেও সূর্যের আলো যেন একটু ম্লান। পাহাড়ে অবশ্য মেঘ-রৌদ্রের খেলা চলে সবসময়। আকাশের দিকে তাকিয়ে কানোরিয়া বললেন, বৃষ্টি আসবে মনে হয়। আমার একটা কাজ আছে। বৃষ্টি নামার আগেই বেরিয়ে পড়তে হবে। সন্ধ্যার আগেই ফিরব। বাড়িতে কেউ নেই। আপনি বাইরে গেলে সদর দরজাতে একটা চাবি সমেত তালা ঝুলছে, সেটা দিয়ে বেরোবেন। যদিও এখানে চোর-ডাকাতের কোনও উপদ্রব নেই। তেমন চিন্তারও কিছু নেই। এই বলে তাকে রেখে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

।।২।।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পীযূষ শুনতে পেল বাইরে কানোরিয়ার গাড়ির শব্দ মিলিয়ে গেল। কানোরিয়ার কাঠের বাড়িটাতে একলা রইল পীযূষ। দার্জিলিং-এ হলেও কানোরিয়ার বাড়িটা শহরের একটু বাইরের দিকে একটা ছোট টিলার ওপর। চারপাশে আর কোনও ঘরবাড়ি নেই। শহরের দিক থেকে একটা সর্পিল রাস্তা এসে এ বাড়িটার কাছেই শেষ হয়েছে। তার একদিকে খাদ আর অন্যদিকে পাহাড়ের ঢালে পাইন আর দেবদারুর বন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে মিনিট কুড়ি হাঁটলে তবে কয়েকটা ঘরবাড়ি আর একটা খাবারের হোটেল আছে। ভাড়া গাড়ি করে এখানে আসার পথে সেগুলো চোখে পড়েছিল পীযূষের।

ঘর ছেড়ে বাইরের কাঠের রেলিং-ঘেরা বারান্দাতে এসে দাঁড়াল পীযূষ। কিছুটা দূরে সেই মমির ঘরটা। অফিসের সান্যালবাবুর কথাটা ভেবে পীযূষ আরও একবার মনে মনে হাসল। চারপাশে এমন নির্জন পরিবেশ, বাড়িটাতেও কোনও লোক নেই। এই পরিবেশে মমিটার সঙ্গে একলা এ-বাড়িতে কিছুতেই থাকতেন না সান্যালবাবু। এ অবস্থায় থাকতে হলে নিশ্চয়ই হার্টফেল করতেন তিনি।

বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে পীযূষ এরপর ভাবতে লাগল, তার কী করা উচিত? বিমাটা কি সে করিয়ে নেবে?

কিছুক্ষণের মধ্যেই পীযূষের চোখের সামনে বাইরের পরিবেশটা কেমন যেন দ্রুত বদলাতে শুরু করল। পাইনবনের মাথার ওপর ভেসে বেড়ানো সাদা তুলোর মতো মেঘগুলো জমাট বাঁধতে শুরু করল। অন্ধকার নামতে শুরু করল চারদিকে। কনকনে ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা এসে লাগল পীযূষের গায়ে। দুলতে শুরু করল পাইন গাছের মাথাগুলো। ঝড়ের পূর্বাভাস। বারান্দায় আর দাঁড়িয়ে থাকা সমীচীন হবে না—মনে করে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল পীযূষ।

আর তারপরই শুরু হল প্রচণ্ড দুর্যোগ। প্রথমে শোঁ শোঁ শব্দে প্রচণ্ড বাতাস বইতে লাগল, আর তারপর তা মারাত্মক ঝড়ের রূপ নিল। থরথর করে কাঁপতে লাগল কাঠের বাড়িটা। ঘরের ভিতরে বসে বাড়ির ভিতরের নানা জায়গা থেকে নানা দুমদাম শব্দ কানে আসতে লাগল তার। হয়তো বা খোলা জানলা-দরজার শব্দ। বাইরে কোথায় যেন মড়মড় করে একটা গাছ ভেঙে পড়ল। কেঁপে উঠল বাড়িটা।

এরপর ঝড় একটু কমল বটে, কিন্তু শুরু হল মুহুর্মুহু বজ্রপাত আর বৃষ্টি। পীযূষের ঘরের ভিতর যে বাতি জ্বলছিল সেটা হঠাৎ নিভে গেল। সম্ভবত কারেন্ট চলে গেল। বাজ পড়ার শব্দে থরথর করে কেঁপে উঠতে লাগল বাড়িটা।

এবার একটু ভয় পেয়ে গেল পীযূষ। না, অন্য কিছুর ভয় নয়; সে ভাবতে লাগল, কাঠের এই বাড়িটা ধসে পড়বে না তো? শেষে একবার প্রচণ্ড জোরে বাজ পড়ল। সম্ভবত সেটা পড়ল বাড়ির গা ঘেঁসেই। আর এতটাই তার অভিঘাত যে, বাড়িটা যেন সেই শব্দে মৃদু দুলে উঠল। কোথায় কী যেন একটা ঝনঝন শব্দে ভেঙে গেল।

এবার স্পষ্টতই আতঙ্ক গ্রাস করল পীযূষকে। সে বুঝে উঠতে পারল না তার কী করা উচিত? ঘরে থাকবে, না বাইরে বেরোবে?

কিন্তু প্রচণ্ড শব্দে সেই শেষ বাজটা পড়ার পরই ধীরে ধীরে সব কিছু শান্ত হয়ে আসতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই যেমন আকস্মিকভাবে দুর্যোগটা এসেছিল, ঠিক তেমনভাবেই তা থেমে গেল। পাহাড়ি অঞ্চলে অবশ্য ঝড়বৃষ্টি এমনই আসে-যায়। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল পীযূষ। এরপর ঘরের ভিতর আরও কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর যখন বাইরের প্রকৃতি একদম শান্ত হয়ে গেল তখন বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে এল সে।

চারদিকে দূর্যোগের স্পষ্ট চিহ্ন ছড়িয়ে আছে। বাড়ির কিছুটা দূরেই দুটো বিরাট পাইনগাছ ভেঙে পড়েছে। বারান্দা বৃষ্টির জলে না ভিজলেও উড়ে-আসা শুকনো পাতার রাশি ছড়িয়ে আছে সারা বারান্দা জুড়ে। বারান্দা লাগোয়া একটা ঘরের জানলার কাচের শার্সি ঝড়ের দাপটে ভেঙে ছড়িয়ে আছে মাটিতে। হয়তো বা এই কাচ ভাঙার শব্দই শুনতে পেয়েছিল সে—মনে মনে ভাবল পীযূষ।

এক সময় বাইরে তাকিয়ে দেখল, পাইনবনের আড়ালে আবার দেখা দিলেন সূর্যদেব। তার আলো এসে ছড়িয়ে পড়ল বারান্দাতে। বিকেল হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। দিনের শেষে আলো ছড়িয়ে পড়েছে দূরের পাহাড়গুলোর ঢালে। ঝড়ের সময় চারপাশটা যত ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল ঠিক ততটাই এখন যেন সুন্দর লাগছে চারদিকের পৃথিবী। তন্ময়ভাবে বেশ কিছুক্ষণ পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে রইল পীযূষ। তারপর তার খেয়াল হল, তাকে খাবার কিনতে যেতে হবে। একটা মোমবাতিও কিনে রাখা ভালো। আলো ফিরবে কিনা তা জানা নেই। তাছাড়া পাহাড়ি অঞ্চলে দ্রুত সন্ধ্যা নামে। জিনিসগুলো কিনে অন্ধকার নামার আগেই ফিরে আসা ভালো। বলা যায় না, হয়তো আবারও ঝড়-বৃষ্টি নামতে পারে। পাহাড়ি অঞ্চলে প্রকৃতির রূপ দ্রুত পাল্টায়।

ভাবনাগুলো মাথায় নিয়ে পীযূষ কিছুক্ষণের মধ্যেই কানোরিয়ার কথামতো বাড়ির সদর দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। নির্জন পথ। মনোরম প্রকৃতি। যদিও রাস্তাটা ঝরাপাতায় ঢাকা। সেই পথে পাকদন্ডী বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে মিনিট পনেরোর মধ্যেই পৌঁছে গেল ছোট জনবসতিটাতে।

রাস্তার গায়ে পাহাড়ের ঢালের নীচে গোটা সাতেক কাঠের বাড়ি। তারই মধ্যে একটা বাড়ি সংলগ্ন ছোট একটা হোটেল আর তার পাশেই একটা ছোট মুদিদোকান। প্রথমে সেই দোকান থেকে একটি মোমবাতি কিনে হোটেলে ঢুকল সে। হোটেলওয়ালা বলল যে, অন্য কিছু খাবার আজ নেই, তবে মিনিট কুড়ি দাঁড়ালে সে রুটি-সবজি বানিয়ে দিতে পারবে।

পীযূষ বলল, ঠিক আছে, তাই বানিয়ে দিন।

লোকটা তার কাজ শুরু করল, আর পীযূষ বসল একটা কেঠো চেয়ারে। রুটি বেলতে বেলতে লোকটা এক সময় জানতে চাইল, আপনি কোথায় এসেছেন? এদিকে তো টুরিস্ট আসে না!

পীযূষ জবাব দিল, আমি টুরিস্ট নই। কানোরিয়া সাহেবের বাংলো চেনেন? ওখানেই এসেছি।

হোটেল মালিক বলল, ‘হ্যাঁ, চিনি। আমি তেমনই আন্দাজ করেছিলাম। ওখান থেকে আপনার মতো এক বাঙালিবাবু আমার এখান থেকে খাবার নিয়ে যেতেন বেশ কয়েকদিন। তবে সপ্তাহখানেক ধরে আর আসছেন না। মনে হয় কলকাতায় ফিরে গেছেন।

মিনিট কুড়ি নয়, আধ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগল তার খাবার বানাতে। খাবার নিয়ে, দাম মিটিয়ে পীযূষ যখন রাস্তায় নামল তখন সূর্য ডুবে গেছে। নির্জন পথ। কুয়াশা আর অন্ধকার নামতে শুরু করেছে পাহাড়ের ঢালে। ফেরার পথ ধরল পীযূষ। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকারে ডুবে যাবে এই পাহাড়ি অঞ্চল। দ্রুত হাঁটতে লাগল সে। অর্ধেক পথ অতিক্রম করার পর হঠাৎ যেন তার পিছনে একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনতে পেল। ভেজা-পাতায় পা ফেলে কেউ হাঁটছে!

কেউ তাকে অনুসরণ করছে কি? কথাটা মনে হতেই ঘুরে দাঁড়াল পীযূষ। দেখল কিছুটা তফাতেই দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক। মাঝবয়সি, শীর্ণ চেহারা। পরনে মলিন একটা পাজামা আর হাফশার্ট। এই ঠান্ডাতেও তার পরনে কোনও শীতবস্ত্র নেই! পীযূষ ফিরে দাঁড়াতেই লোকটা প্রশ্ন করল, আপনি বাঙালি?

—হ্যাঁ। আপনি?

লোকটা হাতজোড় করে নমস্কারের ভঙ্গিতে বলল, আমিও বাঙালি। আমার নাম অবিনাশ বিশ্বাস।

পীযূষ প্রশ্ন করল, আপনি এখানেই থাকেন?

লোকটা বলল, হ্যাঁ। চলুন হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি। অন্ধকার নামলে ফিরতে অসুবিধে হবে আপনার। কী ঝড়টাই না হল। তবে ঝড়টার দরকার ছিল। কিন্তু আবার যদি ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়…

আবার হাঁটতে শুরু করল পীযূষ। আর তার কিছুটা পিছনে সেই লোকটা। একটু এগোবার পরই লোকটা বলল, আপনি তো বিমা কোম্পানির লোক, তাই না?

প্রশ্নটা শুনে বেশ অবাক হয়ে গেল পীযূষ। সে তো নিজের পরিচয় দেয়নি লোকটাকে। হাঁটতে হাঁটতেই বিস্ময়ে পিছনে তাকিয়ে পীযূষ জানতে চাইল, আপনি জানলেন কীভাবে?

লোকটা বলল, আমি জানি। আমি তো কানোরিয়া সাহেবের কাছেই কাজ করি। কানোরিয়া সাহেবের নানা ব্যবসা আছে। হাওড়াতে একটা কাপড়ের ফ্যাক্টরিও আছে। সেখানে কেরানির কাজ করতাম। সাহেব আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন।

ব্যাপারটা এবার বোধগম্য হল পীযূষের। লোকটা হাঁটতে হাঁটতে বলল, হোটেলে খাবার কিনতে গেছিলেন নিশ্চয়ই? আমিও ওখানেই খেতে যেতাম।

পীযুষ আলগোছে জবাব দিল, হ্যাঁ। হোটেলের লোকটা বলছিল বটে যে, একজন বাঙালি খেতে যেত ওখানে।

লোকটা জিগ্যেস করল, বাড়িতে কে কে আছে আপনার?

লোকটা কেমন যেন গায়ে পড়া ধরনের। তবুও পীযূষ ভদ্রতার খাতিরে জবাব দিল, মা-বাবা-ভাইবোন সবাই আছেন।

পীযূষের জবাব শুনে লোকটা বলল, আমারও সবাই আছে। স্ত্রী-বাচ্চাকাচ্চা। তাদের জন্যেই তো, পেটের জন্যেই তো এতদূরে ছুটে আসা।

দ্রুত অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। তবে বাড়িটার বেশ কাছাকাছি পৌঁছে গেছে পীযুষ। কিছুক্ষণ হাঁটার পর লোকটা বলল, আমি জানি কেন আপনি এখানে এসেছেন। ওই মমিটার বিমা করাতে।

লোকটা তবে সব খবরই জানে। আবারও একটু অবাক হল পীযূষ। তবে লোকটার সঙ্গে এ-ব্যাপারে কথা বলা সমীচীন মনে করল না সে। ‘হ্যাঁ’, বলে সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে হাঁটতে লাগল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়িটার কাছাকাছি পৌঁছে গেল পীযূষ। তখন প্রায় পুরোপুরি অন্ধকার নেমে গেছে। ঠিক সেই সময় পিছন থেকে লোকটা বলল, আমি এবার যাই। তবে যাবার আগে আপনার ভালোর জন্য একটা কথা বলে যাই।

এবার পীযূষ ঘুরে দাঁড়াল। তার কয়েক হাত তফাতেই আবছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। পীযূষকে অবাক করে দিয়ে সে বলল, আজ রাতেই মমিটা একবার ভালো করে দেখবেন। তারপর যা সিদ্ধান্ত নেবার তা নেবেন।

—মানে?

—বললাম তো, কানোরিয়া সাহেবকে বলবেন মমিটা আজ রাতেই একবার দেখাতে। তারপর যা সিদ্ধান্ত নেবার তা নেবেন। আপনার ভালোর জন্যই কথাগুলো বললাম।—পীযূষকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল লোকটা।

অদ্ভুত লোক তো! এ-কথা কেন বলে গেল? আর এ-কথাটা বলার জন্যই কি গায়ে পড়ে আলাপ করতে এল সে? মনে মনে ভাবল পীযূষ। ব্যাপারটা বোধগম্য হল না তার। লোকটার কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ির দিকে এগোল। কারেন্ট এখনো আসেনি। অন্ধকারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে কাঠের বাড়িটা। মোম জ্বালিয়ে তালা খুলে দোতলায় উঠে পীযূষ তার ঘরে গিয়ে ঢুকল।

।।৩।।

কানোরিয়া তখনও ফেরেননি। মোম জ্বালিয়ে ঘরে বসে কানোরিয়ার প্রতীক্ষা করতে লাগল পীযূষ। কিন্তু তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকল সেই লোকটার কথাগুলো। লোকটা কি কোনও কারণে ভড়কে দিতে চাইছে তাকে? মমিটা একবার সে দেখতে বলল কোন উদ্দেশ্যে?

বাইরের বারান্দায় হঠাৎ একটা শব্দ শুনতে পেল পীযূষ। শুকনো পাতার ওপর হাঁটার শব্দ। কানোরিয়া কি তবে ফিরে এলেন? হয়তো তার গাড়ির শব্দ খেয়াল করেনি পীযূষ। এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে বারান্দায় উঁকি দিল। শব্দটাও যেন থেমে গেল। ইতিমধ্যে বাইরে চাঁদ উঠতে শুরু করেছে। সে আলোতে বারান্দার শেষ প্রান্ত অবধি আবছা হলেও দেখা যাচ্ছে।

কিন্তু বারান্দাতে কেউ কোথাও নেই! তবে কি শব্দটা মনের ভুল? ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না পীযূষ। আবার দরজা বন্ধ করে খাটে বসল। এরপর ভাবতে লাগল তার কী করা উচিত? বিমাটা করাতে পারলে কমিশন বাবদ বেশ কিছুটা টাকা পকেটে আসবে তার। আর কোম্পানিও খুশি হবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া কাজটা করলে একটা আশঙ্কাও থেকে যায়। পরে হয়তো দেখা গেল যে, জিনিসটার মূল্যই হয়তো অত নয়। তখন কোম্পানির কোনও আর্থিক ক্ষতি হলে তার দায় নিতে হবে পীযূষকে।

কিন্তু এসব ভাবনার মাঝেই পীযূষের মনে পড়ল অবিনাশ বিশ্বাস নামে লোকটার কথা। কেনই বা লোকটা হঠাৎ পথের মাঝে উদয় হল, আর কেনই বা মমিটা তাকে দেখার কথা বলে উধাও হল কে জানে। পীযূষের মনে হল, এমনও হতে পারে যে, লোকটা কোনও বিমা কোম্পানির এজেন্ট। কোনওভাবে সে হয়তো জানতে পেরেছে পীযূষের পরিচয়। তাই পীযূষের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করে বিমাটা নিজেরা করার ধান্দা করছে।

পীযূষ শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিল যে, বিমাটা সে করবে। তবে লোকটা কেন তাকে মমিটা দেখার কথা বলল সেই সন্দেহ নিরসনের জন্য কানোরিয়া সাহেব ফিরলে মমিটা আর একবার সে দেখবে।

সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ খাওয়া সেরে নিল পীযূষ। আর তারপরই সে শুনতে পেল কানোরিয়ার গাড়ির শব্দ।

কানোরিয়ার ওপরে উঠে আসতে অবশ্য আরও আধঘন্টা সময় লাগল। দরজায় নক করার শব্দ শুনে পীযূষ খুলে দেখল কানোরিয়া দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর পরনে ড্রেসিং গাউন। পীযুষকে তিনি বললেন, ঝড়ে রাস্তায় একটা গাছ পড়েছিল। তার জন্যে আটকে ছিলাম বহুক্ষণ। তাই ফিরতে দেরি হল। তারপর ড্রেস চেঞ্জ করে ওপরে এলাম। আপনার কোনও অসুবিধা হয়নি তো?

—না, তেমন কিছু নয়। তবে ঝড়-জলের সময় একটু ভয় পেয়ে গেছিলাম।

কানোরিয়া মৃদু হেসে বললেন, ভূতের ভয় নয় তো? হাজার লোক, মমিটা তো এ-বাড়িতেই আছে।

পীযূষ হেসে জবাব দিল, না স্যার। ওসব আমার নেই। আসলে এত বাজ পড়ছিল যে একটু ভয় লাগছিল।

কানোরিয়া এরপর জানতে চাইলেন, ভাবলেন কিছু? অবশ্য কাল পর্যন্ত ভাবার সময় আছে আপনার।

পীযূষ জবাব দিল, ভেবেছি। বিমাটা করাব আমি। তবে…

বিমাটা পীযূষ করাবে শুনে মৃদু হাসি ফুটে উঠল অখিলেশ কানোরিয়ার মুখে। তিনি বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ। কিন্তু ‘তবে’ কী?

—মমিটা আমি এখন একবার দেখতে চাই।

কানোরিয়া কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ পীযূষের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আপনি তো এসব ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নন। তবে আপনি যখন মমিটা আর একবার দেখতে চান তখন আমার আপত্তি নেই। দাঁড়ান, আমি নীচে গিয়ে চাবি আনি।

মিনিট তিনেকের মধ্যেই চাবি নিয়ে ফিরে এলেন তিনি। বাইরে বেশ বড় চাঁদ উঠেছে। মেঘমুক্ত আকাশ। চাঁদের আলো চুঁইয়ে পড়ছে দূরের পাহাড়গুলোর গা বেয়ে। ঘর থেকে মোমবাতিটা পীযূষকে সঙ্গে নিতে বললেন কানোরিয়া। আলোটা নিয়ে কানোরিয়ার পিছন পিছন বারান্দা ধরে এগোল পীযুষ।

কানোরিয়া এসে দাঁড়ালেন মমির ঘরের বন্ধ দরজার সামনে। চাবি দিয়ে তালাটা খুললেন। তারপর পাল্লাটাও। ঘরের ভিতরে কিন্তু আলো ঢুকছে। বাড়ির পিছনের দিকের একটা গাছ ঝড়ের দাপটে ভেঙে পড়েছে দেওয়ালের পিছন দিকের একটা জানলার ওপর। আর তার আঘাতেই ঘরের ভিতর ছিটকে পড়েছে পাল্লাটা। বাইরের চাঁদের আলো ঘরে ঢুকছে সেখান দিয়ে।

ঘরের ভিতর কানোরিয়া কয়েক পা ঢুকেই আর্তনাদের স্বরে বলে উঠলেন, ও মাই গড!

খোলা জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঠিক যেখানে কাচের বাক্সতে মমিটা থাকার কথা সেখানে। কিন্তু চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে সেই কাচের আধার। জানলার পাল্লাটা তার কিছুটা তফাতে পড়ে। হয়তো তার আঘাতেই অথবা বজ্রপাতের অভিঘাতে ভেঙে গেছে কাচের বাক্সটা। পীযুষের মনে হল, ঝড়বৃষ্টির সময় ঘরে বসে সে যে ঝনঝন শব্দ শুনেছিল, তা এই কাচের বাক্স ভাঙার শব্দটাও হতে পারে। ভালো করে সেদিকে তাকিয়ে পীযূষ দেখতে পেল, ভাঙা কাচের বাক্সর ভিতর সেই প্রাচীন কাঠের কফিন আছে ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যে মমিটা নেই। ঘরের চারপাশে ছড়িয়ে আছে কাচের টুকরো আর লম্বা লম্বা কাপড়ের ফালি বা প্রাচীন ব্যান্ডেজগুলো, যা দিয়ে মোড়ানো ছিল মমিটা।

পীযুষ কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে কাঠের কফিনটার সামনে দাঁড়াল। তার সঙ্গে কানোরিয়াও। কাঠের শূন্য কফিনটার সামনে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে হতবাক পীযূষ প্রশ্ন করল, মমিটা কোথায় গেল?

কানোরিয়ার চোখে মুখেও বিস্ময় ফুটে উঠেছে। তিনিও যেন এই শূন্য কফিনটা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। পীযূষের কথায় হয়তো তিনি কোনও জবাব দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘ওর মধ্যে তো কোনও মমি ছিলই না। বিদেশ থেকে তো শুধু ওই কাঠের পুরোনো কফিনটা আর ব্যান্ডেজগুলো আনা হয়েছিল। তাই না কানোরিয়াসাহেব?’

সঙ্গে সঙ্গে কানোরিয়ার মুখটা কেমন যেন একটু ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কথাটা কে বলল, বোঝার জন্য ঘরের চারদিকে তাকাতে লাগলেন তিনি।

আবার শোনা গেল সেই কণ্ঠস্বর, ‘বুদ্ধিটা ভালোই ফেঁদেছিলেন। কিছুদিন পরই মমিটা খোয়া গেছে বলে বিমার টাকা দাবি করতেন। কেউ বুঝতেই পারত না যে, ওই কাঠের কফিনে কোনও মমি ছিল না। কানাঘুষো শুনেছিলাম যে, আপনার ব্যবসা লোকসানে চলছে। কিন্তু তার জন্য মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেললেন?’

পীযূষ আর কানোরিয়া দুজনেই এবার বুঝতে পারল যে কণ্ঠস্বরটা আসছে ঘরের অন্ধকার এক কোণ থেকে, চাঁদের আলো যেখানে পৌঁছোচ্ছে না। যেদিকে তাকিয়ে কানোরিয়া বলে উঠলেন, কে! কে আপনি?

এবার অন্ধকার ছেড়ে বেরিয়ে এল লোকটা। মমির মুখের ওপর যে-মুখোশটা পরানো ছিল, এক হাত দিয়ে সেই প্রাচীন কাঠের মুখোশটা দিয়ে নিজের মুখটা আড়াল করে রেখেছে সে।

কানোরিয়া আবারও বলে উঠলেন, কে, কে, তুমি? এবার যেন মৃদু কেঁপে উঠল কানোরিয়ার গলাটা।

লোকটা প্রথমে জবাব দিল, ‘যে এতদিন ওই কাচের বাক্সের মধ্যে শুয়েছিল। তবে মিশরের মমি নয়। যাকে আপনি মমি বানালেন।’ কথাটা বলার পর মুখোশটা সরিয়ে নিল লোকটা।

আরে, এ যে সেই লোক। যার সঙ্গে পীযুষের দেখা হয়েছিল রাস্তায়। অবিনাশ বিশ্বাস।

তাকে দেখেই কানোরিয়ার চোয়ালটা যেন ঝুলে পড়ল। বিস্মিতভাবে তিনি বলে উঠলেন, তুমি বেঁচে আছ?

লোকটা জবাব দিল, ‘আপনার কী মনে হয়? আমি মারা গেছি ধরে নিয়ে কাচের বাক্সটা সিল করে দিলেন আপনি। যাতে মরদেহের গন্ধ বাইরে না বেরোতে পারে। নিশ্চয়ই ভেবে রেখেছিলেন এরপর আমার দেহটা কোনও খাদে গিয়ে ফেলে আসবেন।’

কানোরিয়া নিশ্চুপ। বিস্ময় ফুটে উঠেছে তার চোখে-মুখে।

অবিনাশ বিশ্বাস এরপর বলল, ‘আপনি যেমন আমাকে এই প্রাচীন ব্যান্ডেজে জড়িয়ে মমি বানিয়েছিলেন, তেমনই আপনাকে এখন মমি বানাব আমি।’ লোকটা এই বলে মাটি থেকে একটা লম্বা ব্যান্ডেজের ফালি কুড়িয়ে নিল।

ঠিক এই মুহূর্তে কানোরিয়া যেন নিজেকে সামলে নিলেন। হিংস্র একটা ভাব ফুটে উঠল তাঁর মুখে। তিনি বলে উঠলেন, বুঝতে পারছি তুমি বেঁচে আছ। কাচের বাক্সর কোথাও ছিদ্র রয়ে গেছিল আর তা দিয়েই বাতাস ঢুকত ভিতরে। কিন্তু তুমি আর এই বিমার দালাল যদি ভেবে থাকো যে, দুজন মিলে আমাকে ফাঁসাবে, তবে ভুল। তোমাদের দুজনের দেহই পড়ে থাকবে এখানকার কোনও খাদে। কেউ কোনও দিন তোমাদের খবর পাবে না।

লোকটার উদ্দেশ্যে এ-কথা বলার পর পীযূষের দিকে তাকিয়ে কানোরিয়া বললেন, তুমি ইচ্ছা করেই এখন মমি দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলে, তাই না? ভেবেছিলে তোমরা দুজন আর আমি একা। আমাকে কাবু করতে অসুবিধা হবে না। কিন্তু তোমাদের সে ইচ্ছা পূরণ হল না।—এই বলে ডান হাতটা ওপরে তুললেন কানোরিয়া। তার হাতে কখন যে উঠে এসেছে পীযূষের দেখা ক্লাইভের আমলের সেই প্রাচীন পিস্তলটা!

বাকরুদ্ধ হয়ে গেল পীযূষ। পিস্তলের নলটা ধীরে ধীরে পীযূষের বুক লক্ষ্য করে সোজা হচ্ছে…

পীযূষ আতঙ্কে হিম হয়ে গেলেও ঘরের অন্য লোকটা কিন্তু ঘাবড়াল না। সে বলে উঠল, ‘পিস্তলটাও মমির নকল নয়তো? কাজ হবে তো? আমাকেই আগে গুলি করুন।’

কথাটা কানে যেতেই কানোরিয়ার হাতের পিস্তলটা ঘুরে গেল লোকটার দিকে। হিংস্র হাসি হেসে কানোরিয়া বললেন, দেখো গুলি বেরোয় কিনা!—লোকটার বুক লক্ষ্য করে কানোরিয়া পিস্তলের ঘোড়া টেনে দিলেন।

আলোর ঝিলিক। প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল ঘরটা। বারুদের ধোঁয়ায় কয়েক মুহূর্তের জন্য অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটা। কিন্তু তারপরই পীযূষ দেখতে পেল, একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। আবছা হাসিও যেন ফুটে উঠেছে তার ঠোঁটে। আর কানোরিয়ার চোখ-মুখে ফুটে উঠেছে প্রবল বিস্ময়।

মুহূর্তখানেক সময়। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলেন তারা। তারপর কানোরিয়া আবারও পিস্তল উঠিয়ে গুলি চালালেন অবিনাশের বুক লক্ষ্য করে। আবার প্রচণ্ড শব্দ আর বারুদের ধোঁয়াতে ভরে গেল ঘর। মোমবাতিটা খসে পড়ল পীযূষের হাত থেকে।

ধোঁয়া কাটতেই পীযূষ দেখল লোকটা একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখের হাসিটা এবার স্পষ্ট। আর তার দিকে তাকিয়ে যেন রক্তশূন্য হয়ে গেছে কানোরিয়ার মুখ।

কানোরিয়া আরও একবার তাকে লক্ষ্য করে পিস্তল উঠিয়ে ঘোড়া টানলেন। খট করে একটা শব্দ হল। গুলি বেরোল না। ওই প্রাচীন দোনলা পিস্তলে দুটোমাত্র গুলি ছিল শুধু।

লোকটা এরপর বলল, ‘এবার আমার পালা।’—সে এক পা-এক পা করে এগোতে লাগল কানোরিযার দিকে। কানোরিয়া কিন্তু কোনও প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলেন না। তাঁর হাত থেকে পিস্তলটা মাটিতে খসে পড়ল। প্রচণ্ড আতঙ্কে বিস্ফারিত চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে কাঁপতে শুরু করলেন তিনি। লোকটা যখন একদম কাছে চলে এল তখন কাটা কলাগাছের মতো মাটিতে পড়ে গেলেন তিনি। অবিনাশ বিশ্বাস নামের লোকটা এরপর মাটিতে বসে পড়ে ব্যান্ডেজের কাপড়গুলো কানোরিয়ার মুখে-মাথায় জড়াতে শুরু করল।

ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুক্ষণের জন্যে স্তব্ধ হয়ে গেছিল পীযূষ। হুঁশ ফিরতেই সে লোকটার উদ্দেশ্যে বলল, কানোরিয়া সাহেব কি মারা গেছেন? ও কী করছেন আপনি?

অবিনাশ বিশ্বাস জবাব দিল, ‘অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমি জীবন্ত মমি বানাচ্ছি, যেমন ও আমাকে বানিয়েছিল। আমাকে বাধা দেবেন না। লোকটা আপনারও ক্ষতিও করতে চেয়েছিল। তাড়াতাড়ি কাজটা সেরে আপনাকে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দেব। এখানে থাকলে আপনি বিপদে পড়তে পারেন।’

পীযূষ আর তার কাজে বাধা দিল না। খুব দ্রুত লোকটা তার কাজ সম্পন্ন করল। কানোরিয়ার দেহটা ঠিক যেন একটা প্রাচীন মমির মতো লাগছে। লোকটা কাপড়-জড়ানো কানোরিয়ার সংজ্ঞাহীন দেহটাকে পাঁজাকোলা করে তুলে সেই কাঠের কফিনের মধ্যে শুইয়ে দিল। মুখোশটাও পরিয়ে দিল তাঁর মুখে। তারপর পীযূষকে বলল, ‘আপনার ঘর থেকে জিনিসপত্র নিয়ে নিন। আপনার এখানে আসার কোনও চিহ্ন যেন না-থাকে। চলুন, আপনাকে বাসস্ট্যান্ডে ছেড়ে দিয়ে আসি।’

কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকটার সঙ্গে পথে নামল পীযূষ। বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপভাবে চলার পর লোকটা বলল, ‘সামান্য ক’টা টাকার জন্য লোকটার কথায় মমি সেজেছিলাম। তবে লোকটা যে বিমা কোম্পানিকে ঠকাবার জন্য আমাকে মমি সাজিয়েছিল তখন আমি তা জানতাম না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই আমার দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল। আর তা বুঝেও নির্দয় লোকটা আমাকে বাক্সর বাইরে বের করল না। এর আগে যখন আপনাদের আর একজন লোক এসে কাচের বাক্সর সামনে দাঁড়িয়েছিল তখন আমি ছটফট করছি। আর তারপর তো আমি মরে গেছি ধরে নিয়ে কানোরিয়া বাক্সটাই সিল করে দিলেন, মরদেহের দুর্গন্ধ যাতে না-বেরোয় সেজন্য।’

তাহলে কি আমাদের সান্যালবাবু যা দেখেছিলেন তা ঠিক? তখনই কেঁপে উঠেছিল লোকটা?—কথাটা মনে মনে ভেবে নিয়ে পীযূষ বলল, ভাগ্যিস কাচের বাক্সটাতে ফুটো থেকে গেছিল! তাই বরাতজোরে বেঁচে গেছিলেন আপনি। তাছাড়া জল ছাড়া ওই সাতদিন যে বাঁচলেন এটাও একটা মিরাকেল। তবে কানোরিয়ার পিস্তলে যে শুধু বারুদ ভরা ছিল এটাই রক্ষে। শেষ মুহূর্তেও শয়তান লোকটা আমাদের ভয় দেখাতে চেয়েছিল।

দীর্ঘক্ষণ কোনও জবাব দিল না লোকটা। আধঘন্টা নির্জন পাকদন্ডী বেয়ে নিশ্চুপভাবে চলার পর কিছুটা দূরে আলো দেখা গেল। লোকটা সেই আলো দেখিয়ে বলল, ‘ওই যে বাসস্ট্যান্ড। রাত বেশি হয়নি। ওখান থেকে দার্জিলিং শহরে যাবার বাস পেয়ে যাবেন। তবে যাবার আগে দুটো কথা বলে যাই আপনাকে।’

পীযূষ বলল, কী?

অবিনাশ বিশ্বাস বলল, ‘কাচের বাক্সটা সিল করে দেবার পর ওতে কোনও ছিদ্র ছিল না। আর কানোরিয়ার পিস্তলটা ক্লাইভের আমলের হলেও ওটা সত্যি এখনও কর্মক্ষম। ওতে গুলিও ছিল।’

হঠাৎ যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল লোকটা!

পুনশ্চ : দু-দিন পর কলকাতায় ফিরে এল পীযূষ। ইতিমধ্যেই সে তার কোম্পানিকে জানিয়ে দিয়েছে কানোরিয়ার সঙ্গে তার দেখা হয়নি। কারণ, দার্জিলিং-এ পৌঁছবার পরই কানোরিয়া তাকে টেলিফোনে জানিয়ে দেন, তিনি বিমা করাতে আগ্রহী নন। অবশ্য এই মিথ্যা বলার জন্য পীযুষের বিমা কোম্পানির কাছে ধরা পড়ার ভয় নেই। কারণ ইতিমধ্যেই সংবাদপত্রে একটা খবর প্রকাশিত হয়েছে—বিখ্যাত ব্যবসায়ী অখিলেশ কানোরিয়াকে বাকশক্তিহীন ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় তার দার্জিলিং-এর বাংলোতে উদ্ধার করা হয়েছে। অদ্ভুতভাবে মমির মতো কাপড় গায়ে জড়িয়ে একটা প্রাচীন মমির বাক্সে শুয়ে ছিলেন তিনি। তবে সে-ঘরে আরও একটা পচাগলা মৃতদেহ পাওয়া গেছে। তার বুকে বুলেটের ক্ষতচিহ্ন আছে। এছাড়া সেই ঘরের ভিতর থেকে কানোরিয়ার সংগ্রহের একটা প্রাচীন পিস্তলও মিলেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *