৫৫
ক্রফোর্ড সাহেব সব শুনলেন। বললেন—আমি সব জানি সেন, পুলিস আমাকে রেফার করেছিল—
মিস্টার ক্রফোর্ডকে বেশি বলতে হয় না। বেশি কথার লোকও নয় সাহেব। দু’ একটা কথার পর আবার সেই কামরা। আবার সেই চেয়ার। আবার সেই আলোচনা। আবার সেই কানাকানি। সেক্শানে-সেকশানে আবার সেই কথা-চালাচালি। এতদিন অভয়ঙ্কর কোনওরকমে কাজ চালিয়েছিল। সে-ও বাঁচলো।
অভয়ঙ্কর বললে—মিস্টার ঘোষালের কেস্ সম্বন্ধে কিছু শুনেছ?
দীপঙ্কর বললে—না, কিছুই শুনিনি তো—
—আপিসে এসেছিল মিস্টার ক্রফোর্ডকে ইনফ্লুয়েন্স করতে। কিন্তু মিস্টার ক্রফোর্ড বলে দিয়েছে—হি নোজ্ নাথিং—হেঁকে রিফিউজ করে দিয়েছে!
এ-সব কথায় কান দেবার মত মনের অবস্থা ছিল না দীপঙ্করের। অনেক ফাইল জমে গেছে টেবিলে। এতদিন আপিসের বাইরে থেকে যেন একদিক থেকে সে বেঁচেছিল। অভয়ঙ্কর বোধহয় আরো অনেক কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু দীপঙ্করই গা করলে না তেমন। বললে—আমার মনটা ভাল নেই তেমন অভয়ঙ্কর—
—হোয়াই? তোমার আবার ওরিজ্ কী? তুমি তো এখনও ব্যাচিলর?
সে-সব অভয়ঙ্কর ঠিক বুঝবে না। অত কথা ওদের সঙ্গে না-বলাই ভালো। সকাল থেকেই যে কত ঝঞ্ঝাট চলেছে তা কেমন করে বোঝাবে দীপঙ্কর। সকাল বেলা ডাক্তার নিয়ে গিয়ে সতীকে দেখিয়েছে। তারপর ওষুধ কিনিয়ে এনেছে। তারপর তাড়াতাড়ি বাড়িতে এসে ভাত খেয়েই চলে এসেছে আপিসে।
হঠাৎ যেন কী-কথা একটা মনে পড়ে গেল। মধুকে বললে-লক্ষ্মণবাবুকে একবার ডাক তো—
লক্ষ্মণ সরকার আসতেই দীপঙ্কর বললে—বোস, তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে—
লক্ষ্মণ সরকার বসলো একটা চেয়ারে। দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—তোমার কে আছে সংসারে?
হঠাৎ এই প্রশ্নে লক্ষ্মণ সরকার যেন একটু বিব্রত হলো। দীপঙ্কর বললে—এ আপিসের কাজের কথা নয়, আমি অন্য কথা জিজ্ঞেস করছি তোমাকে। তোমার কে-কে আছে?
এ-কথা আগেও একবার জিজ্ঞেস করেছিল দীপঙ্কর। আজকে আবার এই কথা কেন তুলছে লক্ষ্মণ বুঝতে পারলে না। বললে—আমি তো বলেছিলাম তোমাকে, আমার কেউ নেই—
—কোন্ গ্রেড্ এখন তোমার?
লক্ষ্মণ সরকার বললে—সেই সব বলতেই একদিন তোমার বাড়িতে গিয়েছিলাম, তোমার দেখা পাইনি, একটি মেয়ে দরজা খুলে দিয়েছিল।
দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল। বললে—আমার বাড়িতে গিয়েছিলে? কেন?
—এই সব কথাই বলতে! সেক্শানে সবাই আমাকে ডাউন করবার চেষ্টা করে—
—কেন?
—তুমি আমাকে চাকরিতে ঢুকিয়েছ বলে!
দীপঙ্কর বললে—ওতে কিছু মনে করতে নেই লক্ষ্মণ। দোষ যখন একজন লোক খুঁজে বার করতে চেষ্টা করে, তখন দোষ বেরুবেই। দোষ না থাকলেও দোষ বেরুবে। আমাকে প্রাণমথবাবু বলেছিলেন, এ-সব দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও কাজ করে যেতে হবে। কাজ বন্ধ করলে শত্রুদেরই তো সুবিধে! এই আমাকে দেখ না! তুমি এখন যে-চেয়ারে বসছো, একদিন আমিই ওই চেয়ারে বসতুম। তারপর মাইনে বেড়েছে, পজিশন বেড়েছে, তা বলে শত্রুতা কি কমেছে এতটুকু? বরং দিনের পর দিন উন্নতি হবার সঙ্গে সঙ্গে আমার বিরুদ্ধে নিন্দে পরশ্রীকাতরতা বেড়েই চলেছে। একে এড়িয়ে যাওয়া মানে পরাজয় স্বীকার করা, এতে ভয় পেতে নেই—এ না-হলে বুঝতুম আমার উন্নতি হয়নি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—শত্রুসৃষ্টি শক্তির লক্ষণ! তোমার আমার শক্তি আছে, তাই শত্রুতা হয়। আর তাছাড়া, এটা বাঙালীদের স্বভাব। সুভাষ বোসের কত শত্রুতা করেছে কংগ্রেস—তা তো জানো! প্রাণমথবাবু বলতেন-এ শত্রুতার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে একদিন।
তারপর একটু হেসে বললে—তোমারও মনে আছে নিশ্চয়ই, একদিন তুমিও আমায় কত চাঁটি মেরেছ—
লক্ষ্মণ সরকার মাথা নিচু করলো। দীপঙ্কর আবার বললে—রামের সবচেয়ে বড় শত্রু রাবণ তো? কিন্তু বারণই আবার রামের সবচেয়ে বড় ভক্ত! বারণ সীতাহরণ না করলে রামের বীরত্ব দেখাবার সুযোগ হতো কী করে?
তারপর হঠাৎ বললে—থাক্ গে এ-সব কথা, আমি তোমাকে অন্য কথা বলতে ডেকেছিলাম। তুমি বিয়ে করবে?
—বিয়ে!
লক্ষ্মণ সরকার যেন আকাশ থেকে পড়লো। হঠাৎ দীপঙ্কর তাকে ঘরে ডেকে নিয়ে এসে বিয়ের কথা পাড়বে, এ-কথা সে কল্পনাও করতে পারেনি। বিয়ে করলে খাওয়াবে কী সে। বিয়ে করলে সংসার করবে সে কোথায়! সংসার করলেও সংসার চালাবে সে কেমন করে?
—সে-সব তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি মেসে আছো, সারা জীবনটাকে একটা খেলা ধরে নিয়েছ। এতদিন পরে তোমার চৈতন্য হয়েছে তাই এসেছ এখানে চাকরি করতে। তুমি তো দেখেছ, জীবনকে যা ভেবেছিলে, জীবন তা নয়। এই সংসারে বেঁচে থেকে ভোগ করতে গেলে কিছু যোগ করতেও হয়। শুধু খাওয়া-পরা, খাওয়া-শোয়া নিয়ে তো জানোয়ারেও থাকে, মানুষকে আরো বাড়তি একটা কর্তব্য পালন করতে হয়—একটা দায়িত্ব ঘাড়ে নিতে হয়—
—বিয়ে করাটাই কি সেই দায়িত্ব?
দীপঙ্কর বললে—না, বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অনেকগুলো কর্তব্য-বোধ জাগ্ৰত হয় বলে বিয়েটার এত উপকারিতা—নইলে আর কিছু নয়।
—কিন্তু তুমি? তুমি তো বিয়ে করোনি শুনেছি—
দীপঙ্কর বললে— হয়ত আমিও বিয়ে করবো একদিন, কিন্তু আমার কতকগুলো দায়িত্ব আছে, সেগুলো শেষ না করতে পারলে স্বস্তি পাচ্ছি না।—সে তুমি বুঝবে না। আমার কেউ না-থেকেও আমার অনেক গলগ্রহ।
—কিন্তু আমি যে সব মিলিয়ে তেতাল্লিশ টাকা হাতে পাই।
দীপঙ্কর বললে—আমিও একদিন তেত্রিশ টাকা পেয়েছি।
লক্ষ্মণ বললে—তোমার কথা আলাদা, তোমরা লেখাপড়া শিখেছ, তোমরা ভালো ছেলে—
দীপঙ্কর বললে—সে-সব তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও, আমি তো রইলুমই। এমন অনেককেই আমায় দেখতে হয়, অনেক আমার দায়িত্ব, না-হয় তোমার দায়িত্বটাও ঘাড়ে নেব। তুমি এখন যাও, তোমাকে ঠিক সময়ে খবর দেব—
লক্ষ্মণ সরকার চলে গেল। সেক্শানে যেতেই সবাই মুখ উঁচিয়ে ছিল। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়লো লক্ষ্মণের ওপর।
—কী হলো দাদা? কী বললে সেন-সাহেব?
—খুব সাবধান মশাই, সেন-সাহেব বড় হুইম্জিক্যাল লোক, এমনিতে বেশ ভালো মানুষ কিন্তু ক্ষেপে গেলে আর কারুর নয়—
পুলিনবাবু বললে—কারো ভালো দেখতে পারে না মশাই, ক্লার্কদের ওপর একটা জাতক্রোধ আছে, নিজে একদিন ক্লার্ক ছিল কি না!
কে-জি-দাশবাবু বললেন—তোমরা থামো না হে, কী জন্যে আসলে আপনাকে ডেকেছিল বলুন তো?
লক্ষ্মণ সরকার কিছু বলবার আগেই কে-জি-দাশবাবু বললেন—আমি আপনাকে পই-পই করে বলেছি সেন-সাহেবকে ফাইল পাঠালে আমাকে একবার দেখিয়ে পাঠাবেন, ইংরিজীর ভুল দেখলে সেন-সাহেব ক্ষেপে যায়। কেন, আপনাকে আমি বলিনি, অসবর্ন সাহেবের নোট্ ফাইলের তলাতেই রয়েছে, একটু চোখ বুলিয়ে নেবেন—
তারপর উপদেশের ঝড় বইতে থাকে।
—আপনারা যদি অফিসের পর বাড়ি না-গিয়ে রোজ অন্তত আধ ঘন্টাও ফাইলগুলো পড়েন তো কত কাজ হয় জানেন! আপনাদেরই উপকার হয়, আমার কী? আপনারা সব আজকালকার ছেলে, পাঁচটা বাজলেই বাড়ি! আরে, বাড়িতে গিয়ে আছেটা কী! এত সকাল-সকাল বাড়িতে গিয়ে লাভটা কী হয় শুনি? বউ-এর চুল-বাঁধা আর গা-ধোয়া দেখা ছাড়া আর কিছু লাভ আছে? তা এতদিনে তা-ও পুরোন হয়ে গেল না আপনাদের? ছি ছি ছি—