৯৬
আর গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং-এর বাড়িতে আরো থম্থমে দিন কেটেছে আগে। সেই যখন কলকাতার উদ্বেগ আর অশান্তির রাজ্য। ক্রীপস্ মিশনের সময় থেকেই থম্ থম্ করতো কলকাতায়। যখন দীপঙ্কর সারা দিন আপিসের খাটুনির পর আসতো এ বাড়িতে আর অনেক রাত্রে ফিরে যেত। তখন থেকে ব্রিটিশ-গভর্নমেন্টের মাথায় বোঝা হয়ে উঠেছিল ইন্ডিয়া। বছরে বছরে সমস্ত ঘৃণা সমস্ত হিংসা পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছিল। শেষে আর ধরে রাখা গেল না। যেটুকু বাকি ছিল সুভাষ বোসের শেষ কীর্তিতে তাও নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। নিউইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউন-এ লেখা হলো—The British decision to leave India may bring the British more profit than they would win if they could scrape up power to remain for a time. By retiring with grace and expressions of goodwill they may preserve the bulk of their economic interests for a long period.
সতী দোতলার ওপর থেকে অনেক দূরে চেয়ে দেখে, অনেক দূর থেকে একটা ট্রেন আসে। গোল-গোল পেট্রল ভর্তি ওয়াগনগুলো পশ্চিম দিক থেকে এসে পূর্ব দিকে চলে যায়। দুম্ দুম্ করে শব্ত হয় আর অনেকক্ষণ পরে চোখের আড়ালে চলে যায়। আস্তে আস্তে ভোর হয়, আস্তে আস্তে দিন হয়, তারপর আস্তে আস্তে সন্ধ্যেও হয়। ওদিক থেকে যেন একটা হল্লা ওঠে-আল্লা হো আকবর। রাত্রের নিস্তব্ধতা সেই চিৎকারে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তারপর সঙ্গে সঙ্গে এদিক থেকে কারা চিৎকার করে ওঠে—বন্দে মাতরম্! সমস্ত কলকাতা যেন সচকিত হয়ে ওঠে। দিনের বেলায় রাস্তায় বেরোতে ভয় করে। ভোর বেলা কোন্ ফাঁকে খবরের কাগজওয়ালা নিঃশব্দে কাগজ দিয়ে আবার চলে যায়। সারাদিন ধরে পড়ে পড়ে কাগজখানা ভয়াবহ হয়ে উঠে। সমস্ত কলকাতা যেন ভয়াল হয়ে উঠেছে। যাবার আগে ব্রিটিশ-গভর্নমেন্ট শেষ সর্বনাশ করবে। শেষ বিষ ঢুকিয়ে দেবে। চলে গিয়েও তারা তাদের কারবার পাকা-কায়েম করে রেখে যাবে।
রঘুকে ডেকে সেদিন সতী জিজ্ঞেস করলে—হ্যাঁ রে, লোকে রাস্তায় বেরোচ্ছে?
রঘু বললে—না দিদিমণি, সেদিনও বাজারের কাছে একটা লোককে কেটে ফেলেছে, আপনি বেরোবেন না—
কিন্তু আর যেন বাড়িতে থাকতে ভাল লাগছিল না। কারোর কাছে থেকেই কোনও খবর আসে না। যেন সে হাঁফিয়ে উঠে। লক্ষ্মীদির সঙ্গে কথা বলে কোনও লাভ হয় না। সে সারাদিন ঘরের মধ্যে থাকে। তাকেও পাহারা দিতে হয়। রাত্রে দরজার সামনে রঘু শুয়ে থাকে। যদি পালিয়ে যায়! কতবার লক্ষ্মীদি পালিয়ে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করেছে। অন্ধকারে কেউ কোথাও না থাকলেই লক্ষ্মীদি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। তারপর সদর- দরজা খুলে রাস্তায় চলে যেতে চায়। এক-একবার রেল-লাইন পর্যন্ত চলে গিয়েছির, তারপর রঘু জানতে পেরে আবার ধরে নিয়ে এসেছে, ধরা পড়লেই বলে—আমি মরতে চাইনি, আমি শুধু বেড়াচ্ছি এখানে—
তারপর আবার ধরে নিয়ে এসে ঘরে পুরতে হয়।
সেদিন দুপুর বেলা। সমস্ত কলকাতা যেন তখন ঘুমিয়ে রয়েছে। কিন্তু ওই ঘুমন্ত কলকাতাই আবার জেগে ওঠে রাত্রে। রাত আরম্ভ হতেই আবার চিৎকার শুরু হয়। সবাই সচকিত হয়ে ওঠে। হঠাৎ বাইরে দরজায় কড়া নড়তেই সতী ভেতর থেকে বললে—কে?
বাইরে থেকে গলার আওয়াজ এল—আমি—
—আমি কে? নাম কী তোমার?
কী যেন উত্তর এল। কিন্তু কিছু বোঝা গেল না। সতীর কী সন্দেহ হলো। তারপর দরজাটা খুলতেই দেখলে সামনে সনাতনবাবু দাঁড়িয়ে। সনাতনবাবুকে সামনে দেখে যেন কথা বলতেও ভুলে গেল সতী, তাড়াতাড়ি সংবিৎ ফিরতেই সনাতনবাবুকে ঘরে ঢুকিয়ে সদর দরজাটা বন্ধ করে দিলে। বললে—কী করে এলে তুমি?
সনাতনবাবু বললেন—হেঁটে, গাড়ি পেলুম না—
—কিন্তু যদি কোন সর্বনাশ হত? কেন তুমি আসতে গেলে এই সময়ে?
সনাতনবাবু বললেন—অনেক দিন থেকেই আসবো ভাবছিলুম, কিন্তু সুবিধে হচ্ছিল না—
—কিন্তু এই সময়ে কেউ আসে? চারদিকে কত খুন-খারাপি চলছে খবরের কাগজে দেখনি?
সনাতনবাবু বললেন—তাতে আমার কিছু এসে যায় না, তুমি চলো, তোমাকে নিয়ে যেতেই এসেছি—
—আবার সেই পুরোন কথা তুলছো? একথা তো তুমি অনেকবার বলেছো, সেই একই কথা বলতে এসেছো আবার?
—কিন্তু আমি তো তোমাকে বলেছিলুম আসবো, তুমি বারণ করলেও আসবো।
—কিন্তু কলকাতায় কী মারামারি কান্ড চলছে তুমি জানো না? এই সেদিন বাজারের কাছে একটা লোককে কেটে ফেলেছে, রঘু বলছিল—
সনাতনবাবু বললেন—সে আমি সব জানি। আমি জেনে শুনেই এসেছি—এবার তোমাকে নিয়ে যাবোই। তুমি চলো।
—তুমি কি পাগল হয়েছো? এই অবস্থায় আমি যাবো? তুমি কী করে ভাবতে পারলে যে এত কান্ডের পরেও আমি তোমার সঙ্গে যাবো? তোমার সঙ্গে আমার সব সম্পর্ক ঘুচে গেছে বলেই ধরে নিয়েছি, তোমাদের সঙ্গে আমার আর কোনও সম্পর্ক নেই—
সনাতনবাবু বললেন—কিন্তু তবু তোমাকে যেতেই হবে-আজ আর আমি তোমার কোনও কথা শুনবো না—
সতী সনাতনবাবুর মুখের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেল। এত জোরের সঙ্গে কখনও তো কথা বলেন না।
সনাতনবাবু আবার বলতে লাগলেন—এতদিন আমি পরীক্ষাই করেছি শুধু, তোমাকে নিয়েও পরীক্ষা, নিজেকে নিয়েও পরীক্ষা। আমি আজ পর্যন্তও বুঝতে পারলুম না তোমাতে আমাতে অমিলটার সূত্র কোথায়? আমিই বা কীসে তোমার চোখে অপরাধী, আর তুমিই বা সে অপরাধ এমন বড় করে দেখছো কেন? এও কি তোমার এক অহঙ্কার? আমি বুঝতে পারছি না—
সতী বললে—তুমি আমার অহঙ্কারই দেখলে?
সনাতনবাবু বললেন—অহংকে তুমি ত্যাগ করতে পারনি বলেই অহঙ্কার বলছি—! তুমি যদি আমাকে ভালবাসতে পারতে তো এ অহং থেকেও তুমি কবে মুক্ত হয়ে যেতে! নিজেকে কি তুমি সত্যিই বিলিয়ে দিতে পেরেছে? যেমন করে নদী নিজেকে সমুদ্রে বিলিয়ে দেয়?
—কিন্তু তুমি সমুদ্র আর আমি নদী, এও তো তোমারও এক অহঙ্কার!
সনাতনবাবু বললেন—আমি তো বলিনি আমি সমুদ্র! তুমি আমি এই সমস্ত মানুষ, সবাই তো আমরা এক অনন্ত সমুদ্রের দিকে চলেছি—যে মানুষ নিজেকে সেই অনন্তের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পেরেছে সে-ই তো মানুষ! মানুষের সার্থকতা তো সেখানেই।
সতী বললে—তুমি এখনও সেই পুঁথির মধ্যেই বাস করছো, আমার মত সংসারের জীব হতে পারোনি—
—কিন্তু পুঁথি তো সংসারী লোকেরই লেখা। মানুষ আর পুঁথি কি আলাদা?
সতী বললে—হ্যাঁ আলাদা! আলাদা না হলে কি তোমার কাছ থেকে আমি চলে আসি? আলাদা না হলে আমার সারাটা জীবন এমন করে নষ্ট হয়? আলাদা না হলে তুমিই কি এমন কষ্ট পাও, না আমিই এমন ভুগি? তুমি আমার মত হতে পারো না? তেল-নুন-মশলার সাধারণ মানুষ হতে পারো না?
সনাতনবাবু বললেন—ভালোই হলো, তুমি কথাটা আবার তুললে! তবু আমি বলছি আগে আমি যা ছিলাম তা-ছিলাম, আমি আজ সাধারণ হয়েই এসেছি, সাধারণ মানুষের মতই কথা বলছি, বলো কী করলে তুমি আমার হবে?
—কী করলে তুমি আমার হবে তা তুমি জানো না?
বেশ তাই-ই বলো। কী করলে আমি তোমার হবো? কী করলে তুমি আমায় নেবে?
সতী এবার কী উত্তর দেবে বুঝতে পারলে না। এমন করে এমন সুরে সনাতনবাবু তার সঙ্গে আগে কখনও কথা বলেন নি। তবু যেন কেমন সন্দেহ হতে লাগলো। সনাতনবাবু বলতে লাগলেন—আজকে আমি বাড়ি থেকে তোমাকে এই কথা বলবো বলেই বেরিয়েছি। ক’দিন ধরে খুব ভেবেছি। ক’দিন ধরে রাত্রে আমার ঘুম নেই। ক’দিন ধরে ঠিক করেছি আমি তোমার কাছে এসে নিজেকে নিঃশেষ বিলিয়ে দেবো। বলবো-তুমি আমাকে নাও। একদিন তোমাকেই কেবল নিজের করতে চেয়েছি, এবার আমাকেই তোমার নিজের করে নিতে বলবো। তুমি অস্বীকার করলেও আমি শুনবো না। আমি শুনে যাবো তোমার মুখ থেকে তুমি আমাকে নিয়েছ কিনা!
সতী খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বললে—এত কথা তোমার মনে হয়? আমার কথা তুমি এমন করে ভাবো?
—ভাববো না? আমিও তো তুমি! আর তুমিও তো আমি।
—সত্যি বলছো?
—আমি কোনও দিন অসত্য বলি না। আগেও বলিনি, এখনও বলছি না।
—তোমার সেই সব দিনের কথা মনে পড়ে? সেই অনেক দিন আগে প্রথম যখন তোমাদের বাড়ি গেলাম, তার এক বছর পরেই……
—এক বছর পরেই……..কী বলো?
লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো সতীর সমস্ত মুখখানা।
সনাতনবাবু বললেন—কী বলছিলে, বলো? বলো না, আমার সব মনে আছে—
—সেই খোকা হয়েছিল…….
আর বলতে পারলে না সতী। বলতে গিয়েই যেন ভেঙে পড়লো। সনাতনবাবুর বুকের ওপরেই কান্নায় ভেঙে পড়লো। সনাতনবাবু ধরে ফেললেন সতীকে। নইলে সতী বোধহয় পড়ে যেত তখনি। এতদিন পরে সনাতনবাবুর মনে হলো সতী বাইরে যতই প্রখর হোক, ভেতরে ভেতরে যেন বড় দুর্বল। দুই হাতে ধরে রাখলেন অনেকক্ষণ। সতীও তাঁর বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে দিয়ে আকুলি-বিকুলি করতে লাগলো। সনাতনবাবু সতীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন আস্তে আস্তে। তারপর বললেন—কেঁদো না—চুপ করো—
সতী তেমনি করেই মুখ লুকিয়ে বলতে লাগলো-কিন্তু কেন সে থাকলো না বলো তো? আমি কী অপরাধ করেছিলুম ভগবানের কাছে? কার পাপে এমন হলো? কে এর জবাব দেবে? ভগবান আমাকে সব দিয়েছিলেন, মেয়ে-মানুষ যা চায় সব পেয়েছিলুম, কিন্তু কেন এমন করে সব হারালুম বলো তো? কেন আবার সব কেড়ে নিলেন তিনি?
সনাতনবাবু কিছু কথা বললেন না। তেমনি করেই সতীকে ধরে রইলেন।
—তুমি তো জানো, আমি ও-সব কিছুই চাইনি, অন্য মেয়েমানুষেরা যা চায় আমি তো তা কিছুই চাইনি, আমি গয়না চাইনি, শাড়ি চাইনি, বাড়ি চাইনি, টাকা-কড়ি, চাকর- ঝি কিছুই চাইনি, তুমি তো তা জানো, শুধু চেয়েছিলুম আমাকে কেউ মা বলে ডাকুক…..
বলতে বলতে সতী আবার কাঁদতে লাগলো, তারপর আবার বলতে লাগলো—লোকে বলে আমি খুব জেদী মানুষ, তুমিও হয়ত আমাকে তাই বলে জানো! রাগ হলে আমার নাকি জ্ঞান থাকে না, রাগরে মাথাতেই তো আমি তোমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলুম, কিন্তু কেন আমার রগা হলো তা তো তোমরা কেউ কোনওদিন জানতে চাইলে না? কেন আমি এমন রাগী হলুম তা তো আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করোনি কখনও? কই, আগে তো আমি রাগী ছিলুম, না? আগে তো লক্ষ্মীদির সঙ্গে, দীপুর সঙ্গে কত ঝগড়া করেছি, কিন্তু এমন করে তো কখনও অন্য কাউকেও কষ্ট দিইনি, আর নিজেও এমন করে কষ্ট পাইনি? খোকা চলে যাবার পরেই বা কেন এমন হলো? সে-কথা তো তোমরা কেউ জিজ্ঞেস করলে না?
সমস্ত পৃথিবী তখন নিস্তব্ধ। সমস্ত চরাচর তখন সতীর মন থেকে মুছে গেছে। সতী যেন এতদিন পরে আবার নিজের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করতে পেরেছে। বাইরে ঘড়ির কাঁটা কতখানি ঘুরলো তখন আর তা জানবার যেন প্রয়োজনও নেই। সতী নিজের মনের সব কথাগুলো যেন এই প্রথমবার নিজের কানে শুনতে পাচ্ছে।
বললে—ভেবেছিলাম সেবার তোমাকে অত অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছি, তুমি বোধ হয় আর আসবে না! জানো, একলা একলা এ-বাড়িতে থাকতে-থাকতে আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলুম। তুমি না এলে আমি যে কী করতুম!
সনাতনবাবু বললেন—সেই জন্যেই তো আমি এলুম।
—তোমার মা জানেন যে তুমি এসেছ?
সনাতনবাবু বললেন—না।
—কিন্তু তুমি তো তোমার মাকে না জানিয়ে কোনও কাজই করো না। তাহলে আজ কেন এমন করলে?
সনাতনবাবু বললেন—তোমার জন্যে!
—আমার জন্যে তুমি এত করতে পারো?
—তোমার জন্যে চিরকালই সব করতে পারতুম, তুমি শুধু বুঝতে পারতে না তাই কষ্ট পেতে!
—এবার থেকে আমি যা বলবো তুমি তাই-ই করবে?
—চিরকাল তুমি যা বলতে তা-ই করতাম। তুমি শুধু ভুল বুঝতে আমাকে।
সতী সনাতনবাবুর বুকের মধ্যে আরো নিবিড় হয়ে এল। বললে—এবার আমি তোমাকে আর ভুল বুঝবো না, জানো। তুমি বিশ্বাস করো, তুমি যা বলবে আমি তাই- ই শুনবো। তোমার সব কথাই আমি রাখবো—
সতী একটু থেমে আবার বললে–তোমার বুকের মধ্যে মুখ রাখতে আমার খুব ভালো লাগছে—আমি আরো একটু রাখি আমার মুখটা—কেমন?
সনাতনবাবু বললেন—তা রাখো না, আমারও তো ভালো লাগছে—
বলে সতীকে আরো নিবিড় করে বুকে টেনে নিলেন।