৮৫
সতী তখন লক্ষ্মীদিকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেও গা ধুয়ে নিয়েছে। আয়নাতে দাঁড়িয়ে কপালে সিঁদুরের টিপ্ দিয়েছে। এতদিন কোথা দিয়ে তার সময় কেটে গেছে, কোথা দিয়ে তার দিন কেটেছে, রাত কেটেছে কিছুই সে টের পায়নি। সেই কবে কোন্ ১৯৩৯ সালের কোন্ মাসে পৃথিবীর বুকে এক যুদ্ধ বেধে উঠেছিল, তার হিসেব সে রাখতে পারেনি। কিন্তু তার নিজের বুকের ওপর যে-যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তার হিসেব সে জানতো। সে যুদ্ধে কত রাত বিনিদ্র কেটেছে, কত চোখের জল, কত মনের স্বপ্ন মাটিতে ঝরে পড়েছে তার ও হিসেব তার জানা ছিল। লক্ষ্মীদি আসার পর থেকেই যেন সতী অন্য রকম হয়ে গিয়েছে। এতদিনে নিজেকে নিয়েই সে বিব্রত ছিল, এবার লক্ষ্মীদিকে দেখে যেন সে শান্ত হয়েছিল। এই তো জীবন। কান্না আর হাসি, সুখ আর দুঃখের মধ্যে তফাত তো এইটুকু! এরই জন্যে এত হাহাকার, এত মারামারি, এত কাড়াকাড়ি আর এত হা-হুতাশ!
সিঁদুরের টিপ্ লাগানোটাও যেন অভ্যেস। ওটা লাগাতে হয় তাই লাগানো, নইলে ওর যেন কোনও উপকারিতা নেই জীবনে। ওটা যেন শুধু মুখের একটু শোভা মাত্র। মনের দুঃখটা ঢাকবার একটা ছদ্মবেশ। আর কিছু নয়—
বাইরে হঠাৎ কড়া নড়ে উঠলো। ওই দীপু এসেছে। সতী ডাকলে—রঘু—
রঘু বুঝি বাইরে কোথাও গিয়েছিল। প্রত্যেকদিন আপিস থেকেই তো সোজা চলে আসে দীপঙ্কর। যতদিন সতী এ-বাড়িতে এসেছে ততদিন এসেছে। ঝড়-বৃষ্টি শীত- গ্রীষ্ম, কোনও দিন কোনও ব্যতিক্রম হয়নি তার। কতদিন এয়ার রেড হয়েছে। কতদিন সাইরেন বেজেছে। কতদিন কত কী বিপর্যয় ঘটে গেছে পৃথিবীতে, কিন্তু দীপঙ্কর ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে মিলিয়ে এসে হাজির হয়েছে এখানে। ওই ঘরটিতে বসে দুজনে মুখোমুখি কাটিয়েছে। তারপর আবার যখন রাত ঘন হয়েছে, তখন উঠে দাঁড়িয়েছে দীপু। আস্তে আস্তে বাইরে অন্ধকারে পা বাড়িয়েছে একলা। একলা এতখানি রাস্তা মাড়িয়ে অনেক রাত্রে বাড়িতে পৌঁছেছে গিয়ে। অনেক রাত্রে ভাত খেয়েছে। অনেক রাত্রে শুতে গিয়েছে নিজের সেই একক বিছানায়। তারপর পরের দিন আবার সকালে উঠে যথারীতি আপিসে গিয়েছে। দিনের কাজ করেছে।
এমনি বছরের পর বছর।
কিন্তু এবার থেকে আর আসবে না সে। সতীর প্রতিদিনের অপরাহ্নের প্রতিটি মুহূর্ত আর এমন করে কাটবে না। দীপঙ্কর চলে যাবার পরও পৃথিবীতে সূর্য উঠবে সকালবেলা, সূর্য ডুববে সন্ধ্যেবেলা, কিন্তু এ-বাড়িতে দীপঙ্কর আর আসবে না। তার আসা এবার থেকে ফুরিয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে, সতীর জীবন থেকে দীপঙ্কর হারিয়ে যাবে চিরকালের মত।
সতী ঘড়ির দিকে একবার তাকালে। ঘড়ি যেন আর চলতে চাইছে না। ঘড়ি যেন দীপঙ্করের আসা পেছিয়ে দিচ্ছে মিনিটে মিনিটে।
হঠাৎ বাইরে যেন কার কড়া নড়ে উঠলো। সতী তাড়াতাড়ি সজাগ হয়ে উঠলো।
—রঘু!
রঘু বুঝি কাছাকাছি কোথাও ছিল না। সতী নিজেই গিয়ে দরজা খুলে দিলে। কিন্তু দীপু আজ এত তাড়াতাড়ি এসে গেল যে! এত শিগগির তার আপিস ছুটি হয়ে গেল! দীপু কি তার কাছে আসার জন্যে আপিস কামাই করলে!
কিন্তু না। আশ্চর্য! কেউই না। বাইরের রাস্তার এদিক-ওদিক অনেকক্ষণ ধরে চেয়ে দেখেও কোথাও দীপঙ্করের মূর্তি দেখা গেল না। সতী আবার দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে চলে এল। হঠাৎ সমস্ত বাড়িটা যেন একটা জেলখানা মনে হলো তার কাছে। তাকে এখানেই থাকতে হবে চিরকালচার দেয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে। দীপঙ্কর তাকে এই চারটে দেয়ালের মধ্যে বন্দী করে নিজে পালিয়ে যাবে অনেক দূরে! তারপর বালিশটা আঁকড়ে ধরে হঠাৎ চীৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো সতীর। একটা নিঃশব্দ হাহাকারের সমস্ত অন্তরাত্মা যেন গলা ফাটিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো। বাইরের কেউ জানতে পারলো না, বাইরের কেউ শুনতেও পেলে না। ঈশ্বরের আদালতে সতী তার শেষ আপীল পেশ করে যেন শেষবারের মত মুহ্যমান হয়ে রইল।
—কে?
আবার উঠলো সতী। তাড়াতাড়ি গিয়ে সদর দরজাটা খুলে দিলে। এবার নিশ্চয়ই দীপু এসেছে।
কিন্তু দরজাটা খুলেই একেবারে দশ হাত পেছিয়ে এসেছে সতী! সনাতন-বাবু সামনে দাঁড়িয়ে। আজ সঙ্গে দীপঙ্কর নেই, শম্ভু নেই। আজ সনাতনবাবু একলাই এসে তার দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন।
এক মুহূর্তের মধ্যেই সতী নিজেকে সামলে নিয়েছে। বললে—তুমি? তুমি যে হঠাৎ?
সনাতনবাবু ঘরে ঢুকলেন। ঢুকে বললেন—বসবো?
সতী বললে—হ্যাঁ, বসো। কিন্তু তুমি হঠাৎ এলে যে?
সনাতনবাবু বসলেন। বললেন—হঠাৎ তো নয়। আমি সব দিক ভেবেই মাকে জানিয়ে এসেছি, মা জানে আমি তোমার কাছে এসেছি—
—কিন্তু কেন আবার এলে? তোমরা তো টাকা পেয়ে গিয়েছ? পাওনি?
সনাতনবাবু বললেন—তা পেয়েছি—
—টাকা যখন পেয়ে গিয়েছ, তখন কেন আবার এসেছ শুনি? আমার টাকারই তো তোমাদের দরকার ছিল। টাকা যখন পেয়েই গিয়েছ তখন আমার কাছে তোমাদের আবার কিসের দরকার শুনি? আমি তোমাদের আর কী দিতে পারি?
সনাতনবাবু বললেন—তুমি সবই দিতে পারো—
সতী বললে—সব কি তুমি একদিন নিতে পেরেছিলে? আমি তো আমার সবই তোমাকে দিতে চেয়েছিলুম একদিন—সব কিছু দিতেই তো তৈরী ছিলুম, সেদিন তো আমার দিকে ফিরেও তাকাও নি তুমি? আজ আবার কেন এ-কথা বলছো?
সনাতনবাবু বললেন—অভিযোগ করলে অভিযোগই শুধু বেড়ে যায়, সুতরাং ও-কথা থাক্! অনেক কষ্ট পেয়েছ, এবার তুমি ফিরে চলো।
সতী বললে—এ-কথাও তো তোমার নতুন নয়, এ-কথা তো তোমার মুখ থেকে আমি অনেক বার শুনেছি, শুনতে শুনতে আমার কান ঝালাপালা হয়ে গেছে, আর শুনতে চাই না। তা ছাড়া আমার বুকে অত অপমান সহ্য করবার ক্ষমতাও আর নেই, তা জনো?
সনাতনবাবু বললেন-তা আমি ভালো করে জানি।
সতী বললে-ছাই জানো তুমি! কতটুকু জানবার ক্ষমতা আছে তোমার? কতটুকু তোমার মন? সেই মন দিয়ে আমার অপমান তুমি কী করে বুঝবে? কী করে বুঝবে মেয়েমানুষের স্বামী, শ্বশুরবাড়ি, টাকা, গাড়ি সব পেলেও তার কিছুই পাওয়া হয় না? কী করে বুঝবে মেয়েমানুষের মন বলে আলাদা একটা জিনিস আছে, তোমাদের মনের সঙ্গে যার অনেক তফাত?
সনাতনবাবু বললেন-তাও আমি জানি।
—তাই যদি জানবে, তা হলে আমি কি সাধ করে প্যালেস-কোর্টে চলে গিয়েছিলুম? সাধ করে আমি চাকরি করতে গিয়েছিলুম রেলের আপিসে? আর সাধ করে আমি এখানে এই পরের বাড়িতে পড়ে আছি বলতে চাও? সবই আমার মন-গড়া? কিছুই সত্যি নেই এর পেছনে?
সনাতনবাবু বললেন—বেশ, তাহলে আজ খুলে বলো কী তুমি চাও? আমার কাছে কী পেলে তুমি সব পাবে? তোমার সাধ মিটবে?
সতী বললে—ছিঃ, তুমি আমার মুখ থেকে সেই কথা শুনতে চাও? আমি মেয়েমানুষ হয়ে মুখ ফুটে তাই বলবো তোমার কাছে আর তুমি আমাকে তাই দেবে? তুমি কি আমাকে সেই রকম মেয়ে পেয়েছ? এর চেয়ে যে আমার মরা ভাল!
সনাতনবাবু বললেন—কিন্তু তুমি যদি না বলো তো আমি বুঝবো কী করে?
সতী বললে—ছিঃ, তুমি আমার মুখ থেকে সেই কথা শুনতে চাও? আমি মেয়েমানুষ হয়ে মুখ ফুটে তাই বলবো তোমার কাছে আর তুমি আমাকে তাই দেবে? তুমি কি আমাকে সেই রকম মেয়ে পেয়েছ? এর চেয়ে যে আমার মরা ভাল!
সনাতনবাবু বললেন—কিন্তু তুমি যদি না বলো তো আমি বুঝবো কী করে?
সতী বললে—যদি বুঝতেই না পারো তো কেন বিয়ে করেছিলে? যখন তোমার মা তোমায় বিয়ে দিতে চাইলে তখন কেন তুমি আপত্তি করলে না? কেন আমার গলায় এমন করে দড়ি ঝুলিয়ে দিলে? আর জন্মে আমি কী পাপ করেছিলুম তোমার কাছে বলতে পারো?
সনাতনবাবু যেন কী বলবেন কী করবেন বুঝতে পারলেন না। সতী যেন তাঁর সামনে উন্মাদের মত ব্যবহার করছে। তিনি সান্ত্বনা দেবার আশায় বললেন—সত্যিই আমি স্বীকার করছি, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না—
—কিন্তু কেন তুমি বুঝতে পারো না?
সনাতনবাবু তখনও বললেন—বিশ্বাস করো আমাকে, তুমি নিজের মুখে না বললে আমি বুঝতে পারবো না—
—তুমি বুঝতে পারো না, কিন্তু অন্য সব স্বামীরা তো বুঝতে পারে! দীপু তো বুঝতে পারে!
—দীপঙ্করবাবু?
—হ্যাঁ, দীপঙ্করকে তো আমার কোনও কথা খুলে বলতে হয় না। সে তো আমার দুঃখ-কষ্ট-ব্যথা-আনন্দ সব বুঝতে পারে। তাকে তো মুখ ফুটে কিছু বলতে হয় না? দীপঙ্কর না থাকলে আমি তো কবে আত্মহত্যা করতুম। দিনের পর দিন সে তো ঠিক এসেছে! আমার ভালো-মন্দ নিয়ে তার কত ভাবনা, তা তুমি জানো! আমি তাকে কত বকেছি, কত গালাগালি দিয়েছি, কতবার বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি, তবু তো আমাকে ভুল বোঝেনি তোমার মত! তুমি দীপুর মত হতে পারো না? আর সব স্বামী যেমন করে স্ত্রীর সঙ্গে ব্যবহার করে তেমনি ব্যবহার করতে পারো না? তুমি সাধারণ হতে পারো না?
সনাতনবাবু বললেন—সত্যিই দীপঙ্করবাবু খুব ভালো লোক!
—কিন্তু দীপু ভালো হয়ে আমার কী লাভ? তুমি কেন অমন হলে? এত অহঙ্কার তোমার কিসের? কিসে আমি তোমার অযোগ্য বলতে পারো? কেন এত অপমান তুমি আমাকে করো?
সনাতনবাবু বললেন—অপমান করতে চাইলে কি বার-বার এমন করে তোমার কাছে আসি?
সতী বললে—আমি তো তোমাকে তাই আসতেই বারণ করি। কেন তুমি এমন করে বার-বার আসো? কেন তুমি বার-বার অপমান করে যাও! একবার তুমি আসো, এবার তোমার মা আসে—কেন তোমরা এমন করো? তোমাদের যা দরকার ছিল তা তো পেয়েছ—
সনাতনবাবু বললেন—মার দরকার মিটেছে, কিন্তু আমার?
–তোমার দরকার আর তোমার মার দরকার কি আলাদা?
সনাতনবাবু বললেন—না—
—তা হলে?
সনাতনবাবু বললেন—তুমি সেই একই প্রসঙ্গ তুলছো। আমার মা তো তোমারও মা। তুমি আমিই কি আলাদা? তুমি, আমি, আমার মা–সকলকে জড়িয়েই সংসার। তোমাকেও যেমন ছাড়তে পারি না, আমার মাকেও আমি তেমনি ছাড়তে পারি না। মাকে ছাড়লে তোমাকেও ছাড়তে হয় যে। আর তোমাকে ছাড়লে আমার নিজেরই তো কোনও অস্তিত্ব থাকে না—
এতখানি কথা সনাতনবাবুর মুখ থেকে সতী আগে কখনও শোনে নি। সনাতনবাবুর মুখের দিকে সতী চেয়ে রইল কিছুক্ষণ, বললে—সত্যি বলছো? সত্যি বলছো তুমি এমন করে চাও আমাকে!
সনাতনবাবু বললেন—তুমি এখানে এমনি করে পড়ে থাকো, এ কে চায়? তুমি আমাদের বাড়ি গেলে বুঝতে পারবে, সেখানে সমস্ত বাড়িটা খাঁখাঁ করছে তোমার অভাবে।
—এত টাকা পেয়েও খাঁখাঁ করছে? এত টাকা পেয়েও সমস্যা মেটেনি?
—টাকায় কি সব সমস্যা মেটে!
সতীর যেন তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। বললে—ওগো, তুমি সত্যি বলছো?
সতী আর দাঁড়াতে পারলে না। সনাতনবাবুর পাশের চেয়ারটাতেই বসে পড়লো। বললে——কোর্টে তো টাকা জমা দেওয়া হয়ে গেছে তোমাদের?
সনাতনবাবু বললেন—শুনেছি হয়েছে—
—শুনলাম, চাকর-বাকরদের বাকি মাইনেও মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে?
—হয়ত হয়েছে। ও-সব মা জানে, আমি কিছুই খবর রাখি না।
সতী সনাতনবাবুর মুখের দিকে চেয়ে বললে—শুনলাম তোমাদের সরকারবাবুও নাকি আবার এসে কাজে লেগেছে?
সনাতনবাবু বললেন—দেখেছি, এসেছে। কিন্তু সে-সব তো বাইরের জগতের খবর—
—হোক বাইরের জগতের খবর, কিন্তু টাকা পেয়েছ বলেই তো সব মিটিয়ে দিতে পারলে! টাকা পেলে বলেই তো সব দিক বাঁচলো!
সনাতনবাবু বললেন—সেই জন্যেই তো মা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ!
সতী অবাক হয়ে গেল। বললে-আমার কাছে? কেন?
—বা, তুমিই তো টাকা দিয়েছ! তুমি যদি টাকা না দিতে তো এসব কি হতো?
সতী এবার দাঁড়িয়ে উঠলো। বললে—আমি? আমি টাকা দিয়েছি?
—হ্যাঁ, তুমিই তো দীপঙ্করবাবুর হাত দিয়ে এত টাকা পাঠিয়ে দিয়েছ। নইলে মাকে বড় মুশকিলে পড়তে হতো যে!
সতী আর থাকতে পারলে না। বললে—কী বলছো তুমি? আমি টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি? দীপুর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি? আমি?
সনাতনবাবু বললেন—তুমিই পাঠিয়েছ। তুমি তোমার বাবার অনেক টাকা পেয়েছ, সেই টাকা পাঠিয়েছ তুমি! মা তো সেই কথাই বললেন—
সতীর মাথায় যেন তখন ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল। বললে—বলছো কি তুমি? আমি দীপুর হাত দিয়ে আমার বাবার টাকা তোমাদের পাঠিয়েছি?
সনাতনবাবু নিজেও তখন অবাক হয়ে গেছেন—কেন? তুমি পাঠাওনি?
সতী তখন আরো সরে এসেছে।
—তাই বুঝি তুমি এসেছ? তাই বুঝি তোমার মা তোমাকে পাঠিয়েছে? তাই বুঝি এত মিস্টি কথা তোমার মুখে? তাই বুঝি বাকি টাকাটার লোভে আমার এত খাতির? তোমার লজ্জা করে না এত মিথ্যে কথা বলতে? আমার চেয়ে আমার টাকাটাই তোমাদের কাছে এত বড় হলো? তোমরা এত নীচ? এত ছোট তোমাদের মন?
সনাতনবাবু হঠাৎ সতীর এই ব্যবহারে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বললেন—কী বলছো তুমি, আমি বুঝতে পারছি না—
—তা কেন বুঝতে পারবে? তা বুঝতে পারলে যে অনেক টাকা হাতছাড়া হয়ে যায় তোমাদের। টাকা দিয়েই যে তোমরা সব জিনিসের দাম যাচাই করে নাও। টাকাটাই তোমরা ধর্ম বলে মনে করো! আমার বাবা আমার বিয়েতে যৌতুক বেশী দিতে পারেনি বলেই এতদিন এত অত্যাচার করেছিলে আমার ওপর, আর আজ আমি তোমাদের বিপদের সময়ে টাকা দিতে পেরেছি বলেই এত খাতির? তাই যদি হয় তবে দরকার নেই এত খাতিরের। এ খাতিরের মুখে আমি লাথি মারি। তুমি চলে যাও এখান থেকে। তোমার মুখও আমি দেখতে চাই না আর—চলে যাও—
সনাতনবাবু উঠে দাঁড়ালেন।
সতী বললে—যাও, চলে যাও—
সনাতনবাবু চলেই যাচ্ছিলেন হয়ত। সতী বললে—তবে যাবার আগে শুনে যাও। টাকা আমি দিই নি, আর দেবও না কখনও। আমার এত অধঃপতন হয়নি যে আমি ঘুষ দিয়ে সুখ কিনবো। এ-জন্মের মত আমি সব সুখ জলাঞ্জলি দিয়েছি। আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরবো তবু টাকা দিয়ে শ্বশুরবাড়ির সুখ কেনবার দুর্বুদ্ধি যেন আমার কখনও না হয়—। টাকা আমি রাস্তায় ফেলে দেব, জলে ভাসিয়ে দেব, তবু তোমাদের দিয়ে আমি আমার কালো মুখ আরো কালো করবো না-যাও—
সনাতনবাবু এ-কথার উত্তরে যেন কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই বাধা পড়লো। রঘু হঠাৎ বিব্রত হয়ে ঘরে ঢুকতেই সতী পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করলে—কী রে? কিছু বলবি?
রঘু ভয়ে-ভয়ে বললে-বড়দিদিমণিকে পাচ্ছি না—
—বড়দিদিমণি! কেন? কোথায় গেল? এই তো ঘুমোচ্ছলি, কোথায় আবার যাবে?
-–না, সব জায়গায় খুঁজেছি কোথাও নেই। বাথরুমে নেই, দোতলায় নেই—
—নেই কীরে? যাবে কোথায়?
কথাটা বলেই সতী তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে গেল। যে-ঘরে লক্ষ্মীদি শুতো সে-ঘর ফাঁকা।সতী অবাক হয়ে গেল। এ-ঘর ও-ঘর সব ঘর খুঁজতে লাগলো। শেষকালে ভ্য হতে লাগলো। কোথাও বেরিয়ে গেল নাকি? কথাটা ভাবতেই যেন সতীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত থর থর করে কেঁপে উঠলো।
.
ভূষণ মালী প্রথমটা একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল সেদিন। প্রতিদিন সে এই লেভেল- ক্রসিং গেটে পাহারা দিয়ে আসছে। মাসে আঠারো টাকা মাইনে টিপ্ সই দিয়ে নিয়ে সে এই লেভেল-ক্রসিং-এই তার পৃথিবী বানিয়ে ফেলেছে। যখন সাউথ-কেবিন থেকে করালীবাবু বলেছে,–কে? ভূষণ?
ভূষণ বলেছে—হ্যাঁ বড়বাবু আমি—
করালীবাবু বলেছে—থাট্টি থ্রি আপ্ লাইন ক্লিয়ার হয়ে গেছে, গেট বন্ধ করিস—
—আচ্ছা, ঠিক আছে হুজুর, —
বলে ভূষণ গেট বন্ধ করে দিয়েছে। গেটে কদিন থেকেই ভীষণ ভিড় হতে শুরু করেছে। ময়লা ছেঁড়া কাপড় সব। হাড়-সার চেহারা। কোলে-কাঁখে ছেলে। পায়ে হাঁটা পথে দূর-দূর থেকে সব আসছে। ওদিকে সাহেব-মেমদের গাড়িরও তখন খুব ভিড়। তারা চলেছে ফুর্তি করতে। যোধপুর ক্লাবের সাহেবি আড্ডা তখন জমতে শুরু হবার কথা। ভূষণ ক’দিন থেকেই নিচেয় নেমে এসে ভিড় হটিয়েছে। ভাগো-ভাগো সব, দেখতা নেই, সাহেব লোক্কা গাড়ি আতা হ্যায়? ভাগো হিয়াসে, ভাগো, ভাগ্ যাও—
গ্রামের গরীব-গুর্বো লোক সব। জীবনে হয়ত তারা কখনও মোটরগাড়িও দেখেনি। সাহেব-মেমও দেখেনি। তারা শুধু দেখেছে ক্ষিধে। ক্ষিধে ছাড়া পৃথিবীতে আর কিছুই তারা জানে না। শুধু দু’বেলা পেট-ভরা আউষ-চালের মোটা লাল ভাত, আর কচু-ঘেঁচু কাঁচালঙ্কা, যা-হোক একটা কিছু। কিন্তু তা-ও ক’মাস ধরে জোটেনি তাদের। ভূষণ এসব কথা জানে না। সে রেলের গেটম্যান্। এত কথা জানবে কেন সে? লাইনের ওপর ভিড় করলেই ভূষণ লাঠি নিয়ে তাড়া দিত। বলতো—এ কোম্পানীকা জায়গা, হিয়াসে—
কবে এই রেলওয়ে ছিল কোম্পানীর হাতে, কবে সরকারী প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে, সে- খেয়াল ছিল না ভূষণের। ভূষণ সেই আদ্যিকালের লোক। আদ্যিকালের আইন-কানুনের প্রতিনিধি। তার ধারণা আজো সেই পুরোন আইনেই পৃথিবী চলছে। সেই যে-আইনে পূব-দিকে সূর্য ওঠে; যে-আইনে পশ্চিম দিকে সূর্য ডোবে, সেই আইন। সে জানে না পাঠান-মোগল-ব্রিটিশ যুগ পেরিয়ে এখন টাকার যুগ চলছে। টাকাওয়ালারা সব টাকা মজুত করেছে নিজেদের সিন্দুকে। মানুষের খাবার আজ মুষ্টিমেয়র হাতে চলে গিয়েছে। সে জানে না সে নিজেও আর এক টাকাওয়ালার হাতের যন্ত্র হয়ে গিয়েছে। সে জানে না যে রেলের বড় সাহেবের চোখে তার দাম আজ আঠারো টাকা বার আনা। জানে না বলেই হম্বি-তম্বি করে, মন দিয়ে কাজ করে, প্রাণ দিয়ে গেট বন্ধ করে।
চারিদিকে অন্ধকার হয়ে এসেছে। হঠাৎ কী যেন একটা নজরে পড়লো। ভূষণ ভালো করে ঠাহর করে তাকিয়ে দেখলে সেদিকে। কে যেন দাঁড়িয়ে আছে দাঁড়িয়ে আছে না? ঠিক গুটি ঘরের নিচেয়, অন্ধকার একটা কোনে বেছে নিয়ে মুখ নিচু করে একলা। জেনানা আদমী। আবার ভাল করে দেখলে। হয়ত নজরের ভুল। কিংবা হয়ত অন্ধকার রাতের ছায়া। ডিউটি করতে করতে আগে এমন অনেক ছায়া দেখেছে ভূষণ।
এবার ভূষণ জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললে—কৌন্ হো ইধার?
ছায়াটা যেন একটু আবছা সরে গেল এবার। আরো পাশে সরে গেল। একেবারে গুটি ঘরের নিচে কাঁটা ঝোপটার পাশে।
ভূষণ আবার বললে—কৌন্ হো? কৌন্ হো তুম?
ওদিকে তখনই হঠাৎ করালীবাবুর টেলিফোন বেজে উঠেছে। লাইন ক্লিয়ার হয়ে গেছে। আপ্ সিগ্ন্যাল দিয়ে দিয়েছে করালীবাবু। গেট বন্ধ করো। ভূষণ গেট বন্ধ করেছে। রাস্তার গাড়িগুলো ব্রেক কষে থেমে গেল বাইরে। ভূষণ জানালা দিয়ে বাইরে মুখ বাড়িয়ে দেখে নিলে–আপ্ সিগ্ন্যাল ঠিক পড়েছে। ওদিকে হোম্-সিগন্যালটাও ঠিক পড়েছে। লাল আলোটা সবুজ হয়ে গেছে। আর দেরি নেই থাট্টি-থ্রি আপ্ আসতে—
তারপরেই কয়েকটা মেয়েলি গলার আওয়াজ এল কানে। ওমনি ঘরের নিচেয় যেন কান্না-কাটি চেঁচামেচি হল্লা শুরু হয়ে গেছে। ওদিকে থাট্টি-থ্রি আপের হেড্-লাইটও দেখা যাচ্ছে। ভূষণ কী করবে বুঝতে পারলে না। কাঠের স্লিপারের ওপর তখন চাকার ঘটাঘট্ ঘটাঘট্ প্রতিধ্বনি শুরু হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি হ্যান্ড-সিগ্ন্যাল-লাম্পটার রং বলি করে নিচেয় নেমে এল। নিচেয় নেমে এসে দেখে অবাক কান্ড!
আর সঙ্গে সঙ্গে থাট্টি-থ্রি আপ্ একেবারে হুড়-মুড় করে ভূষণকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেছে বালিগঞ্জ স্টেশনের দিকে। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে থাট্টি-থ্রি আপের হুইশল বেজে উঠলো—হু-উ-উ-উ-উ-উ—
দীপঙ্কর ঠিক সেই সময়েই এসে পড়েছে। দূর থেকেই দীপঙ্কর দেখতে পেয়েছিল-গেটা খোলা। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যায় না। কিন্তু মনে হলো যেন অনেক লোক কাকে ঘিরে জটলা করছে। কেউ চাপা পড়েছে? দীপঙ্করের কী যেন একটা সন্দেহ হলো। দম বন্ধ করে দীপঙ্কর এগিয়ে চললো সেই দিকে। কেউ চাপা পড়েছে?
—কী হয়েছে এখানে? এত ভিড় কেন?
হঠাৎ কোত্থেকে ভূষণ শুনতে পেয়েছে। সেন-সাহেবের গলা। ব্যস্ত সমস্ত হয়ে লাফিয়ে সামনে এসেই সেলাম করলে—সেলাম হুজুর—
—কী হয়েছে ভূষণ? এত ভিড় কেন এখানে?
—হুজুর এক জেনানা আদমী……
আর শোনবার ধৈর্য হলো না। একেবারে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়লো দীপঙ্কর। ভেতরে সতী দাঁড়িয়ে। লক্ষ্মীদিও দাঁড়িয়ে। লক্ষ্মীদি থর-থর করে কাঁপছে। সতীও যেন দীপঙ্করকে দেখে অকুলে কূল পেলে। বললে—দীপু, এখুনি সর্বনাশ হয়ে যেত, এই দেখ—
সনাতনবাবু সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু সেদিকে না-দেখে দীপঙ্কর লক্ষ্মীদির দিকে এগিয়ে যেতেই লক্ষ্মীদি তার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। আর হাউ-হাউ করে কেঁদে উঠলো। বললে—আমি মরতে চাইনি দীপু, আমি মরতে চাইনি, এরা আমাকে মিছিমিছি ধরে রেখেছে—
দীপু কী যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আর একটা ট্যাক্সি সেখানে লাইনের ওপরই এসে থেমে গেল। ভেতর থেকে কে যেন নেমে পড়লো সেইখানেই। তারপর কাছে এগিয়ে এসেই দীপঙ্করের কাঁধে হাত রাখলে। প্রথমটা চিনতে পারেনি দীপঙ্কর। সেই চেহারা এ-রকম হবে কী করে। কিন্তু তবু যেন খুব চেনা-চেনা মনে হলো—দাতারবাবু আপনি? কখন এলেন? এ কী চেহারা হয়েছে আপনার?