2 of 3

কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫২

৫২

কদিন থেকে মিস্টার ঘোষালের বড় পরিশ্রম হচ্ছে। রাত্রে প্যালেস-কোর্টে বিছানায় শুয়েও শান্তি নেই। পৃথিবীর সমস্ত দেশে যেন শান্তিপ্রিয় লোকের ওপর অত্যাচার বাড়ছে। সবাই বড় হতে চায়। সেদিনকার ছেলে মিস্টার সেন। থাট্টি থ্রি রূপীজ ব্রাইব দিয়ে যার-চাকরি হয় ক্লার্কের, সেও ডি-টি-এস হতে চায়। সেদিনকার নেকেড ফকির গান্ধী, সেও ইন্ডিয়ার, প্রেসিডেন্ট হতে চায়। এভরিথিং রটন। এই ক্যালকাটা আগে কী ছিল, কী হয়ে গেল রাতরাতি। স্ট্রীট আর্চিনা এখন সিভিক গার্ড, এ-আর-পি হয়েছে, তারা রাস্তায় সিগ্রেট ফুঁকে বেড়ায় সকলের সামনে। গাড়ি চালালে কেয়ার নেই, নড়ে না। যেন রাস্তাগুলো তাদের।

যতীন কি জগন্নাথ কি মল যখন সামনে আসে তখন ঘুষি মেরে মুখ ভেঙে দিতে ইচ্ছে করে। গেট্ আউট্, গেট্ আউট্—

কোনও কাজের নয়। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বেড়াতো সব। একটা সিগ্রেট কিনে খাবার পয়সা ছিল না কারো। ফ্রী-স্কুল স্ট্রীটের আশে-পাশে পিক-পকেট করা ছিল প্রফেশন। ব্ল্যাক-মেইল করা ছিল হ্যাবিট। রাস্তার মোড়ে মোড়ে অন্ধকার গ্যাস্ পোস্টের তলায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতো। কেউ রাস্তা দিয়ে গেলেই জগন্নাথরা বলতো—কলেজ গার্ল, সুইট সিক্সটিন—

আর তেমন কোনও খদ্দের এলে জগন্নাথরা একেবারে পিছু-পিছু জমে যেত।

—কলেজ গার্ল স্যার, সুইট সিক্সটিন—ভেরি বিউটিফুল—প্লিজ সী ওয়ানস্-

তর্জমা করলে দাঁড়ায়—কলেজে-পড়া মেয়ে, মোটে ষোল বছর বয়েস, খুব সুন্দরী, দয়া করে একটিবার পরীক্ষা করে দেখুন—

এই ছিল এদের কাজ। তারপর খদ্দেরদের নিয়ে একেবারে তুলতো গিয়ে ফ্রী-স্কুল স্ট্রীটের ফ্ল্যাট-বাড়িতে। সেখানে গিয়ে ঘরের মধ্যে পুরে একটা মেয়ে-মানুষকে ঢুকিয়ে দিত। বলতো—পকেটে কত টাকা আছে দেখি, ছাড়ুন, ছাড়ুন শিগগির

লোকটা হতভম্ব হয়ে যেত।

জগন্নাথরা বলতো—শিগির, শিগির করুন, নইলে এখুনি পুলিস ডাকবো, মেয়েমানুষের ইজ্জত নষ্ট করেছেন—

এককালে এদের দিয়ে অনেক কাজ হাঁসিল করেছে মিস্টার ঘোষাল। এরাই ছিল মিস্টার ঘোষালের হাতের পাঁচ। আজ বহু বছর ধরে এদের মাসোহারা দিয়ে আসছে। যখন ছোট-চাকরি ছিল তখনও দিয়েছে। পরে যখন ডি-টি-এস হয়েছে তখনও দিয়েছে। তারপর যখন মিসেস ঘোষকে খোঁজবার জন্যে চারদিকে তোলপাড় করে বেড়িয়েছে, তখন মোটা টাকা এদের খাইয়েছে। এরাই এখন দিনরাত খচ্ খচ্ করে। যখন তখন এসে টাকার জন্যে ডিস্টার্ব করে। মেজাজ তখন বিগড়ে যায় মিস্টার ঘোষালের। তখন চিৎকার করে ওঠে। বলে-গেট্ আউট্, গেট্ আউট্

সেদিন সলিসিটরকে নিয়ে বার-এট-ল মিস্টার দত্তর কাছে যাবার কথা। সবে বেরোচ্ছে, এমন সময় জগন্নাথ এসে হাজির।

—হুজুর, আমার বখশিশ্টা দেবার কথা ছিল।

মিস্টার ঘোষাল চেয়ে দেখলে জগন্নাথের দিকে। আর চেনা যায় না ছোকরাকে। বেশ ফরসা পায়জামা, ফরসা পাঞ্জাবি পরেছে ছোক্রা। টু পাইস উপায় হচ্ছে আজকাল। মিলিটারি এসে জুটেছে কলকাতায়, তাদের নিয়ে এখন তোলে গিয়ে ফ্রী-স্কুল স্ট্রীটের ফ্ল্যাট-বাড়িতে। এখন মোটা বখশিশ পায়।

—আবার কী তোর?

—আজ্ঞে সেই কিছু দেবেন বলেছিলেন?

—কবে বলেছিলুম?

—আজ্ঞে, সেই গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং-এর ধারে মিসেস ঘোষকে খুঁজে বার করেছিলুম?

বড় ভ্যালুয়েল ডকুমেন্ট দিয়েছে মিসেস সতী ঘোষ। মনটা একটু নরম হলো। পকেট থেকে একটা একটাকার নোট বার করে এগিয়ে দিলে মিস্টার ঘোষাল।

—এক টাকা? এক টাকায় কী হবে স্যার?

—আচ্ছা দুটাকা নে, দু’টাকা সাফিসিয়্যান্ট, মোর দ্যান সাফিসিয়্যান্ট—

দু’টাকায় কী হবে স্যার? আমি রোজ বাস-ট্রাম ভাড়াই তো দিয়েছি আট আনা। তারপর আমার টিফিন আছে সমস্ত ঢাকুরিয়া টালিগঞ্জ সব খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েছি স্যার—আমাকে দু’টাকা দিতে আসছেন! তিরিশ টাকার কমে আমি ছাড়ছি না!

মিস্টার ঘোষালের অফিসারি মেজাজ হঠাৎ টগবগ করে ফুটে উঠলো। যুদ্ধের বাজারে এদের পোয়া বারো। এরাই সবচেয়ে বেশি বেনিফিটা পেলে। পিপকেট, ব্ল্যাক-মেলার, চীট, ব্ল্যাকমার্কেটারদেরই লাভ এই যুদ্ধের ফাকা-বাজিতে। তবু পেছন পেছন আসছিল জগন্নাথ।

—হুজুর আমার কী হবে?

—কী হবে তা আমি কী জানি!

—আপনি জানেন না তো কে জানে? আমাদের চটালে কিন্তু টিকতে পারবেন না কলকাতায়, এই বলে রাখছি—

মিস্টার ঘোষাল হঠাৎ গর্জন করে উঠলো—গেট্ আউট্, গেট্ আউট ফ্রম হিয়ার—

.

সলিসিটর গাঙ্গুলীর সঙ্গে সেই কথাই হচ্ছিল। ব্যারিস্টার দত্তর বাড়িতে বড় ভিড়। ওল্ড বালিগঞ্জের সব চেয়ে বড় ব্যারিস্টার দত্তর বেশি কথা বলবার সময় থাকে না। বললেন—য়্যারেস্ট তো করবেই, এ আটকানো যাবে না, —

—কিন্তু আমি যদি আবার মার্ডার চার্জে য়্যারেস্টেড্ হই তো কেস্ চালাবার অসুবিধে হবে যে মিস্টার দত্ত?

সলিসিটর গাঙ্গুলী জিজ্ঞেস করলেন—স্যার, বেইল্ পাবার কোনও উপায় নেই?

ব্যারিস্টার বললেন—মার্ডার চার্জে বেইল্ পাওয়া অসম্ভব। পুলিস রিপোর্ট বড় খারাপ এ-কেসে, য়্যারেস্ট তো আজ-কালের মধ্যে করবেই, আর বেইও পাওয়া যাবে না—পেপার্স যা কিছু তোমার কাছে থাক্ —

মিস্টার ঘোষাল বললে-মিসেস্ ঘোষের নামটাও উইটনেসের লিস্ট-এর মধ্যে দিয়ে দেবেন মিস্টার গাঙ্গুলী —

—সেই চিঠিটা?

—সেটা তো আপনার কাছেই আছে। ডেটা যেন কারেক্ট হয়। শুধু লক্ষ্য রাখবেন মিসেস ঘোষ যেন ইন-দি মীন-টাইম মত না বদলান্—তিনি বলবেন তো ঠিক যে এটা তাঁরই হাতের লেখা?

—এ-চিঠি প্রোডিউস করবার পরও কি কেস্ আমার ফেবারে যাবে না?

ব্যারিস্টার দত্ত বললেন—পুলিস রিপোর্ট বড় স্ট্রং, স্ট্যান্ডিং কাউন্সিল কী করে বলা যায় না ঠিক। তবে আই শ্যাল ট্রাই মাই বেস্ট —

ব্যারিস্টার দত্তর আরো ক্লায়েন্ট অপেক্ষা করছিল। আর বেশিক্ষণ সময় দিলেন না তিনি। সলিসিটর গাঙ্গুলী উঠলেন। মিস্টার ঘোষালও উঠলো। আর টাইম নেই। সলিসিটর গাঙ্গুলী বললে—ব্যারিস্টার দত্ত যাই বলুন, আমি বলছি এটা ক্লিয়ার কেস্ ফর বেনিফিট্ অব ডাউট্—

—আপনি মিসেস ঘোষের চিঠিটা ভালো করে রেখে দেবেন মিস্টার গাঙ্গুলী। মিসেস ঘোষের প্রেজেন্ট য়্যাড্রেসও ওখানে আছে।

সলিসিটর গাঙ্গুলী হঠাৎ চাইলেন মিস্টার ঘোষালের দিকে। বললেন—মিসেস ঘোষ কি এখন হাজব্যান্ডের কাছে আর থাকে না?

মিস্টার ঘোষাল বললে—ক্যারেক্টার তো বরাবরই লুজ্—লুজ্ মর‍্যালস-এর মেয়েমানুষ, সে তো বুঝতেই পারছেন—আর মিসেস ঘোষের একলারই বা দোষ কী! হোল্ ওয়ার্ল্ডে চ্যাস্টিটি বলে জিনিসই উঠে গেল—

সলিসিটর গাঙ্গুলী বললেন—তা তো বটেই, চ্যাস্টিটি কথঅটা শেষকালে শুধু ডিক্সনারিতেই পাওয়া যাবে—বলে হাসলেন হা হা করে।

—তাহলে আমি যাই, আমি একবার মিসেস ঘোষের সঙ্গে দেখা করে আসি। কথাটা রিমাইন্‌ড্ করে দিয়ে আসা ভাল।

মিস্টার ঘোষাল সলিসিটারকে ছেড়ে আবার গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং-এর দিকে চলতে লাগলো। পৃথিবীটা যেন ডে-বাই-ডে কমপ্লেক্স হয়ে উঠছে। ছোটবেলা থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত বেশ ছিল। সহজে বিলেত চলে গিয়েছিল মিস্টার ঘোষাল। সহজে গ্র্যাজুয়েট বলে সকলকে বিশ্বাস করিয়েছে। সহজে সাউথ-ইন্ডিয়ান বলে চালিয়েছে যখনই দরকার হয়েছে। সহজে চাকরি জুটিয়েছে। গেজেটেড্ চাকরি জুটিয়ে নিয়ে এসেছে হোম্‌বোর্ড থেকে। সহজে কলকাতা শহরের ফ্রী-স্কুল স্ট্রীটে প্রতিপত্তি জমিয়েছে। রামমনোহর দেশাইরা সহজে টাকা জুগিয়ে গেছে। সবই সহজে হয়ে গেছে। কিন্তু হঠাৎ কমপ্লেক্স হয়ে উঠলো সব, ভেরি ভেরি কমপ্লেক্স। কোনও উপায় নেই।

লেভেল-ক্রসিংটা পেরিয়ে লাল-বাড়িটার সামনে দাঁড়াতেই একটু চমকে উঠলো। দরজায় তালা বন্ধ!

একবার এদিক-ওদিক চাইলে। তালাবন্ধ। কোথায় গেল? কলকাতার বাইরে? দিল্লিতে—দিদির কাছে? তাহলে? হোয়াট নেক্সট্?

গাড়ি আবার ঘুরলো। আবার সলিসিটর গাঙ্গুলীর অফিসে যেতে হবে! না দরকার নেই! টেলিফোন করে দিলেই চলবে প্যালেস্-কোর্ট থেকে। ছি ছি, সেইদিনই মিসেস ঘোষকে প্যালেস-কোর্টে এনে তুললে হতো! তাহলে আর কোনও হিচ্ থাকতো না।

অন্ধকার হয়ে এসেছে চারদিক। রাস্তায় আবার লোক-জন বেড়েছে। ক্যালকাটা যেন পোকার সিটি। চারদিকে কেবল কিল্-বিল্ করছে পোকা। একটু ফাঁক পেলেই পোকার ঘর থেকে ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। কেবল পোকা। কলকাতায় আর মানুষ নেই, শুধু পোকা!

প্যালেস-কোর্টের সামনে আসতেই কিন্তু গাড়িটা থমকে থেমে গেল হঠাৎ।

এত পুলিস! এত কনস্টেবল!

মিস্টার ঘোষাল গাড়ি থেকে নামতেই ইনস্পেক্টর সামনে এগিয়ে এল। বললে— আপনার নামে ওয়ারেন্ট আছে মিস্টার ঘোষাল—হিয়ার ইট্‌ ইজ্—

ওয়ারেন্ট! তাড়াতাড়ি চোখ বুলোতেই যেন ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠলো মিস্টার ঘোষাল। মুখ দিয়ে বেরোতে যাচ্ছিল অভ্যস্ত বুলি—গেট্ আউট্, গেট্ আউট্—

কিন্তু সামলে নিলে নিজেকে। মিস্টার ঘোষাল মুখ তুলে বললে—আমাকে য়্যারেস্ট করতে এসেছেন?

—ইয়েস্!

—আর বেইল্?

—আপনি সেখানে গিয়ে বেইলের ব্যবস্থা করতে পারেন।

—তাহলে একবার আমার ফ্ল্যাটে যাই, আমার সার্ভেন্টকে সব ইনস্ট্রাকশন দিয়ে আসি!

ইনস্পেক্টর বললে—আমরাও সঙ্গে থাকবো আপনার,—চলুন—

বাইরে জগন্নাথ আর যতীন তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। দূরে এক কোণে। যতীন একটা সিগ্রেট দিলে জগন্নাথকে। বললে—শালা শুয়োরের বাচ্চা। হয়েছে কি তোমার, তোমার ফাঁসি হবে, তবে খুশী হবো আমরা! আমাদের জক্ দেওয়া—আমরা লোক চরিয়ে খাই, আমাদের চটিয়ে তুমি হাওয়া খেয়ে ফুর্তি বাজি করবে বাবা?

জগন্নাথ আনন্দের চোটে সিগ্রেটে প্রাণপণে টান দিয়ে লম্বা করে ধোঁয়া ছাড়লে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *