এ পরবাসে – মনোজ সেন

এ পরবাসে

শ্রীমন্ত বোস একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘দ্যাখো নৃপেন, রোববার সকালবেলাটা আমায় ছেড়ে দাও। শনিবার সন্ধেবেলা চলো, নয়তো রোববার বিকেলে।’

নৃপেন রায় ফিলোজফির প্রফেসর, একটা দার্শনিক-দার্শনিক ভাব আছে। আস্তে আস্তে বললেন কেন? রোববার সকালবেলা কী এমন রাজকার্যে ব্যস্ত থাকবেন মশায় যে, আমাদের সঙ্গে রজতের বাড়ি যেতে পারবেন না। এত বছর বাদে লোকটার বাচ্চা হল, আমাদের কি একবার তাকে দেখতে যাওয়া উচিত নয়? সেই অন্নপ্রাশনে নেমন্তন্ন হবে, আর তখনই প্রথম রজতের বাচ্চার মুখদর্শন করবেন?

শ্রীমন্ত হাত নেড়ে বললেন, ‘না, না, তা কেন? যাব না তো বলিনি। কেবল রোববার সকালবেলাটা আমায় টেনো না।’

নৃপেন দুটো শিঙাড়া অর্ডার দিয়ে বললেন, ‘কেন? রোববার সকালটাই তো প্রশস্ত সময়। গিন্নিরা কাপড়-টাপড় কাচা নিয়ে পড়বেন, ঘরদোর পরিষ্কার করবেন, আমরা সেই সময় টুক করে ঘুরে আসব। আর আপনার তো সে ঝঞ্ঝাটও নেই। ব্যাচেলার মানুষ, করেন সরকারি চাকরি, রোববার আপনার চেয়ে বেশি ফ্রি আর ক-জন আছে এ শহরে?’

শ্রীমন্ত একটু ইতস্তত করে বললেন, না মানে, একটা ইয়ে আছে—’

শ্রীমন্তর ‘ইয়ে আছে’ শুনে কল্পনা রেস্টুরেন্টের সকলের কান খাড়া। দু-কান কাটা চ্যাংড়া দেবকুমার নিয়োগী চোখ কপালে তুলে বলল, ‘শ্রীমন্তদা আপনি প্রেম করছেন? এই বয়েসে?’

শুনে রেস্টুরেন্টসুদ্ধু লোক হাঁ-হাঁ করে উঠল, ‘কেন, শ্রীমন্তদার এমনকী বয়েস হয়েছে? এই বয়েসে কত লোক বিয়ে করছে, আর শ্রীমঙ্গ ইয়ে করতে পারেন না?’ দু-একজন তো বলেই ফেলল যে তাদের একটা গোপন বিশ্বাস ছিলই যে, শ্রীমন্ত বোস একটি বর্ণচোরা আম।

হইচই-এর মধ্যে শ্রীমন্ত হাত নেড়ে বললেন, ‘ওরে, নারে বাবা, প্রেম-ফ্রেম নয়। প্রেম যদি করিই তো লুকিয়ে করব না, তোমাদের সকলকে জানিয়েই করব।’

নৃপেন বললেন, ‘তাহলে আপনার রোববার সকালের ইয়েটা কী? আমরা লক্ষ করেছি যে গত কয়েক হপ্তা হল আপনি আমাদের দুপুরের আড্ডায় বারোটার আগে আসতে পারছেন না। ব্যাপারটা কী? আমরা এর একটা উপযুক্ত ব্যাখ্যা চাই।’

দেবকুমার বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, উইথ রেফারেন্স টু দি কনটেক্সট।’

শ্রীমন্ত চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘চুপ কর! তোর কনটেক্সটের নিকুচি করেছে। আমি রোববার সকালে টেলিভিশনে ইউফো এক্সপেরিয়েন্সটা না-দেখে কোথাও বেরোতে পারব না, এই বলে দিলুম। টেলিভিশনে ওই একটা প্রোগ্রামই দেখি, আমার ভীষণ ভালো লাগে ওটা।’

শুনে রেস্টুরেন্টসুদ্ধু লোক সশব্দে হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নৃপেন বিমর্ষ হয়ে বললেন, ‘এর চেয়ে যে প্রেম ছিল ভালো। ইউফো? ওটা একটা দেখবার জিনিস হল? যত যব আষাঢ়ে গপ্পো! বাইরের জগৎ থেকে গোল গোল চ্যাপটা চ্যাপটা রকেটে চড়ে ভূতুড়ে চেহারার লোকজন পৃথিবীতে আসছে। —এটা একটা দেখবার জিনিস হল?’

শ্রীমন্ত বললেন, ‘দ্যাখো নৃপেন, দর্শন পড়াও অথচ তার বাইরে যে একটা জগৎ আছে তার খোঁজই রাখো না। কাজেই পৃথিবীর বাইরে যে কোনো জগৎ থাকতে পারে সে সম্ভাবনাটা তোমার কাছে আষাঢ়ে বলে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।’

‘দেখুন শ্রীমন্তদা, আপনার ধারণা একদম ভুল। আমি দর্শনও পড়াই, দুনিয়ার সব খবরও রাখি। কিন্তু তা যদি না-ও রাখতুম, তাহলেও পৃথিবীর বাইরে অন্য জগতে মানুষের চেয়ে অনেক বেশি বিদ্বান বুদ্ধিমান জীবেরা সব রয়েছেন— এটা বিশ্বাস করতুম না। এসব বিশ্বাস আসলে কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষ চিরকালই ভাবতে ভালোবেসেছে যে, ওই দূর আকাশের ওপারে তাদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী, অনেক বেশি সুদর্শন, অনেক বেশি বুদ্ধিমান কে বা কারা আছেন। তাঁরা একদিন ধরার ধুলোয় অবতীর্ণ হবেন এবং মানুষের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন। এই বিশ্বাস থেকেই স্বর্গ আর দেবতাদের সৃষ্টি। পরে যখন টেলিস্কোপ এসে দেখাল যে স্বর্গ-টর্গ থাকার সম্ভাবনা নিতান্তই অসম্ভব, তখন শুরু হল এইসব ইউফোর কল্পনা। দেবতাদের রথ আর ইউফোর উদ্ভব মানুষের অবচেতনের একই স্তর থেকে।’

শ্রীমন্ত অবিচলিত মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘বাঃ, বাঃ, দিব্যি লেকচার হয়েছে। কিন্তু দ্যাখো নৃপেন, তোমার লোকচারটা নিতান্তই তোমার দর্শনের ছাত্র-ছাত্রীদের উপযুক্ত হয়েছে, সকলের জন্যে নয়। তুমি বোধ হয় জানো না যে, সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র পৃথিবীতেই প্রাণ আছে— এই বস্তাপচা ধারণাটা এখন সমস্ত বৈজ্ঞানিকেরাই একবাক্যে খারিজ করে দিয়েছেন, যেমন খারিজ হয়ে গিয়েছে পৃথিবীই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্র আর মানুষই ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি— এই ধারণাটা।’

‘খারিজ তো করেছি আমরাই, তাই না? যদিও আমরা জানি, এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর বাইরে আর কোথাও প্রাণের জন্যে যা নিতান্ত প্রয়োজন, সেই অক্সিজেনই আবিষ্কৃত হয়নি। সৌরমণ্ডলে তো নয়ই, তার বাইরেও নয়। এমনকী জ্বলও নয়।’

কল্পনা রেস্টুরেন্টের পুরোনো খরিদ্দার ইঞ্জিনিয়ার বিপ্লব সিং সাধারণত কথা কম বলেন। আড্ডায় যোগ দেন বেশিরভাগ সময়েই শ্রোতা হিসেবে। দেখা গেল এ ব্যাপারে তার কিছু বলবার আছে। শ্রীমন্তকে বাধা দিয়েই বললেন, ‘নৃপেনদা, আপনার ধারণাটা কিন্তু ঠিক নয়। প্রথমত, প্রাণের জন্য অক্সিজেন অপরিহার্য নয়। পৃথিবীতেই নানা প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া এবং উদ্ভিদ আছে যাদের কাছে অক্সিজেন শুধু অপ্রয়োজনীয়ই তাই নয়, বিষ। দ্বিতীয়ত, পৃথিবীতে যে অবস্থায় প্রাণের উদ্ভব হয়েছিল বলে বৈজ্ঞানিকেরা মনে করেন, তখন কিন্তু বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ ছিল অত্যন্ত কম, বরং এমন সব গ্যাস প্রচুর পরিমাণে ছিল যাদের আমরা আজকে বিষাক্ত বলেই জানি। বরং আমি বলব, প্রাণের জন্যে যা অপরিহার্য তা হল হাইড্রোকার্বন অণু, অ্যামাইনো অ্যাসিড এবং জলীয় বাষ্প। এদের সন্ধান কিন্তু মহাশূন্যে পাওয়া গেছে। এমনকী, মহাজাগতিক গ্যাস আর ধুলোর মেঘ, যাকে এতদিন আমরা সম্পূর্ণ নীরস বলে জানতুম, তাদের মধ্যেও এদের সন্ধান পাওয়া গেছে। অতএব পৃথিবীর বাইরে অন্য কোথাও প্রাণের উদ্ভব তো অসম্ভব নয়ই, বরং না-হওয়াই আশ্চর্য।’

শ্রীমন্ত সপ্রশংস দৃষ্টিতে বিপ্লবের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছিলেন। বলে উঠলেন, ‘ঠিক ঠিক। আর যেখানে আমরা, অর্থাৎ মানুষ মাত্র দশ হাজার বছরে বর্বর যাযাবর জীবন থেকে চাঁদে গিয়ে নামার উপযুক্ত হয়েছি, সেখানে হাজার কোটি বছর বয়সের ব্রহ্মাণ্ডে কোনো প্রাণী অতিরিক্ত রকমের বুদ্ধিমান হয়ে পড়বে এতে তোমার আপত্তি করার কী কারণ থাকতে পারে হে, নৃপেন? অবিশ্যি, তুমি যদি মনে করো যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মানুষের আবির্ভাবই প্রথম বুদ্ধিমান জীবের উদ্ভব, তবে আলাদা কথা। তবে, তা মনে করার বিশেষ কোনো কারণ আছে কি?’

নৃপেন বললেন, ‘আছে। আপনারা যেসব অবস্থার কথা বললেন, তাতে প্রথম এককোষী প্রাণীর হয়তো উদ্ভব হতে পারে, বুদ্ধিমান কীর্তিমান কোনো জীবের নয়। অক্সিজেনহীন জগতে হয়তো ব্যাকটেরিয়া বা উদ্ভিদ বাঁচতে পারে কিন্তু তারা ইউফো চড়ে ঘুরে বেড়ায় না। বেড়াতে পারে না।’

বিপ্লব বললেন, ‘আপনার এ ধারণাটাও ভুল। আমাদের পার্থিব অবস্থাটাই কেবলমাত্র বুদ্ধিমান জীবসৃষ্টির পক্ষে আদর্শ— একথা ধ্রুবসত্য বলে মেনে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন প্রভৃতি পদার্থগুলো মিলে যে জীবসৃষ্টি এই পৃথিবীতে হয়েছে, সেরকম যোগাযোগ না হয়েও অন্য কোনোরকম যোগাযোগেও তা হতে পারে। একটা সামান্য উদাহরণ দিচ্ছি। কার্বন আমাদের শরীর ও প্রাণের একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিস। হাইড্রোজেনের সঙ্গে মিলে সে নানারকম খেলা দেখাচ্ছে। কিন্তু আরও কতগুলো পদার্থ আছে, যেমন সিলিকন বা অ্যামোনিয়া অণু যারা কার্বনের মতোই হাইড্রোজেনের সঙ্গে এক মিলিত হতে পারে এবং এরা যদি এই মহাজগতের কোথাও কোনো প্রাণ বা জীবসৃষ্টি করে থাকে, যা মোটেই অসম্ভব নয়, তাহলে সেই জীব এতই অদ্ভুত, এতই বিচিত্র হবে যে আমাদের পক্ষে তা কল্পনা করাই অসম্ভব।’

নৃপেন এতক্ষণে কিঞ্চিৎ উষ্ণ হয়ে উঠেছেন। বললেন, ‘অসম্ভব তো হবেই। এসব উদ্ভট কল্পনা তুমি ইঞ্জিনিয়ার হয়েও যে কী করে তোমার মাথার মধ্যে স্থান দিচ্ছ, সেটাই বোঝা আমার পক্ষে অসম্ভব হচ্ছে। আচ্ছা বেশ, মেনে নিলুম পৃথিবীর বাইরেও প্রাণ আছে, বুদ্ধিমান প্রাণী আছে, তারা মাঝে মধ্যে চ্যাপটা গোলমতো মহাকাশযানে চড়ে পৃথিবীতে আসে। কেন আসে? হাওয়া খেতে বা পৃথিবী সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে। বেশ, তাও মেনে নিলুম। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, বলুন তো, এই আসা-যাওয়ায় জ্বালানির খরচা হয় কি, হয় না? যতই বুদ্ধিমান জীব হোক, যতই টেকনিক্যালি উন্নত হোক, জ্বালানি খরচা না-করে এই মহাশূন্যে পাড়ি দেওয়া সম্ভব?’

বিপ্লব মৃদু হাসলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, জ্বালানি খরচা হওয়াই সম্ভব।’

শ্রীমন্ত বললেন, ‘কেন, অ্যান্টি গ্র্যাভিটি ডিভাইস?’

বিপ্লব মাথা নেড়ে বললেন, ‘অ্যান্টি গ্র্যাভিটি তৈরি করতেও জ্বালানি খরচা হবে, মানে আমাদের জ্ঞানবুদ্ধি আজ পর্যন্ত তাই বলে।’

নৃপেন বেশ একটা গ্রাম্ভারি হাসি হেসে বললেন, ‘বেশ, তাহলে বলোতো ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, একগঙ্গা জ্বালানি খরচা করে এই বিশাল মহাশূন্যের কোটি কোটি মাইল পেরিয়ে এসে কোনো বুদ্ধিমান জীব পৃথিবীর আকাশে স্রেফ কয়েকটা ডিগবাজি খেয়ে ফিরে যাবে? কোনো বুদ্ধিমান লোক এতটা বাজে খরচা সহ্য করে? তার চেয়ে অনেক স্বাভাবিক হত না কি পৃথিবীতে নেমে এসে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা? যারা আমাদের থেকে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে হাজার বছর এগিয়ে আছে, তারা নিশ্চয়ই আমাদের কাছ থেকে কোনো বিপদ আশঙ্কা করে না, তাই না?’

শ্রীমন্ত আর বিপ্লব দু-জনেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর শ্রীমন্ত বললেন, ‘দর্শনে কি পড়াও হে তুমি? তর্কশাস্ত্র নাকি?’

নৃপেন কিন্তু তার কোনো জবাব দিলেন না। বরং নিজের প্রশ্নের উত্তরের প্রত্যাশায় বিপ্লবের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

বিপ্লব মৃদু হেসে বললেন, ‘আপনি কি নিশ্চিত যে যোগাযোগ হয়নি? নিউ ইয়র্ক, টোকিও, লন্ডন বা কলকাতার মতো পৃথিবীর বড়ো বড়ো শহরের রাস্তায় যে লক্ষ লক্ষ লোক ঘুরে বেড়ায় তারা যে সবাই পৃথিবীর অধিবাসী—এ ব্যাপারে কি আপনি একেবারে নিঃসন্দেহ?’

নৃপেন আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘কী বলছ হে তুমি? কী বলতে চাও?’

‘আমি বলতে চাই যে যোগাযোগ হয়তো হয়েছে। হয়তো কেন, আমার বিশ্বাস নিশ্চয়ই হয়েছে এবং আজ থেকে নয়, বহুদিন থেকেই আমাদের পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।’

নৃপেন বললেন, ‘অ, তার মানে তুমি মনে করো যে পৃথিবীর বাইরের সভ্যতার লোকেরা পৃথিবীতে এসে কেবল বিলেত আমেরিকাতেই যোগাযোগ স্থাপন করেছে? সাহেবদের প্রতি তাদেরও বেশ পক্ষপাতিত্ব আছে, বলো? নাকি তারাও সাহেব?’

বিপ্লব এবার বেশ জোরেই হেসে উঠলেন। বললেন, ‘আপনি কেন একথা বলছেন, তা আমি বুঝতে পারছি। একথা ঠিকই যে ইউফো দেখার রিপোর্ট সবচেয়ে বেশি এসেছে বিলেত আমেরিকা থেকেই, কিন্তু তার মানে এই নয় যে অন্যান্য জায়গায় তাদের দেখা যায়নি। তবে তার যে রিপোর্ট পাওয়া যায়নি, তার কারণ আছে। এটা দেখা গেছে যে, যেখান থেকেই এ রিপোর্ট আসুক না-কেন, তা প্রায় সবক্ষেত্রেই এসেছে শহরের বাইরে নির্জন জায়গা থেকে। এখন বিলেত আমেরিকায় এসব নির্জন জায়গায় যারা থাকে, তারা ইউফো দেখলে বুঝতে পারে যে সেটা কোনো নতুন ধরনের প্লেন নয়, একটা অপার্থিব জিনিস। কিন্তু দ্বারভাঙা বা মেদিনীপুর, বালি দ্বীপ বা মাদাগাস্কার— এসব জায়গার নির্জনে যেসব অল্প শিক্ষিত চাষি বা মজুর ইউফো দেখে, তাদের কাছে সেসব কোনো একটা অদ্ভুত ব্যাপারই নয়। তারা ভাবে সাহেবদের তৈরি কোনো নতুন কল। তাদের হাতে এরোপ্লেনও যা ইউফোও তাই। কাজেই তা নিয়ে হইচই করা বা মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজনই তারা দেখে না।’

নৃপেন মাথা নেড়ে বললেন, ‘অদ্ভুত তোমার যুক্তি।’

‘না, অদ্ভুত নয়। আমি একটা উদাহরণ দিতে পারি। কিছুদিন আগে কলকাতার কাছে একটা গ্রামের ওপর দিয়ে বেলা এগারোটার সময় একটা অদ্ভুত আকৃতির উড়ন্ত যান প্রচণ্ডবেগে উড়ে চলে যায়। তার আকৃতিটা অদ্ভুত, কারণ তার কোনো ডানা ছিল না। বেশ নীচ দিয়ে উড়ে গেলেও কোনো শব্দ পাওয়া যায়নি। আর উড়ে যাওয়ার সময় গ্রামের স্কুলবাড়িটার সমস্ত করোগেটেড শিট উড়ে যায় এবং সেইসময় স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মাস্টারমশায়ের হাতঘড়িটা বন্ধ হয়ে যায়। এ ঘটনায় গ্রামবাসীরা বিরক্ত হয়েছিলেন, অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন, কিন্তু কোনোরকম হইচই করার কথা চিন্তাও করেননি। কেবল মাস্টারমশাই, যিনি কেবল শিক্ষিতই নন, নানারকম জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপারে আগ্রহী, তিনিই একমাত্র ব্যাপারটার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেয়েছিলেন। তিনিই গিয়ে থানায় রিপোর্ট করেন এবং সেখান থেকেই অবশেষে কলকাতার কাগজে সংবাদটি প্রকাশিত হয়।’

শ্রীমন্ত পুলকিত মুখে বললেন, ‘তার মানে, তুমি বলতে চাও যে আমাদের মধ্যেই পৃথিবীর বাইরের সভ্যজগতের লোকেরা আছে?’

‘আছেই তা তো জোর করে বলতে পারি না, তবে থাকতে পারে।’

‘আচ্ছা ধরো আমাদের মধ্যেই যদি কেউ থাকে তাহলে সে কে হতে পারে? নৃপেন – ‘

নৃপেন ধড়ফড় করে হাত-পা ছুড়ে বললেন, ‘আমি… মানে…আমাকে–’

বিপ্লব হাত নেড়ে বললেন, ‘না, না, নৃপেনদা হবেন কেন? নৃপেনদা আর ঈশানী বউদিকে তো আমরা অনেকেই অনেকদিন ধরে চিনি। কিন্তু ধরুন, আমাকে কেউ চেনেন কি?’

বিপ্লবের প্রশ্ন শুনে সমস্ত কল্পনা রেস্টুরেন্ট চুপ।

শ্বীমন্ত কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, ‘আর একটু খোলসা করে বলো।’

‘আমি বলছিলুম, আমার সম্বন্ধে আপনারা কি কেউ কিছু জানেন? শুধু এইটুকু জানেন যে আমার নাম বিপ্লব সিংহ, আমি একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, বি কে প্রজেক্টস বলে একটা কোম্পানিতে চাকরি করি, আর হালদারবাগান স্ট্রিটে একটা দোতলা বাড়ির একতলায় দুটো ঘরভাড়া নিয়ে একা থাকি। আর কিছু? আমি কোত্থেকে এসেছি, আমার বাবা-মা কোথায়, আমার আত্মীয়স্বজন কারা, আমি কোথায় পড়াশুনো করেছি, কোথায় বড়ো হয়েছি— এসব কিছু জানেন? জানেন না, কারণ জানা সম্ভব নয়।’

দেবকুমার যেন একটু ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞেস করল, ‘তার মানে?’

‘তার মানে, আমার অতীত বলে কিছু নেই। যেটা আছে, মানে যেটা আছে বলে আমি বলে থাকি, সেটা আপনাদের কারোর পক্ষেই পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব নয়। ধরুন, আমি বলে থাকি যে আমি পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু, মানে ঠিক আমি নই, আমার বাবা-মা আমার আত্মীয়স্বজন সকলেই নিহত হয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে শিয়ালদা স্টেশনে আমার জন্ম। আমার জন্মের সঙ্গেসঙ্গেই আমার মা মারা যান। সাত বছর বয়েস পর্যন্ত আমি আমার বাবার সঙ্গে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে বেরিয়েছি। তারপর আমার বাবা মারা যান। তখন আমাকে আশ্রয় দেন নাগেশ্বর সিং বলে একজন আধপাগলা বিহারি ভদ্রলোক। তিনিই আমাকে স্কুলে ভরতি করে দেন। তারপর তিনিও মারা যান। তারপর থেকে এ আশ্রয় থেকে সে আশ্রয়। কিন্তু একটা ঈশ্বর দত্ত মেধা ছিল আর ছিল পড়াশুনো করার উদগ্র ইচ্ছে। কাজেই নানা বাধা-বিপত্তির মধ্যেও লেখাপড়ার পাট শেষ করে উঠতে পেরেছি। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট ছিল বলে মামা-কাকার সুপারিশ ছাড়াই চাকরি পেয়েছি। এখন এই অতীত কি সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে এসট্যাবলিশ করা যায়? কাজেই আমাকে অতীতহীন বলতে পারেন।

এখন, আমার মতো এরকম লোক কলকাতাতেই অনেক আছে, পৃথিবীর অন্যান্য বিশাল বিশাল শহরগুলোতে তো কথাই নেই। তার ওপর আবার অনেক লোক মাঝে মাঝে চিরকালের জন্য অদৃশ্য হয়ে যান। তাদের অনেকেরই শেষপর্যন্ত স্থান হয় বেওয়ারিশ মড়া হিসেবে কোনো মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমি ক্লাসের টেবিলে, কিন্তু সকলেরই যে তা হয়, তা কি জোর করে বলা চলে? আত্মীয়স্বজন থাকলে একটা হইচই হয় কিছুদিনের জন্যে, কিন্তু যাদের সেসব বালাই নেই, তাদের অপসারণটা নিঃশব্দেই হয়। যেমন ধরুন, আমি যদি কাল থেকে হারিয়ে যাই, তাহলে কী হবে? আপনারা কয়েক দিন হয়তো একটু চিন্তা করবেন, বাড়িওলা পুলিশে খবর দেবে, তারপর একদিন সবাই ভুলে যাবে।’

দেবকুমার রুদ্ধনিশ্বাসে বলল, ‘আর তখন হয়ত আপনি অল্পেসা বা মঘা নক্ষত্রের গভর্নমেন্টের কাছে পৃথিবী ও তার প্রাণীস সম্পর্কে ফাইনাল রিপোর্ট পেশ করছেন আর তারা আপনাকে অশ্লেষাশ্রী তিসরা বর্গ দেবে কি না সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছেন।’

বিপ্লব, ‘ঠিক বলেছ’ বলে হো-হো করে হেসে উঠলেন বটে, কিন্তু আর কেউই হাসল না।

শ্রীমন্ত গম্ভীর গলায় বললেন, ‘সব তাতে তোর চ্যাংড়ামো করা ভালো লাগে না, দেবকুমার।’

নৃপেন সায় দিলেন। বললেন, ‘যা বলেছেন শ্রীমন্তদা। দেবকুমারকে কাল থেকে এখানে ঢুকতে দেওয়াই উচিত নয়।’ তারপর অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘দুর! মনটা খারাপ করে দিলে হে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। এই সন্ধের আড্ডাটাই মাটি করে দিলে। যাই, বাড়ি যাই। বলে উঠে দাঁড়ালেন। রওনা হতে গিয়েও ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘জানো বিপ্লব, দুঃখ-কষ্ট তুমি অনেক পেয়েছ। তবে এই অভিজ্ঞতাই যে তোমাকে জীবনের সব বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে এক অতিউজ্জ্বল ভবিষ্যতে নিয়ে যাবে, সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই।’

দেবকুমার বলল, ‘আমিও তো সেকথাই বলছিলুম, তবে রাগ করলেন কেন? অশ্লেষাশ্রী হওয়া কি চাট্টিখানি কথা? তবে হ্যাঁ, আপনি যখন অতিউজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা বললেন, তখন হয়তো বিপ্লবদার কপালে মঘারত্নটাই নাচছে। কি বলেন?’

আর বলেন! নৃপেন রেগেমেগে গটমট করে বেরিয়ে গেলেন।

ঈশানী বললেন, ‘অতটা রাগ দেখানোর কোনো কারণ ছিল না।’

নৃপেন জুতো খুলতে খুলতে বললেন, ‘তা ছিল না। কিন্তু শ্বীমন্ত বোস হঠাৎ এমন চমকে দিয়েছিল যে–’

ঈশানী হাসলেন। বললেন, ‘বুঝতে পারছি। তবে আমার মনে হচ্ছে, আমাদের এবার বেরোবার সময় হয়ে এসেছে।’

নৃপেন চমকে মুখ তুলে তাকালেন। বললেন, ‘কেন?’

‘ঠিকে ঝি পারুল আমার আলমারি খুলে গয়না চুরি করতে গিয়ে আমাদের কয়েকটা হাত-পা দেখে ফেলেছে।’

‘যাঃ চলে! কিছু বুঝতে পেরেছে?’

‘তা হয়তো পারেনি, কিন্তু মারাত্মক কিছু সন্দেহ করেছে। ব্যাপারটা পল্লবিত হবার আগে বা পুলিশের কাছে যাবার আগেই আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে।’

‘হ্যাঁ, তাই হবে বটে।’

‘এবার কোথায় যাবে?’

‘এবার? দেখি। হয় আফ্রিকার বায়াফ্রা, নয়তো দক্ষিণ আমেরিকার কোনো রাষ্ট্রে। এসব জায়গায় প্রচুর ছিন্নমূল মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের মধ্যে মিশে যাওয়া যাবে। উঃ, আর পারি না! কবে যে ছুটি পাব!’

তুমি তো এখানকার হিসাবে মোটে আট বছর আছ। তোমার আগে যিনি ছিলেন তাঁকে প্রায় তিরিশ বছর থাকতে হয়েছিল, জানো?’

‘জানি, জানি। যাও, মড়াদুটো বের করে তাদের বয়েস বাড়িয়ে –

হাত-পা লাগাও। আমি ততক্ষণ ওপরে যোগাযোগ করে জেনে নিচ্ছি, এরপর কোথায় যেতে হবে।’ বলে নৃপেন মৃদু হাসলেন। বললেন, ‘কালকের কাগজে জোর খবর – অধ্যাপক দম্পতির আত্মহত্যা।’ বলে পাশের ঘরে যেতে যেতে গায়ের জামাটা খুলে মুখের ওপরের চামড়াটা খুলে ফেললেন। তাতে তলায় যা ছিল, তার সঙ্গে আমরা যে একেবারে অপরিচিত তা নয়। মাছির মাথার সঙ্গে তার অদ্ভুত সাদৃশ্য, অবশ্যই কয়েক হাজার গুণ বাড়ানো। তফাতের ভেতর কেবল দুটো শুঁড়ের জায়গায় চারটে শুঁড়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *