এক প্রেমিক পুরুষের ইতিবৃত্ত
এন্তার প্রেম করেছে নন্তু তার এই বেয়াল্লিশ বছরের জীবনে।
জীবনভোরই নন্তু প্রেমে পড়ছে।
ওর প্রেমের প্রথম ইতিহাস খুঁজতে গেলে চলে যেতে হবে ওর আট বছর বয়সে।
হ্যাঁ, ঠিক আট বছর, তখন নন্তু প্রেমে পড়ল। মোক্ষমভাবেই পড়ে গেল।
প্রেমপাত্রী তার সদ্য-বিবাহিত মাসতুতো বৌদি রাকা।
নন্তু সেই নববধূর ঢলঢলে মুখ দেখে মোহিত হলো, কাজলপরা কালো চোখের চাউনি দেখে মুগ্ধ হলো, আলতাপরা পায়ের লাবণ্য দেখে বিভোর হলো, আর ঝকমকে গহনায় মোড়া হাত গলা কান দেখতে জগৎ বিস্মৃত হলো।
নন্তু ওই লাবণ্যবতীর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে ভাবে, স্বর্গের পরীরা নিশ্চয় এই রকমই হয়। ভাবে সোনার কাঠি রুপোর কাঠি গল্পের রাজকুমারী কী আর এর থেকে সুন্দর? নতুন বৌ ওর সঙ্গে কথা কইলে নন্তুর বুকের মধ্যে যেন একটা অজানা সুখের বাঁশি বেজে ওঠে, নতুন বৌ ওর হাত ধরলে, নন্তুর মনে হয় সে এক্ষুনি মরে যাবে।
বিয়ে-বাড়িতে কত লোক, কত ছোট ছেলেমেয়ে, কত হৈ-চৈ, কত খাওয়া-দাওয়া, সে সব দৃশ্যের মধ্যে নন্তু নেই। নন্তু ওই একটি জায়গাতেই পড়ে আছে। নতুন কনের কাছে।
নতুন কনের গতিবিধির সঙ্গে নন্তুর গতিবিধি গ্রন্থিত। নতুন কনের পায়ে পায়ে ঘোরে, ওর একটু কিছু কাজ করতে পেলে কৃতার্থ হয়ে যায়। নতুন কনের আর কাজ কী? হয়তো একটু জল চাইল, হয়তো কোনো একটা বই চাইল। একদিন বললো, এ বাড়িতে খবরের কাগজ আসে না নন্তু?
নন্তুর মনে হলো জীবন ধন্য হয়ে গেল তার। নন্তু একেবারে সোজা দাঁড়িয়ে উঠলো।
হ্যাঁ তো। দুটো কাগজ আসে তো, ইংরিজি বাংলা।
এখন কেউ পড়ছে?
জিগ্যেস করলো নতুন বৌ। তার মানে ওটা ওর এখন পেলে ভালো হয়।
নন্তু তীরবেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, আর মুহূর্তে দু’খানা কাগজই হাতে নিয়ে চলে এলো।…যেন কোথাও কোনো বামনবুড়ো অথবা দৈত্যরাজকে পরাজিত করে রাজকুমারীর প্রাণভোমরা উদ্ধার করে নিয়ে এলো।
মুখের চেহারায় তেমনি দীপ্তি।
রাকা বললো, আরে, দুটোই নিয়ে এলে? আর কেউ যদি পড়তে চায়?
বিয়ে-বাড়িতে কে পড়ছে? বড় মেসোমশাই শুধু সকালে একবার—
নন্তুর তখনো বুক তোলপাড় করছে, নন্তুর কথার ভঙ্গিতে সেটা ধরা পড়ে যায়।
নতুন বৌ হেসে ফেলে বলে, এতো ছুটতে আছে? এই দ্যাখো হাঁপাচ্ছে।
নন্তু কৃতার্থমন্যের হাসি হেসে বলে, না তো।
এ বিয়েতে নন্তুই হয়েছিল নিতবর।
কারণ ওর বয়সের যে সব ছেলে আছে এদিক-ওদিক, নন্তুর তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর সুকান্তি। তাছাড়া নন্তু সব থেকে আদরণীয়ও বটে। বরের মা-র ছোট বোনের ছোট ছেলে।
সেই যে নন্তু কোঁচানো ধুতি আর গিলে-করা পাঞ্জাবি পরে, কপালে চন্দনের ছাপ এঁকে আর গলায় ফুলের মালা দুলিয়ে বরের সঙ্গে গেল, আর ছাঁদনাতলায় বৌকে দেখল, সেই ওর রোমাঞ্চের শুরু।
বিয়ের সত্যি বর ছলছুতোয় এঘরে এসে হেসে হেসে বলে, নিতবরটিই দেখছি সবটা দখল করে নিচ্ছে, আসলের জন্যে কিছু রাখছে না! বৌ মুখ টিপে হেসে বলে, ও তো দস্তুরমতো আমার প্রেমে পড়ে গেছে।
ও পড়লে ক্ষতি নেই, তুমি না পড়লেই হলো।
বৌ বলে, আমিই বা নয় কেন? প্রতিদান বলে একটা কথা আছে তো?
নন্তু অবশ্য এসব শুনতে পায় না। ওর কান বাঁচিয়েই বলা হয়, আর রাশুদা ঘরে ঢুকলে তো নন্তু ব্যাজার মুখে উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। রাশুদাকে আজ-কাল আর দু’চক্ষে দেখতে পারে না নন্তু।
তবু রাশুদা যখন ডাকে, কী রে নন্তু চলে গেলি কেন? আর, না এসে উপায় থাকে না বেচারার। কিন্তু ভালো লাগে না একদম।
রাশুদা ঘরে ঢুকলেই যেন বিশ্বপৃথিবী ভুলে যায় বৌদি। নন্তু নামের একটা ছেলে যে এখানে উপস্থিত আছে তা যেন মনেই থাকে না।
তবু এই নিষ্ঠুরার সঙ্গই নন্তুর কাছে প্রাণ।
নন্তুর মা বলে, ভালো এক নেশায় পড়েছে ছেলে। খেতে ডাকলে আসে না গো। কাল থেকে ওই নতুন বৌয়ের সঙ্গেই খেতে দিতে হবে দেখছি।
বড়মাসি বলেন, তার চেয়ে একটা উচিত মতো কনে যোগাড় করে ফেল, তোর বাড়িতেও একটা ঘটা লাগুক।
হাসির রোল উঠলো বাড়িতে।
কিন্তু ও রোল বেশীদিন থাকল না।
অবশ্য নন্তুরাও তো বেশীদিন থাকল না। নেহাত গরমের ছুটির মধ্যে এই বিয়েটা হলো বলেই এতোদিন থাকতে পাওয়া।
যেতে তো হবেই একদিন। কিন্তু শেষ-রক্ষা আর হলো না। যাবার দিন নন্তু এমন এক কাণ্ড করে বসলো যে, সবাই নন্তুর এ ক’দিনের ব্যবহারের আসল মানে খুঁজে পেয়ে হাঁ হয়ে গেল। আর ভাবতে লাগলো, যত সরল শিশু ভাবা যাচ্ছিলো, ততো তো নয় বাপু!
চলে আসার দিন নন্তু এক ফাঁকে একটি ‘প্রণয়-কাব্য’ লিখে রাকার হাতে গুঁজে দিয়ে পালালো, বলে গেল, কাউকে দেখাবে না কিন্তু। কিন্তু অবিশ্বাসিনী নারী নন্তুর এই নিষেধের মর্যাদা রাখল না। ফলে বাড়ি-সুদ্ধ সকলের হাতে হাতেই ফিরতে লাগল সেই কবিতা-পত্র।
হাসির স্রোতেই ভাসমান হয়ে পড়ল সবাই, কিন্তু মনে মনে না ভেবে পারল না, ও খোকা, তলে তলে তো বেশ পেকেছ দেখছি। সেই কাব্য-পত্রটি এই—
‘রাকা, রাকা রাকা!
তোমায় ছেড়ে চলে যেতে প্রাণ হচ্ছে ফাঁকা।
তুমি এত সুন্দর তাই তো এত ভালবাসি,
তোমার সবই সুন্দর, কথা আর হাসি।
স্কুলে গিয়েও তোমার কথা মনে পড়বে,
লেখা পড়া সব কিছু মাথায় চড়বে।
ইতি নন্তু।
শেষ লাইন দুটোই মারাত্মক।
এর মধ্যেই পাকামির আভাস। যাক, বাড়ি ফিরে বাবার হাতের একটি কড়া কানমলা ব্যতীত আর কোনো খেসারত দিতে হয় নি নন্তুকে তার প্রথম প্রেম বাবদ।
সেটা দিতে হলো দ্বিতীয়বারের বার! দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়েছিল নন্তু তার তেরো বছর বয়সে। …এবার প্রেমপাত্রী তাদের পাশের ফ্ল্যাটে নতুন আসা ভাড়াটেদের বারো বছরের মেয়ে দীপা। মেয়ে নয়, যেন পাকা আপেল, ফোটা গোলাপ। নন্তু জানলা দিয়ে নতুন ভাড়াটেদের আসা দেখছিল, খাট আলমারি আয়না দেরাজ নামানো দেখতে দেখতে হঠাৎ ওই মেয়েকে দেখলো। এবং দেখলো আর মরলো।
নন্তুর থেকে একটু বড় একটা ছেলেও ছিল ওদের বাড়ি, নন্তু হঠাৎ তার দারুণ ভক্ত হয়ে গেল। নন্তু ওদের বাড়িতেই পড়ে থাকতে শুরু করলো।
মা কিছু বললে, তেজের গলায় বলে, দীপকদার কাছে পড়া বুঝে নিতে গিয়েছিলাম।
মা সন্দেহের গলায় বলে, ওর এতো সময় আছে যে, এতক্ষণ তোকে পড়ায়?
নন্তু আরও জোর গলায় বলে, এতক্ষণ পড়াবে কেন? দীপকদা বলে, সর্বদা পড়া পড়া করলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। ক্যারাম খ্যাল। খেলাটা মিথ্যে নয়। নন্তু গেলেই দীপা ক্যারামবোর্ড পেড়ে বসে।
দাদার নাম দীপক, বোনের নাম দীপা। শব্দটার সঙ্গে কোনো মিল খুঁজে না পাওয়ার জন্যেই হোক, আর পূর্ব-অভিজ্ঞতার তিক্ত স্বাদের স্মরণেই হোক, এবার আর নন্তু কবিতার দিক দিয়ে গেল না।
নন্তু সোজাসুজি দীপার হাত ধরে বলে বসলো, আমি তোকে ভালবাসি।
দীপা যে সত্যি একেবারে অবোধ, তা মনে করবার হেতু নেই, আপন রূপ সম্পর্কে দিব্যি সচেতন এই দ্বাদশী, ছলা-কলাও শিখেছে কম নয়।
ক্যারাম খেলায় হেরে গিয়ে যখন হৈ চৈ করে অথবা ‘আর খেলব না’ বলে ঘুঁটি ছড়িয়ে উঠে যায়, তখন ভঙ্গিমা করে অনেক, এবং খাটো ফ্রকের আঁটো কাটের বাহারটি কিসে ভালো মতো উদঘাটিত হয়, তা ভালোই জানে।
কিন্তু এখন, নন্তুর ওই প্রেম-নিবেদন, স্রেফ এইমাত্র পৃথিবীতে পড়া মুখে, বললো, ওমা, সেকথা এতো ঘটা করে বলার কী আছে রে? বন্ধু হোস, ভালবাসবি না? আমিও তো তোকে কত ভালবাসি!
তেরো বছরের নন্তু তার থেকে এক বছর দু’মাসের ছোটো এই অবোধ বালিকার মধুর সরলতায় মুগ্ধ হলো, আবার করুণাও বোধ করলো। তাই করুণার গলাতেই তাকে জ্ঞান দেবার মহৎ উদ্দেশ্য দিয়ে বললো, তুই এমন বুদ্ধু। বন্ধুর মতো নয় মোটেই। তোর জামাইবাবু তোর দিদিকে যেমন ভালবাসে, তেমনি।
এমা! কী অসভ্য! বলে দেব দিদিকে, চল তোকে দিদির কাছে নিয়ে যাই, বলে দীপা ওকে এমন ভাবে সাট্টে পাট্টে ধরে নিয়ে চললো, তেমন ধরা একমাত্র চোরকেই ধরে লোকে, চোর পালিয়ে যাবার ভয়ে।
কিন্তু এখানে, চোর কী পালিয়ে যাবার?
নন্তুর মনে হলো ধরা পড়ার মতো সুখ কি ইহ-পৃথিবীতে আর আছে?
নন্তু সেই সুখটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে চোখ বুঝলো।
কিন্তু নন্তুর সময় নির্বাচনটা বড় ভুল হয়েছিল, দীপার দিদি-জামাইবাবুর উপস্থিতিতে দীপার সঙ্গে প্রেমের রকমফেরের ব্যাখ্যা করাটা সমীচীন হয় নি তার।
তবে সেটা বুঝলো নন্তু একটু লেট-এ।
লেট-এ।
চোখ বোজা অবস্থাতেই দিদির গলা শুনতে পেলো—এর মানে?
কণ্ঠস্বর কুলিশ-কঠোর।
সঙ্গে সঙ্গেই দীপার শিশুকণ্ঠের আদুরে কথা যেন কানের ওপর বাজ ফেললো। দেখ না দিদি এই পাজিটা এমন অসভ্য কথা বলছে। তাই তোমার কাছে ধরে নিয়ে যাচ্ছি।
আর নিয়ে যেতে হবে না, বাচাল বেহায়া মেয়ে কোথাকার! ছাড় ওকে।
মুহূর্তে স্বর্গসুখ বিলুপ্ত। পায়ের তলায় কী মাটি আছে? থাকলে নন্তু নামক প্রেমিক বালকটি তলিয়ে যাচ্ছে কেন?
কেন?
দিদি নন্তুকে জিগ্যেস করলো না, কী বলেছিস তুই দীপাকে?
দীপাকেই জিগ্যেস করলো, কী বলেছে?
দীপা অবলীলায় বললো, বলেছে জামাইবাবু তোমায় যেমন ভালবাসে, ও আমায় তেমনি—হি হি, এমন অসভ্য না!
নন্তু তখনো লোকচরিত বিশ্লেষণ করতে শেখে নি। কিন্তু তখন নন্তুর মনের মধ্যে যে ঝড় বইছিল তা ভাষার ছাঁচে ফেললে এই দাঁড়ায়, উঃ মেয়েমানুষ কী সর্বনেশে জাত। ফোটা গোলাপের মধ্যে এমন কাঁটা? পাকা আপেলের ভিতরটা এমন পচা?
দিদির মুখ দিয়েই বা এসব কথা বেরুচ্ছে কী করে?
নন্তু ভিজে বেড়াল?
নন্তু ন্যাকা বদমাইশ?
নন্তু বোকা বজ্জাত?
নন্তু মনে মনে ঠিক করলো, জীবনে আর এই মেয়েমানুষ জাতটার কাউকে ভালবাসা নয়। এরা হাসতে হাসতে লোকের গলা কাটতে পারে।
আসুক কোনোদিন ওই পাজি মেয়েটা ‘এই নন্তু ক্যারম খেলবি?’ বলে ডাকতে। মজা দেখিয়ে দেবে নন্তু।
কিন্তু ইহজীবনে আর তাকে মজা দেখাবার সুযোগ পেল না নন্তু, মেয়েটা কোনোদিন ডাকা তো দূরের কথা, নন্তুর দিকে তাকিয়েও দেখলো না।…নন্তুর সামনে দিয়ে দিয়ে স্কুলে গেল এলো, স্কুলে গেল এলো করতে করতে শরীরটাকে এমন বাড়বাড়ন্ত করে তুললো যে, চৌদ্দতেই আঠারো মনে হতে লাগলো।
অবশেষে সত্যি আঠারো হতে না হতে দীপুকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিলো ওরা। ওই বিয়েটাকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন দেখেছিল নন্তু। বিরোধ ভুলে ওরা নেমন্তন্ন করবে, বাড়ির আর কেউ যেতে না চাওয়ায়, ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো নন্তুকেই যেতে হবে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে।
তারপর বিয়ের কনেকে জানিয়ে আসা যাবে—তোমার জন্যেই আজ আমার এই দশা, তোমার জন্যেই আজ আমি মরতে বসেছি।
কিন্তু কথাগুলো বলবার সুযোগ আর পেল না নন্তু। দীপুর চোখের চামড়াহীন বাপটা পড়শী হিসেবেও নন্তুদের একখানা নেমন্তন্নর চিঠি দিলো না। সেই পুরনো রাগ পুষে রেখেছে। চিঠিটা বুকপকেটে না থাকলে কিসের বলে বলীয়ান হয়ে এরকম গোলমেলে জায়গায় যাওয়া যাবে?
তবে ঢুকতে পেলেও এবং বলতে পেলেও, সত্যি কথা তো আর বলা হতো না। সত্যি কী আর দীপুর দুর্ব্যবহারে বুক-ভাঙা হয়ে নন্তু চুপ করে বসে ছিল? নাকি তেরো থেকে উনিশ এই ছ’ ছটা বছর রমণীহীন পৃথিবীতে বাস করে এলো নন্তু? এই ছ’বছরে কম করেও তিন ছয়ে আঠারো বার প্রেমে পড়েছে নন্তু।
অতএব আঠারো বার বুক-ভাঙা মন নিয়ে ঘুরে ঘুরে আবার ভাঙা বুক জোড়া দেবার ওষুধ খুঁজে বেড়িয়েছে।
বুকের মধ্যে একখানা তাজা চকচকে প্রেম নেই, সর্বদা স্মরণ করবার মতো একখানা মুখ নেই, এ অবস্থা নন্তুর ধারণার বাইরে।
তবে নন্তু এর ফাঁকে ফাঁকে পাস-টাস গুলোও চালিয়ে গেছে ঠিক মতো। এই যা বাঁচোয়া।
নন্তুর এইসব প্রেমের পাত্রীরা বিচিত্র! এর মধ্যে নন্তুর থেকে বয়েসে অনেকটা বড়ও থেকেছে দু’একজন।
যেমন চারুলতাদি।…মনীষা খুড়িমা। তাছাড়া পাশের বাড়ির মেয়ে, দাদার শ্বশুরবাড়ির মেয়ে, বামুনদির মেয়ে, রজনী স্যাকরার মেয়ে, লন্ড্রীর সুবোধদার মেয়ে, মিল্ক সেন্টারের দুগ্ধদাত্রী মেয়ে, আরো কত কত!
কিন্তু এমনি ভাগ্য নন্তুর যে, নন্তুই শুধু প্রেমে বিহ্বল হয়। তার প্রেমাস্পদারা ফিরেও তাকায় না। আর যদি বা তাকায়, সেটা নন্তুকে শাসাতে। …আর বড়দের বলে দিতে।
একটা প্রেমেও নন্তু সাকসেসফুল হতে পারলো না, সব বিশ্বাসঘাতিনীর দল। অথচ নন্তু সুন্দর সুকান্তি পুরুষ। দেখলেই তো ভালবাসতে ইচ্ছে হবার কথা।
তা সে ইচ্ছে নন্তুর কলেজের মেয়েদের মধ্যে দেখা দিলো। তাই নন্তুকে কলেজসুদ্ধ মেয়ের প্রেমে পড়তে হলো। যাতে নন্তুকে নিরপেক্ষ বলে ধরা যায়, নন্তুকে তাই কখনো বেলার সঙ্গে বেড়াতে যেতে দেখতে পাওয়া যায়, কখনো কণার সঙ্গে গঙ্গার ধারে ঘুরতে দেখা যায়, কখনো মঞ্জুরীর সঙ্গে কফি হাউসে, কখনো হৈমন্তীর সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে।
মোটের মাথায় প্রেমশূন্য অবস্থা একবারও থাকে নি নন্তুর জীবনে। কিন্তু এই প্রেমের জন্যে নন্তু তার জীবনে কী কম লাঞ্ছিত হয়েছে? কম তিরস্কৃত? কখনো নিজের গার্জেনদের কাছে। কখনো অপর পক্ষের গার্জেনদের কাছে।
কখনো প্রেমপাত্রী নিজেই ঠিকরে সরে গেছে।
যেমন কেতকী হালদার।
ওর পিরিয়ডে একদিন নন্তুকে রাখী বোসের সঙ্গে চায়ের দোকানে বসে চা খেতে দেখেই ওর মাথায় রক্ত চড়ে উঠেছিল। ফট ফট করে চায়ের দোকানে ঢুকে এসে নন্তুকে যাচ্ছেতাই করে বেরিয়ে পড়েছিল বাড়ির উল্টোমুখো।
তারপর কেতকী কলেজসুদ্ধ সবাইকে নন্তুর বিশ্বাসঘাতকতার কথা বলে বেড়িয়েছে, এবং নিজের রুমাল ভিজিয়েছে।
স্বভাবতই এতে লোকের নন্তুর প্রতি সমবেদনার মনোভাব চলে যায়, বরং তার উপর তীব্র একটা বিরুদ্ধভাব এসে যায়।
কিন্তু চরম করলো সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেরা। সবাই মিলে নন্তুকে আচমকা ঘিরে ফেলে আচ্ছা করে ধোলাই দিলো। বললো, চাঁদ, তুমি ভেবেছ কি? চাঁদমুখটি দেখিয়ে তুমি গাছেরও খাবে, তলারও কুড়োবে? তোমার প্রেম-রোগ সারাচ্ছি জন্মের শোধ।
বাড়ি ফিরতে মা চমকে উঠে, শিউরে বললেন, এ কী সর্বনাশ! এ কী চেহারা?
কী হয়েছে?
নন্তু বললো, দারুণ পড়ে গিয়েছি।
কোথায়? কী ভাবে?
তখন আবার দারুণ একটা গল্প বানাতে হলো নন্তুকে। …অতঃপর ওষুধ এলো, মলম এলো, বেশ রাজকীয় সেবাই হলো নন্তুর।
কাজেই নন্তু আবার মনে মনে কানমলা খাওয়াটা ভুললো।
তবে এবার নন্তু একনিষ্ঠ হলো।
নন্তুর বড় ভাইঝিকে বাড়িতে পড়াবার জন্যে যে দিদিমণিটি বহাল হলেন, প্রথম দিনেই তার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়লো নন্তু। সূত্রটা এই তাঁর পাড়াটা ভালো নয়, আর সন্ধেটা লোডশেডিংয়ের ছিল বলে ভদ্রমহিলা একটা টর্চ চেয়েছিলেন, নন্তু ‘বেণীর সঙ্গে মাথা’ দিলো, টর্চটা ধরে একেবারে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এলো।
ব্যস।
তদবধি রোজই দেখা যেতে লাগলো, দিদিমণি ঠিক ফেরার সময়ই নন্তু বাড়ি ফেরার পথে। অতএব নন্তুর সৌজন্যবোধ জাগরিত হয়ে ওঠে, নন্তু বলে, চলুন আপনাকে পৌঁছেই দিয়ে আসি।
মহিলাটি অবশ্য আপত্তি করেন, আবার কেন কষ্ট করবেন? বলেন, কিন্তু পৌঁছে দেবার পর বেশ সকৃতজ্ঞ ভাষণেই বলেন, যাই বলুন, এই রাস্তাটা রাত্তিরের দিকে একা আসতে ভয় ভয় করেই। ভাগ্যিস আপনি—। এই ভাগ্যিসের খেলাটা চলছিল বেশ। কিন্তু নন্তু চিরদিনই ধৈর্যের পরীক্ষায় ফেল। নন্তু বরাবর যা করে তাই করলো।
ওই খেলাটা তলিয়ে ভেবে জমিয়ে তোলার আগেই দুম করে একদিন রাস্তাতেই একখানা খোলাখুলি প্রেম-নিবেদন করে বসল। আর আশ্চর্য! এতোদিনের সৌজন্যময়ী ভদ্রমহিলা মুহূর্তে একেবারে ফণা-তোলা ফণিনী হয়ে বলে উঠলো, আপনি কি পাগল নাকি?…ইস! আপনার ভদ্রতার মুখোশের তলায় এই ছিল? ছিঃ!
পরদিন এই নিয়ে চাপা গুঞ্জনে বাড়ি মুখরিত। দিদিমণি কাজ ছেড়ে দিতে চাইছেন। কারণ?
কারণ তাঁর ছাত্রীর কাকা।
নন্তুর বৌদি এমন দিদিমণিটি হাতছাড়ার আশঙ্কায় ঝাঁজালো হলেন, লেখাপড়া তো শিখলে অনেক, জ্ঞানবুদ্ধির বালাই হল না কেন? সুন্দরী মেয়ে দেখলেই আর চোখে কানে দেখতে পাবে না এ রোগ কবে যাবে তোমার? সুধা বিশ্বাসের সিঁথিতে যে সিঁদুর তাও চোখে পড়েনি? আর তো তোমায় ছাড়া গরু করে রাখা যায় না, এবার গোয়ালে পুরতে হবে।
অতএব তোড়জোড় করে মহাসমারোহে গোয়ালজাত করা হল নন্তুকে।
বাড়ির ছোটছেলে, সমারোহ ভালোই হল, আনাচকানাচ থেকে পর্যন্ত আত্মীয়জন এসে ভিড় করলো, তাদের মধ্যে সুন্দরী সুন্দরী মেয়েও ছিল অনেক, কিন্তু নন্তুর নবপরিণীতার কাছে সবাই নিষ্প্রভ।
নন্তুর মা খোট ধরেছিলেন, ও আমার সুন্দর মুখ ভালবাসে, সেটি এনে দিতে হবে। তা ভাগ্যক্রমে এসে গেলও।
না এসে যাবারও কারণ নেই, নন্তুর ভালো নাম নন্দিতকুমার, নন্তু ইতিহাসে এম. এ., নন্তু দেখতে রূপবান, এবং নন্তু এখন একটা নামী কলেজের লেকচারার।
তাছাড়া নন্তু বাড়ির ছোট ছেলে, এখনো মা-বাপ বর্তমান, এবং তিন দাদাই কেষ্টবিষ্টু। সম্প্রতি নন্তুর মেজদা গাড়ি কিনেছেন, আর নন্তুর ঠাকুর্দা এমন একখানি রাস্তার ওপর এমন একখানি জাঁদরেল তিনতলা বাড়ি হাঁকড়ে রেখে গেছেন যে, আরো এক পুরুষের বংশধরদেরও কুলিয়ে যাবে, অতএব সুন্দরী সুগায়িকা, সুপাত্রী জুটবে নন্তুর, এটা আশ্চর্যের নয়।
সবাই নিশ্বাস ফেলে বাঁচলো।
এতোদিনে নন্তু একটা বৈধ প্রেমপাত্রী পেল। আর নন্তুকে নিয়ে দিশেহারা হতে হবে না। বাড়ির লোকের, পাড়ার লোকের, আত্মীয়-জনের, বন্ধুমহলের।
এযাবৎকাল তো সবাইকে হতে হয়েছে দিশেহারা।
কাকের মুখ থেকে মাছের মতো, বেড়ালের মুখ থেকে দুধের মতো, সিঁড়ির মুখ থেকে হামা-দেওয়া শিশুর মতো, ‘ধর ধর’ করতে হয়েছে তো চিরকাল নন্তুকে নন্তুরই মুখ থেকে।
আর কারো দায়িত্ব নেই।
এখন ভাবনা নন্তু বৌ নিয়ে কতটা মাতামাতি করে, কতটা বেহায়াপনা করে।
অষ্টমঙ্গলার মধ্যেই তো হনিমুনে যাবার জন্যে উদ্দাম হচ্ছে দেখা গেল।
আমি নন্তুদের পাড়ার চিরকালের বাসিন্দা। নন্তুর বিয়ে পর্যন্তও তাই ছিলাম, কর্মচক্রে তারপরেই হঠাৎ দেশছাড়া হতে হল।…তারপর যা হয়—
প্রথম প্রথম ঘন ঘন চিঠিপত্রে খবরের লেনদেন, ক্রমশ কমতে কমতে একেবারে শূন্যের অঙ্ক।
দশ বছর পরে আবার দেশে ফিরলাম। এবং সেই পুরনো পাড়াতেই ফিরতে হলো, কারণ বাড়িটা বসতবাড়ি, পৈত্রিক বাড়ি।
বাড়িতে যারা ছিল, তাদের কাছে পাড়ার খবর নিই। এ কেমন আছে? ও কেমন আছে?
ভালো মন্দয় মেশানো খবর।
কিন্তু নন্তু!
নন্তু খবর অদ্ভুত।
হনিমুন থেকে ফিরে এসেই নাকি নন্তুর প্রেম-রোগ এমন সেরে গেল যে, নন্তু তার বৈধ প্রেমপাত্রীটিকেও একেবারে ভুলে গেল। নন্তু খিটখিটে হলো, এবং ছোটলোক হলো।
নন্তুর স্ত্রীর প্রতি যা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, যা দুর্ব্যবহার করে, যা নিষ্ঠুরতা করে, তা নাকি বাসনমাজা ঝিয়েদের বরেও করে না!
উঠতে বসতে খিঁচোয় বৌটাকে।
শুনে তাজ্জব লাগলো বৈকি!
গেলাম ওদের বাড়ি।
বৌ দেখে অবাক!
সেই রং কোথা? সেই গড়ন কোথা? সেই মুখ কোথা? বিষণ্ণ বিষণ্ণ মুখে যে হাসিটুকু সেও যেন করুণ। বিয়ের সময় বাইশ বছর বয়েস ছিল বৌয়ের, দশ বছর পরে অঙ্কশাস্ত্রের নিয়মে এখন বত্রিশ। কিন্তু এই কি বত্রিশ বছরের চেহারা, বৌ যেন বাহান্ন বছরের এক বুড়ি। নন্তু ঘর থেকে বেরিয়ে এলো আমার সাড়া পেয়ে, প্রথম নম্বরেই বৌকে একটা তাড়া দিয়ে—সঙের মতন দাঁড়িয়ে আছ কেন? চায়ের জল-টল চড়াও তো একটু।
বললো শুধু তাড়া দিয়েই নয়, খিঁচিয়েও।
কিন্তু এই নন্তুই কি সেই নন্তু?
এরই বা কী চেহারা হয়েছে?
জেল্লাহীন হলদেটে রং, গাল ভাঙা, চোখ কোটরে, মাথার মাঝখানে টাকের আভাস।
না বলে পারলাম না, চেহারার এ কী হাল করেছ নন্তু?
নন্তু অবজ্ঞায় চোখ উল্টে বললো, বয়েস হচ্ছে না?
নন্তুর বৌ চা নিয়ে এল। খুব ভালো চা। সঙ্গে সিঙাড়া। তবু নন্তু বৌকে আরও দুবার খিঁচিয়ে নিল চা দেওয়ার ছিরির জন্যে, তারপর খিঁচোলো বাড়িতে কিছু করে না দিয়ে বাজারের খাবার আনিয়ে দেওয়ার জন্যে।
বৌ সরে যেতে দুঃখিতভাবে বললাম, বৌকে অত ধমক-টমক দিচ্ছ কেন নন্তু?
নন্তু বিরক্তিতে মুখ বাঁকিয়ে বললো, তবে কি মাথায় করে নাচতে হবে?
ফেরার পথে ভাবতে ভাবতে আসছি নন্তুর এ মনস্তত্বের কারণ কী?…বিয়ে হয়ে নন্তুর সব সম্ভাবনা ফুরিয়ে যাওয়ার হতাশায়? না, সারা জীবন নন্তু নারীজাতির কাছে যে দাগা পেয়েছে, হাতের মুঠোয় তাদের একজনকে পেয়ে হিংস্র প্রতিশোধ নেওয়া?
—