৫৮
এমনি করেই চলছিল দিনগুলো। ভুবনেশ্বর মিত্রের কলকাতার ব্যাঙ্কে তিন লক্ষ টাকারও একটা সদ্গতি করে দিয়েছিল দীপঙ্কর। লক্ষ্মীদি টাকাটা পেয়েই দিল্লি থেকে চিঠি লিখেছিল দীপুকে। টাকা পেয়ে যে কত খুশী হয়েছিল তারই কথা। বেশি লেখবার সময় নেই লক্ষ্মীদির। লক্ষ্মীদি দিল্লিতে গিয়ে আরো ব্যস্ত। আরো কাজ বেড়ে গেছে তার। আরও সময়ের দাম বেড়ে গেছে। সে-যুগের ইন্দ্রপ্রস্থ ব্রিটিশলক্ষ্মীর কৃপাকণা পেয়ে আরো বিলাসিনী হয়ে উঠেছে। কলকাতায় সকাল দশটায় লক্ষ্মীদির ঘুম ভাঙতো, এখন ভাঙে বারোটায়। এখানে বিলিতি সিগারেট চলতো, সেখানে গিয়ে টার্কিশ সিগারেট না হলে চলে না লক্ষ্মীদির। এখানে ইংলিশ মদ, সেখানে স্কচ্। এখানে সিল্ক, সেখানে নাইলন্ এখানে ছিল দিশী কন্ট্রাক্টার, সেখানে বিলিতি। যুদ্ধের আবির্ভাবে দিল্লি তখন আমেরিকা হয়ে উঠছে। আমেরিকান সোলজার অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানকার মত। সমস্ত ইন্ডিয়া যেন আমেরিকার কাছে বাঁধা পড়ে গেছে। সেই লক্ষ্মীদি লিখেছে—টাকাটা পেয়ে বড় খুশী হলুম ভাই। আমাকে শিগগিরই একবার কোলকাতায় যেতে হবে, গেলে যাবার আগে টেলিগ্রাম করবো। সুধাংশু ভাল আছে।
এমনি সব বাজে কথাতে ভর্তি।
কিন্তু সেদিন গড়িয়াহাটের বাড়িতে একটা ব্যতিক্রম হলো। দুপুরবেলা রঘু এসে দরজা টোকা দিলে।
—দিদিমণি, দিদিমণি।
সতী উঠে দরজা খুলে দিয়েছে। বললে—কী হলো?
—আপনাকে একজন ডাকছে।
—আমাকে? কে? মিস্টার ঘোষাল? কোত্থেকে এসেছে?
রঘু বললে—হাইকোর্ট থেকে।
—হাইকোর্ট থেকে কে আবার ডাকবে আমাকে? সতী যেন বিব্রত হয়ে পড়লো। প্রতিদিনের অলস একঘেয়েমীর মধ্যে হঠাৎ যেন একটু ব্যতিক্রম হলো। এ-বাড়িতে আসার পর মন্থর হয়ে এসেছিল সতীর জীবন। কোথাও কোনও উৎসাহ ছিল না, রুটিন- বাঁধা গতিতে গড়িয়ে চলতো দিন আর রাতগুলো। দীপঙ্কর আসতো আর যেতো, আবার পরের দিন তারই পুণরাবৃত্তি হতো একইভাবে।
সতী বললে—বল্ দেখা হবে না—
—কিন্তু আমি যে তাকে বসিয়ে রেখেছি দিদিমণি। বলছেন খুব জরুরী কাজ,—
—তা কেন তুই বসতে বললি! আমি কি কারোর সঙ্গে দেখা করি আর?
তারপর তাড়াতাড়ি কাপড়টা গায়ের ওপর গুছিয়ে নিয়ে সোজা বাইরের ঘরে গিয়ে অবাক হয়ে গেল। সম্পূর্ণ অচেনা লোক। আগে কখনও দেখেছে বলেও মনে পড়লো না। কিছু বলবার আগে ভদ্রলোক নিজেই উঠে দাঁড়ালেন। বললেন—আমি এসেছি এটর্নী মিস্টার গাঙ্গুলীর কাছ থেকে—
সতী তবু বুঝতে পারলে না। বললে—আপনি আমাকে চান?
ভদ্রলোক বললেন—আপনি মিস্টার ঘোষালের কেসের ব্যাপারটা জানেন তো? ম্যাজিস্ট্রেট-কোর্ট থেকে এখন তো সেসন্সে গেছে—আপনি তো সমন পেয়েছিলেন! আজকে সেই সেসন্সের হিয়ারিং আছে—আমি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
সতীর যেন এতক্ষণে মনে পড়লো। অনেকদিন আগে কে যেন একজন কোর্টের লোক এসে কী একখানা কাগজ দিয়ে গিয়েছিল। সতী সই করে নিয়েও ছিল সেখানা। কিন্তু সে যে আজকে তা তার মনে ছিল না।
বললে—এখন?
ভদ্রলোক বললেন—হ্যাঁ, আমি ট্যাক্সি নিয়ে এসেছি একেবারে। আপনি যদি দয়া করে একটু আসেন আমার সঙ্গে—
—কোথায় যেতে হবে?
ভদ্রলোক বললেন—হাইকোর্টে।
হাইকোর্ট! সতী যেন চমকে উঠলো। অনেক অসাধ্য-সাধনের মধ্যে দিয়ে জীবন কাটিয়েছে সতী। প্যালেস-কোর্টের নির্জন ফ্ল্যাটের মধ্যে সমস্ত রাত জেগে কাটিয়েছে। রেলওয়ে অফিসের পুরুষ-বেষ্টিত পরিবেশে দিনের-পর-দিন চাকরিও করেছে। কিন্তু হাইকোর্টের সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াবার অভিজ্ঞতা তো তার কখনও হয়নি। হাইকোর্টে জীবনে যে কখনও যায়নি সতী!
ভদ্রলোক বললেন—মিস্টার ঘোষাল স্পেশ্যালি আপনার স্টেটমেন্টের ওপর নির্ভর করে আছেন—। মিস্টার গাঙ্গুলী তাই আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন, আমি আগেই আসতাম, কিন্তু লেভেল ক্রসিং-এর কাছে ট্যাক্সিটা অনেকক্ষণ ডিটেনড্ হয়ে গেল—
—কিন্তু আমি কী স্টেটমেন্ট দেব সেখানে?
—আপনাকে মিস্টার ঘোষাল কিছু বলেন নি?
সতী বললে—বলেছিলেন, কিন্তু সে তো অনেকদিন আগের কথা, আমি সে-সব ভুলে গিয়েছি—। তিনি কোথায় এখন?
ভদ্রলোক বললেন—তিনি তো য়্যারেস্টেড, আপনি জানেন না? মিস্ মাইকেলের মার্ডার চার্জে তাঁকে হঠাৎ য়্যারেস্ট করা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট-কোর্ট থেকে একবার সব হিয়ারিং হয়ে গেছে, সেখান থেকে সেসন্স-এ পাঠিয়েছে। তিনি খালাস থাকলে নিজেই আসতেন। আপনার কিছু ভয় নেই। বার-এ-ল মিস্টার দত্ত আছেন আমাদের ডিফেন্সে।
—কিন্তু আমি মিস্ মইকেলের ব্যাপারে কীই বা জানি যে বলবো?
—আপনি কিছুই জানেন না?
সতী বললে—আমি রেলওয়েতে যে-পোস্টে ঢুকেছিলাম, শুনেছিলাম মিস্ মাইকেল আমার আগে ছিল সেই পোস্টে। তার বেশি তো আমি কিছুই জানি না। শুনেছিলাম আমেরিকা যাবার আগের দিন তার ফ্ল্যাটে সে খুন হয়ে যায়, তখন তার কাছে সেদিন প্রভিডেন্ট ফান্ডের অনেক টাকা ছিল—
—সেটা কী তারিখ ছির আপনার মনে আছে তো?
সতী বললে—তা তো মনে নেই—!
—কিন্তু সেই দিন আপনি মিস্টার ঘোষালকে একটা চিঠি লিখেছিলেন তা তো মনে আছে? রাত্রে আপনি আপনার বাড়িতে থাকবার জন্যে মিস্টার ঘোষালকে আসতে রিকোয়েস্ট করেছিলেন, তা তো মনে আছে?
সতী অবাক হয়ে গেল। বললে—কিন্তু সে চিঠি তো মিস্টার ঘোষাল পরে তারিখটা বসিয়ে নেবেন। তার কভিক্শন হবার ভয় ছিল, তাই আমি ও-রকম চিঠি লিখেছিলাম—
ভদ্রলোক বললেন—সত্যিই কভিক্শন হয়ে যাবে মিস্টার ঘোষালের। শেষ পর্যন্ত, গড-ফরবিড, ফাঁসিও হয়ে যেতে পারে। আপনি শুধু গিয়ে বলবেন যে ও-চিঠিটা আপনারই হাতের লেখা। স্ট্যান্ডিং-কাউন্সিল আপনাকে যা-যা প্রশ্ন করবে, আপনি তারই উত্তর দেবেন—তার পরেই আমি নিজে আপনাকে গাড়ি করে বাড়ি পৌছিয়ে দিয়ে যাবো—। অলরেডি দেরি হয়ে গেছে, আপনি চলুন।
সতী নিজের মনেই কী যেন ভাবতে লাগলো। একলা সে, কারোর সঙ্গেই পরামর্শ করার সময় নেই।
বললে—আজকেই যেতে হবে?
—হ্যাঁ, আর সময় নেই, এখন সাড়ে এগারোটা বেজেছে, যেতে যেতে বারোটা বেজে যাবে—তার আগে পৌঁছলেই ভাল হয়—
সতী বললে—তাহলে আমি আমার চাকরকে সঙ্গে নিয়ে যাবো—
—তা চলুন, একটু শিগির-শিগির করুন—
সতীর মনে আছে প্রথমটায় একটু ভয় ভয় করেছিল। কিন্তু একজনের জীবন। একজনের জীবনের চেয়েও কি বড় সতীর মর্যাদা! আর মর্যাদাই বা তার কোথায়? সব মর্যাদাই তো ধূলিসাৎ হয়ে গেছে তার চিরজীবনের মত। চিরকালের মত তার জীবনের সব গৌরব ধূলোয় পড়ে চুরমার হয়ে গেছে। আর কীই বা বাকি আছে শেষ পর্যন্ত। মেয়েমানুষের জীবনে যা কিছু সে চেয়েছিল সবই তো নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। তার মত এমন করে কে অপমানিত হয়েছে? কে সর্বস্ব খুইয়ে এমন করে এই নির্বাসন দন্ড গ্রহণ করেছে?
টেম্পল্ চেম্বার্সের মিস্টার গাঙ্গুলীর আপিসে আসতেই মিস্টার গাঙ্গুলী সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন—আপনার ভয় পাবার কিছু নেই। এই লাঞ্চ-আওয়ার্সের পরেই হিয়ারিং হবার কথা আছে। আপনি বসুন, এই ঘরটার মধ্যে ততক্ষণ বসুন, যখন আপনার ডাক পড়বে তখনই আমি আপনাকে ডেকে নিয়ে যাবো—আপনাকে একটা কোল্ড ড্রিঙ্ক আনিয়ে দিই—
সতী বললে—না—
—তাহলে চা?
সতী তাতেও বললে—না—
মিস্টার গাঙ্গুলী বললেন—আপনার খুব কষ্ট হবে জানি। কষ্ট হবে বলেই এখানে নিরিবিলিতে বসিয়ে রাখলাম। ওই যে জানালা দিয়ে বিরাট বাড়িটা দেখছেন, ওইটেই হলো হাইকোর্ট! অন্য উইনেসরা সবাই ওখানে ওয়েট করছে, আপনি রেসপেক্টেবল্ লেডী, আপনাকে তাই এখানে বসিয়ে রাখলুম—
মিস্টার গাঙ্গুলী পাখাটা জোরে ঘুরিয়ে দিলেন। বললেন—আসলে আপনার এভিডেন্সের ওপরেই মিস্টার ঘোষালের কেস্টা ডিপেন্ড করছে। আপনিই আমাদের একমাত্র ভরসা—তাহলে আপনি বসুন, আমি ওদিকটা দেখে আসি—
বলে মিস্টার গাঙ্গুলী বেরিয়ে গেলেন। আর প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের নয়নরঞ্জিনী দাসীর একমাত্র পুত্রবধূ সেই কাঠের পার্টিশান্ ঘেরা অন্ধকার ঘরের ময়লা কালি-পড়া টেবিল-চেয়ারের মধ্যে নিজের সঙ্গে মিস্টার ঘোষালের ভাগ্য জড়িয়ে এক অদ্ভূত পরীার প্রতীক্ষা করতে লাগলো।
.
নয়নরঞ্জিনী দাসীর তখনও গা-ধোয়া হয়নি। তখনও কাপড়-কাচা হয়নি। সবে সন্ধ্যে দেখিয়ে গেছে ভূতির-মা। শম্ভু দৌড়তে দৌড়ুতে এল ঘরের সামনে। বললে—মা- মণি, কোর্ট থেকে লোক এসেছে—ডাকছে আপনাকে—
চমকে উঠলেন নয়নরঞ্জিনী। বললেন—কোর্ট থেকে লোক এসেছে কী রে?
–আজ্ঞে হ্যাঁ, কোর্টের পেয়াদা, নোটিশ নিয়ে এসেছে—
—নোটিশ? কীসের নোটিশ? কী শুনতে কী শুনেছিস কে জানে? কোথায় সে?
মা-মণি আর দাঁড়াতে পারলেন না। মোটা শরীরটা নিয়ে বাইরে এলেন। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নিচেয় নামতে লাগলেন। শম্ভুও তাড়াতাড়ি সামনে সামনে নামছিল। একেবারে সদরে এসে দেখা গেল কোর্টের পেয়াদাকে।
—হ্যাঁগা, তুমি কোত্থেকে আসছো বাছা?
—আজ্ঞে কোর্ট থেকে। এই নোটিশ আছে নয়নরঞ্জিনী দাসীর নামে। সই করে নিতে হবে।
নয়নরঞ্জিনী দাসী যেন তখনও বিশ্বাস করতে চাইছিলেন না। বললেন—কীসের নোটিশ শুনি? আমি ইংরিজী জানি নে—কীসে সই করতে শেষে কীসে সই করে দেব, সই করে আগে অনেক ঠকেছি বাছা, এখন আর সহজে সই করিনে—তুমি খুলে বলো কীসের নোটিশ এনেছো?
—নীলেমের নোটিশ।
—কীসের নীলেম?
পেয়াদাটা ঘুঘু লোক। জীবনে এমন অনেক নোটিশ অনেক বাড়িতে দিয়ে এসেছে। অনেক ভিটেতে অনেক ঘুঘু চরিয়েছে। বললে—আজ্ঞে, আপনাদের এই বাড়ি কোর্টে নীলেম হবে, তাই নোটিশ—
নয়নরঞ্জিনী দাসী রেগে গেলেন। বললেন- কেন নীলেম হবে শুনি? আমি কার খেয়েছি না পরিছি, কার কাছে কী দেনা করেছি যে, আমার শ্বশুরের ভিটে নীলেম করে নেবে তোমরা?
পেয়াদাটা এসব কথা শোনা অভ্যেস আছে। এ-সব ক্ষেত্রে দু’দশ টাকা পেয়েও থাে তারা। তাই মিহি সুরে বললে-আজ্ঞে, আমাকে কেন খামোকা দুষছেন, আমি কোর্টের পেয়াদা, নোটিশ আপনি না নিতে চান তো আপনার সদর-দরজায় লটকে দিয়ে যাবো নোটিশখানা—
নয়নরঞ্জিনী দাসী এবার যেন একটু ধাতস্থ হলেন। বললেন—তুমি চটছো কেন বাছা, আমি তো অন্যায় কিছু বলিনি, আমি মেয়েমানুষ, ইংরিজী জানি না, তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করছি—। তা কীসের নোটিশ বাবা? নীলেম হবে কেন? আমি কার কী সর্বনাশ করেছি? আমি কার পাকা ধানে মই দিয়েছি যে তোমরা সবাই মিলে আমায় এমন হেনস্থা করছো?
মুহূর্তের মধ্যে নয়নরঞ্জিনী দাসীর মুখখানা যেন কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তিনি ইংরিজী জানেন না। কাগজখানা নিয়ে চোখ বুলোতে লাগলেন। কিন্তু শম্ভু দেখলে মা- মণির চোখ যেন খুঁজেই বেড়াচ্ছে শুধু, খুঁজে পাচ্ছে না কিছুই। যে-মানুষ সমস্ত বাড়ির মালিক, যার অহঙ্কারের শেষ নেই, যে-মানুষ জন্ম থেকে কর্তৃত্ব করবার অধিকর অর্জন করেছে, আজ তার সেই অহঙ্কারে যেন হঠাৎ চরম আঘাত লেগেছে এই ঘটনায়।
মা-মণি হঠাৎ বললেন—এটা নিয়ে আমি কী করবো বাবা?
পেয়াদাটা বললে—আপনি কাগজটা রেখে দিন—
মা-মণি আবার বললেন—রেখে দিলেই সব সুরাহা হয়ে যাবে?
পেয়াদাটা বললে—নিজের কাছে রেখে দেবেন কেন, আপনার উকিলবাবুকে দেখাবেন, তিনি যা বলবেন তাই করবেন—
তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। সেই সন্ধ্যেবেলাই যেন নয়নরঞ্জিনী দাসীর চোখে অনন্ত রাত্রির অন্ধকার নেমে এল। ভেতর বাড়িতে ভূতির-মা রোজকার মত শাঁখ বাজাচ্ছিল। সেই শাঁখের শব্দটা যেন আর শাঁখের শব্দ রইল না তখন। যেন মা-মণির অন্তরের আর্তনাদ হয়ে আকাশে বাতাসে সব জায়গায় প্রতিধ্বনিত হয়ে আবার ফিরে এল তাঁর অন্তরের মধ্যে। সেখানে তিনি বড় নিঃসঙ্গ, বড় অসহায়। সেখানে তাঁর কেউ নেই, সেখানে তিনি বড়ই একলা।
পেয়াদাটা তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। মা-মণি জিজ্ঞেস করলেন—তুমি বলতে পারবে বাছা কত টাকার দায় আমার?
পেয়াদাটা বুঝতে পারলে না। বললে—আমি বুঝতে পারছি না, আপনি কী বলছেন মা!
মা-মণি বললেন—দেখ বাবা, তোমায় বুঝিয়ে বলি তবে, এ তো আমারই বাড়ি, আমার ব্যারিস্টার ছিল একজন, সে-ই বদমায়িসি করে এ-বাড়ি বাঁধা রেখেছে, তাকে আমি মরতে ওকালত-নামা দিয়েছিলুম, তা কত টাকা দিলে আবার এ-বাড়ির ছাড় পাবো?
পেয়াদাটা বললে—তা তো আমি বলতে পারবো না মা, তবে পেস্কারবাবুর কাছে শুনিছি, লাখ টাকার নীলেম—
—লাখ টাকা?
টাকার অঙ্কটা শুনে মা-মণি যেন আঁতকে উঠলেন। খানিকক্ষণের জন্যে তাঁর মুখ দিয়ে কোনও কথাও বেরোল না আর। পেয়াদাটা তখন নিঃশব্দে চলে গেছে। এমন কত লোকের বাড়িতে কত নোটিশ দিয়ে এসেছে সে, কত চোখের জলের, কত হাহাকারের, কত সর্বনাশের সে সাক্ষী হয়েছে জীবনে, তার হিসেব নেই। এখন এ-সব দেখে তার ভাবান্তরও হয় না আর। রাস্তায় বেরিয়ে পকেট থেকে একটা বিড়ি বার করে ধরালে পেয়াদাটা, এসব ভাবতে গেলে কোর্টের পেয়াদাগিরি তাকে কবে ছেড়ে দিতে হতো। যত চোর-ছ্যাঁচোড় আর জোচ্চোরের জায়গা হয়েছে কাছারি কোর্ট। পেয়াদাটা আবার বিড়ি ধরালে একটা। পেস্কার-বাবুদেরই কপাল ভালো। হুকুম জারি করেই খালাস। লাভের গুড সবটাই তারা খাবে, আর যত শাপ-মন্যি কুড়োবে পেয়াদা। বিড়িতে আবার একটা সুখটান দিয়ে পেয়াদাটা ট্রাম রাস্তার দিকে এগোল।
.
নয়নরঞ্জিনী দাসী তখন ন’দিদির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলছেন।
ন’দিদি ওধার থেকে বলছে—তা কবে নীলেম হবে?
মা-মণি বললেন—তা কি আমিই জানি ছাই, কাগজখানায় সব তো ইংরিজী লেখা—! আমি তো সেজন্যে তোমাকে ডাকিনি ন’দিদি, সে তো আমি এখুনি উকীলের কাছে যাচ্ছি, কিন্তু আমি বলছিলুম অন্য কথা, লাখ খানেক টাকা আমাকে দিতে পারো তুমি? তোমার তো অনেক রয়েছে, আমি আস্তে আস্তে শোধ করে দিতাম, আর সুদও দিতাম আস্তে আস্তে—
ন’দিদি বললে—আগে উকীলের কাছে যা না, দেখ না কী বলে তোর উকীল!
মা-মণি বললেন—উকীল যা বলবে তা তো আমার জানা আছে ন’দিদি, উকীল তো কেবল টাকা চাইবে, একবার কোর্ট-কাছারির হাতের মুঠোয় গেলে কি আর আমায় রেহাই দেবে ভেবেছ? তারা তো টাকা শুষে নেবে বলে বসেই আছে। তা তুমি আমায় দরকার হলে টাকাটা দিতে পারবে কি না বলো না ন’দিদি! আমার এই বিপদের দিনে তুমি ছাড়া আর কে আছে বলো তো? দেবে টাকাটা? দিতে পারবে?
ন’দিদি বললে—আমি কী করে দিই বল তো? তাহলে তো আমাকেও বাড়ি বেচতে হয়, কিংবা বাঁধা রাখতে হয়—
—তা তাই রাখো না ন’দিদি, তুমি যদি না দেখ তো কে দেখবে আমাকে বলো? আমার আর কে আছে?
ন’দিদি বিরক্ত হলো। বললে—কিন্তু তুই বুঝছিস না নয়ন, টাকা তো আমার একলার নয় রে। ছেলেরা এখন বড় হয়েছে, কর্তা বেঁচে রয়েছেন, তারা কী বলবে?
নয়নরঞ্জিনী বললেন-আমি কথা দিচ্ছি ন’দিদি, আমি যেমন করে পারি শোধ করে দেব তোমাকে, নেহাৎ বাসন-কোসন বেচেও শোধ করবো, আমাকে তুমি বিপদ থেকে বাঁচাও—
নয়নরঞ্জিনীর গলার শব্দটা যেন কান্নার মতন করুণ শোনালো।
—কী বলো ন’দিদি, আমি যাবো তোমার কাছে? জামাইবাবুর কাছে গিয়ে সব ব্যাপারটা বলবো?
ন’দিদি কিছুতেই রাজী হয় না।
বললে—তুই তো জানিস নয়ন আমার অবস্থা, কর্তার এই শরীর, তার ওপর বউ সবে আঁতুড় থেকে উঠেছে, আমি বলে কোন্ দিক ছেড়ে যে কোন্ দিক সামলাই তা-ই ঠিক করতে পারছি না—। আমার নিজের হাতে যদি টাকা থাকতো তো দিতাম না ভাবছিস তুই? তুই কি আমার পর রে?
—তাহলে অন্তত হাজার পঞ্চাশেক দিতে পারবে?
—ওরে, যে পঞ্চাশ হাজার দিতে পারে, সে লাখ টাকাও দিতে পারে, দিতে পারলে তো আমি নিজেও বাঁচতুম, তোর বিপদের দিনে আমি দিতে পারছিনে, এতে আমি কষ্ট পাচ্ছি না ভাবছিস?
—তুমি আমায় কম করেও পঞ্চাশ হাজার দাও ন’দিদি, আমার মানটা বাঁচাও, বাকিটা আমি যেমন করে পারি যেখান থেকে পারি, কাবলিওলার কাছ থেকে ধার করেও জোগাড় করে নেব—
ন’দিদি বললে—তা তোর বউ তো শুনছি বাপের অনেক টাকা পেয়েছে, তাকে বল না—
—না ন’দিদি, তুমি বলছো কী? আমি সেই হারামজাদীর কাছে হাত পাতবো? আচ্ছা, পঞ্চাশ হাজার না-হয় পঁচিশ হাজারই দাও, তাতেও আমি কাজ চালিয়ে নেবখন—
—তা তোর বউ-এর কাছে চাইতে লজ্জা কী? নিজের ছেলের বউ, তার কাছে চেয়েই দেখ না তুই একবার! কত পেয়েছে সে? তিন লাখ না চার লাখ?
—তার কথা ছাড়ো ন’দিদি, তুমি এ বিপদে আমাকে বাঁচাও, তোমার দুটি পায়ে ধরছি ন’দিদি, আমার মান-ইজ্জৎ সব গেল। বাড়ি যদি নীলেম হয়ে যায় তো আমি কোথায় থাকবো বলো দিকিনি?
ন’দিদি যেন বিরক্ত হলো। বললে-আঃ, তোর সঙ্গে আর কথা বলতে পারিনে বাপু, আমার অনেক কাজ পড়ে রয়েছে, তুই এখন উকীলের বাড়ি যা দিকিনি, গিয়ে দেখ না, কী বলে তোর উকীল?
বলে টেলিফোন ছেড়েই দিচ্ছিল ন’দিদি। নয়নরঞ্জিনী অনেক কাকুতি মিনতি করলেন। অনেক অনুনয়-বিনয় করলেন। জীবনে কাউকে এমন করে অনুরোধ-উপরোধ করেননি নয়নরঞ্জিনী! কেঁদে ফেলবার অবস্থা হলো নয়নরঞ্জিনীর। শেষকালে টেলিফোনটা ছেড়ে দিয়ে একবার ভাবলেন ছেলের কাছে যাবেন। কিন্তু সেখানেও যেন বাধলো। এই-ই হলো সংসার। এই সংসারের মায়াতেই তিনি এতদিন নাজেহাল হয়েছেন, এখনও নাজেহাল হচ্ছেন। কার জন্যে তিনি এত ভাবছেন! কে ভোগ করবে তাঁর এই বাড়ি। তিনি মারা গেলে হয়ত ওই হারামজাদী বউই এসে আবার এখানে জুড়ে বসবে। তিনি এতদিন ধরে এত কষ্ট করে ঘর-বাড়ি সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখে যাচ্ছেন, আর শেষকালে সেই বউই এসে হয়ত ভোগ করবে সব! কীসের মায়া, কীসের সংসার! চোখ বুজলেই তো সব অন্ধকার। তারপর? তারপর সাত ভূতে এসে লুটে পুটে খাবে! এই যে ন’দিদি, এত টাকার মালিক। এতগুলো বাড়ি। পারতো না দিতে লাখ খানেক টাকা।
শম্ভুকে আবার ডাকলেন। কাপড়খানা ততক্ষণে বদলে নিয়েছেন। সব যেন নয়-ছয় হয়ে গেল! কী ছিল আর কী ছিরি হলো বাড়ির। তা ভাঙা হোক চোরা হোক, এই বাড়িতে এতদিন আছেন, ওমনি এক-কথায় বাড়ি ছাড়তে হবে! দেশে আইন বলে কিছু নেই গো? দেশে একজন মানুষ নেই গা যে একটু দেখবে। এই যে ভালোমানুষের বিধবা বউএর এই হেনস্থা, এ কেউ দেখবার নেই দেশে?
চাবির গোছাটা আঁচলে বাঁধলেন। তারপর শম্ভুকে দেখে বললেন—একটা গাড়ি ডাক, আমার সঙ্গে তোকে উকীল-বাড়ি যেতে হবে—
শম্ভু বললে—এখুনি?
নয়নরঞ্জিনী খেঁকিয়ে উঠলেন। বললেন—তা এখুনি নয়তো কি চব্বিশ ঘন্টা পরে?
শম্ভু তাড়াতাড়ি গাড়ি আনতে ছুটলো। নয়নরঞ্জিনী বললেন—তোরাই সুখে আছিস বাছা, তোদের সম্পত্তি নেই, টাকাকড়ি নেই, তোরাই সবচেয়ে সুখী। পরের পয়সায় খাচ্ছিস-দাচ্ছিস, আর আরাম করে ঘুমোচ্ছিস—
কিন্তু ফিরে দেখলেন যাকে লক্ষ্য করে কথাগুলো বলা সে তখন নেই। সত্যিই, ওরাই সুখে আছে। কোত্থেকে খাওয়া-পরা আসছে, কে দিচ্ছে, তা দেখবার জানবার বালাই নেই। সন্ধ্যেবেলায় মিনিট-কয়েকের জন্যে নয়নরঞ্জিনী দাসীর মনে হলো সম্পত্তি না থাকাই বুঝি সুখের। এই সম্পত্তিই তো যত গোল বাধালে! এই সম্পত্তির জন্যেই তো এই সংসারের মায়ায় আটকে থাকা। নইলে তাঁর তো চিরকাল ইচ্ছে ছির ছেলের বিয়ে দিয়ে তিনি কাশীবাসী হবেন।
শম্ভুর সঙ্গে গাড়িতে উঠে বউবাজারে গেলেন।
উকীলবাবুর কাছে গিয়ে বললেন—আজ দশ বছর ধরে মামলা চলছে, আর আমি জানলুম না, এ কী-রকম কথা উকীলবাবু?
উকীলবাবু বললেন—তা কি আমিই জানতুম?
—তা আমার বাড়ি বিক্রি করলুম আর আমি জানতে পারলুম না?
উকীলবাবু বললেন—আপনি বসুন মা, এ আইনের ব্যাপার, অত হাঁক-পাঁক করলে তো কাজ হবে না। আমি আজ সব খোঁজ নিয়েছি। কোর্টের নথিপত্র দেখলাম—নয়নরঞ্জিনী দাসীর কেস চলছে রামমনোহর দেশাই-এর সঙ্গে আজ দশ বছর।
নয়নরঞ্জিনী দাসী চমকে উঠলেন। বললেন-বলেন কী? আমি জানতে ও পারলুম না, আর আমার সঙ্গে মামলা হচ্ছে? ও রামমনোহর দেশাই বেটা কে?
উকীলবাবু বুঝিয়ে দিলেন। বললেন—ও একজন গুজরাটি ব্যবসাদার, ভেজিটেবল ঘি-এর কারবার খুলেছে এখন। সে-ই এই মামলার বাদী। আপনি নিজেই তো উনিশ শো তেত্রিশ সালে চৌত্রিশ হাজার টাকা ধার করেছিলেন ওর কাছে আপনার বাড়ি বন্ধক রেখে—
—সে কী? আমি কবে কার কাছ থেকে চৌত্রিশ হাজার টাকা ধার করলুম?
—ওই রামমনোহর দেশাইএর কাছ থেকে। তার দলিল রয়েছে, সাক্ষী-সাবুদ রয়েছে, আপনি নিজে কোর্টে গিয়ে হাজির হয়ে তার কথায় রাজী হয়ে এসেছিলেন তারও নথি রয়েছে, যত বছর যাচ্ছে তত বছরের সুদ ধরে এখন এক লাখ টাকার ডিক্রী পেয়েছে সে, সুদে আসলে হিসেব করে কম-বেশি এক লাখ টাকাই তো দাঁড়ায়-আপনি তো মা নিজের মুখে টাকাটা শোধ করে দেবেন বলে এসেছিলেন জজ সাহেবের সামনে?
—ওমা, কী সব্বনেশে কথা! আমি আবার কবে কোর্টে গেলুম?
উকীলবাবু হাসলেন। বললেন—ও-সব কথা বললে তো জজসাহেব শুনবে না, ওদের নথিপত্র সাক্ষী-সাবুদ সব যে মজুদ, আপনার নিজের হাতের সই রয়েছে যে তাতে? আপনি যে নিজের হাতে দলিলে দস্তখত করে দিয়েছেন? এখন তো আপনার কথা কেউ শুনবে না—
নয়নরঞ্জনী দাসীর চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। বললেন—এই ভগবানের নাম করে আমি বলতে পারি, তামা-তুলসী গঙ্গাজল ছুঁয়ে আমি বলতে পারি উকীলবাবু, আমি জীবনে কখনও কোর্ট-কাছারির মুখ দেখিনি, জজসাহেব তো দূরের কথা—
উকীলবাবু আরো হাসলেন। বললেন—তা যে-পাল্লায় আপনি পড়েছিলেন, তার পক্ষে আর একজন ডুপ্লিকেট নয়নরঞ্জনী দাসী কোর্টে খাড়া করে দেওয়া কিছু শক্ত ব্যাপার নয়, টাকা দিলে অমন অনেক নয়নরঞ্জনী দাসী কলকাতা শহরে পাওয়া যায়। তারা গিয়ে আপনার নাম নিয়ে বেমালুম সব কবুল করে আসবে, জজসাহেবের ধরবার কোনও ক্ষমতা নেই—কোর্টে আমাদের এ-রকম হরদম হচ্ছে—
নয়নরঞ্জনী বললেন—তা বলে এই রকম দিনকে রাত করা হবে? আমার যে হৃৎকম্প হচ্ছে শুনে উকীলবাবু। তাহলে অনাথা বিধবাকে দেখবার কেউ নেই সংসারে? উকীলবাবু বললেন—আপনি বড় মুষড়ে পড়েছেন মা, অত ভাবছেন কেন? তাহলে আমরা আছি কী করতে? আমরা তো এই জন্যেই আছি! আইন যেমন দিনকে রাত করতে পারে তেমনি রাতকেও যে দিন করতে পারে, আইন যে দু-মুখো ছোরা—
নয়নরঞ্জনী বললেন—না উকীলবাবু, গরীবদের মারবার জন্যেই দেখছি আইন তৈরি হয়েছে—
উকীলবাবু এবার আর হাসি চেপে রাখতে পারলেন না। হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন—আপনি যদি গরীব হন, তো আমরা আপনার কাছে কী বলুন তো মা? আর এই রকম ঠগ-জোচ্চোর যদি দুনিয়ায় না থাকে তো আমাদের চলে কী করে বলুন তো? আমরা পেট চালাই কী করে? আমাদের কথাটাও একবার ভাবুন—
নয়নরঞ্জনী বললেন—আমার ভাবনা কে ভাবে তার ঠিক নেই, আপনাদের কথা আমায় ভাবতে বলছেন? আমার যে মাথা খুঁড়ে মরতে ইচ্ছে করছে উকীলবাবু? আমার যে সব গেছে। আমার শ্বশুর গেছেন, স্বামী গেছেন, ছেলে গেছে, ছেলের বউ গেছে, আমার বাড়িটা ছিল মাথা-গোঁজার তাও যেতে বসেছে এখন আমি কী করি—
—কিন্তু কেঁদে তো কিছু লাভ নেই, একটা কিছু করতেই হবে—
—কী করতে হবে বলুন, এখন এই নীলেমের নোটিশ এসেছে, এখন কীসের পিন্ডী চটকাবেন চটকান!
উকীলবাবুর এসব সহ্য করা অভ্যেস আছে। বললেন—নোটিশ না হয় আমি নিলাম, নীলেমের দিন ফেলবার জন্যেও না হয় আমি দরখাস্ত করে দেব-খন, এখুনি না-হয় দু’দিন পরে টাকাটা দিলেও চলবে। সে ব্যবস্থা আমি করে দেব আপনাকে— তা করে দিলেই তো হলো?
—কিন্তু টাকা আমি দেব কোত্থেকে?
উকীলবাবু বললেন—সে যেখান থেকে হোক আপনাকে দিতেই হবে। সাক্ষী-সাবুদ, নথিপত্র, সব যে আপনার বিপক্ষে, আপনি যে নিজেই গোড়া থেকে ভুল করে এসেছেন, এখন খেসারত দিতে হবে না? জানেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলতেন—সংসারে বাস করবি আর ট্যাক্সো দিবি না? একে আপনার সেই ট্যাক্সোই ধরে নিন না—
নয়নরঞ্জনী বললেন—কিন্তু ট্যাক্সো যে আমি দেব, তার জন্যে সংসার আমাকে কী দিয়েছে? আমাকে কী দিয়েছে বলুন তো? সংসার আমাকে কোন্ সুখটা দিয়েছে বলতে পারেন? মআমি সংসারের কাছ থেকে কোন্ সুখটা পেইছি? বিয়ে হবার পরেই বিধবা হলুম, ছেলে হলো, ছেলেকে ছোটবেলা থেকে বুকে আগলে মানুষ করলুম, সেই ছেলে বড় হয়ে মায়ের দুঃখ দেখলে না। তারপর ছে েলর বিয়ে দিলুম, সেই বউও পর হয়ে গেল। বিষয়-সম্পত্তি দেখবার জন্যে বিশ্বাসী ব্যারিস্টার ছিল সেও শেষকালে আমাকে পথে বসালে—এত ট্যাক্সো আমি বিধবা মানুষ হয়ে দিই কী করে? কোত্থেকে দিই?
এত ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের কথা শোনবার সময় উকীল মানুষদের থাকে না। থাকবার কথাও নয়। বউবাজারের পাকা-প্রবীণ উকীল বিভূতিভূষণ বসুর অনেক মক্কেল। সব মক্কেলদের সব সুখ-দুঃখের কথা শুনতে গেলে বাহাত্তর ঘন্টায় দিন হতে হয়। সকাল থেকে লাইন দিয়ে মক্কেলরা তাঁর বৈঠকখানায় বসে থাকে। তারপর রাত বারোটা পর্যন্ত তাঁর দরজায় মক্কেলরা ভিড় করে থাকে। এরকম ব্যস্ত উকীল হয়েও যে এতখানি কথা শুনেছেন, এটাই যথেষ্ট। সব শুনে বললেন—ঠিক আছে, আমি না-হয় দরখাস্ত পেশ করছি কালকেই, আরো তিন মাস ঠেকিয়ে রাখবো নীলেমটা, সেই তিন মাসের মধ্যে টাকাটা জোগাড় করতে পারবেন না?
—টাকা কোত্থেকে পাবো আমি? আমার কি টাকার গাছ আছে?
—কিন্তু সে বললে তো কোর্ট শুনবে না। টাকা আপনাকে দিতেই হবে। নইলে ও- বাড়ি নীলেম হয়ে যাবে! আপনাকে বাড়ি ছাড়তে হবে—এই যে এত মক্কেল আমার বসে আছে দেখছেন, সকলেই আপনার মতন সমস্যা, কারোর দেনা, কারোর পাওনা, কারোর বাড়ি, কারো জমিদারী। আপনি আজ রাত্রে ভালো করে ঘুমোনগে যান, আমি আছি, আপনার কোনও ভাবনা নেই—শুধু টাকাটা যাতে শিগির জোগাড় হয় তার ব্যবস্থা করুন গিয়ে—
—হ্যাঁ, একটা কথা!
নয়নরঞ্জনী উঠছিলেন, শম্ভুও তৈরি হয়ে ছিল। একটা ট্যাক্সি ডেকে আবার চলে আসছিলেন।
উকীলবাবুর যেন শেষ মুহূর্তে কথাটা মনে পড়লো। বললে—হ্যাঁ, আর একটা কথা, শ’খানেক টাকা যে দিতে হবে—
—শ’খানেক? কেন?
উকীলবাবু বললেন—মামলা হচ্ছে লাখ টাকার, তার নীলেম ঠেকাতে গেলে ওমনি তো হবে না। পেশকার আছে, নাজির আছে, পেয়াদা আছে, হাকিম-হুকুম, সবাই যে ওৎ পেতে আছে, শ্মশানে মড়া এলে শুকুনিরা যেমন ওৎ পেতে থাকে, এও যে তাই—পান খেতে দিতে হবে না?
—তা বলে শ’খানেক টাকার পান?
—আহা, পান বলছি বলে কি সত্যি-সত্যি পানই খাবে? ওদের এটা পাওনা; না দিলে আপনারই ক্ষতি—না দেন না দেবেন, কেউ তো আর আপনাকে মাথার দিব্যি দিয়ে চাইছে না। এটা যতবার দিন পড়বে ততবার দিয়ে যেতে হবে —
নয়নরঞ্জনী বললেন—তা দেব, কপালে গেরো থাকলে দিতেই হবে। আমার এই চাকরকে দিয়ে কাল সকালেই পাঠিয়ে দেব—
—বাড়িতে না পাঠালেও চলবে, কাল কোর্টে পাঠিয়ে দেবেন। আমি বাড়িতে টাকা নিয়ে কী করবো? আমি তো নিজে পেটে পুরবো না—
বলে হো হো করে অমায়িক হাসি হাসলেন আবার।
গাড়িতে আসতে আসতে শম্ভু সারা রাস্তাটা মা-মণির পাশে বসে মা-মণির চেহারাটার দিকে চেয়ে দেখতে লাগলো। আগে এতদিন এত কান্ড হয়েছে বাড়িতে, এত বকা-ঝকা হয়েছে বৌদিমণিকে নিয়ে কিন্তু মুখের চেহারা কখনও এমন হয়নি। সমস্ত বাড়িটা নীলেম হয়ে যাবে, তাহলে যাবে কোথায় সবাই। আর তো বাড়ি নেই মা-মণির। মা-মণি যেন পাথর হয়ে উঠছে ভেতরে ভেতরে।