1 of 3

কংসমামা

কংসমামা

নিকটজনের বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্বেষ পোষণকারীকে কংসমামা অভিধায় অভিহিত করা হয়। কংস কৃষ্ণের মামা হওয়া সত্ত্বেও কৃষ্ণের প্রবল শত্রু ছিলেন এবং তাকে হত্যার জন্য যতরকম ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন তা নিয়েছেন। এজন্য এ প্রবাদের উৎস কৃষ্ণের মামা কংস। শ্রীকৃষ্ণ হলেন কংসের অরি বা শত্রু। সেজন্য কৃষ্ণের নাম কংসারি। কংসকে পরাজিত করে তিনি কংসজয়ী। আবার কংসকে নিহত করায় তার নাম কংসহা।

কংস হলেন মথুরার ভোজবংশীয় রাজা উগ্রসেনের ক্ষেত্রজ পুত্র। ভোজবংশের পরাক্রান্ত ও চরিত্রবান রাজা আহুক। আহুকের স্ত্রী কাশ্যার গর্ভে দেবক ও উগ্রসেন নামে দুই পুত্র জন্মে। দেবকের চার ছেলে ও সাত মেয়ে। এই সাত মেয়ের সাথেই বিয়ে হয় শ্রীকৃষ্ণের বাবা বসুদেবের বোনদের মধ্যে দেবকী সবার বড়।

উগ্রসেনের স্ত্রী কর্ণী হলেন কংসের মা। কংস কিন্তু উগ্রসেনের ক্ষেত্রজ পুত্র। কংসের জন্মকাহিনী নিম্নরূপ (হরিবংশ) –

একসময় উগ্রসেনের ঋতুস্নাতা স্ত্রীকে দেখে সৌভদেশের রাজা দ্ৰুমিল অত্যন্ত কামাতুর হয়ে পড়েন। উগ্রসেনের ছদ্মবেশে তিনি তার সাথে সঙ্গম করেন। পরে কর্ণীর সন্দেহ হয় বলে ‘কস্যত্বং’ বলে উগ্রসেনরূপী ভ্রমিলকে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করেন। প্রকৃত পরিচয় পেয়ে তিনি ভ্রমিলকে তীব্র তিরস্কার করেন। দ্রুমিল বলেন যে, অনেক মানুষের স্ত্রী ব্যভিচার করেই দেবতার মতো পুত্র উৎপাদন করেছেন। অতএব এতে তেমন কোনো দোষ হয় না।

সৌভপতি দ্ৰুমিল কর্ণীকে আরো বলেন ‘তুমি আমাকে কস্য ত্বং বলে প্রশ্ন করেছিলে। সে কারণে তোমার যে পুত্র হবে সে প্রবল পরাক্রান্ত হবে। তার নাম হবে কংস।’

মগধরাজ জরাসন্ধের দুই কন্যা অস্তি ও প্রাপ্তির সাথে কংসের বিয়ে হয়। শ্বশুর জরাসন্ধের সহায়তায় পিতা উগ্রসেনকে সিংহাসনচ্যুত ও বন্দী করে নিজে মথুরায় রাজা হলেন তিনি। ঐ সময় তার পিতৃব্য দেবকের কন্যা দেবকীর সাথে বসুদেবের বিয়ে হয়। ঐ বিয়েতে উপস্থিত থাকাকালে কংস দৈববাণী শুনতে পান যে, দেবকীর অষ্টম গর্ভজাত পুত্র তাকে বধ করবে। দেবকী ও কংস পরস্পর খুড়তুতো- জ্যাঠতুতো ভাইবোন। সুতরাং কংস হলেন শ্রীকৃষ্ণের মামা।

বসুদেব ও দেবকীকে কারারুদ্ধ করে রাখেন কংস। কারাগারে এদের পর পর যে ছয়টি পুত্র-সন্তান হয়, সবাইকে হত্যা করেন তিনি। সপ্তম সন্তান গর্ভেই বিনষ্ট হয়। ভাদ্রমাসের কৃষ্ণাষ্টমী তিথিতে মাঝরাতে দেবকীর অষ্টম গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন কৃষ্ণ। ঐ রাতে মথুরার অপরদিকে গোকুল গ্রামে নন্দ গোপের স্ত্রী যশোদার গর্ভে জন্ম হয় নীলপদ্মের পাপড়ির মতো কন্যা যোগমায়ার। যোগমায়ার মায়াতে সেই রাতে গোকুলের সবাই ছিল ঘূমে অচেতন।

এদিকে বংশলোপের ভয়ে বসুদেব কংসের কারাগার থেকে সুকৌশলে নবজাত কৃষ্ণকে রেখে আসেন যশোদার কাছে এবং যশোদার কন্যা যোগমায়াকে নিয়ে আসেন কংসের কারাগারে। কংসের কাছে সংবাদ গেল যে, দেবকীর গর্ভে জন্ম হয়েছে এক কন্যার। ভবিষ্যদ্বাণী ছিল যে, দেবকীর পুত্র কংসকে বধ করবে। তবু শত্রুর শেষ রাখতে নেই ভেবে কংস সেই কন্যাকেও হত্যার নির্দেশ দেন। যোগমায়াকে হত্যার জন্য পাথরের ওপর আছাড় মারা হলো। নিক্ষিপ্ত যোগমায়া অষ্টমহাভুজ-বিশিষ্ট সর্ব অস্ত্রসজ্জিত রূপে অদৃশ্য হতে হতে কংসের উদ্দেশে বললেন— ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।’

এরপর বসুদেব ও দেবকী কারামুক্ত হলেন। নন্দ ও যশোদার বাড়িতে তাদের সন্তান হয়ে গোপনে বড় হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। সবাই জানে যে, কৃষ্ণ তাদের সন্তান। এদিকে তাকে খুঁজে হত্যার জন্য কংস চারদিকে অনুচর ও গুপ্তহন্তা পাঠাচ্ছেন। কিন্তু তারা কৃষ্ণের হাতে নিহত হলো একে একে সবাই। কৃষ্ণকে হত্যা করতে ব্যর্থ কংস কৌশলের পর কৌশল অবলম্বন করতে থাকেন।

মথুরায় রাজা কংস ধনুযজ্ঞের আয়োজন করে কৃষ্ণকে কৌশলে আহ্বান করেন মথুরায়। এই যজ্ঞের আগে কৃষ্ণের অজান্তে কংস তার সেনাদলের সেরা মল্লযোদ্ধা চাণূর, মুষ্টিক, কূট, শল ও তোশলকে প্রস্তুত রাখেন কৃষ্ণ ও তার বড় ভাই বলরামকে হত্যা করতে। বলরাম হলেন বসুদেবের আরেক পত্নী রোহিণীর গর্ভজাত সন্তান। কংসের ভয়ে তাদের রাখা হয়েছিল গোকুলে। বলরামের অন্যান্য নাম সঙ্কর্ষণ, হলধর, বলভদ্র ও বলদেব। কৃষ্ণের সাথে নন্দের গৃহে বলরাম প্রতিপালিত হন এবং সান্দীপনি মুনির কাছে একত্রে বেদবিদ্যা, কলাবিদ্যা, ধনুর্বেদ, ধর্মশাস্ত্র, আয়ুর্বেদ, নীতিমার্গ ইত্যাদি বিষয়ে পারদর্শী হন। গদাযুদ্ধে অদ্বিতীয় ছিলেন বলরাম। তিনি কৃষ্ণের সকল কাজের সহায়ক ও লীলাসহচর।

যাহোক, কংসের নির্দেশে মথুয়ার এক বিশাল প্রাঙ্গণের চারদিকে সুন্দর সুন্দর মঞ্চ তৈরি হলো। সুশোভিত করা হলো রাজধানী। দেশ-দেশান্তরে নেমন্তন্ন পাঠালেন কংস। অতিথিরা সমবেত হলেন মথুরায়। কংসদূত অক্রূরের কাছে নেমন্তন্ন পেলেন কৃষ্ণ, বরলাম, নন্দ এবং অনেকে।

যথাকালে মল্লদুন্দুভি বেজে উঠলো। কৃষ্ণ ও বলরাম মল্লযুদ্ধ দেখতে এসেছিলেন। মল্লযুদ্ধে যোদ্ধা হিসেবে তারা লড়বেন এমন কথা ছিল না। তাদের সে প্রস্তুতিও ছিল না। ভাগবতে বলা হয়েছে— সুন্দর বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে বলদৃপ্ত মল্লগণ বিপুল উৎসাহে রঙ্গভূমিতে প্রবেশ করলেন। এই সময় কৃষ্ণ-বলরামও মল্লদুন্দুভি শুনে লড়াই দেখার জন্য সেখানে গেলেন। পথে তাদের হত্যা করার জন্য কংসের আদেশে যে মদমত্ত হাতি রাখা ছিল, তাকে নিহত করে তার দুই বিশাল দাঁত কাঁধে নিয়ে কৃষ্ণ-বলরাম দুইভাই যুদ্ধ দেখতে এলেন। দর্শকদের দৃষ্টি পড়লো তাদের ওপর। ভাগবতের একটি শ্লোকে এর বর্ণনা আছে এভাবে-

মল্লানামশনিনূর্ণাং নরবরঃ স্ত্রীণাং স্মরো মূর্তিমান্
গোপানাং স্বজনহসতাং ক্ষিতিভুজাং শাস্তা স্বপিত্রোঃ শিশুঃ মৃত্যুভোজপতের্বিরাড়বিদুষাং তত্ত্বং পরং যোগিনাং
বৃষ্ণিণাং পরদেবতেতি বিদিতো রঙ্গং গতঃ সাগ্রজঃ।

কৃষ্ণবলরাম দর্শক হয়ে গোকুল থেকে এসেছিলেন মথুরায়। কিন্তু কংসের চক্রান্তে তাদের লড়তে হলো কংসের বিখ্যাত ও প্রবল মল্লযোদ্ধাদের সাথে। প্রস্তুতি ছাড়াই তাদের লড়তে হলো। কারণ তৎকালে কোনো যোদ্ধা বা পালোয়ানকে লড়াইয়ের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে আহ্বান করলে তা প্রত্যাখ্যান করা অগৌরবের কাজ ছিল।

মল্লদুন্দুভি বেজে উঠলো। দর্শকদের মধ্যে উত্তেজনা। অপ্রস্তুত অবস্থাতেই চাণূরের সাথে কৃষ্ণ এবং মুষ্টিকের সাথে বলরাম অবতীর্ণ হলেন মল্লযুদ্ধে। ‘হস্তে হস্তে, পদে পদে, বক্ষে বক্ষে, ঊরুতে ঊরুতে, মস্তকে মস্তকে পরস্পর পরস্পরের ঘাত-প্রতিঘাত আরম্ভ হলো। পরিভ্রমণ, বিক্ষেপ, পরিরম্ভ, অবপাতন, উৎসর্পণ, অপসর্পণ, উত্থাপন, উন্নয়ন চালন, স্থাপন ইত্যাদি বহু কায়দায় মল্লগণের যুদ্ধ চলতে লাগলো। বহুক্ষণ মল্লযুদ্ধের পর চাণূর, মুষ্টিক ইত্যাদি কংসের প্রধান মল্লগণ কৃষ্ণবলরামের হস্তে নিধনপ্রাপ্ত হলো।

ঘটনার প্রেক্ষিতে কংস যেন দিশেহারা হয়ে গেলেন। ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি কৃষ্ণ ও বলরামকে নির্বাসিত করার আদেশ দিলেন। নন্দকে বন্দী করতে এবং উগ্রসেন ও বসুদেবকে হত্যা করার নির্দেশ দিলেন। এই আদেশ শোনার সাথে সাথে কৃষ্ণ অন্যায়কারী কংসকে আক্রমণ করেন এবং সিংহাসন থেকে ফেলে দেন। কংসের আটভাই বাধা দিতে এসে বলরামের হাতে নিহত হন। অতঃপর বন্দী উগ্রসেনকে উদ্ধার করে মথুরার সিংহাসনে বসান শ্ৰীকৃষ্ণ।

উগ্রসেনের ভাই দেবক হলেন শ্রীকৃষ্ণের মা দেবকীর বাবা। উগ্রসেনের ক্ষেত্রজ সন্তান কংস। কংস সে হিসেবে শ্রীকৃষ্ণের মামা। মামা হয়ে ক্ষমতা ও দম্ভে ভাগিনাকে বিনাশ করার জন্য কংস যথাশক্তি নিয়োগ করেছেন : ছলচাতুরী, ষড়যন্ত্র, প্রতিহিংসা ও ক্ষমতালোভের বশবর্তী হয়ে তিনি যা করেছেন তা একজন নিকটাত্মীয় কখনোই করতে পারে না। এ কারণে কোনো আত্মীয়ের মধ্যে কংসের মতো গুণ লক্ষ করলে ব্যঙ্গার্থে তাকে কংসমামা বলা হয়ে থাকে।

এই কাহিনী থেকেই অর্থাৎ কংসের প্রতি যোগমায়ার ইঙ্গিত থেকে একটি প্রবাদ বাক্য বা প্রবচন এসেছে। তা হলো—

তোমারে বধিবে বে
গোকুলে বাড়িছে সে।

কারো অত্যাচার, অনাচার ও যন্ত্রণা অসহনীয় হয়ে উঠলে দুর্বলতর মানুষ ভবিষ্যতের জন্য নিয়তির হাতে তার শাস্তির ভার রেখে দেয় এমন কথা বলে। দুষ্টের দমন একদিন হবেই— এমন আশা থেকে প্রবচনটি এসেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *