এস্তাদিও ন্যশিওনাল

এস্তাদিও ন্যশিওনাল

দুঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষার পর এস্তাদিও ন্যশিওনাল স্টেডিয়ামের টিকিট কাউন্টারে যখন পৌঁছলাম তখন কাউন্টারের ভিতরে বসা সুবেশী পেরুভিয়ান তরুণী আমাকে দেখে বলল, ‘মাপ করবেন, সোনোরাস৷ শেষ টিকিটটা আপনার আগের ভদ্রলোককে দিয়ে দেওয়া হল৷ স্টেডিয়ামে আর একটা আসনও খালি নেই৷’

টিকিট কাউন্টার বন্ধ হয়ে গেল৷ একটা হাহাকারের শব্দ উঠল আমার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর বুক থেকে, টিকিট শেষ! আর তারপরই লাইনটা ভেঙে গেল৷ আমারই মতো টিকিট প্রত্যাশী নানা বয়সি মানুষগুলো যারা এতক্ষণ রোদে পুড়ে একবুক আশা নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল তারা চার দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল৷ আগেই শুনেছিলাম টিকিটের বেশ চাহিদা৷ কিন্তু ভেবেছিলাম হয়তো পেয়ে যাব৷ আমিও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাউন্টারের সামনে থেকে সরে একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম৷ আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নীল রঙের বিশাল স্টেডিয়ামের বহিঃদেশ৷ স্টেডিয়ামের প্রবেশ তোরণগুলো প্রাচীন ইনকা স্থাপত্যের অনুকরণে ট্রাপিজিয়ামের আদলে তৈরি৷ তার মাথায় উড়ছে লাল সাদা পেরুর ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ৷ ‘এস্তাদিও ন্যশিওনাল স্টেডিয়াম’৷ চলতি কথায় বলা হয়, ‘লিমা ন্যাশনাল স্টেডিয়াম৷’ আগামী কাল এই স্টেডিয়ামেই হবে ‘ন্যশিওনাল প্রিমেরা’ অর্থাৎ ন্যাশনাল প্রিমিয়ার ডিভিশন লিগ ফুটবলের ফাইনাল ম্যাচ৷ রাজধানী লিমা তেতে আছে এ জন্য৷ সর্বত্র খালি ফুটবলের আলোচনা৷ ফাইনাল ম্যাচ হচ্ছে ‘স্পোর্টিং ক্রিস্টাল’ আর ‘সান মার্টিনের’ মধ্যে৷ এ দুটো ক্লাবকে বলা যেতে পারে জনপ্রিয়তার নিরিখে আমাদের কলকাতার ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের মতো৷ তবে গুণগত মানে যে তারা ভারতীয় ফুটবলের চেয়ে এগিয়ে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না৷ মোট ষোলোটা ফার্স্ট ডিভিশন ক্লাব আছে পেরুতে৷ ‘লিঁও-ডি-হুয়ানকো’, ‘আলিয়ানজা লিমা’, ‘সিজার ভ্যালেজো’, ‘স্পোর্টস বয়েজ’-এরাও সব বিখ্যাত ক্লাব৷ কিন্তু এদের সবাইকে পিছনে ফেলে চ্যাম্পিয়ানশিপে মুখোমুখি স্পোর্টিং ক্রিস্টাল-সান মার্টিন৷ উত্তেজনার জ্বরে কাঁপছে লিমা৷ আর তার ছোঁয়াচ লেগেছে আমারও৷

ছোঁয়াচ তো লাগারই কথা৷ আমি অঞ্জন সেন নিখাদ কলকাতার ‘ফুটবলপ্রেমী’ বাঙালি৷ কপালগুণে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করি৷ কিশোর বয়স থেকেই ফুটবল মাঠে যাওয়া আমার নেশা৷ মোহনবাগান মাঠে সে সময় একবার মাউন্টেড পুলিশের ঘোড়ার লাথিতে হাঁটুতে সেলাই পড়েছিল৷ সে দাগ আমার এখনও আছে— আমার ফুটবল প্রেমের অকাট্য প্রমাণ৷ কেউ দেখতে চাইলে আত্মশ্লাঘার সাথে তা দেখাই৷ এখন হয়তো অফিসের চাপে সব সময় মাঠে যাওয়া হয় না, কিন্তু টিভিতে খেলা দেখি৷ রাত জেগে দেখি ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ানশিপ, কোপা আমেরিকার ম্যাচ৷ হকার নিয়মমাফিক মাসে দুবার খেলার পত্রিকা পৌঁছে দেয় বাড়িতে৷

কোম্পানিরই কাজে সাতদিনের জন্য এসেছিলাম পেরুর রাজধানী লিমাতে৷ পাঁচ দিন কাটতে চলেছে৷ কোম্পানির কাজ মিটে গেছে৷ পরশু ফেরার প্লেন ধরব৷ লিমাতে যে দিন পা রেখেছিলাম সেদিনই এয়ারপোর্টের বাইরে বিশাল হোর্ডিং-এ দেখেছিলাম আগামী কালের ‘ন্যশিওয়ানা প্রিমেরা’ ফাইনাল ম্যাচের খবরটা৷ সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করেছিলাম ম্যাচটা দেখব৷ ল্যাটিন অমেরিকার ছন্দবদ্ধ ফুটবল শিল্প বাঙালি মাত্রেরই প্রিয়৷ ফি বিশ্বকাপে আমরা পাড়ায় পাড়ায় ভাগ হয়ে যাই ব্রাজিল-আর্জেন্টনা শিবিরে৷ পেরু হয়তো ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নয় ঠিকই, কিন্তু লাটিন আমেরিকার ফুটবল ঘরানার সৌন্দর্য এদেরও আছে৷ তারপর ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপের মূলপর্বে খেলেছে পেরু৷ ১৮৯৭-র অ্যালিয়েঞ্জা লিমার এয়ার ক্র্যাশে পেরু ন্যাশনাল টিমের বেশ কিছু খেলোয়াড়ের মৃত্যু হয়৷ এই ক্ষতিটা তারা আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি৷ এখানকার অনেকে মনে করেন এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব না ফেললে পেরু নির্ঘাৎ বিশ্বের প্রথম ষোলটা টিমের মধ্যে থাকত৷ তবে তা না থাক, লিমার প্রতিটা মানুষের সাথে মিশে আছে ফুটবল৷ আর ফলশ্রুতি আমার টিকিট না পাওয়া৷ আমার চারপাশের মানুষগুলোর টিকিট না পাবার জন্য হা-হুতাশ৷ আর আমার আক্ষেপটা ভিতরে ভিতরে অন্যদের থেকে বেশি৷ লিমা স্টেডিয়ামে ল্যাটিন আমেরিকার ফুটবল দেখার প্রথম ও সম্ভবত শেষ সুযোগ হারালাম আমি৷ কোম্পানি তো আমায় আর বারবার এদেশে পাঠাবে না৷

বেশ কিছুক্ষণ আমি চুপচাপ হতাশ ভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম স্টেডিয়ামের বাইরে৷ একবার মনে হল, এখানে কলকাতা ময়দানের বটতলার মতো বেশি দামে টিকিট নেবার কোনো জায়গা আছে কিনা তা খোঁজ নিই৷ কিন্তু লোকজনকে কথাটা জিজ্ঞেস করতে ঠিক সাহস পেলাম না৷

এই মে মাসে বেশ গরম পেরুতে৷ রোদের তাত এবার কমে আসতে শুরু করেছে৷ বিকাল সাড়ে চারটে৷ বিশাল স্টেডিয়ামের ছায়া হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছে বড়ো রাস্তার দিকে৷ আমার হোটেল খুব বেশি দূরে নয়৷ সূর্য ডুবতে এখনও অনেকটা দেরি৷ কোনো কাজ নেই৷ টিকিট যখন পেলামই না তখন মনে হল শহরটা একবার পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখি৷ টিকিট না পাবার কষ্ট হয়তো কিছুটা লাঘব হবে তাতে৷ এই ভেবে স্টেডিয়াম চত্বর ছেড়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম৷

ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করলাম আমি৷ ঝাঁ চকচকে রাস্তায় অবিশ্রান্ত গাড়ির মিছিল৷ ফুটপাতেও বেশ লোকজন৷ ফুটপাতের গা লাগোয়া সারসার সব ঝলমলে দোকান, কিউরিও শপ৷ আমেরিকার প্রাচীন সভ্যতার ভিত্তিভূমি পেরু৷ এ মাটিতেই একদিন জন্ম নিয়েছিল সোনার সভ্যতা ‘ইনকা’৷ যার নিদর্শন আজও ছড়িয়ে আছে পেরুর প্রাচীন রাজধানী কুজকো, নাজকা বা আন্দিজ শীর্ষে ইতিহাস প্রসিদ্ধ মাচুপিচুতে৷ বহু ট্যুরিস্ট এ সব দেখার জন্য পেরুতে আছে৷ রাস্তায় তাই ভিনদেশিদেরও দেখা যাচ্ছে৷ ইউরোপিয়ান, আফ্রিকান, পীতবর্ণের এশিও নানা জাতের ট্যুরিস্ট৷ প্রাচীন ঐতিহ্যকে পেরুভিয়ানরা খুব সমাদর করে৷ প্রাচীন ইনকা সভ্যতার আদলে গড়া নানা স্তম্ভ, তোরণ, মূর্তিও মাঝে মাঝেই চোখে পড়ছে৷ নেটিভ আমেরিকানরা তাদের সনাতন পোশাকে সজ্জিত হয়ে কোথাও কোথাও রাস্তার মোড়ে রণডাডর বাঁশিতে মন দোলা দেওয়া সুর তুলে পথচলতি ট্যুরিস্টদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে৷ এসব নানা জিনিস দেখতে দেখতে আমি এগোলাম৷ টিকিট না পাবার কষ্টটা যেন ধীরে ধীরে ভুলতে লাগলাম৷

বড়ো রাস্তা থেকে এ গলি সে গলি ধরে কখন যে বেশ দূরে একটা ফাঁকা অঞ্চলে চলে এসেছি তা খেয়াল হয়নি৷ জায়গাটাতে বড়ো রাস্তার কোলাহল এসে পৌঁছয় না৷ চারপাশ যেন নিরিবিলি৷ সামনেই একটা পার্কের মতো গাছে ছাওয়া জায়গা দেখে এগোলাম সে দিকে৷ অনুচচ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা জায়গা৷ প্রবেশ তোরণ দিয়ে তার ভিতরে ঢুকতেই আমার ভুল ভাঙল৷ পার্ক নয়, এটা একটা সিমেট্রি বা কবরখানা৷ বিকালের আলোতে সারসার সমাধি বেদির পাথরের ক্রশগুলো বিষণ্ণতা নিয়ে জেগে আছে৷ কেমন যেন মায়াময় পরিবেশ! সমাধিক্ষেত্রের ভিতরে এক জায়গাতে বেশ কয়েকটা পাথুরে বেঞ্চ আছে বসার জন্য৷ তার কাছাকাছি একটা স্তম্ভ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল৷ ফুট সাতেকের স্তম্ভের মাথায় বসানো আছে একটা ফুটবল! পুরোটাই অবশ্য শ্বেতপাথরে তৈরি৷ এগিয়ে গেলাম স্তম্ভর দিকে৷ স্প্যানিশে তার গায়ে কী সব লেখা! পড়তে পারলাম না৷ কিন্তু ভারি অদ্ভুত লাগল! ল্যাটিন আমেরিকার লোকদের রক্তে ফুটবল তা জানি, কিন্তু তা বলে তাঁরা অন্তিম শয়নেও যে ফুটবলকে সাক্ষী রাখেন তা জানা ছিল না৷ নইলে সিমেট্রিতে ফুটবলের স্তম্ভ কেন?

কাছেই একটা বেঞ্চে বসলাম৷ বড় বড় গাছের ফাঁক দিয়ে শেষ বিকালের নরম আলো আমার কোলে এসে পড়েছে৷ মাঝে মাঝে একটা অচেনা পাখির ডাকা ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই কোথাও৷ একটু বিষণ্ণ হলেও জায়গাটা বেশ ভালো লাগল আমার৷ ভাবলাম একটু জিরিয়ে নিয়ে ফেরার পথ ধরব৷

দুই

বসেই ছিলাম৷

‘সেনোরাস, আপনার কাছে লাইটার আছে?’

প্রশ্ন শুনে তাকিয়ে দেখি কখন যেন একজন স্থানীয় লোক এসে দাঁড়িয়েছে আমার কাছে৷ দাড়িতে তার পাক ধরেছে৷ বয়স মনে হয় বছর ষাটেক হবে৷ মাথায় ঘাসে বোনা পানামা হ্যাট৷ এই গরমেও গায়ে একটা কোট চাপানো৷ তবে সেটা বিবর্ণ৷ ট্রাউজারেরও একই দশা৷ ছেঁড়া জুতোর ফাঁক দিয়ে বুড়ো আঙুল দেখা যাচ্ছে৷ কাঁধে তেলচিটে ঝোলা৷ লোকটাকে দেখে ভবঘুরে জাতীয় বলে মনে হল৷ তার হাতে ধরা আছে এক গোছা মোমবাতি৷ তার লাইটার চাওয়ার কারণটা অনুমান করলাম৷ কবরে সে বাতি জ্বালাতে এসেছে৷ লোকটার কথায় মাথা নেড়ে পকেট হাতড়ে লাইটার বার করলাম৷ এক বন্ধুর প্রেজেন্ট করা দামি ইলেট্রনিক্স লাইটার৷ সেইটা লোকটার হাতে দিয়ে মন ঠিক সায় দিল না৷ আমি নিজেই খুব যত্নে জিনিসটা ব্যবহার করি৷ তাই লাইটার জ্বালিয়ে হাতটা এগিয়ে দিলাম লোকটার উদ্দেশ্যে৷ লোকটা তার ঝোলা থেকে একটা কাগজের টুকরো বার করে নিয়ে সেটাতে আগুন ধরাবার জন্য লাইটারের দিকে বাড়াল৷ উদ্দেশ্য কাগজটা ধরিয়ে নিয়ে তার থেকে মোমগুলো জ্বালাবে৷

আমি হাতটা আর একটু এগিয়ে তাতে আগুন ধরাতে যাচ্ছিলাম৷ কিন্তু কাগজটাতে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম৷ নিজের অজান্তেই লাইটারটা আমি নিভিয়ে ফেললাম৷ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় কাউন্টার ফেরতা অগ্রবর্তী কয়েকজনের হাতে স্টেডিয়ামের এমব্লেম আঁকা এই রঙিন কাগজের টুকরো আমি দেখেছি! বিস্মিত ভাবে লোকটাকে আমি বললাম, ‘আপনি কী দিয়ে আগুন ধরাতে যাচ্ছেন সেটা খেয়াল করেছেন?’

লোকটা বেশ শান্ত স্বরে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, করেছি৷ এটা ন্যাশিওনাল প্রিমিয়ারের কালকের ম্যাচের টিকিট৷’

তার জবাব শুনে আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম৷ যে টিকিটের জন্য এত হাহাকার তা জেনে বুঝে লোকটা সে টিকিটটা পোড়াতে যাচ্ছে! লোকটা পাগল নাকি?

লোকটা বোধহয় আমার মনের ভাষা পড়তে পারল৷ বেশ শান্ত স্বরে সে বলল, ‘কী ভাবছেন, আমি পাগল? এখানেও কেউ কেউ অবশ্য তাই মনে করে৷’

আমি বলে উঠলাম, ‘না, না, আমি ঠিক তাই ভাবছি না৷ আসলে, যে টিকিটের জন্য লোকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেটা আপনি পুড়িয়ে দিচ্ছেন! ব্যাপারটা বেশ আশ্চর্য লাগছে! আমিও তো এই টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ পেলাম না৷ আমি ইন্ডিয়া থেকে এসেছি৷ আর কোনোদিন হয়তো আসা হবে না৷ ল্যাটিন আমেরিকার ফুটবল স্বচক্ষে দেখা হল না৷’

সে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘আসলে এ টিকিটটা আমার কাছ মূল্যহীন৷ এরকম আরও টিকিট আমি বহু দিন পুড়িয়েছি৷’

আমি বললাম, ‘ও বুঝেছি, আপনি সম্ভবত ফুটবল মাঠে যান না৷ কিন্তু আপনাদের তো ফুটবলের দেশ৷ কাউকে টিকিটটা দিলে সে তো খেলা দেখতে পারে৷’

লোকটা জবাব দিল, ‘ভয় করে৷’

‘মানে? কিসের ভয়? অবাক হয়ে জানতে চাইলাম আমি৷

সে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘কিসের ভয় শুনবেন? হতো সময় আছে আপনার? আপনি তো বিদেশি, তাই গল্পটা শোনানো যেতে পারে আপনাকে৷’

আমার হোটেলে ফেরা ছাড়া অন্য কোনো কাজ নেই৷ সূর্য ডুবতেও আরও কিছুক্ষণ বাকি৷ আর এই অদ্ভুত লোকটা বেশ আগ্রহ সৃষ্টি করেছে আমার মনে৷ তাই বললাম, ‘আমার তেমন তাড়া নেই৷ আপনি বলতে পারেন—৷’

লোকটা বেঞ্চের অপর প্রান্তে বসল৷ তারপর বলল, ‘আসলে এটা ঠিক গল্প নয়, সত্যি ঘটনা৷ আর সে ঘটনার সূচনা হয়েছিল বলা যেতে পারে আমরা যেখানে বসে আছি এই জায়গা থেকেই৷ সে দিন অবশ্য এখানে সিমেট্রি ছিল না৷ ছিল, ফুটবল খেলার ছোট্ট একটা মাঠ৷’

আমি বললাম, ‘তাই নাকি!’

সিমেট্রির গাছগুলোর মাথায় আলো ছড়াচ্ছে শেষ বিকালের রোদ৷ অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ চারপাশে৷ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার পর লোকটা ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল তার কাহিনি৷

‘এ গল্পের জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের এক বিকালে৷ ১৯৬৪-র মে, মাসের এক বিকাল৷ ঠিক আজকের মতোই গরমের পড়ন্ত দিন৷ স্টেডিয়ামের পথেই বিখ্যাত গুডিয়ার টায়ার ফ্যাক্টরির পিছনের শ্রমিক বস্তির একদল ছেলে এ মাঠে ফুটবল খেলছে৷ তাদের নেতা টিমের সেরা দুই স্ট্রাইকার দুই বন্ধু মন্তেনিও আর ব্ল্যাঙ্কো৷ তাদেরই নেতৃত্বে ছেলের দল পাঁচ-পাঁচে ভাগ হয়ে খেলছে৷ তবে মন্তেনিও আর ব্ল্যাঙ্কো আজ যুযুধান প্রতিপক্ষ৷ ক-দিন ধরেই সারা দেশে প্রচণ্ড একটা উত্তেজনা৷ ফুটবল জ্বরে কাঁপছে পেরু৷ পরদিন লিমা ন্যশিওনালে পেরু-আর্জেন্টিনার ম্যাচ৷ না, সেটা কোনো সাধারণ ম্যাচ নয়৷ সেই ম্যাচই ঠিক করে দেবে আগামী টোকিও অলিম্পিকে পেরু ও আর্জেন্টিনার মধ্যে কোন দল ল্যাটিন আমেরিকার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করবে৷ যে ছেলের দল সে দিন মাঠে খেলছিল তাদের মধ্যেও ছিল প্রচণ্ড উত্তেজনা৷ বলা যেতে পারে সে উত্তেজনা অন্যদের থেকে কিছুটা বেশি৷ কারণ তারা ইতিমধ্যেই পেরু-আর্জেন্টিনা ম্যাচের একটা টিকিট সংগ্রহ করে ফেলছে৷ দশজনে মিলে একটাই টিকিট৷ প্রত্যেকেই দুঃস্থ পরিবারের ছেলে৷ কেউ সাতদিন টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কেউ বা বাবার পকেট কেটে প্রচণ্ড মার খেয়ে যে পয়সা সংগ্রহ করেছিল তা দিয়ে এই একটা মাত্রই টিকিট সংগ্রহ করা গেছিল৷ তবে তাই ঢের৷ চারপাশে ওই একটা টিকিটের জন্যই হাহাকার করছে বহু লোক৷ সামান্য পাঁচ ডলারের ওই টিকিটের বদলে হাজার ডলার দিতেও রাজি অনেকে৷ কিন্তু একটা টিকিটও নেই৷

তবে সে কথা থাক, ছেলের দল দশ হাজার ডলার দিলেও কাউকে দেবে না সে টিকিট৷ কিন্তু মুশকিল একটা তাদেরও আছে৷ দশজনের মধ্যে একজনই পাবে স্টেডিয়ামে ঢোকার সুযোগ৷ তাই তারা আলোচনা করে নিয়েছে যে নিজেদের মধ্যে পাঁচ-পাঁচে খেলায় যে গোল দেবে বা সর্বোচচ গোল দেবে সেই পাবে টিকিটটা৷ এ ব্যাপারটা মীমাংসা করার জন্যই সে দিন এই ছোট্ট মাঠে খেলতে নেমে ছিল তারা৷

মাঠে কোনো বারপোস্ট নেই৷ দুপাশে জুতো দিয়ে পরিমাপ করে কল্পিত গোলের পরিধি৷ এক এক দলের পাঁচ জনের প্রত্যেকেই একাধারে স্ট্রাইকার, স্টপার গোলকিপার৷ কারণ, প্রত্যেকেই চায় নিজে গোল দিতে৷ আর অন্যর গোল আটকাতে৷ কাজেই পাসটাসেরও তেমন কোনো ব্যাপার নেই৷ তবু জমে উঠল খেলা৷ প্রথম হাফেই তিনটে ছেলে মন্তেনিও, দেলসালদো আর ব্ল্যাঙ্কো একটা করে গোল দিয়ে ফেলল৷ দ্বিতীয় হাফে আরও জমে উঠল খেলা৷ মিনিট দশেকের মধ্যেই মন্তেনিও ও ব্ল্যাঙ্কো দুটো গোল দিল৷ সবাই বুঝে গেল তাদের একজনই টিকিটটা সম্ভবত পাচ্ছে৷ কিন্তু, কে? মাঠ ঘিরে জনাপঞ্চাশেক দর্শকও জুটে গেছিল৷ সবাই তারা টায়ার ফ্যাক্টরির বস্তির ছেলে মেয়ে৷ তারা যে যা পছন্দমতো চেঁচিয়ে উৎসাহ দিতে লাগল মন্তেরিও অথবা ব্ল্যাঙ্কোকে৷ যেন এই ছোট্ট মাঠেই হচ্ছে পরদিনের পেরু-আর্জেন্টিনা ম্যাচ! দ্বিতীয়ার্ধে খেলা যত এগোতে লাগল প্রতি মিনিটে উত্তেজনা ততই বাড়তে লাগল৷ মন্তেনিও না ব্ল্যাঙ্কো? কিন্তু কেউই আর কোনো গোল দিতে পারছে না৷ এ দিকে সময় প্রায় শেষ হতে চলেছে৷ বস্তিরই ছুতোর মিস্ত্রি পাউল খেলার রেফারি৷ টিকিট তার কাছেই রাখা৷ বারবার ঘড়ি দেখছে সে৷ তার অন্য কাজ আছে৷ সে যখন খেলা শেষ হবার বাঁশি বাজাবে বাজাবে করছে ঠিক তার আগের মুহর্তে দু-জনকে ডজ করে একটা দুরন্ত কিকে গোলে বল ঢুকিয়ে দিল মন্তেনিও৷ গো-ও-ও-ল! চিৎকা করে উঠল সবই৷ পরপর দুটো বাঁশি বাজিয়ে দিল রেফারি পাউল৷ খেলা শেষ৷ জিতে গেছে মন্তেনিও৷ পাউলের থেকে টিকিটটা কোনো মতে ছিনিয়ে নিয়ে বস্তির দিকে ছুটল মন্তেনিও৷

মন্তেনিও যখন ঘরে ঢুকল তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে৷ তার দশ বছরের বোন সুসানা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল তাকে৷ বস্তির সেই ছোট্ট কাঠের বাড়িতে তারা দুজনেই থাকে৷ সুসানার জন্মের কিছুদিন পর থেকেই বাবা নিরুদ্দেশ৷ মা-ও মারা গেছে বছরখানেক আগে৷ ভাই বোনের আর কেউ নেই৷ স্থানীয় এক মিশনারি সংস্থা তাদের খাবার আর পড়াশোনার খরচ চালায়৷ মন্তেনিও টিকিটটা দেখাতেই প্রথমে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মুখ৷ তারপর সে যখন জানতে পারল যে একজনই তাতে যেতে পারবে তখন ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল৷ দাদা যখন মাঠে যাচ্ছে তখন তাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করল৷ কিন্তু সে নাছোড়বান্দা৷ সেও যাবে মাঠে৷ মহা মুস্কিলে পড়ে গেল ছেলেটা৷ বোনকে সে খুব ভালোবাসে৷ শেষে না তার যাওয়াটাই ভেস্তে যায়৷ হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল সেদিন খেলায় রেফারি ছুতোর মিস্ত্রি পাউলের কথা৷ বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং লাগানোর কাজে সে স্টেডিয়ামে যাওয়া আসা করছে৷ যদি সে কোনো ভাবে সুসানার খেলা দেখার ব্যবস্থা করতে পারে?

পাউলের ঘর মন্তেনিওদের বস্তিতেই৷ সুসানাকে নিয়ে মন্তেনিও হাজির হল পাউলের ঘরে৷ পাউল লোকটা ভালো৷ বিশেষত মন্তেনিও আর ব্ল্যাঙ্কোকে সে খেলার জন্য পছন্দ করে খুব৷ লোকজনকে সে প্রায়ই বলে, ‘সুযোগ পেলে একদিন মন্তেনিও-ব্ল্যাঙ্কোও, লারোসা-ল্যাবটোনের মতো পেরু ন্যাশনাল টিমে খেলবে৷’ মন্তেনিওর সব কথা শুনে আফশোসের সুরে সে বলল, ‘না, খেলার সময় কাউকে মাঠে ঢোকাবার ক্ষমতা আমার নেই৷ ব্ল্যাঙ্কোও এখনই এসেছিল৷ তাকে না করে দিলাম৷ খুব খারাপ লাগল৷ তবে সুসানা তো ছোটো মানুষ, তাই ওকে মাঠে ঢোকাবার অন্য একটা ব্যবস্থা করতে পারি৷ কাল ভোরে হোর্ডিং-এর ট্রাক নিয়ে মাঠে যাব৷ সে ট্রাকে আমি সুসানাকে নিয়ে স্টেডিয়ামে যাব৷ বেলা দশটার মধ্যে মাঠ থেকে বেরোতে হবে আমাকে৷ বিনা টিকিটে খেলা দেখার অনুমতি আমারও নেই৷ কিন্তু বেরোবার আগে সাত নম্বর গেটের ভিতর মাঠের গায়ে হোর্ডিং-এর আড়ালে ওকে লুকিয়ে রেখে আসব৷ ওই গেটেই তো তোমার সিট নম্বর৷ মাত্র ঘণ্টাখানেকের ব্যাপার তুমি মাঠে ঢুকলেই ও তোমার কাছে গ্যালারিতে চলে যাবে৷ ভিতরে টিকিট চেক হবে না৷ ও তোমার সাথে খেলা দেখবে৷ ব্যাপারটা কেউ ধরতে পারবে না৷ কাল ভোরে আলো ফোটার আগেই তুমি সুসানাকে আমার ঘরে পৌঁছে দিও৷’

মন্তেনিও একবার বলল, ‘কিছু হবে না তো?’

পাউল বলল, ‘না, হবে না৷ এর আগেও একবার আমি একটা বাচচাকে এ ভাবে মাঠে ঢুকিয়ে ছিলাম৷ আর আগে যদি পুলিশ ওকে দেখে ফেলে তাহলে ও বলবে আমি কাজ করতে এসে ওকে ভুলে মাঠে ফেলে গেছি৷ পুলিশ ওকে বাড়ি পৌঁছে দেবে৷’

কথা পাকা হয়ে গেল৷ পাউলের বাড়ি ছেড়ে খুশি মুখে নিজেদের ঘরের দিকে রওনা হল ভাই বোন৷ কিন্তু একটা জিনিস তারা বা পাউল জানতে পারল না৷ তারা পাউলের বাড়ি থেকে বেরোবার পর পাউলের দেওয়ালের অন্ধকার আড়াল থেকে বেরিয়ে অন্য রাস্তা ধরল আর একজন৷ সে ব্ল্যাঙ্কো৷ পাউলের ঘরের দিকে মন্তেনিওদের আসতে দেখেই সে দেওয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিল৷ সে চলে যায়নি৷ আড়াল থেকে ঘরের ভিতরের সব কথা শুনেছে৷ এমনিতে সে আর মন্তেনিও খুব বন্ধু৷ এক সাথে তার স্কুলে টিফিন খায়, স্কুল ফাঁকি দিয়ে ফুটবল খেলার জন্য শিক্ষকদের কাছে এক সাথে তারা মারও খায়৷ স্পোর্টস বয়েজ জুনিয়ার টিমে খেলার জন্য তার কিছুদিন আগে একসাথে ট্রায়ালও দিয়ে এসেছে সে৷ সম্ভবত দু-জনেরই হয়ে যাবে৷ কিন্তু টিকিটটা হাতছাড়া হওয়ায় মাথাটা গোলমাল হয়ে গেছে তার৷ কিছুতেই সে মেনে নিতে পারছে না ব্যাপারটা৷ তার ওপর বোনের ব্যবস্থাটাও মন্তেনিও করে ফেলল শুনে আগুন হয়ে গেল তার মাথা৷ সে চলল পেড্রোর বাড়ি৷ সে লিমা পুলিশ টিমে সদ্য ঢুকেছে৷ খেলার সূত্রে তার সাথে আলাপ আছে ব্ল্যাঙ্কোর৷ কাল স্টেডিয়ামে ডিউটি আছে পেড্রোর৷

তিন

১৯৬৪ সালের ২৪ মে৷ বেলা বাড়ার সাথে সাথেই সমস্ত রাস্তা যেন রওনা হল একই অভিমুখে৷ রাস্তায় হাজার হাজার মানুষের মিছিল৷ সবারই গন্তব্যস্থল লিমা ন্যশিওনাল৷ সেখানে আজ ইতিহাস রচনা করতে চলেছে পেরু৷ সবাই তার সাক্ষী থাকতে চায়৷ সারা রাস্তা মুড়ে দেওয়া হয়েছে পেরুর লাল-সাদা জাতীয় পতাকায়, রাস্তার মোড়ে লারোসা, ভ্যালডোজ, ল্যাবটোনদের বড়ো বড়ো ছবি৷ ওরাই আজ পেরুকে পৌঁছে দেবে টোকিও অলিম্পিকের মানচিত্রে৷ দেশের রাষ্ট্রপতিও আজ তাঁদের কাছে জনপ্রিয়তায় ম্লান৷ সারা দেশ তাকিয়ে আছে ওই মহানায়কদের ছবিগুলোর দিকে৷ ফরোয়ার্ড লারোসা ১০ তারিখের ম্যাচে উরুগুয়েকে তিন গোল দিয়ে চুরমার করে দিয়েছিল৷ তার আগে ইকুয়েডরের সাথে খেলায় গোল দিয়েছে ভ্যালডোজ আর ল্যাবটোন৷ আজ আর্জেন্টিনার জালে কে বল ঢোকাবে? লারোসা, ল্যাবটোনা, না ভ্যালডোজ? নাকি তারা প্রত্যেকেই! যেই গোল দিক না কেন আর্জেন্টিনার দম্ভ চূর্ণ হবেই৷ এ কথা প্রত্যেক পেরুবাসীরই মনে প্রাণে বিশ্বাস করে৷ আর সে বিশ্বাসকে সমর্থন জানিয়ে লিমার আকাশে খুব নিচ দিয়ে ভোর বেলা থেকে চক্কর কাটছে একটা হেলিকপ্টার৷ লম্বা ব্যানার ঝুলছে তার গায়ে৷ তাতে লেখা, ‘পেরু আজ জয়ী হবে৷’ রাস্তায় দাঁড়ানো লোকেরা হাত নাড়ছে কপ্টারটার উদ্দেশে৷ লাখোলাখো আন্দোলিত হাত! সবার কণ্ঠে একই আওয়াজ— ‘পেরু আজ জিতছে৷’

দুপুরের আগেই হাতে সময় নিয়ে বেরিয়ে সেই মিছিলে সামিল হল মন্তেনিও৷ কথা মতোই কাকভোরেই পাউলের বাড়ি সে পৌঁছে দিয়েছিল সুসানাকে৷ মাঠ ফেরতা পাউল খবর দিয়ে গেছে, চিন্তার কিছু নেই৷ হোর্ডিং-এর আড়ালে নিরাপদেই সে রেখে এসেছে সুসানাকে৷ তবুও তার কথা ভেবে যথাসম্ভব দ্রুত স্টেডিয়ামের দিকে এগোবার চেষ্টা করল মন্তেনিও৷ কিন্তু এগোবো বললেই কি আর এগোনো যায়! মন্তেনিওর সামনে-পিছনে, ডাইনে-বাঁয়ে শুধু মানুষ আর মানুষ! কত বিচিত্র তাদের সাজ! হাতে প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন, জাতীয় পতাকা৷ মুখে পেরুর জয়ধ্বনি৷ একদল মানুষ সেজেছে পেরুর প্রাচীন ইনকা যোদ্ধাদের সাজে৷ যুদ্ধের বাজনা বাজাতে বাজাতে তারা চলেছে ন্যশিওনালের দিকে৷ সেই মহামিছিলে একদল ব্রাজিলিওকেও দেখতে পেল মন্তেনিও৷ সবুজ ঝালর দেওয়া পালকের পোশাকে সজ্জিত হয়ে সাম্বা নাচতে নাচতে তারাও এগোচ্ছে একই গন্তব্যে৷ চির প্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার পরাজয়ের সাক্ষী হতে৷ পেরুর সমর্থনে তারাও মাঠে থাকবে৷ এ সব নানা জিনিস দেখতে দেখতে মানব-সমুদ্রে দুলতে দুলতে এক সময় মন্তেনিও পৌঁছে গেল ন্যশিওনালে৷ স্টেডিয়ামের বাইরে শুধু মানুষের মাথা আর মাথা৷! যারা ভিতরে ঢুকতে পারবে না তাদের জন্য বিশাল টিভি স্ক্রিন টাঙানো হয়েছে বাইরে৷ সেই স্ক্রিনেও ফুটে আছে— ‘পেরু আজ জিতবেই৷’

সাত নম্বর গেটে লাইন দিয়ে ভিতরে ঢুকে তিনশো তেরো নম্বর সিটে পৌঁছে গেল মন্তেনিও৷ গ্যালারির আপার টাওয়ার৷ সবচেয়ে কম দামি আসন৷ তবে এই আসনেও যারা বসছে, নিজেকে আজ তারা ধন্য মনে করছে৷ গুডিয়ারের হোর্ডিংটা গ্যালারির ঠিক নিচেই ছিল৷ সেখানে থেকে দাদাকে দেখতে পেয়েই আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে গ্যালারিতে উঠে পড়ল সুসানা৷ বোন কাছে আসতেই তাকে জড়িয়ে ধরল মন্তেনিও৷ যাক, এবার সে নিশ্চিন্ত৷ ভাই-বোন মিলে খেলা দেখা যাবে শান্তিতে৷ কাতারে কাতারে লোক ঢুকছে মঠে৷ বিউগল, ড্রাম বাজছে গ্যালারিতে৷ ভাই বোন দেখতে লাগল সে সব৷

কিন্তু তাদের শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হল না৷ হঠাৎই গ্যালারি বেয়ে ওপরে উঠে মন্তেনিওর সামনে এসে দাঁড়াল লালমুখো পেট-মোটা একজন পুলিশ অফিসার আর তার কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ৷ অফিসার সটান এসে মন্তেনিওর কাছে দুজনের টিকিট দেখতে চাইল৷ বিপদে পড়ে গেল মন্তেনিও৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যাপারটা ধরে ফেলল অফিসার৷ গোঁফে তা দিয়ে সঙ্গীদের সে বলল, ‘দেখলে, ঠিক পাকড়াও করেছি৷’

একজন পুলিশ জানতে চাইল, ‘কী ভাবে বুঝলেন ব্যাপারটা?’

অফিসার বলল, ‘খবর ছিল৷ আমাদের পেড্রোকে ব্ল্যাঙ্কো বলে এক ছোকরা খবরটা দিয়েছিল৷ তারপর সে খবরটা দেয় আমাকে৷ তক্কে তক্কে ছিলাম, ধরে ফেলেছি৷’

কিন্তু এখন কী হবে? অফিসার দুজনকেই ধরে নিয়ে যেতে চাইলেন৷ কিন্তু বাদ সাধল গ্যালারির অন্য লোকেরা৷ আরে একটা টিকিট তো আছে৷ দুজনকে নিয়ে যাওয়া হবে কেন? জনতার চাপে শেষ পর্যন্ত একটা মীমাংসা হল৷ খেলা চলাকালীন পুলিশের হেফাজতেই থাকবে মেয়েটা৷ খেলা শেষ হলে তিন নম্বর পুলিশ-তাঁবু থেকে তাকে ছাড়িয়ে নেবে মন্তেনিও৷ তাঁবুতে বসে খেলা দেখবে মেয়েটা৷ অগত্যা তাদের হাতেই সুসানাকে তুলে দিল বিমর্ষ মন্তেনিও৷ কাঁদতে কাঁদতে পুলিশদের সাথে চলে গেল সুসানা৷’— একটানা কথাগুলো বলে মনে হয় দম নেবার জন্য থামল লোকটা৷ সূর্য ডুবতে চলেছে৷ অন্ধকার নেমে আসছে সিমেট্রিতে৷ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে লোকটা আবার আমার উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করল—

সুসানাকে নিয়ে তারা চলে যাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই খেলা শুরু সময় হয়ে গেল৷ মাইকে ঘোষণা করা হল, দুই দল মাঠে নামবে৷ আর আজকের খেলা পরিচালনা করবেন উরুগুয়ের অভিজ্ঞ রেফারি এডোয়ার্ডো প্যাজোজ৷ স্টেডিয়াম তখন পঞ্চাশ হাজার দর্শকে কানায় কানায় পূর্ণ৷ আর স্টেডিয়ামের বাইরে কয়েক লক্ষ জনতা৷ প্রথমে মাঠে নামল পেরু৷ আরে, ওই তো ভ্যালডোজ! ওই তো ল্যাবটোন! ওই তো লারোসা!! জনতা উঠে দাঁড়িয়ে গ্যালারি থেকে তুমুল হর্ষধ্বনি আর করতালিতে স্বাগত জানাল তাঁদের৷ সে শব্দ যেন কাঁপিয়ে দিল আন্দিজ পাহাড়ের মাথায় মাচু পিচুর প্রাচীন ইনকা নগরীকেও, ঢেউ তুলল সমুদ্রে! পেরুর পর মাঠে নামল আর্জেন্টিনা৷ মেলিও, পেরেজ, ম্যানফেড্রি, বুল্লা, অর্জেন্টিনার সব বিখ্যাত প্লেয়ার! মেলিও দুটো করে গোল দিয়েছে কলম্বিয়া আর চিলির সাথে খেলায়৷ ম্যানফ্রেডিও গোল দিয়েছে চিলির সাথে খেলায়৷ ম্যানফ্রেডিও গোল দিয়েছে চিলিকে, পেরেজ ইকুয়েডরকে৷ আর বুল্লা শেষ ম্যাচে একাই তিন গোল দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে উরুগুয়েকে! আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের শরীরী ভাব বলে দিচ্ছে তাদের আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে৷ দু-দলের সামান্য কিছুক্ষণ গা ঘামানোর পর আনুষ্ঠানিক পরিচয় পর্ব মিটে গেলে প্যাজোজ বাঁশি বাজিয়ে খেলা শুরু করলেন৷ মাঠের পঞ্চাশ হাজার লোকের মতোই মন্তেইনও সব কিছু ভুলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল মাঠের দিকে৷ সুসানার কথাও যেন ভুলে গেল সে৷

জমে উঠতে লাগল খেলা৷ প্রথম থেকে পেরু আক্রমণাত্মক৷ গ্যালারি থেকে সবাই চিৎকার করে উৎসাহ দিতে লাগল পেরুর প্লেয়ারদের৷ মন্তেনিওও গলা ফাটাতে লাগল অন্যান্যদের সাথে৷ সময় এগিয়ে চলল, কিন্তু মুশকিল হল পেরু গোল করতে পারছে না৷ আর্জেন্টিনা রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে খেলছে৷ আক্রমণ শানাচ্ছে না৷ তাদের দুর্গ সামলাচ্ছে ল্যাটিন আমেরিকার সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাক সাইমন অলিভেরা৷ লারোসাদের সব আক্রমণই বানচাল করে দিচ্ছে সে৷ সমবেত দর্শকদের মিলিত উৎসাহ আর নিজেদের হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও প্রথমার্ধে গোল করতে পারল না পেরু৷ হাফটাইমের বাঁশি বেজে গেল৷

সামান্য দশ মিনিটের বিরতি৷ দর্শকরা কিন্তু নিজেদের বিশ্বাসে অবিচল৷ শেষ পর্যন্ত পেরু জিতবেই গ্যালারিতে সবাই বলাবলি করতে লাগল, আর্জেন্টিনা বুঝতে পেরেছে তারা আজ গোল খাবেই৷ সেই ভয়ে তারা রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে খেলছে৷ দ্বিতীয়ার্ধে পেরু অবশ্যই গোল দেবে৷ মন্তেনিওর একই মত৷ সবাই প্রতীক্ষা করতে লাগল আবার খেলা শুরুর জন্য৷ আর এই হাফটাইমে মাঠে অন্য সবার অজান্তে একটা অন্য ঘটনাও ঘটল৷ আট নম্বর গেটের গেটকিপার হুগোকে বাইরে অপেক্ষমান জনতার কিছু লোক চাপ দিচ্ছিল ভেতরে ঢুকতে দেবার জন্য৷ কিছুটা তাদের তাড়না থেকে বাঁচার জন্য আর কিছুটা খেলা দেখার নেশায় বিশাল গেটটার শাটার নামিয়ে দিল হুগো৷ তাকে দেখে অন্য গেট কিপাররাও গেট বন্ধ করে খেলা দেখতে বসে গেল প্রেস বক্সে৷

শুরু হল দ্বিতীয়ার্ধের উত্তেজনাপূর্ণ খেলা৷ আর্জেন্টিনা বদলে ফেলল তাদের স্ট্র্যাটেজি৷ প্রতি আক্রমণে উঠে এল তারা৷ তারপর হঠাৎই সবাইকে অবাক করে দিয়ে খেলার ৬০ মিনিটের মাথায় পেরুর গোলে বল ঢুকিয়ে দিল আর্জেন্টিনার ফরোয়ার্ড ম্যানফ্রেডি৷ মুহূর্তের মধ্যে স্টেডিয়ামে নেমে এল শ্মশানের নিস্তব্ধতা৷ মাঝ মাঠ থেকে শুধু ভেসে আসতে লাগল ম্যানফ্রেডিকে জড়িয়ে ধরে আর্জেন্টিনার প্লেয়ারের উল্লাস৷

আবার খেলা শুরু করলেন প্যাজোজ৷ গ্যালারি এবার অন্যরূপ ধারণ করল৷ ধীরে ধীরে তেতে উঠছে দর্শকরা৷ পেরুর প্লেয়ারদের উদ্দেশে সবাই চেঁচাতে লাগল, ‘গোল দাও, গোল দাও, নইলে তোমাদের আজ ছাড়ব না৷’ অশ্লীল গালিগালাজ আর চিৎকারে ভরে গেল মাঠ৷ দর্শকদের শান্ত করার জন্য মাইকে বারবার ঘোষণা হতে লাগল, ‘সেনোরাস-ই-সেনোরাস আপনারা শান্ত হোন৷ খেলা এখনও চলছে৷ মনে রাখবেন এটা ফুটবল৷ প্রীতির খেলা, সম্প্রীতির খেলা৷’ কিন্তু তাতে শান্ত হল না গ্যালারি৷ সময় এগোবার সাথে সাথে উত্তেজনা বাড়তেই থাকল৷ স্টেডিয়ামের বাইরে লিমার রাজপথেও তখন একই অবস্থা৷ টেলিভিশন, রেডিয়োর সামনে জনতা তখন একই অবস্থা৷ টেলিভিশন, রেডিয়োর সামনে জনতা তখন চিৎকার করছে, ‘গোল দাও! গোল দাও!’ কিন্তু গোল দিতে পারছে না পেরু৷ আর্জেন্টিনা আবার ফিরে গেছে তাদের রক্ষণাত্মক ঢঙে৷ অযথা নিজের মধ্যে পাস ঠেলে যত তারা সময় নষ্ট করছে ততো আরও তেতে উঠছে গ্যালারি!

চার

খেলা শেষ হতে তখন নামমাত্র সময় বাকি৷ দর্শকদের হতাশা আর উত্তেজনা তখন তুঙ্গে৷ ঠিক সেই সময় এক অভাবনীয় কাণ্ড ঘটল৷ মাঝ মাঠ থেকে বল নিয়ে উঠতে শুরু করল ভ্যালডোজ তিনজনকে কাটিয়ে অলিভেরাকে পর্যদস্ত করে সাইক্লোনের গতিতে এগিয়ে গোলে অবিশ্বাস্য দুরন্ত শট করল ভ্যালভেজ!

গো-ও-ও-ল!! মিনিট খানেক ধরে সারা দেশ ধরে অনুরণিত হতে লাগল সেই শব্দ! ৮৫ মিনিটের মাথায় গোল শোধ করল পেরু! ইথার তরঙ্গে সারা ল্যাটিন আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল সেই বার্তা৷ কিন্তু ওই শব্দ যেন আসলে ছিল এক মহাপ্রলয়ের সূচনা ধ্বনি৷

হঠাৎ সবাই লক্ষ করল গ্যালারি উল্লাসধ্বনিতে ফেটে পড়লেও মাঝ মাঠে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে পেরুর প্লেয়াররা৷ দারুণ হতাশায় বসে পড়েছে ভ্যালডোজ, ল্যাবটোন৷ পেরুর বিপক্ষে ফাউল৷ গোল বাতিল!!

প্রচণ্ড ঝড়ের আগে যেমন গাছের একটাও পাতা নড়ে না, তেমনই কয়েক মুহূর্তের জন্য পাথরের মূর্তি বনে গেল পঞ্চাশ হাজার লোক৷ মন্তেনিওরও একই অবস্থা৷ গোল বাতিল! মাথার ভিতর সব কিছু যেন গুলিয়ে যাচ্ছে৷ মগজ ফাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে আগুন! হঠাৎ সেই সময় দেখতে পেল পেটমোটা পুলিশ অফিসারটাকে৷ সুসানাকে যে ধরে নিয়ে গেছে৷ হাসছে লোকটা৷ একটা ইটের টুকরো পড়ে ছিল মন্তেনিওর পাশেই৷ গ্যালারিতে বহু মানুষের দাপাদাপিতে সম্ভবত ওটা খসে গেছিল৷ মন্তেনিওর অজান্তেই যেন সেই হাতটা এগোল নিরীহ পাথরখণ্ডর দিকে৷ হাতটা পাথরটা তুলল৷ তারপর সেই পাথরখণ্ড ধাবিত হল নিচের দিকে৷ অব্যর্থ লক্ষ৷ সঙ্গে সঙ্গে ধরাশায়ী হল সেই পুলিশ অফিসার৷ প্রচণ্ড শব্দে ফেটে গেল তার টিয়ার গ্যাসের শেল৷ এরকমই একটা ইঙ্গিতের জন্য যেন প্রতীক্ষা করছিল গ্যালারি৷ মন্তেনিওর ইট বিস্ফোরণে স্ফুলিঙ্গের কাজ করল৷ ‘মারো, মারো! খুন করো!’ গর্জন করতে করতে গ্যালারির নিচের দিকে ধাবিত হল ক্রুদ্ধ জনতা৷ চারজন পুলিশ যারা জনতাকে শান্ত করতে গ্যালারিতে উঠতে যাচ্ছিল তাদের ছুড়ে ফেলা হল নীচে৷ উন্মাদ জনতার আক্রোশে মুহর্তের মধ্যে গুঁড়িয়ে গেল মাঠের কাঁটাতারের ফেনসিং৷ জনসমুদ্র ঢুকে পড়ল মাঠে৷ কোনো রকমে আন্ডারগ্রাউন্ডে ঢুকে প্রাণ বাঁচাল রেফারি ও উভয় দলের প্লেয়াররা৷ প্রাণ বাঁচানোর জন্য গেটের দিকে ছুটল মানুষ৷ কিন্তু গেট তো বন্ধ! পদপিষ্ঠ হতে লাগল শয়ে-শয়ে মানুষ৷ মুহূর্তের মধ্যে বধ্যভূমিতে পরিণত হল লিমা ন্যশিওনাল৷ মানুষের আর্তচিৎকার, টিয়ার গ্যাসের শেল ফাটার শব্দ, আগুন আর ধোঁয়াতে, আর উড়ে আসা ইট কাঠ পাথরে সে এক নারকীয় অবস্থা৷ মাঠে ঘাপটি মেরে বসে থাকা ফুটবল গুণ্ডা ম্যাম্বার দলবলও ততক্ষণে ওই নরমেধ যজ্ঞে সক্রিয় হয়ে উঠেছে৷ আহত-মৃত মানুষদের কান, হাতের আঙুল কেটে নিচ্ছে তারা অলঙ্কারের জন্য৷ মন্তেনিও হঠাৎ খেয়াল হল সুসানার কথা৷ সে ছুটল পুলিশ তাঁবুর দিকে৷ কিন্তু সে তাঁবুতে কারা যেন ততক্ষণে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে৷ আর স্টেডিয়ামের বাইরে তখন লিমানগরীর অবস্থা আরও শোচনীয়৷ জনতার হতাশার ক্রোধ গণ হিস্টিরিয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে৷ যা কিছু সামনে পাচ্ছে তাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে স্টেডিয়ামের দিকে ধেয়ে আসছে লাখো লাখো উন্মত্ত জনতা৷ তাদের সামনে প্রাণ হারাছে অজস্র মানুষ৷ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে বিখ্যাত গুডিয়ার টায়ার ফ্যাক্টরি৷ কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেল লিমার আকাশ৷

সব দিনের যেমন অবসান হয়, তেমনি সেই অভিশপ্ত দিনেরও এক সময় অবসান হল৷ পরদিন ভোরে আবার সূর্য উঠল আন্দিজের মাথায়৷ কিন্তু ওই একটা দিনেই অনেক কিছু শেষ হয়ে গেছে৷ সূর্য আলো ছড়াচ্ছে লিমানগরীর ধ্বংসস্তূপে৷ দেশি বিদেশি পুরুষ নারী শিশু মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা পাঁচশো, আহত পাঁচ হাজার৷ কয়েক কোটি ডলারের সম্পত্তি ক্ষতি৷ সাত দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হল পেরুতে৷ এত মৃতদেহের স্থান সঙ্কুলান অন্য কবরখানায় হল না৷ এই ছোট্ট মাঠটা বেছে নেওয়া হল নতুন সিমেট্রি হিসেবে৷ ওই যে অন্ধকারের মধ্যে যে স্তম্ভটা দাঁড়িয়ে আছে ওটাই স্মরণ করাচ্ছে এখন ঘুমিয়ে থাকা ফুটবলপ্রেমী মানুষদের৷’

সিমেট্রি স্তম্ভর মাথায় ফুটবল কেন এবার ব্যাপারটা স্পষ্ট হল আমার কাছে৷ আমি প্রশ্ন করলাম, ‘মন্তেনিওর কী হল?’

লোকটা জবাব দিল৷ ‘পেরুর কুখ্যাত ফুটবল গুণ্ডাদের সাথে মন্তেনিও গ্রেপ্তার হল৷ না ঠিক গ্রেপ্তার নয়, নিজে থেকে ধরা দিয়েছিল সে৷ আদালতে দোষও কবুল করেছিল৷ জুরিরা বলেছিল ওই ইটের টুকরোটাই বারুদ স্তূপে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের কাজ করেছিল৷ সামান্য একটা ইটের টুকরো মুহূর্তে লিমা ন্যশিওনলকে পরিণত করেছিল আগ্নেয়গিরিতে৷ বিচারের পর মন্তেনিওর ঠাঁই হল পেরুর কুখ্যাত চ্যাসকুইটোম্বো কারাগারে৷ সেখানে সাত বছর কাটাবার পর ‘‘লিমা স্টেট মেন্টাল অ্যাসাইলামে’’ আরও দশ বছর৷’

আমি বললাম, ‘আর, সুসানা? তাকে খুঁজে পাওয়া গেছিল?’

কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ থেকে লোকটা বলল, ‘হ্যাঁ৷ আপনি আসুন আমার সাথে৷’

গল্প শুনতে শুনতে কখন যে অন্ধকার হয়ে গেছে খেয়াল করিনি৷ আমি লোকটার সাথে এগোলাম কবরগুলোর দিকে৷ যেতে যেতে অস্পষ্ট স্বরে বলল, ‘এ টিকিট কাউকে দিতে ভয় হয়! যদি সে আবার তুলে নেয় কোনো ইটের টুকরো!’

আমরা গিয়ে দাঁড়ালাম একটা ছোট্ট কবরের কাছে৷ লোকটা বলল, ‘আজ ২৪ মে৷ প্রতিবছর আমি এদিনে এখানে আসি৷ এখানে ঘুমিয়ে আছে ছোট্ট সুসানা৷’

লোকটা আমার কাছ থেকে লাইটার নিয়ে একটা মোম জ্বালিয়ে বসালো কবরের উপর৷ মোমের আলোতে একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করলাম আমি৷ লোকটার উন্মুক্ত কবজিতে উল্কিতে আঁকা একটা ফুটবলের ছবি৷ আর তার সাথে জ্বলজ্বল করছে ইংরেজিতে লেখা একটা নাম— ‘মন্তেনিও!’

কিছুক্ষণ নির্বাক থেকে আমি বললাম, ‘তাহলে টিকিট কেনেন কেন?’

কবরের দিকে চোখে রেখে সে জবাব দিল, ‘কিনি না, তিনশো তের নম্বরের টিকিটটা প্রতিবছর আমার নামে কে যেন পাঠিয়ে দেয়৷ ওই টিকিট নম্বরেই গ্যালারিতে সে দিন বসেছিলাম আমি৷ যে পাঠায় সে ব্ল্যাঙ্কো হতে পারে৷ সে এখন ফুটবল ফেডারেশনের কর্মকর্তা৷ হয়তো নিজের পাপ স্খালন করার জন্য বা এখনও তার আক্রোশ মেটেনি বলে পাঠায়৷ সুসানা সঙ্গে থাকলে হয়তো ইটটা ছুড়তাম না আমি৷ এই টিকিটটাই সব গণ্ডগোল করে দিয়েছিল আর ওই ইটটা৷’

আমাকে এবার হোটেলে ফিরতে হবে৷ অন্ধকার নেমে গেছে৷ আমি তার উদ্দেশে বললাম, ‘আমি এবার আসি মিস্টার মন্তেনিও৷ আপনার কাহিনি আমার মনে থাকবে৷’

মন্তেনিও বললেন, ‘এক মিনিট দাঁড়ান৷’

এই বলে তিনি কোটের পকেট থেকে টিকিটটা বার করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা রাখুন এটা আমার উপহার৷ ফুটবল তো দেশে দেশে মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি মৈত্রীর সেতু গড়ে তোলে৷ কত দূর দেশ থেকে আপনি এসেছেন! ফুটবল আছে বলেই তো আমার আপনার পরিচয় হল৷ তবে একটা জিনিস দয়া করে খেয়াল রাখবেন আপনি পৃথিবীর যে মাঠেই খেলা দেখুন না কেন, আপনি হয়তো লাখো দর্শকের একজন মাত্র, কিন্তু আপনার আচরণ মুহূর্তের মধ্যে ঘটিয়ে দিতে পারে লিমা ন্যশিওনালের ২৪ মের পুনরাবৃত্তি৷ মাথা ঠাণ্ডা রাখবেন৷ ফুটবল তো ভালোবাসার খেলা৷ খেলা দেখুন ফুটবলকে ভালোবাসুন৷’ এই বলে কবরের দিকে চোখ ফেরালেন তিনি৷ মোমবাতির উজ্জ্বল স্নিগ্ধ আলোর মতোই কথাগুলো৷

টিকিটটা হাতে নিয়ে আমি ধীর পায়ে সিমেট্রি ছেড়ে ফেরার পথ ধরলাম৷ অনেকক্ষণ ধরে তাঁর কথাগুলো অনুরণিত হতে থাকল— ‘ফুটবল তো ভালোবাসার খেলা৷ খেলা দেখুন৷ ফুটবলকে ভালোবাসুন৷’

(লিমা ফুটবল ডিজাস্টার ১৯৬৪-র সত্য ঘটনা অবলম্বনে এই গল্প৷

শুধু গল্পের প্রয়োজনে কয়েকটি কল্পিত চরিত্রর আগমন ঘটেছে)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *