2 of 3

কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬০

৬০

আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে এর গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং-এর বাড়িতে। বাইরে-ভেতরে ক্রমে আরো অস্বস্তি জমে উঠলো। দীপঙ্কর তখনও চুপ করে বসে ছিল হেলানো চেয়ারটায় হেলান দিয়ে।

হঠাৎ একটা ঝন্ ঝন্ শব্দে দীপঙ্কর চমকে উঠেছে। কেউ যেন একটা বিকট আর্তনাদ করে উঠলো পাশেই। দীপঙ্কর চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলে—কে? কে?

রঘুর গলার আওয়াজ হলো সঙ্গে সঙ্গে। বললে—আমি, আমি দাদাবাবু

—কী হলো? কিসের শব্দ হলো?

রঘু বললে—হাত থেকে কাচের প্লেটটা পড়ে গেল—! আমি আলোটা জ্বালতে এসেছিলাম, আপনি একলা অন্ধকারে বসে আছেন—

তারপর আলোটা জ্বেলে দিতেই দেখা গেল কাচের প্লেটের ভাঙা টুকরোগুলো সারা ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছে। কার পায়ে ফুটবে আবার। রঘু তাড়াতাড়ি একটা ঝাঁটা নিয়ে এসে ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করতে লাগরো।

দীপঙ্কর বললে–হাঁ, ভালো করে ঝাঁট দিয়ে দাও, দিদিমণির পায়ে ফুটলে আর রক্ষে থাকবে না, ওতে একেবারে সেটিক হয়ে যায়—একটা ছোটো টুকরোও যেন কোথাও না পড়ে থাকে—খুব সাবধান—

রঘু খুব যত্ন করে ঘর ঝাঁট দিতে লাগলো। দীপঙ্কর চেয়ারটাকে সরিয়ে নিয়ে ঘরের অন্য কোণে সরে বসলো। বাইরে অনেক দূরে চাঁদ উঠেছে একটা। বিরাট থালার মত চাঁদটা। ঢাকুরিয়ার এই দিকটার বাড়িগুলো ছোট-ছোট। কয়েকটা তাল গাছ। ক্রমে ক্রমে তালগাছগুলো কমে যাচ্ছে। যত বাড়ি হচ্ছে তত গাছ কমে যাচ্ছে। আকাশের একেবারে পূবের দিকে বাড়ির ছাদটা ছুঁয়ে চাঁদটা উঠছে। ছাদে দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালেই যেন চাঁদটাকে ছোঁয়া যাবে।

—আজকের খবরের কাগজটা আছে রঘু?

রঘু খবরের কাগজটা দিয়ে গেল। কতদিন ধরে খবরের কাগজটা দেখার সময়ও হয়নি। কোনও খবর নেই কোথাও পড়বার মত। প্রত্যেক দিন সেই একই খবর। সেই স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, সেই মিস্টার এল এস অ্যামেরি, সেই মারকুইস অব লিলিগো, সার মন্মথ মুখার্জি, হাইকোর্টের চিফ জাস্টিস মারা গেছেন। মুশলিম লীগ। নলিনীরঞ্জন সরকার, কমার্স মেম্বার, কোথায় কী বক্তৃতা দিয়েছেন। কোথাও কিরণের খবর নেই, কোথাও প্রাণমথবাবুর খবর নেই, কোথাও সুভাষ বোসের খবর নেই। মানুষের যুদ্ধ যেন সকলকে গ্রাস করে ফেলেছে। সব শুভ-বুদ্ধিকে ভূমিসাৎ করে দিয়েছে।

কাগজটা আবার সরিয়ে রাখলে দীপঙ্কর! কিন্তু এত দেরি হচ্ছে কেন?

হঠাৎ একটা গাড়ির আওয়াজ আসতেই দীপঙ্করও যেন একটু সচেতন হয়ে উঠলো। ওই, ওই সতী এসে পড়েছে। রঘুও বুঝি উদ্‌গ্রীব হয়ে প্রতীক্ষা করছিল। সেও গাড়ির শব্দটা শুনতে পেয়েছে। বলে—ওই দিদিমণি এল—

দীপঙ্কর বললে—ঘরটা ভালো করে পরিষ্কার করেছ তো তুমি?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

দীপঙ্করও তৈরি হয়ে সোজা উঠে বসলো। এত দেরি হলো আসতে!

রঘু দরজা খুলে দিলে।

দীপঙ্কর বললে—বাইরের আলোটা যেন জ্বেলো না আবার, ব্ল্যাক-আউট আছে—

না, বাইরের আলো জ্বালেনি রঘু। বাইরের চাঁদের আলো এসে সমস্ত ব্ল্যাক-আউট যেন ধুয়ে-মুছে ভাসিয়ে দিয়েছে।

রঘু বললে—কই, দিদিমণি তো নয়!

দীপঙ্কর যেন অবাক হয়ে গেল। বললে-দিদিমণি নয় তো কে? কে এল? কারা?

রঘু সদর দরজাটা আবার বন্ধ করে দিলে। বললে—ও অন্য গাড়ি, এখানে একটুখানি থেমে আবার চলে গেল, ওরা ঠিক-ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছে না—

তাহলে সতী নয়! সতী নয় তাহলে! দীপঙ্কর হেলানো চেয়ারটায় আবার হেলান দিয়ে বসলো। এত রাত পর্যন্ত হাইকোর্টে কী করছে সতী! কোর্ট থেকে কি অন্য কোথাও গেল? প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে? কিন্তু সেখানেই বা যাবে কেন হঠাৎ? তাহলে কোথায়? এত রাত পর্যন্ত কোথায় কী করছে সতী? দীপঙ্কর ঘড়িটার দিকে চেয়ে দেখলে—রাত বাড়ছে। রাত বাড়ছে—আর আকাশের চাঁদটাও বড় হচ্ছে। হয়ত পূর্ণিমা। পূর্ণিমার চাঁদ হয়ত এমনি করে বেড়ে ওঠে।

দীপঙ্কর আবার হেলান দিয়ে বসলো হেলানো চেয়ারটায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *