এতিম ছেলে
“যারা এতিমের অর্থ সম্পদ অন্যায়ভাবে খায়, তারা নিজেদের পেটে আগুনই ভর্তি করছে এবং সত্বরই তারা অগ্নিতে প্রবেশ করবে।”
(আল-কোরআন, সূরা আন-নিসা, ১০ নাম্বার আয়াত, ৪ পারা)
১
আনাম–রে ও আনাম, কোথায় গেলিরে? আমার কাছে এসে একটু বস্ না বাপ।
আট বছরের আনাম ঘরের দাওয়ায় দু’হাতে পেট চেপে রেখে বসে বসে কাঁদছে। মায়ের ডাক শুনতে পেয়েও তার কাছে গেল না। আজ দু’দিন শুধু পানি খেয়ে রয়েছে। খিদেতে দাঁড়াতে পারছে না।
তহুরা আজ পনেরো দিন জ্বর হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। অনেক দিন আগে থেকে তার শরীর ভেঙে পড়েছিল। তাই এই জ্বরে সে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে। তিন চার দিন তার পেটেও পানি ছাড়া কিছুই পড়েনি। তাতেও তার কোনো দুঃখ নেই। যত দুঃখ তার আনামের জন্য। অতটুকু ছেলের মুখে আজ দু’দিন কোনো খাবার দিতে পারেনি।
তহুরা রাইস মিলে কাজ করে। তার সাথে পাড়ার আরও তিনজন মেয়েও করে। সেখানে তাদেরকে সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত ধান সিদ্ধ করতে ও শুকোতে হয়। তার বদলে যা পায়, তাতে কোনো রকমে আনামকে নিয়ে দিন গুজরান করে।
রাইস মিলের মহাজন যেমন কড়া তেমনি কৃপণ। কাজ ছাড়া কিছু বোঝে। কেউ অসুখ বিসুখের সময় কাজ না করে আগাম কিছু টাকা পয়সা চাইলে নানারকম গালাগালি করে দূরদূর করে তাড়িয়ে দেয়। বলে, বেটিদের সাহস কত, কাজ না করে টাকা চায়?
তহুরা জ্বরে ধুঁকতে ধুঁকতে ছেলেকে আবার ডাকল, আমাকে একগ্লাস পানি দিয়ে যা বাপ, বড্ড পিয়াস পেয়েছে।
এবার আনাম আর বসে থাকতে পারল না। ঘরে এসে গ্লাসে পানি ঢেলে মায়ের কাছে এল।
তহুরা উঠে বসতে পারল না। একপাশে কাত হয়ে একটা হাতের উপর ভর দিয়ে অন্য হাতে পানির গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে সব পানি খেয়ে ফেলল। তারপর শুয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, তুই একবার তোর নানার কাছে যা। বলবি মা কয়েকটা টাকা চেয়েছে।
আনাম গ্লাসটা রেখে এসে মায়ের পাশে বসে বলল, খিদেতে আমি দাঁড়াতে পারছি না, তার কাছে যাব কী করে?
তহুরা চোখের পানি রোধ করতে পারল না। চোখ মুছে ছেলের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আস্তে আস্তে যা বাপ। টাকা দিলে এক কেজি চাল ও আধ কেজি আলু কিনে আনবি। যদি টাকা না দেয়, তাহলে বলবি, কিছু যেন চাল দেয়।
আনাম উঠে একগ্লাস পানি খেয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে দরজার দিকে এগোল।
তহুরা ছেলের দিকে চেয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, আল্লাহ আমি তো কোনো অন্যায় করিনি; তবু কেন এত কষ্ট দিচ্ছ? আর আমার মাসুম বাচ্চাকেই বা কেন এত কষ্ট দিচ্ছ? শুনেছি তুমি দয়ার সাগর, তুমি ন্যায় বিচারক। এটাই কি তার প্রমাণ? যারা মানুষকে ঠকিয়ে এতিমের মাল ভক্ষণ করে, তারাই তো বেশ সুখে রয়েছে। এটাই কি তোমার ন্যায় বিচার? আমি মুখ মেয়ে। তোমাকে চিনি না, জানি না। তোমার কুদরত বুঝতে পারি না। তাই হয়তো তোমাকে দোষ দিচ্ছি। এতে যদি আমার কোনো অন্যায় হয়, তাহলে মাফ করে দিও। আল্লাহগো, তুমি আমাদের উপর রহম কর। আমার অসুখ ভালো করে দাও আল্লাহ। আমার আনামকে মানুষ করার ক্ষমতা আমাকে দাও। শুনেছি বড় লোকদের লোকজনের বল আছে, তাদের অনেক টাকা-পয়সা আছে, আর গরিবদের আল্লাহ আছে। যদি তাই হয়, তা হলে তুমি কি আমাদের দুঃখ-কষ্ট দেখতে পাচ্ছ না? আমাদেরকে সাহায্য করছ না কেন? মৌলবীদের মুখে শুনেছি, তুমি সমস্ত জীবের রিজিকদাতা। কাউকেই খাইয়ে রাখ না। সন্তান জন্মাবার আগে মায়ের বুকে তার জন্য খাবার তৈরি করে রাখ। যদি তাই হয়, তা হলে এই কয়েক দিন আমাদেরকে না খাইয়ে রেখেছ কেন? জ্ঞানমত আমি তো কোনো গোনাহর কাজ করিনি; তবু কেন আমাকে এত শাস্তি দিচ্ছ গো খোদা? তখন তার প্রথম স্বামীর কথা মনে পড়ল। অমন লম্বা চওড়া জোয়ান লোকটা মাত্র দু’চারবার পায়খানা-বমি করে মারা গেল। ঘটনাটা প্রায় চারবছর আগের হলেও সেকথা মনে পড়লে এখন তার কলজে কেঁপে উঠে।
সেদিন দুপুর রাতে জয়নুদ্দিনের দু’বার পাতলা পায়খানা হবার পর যখন একবার বমি হল তখন সে স্ত্রীর গায়ে হাত রেখে নাড়া দিয়ে বলল, এই তহুরা উঠ, আমার শরীর খারাপ লাগছে।
তহুরা ঘরের মেঝেয় ঘুমায়। চৌকিটা ছোট। তিনজনের শুবার জায়গা হয় না। জয়নুদ্দিন আনামকে নিয়ে সেখানে ঘুমায়।
স্বামীর ডাকে তহুরা ধড়মড় করে উঠে হারিকেনের কমানো বাতি বাড়িয়ে দিয়ে বলল, কী হয়েছে তোমার?
জয়নুদ্দিন বলল, দু’বার পাতলা পায়খানা ও একবার বমি হয়েছে। আবার পাচ্ছে।
তহুরা ভয় পেল। দু’দিন আগে দক্ষিণ পাড়ার মোবারক পায়খানা বমি করে মারা গেছে। সেই কথা ভেবে আতঙ্কিত স্বরে বলল, আমি আনামকে নিয়ে বাজারে গিয়ে ওহিদ ডাক্তারকে নিয়ে আসি। কথা শেষ করে ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে বলল, আনাম উঠ তো বাবা।
জয়নুদ্দিন তখন আবার বমি করতে শুরু করল।
তা তার মাথাটা দুহাত দিয়ে ধরে রাখল।
মায়ের ডাকে পাঁচ বছরের আনাম জেগে গিয়ে উঠে বসেছিল। আব্বাকে বমি করতে দেখে চুপ করে রইল।
বমি বন্ধ হবার পর তহুরা সেগুলো পরিষ্কার করে বলল, তুমি একটু বস, আমি আনামকে নিয়ে যাব আর আসব।
জয়নুদ্দিনের তখন অবস্থা খারাপ। শুয়ে পড়ে বলল, ডাক্তার আনতে হবে না। তোরা এখন বাইরে যাবি না। পায়খানা করতে গিয়ে যা দেখেছি সেকথা শোনার দরকার নেই। আমাকে ওলাবিবি ধরেছে। আমি আর বাঁচব না। দু’একটা কথা বলছি শুন, তুই যতই দুঃখকষ্টে পড়ি না কেন, কখন ইজ্জত খোয়াবি না। জান গেলেও না। আনামের দিকে খুব লক্ষ্য রাখবি। তারপর জয়নুদ্দিন কথা বলার সুযোগ পেল না। আর একবার পায়খানা ও বমি করার পর তার খিচ এসে গেল। খিচতে খিচতে কিছুক্ষণের মধ্যে সে মারা গেল।
তহুরার বুকফাটা কান্নায় আশপাশের মেয়ে-পুরুষ অনেকে ছুটে এল। তারা অমন জোয়ান গাট্টা জয়নুদ্দিন মারা গেছে জেনে যেমন খুব দুঃখ পেল, তেমনি পায়খানা বমি করে মারা গেছে জেনে ভয়ও পেল। তবু মুরুব্বিরা রাতের মধ্যে তার দাফন কাফনের ব্যবস্থা করল। একজনকে তহুরার চাচাকে খবরটা দেওয়ার জন্যে পাঠাল।
খবর পেয়ে তহুরার চাচা মজিদ তিন ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ফজরের আগেই এসে গেল। নামাযের পর জয়নুদ্দিনকে কবর দেয়া হল।
এরপর থেকে তহুরার জীবনে দুর্দিন নেমে এল। জয়নুদ্দিন খেটে খাওয়া মানুষ ছিল। কাঠা দুই ভিটে জমি-ও একটা বেড়ার ঘর ছাড়া স্ত্রী ও ছেলের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারেনি। তহুরা পাশের গ্রামের গরিব চাষির মেয়ে। তাকে চার বছরের রেখে তার বাপ মা মারা গেছে। তার চাচা মজিদ ও চাচি আমিনা মানুষ করে বিয়ে দিয়েছে। মজিদের অবস্থাও তেমন ভালো নয়। তার তিন ছেলে তিন মেয়ে। অভাব অনটনের মধ্যে অনেক কষ্ট করে তাদেরকে মানুষ করেছে। ছেলেরা বড় হয়ে রোজগার করতে শিখার পর মজিদের সংসারে একটু সচ্ছলতা এসেছে। ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়েছে। নাতি-নাতনি হয়েছে। এখনও ছেলেরা এক সংসারে। ছোট দু’জন বড় ভাইকে খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করে। তার কথার বরখেলাপ কোনো কাজ করে না। বড়জনের নাম জাব্বার, মেজ শাকের আর ছোট কায়েস। তহুরাকে তারা ছোটবেলা থেকেই সহ্য করতে পারত না। ভাবত, আব্বা আমাদেরকেই ভালোভাবে খাওয়াতে পরাতে পারে না, চাচা চাচি মরে গিয়ে এ আবার আব্বার ঘাড়ে এসে পড়েছে। তাই তহুরার বিয়ে হয়ে যাবার পর তারা কেউ তার খোঁজ-খবর নিত না। কিন্তু মজিদ মাঝে মাঝে ভাইঝির খোঁজখবর নিতে তাদের বাড়িতে যেত এবং সময়- অসময় কিছু সাহায্যও করত। জামাই মারা যাবার পর মজিদ তহুরার আবার নিকে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তহুরা স্বামীর অন্তিমকালের কথা ভেবে এবং আনামের ভালো-মন্দ চিন্তা। করে রাজি হয়নি। মজিদ ভাইঝিকে বুঝিয়ে বলেছিল, একটা দুধের বাচ্চাকে নিয়ে তুই সারাজীবন কাটাবি কী করে? তাছাড়া এখানে একা ঐ ছেলেকে নিয়ে থাকা নিরাপদ নয়। গ্রামের লোকজন ও ছেলে-ছোকরারা নানারকম উৎপাত করবে। সে সব সামলাবি কী করে? তার চেয়ে আমাদের কাছে থাকবি চল। তবু সে রাজি হয়নি। বলেছিল, স্বামীর ভিটে ছেড়ে আমি যাব না। তারপর হাঁস মুরগি পেলে, এ বাড়ি সে বাড়ি কাজ করে পাঁচ বছরের আনামকে নিয়ে কোনো রকমে একবেলা একসন্ধ্যে খেয়ে দিন কাটাচ্ছিল। কিন্তু একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার জীবনের গতি পাল্টে গেল।
ঘটনাটা হল, এই গ্রামের করিমের সঙ্গে জয়নুদ্দিনের বেশ ভাবসাব ছিল। করিমেরও বিয়ে হয়েছে; দুটো ছেলে-মেয়েও আছে। দুজন দুজনের ঘরে যাতায়াত করত। একথা গ্রামের লোকজন জানত। জয়নুদ্দিন মারা যাবার পর করিম মাঝে মাঝে তহুরার খোঁজ-খবর নিতে তার কাছে আসত। মা-ছেলের কষ্ট দেখে কিছু কিছু সাহায্যও করত। মাস ছয়েকের মধ্যে গ্রামের লোকজন জানতে পেরে তহুরার চাচা মজিদকে খরবটা জানিয়ে এর একটা বিহিত করতে বলে। এদের মূলে ছিল, জয়নুদ্দিনের চাচাত ভাইয়েরা। তাদের ইচ্ছা, তহুরাকে এখান থেকে বিদায় করে জমিটুকু দখল করার। ব্যাপারটা গ্রামের লোকজন বুঝতে পারেনি।
মজিদ খবর পেয়ে ভাইঝির বাড়ি এসে তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে গ্রামের লোকের সহায়তায় করিমের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয়। তহুরা কিন্তু করিমের ঘরে না গিয়ে আগের স্বামীর ভিটেতেই রইল। করিম সতীনে সতীনে ঝগড়া হবে মনে করে তাকে নিয়ে যাবার জন্য তেমন জোর করল না। জয়নুদ্দিনের চাচাতো ভাইয়েরা তখন তহুরার উপর রেগে গেলেও তাকে কিছু না বলে করিমের উপর চাপ সৃষ্টি করল, তহুরাকে নিজের ঘরে নিয়ে যাবার জন্য। সে কথা করিম তহুরাকে জানাতে, তহুরা চাচাতো ভাসুর ও দেবরদের মতলব বুঝতে পেরে বলল, তুমি না পুরুষ! কেউ অন্যায় বললে তুমি মানবে কেন? তারপর তাদের কুমতলবের কথা জানাল। করিম সাদাসিধে লোক। অতটা ভেবে দেখেনি। এখন বুঝতে পেরে বলল, তুমি ঠিক কথাই বলেছ। আমিও দেখব তারা আমার কী করে। তারপর সুখে-দুঃখে আনামকে নিয়ে তহুরার একরকম দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু যার তকদীরে যা থাকে তা ঘটবেই। তাই করিমের সাথে নিকে হবার এক বছর পর জয়নুদ্দিনের মতো করিমও একরাতে দু’চারবার পায়খানা বমি করে তহুরার ঘরেই মারা গেল। এই ঘটনার পর সবাই তাকে অপয়া মেয়ে মনে করল। মজিদের ছেলেরাও তাই ভাবল। কিন্তু মজিদ ও তার স্ত্রী আমেনা খুব দুঃখ পেল। তারা চিন্তা করল, তহুরা খুব বদনসীব মেয়ে। জন্মাবার পর বাপ মাকে খেল। বড় হয়ে দু’দুটো স্বামীকে খেল। এরপর তার কী হবে আল্লাহ জানে।
দ্বিতীয় স্বামী মারা যাবার পর তহুরার জীবনে আবার দুর্দিন নেমে এল। একদিকে অপয়া মেয়ে ভেবে তাকে দিয়ে কেউ কাজ করাতে চায় না। অদিকে তার চাচাতো ভাসুর-দেবররা ভিটেবাড়ি ছেড়ে চলে যাবার জন্য। হুমকি দিতে লাগল। শেষে তহুরা বাজারের পাশে যে রাইস মিল আছে, সেখানে কাজ নিল। তার বয়স কাঁচা হলেও দু’টো স্বামী মারা যাওয়ার পর দুঃখ-কষ্টে ও ভাবনা-চিন্তায় স্বাস্থ্য অনেক ভেঙে গেছে। ফলে আর কেউ তার শরীরের দিকে ফিরেও চায় না। রাইস মিলে কাজ নেবার পর খাওয়া পরার চিন্তা দূর হলেও চাচাতো ভাসুর-দেবরদের চিন্তা দূর হল না। কিছুদিনের মধ্যে গোপনে তারা। একবারনামার জাল দলিল করে গ্রামের লোকজন নিয়ে তহুরাকে ভিটে থেকে তাড়িয়ে দিল।
তহুরা কাঁদতে কাঁদতে আনামকে নিয়ে চাচা ও চাচাতো ভাইয়েদের কাছে এসে বলল, আনামের বাপ ভিটে বাড়ি এক বারে রেখে কোনো টাকা নেয়নি। ওরা তার ভিটে জমি দখল করার জন্য মিথ্যে দলিল করেছে। তোমরা এর প্রতিকার কর।
মজিদ কথাটা বিশ্বাস করলেও তার ছেলেরা করল না। বলল, তোর কথা সত্য হলেও আমরা কিছু করতে পারব না। কিছু করতে হলে কোর্টে মামলা করতে হবে। মামলা করতে অনেক টাকার দরকার। অত টাকা আমাদের নেই। আর তোর মতো অপয়া মেয়েকে আমরা ঘরে জায়গা দিতেও পারব না। তুই এখান থেকে চলে যা।
তহুরা কাঁদতে কাঁদতে চাচার পায়ে ধরে একটু আশ্রয় চেয়েছিল। মজিদ ছেলেদের মতের বাইরে তাকে আশ্রয় দিতে পারল না। সে এখন বুড়ো হয়েছে। কাজ-কাম করতে পারে না। ছেলেদের এন্তেজারে থাকে। তাই তহুরার কান্নাকাটি দেখেও কিছু বলতে পারল না।
সেখানে আমিনাও ছিল। স্বামীকে চুপ করে থাকতে দেখে ছেলেদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল, তহুরাকে তোরা ঘরে ঠাই না দিলেও আমি দেব। আমার বাপের যে পোড় ডাঙ্গাটা আমি পেয়েছি সেখানে ও থাকবে। তোরা আমার পেটে হয়েছি। তোদের উপর আমার যেমন টান, তহুরার উপরও তেমনি টান। সে আমার পেটে না হলেও আমি তাকে পেটের মেয়ের মতো মানুষ করেছি। তোদের একটা বোন যদি ওর মতো বিপদে পড়ত, তাহলে তাকে কি এভাবে তাড়িয়ে দিতে পারতিস্?
স্ত্রীর কথা শুনে মজিদ সাহস পেল। বলল, তোদের মা ঠিক কথা বলেছে। তাছাড়া তোরা ওকে এখানে থাকতে দিবি না কেন? এই ভিটেতে ওর বাপের অংশ রয়েছে না? তোদের মা তার ডাঙ্গাই বা দেবে কেন? তহুরা বাপের অংশ পাবে। তোরা ভিটের একদিকে একটা ঘর করে দে। সেখানে ও ছেলেকে নিয়ে থাকবে।
বাপের কথা শুনে বড় ছেলে জাব্বার রেগে উঠে বলল, চাচা-চাচির অসুখের সময় যে টাকা পয়সা তাদের চিকিৎসায় খরচ করেছ, তা তার অংশের ভিটে জমির দামের চেয়ে বেশি। তহুরা তার বাপের অংশ পাবে কোথা থেকে?
মজিদ বলল, সে সব টাকা পয়সা আমি খরচ করেছি, তোদের রোজগারের টাকা না। তোরা তখন তো ছোট ছিলি।
জাব্বার বাপের এই কথার কোনো উত্তর দিতে পারল না। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, তবু আমরা এই অপয়া মেয়েকে এখানে থাকতে দেব না। মায়ের পোড়ো ডাঙ্গাতে একটা ঘর করে দেব, সেখানে থাকবে।
শাকের ও কায়সার বড় ভাইয়ের কথায় সায় দিল।
মজিদ আর কী বলবে? কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তহুরাকে বলল, কী আর করবি মা, তোর ভাইয়েদের কথা মেনে নে। আমার কি সেদিন আছে যে তোর জন্য কিছু করব?
তহুরা চাচার অপারগতার কথা জানে। তাই মনের কষ্ট মনে চেপে রেখে বলল, বেশ তাতেই আমি রাজি।
সেই থেকে আজ প্রায় দু’বছর তহুরা আনামকে নিয়ে গ্রামের শেষ প্রান্তে মায়ের পোড়ো ডাঙ্গাতে বাস করছে। আর রাইস মিলে কাজ করে মায়ে-পুতের সংসার চালাচ্ছে।
আজ আনাম দু’দিনের অভুক্ত শরীর টলতে টলতে নানার বাড়ির কাছে এসে নানাকে দেখতে পেয়ে মায়ের কথা বলল।
মজিদ নাতির মুখের দিকে চেয়ে বলল, কিরে তোর মুখ অত শুকনো কেন? মনে হচ্ছে কিছু খানি।
আনাম ছলছল চোখে মায়ের অসুখের কথা ও দু’দিন না খেয়ে থাকার কথা বলল।
মজিদ তাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে স্ত্রীকে ডেকে তহুরার কথা বলে বলল, আনামকে কিছু খেতে দাও। ও দু’দিন না খেয়ে আছে।
আমিনা বড় বৌকে বলল, বৌমা এর জন্য কিছু খাবার নিয়ে এসো। বড়বৌ রহিমন এক পলক আনামের দিকে চেয়ে নিয়ে রাগে গরগর করতে করতে বলল, ঘরে কি খাবার তৈরি রয়েছে যে, বললেই সাথে সাথে এনে হাজির করব?
আমিনা বলল, সে কথা আমি বলিনি। মুড়ি বা বাসি ভাত থাকলে নিয়ে এস।
রহিমন ঝংকার দিয়ে বলল, চাল ছিল না বলে গত রাতে ভাত কম রান্না হয়েছে। বাসি ভাত নেই। আর যে কটা মুড়ি ছিল ছেলে-মেয়েরা খেয়েছে। এইমাত্র আপনার বড় ছেলে চাল কিনে পাঠিয়েছে। এখন রান্না চাপাব। এই কথা বলে সে অন্যত্র চলে গেল।
আনাম বড় মামির কথা শুনেছে। সে নানাকে বলল, আমি কিছু খাব না। তুমি টাকা দাও।
মজিদ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে স্ত্রীর দিকে চেয়ে বলল, আমার কাছে তো কিছু নেই, তোমার কাছে থাকলে দাও।
আমিনা বলল, আমার কাছে দশ টাকা আছে এনে দিচ্ছি। তারপর একটা দশ টাকার নোট এনে আনামের হাতে দিল।
মজিদ স্ত্রীকে আবার বলল, কেজিখানেক চাল আর কয়েকটা আলু একটা কাপড়ে বেঁধে দাও।
আমিনা চাল আলু কাপড়ে বেঁধে এনে আনামের হাতে দিয়ে বলল, তোকে খেতে দেবার মতো ঘরে কিছু নেই ভাই। এগুলো নিয়ে যা, তোর মা বেঁধে খাওয়াবে।
মেজ বৌ সফুরা আনামকে পুঁটলি হাতে চলে যেতে দেখে বড় জাকে কথাটা জানিয়ে বলল, মনে হয় আম্মা চাল বেঁধে দিয়েছে।
রহিমন শুনে রেগেমেগে শ্বশুর শাশুড়ির কাছে এসে বলল, ঐ রাক্ষুসী দুটো স্বামীকে খেয়েছে, এবার আমাদেরকেও না খেয়ে ছাড়বে না। আমাদের কি চাষের জিনিস যে, তোমরা বিলি করছ? আমাদের ছেলে-মেয়েরাই দু’বেলা পেটপুরে খেতে পায় না, আর তোমরা কিনা ঐ রাক্ষুসীকে চাল দিলে?
মজিদ ও আমিনা বড় বৌয়ের কথার কোনো প্রতিবাদ না করে চুপ করে রইল।
রহিমন তাদের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে গজর গজর করতে করতে সেখান থেকে চলে গেল।
.
আনাম ফেরার পথে বাজারে ওহিদ ডাক্তারের ডিসপেন্সরিতে গিয়ে তাকে মায়ের অসুখের কথা বলে ওষুধ দিতে বলল।
ওহিদ ডাক্তারের বাড়ি এই গ্রামের বাজারের পাশেই। ঢাকায় কোনো এক ডাক্তারের কাছে পঁচিশ বছর কমপাউন্ডারী করে এসে বছর দশেক হল নিজের বাড়ির সদরে ডিসপেন্সরী খুলে ডাক্তারি করছে। লোক হিসাবে খুব ভালো। শহরে অতদিন থাকলেও শহরের চাল চলন গ্রহণ করেনি। নামাযী মুসুল্লী লোক। বাংলায় ধর্মীয় বইপত্র অনেক পড়েছে, এখনও পড়ে। গরিবের মা-বাপ। তাদেরকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করে। স্বামী-স্ত্রীর সংসার। তাদের কোনো ছেলে-মেয়ে হয়নি। পৈত্রিক কিছু জমি জায়গা আছে। তাতে সংসার চলেও উদ্ধও হয়। গ্রামের পয়সাওয়ালা লোকেরা তার কাছে রুগী নিয়ে আসে না। তারা পাস করা ডাক্তারের কাছে যায়। তাতে ওহিদ ডাক্তারের কোনো দুঃখ নেই। গরিবদের নিজের খরচে চিকিৎসা করেই সুখী। সে গ্রামের প্রায় সবাইকেই চিনে। দেখা হলেই তাদের খোঁজ-খবর নেয়। তহুরার সব কথাই সে জানে। আনামকেও চিনে। আনামের কথা শুনে বলল, ওষুধ দিলে টাকা লাগবে। টাকা এনেছিস? আনামকে নাতির মতো মনে করে একটু রসিকতা করল।
আনাম দশ টাকার নোটটা টেবিলের উপর রেখে বলল, দশ টাকা এনেছি।
ওহিদ ডাক্তার অন্য একজন রুগীর সঙ্গে কথা বলছিল বলে আনামের দিকে ভালো করে তাকায়নি। তাকে টাকা দিতে দেখে তার দিকে চেয়ে করুণ মুখ দেখে বলল, কিরে তোরও কি অসুখ করেছে নাকি?
আনাম বলল, না আমার কিছু হয়নি। তুমি তাড়াতাড়ি ওষুধ দাও।
: তোর মায়ের কী অসুখ হয়েছে?
: জ্বর হয়েছে।
: কবে থেকে?
: দু’সপ্তাহ হয়ে গেল।
: তা এতদিন আসিসনি কেন?
: আনাম কিছু না বলে চুপ করে রইল। ও বুঝেছি, তোর মায়ের খুব নাক, বিনা পয়সায় ওষুধ নেবে না। এ টাকা কোথায় পেলি?
: নানা দিয়েছে।
ওহিদ ডাক্তার হুঁ বলে এক শিশি মিকচার তৈরি করে আনামের হাতে দিয়ে বলল, তিন ঘণ্টা পর পর এক দাগ করে খেতে বলবি। তারপর টাকাটা নিয়ে তার হাতে দেবার সময় বলল, তোর মাকে বলিস, ওহিদ ডাক্তার টাকা কামাবার জন্য ডিসপেন্সারি দেয়নি। আরও বলিস্, বিকেলে তাকে দেখতে যাব।
আনাম ওষুধের শিশি নিয়ে চলে গেল।
ওহিদ ডাক্তার তার দিকে চেয়ে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে চিন্তা করল, তহুরা ছোট বেলায় এতিম হয়েছিল। তার ছেলে আনামও তাই।
.
আনাম ঘরে এসে ওহিদ ডাক্তারের কথা বলে মাকে প্রথমে ওষুধ খাওয়াল। তারপর টাকাটা তার হাতে দিয়ে বলল, নানা টাকা ও চাল আলু দিয়েছে।
তহুরা অসুখে ভুগে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। তার উপর এখনও গায়ে বেশ জ্বর। উঠে বসবারও ক্ষমতা নেই। কী করে রান্না করবে ভাবতে লাগল।
আনাম মায়ের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, তুমি শুয়ে শুয়ে কী করে রান্না করতে হয় বলে দাও, আমি রান্না করি।
তহুরা বলল, না বাপ, তুই পারবি না। তোর নাসিমা খালাকে ডেকে নিয়ে আয়। সে আলু ভাতে এক মুঠো বেঁধে দিয়ে যাবে।
নাসিমা তহুরার সমবয়সী। একই পাড়ায় তাদের ঘর। ছোট বেলায় এক সঙ্গে খেলাধুলা করেছে। নাসিমার বিয়ে একই গ্রামে তার খালাতো ভাইয়ের সাথে হয়েছে। তাদের ঘর তহুরার ঘরের অল্প দূরে। তহুরা এখানে এসে বাস করার। পর থেকে দুজন দুজনের কাছে প্রায় যাতায়াত করে। অসুখ বিসুখে একে অপরের দেখাশুনা করে। তহুরা অসুখে পড়ার পর নাসিমা প্রতিদিন একবার করে এসে তার সেবাযত্ন করে যায়। তারাও গরিব। তবু এটা সেটা এনে তহুরাকে খেতে দিয়ে যায়। তহুরা নিজে না খেয়ে ছেলেকে খাওয়ায়। গত দু’দিন তাদেরও হাঁড়ি চড়েনি। তাই এই দু’দিন তহুরাকে কিছু দিতে পারেনি। গত রাতে তার স্বামী কিছু চাল কিনে এনেছে। আজ সকাল সকাল রান্না করে তহুরার জন্য এক বাসন ভাত নিয়ে যাবে ভেবে রেখেছে। রান্না শেষ করে ছেলে- মেয়েদের খাইয়ে নিজেও খেয়ে উঠেছে। এমন সময় আনাম এসে বলল, খালা, মা তোমাকে এক্ষুনি আমার সঙ্গে যেতে বলেছে।
নাসিমা মনে করল, তাহুরার বুঝি খারাপ কিছু হয়েছে। আতঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, তোর মা কেমন আছে?
আনাম বলল, মায়ের খুব জ্বর। ওহিদ ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে। তুমি চল না খালা, মা উঠতে পারেনি। নানা চাল আলু দিয়েছে। রান্না করার জন্য মা তোমাকে ডাকতে পাঠাল।
নাসিমা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আনামের শুকনো মুখ দেখে ও তার কথা শুনে যা বোঝার বুঝে গেল। ভাত বেড়ে বলল, তুই এগুলো তাড়াতাড়ি খেয়ে নে, তারপর যাব।
নাসিমা আনামকে মাঝে মাঝে ঘরে নিয়ে এসে খাওয়ায়। তাই খাওয়ার কথা বলতে সে আর দেরি করল না, গোগ্রাসে খেতে শুরু করল।
তার খাওয়া দেখে নাসিমার চোখে পানি এসে গেল। তারপর খাওয়া হয়ে যেতে একটা বাসনে কিছু ভাত তরকারি নিয়ে আনামকে সাথে করে তাদের ঘরে এল।
মিকচার খাওয়ার ফলে তহুরার জ্বর একটু কমেছে। আনামের ফিরতে দেরি দেখে তার কথা চিন্তা করছিল।
নাসিমা এসে প্রথমে তহুরার মাথা ঘোয়াল। তারপর গা মুছিয়ে ভাত খাইয়ে রান্না করে দিয়ে ঘরে ফিরে গেল।
.
বিকেলে ওহিদ ডাক্তার এসে তহুরাকে রাগারাগি করে বলল, তোর এতদিন অসুখ হয়েছে, আমাকে খবর দিলি না কেন? দিলে এতদিন ভুগতিস্ না। তারপর পরীক্ষা করে বলল, তোর ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছি। কয়েকটা ট্যাবলেট দেব, মিকচার খেয়ে খাবি। আর শোন, তুই ভালো হয়ে যাবার পর আনামকে আমার কাছে দিবি। আমি ওকে লেখাপড়া করিয়ে ডাক্তারি শেখাব। কবে থেকে সেকথা বলে আসছি তুই যদি আমার কথা শুনিস….! জানি তুই ওকে ছেড়ে থাকতে পারবি না। তাই ভেবেছি, সারাদিন আমার কাছে থাকলেও রাতে তোর কাছে থাকবে। তারপর ওহিদ ডাক্তার আনামকে নিয়ে চলে গেল।
তহুরার অসুখ দিন দিন বেড়েই চলল। ওহিদ ডাক্তার প্রতিদিন একবার করে এসে দেখে যাচ্ছে, ওষুধ পাল্টে দিচ্ছে; কিন্তু তহুরার অসুখ কিছুতেই ভালো হল na। ক্রমশঃ সে কাহিল হয়ে পড়ল। মায়ের অবস্থা দেখে এবং উপোসের উপর উপোস দিয়ে আনামের অবস্থাও কাহিল হয়ে পড়েছে। ওহিদ ডাক্তার প্রতিদিন তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে তবু একবেলা খাওয়ায়। নাসিমাও যতটুকু পারছে মা ছেলেকে সাহায্য করছে। আনাম অনেকবার ভেবেছে সে লোকের বাড়িতে কাজ করবে; কিন্তু অসুস্থ মাকে একা ঘরে রেখে কোথাও যেতে তার মন চায় না।
একদিন তহুরার অবস্থা খুব খারাপের দিকে। কোনো রকমে আনামকে বলল, তোর নানা-নানিকে ডেকে নিয়ে আয়।
আনাম গিয়ে তাদেরকে মায়ের কথা বলে ডেকে নিয়ে এল।
মজিদ ও আমিনা যখন এল তখন তহুরার অন্তিম মুহূর্ত।
চাচা-চাচিকে দেখে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, আমি আর বাঁচব না। তোমরা আমার আনামকে দেখ।
আমিনা তার চোখের পানি মুছে দিয়ে ভিজে গলায় বলল, আল্লাহ চাহে তুই ভালো হয়ে যাবি।
তহুরার অবস্থা দেখে মজিদের চোখেও পানি এসে গেল। চোখ মুছে বলল, তুই আমাকে মাফ করে দে মা। আমার সামর্থ্য থাকলে আজ তোর এই অবস্থা হতো না। তোকে বড় ডাক্তার দেখাতাম। তারপর দু’হাত তুলে দেওয়া চাইল, “আল্লাহগো, তুমি তহুরাকে ভালো করে দাও। এদের উপর রহম কর।”
সেদিন ঘরে এসে মজিদ ছেলেদেরকে বলল, আজ তোদের মাকে নিয়ে তহুরাকে দেখতে গিয়েছিলাম, সে বোধহয় আর বাঁচবে না। তোদের মা তহুরার কাছে আছে। তোরা তিনভাই গিয়ে একবার দেখে আয়। পারলে কিছু টাকা পয়সা দিস্। হাজার হোক তোদের চাচাত বোন।
ছেলেরা হা-না কিছু বলল না। একে একে বাপের কাছ থেকে চলে গেল। পরের দিন সকালে নাসিমার স্বামী নিজাম এসে মজিদকে জানিয়ে গেল, তহুরা ভোর বেলা আযানের সময় মারা গেছে।
শুনে মজিদের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। “ইন্না লিল্লাহে ওয়াইন্না ইলাইহে রাজেউন” পড়ে ছেলেদেরকে বলল, তহুরার জন্য তোরা কিছুই করলি না। মেয়েটা জীবনে অনেক দুঃখ-কষ্ট পেয়ে মরল। এখন তোরা দাফন-কাফনের ব্যবস্থাটা অন্তত কর।
২
দাফন-কাফনের পর মজিদ আনামকে সাথে করে ঘরে নিয়ে এসে ছেলেদের ও বৌদের বলল, এই এতিম ছেলেটা কোথায় আর যাবে? একে তোরা মানুষ কর। এতিমের উপর দয়া করলে আল্লাহ তোদের ভালো করবে।
এরপর থেকে আনাম মামাদের কাছে মানুষ হতে লাগল। সে মামাদের গরু ছাগল চরায়। তাদের ফাইফরমাস খাটে। তার বদলে তিন বেলা খেতে দেয়। কিন্তু কেউ তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না। মামা-মামিরা সামান্য কারণে তার মায়ের কথা তুলে গালাগালি করে বলে, অপয়া মেয়েটা মরে গিয়ে ছেলেটাকে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেছে। থালা থালা ভাত খাবে আর কাজের নামে অষ্টরম্ভা। কোনো কাজ করতে একটু দেরি হলে মারধর করে।
একদিন সকালে জাব্বারের বড় ছেলে আজিম আনামকে টাকা দিয়ে বলল, যা বাজার থেকে আলু কিনে নিয়ে আয়। সে আনামের চেয়ে চার পাঁচ বছরের বড়।
বড় মামি যখন আজিমকে আলু কিনতে দেয় তখন আনাম দেখেছে। বলল, আমি এখন গরু-ছাগল মাঠে নিয়ে যাব। বড় মামি তো তোমাকে বাজারে যেতে বলল।
আজিম রেগে উঠে বলল, দেখ, বেশি কথা বলবি না। বাজার থেকে এসে মাঠে যাবি।
আনাম বলল, দেরি হলে বড় মামা আমাকে বকবে। আমি বাজারে যেতে। পারব না।
আজিম আরও রেগে গিয়ে মারতে মারতে বলল, যাবি না মানে, তোর বাপ যাবে। যা বলছি, তা না হলে মেরে শেষ করে দেব। আমাদের খাবি, আবার আমার মুখের উপর চোপড়া করবি?
আনাম কাঁদতে কাঁদতে বাজার থেকে আলু কিনে নিয়ে এসে দেখল, আজিম সেইখানে দাঁড়িয়ে আছে।
আজিম তার হাত থেকে আলুর ঠোঙাটা নিয়ে বলল, যা এবার তুই তোর কাজে যা।
আনাম কিছু না বলে গরু-ছাগল নিয়ে মাঠে চরাতে গেল।
আনামের লেখাপড়া করার খুব ইচ্ছা হয়। মামাতো ভাই বোনেরা যখন পড়ে তখন সে সংসারের নানা রকম কাজ করে। আজ আজিমের হাতে মার খেয়ে সেই ইচ্ছাটা আরও বেশি হল। রাতে নানা-নানির কাছে ঘুমাবার সময় নানাকে বলল, ওহিদ ডাক্তার মাকে বলেছিল, সে আমাকে লেখাপড়া করিয়ে ডাক্তারি শেখাবে। আমি এখানে থাকব না, তার কাছে থাকব।
মজিদ জানে এ বাড়ির কেউ আনামকে দেখতে পারে না। যখন তখন গালাগালি করে, মারধর করে। তাই এখানে থাকতে চাচ্ছে না। ভাবল, ওহিদ ডাক্তার যে কথা বলেছে তা ঠিক নয়। আসলে তার ছেলেমেয়ে নেই, কোনো আত্মীয়-স্বজনও নেই। তাই ফাইফরমাস শোনার জন্য হয়তো তহুরাকে কথাটা বলেছিল। তবে তার কাছে থাকলে এদের অত্যাচার থেকে আনাম রেহাই পেত। ঠিকমত খেতে পরতেও পেত।
নানাকে চুপ করে থাকতে দেখে আনাম বলল, তুমি কিছু বলছ না কেন? জান নানা, আমি ডাক্তার হবার পর আগে তোমার ও নানির বাতের অসুখ সারাব।
মজিদ নাতির ছেলেমানুষি কথা শুনে হেসে উঠে বলল, আরে ভাই ডাক্তার হওয়া কি চাট্টিখানি কথা? কত লেখাপড়া করলে তবে ডাক্তার হওয়া যায়। তুই ছেলে মানুষ, ওসব বুঝবি না। আর শোন্, ওহিদ ডাক্তারের নাম ধরে কথা বলবি না। সে মুরুব্বি মানুষ, তাকে ডাক্তার নানা বলে ডাকবি।
আনাম বলল, আচ্ছা, তারপর আবার বলল, ডাক্তার নানার কাছে থাকার কথা কিছু বলছ না কেন?
মজিদ কী বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইল।
এতক্ষণ আমি চুপচাপ তাদের কথা শুনছিল। স্বামীকে চুপ করে থাকতে দেখে আনামকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুই বললেই তোর নানা তোকে ওহিদ ডাক্তারের কাছে দিতে পারবে না। কারণ তোর মামারা খুব রেগে যাবে। তারা তোকে তার কাছে যেতে দেবে না। আর তোর নানা যদিও তার কাছে দেয়, তা হলে তারা তোকে জোর করে নিয়ে চলে আসবে। তখন হয়তো মারধর করবে।
নানির কথা শুনে আনাম আর কিছু বলল না। মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।
এরপর যত দিন যেতে লাগল তত আনামের প্রতি মামা-মামিদের অত্যাচার বেড়ে চলল। এভাবে এক বছর পার হবার পর আনাম তাদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে চিন্তা করল, এখন তো মা নেই। সে একা। এবার সে অন্য কোথাও চলে যাবে। এর মধ্যে তার নানি আমিনা মারা গেল। আমি যতদিন বেঁচে ছিল, ততদিন আনামের খাওয়া পরার দিকে লক্ষ্য রাখত। সে মারা যাবার পর মামিরা তাকে ঠিকমত খেতে দেয় না। আধপেটা খেতে দেয়। সকালের নাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। কোনো কোনো দিন ভাত শেষ হয়ে গেছে বলে খেতে দেয় না। আনাম সে রাতে মায়ের কথা মনে করে কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজায়।
মজিদ সবকিছু দেখেও ছেলে-বৌদের কিছু বলতে পারে না। স্ত্রী মারা যাবার পর সে যেন বোবা হয়ে গেছে।
আনাম যেদিন রাতে এখান থেকে পালিয়ে যাবে বলে ঠিক করল, সেদিন রাতে তার জ্বর হল। ভেবে রাখল, জ্বর ভালো হলে পালিয়ে যাবে। সকালেও জ্বর রয়েছে। তাই সে শুয়ে রইল।
জাব্বার বেলাতে গরু-ছাগল গোয়ালে বাঁধা রয়েছে দেখে রেগে গিয়ে শোয়া অবস্থায় আনামকে ভীষণ মারধর করতে করতে বলল, নবাবের বাচ্চার মতো এত বেলা তানিক শুয়ে রয়েছিস, গরু-ছাগল তোর কোন বাবা মাঠে চরাতে যাবে? কেন সে শুয়ে রয়েছে, একথা জিজ্ঞেস করার দরকার মনে করল না।
আনাম জানে জ্বরের কথা বললে মামা বিশ্বাস করবে না, বরং আরও বেশি মারবে। তাই সে কান্নাকাটি করলেও কোনো কথা বলল না।
মজিদ থাকতে না পেরে বলল, ওকে মারছিস্ কেন? ওর তো খুব জ্বর, তাই শুয়ে আছে।
আব্বার কথা শুনে জাব্বার মার বন্ধ করে সেখান থেকে চলে গেল।
সেদিন মামারা যখন ঘরে ছিল না তখন আনাম ওহিদ ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলল, ডাক্তার নানা, তুমি নানাকে বলে আমাকে তোমার কাছে এনে রাখ। ওখানে থাকতে আমার মন চায় না।
: কেন রে, সেখানে আবার কী হল? মামা-মামিদের কাছে তো বেশ ভালোই আছিস?
আনাম চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে জ্বরের কথা বলে শরীরের মারের দাগ দেখিয়ে বলল, দেখ না, কত ভালো আছি। মামারা যখন তখন মারে। মামিরা পেট ভরে খেতে দেয় না। সারাদিন কাজ করি; তবুও আমাকে কেউ দেখতে পারে না। যা-তা করে গালাগালি করে।
তার কথা শুনে ওহিদ ডাক্তারের চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। চোখ মুছে বলল, তোর মামারা কি তোকে আমার কাছে রাখবে?
আনাম বলল, তুমি মামাদেরকে বলবে কেন? নানাকে বলবে।
ওহিদ ডাক্তার বলল, ঠিক আছে তুই এখন যা, আমি তোর নানার সাথে দেখা করব। তারপর একপাতা সিটালজিন ট্যাবলেট তার হাতে দিয়ে বলল, রোজ তিনটে করে খাবি। তাহলে জ্বর সেরে যাবে। আর গায়ের ব্যথাও থাকবে না। তবে জ্বর ছেড়ে গেলে খাবি না।
আনাম আর কিছু না বলে চলে এল।
.
কয়েক দিন পর ওহিদ ডাক্তার একদিন মজিদের সঙ্গে দেখা করে বলল, আনামকে আমার কাছে দিয়ে দাও। তোমরা তার মায়ের প্রতি অবিচার করেছ। এখন আবার তার ছেলের প্রতিও করছ। তহুরার স্বামীর ভিটেটা তার চাচাতো ভাসুর ও দেববরা বেঈমানি করে নিয়ে নিল, সেটার ব্যাপারেও কিছু করলে না। তাকে তার বাপের অংশও দিলে না। এসব করা কি তোমার ঠিক হয়েছে?
ওহিদ ডাক্তারের কথা শুনে মজিদ রাগতে গিয়েও পারল না। সে এখন বুড়ো হয়েছে। স্ত্রী মারা যাবার পর মউতের ভয় এসেছে। তহুরার প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে সে কথা তহুরা মারা যাবার পর প্রায়ই মনে হয়। এখন আবার আনামের প্রতি ছেলেদের ও বৌদের দুর্ব্যবহার দেখে খুব কষ্ট অনুভব করে। কিন্তু এখন আর সে কীই বা করতে পারে? নিজেই ছেলে-বৌদের দয়ার উপর রয়েছে। তার কথা তারা শুনবে কেন?
তাকে চুপ থাকতে দেখে ওহিদ ডাক্তার বললেন, কী হল মজিদ ভাই, কিছু বলছ না কেন?
এমন সময় জাব্বার সেখানে এসে ওহিদ ডাক্তারের কথা শুনতে পেয়ে। আব্বাকে জিজ্ঞেস করল, ডাক্তার চাচা তোমাকে কী কথা বলছে?
মজিদ বলল, ডাক্তার ভাই আনামকে নিজের কাছে রাখতে চায়।
জাব্বার রেগে গিয়ে বলল, কেন?
মজিদ বলল, সে কথা আমি বলব কী করে?
ডাক্তার ভাইকেই জিজ্ঞেস কর।
ওহিদ ডাক্তার কাউকে পরওয়া করে না। জাব্বার জিজ্ঞেস করার আগেই বলল, আনামকে আমি লেখাপড়া করিয়ে ডাক্তার করব।
জাব্বার প্রথমে চিন্তা করল, আপদটা গেলেই ভালো। আবার চিন্তা করল, আনাম চলে গেলে তাদের গরু-ছাগল দেখবে কে? ফাইফরমাস শুনবে কে? এইসব ভেবে বেশ রাগের সঙ্গে বলল, না, আনাম আমাদের কাছেই থাকবে। এতিম ছেলেদের আবার লেখাপড়া?
ওহিদ ডাক্তার বলল, কিন্তু তোমরা তো তার প্রতি খুব অবিচার করছ? ছেলেটা সারাদিন পরিশ্রম করে; তবু তোমরা তাকে মারধর কর, ঠিকমত খেতে দাও না।
এই কথা শুনে জাব্বার আরও বেশি রেগে উঠে বলল, এসব কথা তোমাকে কে বলেছে?
ওহিদ ডাক্তার বলল, বাবাজি অত রেগে যাচ্ছ কেন? কে আবার বলবে? এসব কথা কি আর চাপা থাকে? গ্রামের সবাই জানে, তোমরা তহুরার প্রতি যেমন অবিচার করেছ, তেমনি তার এতিম ছেলে আনামের প্রতিও করছ। তোমরা কি মৌলবীদের মুখে শুননি? আল্লাহ কোরআন পাকে বলেছেন, “এতিমদেরকে তাদের সম্পদ বুঝিয়ে দাও! খারাপ মালামালের সাথে ভালো মালামালের অদল-বদল করো না। আর তাদের ধন-সম্পদ নিজেদের ধন সম্পদের সাথে সংমিশ্রিত করে তা গ্রাস কর না। এটা নিশ্চয় বড় মন্দ কাজ।” [আল কোরআন-সূরা আন-নিসা, আয়াত নং- ২, পারা-৪।]
জাব্বার রাগ সামলাতে পারল না। চিৎকার করে বলল, কোরআনে যে সব কথা লেখা আছে, সে সবের তুমি কটা মেনে চল ভেবে দেখেছ? যাও চলে যাও, আনামের জন্য অত দরদ দেখাতে হবে না। আনাম আমাদের ভাগনা। তার কথা আমরা ভাবব, তোমাকে ভাবতে হবে না। এ যে দেখছি মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি।
ওহিদ ডাক্তার বলল, কুরআনের কথা সবটা হয়তো মানতে পারি না; কিন্তু জেনে শুনে তোমাদের মতো এত বড় অন্যায় কোনোদিন করিনি। এই কথা বলে সে হন হন করে চলে গেল।
জাব্বারের রাগ এবার তার আব্বার উপর পড়ল। বলল, তুমিই তাহলে ওহিদ ডাক্তারকে এইসব কথা বলেছ?
মজিদ গভীর স্বরে বলল, না, আমি বলিনি।
জাব্বার বলল, ঐ শুয়োরের বাচ্চা আনাম তা হলে বলেছে? ঘরে আসুক, আজ তাকে যা করার করব।
জাব্বার ভাইদের সঙ্গে পরামর্শ করে সেদিন রাতে তিন ভাই আনামকে ভীষণ মারধর করে বলল, ফের যদি ঘরের কথা বাইরের কাউকে বলিস, তা হলে তোকে জ্যান্ত কবর দিয়ে দেব।
মজিদ ছেলেদেরকে তিরস্কার করে বলল, এতিমের উপর এত জুলুম আল্লাহ সহ্য করবে না।
জাব্বার বলল, তুমি চুপ থাক আব্বা। যে ছেলে ঘরের কথা বাইরের মানুষকে বলে, সে ছেলেকে মেরে ফেলাই ভালো।
মার খেয়ে সেই রাতে আনামের ভীষণ জ্বর এল। জ্বরের ঘোরে ভুল বকতে লাগল।
মজিদ সারা রাত জেগে তার মাথায় জলপট্টি দিল। সকালে ছেলেদেরকে বলল, তখন তোদেরকে অত করে বললাম বেশি মারি না। আমার কথা শুনলি না। ছেলেটা সারারাত জ্বরে ভুল বকেছে। এখনও কোনো হুঁশ নেই। ডাক্তার এনে দেখা। কিছু একটা হয়ে গেলে তখন কী হবে?
মেজ ছেলে শাকের, বলল, কী আর হবে, মরে গেলে কবর দিয়ে দেব। ওকে নিয়ে আমাদের আর ঝামেলা পোহাতে হবে না।
মজিদ রেগে উঠে বলল, শাকের, মুখ সামলে কথা বল। এতিমের উপর জুলুম করলে আল্লাহ গজব পাঠাবে।
ছোট ছেলে কায়েস বলল, তহুরাকে তুমি মানুষ করে দু’দু’বার বিয়ে দিয়েছ। তারপর তাকে আমরা বাস করার জায়গা দিয়েছি, এখন আবার তার ছেলের ভরণ- পোষণ করছি, এতে আমরা অন্যায় করলাম কোথায়? আল্লাহ কী এসব দেখবে না? না এসব না দেখেই গজব পাঠাবে? আমাদের ডাক্তার আনার পয়সা নেই। হায়াত থাকলে আনাম বাঁচবে, না থাকলে বাঁচবে না। কারও হায়াত শেষ হয়ে গেলে, ডাক্তার তো তাকে হায়াত দিতে পারবে না।
মজিদ ছেলেদের মনোভাব বুঝতে পেরে বলল, হায়াত-মউত আল্লাহর ওপর, একথা সবাই জানে, তবু রোগের চিকিৎসা করাতে হয়। এবার তোরা তোদের কাজে যা, আল্লাহ আনামের তকদীরে যা রেখেছে তাই হবে।
দু’তিন দিন হয়ে গেল আনামের জ্বর কমছে না। জ্বরের ঘোরে ভুল বকতে বকতে এক সময় বলতে আরম্ভ করল, “আমি ডাক্তার নানার কাছে থাকব। সে আমাকে ডাক্তার করবে বলেছে। আমি এখানে কেন? মায়ের কাছে যাব।”
মজিদ দিনের বেলা বৌদের সাহায্যে আনামের মাথায় পানি ঢালে। কিন্তু রাতে তারা কেউ আনামের কাছে আসে না। ছেলেরা তো তার কোনো
খোঁজই নেয় না। বুড়োর পানি ঢালার ক্ষমতাই নেই। যতক্ষণ পারে মাথায় জলপট্টি দেয়।
চার দিনের দিন মজিদ আর স্থির থাকতে পারল না। নিজেই ওহিদ ডাক্তারের কাছে ওষুধ আনতে গেল। তার কাছে যাবার ইচ্ছা না থাকলেও এক রকম বাধ্য হয়ে গেলো। কারণ অন্য ডাক্তারের কাছে গেলে টাকা ছাড়া ওষুধ দিবে না। তার কাছে টাকা নেই। ছেলেদেরকেও বলতে সাহস করল না।
মজিদকে দেখে ওহিদ ডাক্তার সালাম বিনিময় করে বলল, কী খবর মজিদ ভাই? এস বস।
মজিদ বসে বলল, আনামের কয়েক দিন থেকে খুব জ্বর। সব সময় ভুল বকছে। ওকে ওষুধ দাও, টাকাটা পরে দেব।
ওহিদ ডাক্তার বলল, এ রকম রুগীকে তো পরীক্ষা না করে ওষুধ দিতে পারব না। তারপর ডাক্তারী ব্যাগের মধ্যে কয়েক পদের ওষুধ ও ষ্টেথিসকোপ ভরে নিয়ে বলল, চল, ওকে দেখে তারপর ওষুধ দেব।
মজিদ এসেও বিপদে পড়ে গেলো। ভেবেছিল চুপে চুপে এসে ওষুধ নিয়ে যাবে। এখন ওহিদ ডাক্তার গেলে ছেলেরা জেনে গিয়ে রেগে যাবে। ডাক্তারের ফি তো দূরের কথা, ওষুধের দামও দেবে না।
ওহিদ ডাক্তার তার মনোভাব বুঝতে পেরে বলল, মজিদ ভাই, একটা কথা জান না বোধ হয়, ডাক্তাররা শুধু টাকার জন্য ডাক্তারি করে না। তাড়াতাড়ি চল, আমাকে আবার পুব পাড়ায় একটা রুগী দেখতে যেতে হবে।
মজিদ কিছু না বলে তার সঙ্গে রওয়ানা দিল।
ওহিদ ডাক্তার আনামকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে চিন্তিত মুখে বলল, এর সারা শরীর মারের আঘাতে কালশীরা পড়ে গেছে। ছি ছি, মজিদ ভাই, এতিম ছেলেকে কেউ এরকমভাবে মারে? তাছাড়া ছেলেটা কয়েকদিন ধরে জ্বরে অজ্ঞান হয়ে রয়েছে, আমাকে আগে খবর দাওনি কেন?
মজিদ বলল, ডাক্তার ভাই, ওসব কথা বলে লজ্জা দিও না। তুমি চিকিৎসা করে ছেলেটাকে বাঁচাবার ব্যবস্থা কর।
ওহিদ ডাক্তার বলল, বাঁচা-মরা আল্লাহ’র ওপর। তুমি অনেক দেরিতে আমাকে নিয়ে এসেছ। এখন আমার কিছু করার নেই। তবু আমি ওষুধ দিয়ে যাচ্ছি। কেমন থাকে না থাকে খবর দিও। আর আমিও রোজ একবার এসে দেখে যাব। তারপর ওষুধপত্র দিয়ে চলে গেল।
মজিদের ছেলেরা তখন ঘরে ছিল না। সবাই কাজে বেরিয়ে গেছে। দুপুরে ঘরে খেতে এসে স্ত্রীদের মুখে আব্বা ওহিদ ডাক্তারকে নিয়ে এসেছিল শুনে রেগে গেলেও কেউ রাগ করল না।
ওহিদ ডাক্তার আনামকে পরীক্ষা করে বুঝতে পেরেছিল, তার বাঁচার আশা নেই। তবু চেষ্টার ত্রুটি করল না। প্রতিদিন দু’বেলা এসে দেখে যেতে লাগল। কয়েকবার ওষুধ পান্টাল। কিন্তু আনামের অসুখের কোনো উন্নতি হল না। আট দিনের দিন আনাম মারা গেল।
তার দাফন-কাফনের সময় ওহিদ ডাক্তার এসেছিল। কবর দেওয়ার পর ফিরে আসার সময় মজিদ ও তার তিন ছেলেকে বলল, সেদিন তোমাদেরকে যা কিছু বলেছিলাম, তা আল্লাহপাকের কোরআনের কথা। তবু যদি তোমরা মনে। কষ্ট পেয়ে থাকো, তা হলে আমাকে মাফ করে দাও।
তিন ভাই কিছু বলল না। মজিদ ভিজে গলায় বলল, তুমি আল্লাহর কথা বলেছ, তাতে আমাদের মনে কষ্ট হবে কেন? আর তুমিই বা মাফ চাইছ কেন?
ওহিদ ডাক্তার বলল, তাহলে আর দু’একটা কথা বলছি শোন, তোমরা তওবা করে কেঁদে কেঁদে আল্লাহ পাকের কাছে মাফ চাও। নচেৎ তহুরা ও তার ছেলে আনামের প্রতি যা আচরণ করেছ, সেজন্য ইহকালে কি হবে বলতে পারব না; তবে পরকালে ভীষণ শাস্তি পাবে। এটাও কোরআনের কথা। একটা হাদিস বলছি শোন, “রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলেছেনঃ “যে গৃহে এতিমের সহিত ভালো ব্যবহার করা হয়, তাহাই মুসলমানদের সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট গৃহ এবং যে গৃহে এতিমদের সহিত মন্দ ব্যবহার করা হয়, তাহাই মুসলমানদের সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট গৃহ।” [বর্ণনায়ঃ হজরত আবু হোরায়রা (রাঃ) ইবনে মাযাহ।]
মজিদ চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, ডাক্তার ভাই, তুমি সেদিন ও আজ যে সব কথা এবং কোরআন-হাদিসের বাণী শোনালে, তা আমরা জানতাম না। আমরা মুখ মানুষ। তুমি এইসব বলে আমাদের অনেক উপকার করলে। আমরা তওবা করে আল্লাহর কাছে মাফ চাইব।
ওহিদ ডাক্তার আল হামদুলিল্লাহ বলে সালাম বিনিময় করে চলে গেল।