৬৯
১৯৪২ সালের ডিসেম্বরে স্ট্যালিনগ্রাডও তার দরজা বন্ধ করে দিলে। বাইরে থেকে ট্যাঙ্ক আর আর্টিলারি দিয়ে জার্মান আর্মি ঠক্ ঠক্ শব্দ করতে লাগলো। চিৎকার করে উঠলো। হুঙ্কার দিয়ে উঠলো। কিন্তু ভেতর থেকে কোনও সাড়া শব্দ নেই। দরজার ভেতরে যেন মৃত্যুর স্তব্ধতা বিরাজ করছে। বাইরে থেকে ড আর ভল্গা নদীর মধ্যেকার সব জায়গাটুকু দখল করে নিয়েও কোনও ফল হয়নি। এবার টাকা চাই। এবার সাক্ষী দিতে হবে কোর্টে গিয়ে। নইলে মিস্টার ঘোষালরা জেলে যাবে। নইলে নয়নরঞ্জিনী দাসীরা বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াবে। ককেশাস্ চাই, নইলে পেট্রল পাবো না। সমস্ত পৃথিবী গ্রাস করতে পারবো না। লেনিনগ্রাড থেকে ককেশাস পর্যন্ত হাজার হাজার মাইল লম্বা লাইন দিয়েছে সোলজাররা। বাকুর তেলের খনি চাই, গ্রেজনির তেলের খনিও চাই। পেট্রল পেলে তবে মিস্টার ঘোষালরা আবার রেলওয়েতে ডি-টি-এস হয়ে বসবে, নয়ন রঞ্জিনী দাসীরা আবার শাশুড়ী হয়ে আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে। ইরিত্রিয়া, সোমালিল্যান্ড, ইথিওপিয়া—সব গেছে মুসোলিনীর হাত থেকে। নয়নরঞ্জিনী এখন অনাথ। দরোয়ান গেছে, গাড়ি গেছে, ড্রাইভারও গেছে। চাকর-ঝিরাও মাইনে পাচ্ছে না। এখন একমাত্র ভরসা রাশিয়া। তাই সতীর কাছে এসেছে হিটলার। এসেছে মুসোলিনী। টাকা দাও, সাক্ষী দাও, পেট্রল দাও! সব দিয়ে ইজ্জত বাঁচাও!
কিন্তু স্ট্যালিনগ্রাডের দরজা বন্ধই রইল। বাইরের বন্ধ দরজা থেকেই ফিরতে হলো মিস্টার ঘোষালকে!
বৌবাজারের প্রবীণ উকীল বিভূতিভূষণ বসু টেম্পল চেম্বার্সের এটর্নী মিস্টার গাঙ্গুলীকে টেলিফোন করলে।
—কী হে, খুব কাজকর্মে ব্যস্ত নাকি? তোমার আপিসে গিয়েও দেখা পাওয়া যায় না! ঘোষালের কেসটার কী হলো?
—আরে সে কেস্-এর তো জাজমেন্ট বেরিয়ে গেছে, দেখনি? জজ্ বড্ড কড়া রিমার্ক দিয়েছে ভাই। এমন স্ট্রিকচার দিয়েছে, আসামী ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আমি বুঝিয়ে বললুম—ওতে কিছু ভয় পাবার নেই। তা যদি হতো তাহলে কলকাতার সমস্ত নামজাদা লোকই আজ সুইসাইড্ করতো। তবে সেই স্পেশ্যাল-ট্রাইব্যুন্যালের কেটা তো এখনও ঝুলছে, তার জন্যেই ভাবনা।
কেন? ভাবনা কীসের? সেকশন থ্রি হান্ড্রেড-টু থেকে যখন খালাস করে দিলে তখন আবার ভাবনা কীসের?
—না ভাই, আমার ডিফেন্স উইনেস্ মিসেস ঘোষকে নিয়ে এখন মুশকিলে পড়েছি।
—কোন্ মিসেস ঘোষ? নয়নরঞ্জিনী দাসীর পুত্রবধূ?
—হ্যাঁ, সেই-ই তো আমার প্রিন্সিপ্যাল উইনেস্! আসামী বার বার যাচ্ছে দেখা করতে, কিছুতেই দেখা করছে না।
—কী বলছে?
—-আরে, দেখাই করছে না তো বলবে কী? অথচ সামন্ দেওয়া হয়ে গিয়েছে, সামন্ অ্যাকসেপ্ট করেছে সে, আমি উইনেস্-লিস্টে তার নামও সাবমিট্ করেছি, এখন স্পেশ্যাল পাব্লিক প্রোসিকিউটারের কাছে নাজেহাল্ হয়ে যাবো।
বিভূতিভূষণ বসু বললে—এদিকে আমার মুশকিল হয়েছে ভাই, মিসেস ঘোষের শাশুড়ীকে নিয়ে।
—কেন? নয়নরঞ্জিনী দাসীর কেস্টা? তা তুমি তো সুট্ ফাইল করেছ?
—তা তো করেছি, কিন্তু জজ্ যে টাকাটা ডিপোজিট্ দিতে বলেছে। দেব কোত্থেকে? পুত্রবধূ নাকি দেড় লাখ টাকা পেয়েছে বাবার কাছ থেকে—সেই টাকাটা চাইতে গিয়েছিল, গালাগালি দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে শাশুড়ীকে!
গাঙ্গুলী বললে—তা তো দেবেই! বড় ধড়িবাজ মেয়ে হে! আমি তো চিনি। সেদিন কী ওয়ান্ডারফুল সাক্ষী দিলে ভাই কী বলবো! এবার ভাবছি আমি নিজে একবার যাবো। তা আমাদের পাড়ায় বোমা দেখতে তো এলেনা তুমি?
—বোমা? কোথায়? শোভাবাজারে?
—হ্যাঁ, আমার বাড়ির সাতখানা বাড়ির পরেই পড়েছে বোমাটা। একটুর জন্যে বেঁচে গেছি ভাই। সমস্ত কলকাতার লোক দেখতে আসছে রোজ। খুব ভিড় হচ্ছে ক’দিন —
—কোথায় পড়েছে?
—একটা ভাঙা পুরোন পাঁচিলের ওপর। তেমন কিছু হয়নি। কিন্তু তাই দেখতেই লোকে-লোকারণ্য। আমার ভায়রাভাই থাকে চুঁচড়োতে, সে সেদিন সপরিবারে এসেছিল দেখতে, আমার এক মামা আছে বেনারসে, তারা সবাই দেখতে আসবে লিখেছে—
সত্যিই, কলকাতার সবাই সেদিন সেই বোমা দেখতেই ছুটেছিল শোভাবাজারে। মানুষকে নিয়ে এত বড় রাহাজানিটা সেদিন মজা বলেই প্রতিপন্ন হয়েছিল কলকাতার লোকদের কাছে। কিন্তু সেদিন কেউই জানতো না যে কলকাতার সেই ইতিহাসের পেছনে আর এক মর্মান্তিক হাহাকার লুকিয়ে আছে। শুধু বোমা নয়, দুর্ভিক্ষ, খুন জখম, সমস্তই’ যেন ওৎ পেতে ছিল কলকাতার সদর দরজায়। বলতে গেলে আর একটা সিভিল-ওয়ার তখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি মারছে। কেউ জানতো না, কেউ টেরও পায়নি। শুধু মিস্টার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস জানতো আর জানতো মিস্টার চার্চিল। স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস্ পার্লামেন্টে ফিরে গিয়ে কী রিপোর্ট দিয়েছিল, আজ পর্যন্ত তা জানা যায় নি। জানা যাবেও না আর। বার্ট্রান্ড রাসেল নিউ ইয়র্কের ‘টাইম’ কাগজে লিখলেন—না, ইন্ডিয়াকে কখনও স্বাধীনতা দেওয়া যায় না। কংগ্রেস কেউ নয়। তিনি লিখলেনঃ—
I deplore the present conflict in India. I do not think it would be possible, as the Congress Party demanded, to hand over the Government to a professedly representative collection of Indians hastily assembled in the middle of a war, and bitterly at odds among themselves on many important questions. the replies to Sir Stafford Cripps made clear that a British withdrawal now would leave India in chaos and anarchy, if not actually in civil war.
আসলে কার মতলবে বলা যায় না, সেই সিভিল-ওয়ারই হলো শেষ পর্যন্ত। কিন্তু সে অনেক পরে। তখন মহাত্মা গান্ধী জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। মৌলানা আজাদ, জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল, প্রাণমথবাবু, ফোঁটা, সবাই তখন জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। সে অনেক পরে। তখন লক্ষ্মীদি এসে গেছে কলকাতায় সর্বস্বান্ত হয়ে, তখন সতী তার আত্মমর্যাদা ফিরে পেয়েছে আবার। তখন ফোঁটা কালিঘাট কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হয়েছে। তখন প্রাণমথবাবুও মারা গেছেন। আর কিরণ? কিরণের কথাও বলবো। সে অনেক পরে। তখন এ-উপন্যাসের শেষ পর্যায় লেখা হচ্ছে। দীপঙ্করের জীবনেরও প্রায় শেষ অধ্যায়!