কনক-শাস্ত্র
উপক্রম:
আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় মেতে আছে। গভীর রাত। বৃষ্টি হয়েছে একটু আগে পর্যন্ত। গাছের পাতা থেকে এখনও চুঁইয়ে পড়ছে জল। আকাশ আবার ধীরে ধীরে মেঘে ঢাকা পড়ছে, আবার বৃষ্টি আসবে, নাঃ এইবার একটা ঝড় আসবে হয়তো। গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দূর থেকে শোনা যাচ্ছে ঘোড়ার খুরের শব্দ। একটা নয়, অন্তত দুটো ঘোড়া তাল মিলিয়ে পাশাপাশি ছুটে আসছে রাস্তা ধরে। একটু বাদেই দেখা গেল ঘোড়ার গাড়িটা। সামনে দুটো কালো ঘোড়া দ্রুতগতিতে টেনে নিয়ে চলেছে গাড়িটাকে। সাধারণ মালবাহী ঘোড়ার গাড়ি। একজন সহিস বসে চাবুক চালাচ্ছে।
এই গাড়ির মাথায় একজন প্রহরী বসে আছে। চারিদিকে তার সতর্ক নজর। গাড়ির গায়ে কোনোরকম নিশান বা ধ্বজা না থাকায় এক পলকে মনে হবে এটা সাধারণ কোনো ব্যবসায়ীর পণ্যবাহী গাড়ি। কিন্তু এই গাড়ির গন্তব্য মগধ। মগধের রাজকোষাগার। এই গাড়ির ভেতর চার জন সশস্ত্র প্রহরীর তত্ত্বাবধানে, একটা সিন্দুক নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মগধে। এই সিন্দুকের ভেতর রয়েছে স্বর্ণমুদ্রা। আর্যাবর্তর একটা বড়ো অংশের থেকে রাজকর হিসেবে নেয়া অর্থ, স্বর্ণমুদ্রায় পরিবর্তিত করা হয় পরিবহণের সুবিধার্থে। গোপনীয়তার এবং সুরক্ষার উদ্দেশ্যে গাড়িতে কোনোরকম রাজমোহর বা রাজধ্বজা লাগানো হয়নি। এই গাড়িগুলো প্রতিবার আসে আলাদা আলাদা পথ ধরে। এই নির্দিষ্ট পথ কেউ জানে না, এমনকী প্রহরীরাও আগে থেকে জানতে পারে না। পথের মাঝে মাঝে তারা আলাদা আলাদা জায়গায় থাকে, দূত মারফত তাদের পরবর্তী পথের নির্দেশ আসে। এই সবই করার কারণ সুরক্ষা, যাতে দস্যুরা নির্দিষ্ট পথ অনুমান করতে না পারে।
মগধের রাজপথে উঠতে এখনও এক প্রহর লাগবে। পুরো পথের মধ্যে এইটুকু অংশ বিশেষভাবে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। এর কারণ, যে পথই নেয়া হোক, এইটুকু অংশ সব ক্ষেত্রে অতিক্রম করতেই হয়। দক্ষিণ থেকে আসা প্রতিটা যানবাহনকে এইটুকু পথ অতিক্রম করতেই হবে। তার ভেতর এই বিশেষ অংশ আরও বেশি নিস্তব্ধ এবং সড়কের দু-দিকে গভীর জঙ্গল।
তীব্র গতিতে ছুটে আসছিল ঘোড়া দুটো। সহিস গতি বাড়াতে ঘন ঘন চাবুক চালাচ্ছে। অতএব গতি বড্ড বেশি ছিল। আর সেটাই কাল হল। হঠাৎ পায়ের কাছে আচমকা কোনো বাধা পেয়ে হুমড়ি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল ঘোড়া দুটো। ছিটকে সামনের দিকে গিয়ে পড়ল সহিস আর ছাদে বসা প্রহরী। প্রচণ্ড আঘাতে তারা জ্ঞান হারাল। গাড়িটা ঘোড়া দুটোর থেকে আলাদা হয়ে একদিকে কাত হয়ে উলটে পড়েছে। ঘোড়াগুলো ভূপাতিত হয়ে যন্ত্রণা ভরা হ্রেষাধ্বনি করছে। তাদের সামনের দিকের পাগুলো কেটে বসে গেছে কয়েকটা শক্ত দড়ির দাগ। আড়াআড়ি ভাবে রাস্তার দু-দিকের দুটো গাছের সঙ্গে বাঁধা হয়েছিল সেগুলো। তাতে কয়লার কালি ঘষে কালো করা হয়েছে যাতে রাতের আঁধারে নজর না পড়ে কোনোভাবেই। দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসা ঘোড়ার গাড়ির পক্ষে অবশ্য দেখতে পেলেও বিশেষ লাভ হত না।
ভেতরে সৈনিকদের সামলাতে কিছুটা সময় লাগল। কাত হয়ে থাকা গাড়ির দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল এক এক করে চার জন। তারা এখনও এই ভ্রমে আছে যে এটা একটা দুর্ঘটনা মাত্র। অসতর্কভাবেই তারা সামনে দিকে পড়ে থাকা সহিসের দিকে এগোতে গেল। আর ঠিক তখনই, জঙ্গলের থেকে ছুটে এসে একটা তির বিদ্ধ করল একজনের গলা। লুটিয়ে পড়ল প্রহরীটি। পরমুহূর্তে আরও একটা তির এসে লাগল আরও একজনের উন্মুক্ত হাতে। আরও একটা তির এসে বিদ্ধ করল তৃতীয়জনের একটা চোখ। সম্ভবত এই তিরগুলোর ফলায় কোনো তীব্র মারণ বিষ ছিল, যে কারণে তিনটে লোক ঢলে পড়ল বৃষ্টিভেজা মাটিতে। শেষজন কোমর থেকে তলোয়ার বের করতে পারল বটে, তবে লাভ হল না। আরও একটা তির এসে তাকেও মুহূর্তে ধরাশায়ী করল।
এইবার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল তিনজন লোক। কালো কাপড়ে সর্বাঙ্গ ঢাকা। শুধু দেখা যাচ্ছে তাদের চোখ জোড়া, যা শ্বাপদের মতো অন্ধকারে সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলেছে। দু-জনের হাতে তলোয়ার আর একজনের হাতে একটা ধনু। একজন তলোয়ারধারী এগিয়ে গেল সামনে পড়ে থাকা রক্তাক্ত সহিসের দিকে। মাঝপথে একবার তলোয়ার চালিয়ে প্রায় অদৃশ্য দড়িগুলো কেটে ফেলল। লোকগুলো দ্রুত একে একে পাঁচ জন প্রহরী ও সহিসের সামনে গেল এবং তলোয়ার বসিয়ে দিল প্রত্যেকের বুকে। মৃত বা জীবিত নির্বিশেষে প্রত্যেকের বুকে অস্ত্র ঢুকিয়ে আবার বের করে আনা হল। ফিরে গেল সেগুলো কোমরবন্ধে বাঁধা খাপে।
অতি দ্রুত তারা বের করে আনল গাড়ির ভেতরের সিন্দুকটা। একজন এগিয়ে হাঁটা দিল জঙ্গলের দিকে। আর তার পিছু পিছু দু-জনে মিলে ভারী সিন্দুক টেনে নিয়ে চলল। কয়েক মুহূর্ত পরেই লোকগুলো মিলিয়ে গেল জঙ্গলের ভেতরের অন্ধকারে।