2 of 3

কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৭

৭৭

সে ক-দিন দিন-রাত্রি জ্ঞান ছিল না নয়নরঞ্জিনী দাসীর। কোথায় টাকা পাওয়া যাবে, কার কাছে টাকা পাওয়া যাবে—এই ভাবনাতেই অস্থির হয়ে থাকতেন সব সময়। একবার যেতেন উকীল বিভূতিভূষণ বসুর বাড়ি। গিয়ে হাজার হাজার প্রশ্ন করতেন-কোর্টে কি আমাকে জেরা করবে জজ?

উকীলবাবু বুঝিয়ে বলতো—জজ সাহেব আপনাকে জেরা করবে কেন? জেরা করবে পাবলিক প্রসিকিউটর—

সে-সব কূট-নিয়ম বুঝতে পারতেন না নয়নরঞ্জিনী দাসী। বলতেন—জেরা কররে আমি জেরার উত্তর দিতে পারবো তো?

উকীলবাবু বলতো—আপনার ভয় কী? আমি তো রয়েছি, আমি আপনাকে তখন সব শিখিয়ে-পড়িয়ে দেব।

—কিন্তু শুনেছি নাকি কোর্টে গেলে উকীলরা হাঁড়ির খবর নেবার জন্যে যা-তা জেরা করে?

উকীলবাবু বলতো—আমি সব সামলাবো—আপনাকে কিছু খারাপ জেরা করবে না।

নয়নরঞ্জিনী বলতেন—তুমি জানো তো বাবা, আমার বউকে নিয়ে ঢি-ঢি পড়ে গেছে কলকাতায়, কারো কাছে তাই আর মুখ দেখাতে পারি না আমি—আমার যে কী জ্বালা হয়েছে, তা আমিই জানি—

উকীলবাবু বলতো—আজকাল তো ও-সব সব বাড়িতেই হচ্ছে মা। শাশুড়ী-বউতে ঝগড়া নেই, এমন বাড়ি আমায় দেখাতে পারেন আপনি? ও আছার হচ্ছে—

—কিন্তু আমার বউ-এর মত বউ ভূ-ভারতে নেই বাবা। আমার সোনার ছেলে, তাই মুখ বুজে এতদিন সব সহ্য করেছে—

উকীলবাবু সান্ত্বনা দিত। বলতো—ও নিয়ে আপনি মিছিমিছি মাথা ঘামাবেন না মা। বরং এই মামলার টাকাটা শিগির জোগাড় করবার চেষ্টা করুন। মামলা এদিকে চলতে থাকুক, আর টাকাটাও জমা দেওয়া থাক্। তিনমাসের জন্যে নীলেমটা ঠেকিয়ে রেখেছি, এখন দেখা যাক্

কিন্তু দেখা যাক্ বললে নয়নরঞ্জিনী দাসী শুনবেন কেন? কত টাকা যে ট্যাক্সির পেছনে খরচ হচ্ছে, আর কত টাকা যে উকীল-মুহুরীতে নিচ্ছে তার হিসেব নেই। উকীলবাবুর কাছে গেলেই টাকা চায়। বলে—আরো পাঁচটা টাকা আছে আপনার কাছে মা?

কাছে দশটাকার নোট ছিল।

উকীলবাবু বললে—তা ভালোই হলো, পেশকারকে পাঁচ টাকা দেব আর পেকারের দু’জন চাপরাসীদের আড়াই টাকা করে পাঁচ টাকা দেব—

নয়নরঞ্জিনী বলেন—কিন্তু সেদিন যে দিলাম পেশকারের পাওনা? সেই একশো টাকার মধ্যে পেকারের পাওনা-গন্ডা মেটানো হয়নি?

শুধু পেকার নয়। পেকার, মুহুরি, পেয়াদা, চাপরাশি, আর্দালী সবাইকে দিতে হয়। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, কিন্তু মামলায় ছুঁলে ছত্রিশ ঘা। আপনি তো জানেন মা, এ- সব না দিলে আপনারই লোকসান। মামলা মানেই তবির। মামলায় আর কত খরচ? বড় জোর কোর্ট-ফী আর উকীলের ফীটা। কিন্তু আসল মোটা খরচ তো তবিরে। আর ভালো করে তদবির না করতে পারলে আপনার মামলা গেল! আপনি ফাঁসলেন! তাই প্রত্যেকদিনই নয়নরঞ্জিনী উকীলবাবুর সঙ্গে দেখা করেন।

সেদিন বললেন—আসলে সেই হতচ্ছাড়া ব্যারিস্টারটার জন্যেই তো সব কিছু ঝঞ্ঝাট হলো—

উকীলবাবু বললে—তা তো বটেই, আপনি যদি সেই ব্যারিস্টারকে অত বিশ্বাস না- করতেন তাহলে আর এ-সব কিছুই হতো না। আপনি পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে এখন আয়েস করতে পারতেন—

—তা তাকে এখনও ডাক্তার ভাল করতে পারলে না? ডাক্তারবেটারাও কি ঘুষ খেয়েছে?

সত্যিই নির্মল পালিত তখনও ভালো হয়নি। নির্মল পালিত ভালো হলেও না-হয় তার বিরুদ্ধে আইনের সাহায্য নেওয়া যেত। উকীলবাবুর সঙ্গে নয়নরঞ্জিনীও একদিন দেখতে গিয়েছিলেন তাকে। তখন নির্মল পালিতকে পুলিশ পাগলা গারদে রেখেছে। নয়নরঞ্জিনী দেখেছিলেন সে নির্মল পালিত আর নেই। প্যান্ট কোট ছেঁড়া। দাড়ি গোঁফ গজিয়েছে মুখে। গরাদের ভেতর তার চেহারাটা কেমন বীভৎস ভয়ঙ্কর লেগেছিল। যেন পৃথিবীর সমস্ত লোভ, সমস্ত কামনা-বাসনা-হিংসে মানুষের আকার নিয়ে সশরীরে মানুষকেই ক্যারি-কেচার করছে। মানুষকে মুখ-ভ্যাঙ্গাবার জন্যেই যেন নির্মল পালিতকে এমনি করেছে ভগবান। দিনের পর দিন অন্ধকার সেল্-এর মধ্যে থাকতে থাকতে নির্মল পালিতের যেন ক্ষয় ধরেছে শরীরে। কিছু যেন কামড়াতে গিয়ে মুখের ভেতরে দুটো দাঁত ভেঙে গিয়েছে। কপালে চোট্ লেগেছে, দেয়ালে হয়ত মাথা ঠুকতে গিয়ে। কপালে ব্যান্ডেজ বাঁধা। রক্তের লাল দাগ কালো হয়ে নির্মল পালিতের কপালটাই যেন কলঙ্কিত করে দিয়েছে। আর সঙ্গে সঙ্গে নয়নরঞ্জিনী দাসীর কপালও কলঙ্কিত হয়ে গিয়েছে।

প্রথমটায় চিনতে পারেননি নয়নরঞ্জিনী। জিজ্ঞেস করেছিলেন—কোথায়? সে-বেটা কোথায়?

—ওই যে, ওই কোণের দিকে বিড়-বিড় করছে?

আর তারপর নির্মল পালিতের কানেও বুঝি শব্দটা গিয়েছিল। সেইরকম হাতে একটা ছেঁড়া নোটবুক। সারা দিনরাত নোটবুক নিয়েই থাকতো নির্মল পালিত শেষের দিকটায়। শেষের দিকটায় যখন অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেল তখন আর নোটবুক কেউ দিত না। একই নোটবুকে হাজারবার লিখে লিখে পাতাগুলো সব ভর্তি হয়ে গেল। তবু সেই লেখা পাতাগুলোর ওপরই হিজিবিজি কাটতো। বলতো—কী নাম তোমার? হোয়াট ইজ্ ইওর নেম্?

তারপর শুনতে পেত কি পেত না, তা আর বোঝা যেত না। কিন্তু নির্মল পালিত লিখেই চলতো। মুখে বিড় বিড় করতো আর লিখে চলতো। আকাশ-পাতাল ছাই-ভস্ম লিখে চলতো। যারা খাবার দিতে আসতো, ঘর পরিষ্কার করতে আসতো, তাদেরও নাম জিজ্ঞেস করতো—হোয়াট-ইজ ইওর নেম্? নাম কী তোর?

তারপর সে-লেখা যেন তার জীবনে আর শেষ হতো না। কখনও-কখনও দু-একটা কথা বোঝা যেত। টাকা, ক্লায়েন্ট, গান্ধী, সুরেন বাঁড়ুজ্জে, সি আর দাশ, কংগ্রেস, সুভাষ বোস। যেন সকলের বিরুদ্ধে লিখতে হবে তাকে। এই পৃথিবী, এই কলকাতা, এই ইন্ডিয়া, এই করাচী, এই ইংল্যান্ড, এই আমেরিকা। সকলের বিরুদ্ধে। আর কখনও- কখনও একটা অচেনা নাম বলতো—ইন্দ্রাণী। আর সব কথার একটা মানে ছিল তবু, কিন্তু ইন্দ্রাণী কথাটার মানে বুঝতে পারতো না কেউ। তারা জিজ্ঞেস করতো—ইন্দ্রাণী কে? কোনও গার্ল?

—হ্যাঁ, ওর স্ত্রীর নাম। ওর ওয়াইফ, ওকে ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে—

তা হবে। হয়ত স্ত্রীর নামই ইন্দ্রাণী। আশ্চর্য, ইন্দ্রাণীই যেন নির্মল পালিতকে ইন্দ্রের সিংহাসন থেকে নামিয়ে দিয়েছে। তারপর থেকেই নির্মল পালিত একেবারে রাস্তার মানুষ হয়ে গেছে। যে-জীবন যে-ঐশ্বর্যের জন্যে নির্মল পালিত নয়নরঞ্জিনী দাসীর এমন সর্বনাশ করে গেল, ইন্দ্রাণী চলে যাবার পর সেই ঐশ্বর্যও চলে গেল তার সঙ্গে সঙ্গে সেই ঐশ্বর্য ও হাতছাড়া হয়ে গেল তার। সাউথ ইস্ট এসিয়া কম্যান্ডে কোন্ আমেরিকা- মেড্ মেজর ইন্ডয়ান মানি আর ইন্ডিয়ান্ ওম্যান নিয়ে সাগরপাড়ি দিলে! তখন একেবারে পপার, একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেল নির্মল পালিত। নিরাশ্রয় হয়ে গেল নয়নরঞ্জিনী দাসী। ইন্ডিয়া ফতুর হয়ে গেল।

নয়নরঞ্জিনী আবার জিজ্ঞেস করলেন—তা হ্যাঁ বাবা, বিধবা মানুষকে এইভাবেই সর্বনাশ করতে হয়? আমার টাকাটা দেবে না?

নির্মল নোট বুক থেকে মুখ তুললে। বললে—হোয়াট ইজ্ ইওর নেম?

নাম কী তোমার? সরোজিনী নাইডু?

—ওমা, এ যে কথারও উত্তর দেয় না গো? এত রোগের চিকিৎসা হয়, আর এই পাগলের রোগের চিকিৎসা হয় না? পাগল সারাতে পারে না কেউ? তুমি পুলিসদের বলো না বাবা। চিকিৎসার খরচ যা-লাগে, না-হয় আমিই দেব—

উকীলবাবু বলেছিল—না মা, তা তো হতে পারে না। গভর্নমেন্ট আপনার কাছ থেকে টাকা নেবে কেন?

—নিতে দোষ কী উকীলবাবু, গভর্নমেন্টর তো আর দায় নয়, দায় যে আমার। আমারই যে পিতৃ-মাতৃ দায় হয়ে উঠেছে—

ততক্ষণে নির্মল পালিত যেন হঠাৎ চিনতে পেরেছে। হঠাৎ সচেতন হয়ে উঠেছে। ইয়েস্, মানি! ওম্যান্ ইজ্ পোটেন্ট বাট মানি ইজ ওমনিপোটেন্ট। আমি ভাইসরয়কে লিখে দেব, তোমাকে জেলে পুরবে সরোজিনী নাইডু। গান্ধীকে জেলে পুরেছি। নেহরুকে জেলে পুরেছি, প্যাটেলকে জেলে পুরেছি, এবার তোমাকেও জেলে পুরতে লিখে দেব সরোজিনী নাইডু—তুমিও মেয়েমানুষ।

শেষকালের দিকে নির্মল পালিত মানি আর মেয়েমানুষ—দুটো জিনিসকেই সহ্য করতে পারতো না। কেবল নাম লিখে নিত নোটবুকে। চিত্রগুপ্তের নোট-বুকের মত তার নোটবুকেও সব কিছু লেখা থাকতো। আর কেউ সে লেখা বুঝতে পারতো না বটে, কিন্তু নির্মল পালিত একলাই হয়ত বুঝতে পারতো। সে-নোটবুকে লেখা থাকতো—পাপের কথা, পুণ্যের কথা, লোভের কথা, হিংসার কথা, মৃত্যুর কথা, হত্যার কথা। পৃথিবীর তাবৎ বিষয় নিয়ে তার যেন ভাবনার আর শেষ ছিল না। ভেবে ভেবেই আরো পাগল হয়ে যাচ্ছিল নির্মল পালিত।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *