এক টুকরো কাচ
৷৷ ১৷৷
সমুদ্র অফিসের বড়বাবুর চেম্বারের বাইরে দাঁড়াতেই শুনতে পেল তিনি কাউকে বলছেন, ‘ভাবা যায়! একদম বাড়ির ভিতর ঢুকে খুন করে দিয়ে গেল লোকটাকে! কলকাতা শহরটা একেবারে রসাতলে গেল!’
সমুদ্র দরজা ফাঁক করতেই বড়বাবু টেলিফোনের রিসিভারটা একটু নামিয়ে সমুদ্রর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নিশ্চয়ই অফিস থেকে পালাবার কথা বলতে এসেছেন?’
সমুদ্র লজ্জিতভাবে জবাব দিল, ‘আমার এক পিসিমা হাসপাতালে৷ তাই মানে ইয়ে….৷’
বড়বাবু বললেন, ‘আজ পিসিমার হাসপাতাল, কাল বন্যাত্রাণে সাহায্য তুলতে যাওয়া, পরশু মড়া পোড়াতে যাওয়া, এ সবের জন্য অফিস-পালানো লেগেই থাকে! আমার আর কী! যান৷ তবে নিকেলসন কোম্পানির কাগজগুলো যেন এ সপ্তাহে রেডি হয়৷’—এই বলে তিনি আবার টেলিফোনে মন দিলেন—‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম, বীভৎস কাণ্ড, গলা কেটে দু-ফাঁক…!’
সমুদ্র আর দাঁড়াল না, ‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার’ বলে সেখান থেকে সরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সোজা অফিসের বাইরে ফুটপাতে এসে দাঁড়াল৷ তারপর অফিস পাড়ার ব্যস্ত রাস্তায় মিশে গেল৷
সে কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেল লালবাজারে ডেপুটি কমিশনারের চেম্বারের বাইরে৷ যিনি ঘণ্টাখানেক আগে ফোন করেছিলেন তাকে৷ দরজার সামনে বেয়ারাকে সে ‘সাহেবকে বলো সমুদ্র বসু এসেছেন’ বলতেই কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দরজা খুলে গেল৷ সমুদ্র ঘরে ঢুকে সটান কমিশনারের টেবিলের মুখোমুখি চেয়ারে বসল৷
কমিশনার একটু অনুযোগের সুরে বললেন, ‘আসতে এত দেরি করলেন! নিশ্চয়ই অফিসে ছিলেন? কেন যে ঐ অফিসে কেরানির চাকরি নিয়ে পড়ে আছেন কে জানে? অন্য কোনো বড় অফিসে মোটা মাইনের চাকরির যোগ্যতা তো ছিল৷ আর আপনি তো সংসার পাতেননি, পৈত্রিক বিষয় যা আছে তাতেই চলে যেত, চাকরিটা তো না করলেও চলত৷’
সমুদ্র সেলোটেপ দিয়ে আটকানো তার ভাঙা মোবাইল ফোনটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে বলল, ‘তা বটে৷ আমার চাকরিটা না করলেও চলত৷ আসলে, বলতে পারেন ব্যক্তিগত জীবনের ছদ্মবেশ৷ আপনাদের কল্যাণে কম চোর-ডাকাত তো শত্রু হল না৷ চশমার নীচে গোলগোল চোখ, উস্কোখুস্কো চুল, হাতে ভাঙা মোবাইল, কখনও বা শুকতারা, সন্দেশ, সরকারি অফিসের ছা-পোষা কেরানিকে, আর যাই হোক গোয়েন্দা বলে সন্দেহ করে না৷ ক’দিন আগে যে ব্যাঙ্কের ঘটনায় জালিয়াত ভুবন মল্লিককে ধরলাম, সে খবরটা খবরের কাগজে আমার পাশের চেয়ারে বসে পড়ছিল একজন সহকর্মী৷ সে ধারণাই করতে পারল না যে কাগজে যে সমুদ্র বসুর নাম বেরিয়েছে সে লোকটা আমি৷ বেশ মজার ব্যাপার!’
কমিশনার শুনে মন্তব্য করলেন, ‘বুঝলাম! এবার যে কারণে আপনাকে ডেকেছি সেটা বলি….৷’
তাঁকে কথা শেষ করতে না দিয়ে সমুদ্র বলল, ‘নিশ্চয়ই কৈবর্ত লেনে ব্যারিস্টার অবনী ঘোষের খুনের ব্যাপারের জন্য? তবে আমাকে কেন? আপনার সরকারি গোয়েন্দারা তো আছে৷’
কমিশনার একটু বিস্মিতভাবে বললেন, ‘কীভাবে জানলেন?’
সমুদ্র বলল, ‘ভোরবেলা টেলিভিশনে খবরটা আসার পর থেকেই এ নিয়ে সারা শহরে শোরগোল পড়ে গেছে৷ আমার অফিসের বড়বাবুও টেলিফোনে কাকে যেন ঘটনাটা বলছিলেন৷’
কমিশনার বললেন, ‘ঠিক তাই৷ সরকারি গোয়েন্দাদের হাতে এই তদন্ত না দিয়ে এটা আপনাকে দেব কারণ এ ঘটনার সন্দেহভাজনরা সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি৷ তদন্ত করতে গিয়ে পান থেকে চুন খসলে বিপদ৷ মিডিয়া ছেড়ে কথা বলবে না৷’
সমুদ্র হেসে বলল, ‘কিছু হলে ব্যাপারটা সরকারি পুলিশকর্মীদের বদলে আমার ঘাড়ে চাপাবেন তাই তো? বেশ তাই হবে৷ এবার ব্যাপারটা খুলে বলুন৷’
কমিশনার বললেন, ‘ঘটনাটা মোটামুটি এই—অবনী ঘোষ প্রথিতযশা ব্যারিস্টার৷ বয়স ষাটের কোঠায়, বিপত্নীক৷ বছরখানেক হল ওকালতি পেশা ছেড়ে দিয়েছিলেন৷ একজন চাকরকে নিয়ে কৈবর্ত লেনের পৈত্রিক বাড়িতে থাকতেন৷ প্রচুর পয়সার মালিক, তবে একটু দুর্মুখ স্বভাবেরও ছিলেন, যে কারণে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না৷ বন্ধু বলতে ছিলেন তিনজন৷ তাঁরাও তাঁরই মতো সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও গণ্যমান্য ব্যক্তি৷ প্রখ্যাত অভিনেতা অরিন্দম মল্লিক, ন্যাশানাল চ্যাম্পিয়ন বক্সার ফটিক কর্মকার, ন্যাশানাল মেডিকেল কলেজের বিখ্যাত সার্জেন ডক্টর পরেশ গুপ্ত৷ চারজনই সমবয়সী৷’
সমুদ্র বলল, ‘হ্যাঁ, এদের তিনজনের নামই শুনেছি, কাগজে টেলিভিশনে ছবিও দেখেছি৷ তারপর?’
কমিশনার বললেন, ‘এই তিনজনই শুধু যাওয়া-আসা করতেন অবনীর বাড়িতে৷ রোজ সন্ধ্যায় সেখানে তাসের আড্ডা বসত৷ কালও তাঁরা গেছিলেন৷ রাত দশটা নাগাদ খেলা সাঙ্গ হলে তাঁরা বেরিয়ে যান৷ অবনীবাবুর চাকর হরি দু-দিনের ছুটিতে বাড়ি গেছিল৷ আজ সকালে সে ফিরে দেখে সদর দরজা খোলা আর বেডরুমে অবনীবাবুর গলাকাটা লাশ পড়ে আছে৷ খুনি নিশ্চয়ই মৃতের পরিচিত কেউ, নইলে তিনি তাকে বেডরুমে নিয়ে যেতেন না৷ আমার ধারণা তাঁর তিন বন্ধুর মধ্যেই কেউ ফিরে এসে ব্যাপারটা ঘটিয়েছে৷ যদিও আমি হরিকে আটক করেছি যাতে বাইরের লোকের চোখে সন্দেহের তির অন্যদিকে ঘুরে যায়৷ সন্দেহভাজন তিনজনকেই তদন্তর সাহায্যের জন্য সবিনয়ে বিকাল চারটেতে এখানে আসতে বলেছি৷ কোনো মার্ডার ওয়েপন পাইনি৷ লাশ মর্গে পাঠিয়েছি৷ আনঅফিশিয়ালি রিপোর্টটা কিছুক্ষণের মধ্যেই জেনে যাব৷’
সমুদ্র ঘড়ি দেখে বলল, ‘এখন বেলা দুটো৷ আপনার অতিথিরা আসার আগে চলুন অকুস্থল থেকে ঘুরে আসি৷ আর প্রতাপকেও আসতে বলি৷ সে আমার বন্ধু কাম সহকারী৷ সে আবার সাহিত্যের পোকা৷ বিশেষত রহস্য-রোমাঞ্চ গল্পের৷’
কৈবর্ত লেনে পৌঁছে গেল সমুদ্ররা৷ পুরোনো দিনের প্রকাণ্ড বাড়ি৷ তার সামনে কৌতূহলী লোকজনের জটলা৷ পুলিশের গাড়ি থেকে নেমেই কমিশনার সাহেব জনতার উদ্দেশে বললেন, ‘আপনারা কয়েকজন থাকবেন৷ সাক্ষী দিতে হবে৷’ নিমেষে ভিড় ফাঁকা হয়ে গেল৷ কে আর পুলিশ-আদালতের ঝামেলায় নিজেদের জড়াতে চায়? প্রতাপও হাজির হয়ে গেছিল৷ তাকে নিয়ে কমিশনার সাহেবের সঙ্গে বাড়ির ভিতর ঢুকল সমুদ্র৷ সঙ্গে জনাকয়েক পুলিশকর্মী৷ প্রথমে বিরাট বৈঠকখানা৷ সার সার আলমারিতে আইনের বই ভর্তি৷ একটা ওক কাঠের টেবিল ঘিরে কিছু চেয়ার৷ টেবিলে এক সেট তাসও পড়ে আছে৷ এ ঘর পেরিয়ে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে তারা পৌঁছল দোতলার সেই বেডরুমে৷ বেশ বড় ঘর৷ মাঝখানে একটা খাট, পরিপাটি বিছানা৷ অবনী ঘোষ মনে হয় শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তার আগেই ব্যাপারটা ঘটে৷ তবে ঘরের অন্য অংশ লণ্ডভণ্ড৷ একটা চেয়ার, তেপায়া মাটিতে উল্টে আছে৷ একটা ছোট আয়না মাটিতে পড়ে চুরমার৷ কাচ ছড়িয়ে আছে মেঝেতে৷ আক্রমণকারীর সঙ্গে একটা ধস্তাধস্তি হয়েছিল সম্ভবত৷ ঘরের এককোণে মেঝেতে চাপচাপ রক্ত কালো হয়ে জমাট বেঁধে আছে৷ তার চারপাশে চকখড়ির গণ্ডি কেটেছে পুলিশের লোক৷ কমিশনার সে জায়গাটা দেখিয়ে বললেন, ‘ওখানেই লাশটা পড়েছিল৷ অবনী শীর্ণকায় ছিলেন৷ সম্ভবত ঘরের কোণে ঠেলে ধরে তাঁর গলাতে অস্ত্র চালিয়েছিল খুনি৷’
সমুদ্র ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল ঘরটা৷ হঠাৎ কমিশনার সাহেবের মোবাইল বেজে উঠল৷ ফোনে কথা বলার পর তিনি সমুদ্রকে বললেন, ‘ময়না তদন্তর একটা মৌখিক রিপোর্ট পেলাম৷ রাত সাড়ে দশটা থেকে দু’ঘণ্টার মধ্যে খুনটা ঘটেছে৷ ধারালো কোনো কিছু দিয়ে একটানে শ্বাসনালী কাটা হয়েছে৷ একটা অদ্ভুত ব্যাপার৷ মৃতের ক্ষতস্থানে নাকি মিহি কাচের গুঁড়ো মিলেছে!’ সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে বসে পড়ে ভাঙা কাচের টুকরোগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কাচের গুঁড়ো! তাহলে কী এ কাচ দিয়ে…কিন্তু কোনো কাচে তো রক্ত লেগে নেই!’ তারপর সে বলল, ‘হতে পারে খুনি সেই কাচের টুকরো সঙ্গে নিয়ে গেছে৷ যাই হোক এখন এ কাচগুলো আমি সঙ্গে নিচ্ছি৷ আপাতত আমার দেখা শেষ৷ আমি একটু বাড়ি হয়ে তারপর আপনার অফিসে অতিথি আপ্যায়নে যাব৷’ প্রতাপ একটা রুমালে সাবধানে তুলে নিল ভাঙা আয়নার সব টুকরোগুলো৷ সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কমিশনার তাঁর অফিসে চলে গেলেন৷ আর সমুদ্র প্রতাপকে নিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে নিজের বাড়ি ফিরল৷
বাড়ি ফিরেই সমুদ্র একটা টেবিলে সেই ভাঙা আয়নার টুকরোগুলো নিয়ে বসে গেল৷ এ যেন জিগজাগ পাজেলের মতো ব্যাপার! টেবিলের ওপর মিলিয়ে মিলিয়ে কাচের টুকরোগুলো সাজাতে লাগল সে৷ কিছু সময় পর টেবিলের ওপর এক ফুট বাই দেড় ফুট মাপের আয়না তৈরি হয়ে গেল৷ তখনও সমুদ্রর হাতে ধরা একটা ছোট্ট আয়নার টুকরো৷ নিজের মনেই যেন সমুদ্র বলে উঠল, ‘অদ্ভুত ব্যাপার তো!’ তারপর একটা ছোট্ট আয়নার টুকরো কাগজে মুড়ে যত্ন করে পকেটে রাখল৷
প্রতাপ বলল, ‘কী অদ্ভুত ব্যাপার?’
সমুদ্র তার উত্তর না দিয়ে বলল, ‘চলো একঘণ্টা ঘুমিয়ে নিয়ে তারপর বেরোব৷ স্নায়ুতন্ত্রকে বিশ্রাম দেওয়া প্রয়োজন৷’
৷৷ ২৷৷
ঠিক বিকাল চারটেতেই কমিশনার সাহেবের চেম্বারে পৌঁছে গেল সমুদ্র আর প্রতাপ৷ কমিশনার সাহেব বললেন, ‘অরিন্দম মল্লিক আর ফটিক কর্মকার এসেছেন৷ পরেশ গুপ্ত এখনও আসেননি৷ দু-জনকে গেস্টরুমে বসিয়ে কফি খাওয়াচ্ছি৷ তবে বেশিক্ষণ তাঁদের আটকানো যাবে না৷ দুজনেই সেলিব্রিটি৷ কমপ্লেন হলে বিপদে পড়ব৷ অরিন্দমকে দেখতে তো পুলিশকর্মীদের ভিড় জমে গেছে! আপনারা পাশের ঘরে যান, আমি ওঁদের একজন করে পাশের ঘরে পাঠাচ্ছি৷’
সমুদ্ররা পাশের ঘরে গিয়ে বসল৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘরে প্রথমে ঢুকলেন অরিন্দম মল্লিক৷ বয়স পঞ্চাশ হলেও এখনও যুবকদের মতো চেহারা৷ হাসিমুখ হলেও ঠোঁটের কোণে একটা বিষণ্ণতা৷ হয়তো তা বন্ধুবিয়োগের জন্যই৷ সিনেমার পর্দায় বহুবার সমুদ্ররা এই অভিনেতাকে দেখেছে৷ নমস্কার বিনিময় করে বসার পর সমুদ্র তাঁকে হেসে বলল, ‘আপনার বহু ছবি দেখেছি৷ ‘জীবন সংগ্রাম’ ছবিতে তো আপনার অভিনয়ের কথা লোকের মুখে মুখে ফেরে৷ তা এখন কী ছবি করছেন?’
ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘ধন্যবাদ৷ এখন ‘ইন্দ্রপ্রস্থ’ নামে একটা ছবি করছি৷ টালিগঞ্জেই শু্যট হচ্ছে৷ মহাভারতের একটা অংশ নিয়ে ছবি৷ কৃষ্ণর ভূমিকায় আছি৷ ইদানীং এসব ছবি পাবলিক ভালো খাচ্ছে৷’
সমুদ্র বলল, ‘বাঃ, আপনার আর সময় নষ্ট না করে কাজের কথা জেনে নিই৷ কাল অবনীবাবুর বাড়ি থেকে ক’টায় বেরিয়েছিলেন? সবাই একসঙ্গে বেরিয়েছিলেন? তারপর কোথায় গেছিলেন?’
অরিন্দম মল্লিক বললেন, ‘রাত দশটা নাগাদ একসঙ্গেই তিনজন বেরোই৷ সবার বাড়ি উত্তর কলকাতাতেই৷ আমার বাড়ি আমহার্স্ট স্ট্রিট, পরেশ থাকে শোভাবাজার, আর ফটিক থাকে ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির কাছে৷ তিনজনেরই নিজস্ব গাড়ি৷ আমি সোজা বাড়ি ফিরেছিলাম৷’
সমুদ্র জানতে চাইল, ‘আপনাদের সম্পর্ক কেমন ছিল? ইদানীং তাঁর সঙ্গে কারো মনোমালিন্য ঘটেছিল? কাল তাসের আসরে কিছু ঘটে?’
অরিন্দম জবাব দিলেন, ‘সম্পর্ক মোটামুটি ভালোই ছিল৷ আমাদের একটু নাম আছে বলে সাধারণ পাবলিকের সঙ্গে তেমন মেশা যায় না৷ তবে কাল তাসের আড্ডায় একটা ছোট ঘটনা ঘটেছিল, সেটা খুনোখুনির পর্যায়ে যাবে না৷ আর যাই হোক ফটিক তাকে খুন করতে পারে না৷ পরেশও নয়৷’
সমুদ্র বলল, ‘ব্যাপারটা একটু দয়া করে বলবেন?’
অরিন্দম একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘সত্যি কথা বলতে কী তাসটা আমরা বাজি ধরেই খেলি৷ কাল আমি অবনীর পার্টনার, পরেশ ফটিকের৷ অবনীর সন্দেহ হয় ফটিক জুয়াচুরি করছে৷ সে চোর বলে ফটিককে৷ পাল্টা ফটিক তার কলার চেপে ধরে৷ আমি আর পরেশ অবশ্য তাদের ছাড়িয়ে দিই৷ ব্যাপারটা মিটমাট হয়ে যায়৷ পরের দানে ফটিকই অবনীর পার্টনার হয়ে খেলে৷’
সমুদ্র বলল, ‘আমার শেষ প্রশ্ন, খুনের ঘটনায় আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?’
অরিন্দম বেশ জোরের সঙ্গে বললেন, ‘না৷’
অরিন্দম মল্লিক বেরিয়ে যাবার পরই ফটিক কর্মকার ঘরে ঢুকলেন৷ কদমছাঁট চুল, থ্যাবড়া নাক, পেশিবহুল বেঁটেখাটো কেমন একটা গুন্ডা-গুন্ডা চেহারা৷ ঘরে ঢুকেই সমুদ্রদের দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে তিনি রুক্ষভাবে বললেন, ‘যা জানার তাড়াতাড়ি জিগ্যেস করুন৷ আমার আজ একটা বক্সিং কোচিং ক্যাম্প উদ্বোধনে যাবার কথা৷’
সমুদ্র হেসে বলল, ‘আপনার বেশি সময় নেব না৷ আচ্ছা, অবনীবাবু লোকটা কেমন ছিলেন? ইদানীং আপনাদের কারো সঙ্গে তাঁর ঝগড়াঝাটি হয়েছিল?’
প্রশ্ন শুনে ফটিক কর্মকার বললেন, ‘দেখুন, আমরা খেলোয়াড়রা সোজাসাপটা কথা বলি৷ অবনী মোটেও সুবিধার লোক ছিল না৷ ব্যবহার খুব বাজে ছিল৷ নেহাত অন্য কোথাও যাবার জায়গা নেই বলে ওর বাড়ি তাসের আড্ডায় যেতাম৷ আমার আর পরেশদার সঙ্গে তো প্রায়ই ঝগড়া বাধত৷ তবে পরেশদার সঙ্গে ইদানীং তার সম্পর্কটা তলায় তলায় ভালো যাচ্ছিল না৷ নার্সিংহোম করার জন্য পরেশদা কিছু টাকা নিয়েছিলেন অবনীদার কাছ থেকে৷ সময় পেরিয়ে যাবার পরও সম্ভবত তিনি তা ফেরত দেননি৷ কাল সন্ধ্যায় আমি যখন অবনীদার ঘরে ঢুকছি, তখন তীব্র কথা কাটাকাটি হচ্ছিল দুজনের৷ আমি ঢুকতে তা থেমে গেল৷’
সমুদ্র এরপর জানতে চাইল, ‘কাল অবনীবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আপনি কোথায় গেছিলেন?’
প্রশ্নটা শুনেই একটু উত্তেজিতভাবে ফটিক কর্মকার বললেন, ‘আপনারা কী আমাকে সন্দেহ করছেন? আমি সোজা বাড়ি ফিরেছি৷’
সমুদ্র বলল, ‘আমার শেষ প্রশ্ন, এই খুনের ঘটনাতে আপনি কাউকে সন্দেহ করেন?’
তিনি জবাব দিলেন, ‘এটা বার করা আপনাদের কাজ৷ এবার আমি উঠলাম, নমস্কার৷’ এই বলে দরজার দিকে এগোলেন ফটিকবাবু৷
আবার কমিশনার সাহেবের ঘরে ফিরে এল সমুদ্ররা৷ কমিশনার জিগ্যেস করলেন, ‘কী বুঝলেন?’
সমুদ্র বলল, ‘যতটুকু বুঝলাম তাতে বর্তমানে ফটিক কর্মকার আর পরেশবাবুর সঙ্গে ভিক্টিমের সম্পর্ক তেমন মধুর ছিল না৷ আচ্ছা, পরেশবাবু এলেন না কেন বলুন তো?’
কমিশনার সাহেব বললেন, ‘দাঁড়ান একটা ফোন করি ওনাকে৷’ কিছুক্ষণের মধ্যেই কমিশনার সাহেবের স্পিকার ফোনে ভেসে এল ডক্টর পরেশ গুপ্তর গলা, ‘ডক্টর গুপ্ত বলছি৷’
কমিশনার সাহেব নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আপনি আজ এলেন না কেন?’
ডক্টর গুপ্ত বললেন, ‘কাজ ছিল তাই যাইনি৷ আমাদের মতো লোককে কী ডেকে পাঠালেই যাওয়া যায়?’
‘আপনি তাহলে কি কাল আসবেন?’
‘না, আমি কাল থেকে ক’দিনের জন্য কলকাতার বাইরে যাব৷’
‘কিন্তু এখানে আপনার আসাটা যে খুব জরুরি ছিল পরেশবাবু৷’
কমিশনার সাহেবের এ কথা শুনে ডক্টর গুপ্ত বেশ কর্কশভাবে বললেন, ‘আমি সেটা মনে করছি না৷ অযথা বিরক্ত করবেন না আমাকে৷ তেমন হলে আদালতের সমন পাঠান৷ যা বলার সেখানেই বলব৷’ এরপর তিনি লাইন কেটে দিলেন৷
কমিশনার সাহেব সমুদ্রকে বললেন, ‘পুরো ব্যাপারটাতে কী বুঝলেন? ডক্টর গুপ্ত কি কোনো কিছু এড়াতে চাচ্ছেন?’
সমুদ্র বলল, ‘আপাতত এক অরিন্দম মল্লিক বাদে অন্য দুজনের দিকেই কিছুটা সন্দেহের তির উঠছে৷ এবার একবার আপনি হরিকে ডাকুন৷’
কিছুক্ষণের মধ্যেই এক কনস্টেবলের সঙ্গে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ঢুকল হরি৷ ঘরে ঢুকেই সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি বাবুকে খুন করিনি৷ বিশ্বাস করুন আমি খুন করিনি৷’
সমুদ্র বলল, ‘তা বুঝলাম৷ কিন্তু তোমার বাবুর ঐ তিনজন বন্ধু ছাড়া আর কেউ আসা-যাওয়া করত? তিনি অন্য কোথাও যেতেন?’
হরি জবাব দিল, ‘না, আর কেউ আসত না৷ বাবু এমনিতেও বাড়ি থেকে আজকাল বেরোতেন না৷ দরকারে আমাকেই বাইরে পাঠাতেন৷’
সমুদ্র জানতে চাইল, ‘আচ্ছা তোমার বাবু হঠাৎ কাজকর্ম ছেড়ে দিয়েছিলেন কেন যেন?’
সে জবাব দিল, ‘শুনেছি বাবুর জন্য নাকি অল্পবয়সী একটা ছেলের যাবজ্জীবন জেল হয়৷ ব্যাপারটাতে বাবুর মন খারাপ হয়৷ তিনি কাজ ছেড়ে দেন৷ তবে ছেলেটা কে তা জানা নেই৷’
সমুদ্র বলল, ‘ঠিক আছে তুমি এবার যাও৷’
সে চলে যাবার পর সমুদ্র বলল, ‘এবার আমি উঠি৷ সবার কথাই শুনলাম, কিন্তু আমাকে ভাবাচ্ছে ছোট্ট একটা জিনিস৷’
৷৷ ৩৷৷
বাইরে এসে একটা ট্যাক্সি নিল সমুদ্র বাড়ি ফেরার জন্য৷ প্রতাপ তার মুখ দেখে বুঝতে পারল গভীর চিন্তামগ্ন সে৷ পরিস্থিতিটা একটু হালকা করার জন্য সে বলল, ‘এই সুযোগে হঠাৎ অরিন্দম মল্লিকের মতো অভিনেতাকে দেখা হয়ে গেল৷ ‘ইন্দ্রপ্রস্থ’ সিনেমাটাও দেখতে হবে৷ উনি কিন্তু বেশ ভালো অভিনয় করেন৷’
তার কথা শুনেই সমুদ্র হঠাৎ বলে উঠল, ‘আরে, আমিও দুর্যোধনের মতো অন্ধ নই তো! এই ড্রাইভার গাড়ি থামাও৷’ গাড়ি থামলে সে প্রতাপকে বলল, ‘তুমি লালবাজারে ফিরে কমিশনার সাহেবকে একটু থাকতে বলো, আমি আসছি৷’ প্রতাপ গাড়ি থেকে নামতেই; ট্যাক্সি নিয়ে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল সমুদ্র৷ সে মাঝে মাঝে এমন খ্যাপামি করে৷ প্রতাপ অন্য একটা ট্যাক্সি নিয়ে এগোল লালবাজারের দিকে৷
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরে এল সমুদ্র৷ তার চোখ-মুখ তখন খুশিতে উজ্জ্বল৷ কমিশনার সাহেবকে বলল, ‘চলুন খুনিকে ধরতে যেতে হবে, শুধু তার স্বীকারোক্তির জন্য ছোট্ট একটা মিথ্যা বলতে হবে আমাদের৷ বলতে হবে অবনীবাবুর ঘরে সিসি টিভি বসানো ছিল, আর তাতেই সব ধরা পড়ে গেছে৷ চলুন চলুন!’
আধঘণ্টার মধ্যেই আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটা বিরাট বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ল পুলিশদল৷ দরজা খুলতেই বাড়িতে ঢুকে পড়ল সমুদ্ররা৷ সম্ভবত সদ্য বাইরে থেকে ফিরেছেন অরিন্দম৷ সমুদ্রদের দেখে তিনি বললেন, ‘কী ব্যাপার?’ কোনো ভণিতা না করে সমুদ্র বলল, ‘আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে৷ অবনীবাবুকে খুনের অপরাধে আপনাকে আমরা গ্রেপ্তার করতে এসেছি৷’
অরিন্দম চিৎকার করে উঠলেন, ‘আপনারা কী পাগল! আপনাদের কাছে কী প্রমাণ আছে? আমি মানহানির মামলা করব!’
এবার অমোঘ অস্ত্র প্রয়োগ করল সমুদ্র৷ সে বলল, ‘সিসি টিভির ফুটেজ৷ আপনার বা আমাদের কারো জানা ছিল না যে ঘরে ক্যামেরা বসানো আছে৷ একটু আগে আলমারির আড়াল থেকে সেটা উদ্ধার হয়েছে৷ সব ধরা আছে তাতে৷’
সমুদ্রর কথা শুনে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন অরিন্দম৷ আর নিজেকে তিনি সামলাতে পারলেন না৷ দু-হাতে মুখ ঢেকে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিই খুন করেছি৷ ওর জন্যই আমার ভাইয়ের একটা কেসে যাবজ্জীবন হয়েছিল৷ ওকে অনেক অনুরোধ করেছিলাম মামলা না লড়তে৷ আমি প্রতিশোধ নিলাম৷’
খুনের দৃশ্য সিসি টিভিতে ধরা না থাকলেও এবার সমুদ্রর কাছে থাকা গোপন টেপরেকর্ডারে রেকর্ড হতে থাকল তাঁর স্বীকারোক্তি৷
প্রিজন ভ্যান অরিন্দম মল্লিককে নিয়ে লালবাজারে রওনা হবার পর কমিশনার সাহেবের গাড়িতেই বউবাজারের বাসায় ফিরছিল সমুদ্ররা৷ কমিশনার সাহেব সমুদ্রকে বললেন, ‘কোনো তেমন প্রমাণ ছাড়াই আপনি কীভাবে খুনিকে সনাক্ত করলেন বলুন তো?’
সমুদ্র পকেট থেকে একটা কাগজের পুরিয়া বের করল৷ তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল ছোট্ট একটা আয়নার টুকরো৷ সেটা দেখিয়ে সমুদ্র বলল, ‘ব্যাপারটা খুলে বলি৷ নিহতের গলায় কাচের গুঁড়ো পাওয়া গেছে শুনে আমি ভাঙা আয়নার টুকরোগুলো বাড়ি নিয়ে গেছিলাম৷ ভেবেছিলাম আয়নার কোনো টুকরো হয়তো কম হবে৷ যা দিয়ে খুন করার পর খুনি সেটা সঙ্গে নিয়েছে৷ কিন্তু দেখলাম ব্যাপারটা উল্টো৷ সব টুকরো জোড়া লাগার পর এই টুকরোটা বাড়তি হল৷ এই টুকরোটা আয়নার থেকে অনেক বেশি উজ্জ্বল৷ তাহলে কি খুনি যে কাচের টুকরো এনেছিল তার থেকেই এটা ভেঙে পড়েছিল?
‘ট্যাক্সিতে বাড়ি ফেরার সময় প্রতাপ বলল, অরিন্দমবাবুর অভিনীত ‘ইন্দ্রপ্রস্থ’ সিনেমাটা দেখতে হবে৷ সঙ্গে সঙ্গে ইন্দ্রপ্রস্থ নিয়ে মহাভারতের সেই অংশ মনে পড়ে গেল৷ ময়দানব পাণ্ডবদের জন্য স্ফটিকের ইন্দ্রপ্রস্থ বানিয়েছিল৷ যেখানে স্ফটিক আর জলের পার্থক্য না করতে পেরে জলে পড়েছিলেন দুর্যোধন৷ আর দ্রৌপদী তাই দেখে বলেছিলেন, ‘অন্ধর ছেলে অন্ধ!’ স্ফটিক মানে নিশ্চয়ই কাচ দিয়ে স্টুডিওতে সেট বানানো হবে৷ আমি ছুটলাম টালিগঞ্জে সেই স্টুডিওতে৷ দেখলাম ইন্দ্রপ্রস্থ যে কাচ দিয়ে বানানো হয়েছে তা হুবহু এই কাচ৷ প্রাথমিক অবস্থায় সন্দেহ কিন্তু ঘুরে যাচ্ছিল ফটিক কর্মকার বা পরেশ গুপ্তর দিকে৷ কিন্তু ভেবে দেখলাম পরেশ গুপ্ত গলা কাটলে তাঁর সার্জিক্যাল ছুরিই সহজলভ্য৷ আর ফটিকবাবুর সঙ্গে মৃতের টাটকা গণ্ডগোল৷ তিনি এ সময় খুন করার ঝুঁকি নেবেন না৷ সবাই তাঁকে সন্দেহ করবে৷ কাজেই আমার হাতে শেষ পর্যন্ত রইল এই এক টুকরো কাচ! যুক্তিপূর্ণ অনুমান অনেক সময় প্রমাণের থেকে অনেক বেশি জোরালো হয়৷ অবশ্য অরিন্দম স্বীকার না করলে মুস্কিল হত৷ অডিওটেপটা যত্ন করে রাখবেন৷’
—