কনয়্যাকের দেশে
পাথুরে রাস্তা বেয়ে খুব সাবধানে এগোচ্ছিল আভাসদের গাড়িটা৷ পিছল রাস্তা৷ মাঝে মাঝেই নাম-না-জানা ঝোরার জল রাস্তা ভাসিয়ে নেমে গেছে আরও নীচের দিকে৷ বর্ষার সময় নাকি এই সব ছোটো-ছোটো ঝরনাগুলোই প্রায় জলপ্রপাতের চেহারা নেয়৷ তখন আর এ রাস্তায় গাড়ি চলে না৷ অবশ্য এমনিতেই এ রাস্তায় গাড়ি চলাচল নেই৷ গত দু-ঘণ্টার মধ্যে উলটো দিক থেকে আসা মাত্র দুটো গাড়ি চোখে পড়েছে আভাস আর স্মিথের৷ একটা বর্ডার আর্মি ট্রাক, আর একটা মিশনারিদের জিপ৷ রাস্তার দু-পাশে ঘন জঙ্গল৷ আদিম মহাবৃক্ষ সব৷ তাদের মাথাগুলো যেন আকাশ ছুঁয়েছে৷ থামের মতো গুঁড়িগুলোর গায়ে জমে আছে পুরু শ্যাওলার স্তর৷ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গাছগুলো থেকে ঝরে-পড়া পাতা ঢাল বেয়ে নেমে এসে অনেক জায়গাতে রাস্তা ঢেকে দিয়েছে৷ জঙ্গল এত ঘন যে রাস্তার দু-পাশে হাত-দশেক তফাতেই আর কিছু দেখা যাচ্ছে না৷ বড়ো বড়ো গাছগুলোর মাথার ওপর দিয়ে মাঝে মাঝে সূর্যের আলো ঝিলিক দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বনের গভীরে সে আলো প্রবেশ করছে না৷ নিশ্ছিদ্র অন্ধকার বিরাজ করছে সেখানে৷ দিনের বেলাতেও ঝিঁঝিঁ পোকার কলতান ভেসে আসছে সেখান থেকে৷ ওই ঝিঁঝিঁর ডাক আর গাড়ির চাকায় শুকনো পাতা ভাঙার অস্পষ্ট খসখস শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না কোথাও৷ একটা পাখির ডাকও নয়! সত্যিই এ যেন পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনো এক পৃথিবী! আভাসদের গাড়ির ড্রাইভার কাম গাইড লংপু গাড়ি চালাতে চালাতে এক সময় বলল, ‘আপনারা যে জঙ্গল দেখছেন এ জঙ্গলগুলোকে বলে ‘ভার্জিন ফরেস্ট’৷ অর্থাৎ এ সব জঙ্গলের ভিতর এখনও মানুষের পায়ের ছাপ পড়েনি৷ এর ভিতর কী আছে তা কারো জানা নেই৷ এই নাগাল্যান্ডে এমন বেশ কিছু ‘ভার্জিন ফরেস্ট’ আছে৷’
তার কথা শুনে স্মিথ মন্তব্য করল, ‘সত্যি যেন এ এক ‘লস্ট ওয়ার্ল্ড’৷’
ডিমাপুর থেকে কাকভোরে রওনা হয়েছিল আভাসরা৷ বেলা দুটো বাজে এখন৷ আভাস জানতে চাইল, ‘আর কত সময় লাগবে আমাদের সে-গ্রামে পৌঁছতে?’
লংপু জবাব দিল, ‘আমরা প্রায় এসে গেছি৷ কনয়্যাকদের গ্রামটা আর বেশি দূর নয়৷’
স্মিথ, পাশে-বসা আভাসকে জিগ্যেস করল, ‘তুমি এরকম জায়গাতে আগে এসেছ কোনোদিন?’
আভাস হেসে জবাব দিল, ‘আমাদের সেলফোন কোম্পানির কাজে ডিমাপুরে বেশ কয়েকবার এসেছি, কিন্তু এই রকম জায়গাতে কোনোদিন আসিনি৷ সত্যি কথা বলতে, তোমার সঙ্গে ডিমাপুরের হোটেলে যদি আমার পরিচয় না হত, তাহলে আমার এ পথে আসাই হত না৷ আমাদের দেশটা বিরাট৷ পাহাড়, জঙ্গল, সমুদ্র, মরুভূমি কত কিছু আছে এদেশে! কতরকমের মানুষ! অথচ, মজার ব্যাপার হল এদেশের অনেক মানুষ বিদেশে বেড়াতে যান, কিন্তু নিজের দেশটাকে ভালোভাবে জানেন না, চেনেন না৷ আমি নিজেও তো চিনি না তেমন৷ কিন্তু তুমি কত দূর থেকে ছুটে এসেছ এদেশের একটা প্রত্যন্ত গ্রাম দেখার জন্য৷’
স্মিথ শুনে বলল, ‘তোমাকে এর জন্য তেমন দোষ দেওয়া যায় না৷ আমাদের ইংল্যান্ডের তুলনায় তোমার দেশের বৈচিত্র্য অনেক বেশি৷ তাই সব কিছু না-দেখাটাই স্বাভাবিক৷ আমি যদি এশিয়ার প্রাচীন জনগোষ্ঠীর লোকসংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা না করতাম, বিশেষত ‘ট্যাটু’ নিয়ে গবেষণা না করতাম, তা হলে এ গ্রামে আসতাম না৷ তোমার মতো আমি আমার নিজের দেশের অনেক কিছু দেখিনি৷ তবে মজার ব্যাপার হল কনয়্যাক উপজাতিদের গ্রামটার সঙ্গে কিন্তু আমার একটা অদৃশ্য সম্পর্ক আছে৷’
‘কী সম্পর্ক?’
স্মিথ জবাব দিল, ‘প্রায় সত্তর বছর আগে আমার ঠাকুরদা একবার এসেছিলেন ‘হেড হান্টার’দের এই গ্রামে৷ তিনি এদেশে প্রথমে এসেছিলেন ব্রিটিশ সামরিক দপ্তরের কাজ নিয়ে৷ পরে মিশনারিদের কাজকর্মে জড়িয়ে পড়েন৷ সে কাজেই তিনি আসেন ‘ট্যাটুড ফেস হেড হান্টারদের’ গ্রামে৷’
‘ট্যাটুড ফেস হেড হান্টার’, অর্থাৎ ‘মুখে উল্কি আঁকা মুন্ডু শিকারি’—স্মিথের মুখে এ কথাটা শুনেই ডিমাপুরের হোটেলে তার সঙ্গী হবার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল আভাস৷ অদ্ভুত এক জায়গা দেখার লোভ সামলাতে পারেনি সে৷ স্মিথও সাগ্রহে রাজি হয়েছে তার প্রস্তাবে৷ যার ফলশ্রুতি তাদের কনয়্যাক গ্রামে অভিযান৷ স্মিথ ছবি তুলবে উল্কি আঁকা কনয়্যাকদের, গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলবে তাদের সঙ্গে৷ আর তার সঙ্গী হয়ে আভাসের ঘোরা হয়ে যাবে কনয়্যাকদের অদ্ভুত গ্রামটা৷ খরচখরচা আধাআধি দেবার সিদ্ধান্ত হয়েছে৷ তাতে সুবিধা হবে তাদের দুজনেরই৷ আভাস আর স্মিথ যে গ্রামে যাচ্ছে সত্যি সত্যি সে-গ্রামটা অদ্ভুতই বটে৷ কনয়্যাক নরমুণ্ড শিকারিদের গ্রাম! সত্যি সত্যি এক সময় এই নাগা উপজাতিরা নরমুণ্ড শিকার করত৷ যদিও সে নৃশংস প্রথা আজ নেই৷ ১৯৫০ সালে কঠোর আইন প্রয়োগ করে এই নৃশংস প্রথা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে৷ কনয়্যাকরা এখন আর তা করে না৷ তারা বাঁশ, কাগজ ইত্যাদি দিয়ে মানুষ বা পুতুল বানিয়ে প্রতীকী নরমুণ্ড শিকার করে৷ সময় বদলে গেছে৷ এখন তারা শান্ত নিরীহ এক জনগোষ্ঠী৷ তবে সে-গ্রামে এখনও বেশ কিছু অতিবৃদ্ধ মানুষ আছে যারা সত্যিই তাদের যৌবনে নরমুণ্ড শিকার করত৷
আভাস স্মিথের কাছে জানতে চাইল, ‘তুমি কী তোমার ঠাকুরদার মুখে নরমুণ্ড শিকারের গল্প শুনেছ?’
স্মিথ হেসে জবাব দিল, ‘না, তিনি আমার জন্মের অনেক আগেই মারা যান৷ আমি তাঁকে দেখিনি৷ তবে বাবার মুখে গল্প শুনেছি, ঠাকুরদা যখন এখানে আসেন তখনও নাকি কনয়্যাকদের এই ভয়ংকর প্রথা চালু ছিল৷ মিশনারিরা ধর্মপ্রচার করত এ তল্লাটে৷ স্বাভাবিক নিয়মেই কনয়্যাকদের সনাতন ধর্ম, রীতি-নীতির সঙ্গে তাদের কিছুক্ষেত্রে সংঘাতও ঘটে৷ নরমুণ্ড শিকারিদের হাতে বেশ কিছু মিশনারির প্রাণও যায়৷’
এরপর একটু থেমে সে বলল, ‘জানো, কনয়্যাকদের মুখের উল্কির সঙ্গে নরমুণ্ড শিকারের এক অদ্ভুত সম্পর্ক আছে৷ এক-একটা নরমুণ্ড শিকারের পর এক-একটা নতুন উল্কি তারা মুখে আঁকত৷ এইভাবে ধীরে ধীরে উল্কিতে ভরে যেত তাদের মুখ৷’
আভাস জিগ্যেস করল, ‘কাদের মুন্ডু শিকার করত ওরা?’
লংপু এবার উত্তর দিল, ‘সাধারণত অন্যগোষ্ঠীর মানুষদের, যুদ্ধবন্দিদের, আর সাহেবদেরও সুযোগ-সুবিধা মতো পেলে৷ আমাদের এই নাগাল্যান্ডে ষোলোটা উপজাতি গোষ্ঠী আছে৷ আংগমি, আও, চ্যাং, লোথা, মত্ত ইত্যাদি৷ এই আমি যেমন ‘আংগমি’ উপজাতির লোক৷ আমরাও এক সময় যুদ্ধবাজ উপজাতি ছিলাম৷ সুযোগ পেলে আমাদেরও ছাড়ত না ওরা৷’
কথা বলতে বলতে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে শ্যাওলা-ধরা পাথুরে রাস্তা, নানা বাঁক পেরিয়ে এগিয়ে চলল তারা৷ আরও কিছুক্ষণ চলার পর একটা নদীর ওপর একটা নড়বড়ে কাঠের ব্রিজ পার হয়ে লংপু বলল, ‘ওই যে দেখুন ওদিকে, এবার গ্রামটা দেখা যাচ্ছে!’
জঙ্গল হঠাৎই যেন এবার একটু ফাঁকা হয়ে এসেছে৷ লংপুর কথা শুনে সোজা হয়ে বসে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আভাসরা জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে কিছু দূরে সত্যিই দেখতে পেল গ্রামটাকে৷ পান্নাসবুজ পাহাড়ের ঢালের ঠিক নীচে একটা ফাঁকা জায়গাতে দাঁড়িয়ে আছে একটা গ্রাম৷ তার ঘরবাড়িগুলো চোখে পড়ছে আভাসদের৷ গ্রামের তিনদিক পাহাড় আর জঙ্গল দিয়ে ঘেরা৷ একটা দিকই শুধু উন্মুক্ত৷ সেদিকেই সাঁকো পেরিয়ে এগিয়েছে রাস্তা৷ দুপুরের সূর্যকিরণে ঝলমল করছে গ্রামের খড়ের চালাগুলো৷ দূর থেকে পিঁপড়ের মতো ছোটো-ছোটো বেশ কিছু মানুষ নজরে এল তাদের৷
আভাস জানতে চাইল, ‘কনয়্যাক গ্রামের মানুষদের জীবিকা কী?’
লংপু জবাব দিল, ‘প্রধান জীবিকা এখন চাষবাস৷ গ্রামের পিছনে পাহাড়ের ঢালে ক্ষেত আছে৷ গেলে দেখতে পাবেন৷ তাছাড়া শিকারও আছে৷ নাগা মেয়েরা শাল বোনে৷ এ গ্রামের দু-চারজন এখন শহরে চাকরিও করে৷’
কয়েকটা বাঁক পেরিয়ে আর মিনিট দশেকের মধ্যেই গ্রামে পৌঁছে গেল তারা৷ জিপ এসে থামল গ্রামের ঠিক মাঝখানে একটা ফাঁকা জায়গাতে৷ মাটিতে পা রেখে চারপাশে একবার ভালো করে তাকাল আভাস৷ গ্রামের চারপাশে পান্নাসবুজ পাহাড়৷ মেঘমুক্ত নীল আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে আছে নাগাদের ছোট্ট গ্রামটা৷ বাঁশের তৈরি কুঁড়েঘর৷ তার মাথায় শনের ছাউনি৷ শুধু একপাশে একটা পাকা বাড়ি তার মাথায় ধাতুর তৈরি ক্রশ বসানো দেখে আভাসরা বুঝতে পারল ওটা একটা চার্চ৷ লংপু বলল, এখানে তাদের ধর্মের পাশাপাশি কনয়্যাকদের সনাতন ধর্মেরও চল আছে৷ লংপু এখানে আগেও এসেছে বহুবার৷ তাকে দেখতে পেয়েই একদল বাচ্চা ছেলে ছুটে এল তার কাছে৷ লংপু এক প্যাকেট লজেন্স তাদের হাতে তুলে দিয়ে আভাসদের উদ্দেশে বলল, ‘চলুন আগে আমাদের গ্রামের মোড়লের সঙ্গে দেখা করতে হবে৷ এখানে তো কোনো হোটেল নেই৷ গ্রামের অতিথিশালায় সে-ই থাকার ব্যবস্থা করবে৷’
আভাস আর স্মিথ মোড়লের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য লংপুর সঙ্গে পা বাড়াল৷ গাড়ির শব্দ পেয়ে বেশ কিছু কনয়্যাক বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে৷ তাদের কারো কারো পরনে তথাকথিত সভ্য পৃথিবীর পোশাক থাকলেও বেশিরভাগ নারী-পুরুষের গায়েই লাল-কালো ডোরাকাটা নাগা শাল জড়ানো৷ পুরুষদের কানেও কর্ণকুণ্ডল আছে৷ আর মহিলাদের গলায় রঙবেরঙের পাথরের হারের ছড়া৷ সূর্যের আলোতে সেগুলো ঝলমল করছে৷ উৎসুক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল তারা৷
৷৷ ২৷৷
কিছুটা এগিয়েই গ্রামপ্রধানের ঘরের সামনে উপস্থিত হল আভাসরা৷ লংপু জানাল, গ্রামপ্রধানের নাম নাকি ‘কাবাকাবা মাসং’৷ লোকে তাকে ‘আং’ অর্থাৎ প্রধান বা মোড়ল বলেই ডাকে৷ গ্রামের অন্য ঘরগুলোর তুলনায় মোড়লের ঘর বা বাড়িটা বেশ বড়ো৷ যদিও এ বাড়িটাও বাঁশ আর শন দিয়ে তৈরি৷ দরজার ঠিক ওপরেই আটকানো আছে বিরাট শিংসমেত একটা হরিণের মাথার খুলি৷ লংপু দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে হাঁক দিল—‘আং? আং?’
তার ডাক শুনে কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে এলেন একজন বৃদ্ধ৷ অসংখ্য বলিরেখাময় মুখ তাঁর৷ মাথায় পালকের সাজ, গলায় পাথরের আর ধাতুর তৈরি মালার ছড়া বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে৷ তাঁর ঊর্ধ্বাঙ্গে নাগা শাল৷ কাঁধে একটা লম্বা নলঅলা গাদা বন্দুক৷ তাঁর হাতে একটা বাঁশের লাঠি৷ আর তার মাথায় বসানো আছে একটা নরকরোটি৷
আং-এর প্রতি মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানিয়ে তাঁর সঙ্গে নাগামিজ ভাষায় কথা শুরু করল দোভাষী লংপু৷ আভাস আর স্মিথের পরিচয় দেবার পর আং তাঁর কালো ছোপধরা প্রায় ফোকলা দাঁতে হেসে আভাসদের উদ্দেশে বললেন, ‘গ্রাম দেখতে এসেছ, ভালো৷ তোমরা কী দেখতে এসেছ আমি জানি৷ মানুষের মুন্ডু তো? দেখাব৷ তবে তোমরা ভয় পেও না, সে প্রথা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে৷ আমরা এখন ওসব আর করি না৷’
স্মিথ হেসে জবাব দিল, ‘তা আমরা জানি৷ এখানে আমরা দুটো-তিনটে দিন থাকব৷ গ্রাম সম্বন্ধে জানব, ছবি তুলব৷’
গ্রামপ্রধান বললেন, ‘বেশ-বেশ৷ গ্রামে আমাদের অতিথিশালা আছে ঠিকই৷ কিন্তু…৷’ থেমে গেলেন আং৷ আং-এর ‘কিন্তু’র অর্থ বুঝতে পেরে লংপু ইশারা করল স্মিথকে৷ স্মিথ সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে পাঁচশো টাকার কড়-কড়ে কয়েকটা নোট বার করে এগিয়ে দিল লংপুর দিকে৷ লংপু টাকাটা তুলে দিল আং-এর হাতে৷ অতিথিশালার জন্য ভাড়া ও আভাসদের তিনজনের খাবারের খরচা৷
আং তাড়াতাড়ি টাকাটা তাঁর শালের মধ্যে লুকিয়ে ফেলে বললেন, ‘কিছু সময় তোমাদের বাইরে অপেক্ষা করতে হবে৷ অতিথিশালা পরিষ্কার করানো দরকার৷ তোমাদের শোবার জন্য মাদুর, আর গায়ে চাপানোর জন্য শালের ব্যবস্থাও করতে হবে৷ রাতে খুব শীত পড়ছে আজকাল৷ আগুনের জন্য কাঠেরও ব্যবস্থা করতে হবে৷’ আভাস আর স্মিথের পিছনে ইতিমধ্যে আশেপাশের কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে কয়েকজন নাগা পুরুষ৷ তাদের কারো হাতে দীর্ঘ ফলাঅলা বর্শা, কারও হাতে কুঠার৷ তবে কুঠারগুলো একটু অদ্ভুত দেখতে৷ লম্বা বাঁশের দণ্ডের মাথায় অনেকটা তরোয়ালের মতো দেখতে ফলা বসানো৷ কুঠারের বদলে তাকে ‘দা’ও বলা যায়৷ তাদেরই একজনকে সম্ভবত অতিথিশালা পরিষ্কারের নির্দেশ দিলেন প্রধান৷ সে এগোল কিছুটা তফাতে একটা কুঁড়েঘরের দিকে৷ লংপু আভাসকে বলল, ‘ওটাই এ গ্রামের অতিথিশালা৷’
আং এরপর আভাসদের উদ্দেশে বলল, ‘আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাহাড়ের মাথায় সূর্য ডুববে৷ আজ আর কিছু হবে না৷ আমি এখন একটা কাজে বেরোচ্ছি৷ কাল আপনাদের সবকিছু ঘুরিয়ে দেখাব৷ এ গ্রামে এখনও কিছু বৃদ্ধ মানুষ আছে যারা এক সময় সত্যি মানুষ শিকার করত৷ তাদের সঙ্গে কথা বলবারও ব্যবস্থা করব৷ তবে তাদের গল্প শুনতে হলে কিছু দক্ষিণা দিতে হবে৷ বুড়ো মানুষ সব৷ কোনো কাজকর্ম এখন আর তারা করতে পারে না৷ ট্যুরিস্টদের সাহায্যর ওপরই তারা দিন কাটায়৷’
স্মিথ জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, তাদের নিশ্চয়ই সাহায্য করব আমরা৷’
তার কথা শুনে আং ফোকলা দাঁতে হেসে ইংরিজিতে বললেন, ‘থ্যাঙ্ক য়ু৷ চলি এখন৷’
স্মিথ লংপুকে বলল, ‘আমরা এখন কী করব?’
সে বলল, ‘আমরা আপাতত তাহলে গাড়িতেই বসি৷ ঘরদোর পরিষ্কার হলে তারপর অতিথিশালায় ঢুকব৷’
আং তাঁর কয়েকজন অনুচরকে নিয়ে পা বাড়াচ্ছিলেন তাঁর গন্তব্যের উদ্দেশে৷ কয়েক-পা এগিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে লংপুর উদ্দেশে বললেন, ‘তোমরা আমার সঙ্গে ওই পাহাড়ের ঢালে যাবে? ওখানে একটা কাজে যাচ্ছি আমি৷ ইচ্ছে হলে সঙ্গী হতে পারো৷ গ্রামের অনেকে আছে ওখানে৷’
গ্রামের ঠিক পিছনেই পাহাড়ের ঢালটা৷ এ জায়গাটা ভালো করে দেখতেই তো আভাসরা এসেছে৷ ঘর পরিষ্কার হতে নিশ্চয়ই কিছু সময় লাগবে৷ স্মিথ তাই বলল, ‘হ্যাঁ, যাব আমরা৷’
আভাসরা এরপর আং-এর সঙ্গে এগোল সেই পাহাড়ের ঢালের দিকে৷ যেতে যেতে আং ভাঙা ভাঙা ইংরিজিতে প্রশ্ন করলেন, ‘সাদা চামড়া, তুমি কোন দেশের লোক?’
গাড়িতে আসার সময় লংপু তাদের বলেছিল, মিশনারি ও ট্যুরিস্টদের সংস্পর্শে এ গ্রামের কেউ কেউ নাকি একটু-আধটু ইংরিজি বলতে, বুঝতে পারে৷ আং তাদেরই একজন৷
স্মিথ জবাব দিল, ‘ইংল্যান্ড৷’
আং বললেন, ‘হ্যাঁ, নাম শুনেছি৷ মিশনারিদের দেশ৷ সাদা চামড়ার দেশ৷ জানো, এক সময় সাদা চামড়াদের আমরা পছন্দ করতাম না৷ অনেক সময় তাদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধও হয়েছে৷ সে অবশ্য অনেককাল আগে৷’ চলতে চলতে ঘরবাড়ির ফাঁক দিয়ে পাহাড়ের ঢালে একটা চাষের বড়ো ক্ষেত চোখে পড়ল আভাসদের৷ শূন্য ক্ষেত৷ ফসল সম্ভবত কাটা হয়ে গেছে৷ স্মিথ জিগ্যেস করল, ‘ওখানে কী চাষ হয়?’
আং জানালেন, ‘ওখানে ধান চাষ হয়৷ কিন্তু এবার একটা দানাও তোলা গেল না৷’
‘কেন?’ জানতে চাইল স্মিথ৷’
আং প্রথমে উত্তর দিলেন, ‘পঙ্গপাল সব শেষ করে দিল৷ খড় পর্যন্ত পাওয়া গেল না!’ তারপর বেশ রাগত স্বরে বললেন, ‘জাদুকরটা মহা শয়তান৷ ধান বুনবার আগে বলল, একটা মোষ বলি দিলে নাকি এত ফসল ঘরে উঠবে যে তিন বছর আর চাষের দরকার হবে না৷ আমি অবশ্য ওর তুকতাকে বিশ্বাস করি না৷ কিন্তু গ্রামের লোক করে৷ তাই দিলাম একটা মোষ ওকে৷ কিন্তু পঙ্গপাল ফসল শেষ করল!’
আভাস মৃদু বিস্মিত হয়ে লংপুকে জিগ্যেস করল, ‘এখানে আবার জাদুকর কোথা থেকে এল?’ সে জবাব দিল, ‘জাদুকর মানে একজন কনয়্যাক পুরোহিত৷ ওঝাও বলা যেতে পারে তাকে৷ আপনাদের বলেছিলাম না, এখানে কনয়্যাকদের প্রাচীন ধর্মেরও মান্যতা আছে৷ আং-এর পরই এ গ্রামে তার স্থান৷ আমি দেখেছি লোকটাকে৷ বুড়ো লোক৷ এক সময় সে ‘হেড হান্টার’ ছিল৷ ওর নাম ‘মারঙকাবা’৷ লোকে সংক্ষেপে মারঙ বলে ডাকে৷’
‘মারঙ’ শব্দটা কানে যেতেই আং বলে উঠলেন, ‘খুব বদমাশ লোকটা৷ আজ বিচারসভাটার হোতা ওই৷ কেন যে লোকে ওকে বিশ্বাস করে বুঝি না৷ ইচ্ছা হয়, ওকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেই৷ সুযোগ পেলে তাড়াবও৷’ প্রধানের কথা শুনে বোঝা গেল, তিনি যারপরনাই রুষ্ট জাদুকরের ওপর৷ যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও আং বিচারসভায় চলেছেন৷
লংপু চাপা স্বরে আভাসদের বলল, ‘আসলে, জাদুকর আর প্রধানের মধ্যে একটা চাপা লড়াই আছে ক্ষমতার দখল নিয়ে৷ ওঁরা কেউ কাউকে মহৎ করতে পারেন না৷ তারপর মারঙ আবার ‘স্যুভেনির হাউস’-এর রক্ষক৷’
‘স্যুভেনির হাউস মানে?’ জানতে চাইল আভাস৷
লংপু হেসে বলল, ‘স্যুভেনির হাউস, নামটা অবশ্য এক ট্যুরিস্টের দেওয়া৷ ওর অর্থ হল, যে ঘরে এদের শিকার-করা নরমুণ্ডগুলো রাখা আছে—খুলি ঘর!’
হাঁটতে হাঁটতে স্মিথ আং-কে জিগ্যেস করল, ‘বিচারসভাটা কীসের?’
আং জবাব দিলেন, ‘ওখানে গেলেই বুঝতে পারবে৷ ব্যাপারটাতে আমার মোটেও সায় ছিল না৷ গ্রামের লোকরা ব্যাপারটাতে বিশ্বাস করল তাই বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে৷’
কিছুক্ষণের মধ্যেই জায়গাটাতে পৌঁছে গেল তারা৷ জনাপঞ্চাশেক কনয়্যাক স্ত্রী-পুরুষ পাহাড়ের ঢালের এক জায়গাতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে৷ আং সেখানে উপস্থিত হতেই উঠে দাঁড়াল তারা৷ আভাসরা একজন অদ্ভুত পোশাক-পরা লোককে দেখতে পেল তাদের মধ্যে৷ বৃদ্ধ-দীর্ঘকায় একজন৷ সারা মুখে তার প্রাচীন উল্কি আঁকা৷ এক ঝলক তার মুখের দিকে তাকালে মনে হবে তার মুখ যেন পুড়ে কালো হয়ে গেছে৷ তার গলায় দস্তার পাতের মানুষের মুন্ডুর লকেট আর রঙিন পাথরের মালা, মাথায় বিরাট দুটো শিংসহ মোষ জাতীয় কোনো প্রাণীর খুলি বসানো শিরোভূষণ, লাল শালের ওপর কাঁধ আর পিছনের অংশ ঢাকা আছে রোমশ কালো চামড়ায়৷ সম্ভবত সেটা ভল্লুকের চামড়া হবে৷ লংপু আভাসদের বলল, ‘ওই হল জাদুকর মারঙ৷’ আভাসরা সেখানে উপস্থিত হতেই সেই লোকটা কয়েক পা এগিয়ে এসে তাকাল আভাসদের দিকে৷ বিশেষত সাদা চামড়ার স্মিথকে দেখে বেশ একটু যেন বিস্মিত হয়েই সে আং-কে জিগ্যেস করল, ‘এরা কারা?’
আং জবাব দিলেন, ‘এরা অতিথি৷ গ্রাম দেখতে এসেছে৷’ এ কথা বলে তিনি গিয়ে বসলেন একটা পাথরের ওপর৷ আভাসরা তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াল৷
আং বিচারসভায় বসার পর উপস্থিত কনয়্যাক নাগারা তাঁর সামনে একটা অর্ধবৃত্ত রচনা করে দাঁড়াল৷ শুধু সেই বৃত্তর মধ্যে দাঁড়াল কয়েকজন৷ জাদুকর মারঙ, এক নাগা দম্পতি শালে জড়ানো বছর দশেকের একটা ছেলেকে কোলে নিয়ে৷ আর তাদের কিছুটা তফাতে আরও একটা বাচ্চা ছেলে৷ তার বয়সও সম্ভবত দশ-বারো হবে৷ ছেলেটার হাতে ধরা চোখে ঠুলি পরানো একটা বাজপাখি৷
আং বললেন, ‘এবার তাহলে শুরু করা যাক৷’
আং-এর কথা শোনার পর জাদুকর এগিয়ে এসে মাথা আর হাত-পা নেড়ে উদ্ভট-বিচিত্র ভঙ্গিতে কথা বলতে শুরু করল৷ লংপুর মাধ্যমে কিছুক্ষণের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেল ব্যাপারটা৷ বাচ্চা কোলে নেওয়া দম্পতি আর বাজপাখিওলা ছেলেটা বাদী-বিবাদী দুই পক্ষ৷ দম্পতির বাচ্চাটা অসুস্থ৷ আর তার জন্য নাকি দায়ী ওই বাজপাখি আর তার মালিক বাচ্চা ছেলেটা৷ সে ছেলেটা নাকি চার্চের ফাদারের তত্ত্বাবধানে থাকত৷ সেই ফাদারের মৃত্যু হয়েছে কিছুদিন আগে৷ অনাথ বাচ্চাটার বাজপাখিটার মধ্যে নাকি ভর করেছে সেই ফাদারেরই দুষ্টু আত্মা৷ বাচ্চা ছেলেটার নাম ‘টুংলিং’৷ কিছুদিন আগে সে অসুস্থ ছিল৷ কিন্তু ক-দিন আগে সে তার বাজপাখির মাধ্যমে রোগটা পাঠিয়ে দিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছে৷
ব্যাপারটা শুনে স্মিথ লংপুকে বলল, ‘এরকম উদ্ভট ব্যাপার আবার হয় নাকি?’
সে বলল, ‘ব্যাপারটা আপনি বুঝছেন, আমি বুঝছি, সম্ভবত আং-ও বুঝছেন, কিন্তু গ্রামবাসীরা এ সব কুসংস্কারে বিশ্বাস করে৷ জাদুকরের কথায় তারা বিশ্বাস করে৷’
আং গম্ভীরভাবে মারঙ জাদুকরের কাছে জানতে চাইলেন, ‘তোমার বক্তব্যের প্রমাণ কী?’
জাদুকর জবাব দিল, ‘যে দিন বাচ্চাটা অসুস্থ হয় সেদিন টুংলিং-এর বাজটা দীর্ঘক্ষণ অসুস্থ ছেলেটার ঘরের চালের ওপর বসে ছিল৷ টুংলিং-এর বাজ হঠাৎ কেন তাদের চালে গিয়ে বসবে?’ তার বক্তব্যের সপক্ষে মারঙ জাদুকর একজন সাক্ষীকেও হাজির করল৷ সে বলল, ‘হ্যাঁ, কথাটা সত্যি৷’
আং শুনে বললেন, ‘শুধু এইটুকু প্রমাণে তো বোঝা যাবে না যে ছেলেটার অসুস্থতার জন্য টুংলিংই দায়ী?’ প্রধানের কথা শুনে জাদুকর বলল, ‘প্রমাণ আরও আছে৷ এই যে—৷’
এই বলে সে তার পোশাকের ভিতর থেকে একটা জিনিস বার করল৷ বেশ লম্বা একটা কাঁটা৷ শজারুর কাঁটা৷ কাঁটাটা দেখিয়ে মারঙ বলল, ‘এই কাঁটাটা গোঁজা ছিল অসুস্থ বাচ্চাটার ঘরের চালে৷ কে না জানে যে অশুভ প্রেতাত্মার প্রতীক এই শজারুর কাঁটা৷ এ কাঁটা দিয়ে তুকতাক করা হয়৷ টুংলিংকেই জিগ্যেস করা হোক যে কাঁটাটা সে ঘরের চালে গুঁজে এসেছিল কি না? আমি জলদর্পণে ব্যাপারটা দেখেছি৷’
আং তাকালেন টুংলিং-এর দিকে৷ বাজপাখিটা কোলে নিয়ে বেশ ভীতসন্ত্রস্ত-ভাবে ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে৷ আং তাকে জিগ্যেস করলেন, ‘এ কাঁটা কী তুমি চালে গুঁজেছিলে?’
টুংলিং ভয়ে ভয়ে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ৷’
‘কেন?’
টুংলিং বলল, ‘পাখিটাকে খুঁজতে আমি ওদের চালার সামনে যাই৷ তখন আমার কাছে কাঁটাটা ছিল৷ ওটা আমি বন থেকে কুড়িয়ে পাই৷ পাখিটা কিছুতেই নামতে পারছিল না চাল থেকে৷ ওর পায়ের দড়ি আটকে গেছিল চালের এক জায়গাতে৷ হাতের কাঁটাটা চালের বাখারিতে গুঁজে আমি চালে উঠে পাখিটাকে নামাই৷ কাঁটাটা ওখানে রয়ে গেছিল৷’
টুংলিং-এর কথাটা শেষ হবার সঙ্গে-সঙ্গেই জনতার মধ্যে একটা মৃদু গুঞ্জন উঠল৷ জাদুকর টুংলিংকে ধমকে উঠে বলল, ‘মিথ্যা কথা! ইচ্ছা করেই কাঁটাটা ওখানে রেখেছিল৷ ছেলেটাও অসুখে পড়ল আর তুইও সুস্থ হয়ে উঠলি!’ আং এরপর জাদুকরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আর কিছু প্রমাণ?’
মারঙ এবার তার শেষ তাসটা খেলল৷ সে তার পোশাকের ভিতর থেকে বার করল একটা কাপড়ের পুতুল৷ তার গায়ে বেশ কিছু শজারুর কাঁটা ফোটানো৷ পুতুলটা দেখে ফ্যাকাশে হয়ে গেল টুংলিং-এর মুখটা৷ মারঙ পুতুলটা তুলে ধরে বলল, ‘এই সেই তুক করা জাদুপুতুল৷ এর মাধ্যমেই আসল কাজটা করেছে৷ এর মধ্যেই প্রেতাত্মা বাস করে৷ এখন অবশ্য সে আশ্রয় নিয়েছে পাখিটার দেহে৷ টুংলিং, এটা তোর পুতুল কি না?’
টুংলিং ঢোক গিলে বলল, ‘হ্যাঁ, ওটা আমারই পুতুল৷ পাদ্রীসাহেব দিয়েছিলেন৷ আমি অনেকদিন আগে জঙ্গলে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছিলাম ওটা৷’ তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে মারঙ জাদুকর অট্টহাস্য করে জনতার উদ্দেশে বলল, ‘দেখলে তো তিন-তিনটে প্রমাণ দিলাম৷ আর সন্দেহ আছে? কী বলো তোমরা?’
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর জনতা চিৎকার করে উঠল, ‘হ্যাঁ, ও দোষী৷ দোষী-দোষী-দোষী…৷’
এই উদ্ভট, অবাস্তব সাক্ষ্যপ্রমাণ দেখে আং কী রায় দেন তার জন্য আভাস আর স্মিথ তাকাল আং-এর মুখের দিকে৷ তিনি চাপা স্বরে তাদের উদ্দেশে বললেন, ‘সাক্ষ্যপ্রমাণ টুংলিং-এর বিরুদ্ধেই যাচ্ছে৷ তাছাড়া মারঙ-এর কথা গ্রামের লোকেরা সব যখন বিশ্বাস করছে তখন আমাকে দোষী সাব্যস্ত করতে হবে টুংলিংকে৷’ তিনি মারঙকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললেন, ‘ঠিক আছে, বুঝলাম টুংলিং দোষী৷ কিন্তু কী ব্যবস্থা করলে ছেলেটা সুস্থ হবে?’
মারঙ জাদুকর বলল, ‘প্রথমত, এই পুতুলটা পুড়িয়ে ফেলতে হবে৷ দ্বিতীয়ত, বাজটাকে মেরে তার মাংস খাওয়াতে হবে৷ আর তৃতীয়ত হল, টুংলিং এবার থেকে আমার হেফাজতেই থাকবে৷ যতদিন না সে মুক্ত হয় পাদ্রীর অশুভ আত্মার হাত থেকে৷’ তার কথা শুনে সায় দিয়ে উঠল জনতা৷ ‘তাহলে ওই দুষ্টু পাখিটাকে এখনই মারা হোক! মারা হোক!’ তাদের চিৎকার শুনে টুংলিং আতঙ্কে পাখিটাকে জাপটে ধরল৷
স্মিথ তাদের কথা শুনে আভাসকে বলল, ‘পাখি নিয়ে আমার কিছুটা পড়াশোনা আছে৷ ওটা ‘আমুর বাজ’৷ দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির পাখি৷ ওটাকে পুড়িয়ে মারবে এরা?’
আং যেন তাঁর রায়দানের আগে একটা শেষ চেষ্টা করে বললেন, ‘কাজগুলো হলে ছেলেটা যে সুস্থ হয়ে উঠবে কীভাবে বুঝব? মারঙ, তুমি তো বলেছিলে মোষ বলি দিলে ভালো ফসল হবে৷ কিন্তু পঙ্গপালে খেয়ে গেল সবকিছু!’
মারঙ বলে উঠল, ‘তাই হত৷ কিন্তু পঙ্গপালের ব্যাপারটাও ছিল প্রেতাত্মার কারসাজি৷ এ পুতুলটাকে পুড়িয়ে ফেললে আর পাখিটাকে মেরে খেলে সব ঠিক হয়ে যাবে৷ এক চাঁদের মধ্যেই বাচ্চাটা সুস্থ হয়ে যাবে৷ নইলে ছেলেটা বাঁচবে না৷’ নাগারা বলে উঠল, ‘মারঙ জাদুকর যা বলছে, তবে তাই হোক৷ তাই হোক…৷’
আং শুধু এরপর মারঙের উদ্দেশে বললেন, ‘কিন্তু যদি তা না হয় তবে কিন্তু এরপর আর তোমার কোনো কথা শোনা হবে না৷’ এ কথা বলে তিনি সম্ভবত জাদুকর যা চাইছে তাতে সম্মতি জানাতে যাচ্ছিলেন কিন্তু স্মিথ আং-কে বলল, ‘বাচ্চাটার কী হয়েছে? ওকে একবার দেখা যাবে?’
আং একবার বিস্মিতভাবে স্মিথের দিকে তাকিয়ে অসুস্থ বাচ্চাটাকে কাছে আনতে বললেন৷ তার বাবা-মা বাচ্চাটাকে কাছে নিয়ে এল৷ বেহুঁশ বাচ্চাটা মৃদু মৃদু কাঁপছে৷ তার নাকি কয়েক ঘণ্টা পরপরই এমন কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে৷ বাচ্চাটাকে একটু পরীক্ষা করে স্মিথ আভাসের উদ্দেশে বলল, ‘আরে, এ তো মনে হচ্ছে ম্যালেরিয়া৷ আমার কাছে মেডিকেল কিট-এ কুইনাইন আছে৷ এক ডোজ খাইয়ে দেখব নাকি?’
আভাস জবাব দিল, ‘তা দেখা যেতে পারে৷ কিন্তু এরা কী তার অনুমতি দেবে?’
লংপু বলল, ‘আমার কিন্তু মনে হয় এদের ব্যাপারে আমাদের মাথা গলানো ঠিক হবে না৷ ওষুধ খেয়ে যদি বাচ্চাটার কিছু হয়, তবে আমাদের ওপর দায়িত্ব বর্তাবে৷’
স্মিথ বলল, ‘কুইনাইন স্টেরয়েড নয়৷ খাওয়ালে ছেলেটার খারাপ কিছু হবে না৷ আর ওই দুষ্প্রাপ্য পাখিটাকে বাঁচানো যাবে৷’ এ কথা বলে সে লংপুর মাধ্যমে আং-কে বলল, ‘আপনি আপনার রায়দান দু-দিনের জন্য স্থগিত রাখতে পারেন? আমি বাচ্চাটাকে ওষুধ খাইয়ে দেখব ও সুস্থ হয় কি না? ওর কোনো ক্ষতি হবে না৷ আপনি যদি অনুমতি দেন…৷’
তার কথা শোনার পর একটু থমকে গেলেন আং৷ মুহূর্তখানেক ভাবার পর তাঁর ঠোঁটে আবছা একটা হাসি ফুটে উঠল৷ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, রায়দান আমি স্থগিত রাখতেই পারি৷ ছেলেটাকে যদি সুস্থ করতে পারো তবে আমারও উপকার হয়৷ জাদুকরটাকে জব্দ করতে পারব আমি৷ ওর সব ক্ষমতা কেড়ে নেব আমি৷’
স্মিথ বলল, ‘আমাকে নানা জায়গা ঘুরে বেড়াতে হয় বলে আমি আমার বাবার কাছ থেকে নিজের স্বাস্থ্যের জন্যই ডাক্তারি বিদ্যাটা কিছুটা শিখেছিলাম৷ তিনি নামকরা ডাক্তার ছিলেন৷ আশা করি আমার ওষুধে কাজ হবে৷’
মারঙ জাদুকর আর নাগারা আভাসদের কিছুটা তফাতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে প্রধানের রায় শোনার জন্য৷ আর টুংলিং তার পাখিটাকে বুকে জড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে৷
আরও কিছুটা সময় স্মিথের প্রস্তাব নিয়ে ভাবার পর আং উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে চমকে দিয়ে বললেন, ‘আমি আমার রায়দান তিনদিনের জন্য স্থগিত রাখলাম৷ দেখি আমি বাচ্চাটাকে নিজে সুস্থ করতে পারি কি না৷ সভা এখন শেষ৷’ তারপর তিনি নাগা দম্পতির উদ্দেশে বললেন, ‘তোমরা বাচ্চা নিয়ে আমার সঙ্গে এসো৷’
সভা ভেঙে গেল৷ মারঙ জাদুকর কিন্তু আর কিছু বলল না৷ স্মিথের দিকে আশ্চর্যভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অন্যদিকে হাঁটতে শুরু করল৷ সে চলে যাবার পর আং স্মিথকে বলল, ‘তোমার ওষুধটা কিন্তু বাচ্চাটাকে আমি খাওয়াব৷ যাতে সে সুস্থ হলে গ্রামের লোকরা ভাবে আমিও জাদুকরের চেয়ে কম জানি না৷ আমারও জাদুক্ষমতা আছে৷’
স্মিথ হেসে বলল, ‘ঠিক আছে৷ আমার নাম চাই না৷ ছেলেটা সুস্থ হলেই ভালো৷’
সভা ভেঙে গেলে টুংলিং কিন্তু তার নিজের জায়গাতে তখনও দাঁড়িয়ে৷ তাকে দেখিয়ে আং আভাসদের বললেন, ‘ওর আশ্রয়কর্তা পাদ্রীটাকে মারঙ সহ্য করতে পারত না৷ তাই তার মৃত্যুর পর সে বাচ্চাটার পিছনে লেগেছে৷’ আভাস আর স্মিথ গিয়ে দাঁড়াল টুংলিং-এর কাছে৷ তার আতঙ্ক তখনও কাটেনি৷ স্মিথ তার কাছে গিয়ে পাখিটাকে পরীক্ষা করে বলল, ‘হ্যাঁ, আমুর বাজ৷ এরা খুব ভালো পোষ মানে৷ বর্তমানে ইউনেস্কোর বিপন্ন পাখির তালিকাভুক্ত৷’
৷৷ ৩৷৷
বাঁশের বাখারির বেড়া দেওয়া লম্বাটে ধরনের একটা ঘর৷ তার মাথায় শনঘাসের ছাউনি৷ শোয়ার জন্য ঘরের ভিতর ঘাসের মাদুর, আর গায়ে দেবার জন্য নাগা-শালেরও বন্দোবস্ত ছিল৷ গ্রামে ঢুকে প্রথমে গাড়ি থেকে ওষুধ নিয়ে সেটা আং-এর হাতে তুলে দিয়ে এই অতিথিশালাতে ফিরে এসেছিল আভাসরা৷ তার কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নেমেছিল, রাতও নেমেছিল নির্দিষ্ট সময়ে৷ রাত আটটার মধ্যে শুয়ে পড়েছিল আভাসরা৷ অতিথিশালার বাইরে কোথা থেকে যেন ভেসে আসছিল কনয়্যাক নাগাদের বাদ্যযন্ত্র-নাচগানের শব্দ৷ সে-সব শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল আভাসরা তিনজন৷
পরদিন মোরগের ডাকে আভাসদের যখন ঘুম ভাঙল তখন সূর্যদেব আকাশে মুখ তুলেছেন৷ তবে বাইরের কুয়াশা তখনও তেমন কাটেনি৷ শীতের ভোর৷ ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণের মধ্যেই বাইরে বেরোবার জন্য তৈরি হয়ে নিল সকলে৷ আং-এর বাড়িতে যেতে হবে প্রথমে৷ তারপর তিনি তাদের নিয়ে গ্রাম ঘোরাবেন৷ আভাসরা বাইরে আসতেই দেখতে পেল গতকালের সেই টুংলিংকে৷ কাঁধে তার পোষা বাজপাখিটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ সে প্রথমে হাসল তাদের দিকে তাকিয়ে৷ তারপর কাছে এগিয়ে এসে আভাসের হাতে তুলে দিল আতার মতো দুটো ফল৷ আভাস লংপুর মাধ্যমে তাকে জিগ্যেস করল, ‘ফল দুটো কোথা থেকে আনলে?’ টুংলিং জঙ্গলের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, ‘ওখান থেকে৷ রাতে আমি যে গাছে ছিলাম সে-গাছেরই ফল৷ খুব মিষ্টি খেতে৷’
আভাস অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, ‘রাতে তুমি গাছে থাকো নাকি?’
সে জবাব দিল, ‘থাকি না, তবে কাল রাতে ছিলাম৷’
‘কেন? রাতে ছিলে কেন?’
টুংলিং একটু ভীতভাবে জবাব দিল, ‘মারঙ যদি আমার পাখিটা ধরে মেরে ফেলে, তাই৷ বাজটা ও অনেকদিন ধরে চাইছিল আমার কাছে৷ আমি দিইনি৷ তাই পাখিটাকে ও মারতে চাইছে৷ সত্যি বলছি, আমি কিছু করিনি৷’
স্মিথ হেসে বলল, ‘এ পাখিটা তোমার কথা শোনে?’
টুংলিং বলল, ‘হ্যাঁ, শোনে৷ ও যেখানেই থাকুক আমি ডাকলেই আমার কাছে চলে আসে৷ দেখবে?’ এই বলে সে কাঁধ থেকে পাখিটাকে হাতে নিয়ে তার ঠুলি খুলে দিয়ে কী যেন বলল৷ পাখিটা সঙ্গে সঙ্গে ডানা ঝাপটিয়ে আকাশের দিকে উড়ে গেল প্রথমে, তারপর পাক খেতে লাগল গ্রামের মাথার ওপর৷ কিছুক্ষণ সে ওড়ার পর টুংলিং তার ছোট্ট হাত দুটো মুখের কাছে এনে আকাশের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত শিসের মতো শব্দ করল৷ আর সঙ্গে সঙ্গে সেই শব্দ শুনে পাখিটা নেমে এসে সোজা টুংলিং-এর কাঁধে বসল৷ হাসি ফুটে উঠল টুংলিং-এর মুখে৷ টুংলিং কিন্তু আর এরপর দাঁড়াল না৷ মাথা ঝাঁকিয়ে আভাসদের উদ্দেশে অভিবাদন জানিয়ে হাঁটতে শুরু করল অন্য দিকে৷ আভাসরা এগোল আং-এর কুঁড়েতে যাবার জন্য৷
লংপুর ডাক শুনে তার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন আং৷ পরনে তাঁর লাল রঙের একটা শাল৷ আজ তাঁর কাঁধে বন্দুকের বদলে হাতে ধরা আছে একটা বাঁশের মাথায় তরোয়ালের ফলার মতো কুঠার৷ আর অন্য হাতে সেই নরমুণ্ড বসানো দণ্ডটা আগের মতোই আছে৷ বয়সের ভারেই সম্ভবত একটু কুঁজো হয়ে হাঁটেন আং৷ আভাসদের দেখে একগাল হেসে তিনি বললেন, ‘ভালো খবর আছে৷ তোমাদের ওষুধটা ধরেছে মনে হয়৷ রাতে আর ছেলেটার কাঁপুনি হয়নি৷ জ্বরও একটু কম৷’
স্মিথ হেসে আভাসকে বলল, ‘আমার ধারণা তবে ঠিক৷ ম্যালেরিয়া৷ ক’দিন ওষুধ খেলেই সুস্থ হয়ে যাবে৷’
আং বললেন, ‘চলো, এবার যাওয়া যাক৷ প্রথমে তোমাদের নিয়ে যাব ‘হেড হান্টার’দের কাছে৷ তারপর নিয়ে যাব সেই ঘরে যেখানে মুন্ডুগুলো রাখা আছে৷ আমার হাতে এই যে কুঠারটা দেখছ, এটা আমার ঠাকুরদার ছিল৷ এ নিয়ে তিনি কুড়িটা নরমুণ্ড শিকার করেছিলেন৷ সেগুলোও ও-ঘরে রাখা আছে৷ ওখানে গেলে মারঙের সঙ্গেও দেখা হবে আমাদের৷ বাচ্চাটা সুস্থ হোক, তারপর ওর মজা দেখাব৷ ও কী একজনকে বলেছে জান? একটা নরমুণ্ড যদি শিকার করা যায় তাহলে নাকি আবার ফসল ভালো হবে! বোঝো ব্যাপারটা৷ আমাকে ডিমাপুর থেকে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাক আর কি!’
আং-এর সঙ্গে এরপর হেড হান্টারদের দেখার জন্য এগোল আভাসরা৷ কুয়াশা কেটে গেছে৷ জেগে উঠেছে গ্রাম৷ তির-ধনুক আর বর্শা নিয়ে নাগা যুবকরা কেউ শিকার করতে যাচ্ছে জঙ্গলে, কেউ কুঠার নিয়ে কাঠ কাটতে যাচ্ছে৷ নাগা মহিলারা কেউ বাড়ির সামনে বিরাট পাথুরে চাকিতে কাঠের ভারী দণ্ড নিয়ে শস্য পেষাই করছে, আবার কেউ-বা চাটাই বা শাল বুনছে তাদের কুঁড়ের সামনে বসে৷ কাজ করতে করতে অবাক চোখে তারা দেখছে আভাসদের৷ কেউ কেউ মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান জানাচ্ছে আংকে৷
আং-এর সঙ্গে আভাসরা এসে উপস্থিত হল একটা বেশ লম্বা, শনের চালঅলা একপাশ উন্মুক্ত কুটিরের সামনে৷ ভিতরটা বেশ নোংরা৷ কয়েকজন অতি বৃদ্ধ লোক উবু হয়ে বসে আছে সেখানে৷ মুখে তাদের উল্কি আঁকা৷ গায়ে শাল জড়িয়ে বসে লম্বা বাঁশের নলে মুখ দিয়ে তারা হুঁকো খাচ্ছে৷ একটা উৎকট ধোঁয়ার গন্ধ চারপাশে৷ সেটা নাকে যেতেই মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করে উঠল আভাসের৷
লংপু আগে এসেছে এ জায়গাতে৷ সে চাপা স্বরে আভাসদের বলল, ‘আফিমের গন্ধ৷ এরাই ‘হেড হান্টার’৷ ব্রিটিশরা এই নেশাটা এদের কৌশলে ধরিয়ে দিত নরমুণ্ড শিকার থেকে বিরত রাখতে৷’
গ্রামপ্রধানকে আর আভাসদের দেখে লোকগুলোর মধ্যে কয়েকজন বাইরে বেরিয়ে এসে সূর্যের আলোতে সার বেঁধে দাঁড়াল তাদের সামনে৷ হেড হান্টার! এক সময় এরাই নরমুণ্ড শিকার করত! দিনের আলোতেও সেই ন্যুব্জ অশীতিপর উল্কি আঁকা মুখগুলো দেখে আভাসের গা’টা কেমন শিরশির করে উঠল৷ আং একজনকে দেখিয়ে বললেন, ‘এর নাম হল ‘ওয়াক’৷ হেড হান্টার৷ খেয়াল করো, ওর গলায় দস্তার তৈরি ন’টা নরমুণ্ডর লকেট ঝুলছে৷ এক-একটা নরমুণ্ড শিকার করার পর এক-একটা লকেট গলায় ঝোলানো হত, আর এক-একটা নতুন উল্কি আঁকা হত মুখে৷ ও ন’টা নরমুণ্ড শিকার করেছিল৷’
আভাসরা তাকিয়ে দেখল, আরও যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের গলাতেও একই রকম লকেট ঝুলছে৷ কারো গলায় তিনটে, কারো গলায় পাঁচটা, কারো দুটো!
আং এরপর বললেন, ‘এরা কিন্তু গ্রামের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি৷ ‘মাউ বো’ বলে একজনের গলায় ষোলোটা লকেট ছিল৷ গত শীতে সে মারা গেছে৷ একশো বছর বয়স হয়েছিল তার৷ ওয়াকের বয়স পঁচাশি৷ ও একটু ইংরিজি জানে৷ ওর সঙ্গে কথা বলতে পারো তোমরা৷’
ওয়াক বলে লোকটা তার নাম শুনে একটা লাঠিতে ভর দিয়ে এগিয়ে এসে ফোকলা দাঁতে হেসে করমর্দন করল আভাসদের সঙ্গে৷ তার শীর্ণ হাতটা স্পর্শ করে এক অদ্ভুত অনুভূতি হল আভাসের৷ তার গা’টা কেমন যেন করে উঠল৷ এই হাতেই তো এই বুড়ো লোকটা একদিন…৷
স্মিথ তাকে জিগ্যেস করল, ‘তুমি নরমুণ্ড শিকার করতে?’
প্রশ্নটা কানে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই বৃদ্ধের নিস্প্রভ চোখ দুটো যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ বেশ গর্বিতভাবে সে বলল, ‘হ্যাঁ, করতাম৷ সে সব দিন ছিল বটে!’
‘মানুষ শিকার করতে তোমার খারাপ লাগত না?’
স্মিথের এ প্রশ্নের জবাবে ওয়াক বলল, ‘খারাপ লাগবে কেন? আমরা ফসলের জন্য মাটি-দেবতাকে খুশি করার জন্য মুন্ডু নিতাম৷ ভালো ফসল ফলত৷’ এবারও তার কণ্ঠে গর্বের ছোঁয়া৷ অপরাধবোধের কোনো চিহ্ন নেই৷ স্মিথ এরপর তাকে বলল, ‘ধরো যদি তোমার যৌবন ফিরে আসত তবে নরমুণ্ড শিকার করতে তুমি?’ বৃদ্ধ কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল স্মিথের দিকে তারপর আভাসদের চমকে দিয়ে স্মিথের উদ্দেশে বলল, ‘হ্যাঁ, করতাম৷ তোমার মতো সোনালি চুলের একটা মাথা নেবার খুব শখ ছিল আমার৷ মাউ বো একটা নিয়েছিল৷ সাহেবরা চলে গেল দেশ থেকে, সরকার আইনও করল, আমারও বয়স হল৷ বয়স ফিরে পেলে ধরো তোমার মাথাটাই…৷’ তার কথা শুনে হাসতে লাগল অন্য বৃদ্ধেরা৷ আভাসের মনে হল তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো আসলে মানুষ নয়, এরা ঘাতক৷
স্মিথ এরপর তাকে আরও কিছু প্রশ্ন করার পর ওয়াক আর অন্য লোকগুলোর মুখের উল্কিগুলোর ছবি তুলতে লাগল৷ এক ধরনের পাতার রসের সঙ্গে কাঠকয়লার গুঁড়ো মিশিয়ে নাকি নাগাদের এই উল্কি আঁকা হয়৷ এই উল্কি নাগা সংস্কৃতির প্রাচীন অঙ্গ৷ বিভিন্ন উল্কির বিভিন্ন মানে আছে৷ যেমন আং-এর নিজের গালের মাপের উল্কি তার পদমর্যাদার প্রতীক৷ প্রাচীনকাল থেকে কনয়্যাক ও অন্যান্য নাগাগোষ্ঠীর মধ্যে উল্কি আঁকার প্রথা চলে আসছে৷ আভাসরা বেশ কিছুটা সময় কাটাল তাদের সঙ্গে৷ তারপর আং তাদের নিয়ে চললেন লংপুর বলা সেই স্যুভেনির রুমের দিকে৷
বাঁশের তৈরি তথাকথিত ‘স্যুভেনির হাউস’টা মাটি থেকে বেশ কিছুটা ওপরে কাঠের খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে৷ মাথায় শনের ছাদঅলা লম্বাটে একটা ঘর৷ বাড়ি বা ঘরটার চারপাশ কাঠের বেড়া দিয়ে ঘেরা৷ ঘরটার ছাদ থেকে, বাইরের দেওয়ালের গা থেকে ঝুলছে নানা ধরনের প্রাণীর খুলি, শিংঅলা মাথা ইত্যাদি৷ ঘরটায় ওঠার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছে মুখে উল্কি আঁকা বর্শাধারী দু-জন নাগা গার্ড৷ আভাসরা সেখানে পৌঁছতেই ঘরটা থেকে নীচে নেমে এসে দাঁড়াল একজন৷ গতকালের সেই মারঙ জাদুকর৷ তার গায়ে আজ ভালুকের ছালের শালের বদলে মাথাসুদ্ধ একটা চিতাবাঘের ছাল জড়ানো৷ তার লেজটা মাটিতে লুটোচ্ছে৷ সকালের সূর্যের আলোতে ঝলমল করছে উজ্জ্বল হলুদ রঙের বাঘছালটা৷ আভাসদের দেখে জাদুকর আং-কে জিগ্যেস করল, ‘এরা কি খুলিঘর দেখবে?’
আং বেশ কর্কশভাবে জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, দেখবে৷ কেন তোমার আপত্তি আছে?’
মারঙ জাদুকরের ঠোঁটের কোণে একটা দুর্বোধ্য হাসি ফুটে উঠল৷ সে জবাব দিল, ‘না আপত্তি নেই৷’ তারপর আং-কে প্রশ্ন করল, ‘ফসল বোনার সময় তো হয়ে এল৷ কী ভাবনা তোমার?’
আং জবাব দিলেন, ‘ভাবনা যাই থাক তোমার ফাঁদে আমি পা দেব না৷ ফসল তো পঙ্গপালের পেটে গেলই৷ তার সঙ্গে সঙ্গে আমার অমন নধর মোষটাও গেল!’
মারঙ তাঁর কথা শুনে বলল, ‘যা বলেছিলাম তা যদি করতে তা হলে প্রেতাত্মারা পঙ্গপাল পাঠিয়ে ফসল নষ্ট করতে পারত না৷ মোষের কথাটা আমি বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে বলেছিলাম৷ সব সময় তা কাজ দেয় না৷’
আং এবার বেশ উত্তেজিতভাবে বললেন, ‘তোমার কোনো কথাই আমি বিশ্বাস করি না৷ বাচ্চা ছেলেটা যদি সুস্থ হয়ে ওঠে তবে তোমার বিচারের জন্য সভা বসাব আমি৷ এ গ্রামে আর থাকা হবে না তোমার৷ অন্য কোনো কনয়্যাক গ্রাম বা যেখানে খুশি চলে যেও৷’
মারঙ জাদুকরের সঙ্গে এরপর আর কোনো বাক্যালাপ না করে আভাসদের নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে সেই স্যুভেনির রুমে প্রবেশ করলেন আং৷ অন্ধকার ঘর৷ প্রথমে কিছু চোখে পড়ল না আভাসদের৷ কিন্তু আং ঘরের একটা জানলা খুলতেই আলোকিত হয়ে উঠল ঘরটা৷ আভাসরা অবাক হয়ে গেল ঘরটা দেখে৷ কাঠের ঘরটার চারপাশে দেওয়ালের গায়ে দড়ি দিয়ে ঝোলানো বাঁশের র্যাকে রাখা আছে সার সার মানুষের মাথার খুলি! আর দেওয়ালের এক কোণে মেঝেতে মাদুরের ওপরও স্তূপ করা আছে বেশ কিছু নরমুণ্ড! আর যে অস্ত্র দিয়ে এই নরমুণ্ডগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল সেই বাঁশের দণ্ডের মাথায় তলোয়ারের ফলার মতো বেশ কিছু কুঠারও দাঁড় করানো আছে ঘরের অন্য একটা কোণে৷ প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে আভাস মন্তব্য করল, ‘অদ্ভুত! অবিশ্বাস্য!’
আং বললেন, ‘আরও অনেক ছিল, কিন্তু সব নষ্ট হয়ে গেছে৷ এখন এই কটাই মাত্র আছে৷’
এই কটা মানে অন্তত একশোটা হবে৷ নরমুণ্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে আন্দাজ করল আভাসরা৷ তবে সেগুলো যে বেশ প্রাচীন তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ আং বললেন, ‘শেষ নরমুণ্ড শিকার হয় ১৯৫০ সালে৷ তবে সেটা এখানে নেই৷ পুলিশ নিয়ে যায়৷ যে কাজটা করেছিল তার ফাঁসিও হয়৷ এখানের সবকটা খুলি অন্তত ষাট-সত্তর বছরের পুরোনো৷ দু-তিনশো বছরের পুরোনো কিছু খুলিও আছে৷’
স্মিথ বলল, ‘এখানে কিন্তু অনেকক্ষণ সময় লাগবে আমার৷ প্রত্যেকটা খুলি আমি পরীক্ষা করব, ছবি নেব৷ অন্তত ঘণ্টাতিনেক লাগবে কাজ শেষ হতে৷’
আং বললেন, ‘কিন্তু আমার তো অন্য কাজ আছে, আমাকে যেতে হবে৷ তুমি তাহলে তোমার কাজ করো৷ অসুবিধা হবে না৷’
স্মিথ বলল, ‘হ্যাঁ, সেই ভালো৷’
তাদের সেখানে রেখে ঘর ছেড়ে বেরোবার আগে আং বললেন, ‘ও, আর একটা কথা৷ গ্রামে আমাদের একটা সমবায় সংস্থা আছে৷ সেখানে নাগা শাল, বাঁশের তৈরি ঘর সাজাবার নানা জিনিস পাওয়া যায়৷ আমরাই তৈরি করি৷ খাঁটি জিনিস৷ এসব ডিমাপুরে পাবে না৷ দামেও সস্তা৷ পারলে ওখান থেকে কিছু জিনিস কিনো৷ ট্যুরিস্টদের ওপর নির্ভর করেই দোকানটা চলে৷ এ বছর আবার ফসল হয়নি৷’
আং চলে যাবার পর স্মিথ তার কাজ শুরু করল৷ বেশ যত্ন করে এক একটা খুলি উঠিয়ে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে সেগুলো দেখা শুরু করল৷ মাঝে মাঝে তার ছবিও তুলতে লাগল৷ আভাস আর লংপু চুপচাপ দাঁড়িয়ে তার কাজ দেখতে লাগল৷ টুকটাক কথাও চলতে লাগল৷ কাজ করতে করতে স্মিথ একসময় বলল, ‘যেন, বিভিন্ন জাতি, বিভিন্ন বয়সের স্ত্রী-পুরুষের মাথার খুলি আছে এখানে৷ আমরা যারা নৃতত্ত্ববিদ, লোকসংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করি, তাদের কাছে এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ বিভিন্ন জাতির মানুষের করোটির গঠনে সূক্ষ্ম পার্থক্য থাকে৷’
‘হ্যাঁ, থাকে৷ এখানে একটা সাহেবের খুলিও ছিল৷ সেটা এখন নেই৷ তবে আং-এর লাঠিতে যে খুলিটা ছিল সেটাই তো তোমরা পরীক্ষা করতে পারতে৷ এত খাটতে হত না৷’ ভাঙা ভাঙা ইংরিজিতে কথাগুলো কানে আসতেই আভাসরা চমকে উঠে পিছনে তাকিয়ে দেখল, কখন যেন তাদের অজান্তে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মারঙ জাদুকর৷ তার ঠোঁটের কোণে জেগে আছে অস্পষ্ট একটা হাসি৷
এর পর সে স্মিথের উদ্দেশে বলল, ‘বাচ্চা ছেলেটাকে নিশ্চয় ওষুধটা তুমিই দিচ্ছ? ওকে সুস্থ করার এলেম আং-এর নেই৷ আং একটা ভীরু-কাপুরুষ-অকর্মণ্য লোক৷ বংশপরম্পরায় ‘আং’ হয়ে বসে আছে৷ ও ভাবছে আমাকে গ্রামছাড়া করবে৷ কিন্তু ওর সে আশা পূর্ণ হবে না৷ গ্রামে তো দুর্ভিক্ষ চলছে৷ ওকেই লোকে ছাড়বে না৷ আমিই কিছুদিনের মধ্যে গ্রামপ্রধান হব৷’ আভাসরা এবার খেয়াল করল মারঙের হাতে ধরা আছে একটা গিরগিটি! তার কথা শুনে স্মিথ বলল, ‘ভবিষ্যতে আপনারা কে গ্রামপ্রধান হবেন সেটা আপনাদের ব্যাপার৷ আমরা ট্যুরিস্ট৷ এখানে বেড়াতে এসেছি, কিছু কাজও করতে এসেছি৷ কাজ শেষ হলে কাল-পরশু চলে যাব৷ আপনাদের ব্যাপার নিয়ে আমাদের তেমন মাথাব্যথা নেই৷’ একটু রুষ্টভাবেই স্মিথ কথাগুলো বলল৷
জাদুকর মারঙ তার কথা শুনে এবার হেসে বলল, ‘মাথাব্যথার ব্যাপার না থাকলেও মাথা নিয়ে কোনো ব্যাপার তো আছেই৷ এ গ্রামটা ‘মাথা দেওয়া-নেওয়া’র জন্যই তো বিখ্যাত৷’
আভাসের জাদুকরের কথাটা ঠিক বোধগম্য হল না৷ কিন্তু তার কেন জানি মনে হল জাদুকরের কথা শুনে স্মিথ মৃদু চমকে উঠল৷ স্মিথ তাকিয়ে রইল মারঙ জাদুকরের দিকে৷
মারঙ এরপর স্মিথের উদ্দেশে বলল, ‘কাল তোমাকে দেখার পর থেকেই আমার মনে হচ্ছে তোমাকে আগে আমি দেখেছি৷ তোমার সোনালি চুল, নীল চোখ, উন্নত নাসা, তোমার উচ্চতা, এ সবকিছুই বলছে তোমাকে আমি আগে দেখেছি৷’ কথা শেষ করে গিরগিটিটাকে হাতের তালুতে নিয়ে খেলতে লাগল মারঙ৷ স্মিথ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘আমাকে এর আগে দেখার কোনো সম্ভাবনা আপনার নেই৷ এই প্রথম আমি আপনাদের গ্রামে এলাম, এ দেশেই আমি প্রথম এসেছি৷ হয়তো আপনার কোনো ভুল হচ্ছে৷’
জাদুকর তার কথা শুনে গম্ভীরভাবে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল৷ তার উল্কি আঁকা অসংখ্য বলিরেখাময় মুখমণ্ডলে কপালের ভাঁজগুলো যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল৷ কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ওষ্ঠাধরে আবার হাসি ফুটে উঠল৷ সে স্মিথকে বলল, ‘বুঝতে পারলাম৷ তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে৷ আমি বাইরে আছি, কাজ শেষ হলে বলব৷’ এই বলে সে দরজার সামনে থেকে অন্য দিকে চলে গেল৷
সে চলে যাবার পর আভাস স্মিথকে জিগ্যেস করল, ‘ও তোমাকে কী কথা বলবে বলো তো?’ একটা খুলি হাতে নিয়ে স্মিথ একটু আনমনাভাবে বলল, ‘কে জানে কী বলবে? হয়তো কোনো বুজরুকি দেখিয়ে পয়সা হাতাবার চেষ্টা করবে৷ তবে তাতে লাভ হবে না৷’ কথাগুলো বলে স্মিথ আবার তার কাজে মনোনিবেশ করল৷ আভাস আর লংপু চুপচাপ দাঁড়িয়ে তার কাজ দেখতে লাগল৷
স্মিথ একসময় আভাসকে বলল, ‘তোমরা তো চুপচাপ দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করছ৷ আমার তো আরও সময় লাগবে৷ তোমরা বরং একটা কাজ করো৷ আং যেখানে তাঁদের হস্তশিল্প বিক্রি হয় বললেন, সে জায়গা থেকে একবার ঘুরে এসো৷ সময়ও কাটবে, কেনাকাটিও হবে৷ আমার কাজ যদি শেষ হয় তবে হয়তো কালই ফেরার পথ ধরব৷ সময় অভাবে হয়তো তোমার সেখানে যাওয়াই হবে না৷ আর হ্যাঁ, আমার জন্য স্যুভেনির হিসাবে একটা শাল কিনো৷ যা দাম হয় আমি দেব৷’
এটা সত্যি যে দীর্ঘক্ষণ সে ঘরটার মধ্যে আভাসের আর দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছিল না৷ লংপুরও সম্ভবত তার মতোই একই বোধ হচ্ছিল৷ সে আভাসকে বলল, ‘ও জায়গা আমি চিনি৷ চলুন আপনাকে ঘুরিয়ে আনি৷’ স্মিথ বলল, ‘হ্যাঁ, ঘুরে এসো৷’
স্মিথের থেকে বিদায় নিয়ে সে বাড়ি ছেড়ে নীচে নামল তারা৷ আভাস দেখতে পেল মারঙ জাদুকর কথা বলছে নাগা-গার্ডদের সঙ্গে৷ সে আভাসদের কিছু বলল না৷ লংপুর সঙ্গে আভাস এগোল সেই হস্তশিল্প যেখানে বিক্রি হয়, সেদিকে৷
গ্রামের মধ্যেই দোকানটা৷ নাগা রমণীরা তাদের পসরা নিয়ে বসে আছে ট্যুরিস্টদের জন্য৷ এটা অবশ্য ট্যুরিস্ট সিজন নয়৷ ট্যুরিস্ট বলতে এখন কেবল আভাসরাই৷ শালের তৈরি হাতকাটা নাগা জ্যাকেট, গায়ের শাল, চাদর, বাঁশের তৈরি মাদুর-টুকরি, এমনকি ছুরি-তির-ধনুক-বল্লমের মতো বেশ কিছু নয়া অস্ত্রও৷ বেশ কিছুক্ষণ ধরে এটা-ওটা দেখার পর নিজের জন্য মোষের শিং-এর হাতলঅলা ফলকাটার জন্য একটা নাগা ছুরি আর স্মিথের জন্য একটা নাগা শাল কিনে সেই খুলিঘরে ফেরার পথ ধরল আভাস৷ মেঘমুক্ত নীল আকাশ৷ চারপাশের পান্নাসবুজ পাহাড়, উপত্যকা সব ঝলমল করছে সূর্যের আলোতে৷ তার মধ্যে এক টুকরো পিকচার পোস্টকার্ডের মতো দাঁড়িয়ে আছে কনয়্যাক নাগাদের গ্রামটা৷ আভাসদের মাথার ওপর দিয়ে একঝাঁক টিয়া পাখি ট্যাঁ ট্যাঁ ডাকতে ডাকতে এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড়ে উড়ে গেল৷ খুব সুন্দর পরিবেশ৷ চারপাশে গ্রামের যে সব মানুষ যাওয়া-আসা করছে তাদের দেখে সরল বলেই মনে হয়৷ যদিও তাদের অনেকের মুখে-বাহুতে বীভৎস উল্কি আঁকা৷ গ্রামবাসীরা মাঝে মাঝেই আভাসের দিকে তাকিয়ে সৌজন্য দেখিয়ে হাসছে৷ কে বলবে ষাট-সত্তর বছর আগে এদের পূর্বপুরুষরাই আভাসদের মতো কাউকে এ গ্রামের আশেপাশে পেলে কুঠার দিয়ে তার মুন্ডু কেটে নিত!
হাঁটছিল আভাস৷ হঠাৎই ছুটতে ছুটতে তাদের সামনে আবার হঠাৎ এসে উপস্থিত হল সেই বাচ্চা ছেলেটা! টুংলিং! রাস্তার পাশে একটা বাড়ির দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে সে দুর্বোধ্য ভাষায় আভাসকে কী যেন বলতে শুরু করল৷ আভাস লংপুকে জিগ্যেস করল, ‘বাচ্চাটা কী বলছে?’
লংপু বলল, ‘ওটা হল সেই অসুস্থ বাচ্চাটার বাড়ি৷ টুংলিং বলছে সে জানলা দিয়ে দেখেছে সেই বাচ্চাটা নাকি উঠে বসেছে৷ সে সুস্থ হয়ে উঠছে৷ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে আপনাদের৷ ও অনুমান করছে ব্যাপারটা আপনাদের জন্যই ঘটেছে৷’
আভাস শুনে হেসে টুংলিংকে বলল, ‘তোমার পাখিটা তাহলে জাদুকরের হাত থেকে বেঁচে গেল৷’ লংপু কথাটা অনুবাদ করে দিতেই হাসি ফুটে উঠল ছেলেটার মুখে৷ আভাসের হাতে একটা চুমু খেয়ে তার পাখিটা নিয়ে নাচতে নাচতে কিছুটা এগিয়েই সম্ভবত মনের আনন্দেই আকাশে উড়িয়ে দিল তার বাজপাখিটাকে৷
৷৷ ৪৷৷
আভাসরা খুলিঘরের কাছে উপস্থিত হয়েই দেখতে পেল ঘরটার নীচে স্মিথ আর মারঙ জাদুকর দাঁড়িয়ে আছে৷ তাদের দেখতে পেয়ে স্মিথ জাদুকরকে বলল, ‘তাহলে এবার আমি যাচ্ছি?’
জাদুকর তার পোষ্য গিরগিটির মতো প্রাণীটার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, ‘ওর ঘরটা চিনতে অসুবিধা হবে না৷ ঘরের ঠিক সামনে একটা মোষের খুলি লাঠির মাথায় বসানো আছে৷ বলবে আমি তোমাদের পাঠিয়েছি৷’
স্মিথ হেসে জবাব দিল, ‘বলব৷’
মারঙ জাদুকর খুলিঘরের ওপরে উঠে গেল, আর সেখান থেকে অন্যদিকে হাঁটতে হাঁটতে আভাস স্মিথকে জিগ্যেস করল, ‘লোকটাকে তো সুবিধার বলে মনে হয় না৷ জাদুকর কী বলল তোমাকে?’
স্মিথ হেসে বলল, ‘আসলে এই সব জনগোষ্ঠীর নিজস্ব কিছু রীতি-নীতি-ধর্মবিশ্বাস আছে৷ যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এসব বিশ্বাস৷ সভ্য পৃথিবীর কাছে তা ভালো না লাগলেও এটা তাদের সংস্কৃতিরই অঙ্গ৷ জাদুকরের সঙ্গে কথা বলে তাকে খারাপ লোক বলে মনে হল না৷ কিছুটা ভড়ং অবশ্যই তার আছে, নইলে কেউ তাকে মানবে না৷ আর আং-এর সঙ্গে ওর সমস্যাটা ওদের গ্রামীণ বিবাদের ব্যাপার৷ সভ্য পৃথিবীতেও ক্ষমতার জন্য যা হয়ে থাকে৷ জাদুকর আমাকে উল্কির ব্যাপারে অনেক তথ্য দিল৷ একজনের খোঁজও দিল৷ আমরা এখন সেখানেই যাব৷ তারপর যাব আং-এর সঙ্গে দেখা করতে৷ আমার কাজ মোটামুটি আজই শেষ হয়ে যাবে৷ কাল ভোরেই গ্রাম ছাড়ব আমরা৷’
গ্রামের প্রায় শেষ প্রান্তে একটা ঝাঁকড়া গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে একটা কুঁড়েঘর৷ তার সামনে একটা বাঁশের খুঁটিতে বিরাট শিংসমেত মহিষের মাথা ঝুলছে৷ মারঙ জাদুকরের নির্দেশ মতো স্মিথ আভাসদের নিয়ে সে ঘরটার সামনে উপস্থিত হতেই একজন লোক বাইরে বেরিয়ে এল৷ তাকে দেখে আভাসরা হতবাক হয়ে গেল৷ লোকটার পরনে নামমাত্র একটা লেংটি, আর অলংকার বলতে একটা ছোট্ট বাঁশের নল, এফোঁড়-ওফোঁড় করে নাকে বেঁধানো আছে৷ তবে তার আসল অলংকার ছড়িয়ে আছে তার গায়ে৷ উল্কি! মুখ থেকে শুরু করে তার পায়ের পাতা পর্যন্ত বিচিত্র সব উল্কি আঁকা৷ বিভিন্ন নকশা থেকে শুরু করে মড়ার খুলি, বাজপাখি, সাপ, বিছা, কী আঁকা নেই লোকটার শরীরে! সম্ভবত সেগুলো অন্য লোকদের দেখাবার জন্যই শুধু লেংটি পরে আছে সে৷ লোকটা তাদের উদ্দেশে বলল, ‘উল্কি আঁকাবে তো?’
স্মিথ বলল, ‘আমরা তোমার ছবি তুলব আর উল্কিও আঁকাব৷’
আভাস বেশ অবাক হয়ে স্মিথকে বলল, ‘সে কী! তুমি উল্কি আঁকাবে?’
স্মিথ হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, আঁকাব৷ ইউরোপে উল্কি আঁকা এখন লেটেস্ট ফ্যাশন৷ উল্কিটাই স্যুভেনির হিসাবে নিয়ে যাব আমি৷’
স্মিথ এরপর ক্যামেরা বার করে বেশ অনেকক্ষণ ধরে ছবি নিল কনয়্যাক উল্কিঅলার৷ আভাসও ছবি তুলল৷ স্মিথ তারপর লোকটাকে বলল, ‘হ্যাঁ, উল্কি আঁকাব আমি৷’
লোকটা তার কথা শুনে তার শরীরটা চারপাশে ঘুরিয়ে বলল, ‘দেখো, কোন ছবিটা আঁকাবে?’
স্মিথ লংপুর মাধ্যমে তাকে বলল, ‘না, এসব উল্কি নয়, ‘টেকো গোকো’র উল্কি আঁকাব আমি৷’
আভাস অবাক হয়ে বলল, ‘সেটা আবার কী?’
স্মিথ জবাব দিল, ‘এক ধরনের দুষ্প্রাপ্য গিরগিটি ধরনের প্রাণী৷ জাদুকরের হাতে যেটা ছিল৷’ তারপর সে উল্কিঅলার উদ্দেশে বলল, ‘জাদুকর মারঙ আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছে, এঁকে দিতে পারবে তো? তাহলে আজ সন্ধ্যায় অতিথিশালায় আসবে৷’
‘টেকো গোকো’-র কথাটা শুনেই একটা বিস্ময়ের চিহ্ন যেন ফুটে উঠেছিল উল্কিঅলার মুখে৷ কিন্তু মারঙের নাম শুনে এরপর সে বলল, ‘ও বুঝলাম৷ ঠিক আছে আমি ঠিক সময় চলে যাব তোমাদের ঘরে৷’ আর কোনো কথা না বলে লোকটা ঘরের ভিতর ঢুকে গেল৷ আভাসরা সেখান থেকে রওনা হল আং-এর কাছে যাবার জন্য৷
আং-এর ঘর পর্যন্ত কিন্তু যেতে হল না৷ গ্রামের মাঝখানেই দেখা হয়ে গেল আং-এর সঙ্গে৷ একদল নাগা যুবক জঙ্গল থেকে বিরাট একটি হরিণ শিকার করে ফিরছে৷ একটা বাঁশের খুঁটিতে হরিণটা ঝুলিয়ে ফিরছিল নাগা শিকারিরা৷ তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কী যেন কথা বলছিলেন আং৷ আর সেখানে উপস্থিত হতেই আং তাদের চলে যেতে বলে আভাসদের উদ্দেশে বললেন, ‘আমার ঝামেলা কী কম? রোজ যা শিকার হয় তার মাংস, চামড়া, শিং এসব আমাকেই ভাগ করে দিতে হয়৷ নইলে এরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে৷ তাছাড়া আং হিসাবে মাংসের একটা ভাগ আমার নিজেরও প্রাপ্য৷ তা খুলিঘর তোমরা কেমন দেখলে? ওই শয়তান মারঙটা কিছু অসুবিধা করেনি তো? বাচ্চাটা সুস্থ হয়ে উঠছে৷ কাল ভাবছি আমি সভা বসাব৷ মারঙের বিচারসভা৷’
স্মিথ হেসে প্রথমে বলল, ‘না, কোনো অসুবিধা হয়নি৷ খুলিগুলো দেখলাম, ছবি নিলাম৷’ তারপর সে আং-কে বলল, ‘কিছু যদি মনে না করেন তবে আপনার হাতের বর্শার খুলিটা একটু দেখব৷ আপনাদের উল্কি আর খুলির ছবিই তুলতে এসেছি আমি৷ এটাই-বা বাদ যাবে কেন?’
আং তাঁর বর্শাটা স্মিথের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘দেখো, দেখো, এটা সুদ্ধ আমার একটা ছবি তুলো৷ দেশে ফিরে লোকজনকে ছবিটা দেখিয়ে আমার কথা বোলো৷’ বেশ আগ্রহের সঙ্গেই তিনি এগিয়ে দিলেন বর্শাটা৷ স্মিথ বর্শাটা হাতে নিয়ে খুলিটা বেশ অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল৷ তারপর সেটা আং-এর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমার কাজ শেষ৷ কাল ভোরেই কিন্তু গ্রাম ছেড়ে চলে যাব আমরা৷ ওষুধগুলো তো আপনার কাছে দেওয়াই আছে৷ যেমন বলেছি তেমন খাইয়ে গেলে ছেলেটা সুস্থ হয়ে উঠবে৷’
আং একটু বিমর্ষভাবে বললেন, ‘চলে যাবে? হরিণের শিং-চামড়া কিনবে? বেশ কম দামে দেব৷’
স্মিথ হেসে বলল, ‘না, আমরা ওসব কিনব না৷ আপনারা পশুপাখি শিকার করলেও ওসব কেনাবেচা নিষিদ্ধ৷ শহরে নিয়ে গেলে পুলিশ ধরবে৷ আচ্ছা, আপনার খুলিটা কোন জাতের মানুষের বলুন তো? ঠিক বুঝতে পারলাম না৷’ আং স্মিথের দিকে তাকিয়ে দায়সারাভাবে জবাব দিলেন, ‘তা ঠিক জানি না৷ এটা বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলাম৷ ঠিক আছে, আমি এখন যাই, কাজ আছে৷’ এই বলে তিনি স্মিথের হাত থেকে খপ করে বর্শাটা নিয়ে তাদের হরিণের শিং-চামড়া বেচতে না পারার কারণেই সম্ভবত একটু ক্ষুণ্ণ হয়ে অন্য দিকে পা বাড়ালেন৷ আভাসরা ফিরে চলল অতিথিশালার দিকে৷
বিকালবেলা লংপু আভাসদের নিয়ে গেল গ্রামের বাইরে একটা ঝরনা দেখাতে৷ সেখান থেকে সন্ধ্যার আগেই তারা নিজেদের আস্তানায় ফিরে এল৷ অন্ধকার নামার পরই এল সেই অদ্ভুত লোকটা৷ তার সঙ্গে উল্কি আঁকার নানা সরঞ্জাম৷ মাটির ভাঁড়ে রঙ, সূচিমুখ পাথরের টুকরো, শজারুর কাঁটা, বেশ কয়েক ধরনের ঔষধি গাছের পাতা ইত্যাদি৷ দরজা বন্ধ করে মোমের আলোতে শুরু হল উল্কি আঁকার প্রস্তুতি৷ যেখানে উল্কি আঁকা হবে সেখানে প্রথমে আরক মাখিয়ে স্মিথকে কিছুক্ষণ মাটিতে শুইয়ে রাখা হল পাতা চাপা দিয়ে৷ তারপর সূচিমুখ পাথরের টুকরো আর ভেষজ রঙ দিয়ে আরম্ভ হল আঁকা৷ ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক এক পদ্ধতি৷ প্রায় ঘণ্টাতিনেক দাঁতে দাঁত চেপে স্মিথ শুয়ে থাকার পর শেষ হল উল্কি৷ স্মিথের গলার এক পাশে আঁকা হয়ে গেল ছোট্ট ইঞ্চিতিনেক লম্বা একটা ‘টেকো গোকো’-র ছবি৷ কাজ শেষ করে বাইরে যাবার সময় লোকটা বলল, ‘মারঙ বলেছে, তাই পয়সা নেব না৷ সে চাইলে ফসল ভালো হবে৷’
স্মিথ আভাসদের সঙ্গে সারারাত আর কোনো কথা বলল না৷ সম্ভবত যন্ত্রণার জন্য ক্ষতস্থানে পাতা চাপা দেওয়া অবস্থায় চুপচাপ শুয়ে রইল৷ এক সময় আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল সকলে৷
ভোর হল এক সময়৷ আভাস ঘুম থেকে উঠে দেখল স্মিথ তার আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে৷ গতকালের যন্ত্রণার রেশ কাটিয়ে আজ বেশ চনমনে দেখাচ্ছে তাকে৷ সে নিজেই পাতা চাপা দেওয়া উল্কি-আঁকা গলার পাশটা দেখিয়ে বলল, ‘একটু ব্যথা থাকলেও আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ৷ তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও৷ কিছুক্ষণের মধ্যে বেরিয়ে পড়তে পারলে বিকালের মধ্যেই ডিমাপুর পৌঁছে যাব৷ লংপু গাড়িটা আনতে গেছে৷’
আভাস বলল, ‘যাবার আগে একবার আং-এর সঙ্গে দেখা করে যাবে না?’
স্মিথ জবাব দিল, ‘তার আর দরকার নেই৷ দেখলে না, কাল কেমন আমাদের হরিণের শিং গছাবার চেষ্টা করছিল৷ দেখা করতে গেলে হয়তো আবার টাকা-পয়সা চেয়ে বসবে৷ যা দেবার তো প্রথম সাক্ষাতেই দিয়েছি৷’ আভাস চটপট তৈরি হয়ে নিল৷ বাইরে গাড়ির মৃদু শব্দ শুনতে পেয়ে তারা বুঝল গাড়ি চলে এসেছে৷ সেই কনয়্যাক গ্রামের অতিথিশালা থেকে তারা যখন গাড়িতে উঠে বসল তখন সূর্যদেব সবে আলো ছড়াতে শুরু করেছেন এই সবুজ উপত্যকায়৷ নাগাদের গ্রামের মাথার ওপর৷ গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল গাড়ি৷ গ্রামের দিকে শেষ একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে আভাস মন্তব্য করল, ‘দুটো দিন বেশ অদ্ভুত জায়গাতে কাটিয়ে গেলাম৷’ স্মিথ মন্তব্য করল, ‘হ্যাঁ, অদ্ভুত জায়গাই বটে! নরমুণ্ড শিকারিদের গ্রাম!’ এগিয়ে চলল গাড়ি৷ গ্রামকে পিছনে ফেলে কিছুটা এগোতেই তাদের যাত্রাপথে একটা কাঠের সাঁকো পড়ল৷ এ সাঁকো পার হয়েই গ্রামে প্রবেশ করেছিল আভাসরা৷ এ সাঁকোটাকেই এদিকে গ্রামের শেষ সীমানা বলা যেতে পারে৷ নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা একটা ছোটো নদী৷ সাঁকোর ওপাশে রাস্তার দু-ধারে শুরু হয়েছে ঘন জঙ্গল৷ দূর থেকে সাঁকোটা চোখে পড়তেই স্মিথ লংপুকে বলল, ‘ব্রিজটা পার হয়েই গাড়িটা কিছুক্ষণের জন্য থামাবে৷ আমার একটা কাজ আছে৷’ কিন্তু ওপারে নয়, সাঁকোর সামনে এসেই থামাতে হল গাড়িটা৷ তাদের গাড়িটা দেখে কোথা থেকে যেন টুংলিং সেখানে সাঁকোর ঠিক মুখটাতে পথ আগলে দাঁড়াল৷ গাড়ি থামতেই সে এগিয়ে এসে দাঁড়াল গাড়ির সামনে৷ তার কাঁধে সেই বাজপাখি, আর হাতে একগোছা বুনো ফুল৷ সেই ফুলগুলো সে গাড়ির জানলা দিয়ে স্মিথের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘তোমার জন্যই আমার পাখিটা বেঁচে গেল৷ ভালো থেকো৷ আবার এসো আমাদের গ্রামে৷’ স্মিথ ফুলগুলো নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, তুমিও ভালো থেকো৷ যদি কোনোদিন আবার আসি তবে তোমার খোঁজ নেব৷’ হাসল টুংলিং, কিন্তু হাসতে হাসতেই তার মুখটা হঠাৎ কেমন যেন বদলে গেল৷ একটা বিস্ময়ের ভাব যেন তার চোখে ফুটে উঠল৷ বাচ্চাটার দৃষ্টি অনুসরণ করে আভাস দেখল সে তাকিয়ে আছে স্মিথের গলার দিকে৷ গাড়ির ঝাঁকুনিতেই মনে হয় কখন যেন পাতাটা খসে পড়েছে, স্মিথের গলায় ফুটে উঠেছে ‘টেকো গোকো’-র ছবি! স্মিথ আর দাঁড়াল না এরপর৷ বাচ্চাটাকে পিছনে ফেলে সাঁকোতে উঠে পড়ল গাড়ি৷ নাগাদের গ্রামটাও পিছনে পড়ে রইল৷
সাঁকোটা পার হয়ে কিছুটা এগোতেই থেমে গেল গাড়ি৷ স্মিথই বলল থামাতে৷ এরপর সে আভাসকে বলল, ‘চলো, একটু নীচে নামব৷ মিনিট দশেকের মধ্যেই আবার ফিরে আসব৷’
আভাস জিগ্যেস করল, ‘কোথায় যাবে?’
স্মিথ বলল, ‘আরে চলোই না? এখনই ফিরব বললাম তো৷’
মালপত্র সব গাড়িতে রেখে নীচে নামল দু-জন৷ তারপর স্মিথ সোজা এগোল রাস্তার ডান পাশের জঙ্গলের দিকে৷ বিস্মিতভাবে আভাস তাকে অনুসরণ করল৷ ঘন জঙ্গল৷ ভোরের আলো সবে প্রবেশ করতে শুরু করেছে তার ভিতর৷ কিছুটা এগোবার পর জঙ্গলের ভিতর সামান্য ফাঁকা মতন জায়গাতে আভাসরা দেখতে পেল একজনকে৷ সেখানে একটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে মারঙ জাদুকর! আভাস বেশ অবাক হয়ে গেল তাকে দেখে৷ কিন্তু স্মিথ যেন জানতই সে সেখানে থাকবে৷ আর মারঙও যেন তার প্রতীক্ষাতেই ছিল৷ স্মিথকে দেখে হাসল সে৷ স্মিথও হাসল তাকে দেখে৷ তারপর বলল, ‘জিনিসটা কই?’
মারঙ জাদুকর বলল, ‘আছে৷ তবে আর একটু ভিতরে চলো৷ আং-এর লোকজন এখানে চলে আসতে পারে৷’ মারঙ হাঁটতে শুরু করল জঙ্গলের আরও ভিতরে৷ আভাসকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে তাকে অনুসরণ করল স্মিথ৷ নিঝুম আদিম জঙ্গল৷ কেউ কোথাও নেই৷ একটা পাখির ডাকও শোনা যাচ্ছে না৷ বেশ অনেকটা এগোবার পর স্মিথ থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আর কতদূর যাব?’
মারঙ কিছুটা দূরে একটা ঘাসবন দেখিয়ে বলল, ‘ওই তো এখানেই আছে জিনিসটা৷ এবার টাকা দাও? তারপর ঘাসবনে ঢুকব৷’
স্মিথ বাক্যব্যয় না করে একটা একশো টাকার বান্ডিল বার করে এগিয়ে দিল তার দিকে৷ টাকাটা নিয়ে হাসল মারঙ জাদুকর৷ তারপর আভাসদের নিয়ে প্রবেশ করল কিছুটা দূরের ঘাসবনের ভিতরে৷ মানুষের মাথা সমান ঘাসবন৷ এক হাত তফাতে কিছু দেখা যায় না৷ আভাসরা কয়েক-পা এগোতেই হঠাৎই সেই ঘাসবনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে তাদের ঘিরে ধরল সাত-আটজন অর্ধউলঙ্গ কনয়্যাক৷ সারা দেহে তাদের উল্কি আঁকা৷ হাতে নাগা কুঠার, বর্শা৷ সেই বর্শার ফলাগুলো বাগিয়ে তারা এগিয়ে আসতে লাগল আভাসদের দিকে৷ বিস্মিত স্মিথ মারঙের উদ্দেশে বলে উঠল, ‘এরা কারা? এসবের মানে কী?’
মারঙ জাদুকর বলল, ‘মানে হল আমাদের সঙ্গে তোমাদের যেতে হবে৷’
স্মিথ বলল, ‘কোথায় যাব? আমরা কোথাও যাব না৷ টাকাটা দাও, আমরা ফিরে যাব৷’ ঠিক এই সময় একজন নাগা যোদ্ধা পাশ থেকে স্মিথের হাতটা চেপে ধরতে গেল৷ স্মিথ তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল ঠিকই কিন্তু তার পরই উপর্যুপরি বেশ কয়েকটা লাঠির বাড়িতে স্মিথ মাটিতে ছিটকে পড়ল৷ আভাস তাদের সঙ্গে কিছুটা ধস্তাধস্তির চেষ্টা করল৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা তীক্ষ্ণ বর্শার ফলা আভাসের কণ্ঠনালী স্পর্শ করে আভাসকে থামিয়ে দিল৷ কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে আছে মারঙ জাদুকর৷ তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠেছে৷ একটা জান্তব হাসি৷ নাগা যোদ্ধার দল তার দিকে তাকিয়ে আছে নির্দেশের প্রতীক্ষায়৷ সে বললেই যেন তারা বর্শার ফলা বিঁধিয়ে দেবে আভাসের গলায়! মারঙ দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন একটা নির্দেশ দিল তার লোকদের৷ তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘাসের দড়ি নিয়ে আভাস আর অচৈতন্য স্মিথকে দুটো লম্বা বাঁশের সঙ্গে বেঁধে ফেলল তারা৷ তারপর শিকার করা পশু যেমনভাবে ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, ঠিক তেমনই তাদের বাঁশে ঝুলিয়ে ঘাসবনের মধ্যে দিয়ে জঙ্গলের গভীরে ছুটতে শুরু করল তারা৷
৷৷ ৫৷৷
ঘরটা পাথুরে৷ মাথার ওপর খড়ের চাল৷ কাঠের একটা দরজা আছে তবে সেটা বেশ শক্তপোক্ত৷ দেওয়ালের গায়ে একটা গোলাকার ফাঁক আছে বটে তবে সেই ফাঁক দিয়ে আভাসরা বাইরে বেরুতে পারবে না৷ এ ঘরেই তাদের রেখে গেছে মারঙ জাদুকর৷ ওভাবে ঝুলিয়ে আনার কারণে, প্রচণ্ড যন্ত্রণা আর উত্তেজনার কারণে আভাসও অজ্ঞান হয়ে গেছিল৷ জ্ঞান ফিরে সে উঠে বসল প্রথমে৷ তার পাশেই মাটিতে পড়ে আছে স্মিথ৷ আঘাতটা বেশ গুরুতর৷ সংজ্ঞা ফেরেনি তার৷ দেওয়ালের ফাটল গলে আলো ঢুকছে ঘরে৷ নানা প্রাণীর হাড়গোড়, খুলি, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ঘরটাতে৷ আভাসরা কোথায় এসেছে জানা নেই৷ তার ঘড়িটাও কোথাও খসে পড়েছে৷ তবে বাইরে থেকে আসা আলোর রেশ দেখে আভাসের মনে হল বেশ বেলা হয়েছে৷ মারঙ তাদের এভাবে বন্দি করে আনল কেন তা কিছুই বুঝতে পারছে না আভাস৷ আর স্মিথই বা তার কাছ থেকে কী কিনতে এসেছিল তাও বোধগম্য হচ্ছে না তার৷ আভাস একবার স্মিথকে ওঠাবার চেষ্টা করল, কিন্তু তার কোনো সাড়া মিলল না৷ আতঙ্কিত, বিপর্যস্ত আভাস তার প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করতে লাগল৷ কিছুতেই তার মাথায় আসছে না কেন এই শয়তান লোকটার ফাঁদে পা দিল স্মিথ৷
দরজা খোলার শব্দ হল৷ ঘরে ঢুকল মারঙ জাদুকর৷ তার পিছনে দরজা আগলে দাঁড়াল মুখে উল্কি আঁকা কুঠারধারী দুই সঙ্গী৷ তাকে দেখেই দেওয়ালের গায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল আভাস৷ মারঙ জাদুকর মাটিতে পড়ে থাকা স্মিথের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ৷ তারপর ভাঙা ভাঙা ইংরিজিতে বলল, ‘ভেবেছিলাম এই সাদা চামড়াটা একাই আসবে৷ তা তুমিও এলে৷ এটা বাড়তি পাওনা৷’ আভাস তাকে জিগ্যেস করল, ‘তোমরা আমাদের এভাবে ধরে আনলে কেন?’
জাদুকর মারঙ প্রথমে বলল, ‘তোমরা ভেবেছিলে ওষুধ দিয়ে বাচ্চাটাকে সুস্থ করে বেশ বাহাদুরি নেবে৷ ফসল বোনার সময় এসে গেছে৷ এবার এমন ফসল ফলাব আমি যে গ্রামের লোক আমাকেই আং বানাবে৷ আমারও অনেক লোক আছে গ্রামে৷ তারা তার জন্য প্রতীক্ষা করে আছে৷’
আভাস বলল, ‘ফসল ফলানো, তোমার আং-হওয়া, তার সঙ্গে আমাদের ধরে আনার সম্পর্ক কী?’ আভাসের প্রশ্ন শুনে মারঙ জাদুকরের মুখে একটা পৈশাচিক হাসি ফুটে উঠল৷ সে বলল, ‘আছে, আছে আছে৷ ঠিক যেভাবে একটা মাথার জোরে আং-এর বাবা মাঠভর্তি ফসল ফলিয়ে আং হয়ে বসেছিল ঠিক তেমনই আমিও মাঠভর্তি ফসল ফলাব৷ সাদা মানুষের মাথা৷’ এই বলে সে তাকাল মাটিতে পড়ে থাকা স্মিথের দিকে৷
কী বলছে মারঙ জাদুকর! একটা হিমেল স্রোত নেমে গেল আভাসের শিরদাঁড়া বেয়ে৷ ফসলের জন্য…! ঠিক যে ব্যাপারটা ফসল উৎপাদনের জন্য একসময় করত অশিক্ষিত, কুসংস্কারগ্রস্ত এই আদিম জনগোষ্ঠী!
আভাস চিৎকার করে বলে উঠল, ‘কী পাগলের মতো কথা বলছ তুমি? পুলিশ তোমাকে ছাড়বে না৷ আং-ও তোমাকে ছাড়বে না৷ তোমার ফাঁসি হবে!’
মারঙ জাদুকর প্রথমে বলল, ‘পুলিশের ভয় আমি করি না৷ তাদের কাছে হয়তো খবরটা পৌঁছবেই না৷ তবে হ্যাঁ, আং জানবে ব্যাপারটা৷ কিন্তু তার কিছু করার থাকবে না৷ তাকে মেনে নিতে হবে ব্যাপারটা৷’
‘তিনি তোমার মতো লোক নন৷ তিনি কিছুতেই মানবেন না৷ তিনি তোমাকে পুলিশে দেবেন, ফাঁসিতে চড়াবেন৷ ছেড়ে দাও আমাদের! ছেড়ে দাও!’ আবার চিৎকার করে উঠল আভাস৷
মারঙ জাদুকর কিন্তু তার চিৎকারে উত্তেজিত হল না৷ সে তার পোশাকের ভিতর থেকে তার পোষ্য গিরগিটিটাকে বার করে হাতে নিয়ে খেলতে খেলতে বলল, ‘আং কিছু বলতে পারবে না কারণ এই টেকো গোকোর উল্কি আঁকা রয়েছে সাদা চামড়ার গলাতে৷ গ্রামের মঙ্গল কামনায় ফসল উৎপাদনের জন্য যারা স্বেচ্ছায় নিজেদের উৎসর্গ করত তারা টেকো গোকোর উল্কি আঁকত গলাতে৷ ওর ওই উল্কিটা দেখে আং-কে মেনে নিতে হবে ব্যাপারটা৷’
আভাস চিৎকার করে উঠল, ‘শয়তান!’
মারঙ জাদুকর তার চিৎকার শুনে নিঃশব্দে শ্বাপদের মতো দাঁত বার করে একবার হাসল৷ তারপর সেই কিম্ভূত পোষ্যটাকে আদর করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল৷ দরজা বন্ধ হয়ে গেল আবার৷
আভাস বসে পড়ল৷ তার হাত-পা উত্তেজনায় কাঁপছে৷ কেন যে স্মিথ গলায় টেকো গোকোর উল্কি আঁকাতে গেল, কেন যে মারঙের সঙ্গে দেখা করল কিছুই বুঝতে পারছে না সে৷ বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর উঠে দাঁড়িয়ে দেওয়ালের ফোঁকরে চোখ রাখল৷ দূরে সবুজ পাহাড়, উপত্যকা, জঙ্গল দেখা যাচ্ছে৷ আর ঘরটার গায়েই বেশ কিছুটা জমি জুড়ে বুনো আগাছার জঙ্গল৷ আর তাতে ফুটে আছে উজ্জ্বল নীল রঙের আঙুরের থোকার মতো ফুল৷ সূর্য ঠিক মাথার ওপরে৷ সেই ফোঁকর দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে রইল আভাস৷
কতক্ষণ সে এভাবে তাকিয়ে ছিল তার খেয়াল নেই৷ হঠাৎ জঙ্গল ফুঁড়ে তার ফোঁকরের ওপাশে উদয় হল একটা মাথা৷ চমকে উঠল আভাস৷ তারপর সে দেখতে পেল তাকে৷ সে টুংলিং! আভাস বেশ অবাক হয়ে গেল টুংলিংকে দেখে৷ চারপাশে একবার সন্তর্পণে তাকিয়ে নিয়ে টুংলিং ফোঁকরের সামনে এসে তার ভাষায় আভাসকে কী যেন বলল৷
আভাস জানে না তার ভাষা৷ সে টুংলিংকে বোঝাবার চেষ্টা করে যেতে লাগল মারঙ তাদের এখানে আটকে রেখেছে৷ আর টুংলিংও চাপা স্বরে তাকে কী যেন বলে যেতে লাগল৷ কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা উপলব্ধি করল, পরস্পরের কোনো কথা তারা বিন্দুবিসর্গ বুঝছে না৷ ধীরে ধীরে চুপ করে গেল তারা৷ কীভাবে বাচ্চাটাকে তাদের পরিস্থিতি বোঝানো যায় তা ভাবার চেষ্টা করতে লাগল আভাস৷ কিন্তু এরপরই হঠাৎ টুংলিং-এর বাজপাখিটা চাপা একটা ডাক দিল তার কাঁধে বসে৷ সঙ্গে সঙ্গে টুংলিং একদিকে তাকিয়েই দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল নীল ফুলের ঝোপের ভিতর৷ আর এর কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল মারঙ-এর দুই অনুচর৷ হাতে তাদের তরোয়ালের ফলার মতো সেই কুঠার বা বর্শা৷ একটা মাটির পাত্রে জল, আর কিছু ফল ঘরে রেখে দাঁত বার করে তারা এমনভাবে আভাসের উদ্দেশে হাসল, যে দেখে মনে হল তারা যেন বলছে, ‘এই শেষ খাবার৷ খেয়ে নাও৷’
খাবার নামিয়ে রেখে স্মিথের জ্ঞান ফিরেছে কি না, তা একবার পরীক্ষা করে লোকগুলো চলে যেতেই আভাস আবার সেই ফোঁকরে মুখ রাখল৷ বারকয়েক সে চাপা স্বরে টুংলিং-এর নাম ধরে ডাকলেও, তার কোনো সাড়া মিলল না৷ শুধু একবার তার মনে হল আকাশের অনেক ওপরে একটা বিন্দু যেন ভাসছে৷ সেটা টুংলিং-এর পাখিটা, না অন্য কোনো পাখি? টুংলিং-এর আর কোনো সন্ধান না পেয়ে আভাস এক সময় হতাশভাবে মেঝেতে বসে পড়ল৷ আতঙ্ক-ক্লান্তি আর অবসাদে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল সে৷
আভাসের এরপর যখন ঘুম ভাঙল তখন দূরে সবুজ পাহাড়ের মাথায় সূর্য অস্ত যেতে বসেছে৷ অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে ঘরটা৷ স্মিথ আগের মতোই অসাড়ভাবে পড়ে আছে৷ আভাস শেষ একবার ফোঁকরে চোখ রাখল৷ বাইরে কেউ কোথাও নেই৷ নির্জন নাগা পাহাড়ের কোলে সন্ধ্যা নামছে এবার৷ আর এই অজানা নরমুণ্ড শিকারিদের মুলুকে মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করছে আভাসরা৷ সে একবার শেষবারের মতো দেখার চেষ্টা করল এ ঘরের বাইরে যাবার কোনো উপায় আছে কি না৷ কিন্তু অনেক উঁচু ছাদ, নিরেট পাথুরে দেওয়াল, আর মজবুত দরজা আভাসদের পালাবার পথ বন্ধ করে রেখেছে৷ অন্ধকার গ্রাস করে নিল ঘরটাকে৷ সময় এগিয়ে চলল৷
একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনে আভাস বুঝতে পারল স্মিথের জ্ঞান ফিরেছে৷ একটা যন্ত্রণা মেশানো মৃদু আর্তনাদ—‘জল জল!’ আভাস তাড়াতাড়ি অন্ধকার হাতড়ে সেই জলের পাত্রটা নিয়ে স্মিথের কাছে গিয়ে আন্দাজে কিছুটা জল স্মিথের মুখে-মাথায় ঢেলে দিল৷ কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে উঠে বসে স্মিথ প্রশ্ন করল, ‘আমরা কোথায়? এত অন্ধকার কেন?’
আভাস বলল, ‘এ জায়গা কোথায় জানি না৷ মারঙ জাদুকর আমাদের এখানে আটকে রেখেছে৷ সারাদিন আমরা এ ঘরে আটকা আছি৷ এখন বাইরে রাত নেমেছে৷’
‘আটকে রেখেছে কেন?’ কিছুটা জড়ানো গলায় জানতে চাইল স্মিথ৷ তার ঘোর কাটেনি এখনও৷
আসল জবাবটা দিতে গিয়ে যেন জিভ আটকে গেল আভাসের৷ সে শুধু জবাব দিল, ‘ফসলের জন্য৷’ নিস্তব্ধ ঘরে চুপচাপ অনেকক্ষণ বসে রইল তারা দুজন৷ তারপর এক সময় স্মিথ সম্ভবত তার হুঁশ ফিরে পেল৷ সে বলল, ‘ওরা আমাদের বলি দেবে, তাই না?’
আভাস বলল, ‘সম্ভবত তাই৷ কিন্তু তুমি মারঙের ফাঁদে পড়লে কেন? গলায় উল্কিই-বা আঁকলে কেন? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না’৷
স্মিথ একটু অপরাধীর ভঙ্গিতে প্রথমে বলল, ‘আমাকে তুমি ক্ষমা করো৷ আমার জন্যই তুমি বিপদে জড়িয়ে গেলে!’ তারপর সে বলল, ‘মারঙ আমাকে একটা প্রাচীন জিনিস দেবে বলেছিল, যে জিনিসের জন্য ইংল্যান্ড থেকে আমি ছুটে এসেছি এই দুর্গম উপজাতিদের গ্রামে৷ মারঙ আমাকে বলেছিল আমার গলায় যদি একটা ‘টেকো-গোকো’-র উল্কি আঁকা থাকে তবে সে জিনিসটা তুলে দিতে পারে৷ নইলে সেটা দিতে তার সংস্কারে বাধবে৷’
আভাস বলল, ‘ও তোমাকে মিথ্যা বলেছে! আমাকে বলে গেল যারা ফসল উৎপাদনের জন্য স্বেচ্ছায় নিজের জীবন দিত তারা ওই উল্কি আঁকাত গলায়৷ সে আং-কে দেখাবে স্বেচ্ছায় তুমি নিজের জীবন দিয়েছ৷ কিন্তু সে তোমাকে কী এমন জিনিস দিতে চেয়েছিল যে তুমি এতটা প্রলুব্ধ হয়ে তার ফাঁদে পা দিলে? কোনো অ্যান্টিক জিনিস? প্রাচীন মূর্তি-টুর্তি? দামি পাথর? নাকি কোনো দুষ্প্রাপ্য প্রাণীর শিং-চামড়া এসব?’
স্মিথ সম্ভবত জবাব দিতে যাচ্ছিল৷ কিন্তু ঠিক তখনই দরজার বাইরে অনেকগুলো পায়ের শব্দ শোনা গেল৷ দরজা খুলে গেল৷ ঘরের ভিতর প্রবেশ করল জাদুকর মারঙ ও তার অনুচরেরা৷ মশালের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল ঘর৷ মারঙের দেহে এখন একটা মাত্র লেংটি৷ সারা দেহে তারও বিচিত্র উল্কি আঁকা৷ গলায় শুধু সেই নীল ফুলের মালা ঝুলছে৷ হাতে ধরা আছে লাঠির মাথায় বাঁধা তলোয়ারের মতো একটা কুঠার৷ মশালের আলোতে ঝিলিক দিচ্ছে সেই ফলা! আভাস আর স্মিথ উঠে দাঁড়াল তাকে দেখে৷ মারঙের সঙ্গীরা ঘরে ঢুকে তাদের সূচিমুখ বর্শার ফলাগুলো তাক করল আভাসদের দিকে৷ কয়েকজন এগিয়ে এল তাদের দিকে৷
৷৷ ৬৷৷
তাদের বাধা দিয়ে যে কোনো লাভ হবে না তা বুঝতে পারল আভাসরা৷ এরা সব কুসংস্কারগ্রস্ত ধর্মভীরু৷ অশিক্ষিত মানুষ৷ যুগ যুগ ধরে আদিম কুসংস্কার প্রবাহিত হচ্ছে এদের ধমনীতে৷ যারা এখনও বিশ্বাস করে মারঙ জাদুকরের তুকতাক, তাদের কে বোঝাবে মানুষের রক্তে কোনোদিন ভূমি উর্বর হতে পারে না, ফসল ভালো হতে পারে না! সভ্য পৃথিবীর মানুষ হয়েও এ লোকগুলো এখনও অসভ্যই রয়ে গেছে৷ তাদের চোখে জেগে আছে এক আদিম হিংস্রতা৷
ঘাসের দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধা হল আভাস আর স্মিথের হাত৷ তারা বাধা দিল না৷ ধাক্কা দিয়ে তাদের বার করা হল ঘর থেকে৷ একটা লম্বা দড়ি গলানো হল আভাস আর স্মিথের হাতের বাঁধনের ফাঁক গলিয়ে৷ তারপর সেই দড়ির প্রান্ত ধরে একজন নাগা যোদ্ধা তাদের টেনে নিয়ে চলল৷ আভাসদের সামনে চলেছে তিনজন নাগা যোদ্ধা৷ একজনের হাতে আভাসদের দড়ি আর অন্য দুজনের হাতে মশাল ও বর্শা৷ আর পিছনেও বর্শাধারী দু-জন লোক৷ তাদের বল্লমের ফলা দুটো আভাস আর স্মিথের কোমরে ছোঁয়ানো৷ আর দলটার সবার আগে চলেছে কুঠার হাতে কনয়্যাক জাদুকর মারঙ৷
মারঙের নেতৃত্বে দলটা জঙ্গলের দিকে কিছুটা এগিয়েছে মাত্র৷ তখন একটা কাণ্ড ঘটল৷ হঠাৎ কাছেই একটা ছোটো ঝোপ নড়ে উঠল৷ আর তারপরই ঝোপটার ভিতর থেকে তিরবেগে বেরিয়ে এল একটা ছোট্ট অবয়ব৷ সে ছুটে এসে কামড়ে ধরল আভাসদের দড়িটা যে ধরেছিল তার হাতটা৷ সঙ্গে সঙ্গে লোকটা চিৎকার করে উঠল৷ আর দলটাও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ যে লোকটার হাতে কামড় পড়েছে সে হাত ছাড়াবার জন্য ঝটাপটি শুরু করল সেই ছোট্ট অবয়বটার সঙ্গে৷ মারঙ জাদুকর সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে সেই ছোট্ট অবয়বটাকে ঘাড় ধরে শূন্যে উঠিয়ে নিল৷ মশালের আলোতে আভাসরা দেখতে পেল জাদুকরের সবল মুঠিতে নেংটি ইঁদুরের মতো ছটফট করছে সেই টুংলিং! মারঙ তাকে দেখে বলল, ‘ভালোই হল৷ এটাকেও পাওয়া গেল৷ এর আশ্রয়দাতা পাদ্রীটা অনেক জ্বালিয়েছিল আমাকে৷ বাজপাখিটা আমার দরকার ছিল, এ ছেলেটা দিল না৷ আজ এরও ব্যবস্থা করব৷ এবার যা ফসল হবে তা কস্মিনকালেও হয়নি৷ এটাকেও বাঁধ৷’
বেঁধে ফেলা হল টুংলিংকেও৷ তারপর আবার সবাই মিলে এগোতে লাগল জঙ্গলের ভিতর৷
বেশ অনেকটা ভিতরে ঢোকার পর জঙ্গলের ভিতর একটা বৃত্তাকার ফাঁকা জায়গাতে ঝাঁকড়া একটা বিরাট গাছের তলায় থামল জাদুকর মারঙ৷ বাঁশ দিয়ে একটা মাচা মতন বানানো হয়েছে সেখানে, আর সেই মাচার গায়েতে দুটো বাঁশের খুঁটি পোঁতা৷ আভাস আর স্মিথকে সেই মাচাতে উঠিয়ে খুঁটিগুলোর সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা হল৷ খুঁটিগুলো আভাসদের বুক সমান৷ গলা বা ঘাড়ে তারা কোনো বাধা সৃষ্টি করবে না৷ খুঁটিগুলোর নির্দিষ্ট উচ্চতার কারণ বুঝতে অসুবিধা হল না আভাসদের৷ তাদের দাঁড় করানো দেহের গলা আর মাথাটা শুধু খুঁটির বাইরে আছে৷ এমনভাবে তাদের বাঁধা হয়েছে যে নড়াচড়া অসম্ভব৷ টুংলিংকে মাটির মধ্যে একপাশে ফেলে রাখা হয়েছে৷ বিস্ফারিত চোখে সে দেখছে সবকিছু৷ তার ব্যবস্থা মনে হয় পরে করবে মারঙ জাদুকর৷
জায়গাটাতে আগেই সব বন্দোবস্ত করা ছিল৷ মাচাটার ঠিক সামনেই একটা অগ্নিকুণ্ড জ্বালানো হল৷ মশাল আর অগ্নিকুণ্ডের আলোতে আলোকিত হয়ে উঠল জায়গাটা৷ মারঙ জাদুকর তার কুঠারটা নামিয়ে রাখলে অগ্নিকুণ্ডের সামনে৷ কুণ্ডটাকে গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়াল সবাই৷ মারঙ জাদুকর দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন বলতে লাগল তার অনুচরদের উদ্দেশে৷ আর তার কথা শুনে মাঝে মাঝে বীভৎস চিৎকার করে উঠতে লাগল সে লোকগুলো৷ জান্তব উল্লাসধ্বনি! উল্কি আঁকা লোকগুলো যেন কোনো মানুষ নয়, ছবির বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা ভৌতিক অবয়ব৷ মাঝে-মধ্যে কুণ্ডে ধুনো জাতীয় কিছু ছুঁড়ছে জাদুকর৷ অগ্নিকুণ্ড তাতে আকাশের দিকে লাফিয়ে উঠছে৷ আর তারপরই ধোঁয়া আর শীতের কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে চারপাশ৷ এরকম বেশ কিছুক্ষণ চলার পর হঠাৎই একবার প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে উঠল জাদুকর আর তার অনুচররা৷ তার পরই সবাই চুপ হয়ে গেল৷ এক অসহনীয় নিস্তব্ধতা! মারঙ এরপর তার কুঠারটা উঠিয়ে নিল৷ সবাই ফিরে দাঁড়াল মঞ্চের দিকে৷ কনয়্যাক জাদুকর মারঙ মঞ্চের কাছে ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল৷ অগ্নিকুণ্ডের আলো এসে পড়েছে তার উল্কি আঁকা মুখে৷ মুখে ফুটে উঠেছে পৈশাচিক হাসি; পৃথিবীর সব ক্রুরতা, হিংস্রতা, জিঘাংসা যেন এসে জমা হয়েছে তার মুখে৷ নরমুণ্ড শিকারি জাদুকর মারঙ! তার চোখ দুটো জ্বলছে শ্বাপদের মতো৷ এগিয়ে আসছে সে৷ আর হয়তো কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র! মারঙ পৌঁছে গেল মঞ্চের সামনে৷ তার দৃষ্টি প্রথমে স্মিথের ওপর৷ মারঙ তার ডান পাটা ওঠাল মঞ্চে ওঠার জন্য৷ আভাস এবার আতঙ্কে অস্পষ্ট চিৎকার করে উঠল৷ কিন্তু এর পরেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল৷ মারঙ সবে একটা পা মাচার ওপর উঠিয়েছে, দ্বিতীয় পাটা ওঠাতে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময় আকাশ থেকে কী একটা যেন বিদ্যুৎগতিতে নেমে এসে ঝাপটা মারল মারঙের মুখে৷ প্রচণ্ড ঝাপটা খেয়ে একটা আর্তনাদ করে টাল সামলাতে না পেরে জাদুকর মাটিতে পড়ে গেল৷ তার কুঠার সশব্দে ছিটকে পড়ল অন্যদিকে! মারঙের লোকেরা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল তার কাছে৷ মারঙ উঠে বসল মাটির ওপর৷ মশালের আলোতে আভাস কয়েক হাত তফাতে মাটিতে বসা মারঙের মুখটা দেখতে পেল৷ জাদুকরের উল্কি আঁকা কালো মুখে আঁকা হয়ে গেছে লাল উল্কি! ব্যাপারটা বুঝতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল জাদুকরের৷ তারপর সে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করল—‘বাজপাখি! বাজপাখি!’ হ্যাঁ, বাজপাখিটাই তার নখের চিহ্ন এঁকে দিয়েছে নরমুণ্ড শিকারি মারঙের মুখে! একজন লোক মাটি থেকে কুঠারটা তুলে এনে দিল মারঙ জাদুকরের হাতে৷ ঠিক সেই সময় পাখিটা অন্ধকারের মধ্যে থেকে কোথা থেকে যেন উড়ে এসে ছোবল দিল জাদুকরের পাশে দাঁড়ানো আর একজনের মুখে৷ হাতের বর্শা ফেলে আর্তনাদ করে মুখ চেপে বসে পড়ল লোকটা৷ আতঙ্কিতভাবে তার অন্য সঙ্গীরা তাদের হাতের বর্শা ওপরে তুলে আকাশের দিকে মুখ করে দেখার চেষ্টা করতে লাগল সেই উড়ন্ত হানাদারকে৷ আর জাদুকর দুর্বোধ্য চিৎকার করে তার কুঠার নিয়ে এগোল মাটিতে পড়ে থাকা টুংলিং-এর দিকে৷ কিন্তু টুংলিং-এর কাছে তার পৌঁছানো হল না৷ কোথা থেকে যেন এক ঝাঁক বর্শা ছুটে এসে টুংলিং আর তার মাঝখানে একটা বেড়া রচনা করল৷ থেমে যেতে হল জাদুকর মারঙকে৷ আর তার পরই সে জায়গা ঘিরে জঙ্গলের মধ্যে জ্বলে উঠল সার সার মশাল! বৃত্তাকার একটা ব্যূহ রচনা করে মশালের আলোগুলো জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে আসতে লাগল৷ মারঙ জাদুকর আর তার সঙ্গীরা বিস্মিত, হতচকিত৷ আভাসরাও বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে ব্যাপারটা৷ আলোকবৃত্ত ক্রমশ ছোটো হয়ে এল৷ জঙ্গলের ভিতর থেকে আত্মপ্রকাশ করল একদল নাগা যোদ্ধা৷ আভাস আর স্মিথ তাদের মধ্যে দেখতে পেল আং আর লংপুকে৷ আং-কে দেখে মারঙ জাদুকর পালাতে যাচ্ছিল৷ কিন্তু ঠিক তখনই আবার আকাশ থেকে নেমে এল সেই পাখিটা৷ মারঙ জাদুকরের মুখ ছুঁয়ে সে আকাশে উড়ে গেল৷ শেষ একটা আর্তনাদ করে মাটিতে পড়ে গেল নরমুণ্ড শিকারি মারঙ৷ আর তারপরই একটা দড়ির ফাঁসে বাঁধা পড়ে গেল সে৷ তার অন্য সঙ্গীরা ভয় পেয়ে হাতের অস্ত্র ফেলে দাঁড়াল৷ আং-এর লোকেরা বেঁধে ফেলল তাদের৷ লংপু এবার তাড়াতাড়ি ছুটে এসে বাঁধন খুলে দিল আভাসদের৷ ওদিকে মাটিতে পড়ে থাকা টুংলিং-এর বাঁধনও খুলে দিল একজন৷ সে উঠে দাঁড়াতেই তার পাখিটা উড়ে এসে তার কাঁধে বসল৷
বাঁশের মাচা থেকে নীচে নেমে আভাসরা লংপুকে জিগ্যেস করল, ‘তোমরা আমাদের সন্ধান পেলে কীভাবে?’ লংপু জবাব দিল, ‘আপনারা ফিরে আসছেন না দেখে আমি জঙ্গলে গিয়ে আপনাদের খোঁজাখুঁজি করে গ্রামে ফিরে ব্যাপারটা আং-কে জানাই৷ আর একপ্রস্থ জঙ্গলে গিয়ে খোঁজাখুঁজির পরও জঙ্গলে যখন আপনাদের সন্ধান মেলে না তখন আমরা আবার গ্রামে ফিরে কীভাবে আপনাদের খোঁজা যায় তার উপায় খোঁজার চেষ্টা করি৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত টুংলিং-এর পাখিটাই আপনাদের খোঁজ দিল৷’
‘কীভাবে?’ জানতে চাইল স্মিথ৷
আং এবার তার পোশাকের ভিতর থেকে বার করলেন আভাসের রিস্টওয়াচ আর এক থোকা নীল ফুল৷ তিনি বললেন, ‘টুংলিং এই ঘড়িটা আর ফুলগুলো পাখিটার পায়ে বেঁধে তাকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিল৷ এ ফুল শুধু এ জায়গাতেই ফোটে৷ তাই কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা বুঝতে পেরেছিলাম আমি৷ এখানে যে শয়তান মারঙের একটা ডেরা আছে তা জানা ছিল আমার…৷’
তাঁর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আভাস গিয়ে তার পাখিসমেত কোলে তুলে নিল টুংলিংকে৷ ঘড়িটা কুড়িয়ে পেয়েছিল টুংলিং৷ নিশ্চয়ই মারঙ-এর হাতে তাদের বন্দি হবার ব্যাপারটা দেখে তাদের অনুসরণ করেছিল সে৷ এইটুকু ছেলের এত সাহস আর বুদ্ধি! কিছুক্ষণের মধ্যেই মারঙ জাদুকর আর অন্য বন্দিদের নিয়ে আং-এর নেতৃত্বে গ্রামে ফেরার জন্য যাত্রা শুরু করল সবাই৷
৷৷ ৭৷৷
একটা সুন্দর সকাল৷ সূর্যের প্রথম আলোতে ঝলমল করছে পাহাড়-নদী-উপত্যকা৷ আগের রাতের ঘটনা এখন নিছকই দুঃস্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে আভাসদের৷ যেন ওসব কোনো ঘটনা ঘটেনি৷ আভাসরা এবার রওনা হবে৷ তাদের বিদায় জানাতে এসেছেন আং ও তাঁর লোকজন৷ টুংলিংও আছে তাদের সঙ্গে৷ আভাসদের জন্য বুনো ফুলের মালা বানিয়ে এনেছিল৷ সে-মালা গলায় পরেছে তারা দুজন৷ বিদায় বেলাতে টুংলিং-এর মাথায় হাত বুলিয়ে স্মিথ আং-কে বলল, ‘দেখবেন এই বাচ্চাটার যেন লেখাপড়ার কোনো অসুবিধা না হয়৷ ওর ভরণপোষণের দায়িত্ব আমার৷ দেশে ফিরে আমি আভাসের মাধ্যমে ওর জন্য টাকা পাঠাব৷’ এই বলে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিল স্মিথ৷ কিন্তু বৃদ্ধ আং ফোকলা দাঁতে হেসে বললেন, ‘দাঁড়াও, তোমাকেও আমার একটা বিশেষ জিনিস উপহার দেবার আছে৷’
আং-এর ইশারায় তাঁর একজন অনুচর একটা সুন্দর কাঠের বাক্স তুলে দিল স্মিথের হাতে৷ বাক্সটা খুলতেই তার ভিতরের জিনিসটা দেখে অবাক হয়ে গেল স্মিথ আর আভাস৷ তার ভিতর যত্ন করে রাখা আছে একটি নরকরোটি৷ স্মিথ বিস্মিতভাবে তাকাল আং-এর দিকে৷ আং বললেন, ‘আমার বর্শাতে লাগানো ছিল এটা৷ আমার অনুমান এটার খোঁজেই তুমি এখানে এসেছিলে৷ মারঙ তোমাকে এটাই দেবে বলেছিল, তাই না? তোমার খুলি পরীক্ষা দেখেই বুঝেছিলাম তুমি সম্ভবত একটা বিশেষ খুলি খুঁজতে এসেছ এখানে…৷’
স্মিথ তাঁর কথা শুনে মাথা নিচু করে লজ্জিতভাবে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, তাই৷ আমাকে ক্ষমা করবেন৷’
আং হেসে বললেন, ‘আমার পূর্বপুরুষের কৃতকর্মের জন্য আমার ক্ষমা চাওয়া উচিত তোমার কাছে৷ যা হোক তোমার জিনিস তোমার হাতেই তুলে দিলাম৷ এবার রওনা হয়ে যাও৷ নইলে সন্ধ্যার আগে ডিমাপুর পৌঁছতে পারবে না৷’
বাক্সটা নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল আভাসরা৷ গাড়ি চলতে শুরু করার পর আভাস বিস্মিতভাবে স্মিথকে জিগ্যেস করল, ‘এটা কার খুলি? যা নিয়ে এত কাণ্ড?’
স্মিথ জবাব দিল, ‘আমার ঠাকুরদার, যিনি এখানে এসে আর ফিরে যাননি৷ তাঁর চেহারার সঙ্গে অদ্ভুত মিল আমার চেহারার৷ সম্ভবত আং আর মারঙ দুজনেই তাঁকে দেখেছিল৷ মারঙই প্রথমে ব্যাপারটা ধরতে পারে…দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে এটাকে সমাধিস্থ করব আমি…৷’
এগিয়ে চলল আভাসদের গাড়ি৷ পিছনে পড়ে রইল সেই ছোট্ট নাগা গ্রামটা৷ টুংলিং-এর বাজপাখিটা গাড়ির মাথার ওপর দিয়ে উড়তে উড়তে বেশ অনেকটা পথ পর্যন্ত এগিয়ে দিল তাদের৷
সমাপ্ত