১০
‘এনভায়রনমেন্ট পাল্টাপাল্টি করে দিলে দুটো মানুষে কি সত্যি খুব তফাত হবে?’
সার ব্যালট বাক্সটা উপুড় করে দিলেন, ‘দেখো উজ্জয়িনী, আর নেই। আর একটাও নেই।’ উজ্জয়িনীর মুখ পাংশু হয়ে গেছে। ঠিক যেন তার গালে কেউ একটা চড় মেরেছে। মিঠুর মুখেরও তাই দশা। অণুকা প্রায় ছুট্টে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল। বাইরে স্লোগান উঠছে—‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ। জিতছে কে, জিতছে কে, এস এফ আই আবার কে!’
সার বললেন, ‘রাজেশ্বরী আচার্য কই? সে-ও দেখুক। এসব ফর্মালিটিজ মানো তোমরা, যখন সবই আইনমাফিক করছ।’ এদিক-ওদিক তাকিয়ে কোথাও রাজেশ্বরীকে দেখতে পেলো না মিঠু। ভেঙ্কট এগিয়ে এসে বলল, ‘আমি রাজেশ্বরীর এজেন্ট সার, আমি দেখেছি, ঠিক আছে। সই করে দিচ্ছি।’
গৌতম বলল, ‘কোথায় গেল রাজেশ্বরী? এই তো একটু আগেও এখানে ছিল!’ রাজেশ্বরীকে কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। মিঠুর মুখের দিকে তাকিয়ে গৌতম আস্তে আস্তে বলল, ‘এস.এফ.আই যাকে দাঁড় করাবে, সে-ই জিতবে, এই সামান্য জিনিসটা বুঝতে তোরা এত সময় নিলি?’
ঠিক তার স্কুলের বন্ধু যে কজন সেই কটা ভোট পেয়েছে উজ্জয়িনী। সে বন্ধুদের সঙ্গে কাউন্টিং হলের বাইরে বেরিয়ে আসছে। একটা হাতে মিঠুর হাত এত শক্ত করে ধরেছে যে মিঠুর হাতে লাগছে। ভেঙ্কট উজ্জয়িনীর মুখের দিকে তাকিয়ে ভীষণ অপ্রস্তুত হল। সে থতমত খেয়ে বলল, ‘সরি উজ্জয়িনী নো অফেন্স মেন্ট।’ উজ্জয়িনী এক ঝটকায় পেছন ফিরে গেল। সে ফুলে ফুলে কাঁদছে। জীবনের গ্রন্থ থেকে তার একটা একটা করে ছবিঅলা পাতা খসে যাচ্ছে। হারাবার খেলা। হারবার খেলা শুরু হয়ে গেছে। ক্রমশই ন্যাড়া, বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে সব। মিঠু রুমাল দিয়ে মুছে মুছে লাল করে ফেলেছে মুখ, চোখ দুটোও ভারী, লাল হয়ে আছে।
ভেঙ্কট বলল, ‘ইস ছি ছি, মেয়েগুলো এত সেন্টিমেন্টাল হয়! গৌতম তন্ময়কে ডাক তো একবার!’
তন্ময় এসে বলল, ‘কী হয়েছে? হেরেছে? তো কী? ভ্যাট! উজ্জয়িনী, বেঁচে গেছ। গৌতম চল আমরা ক্যানটিনে যাই। মিঠু বিষ্ণুপ্রিয়া, উজ্জয়িনী চলো সবাই।’
উজ্জয়িনী অনেক কষ্টে বলল, ‘আমি এখন বাড়ি যাব। তোমাদের আমাকে করুণা দেখাতে হবে না।’
ভেঙ্কট বলল, ‘কে তোকে বাড়ি যেতে দিচ্ছে? দেবই না যেতে! এই সবাই মিলে ওকে ঘেরাও কর তো!’ মুহূর্তের মধ্যে উজ্জয়িনী আর মিঠুকে ঘিরে একটা বলয় তৈরি হয়ে গেল।
‘কী হচ্ছেটা কী? উজ্জয়িনী রেগে কাঁই হয়ে বলল, ‘সবাই মিলে রিজেক্ট করে এখন আবার ঢং করা হচ্ছে!’
মিঠু জানে উজ্জয়িনী ভীষণ অহংকারী। পরাজয় সে কখনও সহ্য করতে পারে না। পরাজয়ের কাছে কখনও আত্মসমর্পণও করে না। কোনও ব্যাপারে হারলে তার প্রতিক্রিয়া হল—ভারি বয়ে গেল। মিঠুর নিজের জোর অনেক অনেক কম। উজ্জয়িনী যেমন তাকে আঘাত করে, তেমনি আবার অনেক সময়ে তার এই ‘বয়ে গেল’ জীবনদর্শন দিয়ে তাকে উদ্বুদ্ধও করে। এসব ব্যাপারে উজ্জয়িনী মিঠুর আশ্রয়। যে কোনও বন্ধুবান্ধবের দলের মধ্যে এই ধরনের একটা পারস্পরিক পরিপূরকতার ব্যাপার থাকে, এই ভিত্তিতেই বন্ধুতা গড়ে ওঠে, মোটেই সবসময়ে মনের মিলের ওপর গড়ে না। এটা আজকাল মিঠু খুব স্পষ্ট করে বুঝতে পারে। উজ্জয়িনীকে কখনও এত বিচলিত হয়ে পড়তে সে দেখেনি। প্রকাশ্যে, সর্বজনসমক্ষে উজ্জয়িনী কাঁদছে এটা একটা নতুন ঘটনা।
ভেঙ্কট উজ্জয়িনীর কথা শুনে অবাক হয়ে বলল, ‘রিজেক্ট? কী বলছে রে গৌতম? রিজেক্ট কী?’
‘আর ই জে ই সি টি—বুঝলি না?’ গৌতম সঙ্গে সঙ্গে যোগান দিল।
‘অ, তাই বল! রিজেক্ট? কে বললে তোকে রিজেক্ট করা হয়েছে? যত দিন যাবে বুঝবি শাপে বর হয়েছে তোর। শাপে বর, বুঝলি?’
‘বুঝেছি। আর বোঝাতে হবে না। পথ ছাড়ো আমি বাড়ি যাব।’
‘চেষ্টা করে দেখ!’
‘ভেঙ্কট, আমি কিন্তু প্রিন্সিপ্যালের কাছে নালিশ করব তোমাদের নামে!’ উজ্জয়িনীর চোখ-মুখ থমথম করছে রাগে।
‘এই তো কী সুন্দর রীজনেবল কথা বলছিস! এমনি রাগ-টাগ করবি তবে তো তোকে মানাবে! চল আজ আমার বাড়ি চল সবাই। খাওয়াবো। উজ্জয়িনী চল প্লিজ!’
উজ্জয়িনী কিছুতেই রাজি হল না। সে মিঠুকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। মোহন গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, দুজনে উঠতে সে বলল, কী ধর?’
‘বাড়ি চলল, কোঠি।’
‘বাস!’ মোহন সাধারণত এত সকাল সকাল কোঠি ফরমাশ শুনতে অভ্যস্ত নয়।
‘হাঁ হাঁ কোঠি চলো না!’ স্বভাব মতো আদেশের সুরে অধৈর্যভাবে ঝাঁঝিয়ে উঠল উজ্জয়িনী। তারপরে সীটে হেলান দিয়ে চোখ দুটো বুজতে হঠাৎ তার এখনকার বাস্তব তার কাছে হু হু করে ফিরে আসতে লাগল। কে সে? ডক্টর মিত্রর চাকরকে এভাবে আদেশ করবার সে কে? যে কোনও দিন ডাঃ মিত্র ফিরে এসে তাঁর একটি অঙ্গুলিহেলনে তাকে চিরদিনের জন্য ধ্বংস করে দিতে পারেন, নয়ত তাকে মেনে নিতে হবে মায়ের সঙ্গে বিচ্ছেদের নিয়তি।
মিঠু বলল, ‘এই উজ্জয়িনী, অত ভেঙে পড়ছিস কেন? বুঝতেই তো পারছিস সবই পলিটিক্সের খেলা। প্লিজ একটু হাস তুই এরকম করে থাকলে আমার ভেতরটা কিরকম করতে থাকে।’
উজ্জয়িনী গাড়ির জানলা দিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ভিখারিণীর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘মিঠু তুই আমাকে খুব ভালোবাসিস, না রে? আচ্ছা ধর, আমি যদি ওই রকম একটা বেগার-মেইড হতাম। ভালোবাসতিস?’
‘এ আবার কী খেয়াল?’ মিঠু বলল, ‘ইলেকশনে হেরে তোর এমন অবস্থা হল যে ভিখারির সঙ্গে নিজের তুলনা করছিস…?’ উজ্জয়িনী কোনও জবাব দিল না। কিছুক্ষণ পর মিঠু বলল, ‘দেখ উজ্জয়িনী, জীবনের এক একটা ঘটনা আমাদের এমনভাবে আঘাত করে যে কতকগুলো মৌলিক প্রশ্নের সামনে যেন আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়, না রে? আমি কে? শুধু আমি, সমস্ত আনুষঙ্গিক বাদ দিয়ে সুদ্ধ আমিটুকু কে! তার মূল্য কী! অন্য আরেক জনের সঙ্গে আমার তফাত কোথায়! ধর সত্যিই ভিখারিণী মেয়েটা যদি আমার জায়গায় জন্মাতো আর আমি যদি ওর জায়গায় জন্মাতাম কী তফাত হত!’
উজ্জয়িনী বলল, ‘তোর এরকম মনে হচ্ছে?’ তার গলা এত আস্তে যে প্রায় শোনাই যাচ্ছে না।
মিঠু বলল, ‘হচ্ছে না। মাঝে মাঝেই হয়। এনভয়রনমেন্ট যদি পাল্টাপাল্টি করে দেওয়া হয় তাহলে কি সত্যি দুটো মানুষে খুব তফাত হবে?’
উজ্জয়িনী বলল, ‘সত্যি! দৈবাৎ, একেবারে দৈবাৎ আমরা আমাদের ভাগ্যটা ভোগ করছি। এভাবে ভোগ করার কোনও অধিকারই আমাদের নেই রে মিঠু। ওই রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা অনাথ ছেলে-মেয়েগুলোর জন্যে আমাদের কিছু করা উচিত। এভাবে..এটা ঠিক নয়। একদম ঠিক নয়।’ সে ‘নয়’ বলতে বলতে মাথা নাড়ছিল, তার গাল বেয়ে এক দানা চোখের জল টুপ করে চিবুকের ওপর পড়ল। মিঠুর ভেতরটা উজ্জয়িনীর জন্যে করুণায়, সমবেদনায়, ভালোবাসায় দ্রব হয়ে যাচ্ছিল।
সেই সময়ে কলেজের ইউনিয়ন রুমে আর একটা নাটক হচ্ছিল। কাউন্টিং প্রায় শেষ হয়ে এসেছে এমন সময়ে হঠাৎ রাজেশ্বরী ফলাফলটা কী হতে যাচ্ছে সেটা বুঝতে পারে। সে এসে সোজা সুকান্তকে একটা পদত্যাগপত্র দেয়। খাতার পাতা থেকে ছিঁড়ে নিয়ে খসখস করে লিখেছে সে পদত্যাগপত্রটা। তার চোখমুখ লাল। না কাঁদলেও ঝড়ের আকাশের মতো তার অবস্থা।
সুকান্ত বলল, ‘এ কি করছ রাজেশ্বরী! এ রকম হয় নাকি? এইমাত্র অত মার্জিনে জিতে এলে এক্ষুনি আবার ব্যাক আউট করা যায় না কি? আবার ইলেকশন, আবার হাঙ্গামা। না না, এরকম হয় না।’
‘আবার ইলেকশনের কী আছে? আমি ড্রপ করলেই উজ্জয়িনী আপসে চলে আসছে।’
‘তা হয় না রাজেশ্বরী। ওকে দাঁড় করিয়েছে সি.পি। আমরা এমনি এমনি ছেড়ে দেব না কি?’
‘সে আপনারা যা ইচ্ছে করবেন।’ বলে রাজেশ্বরী আর দাঁড়াল না। তার চোখের সামনে খালি ভাসছে উজ্জয়িনীর ক্রমশ ছাইয়ের মতো হয়ে যাওয়া মুখটা। সে কারুকে ডাকলো না, একলা একলা চুপি চুপি বাস-স্টপের দিকে চলে গেল।
উজ্জয়িনীর ফোন এসেছে। —‘হাল্লো!’
‘আমি ভেঙ্কট কথা বলছি। শোনো উজ্জয়িনী। জোর খবর। রাজেশ্বরী ভীষণ কান্নাকাটি করে রেজিগনেশন দিয়ে গেছে।’
‘কী?’
‘যা বললুম নির্জলা সত্যি। এস এফ আই-কে আবার ক্যান্ডিডেট দাঁড় করিয়ে আমাদের ক্লাসের ভোট নতুন করে করতে হবে। শোনো, ক্লাসের সবাইকে আমরা বলে দিচ্ছি, কেউ দাঁড়াতে রাজি হবে না। তোমাকে আমরা ইউনানি মাসলি পাঠাচ্ছি।’
‘এ সব কী হচ্ছে? আমি কি তোমাদের কাছে এসব চেয়েছি? রাজেশ্বরীই বা হঠাৎ এরকম করল কেন?’ উজ্জয়িনী এখন অনেক শান্ত হয়ে গেছে।
‘রাজেশ্বরী তো তোকে হারিয়ে ভীষণ আপসেট হয়ে গেছে, সুকান্তদা বলছে, কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ লাল করে ফেলেছে। তোরা মাইরি দেখালি একখানা!’
‘আমি হেরে গেছি সেটা মেনে নেওয়াই আমি সম্মানজনক মনে করি ভেঙ্কট। ওসব মতলব ছাড়ো। ন্যাড়া বেলতলায় দুবার যায় না।’
‘যা ব্বা বা।’
‘বাবাকেই ডাকো আর মাকেই ডাকো, রাখছি।’
রাজেশ্বরীর নম্বর ডায়াল করল উজ্জয়িনী।
‘হ্যাললো?’
আমি উজ্জয়িনী বলছি। রাজকে একটু ডেকে দেবেন?’
‘উজ্জয়িনী? রাজির কি হয়েছে রে? হাউ-হাউ করে কাঁদল কলেজ থেকে এসে। খেলো না। এখন তো শুয়ে পড়েছে।’
‘প্লিজ একটু ডাকুন মাসি। আমার নাম করে বলবেন।’
কিছুক্ষণ পরে ভারী ধরা গলা শোনা গেল ওদিকে।
উজ্জয়িনী বলল, ‘রাজ কংগ্র্যাচুলেশনস।’
‘কিসের জন্য? আমি তো রিজাইন করেছি। বাজে যত সব।’
‘তুই না গেলে আর কেউ যাবে রাজ, আর কাউকে তো আমরা তোর মতো বিশ্বাস করতে পারব না! প্লিজ, পাগলামি করিস না। কালকে গিয়ে চিঠিটা ফিরিয়ে নিস।’
‘দূর, পড়াশোনার ক্ষতি হবে, আমি পারব না।’
‘একটা তো বছর। চালিয়ে দে না। আমাদের মুখ চেয়ে কর রাজ, প্লিজ।’
‘দেখি। চিন্তা করতে হবে।’
‘দেখি নয়, কথা দে। বিশ্বাস কর আমি কিছু মনে করিনি। আর আমারই তো ভুল, অনেকেই আমায় বলেছিল উইথড্র করে নিতে।’
‘তো নিলি না কেন?’
‘কি রকম একট রোখ চেপে গিয়েছিল, সত্যি বলছি ভুল করেছি। ক্ষমা করবি না?’
এইভাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই কে জয়ী, কে পরাজিত, কে কাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, সব গুলিয়ে গেল। উজ্জয়িনী রাজেশ্বরীর কাছ থেকে কথা আদায় করে, হালকা মনে মিঠুকে ফোন করল একঘণ্টা ধরে। রাতে খুব শান্তির ঘুম ঘুমোলো। পরদিন কলেজ গিয়ে রাজেশ্বরীকে পাকড়াও করল। তারপর চিঠি ফেরত নেবার জন্য ইউনিয়ন রুমে চলল।
সুকান্ত বলল, ‘কী ছেলেমানুষি কাণ্ড বলো তো উজ্জয়িনী। ভাগ্যিস তুমি ছিলে তাই আমরা রক্ষা পেলুম। তুমিই দেখছি বেশি স্টেডি। রাজেশ্বরী, ওকে দেখে শেখো। অত ইমোশন্যাল, ইরর্যাশন্যাল হলে কোনও কাজ করা যায় না।’
রাজেশ্বরী বলল, ‘ফেলো ফিলিং বাদ দিয়ে, ইমোশন, ইনভলভমেন্ট এসব বাদ দিয়ে যে কাজ তাতে আমি বিশ্বাস করি না। আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে ইনভলভড। এতে যদি আপনাদের কাজের অসুবিধে হয় তো আমি থাকছি না। বলেই তো দিয়েছি।’
‘উঃ বাবা, এই মেয়েগুলো আমার মাথা ধরিয়ে দিলে, রাজেশ্বরী কালচ্যারাল সেক্রেটারি থাকবে, বুঝলি অরবিন্দ। ওকে লিডারশিপ দেওয়া যাবে না।’
উজ্জয়িনী ক্লাসে এলে গম্ভীরভাবে ভেঙ্কট বলল, ‘আমরা সেলিব্রেট করব। আমার বাড়িতে কাল সন্ধেয়, সুবিধে হবে কি না দেখো।’
বিষ্ণুপ্রিয়া বলল, ‘সন্ধেয় বলছিস, আমি ফিরব কী করে?’
‘কেন? তন্ময় পৌঁছে দেবে।’
তন্ময় বলল, ‘হ্যাঁ, এর মধ্যে অসুবিধের কি আছে! ভেঙ্কট, গৌতম আমরা সবাই তো নর্থে আসব।’
মিঠু বললে, ‘তোরা কেউ ইমনকে দেখেছিস?’
‘ইমন? তুই জানিস না। ও তো ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে ব্যাঙ্গালোর গেছে।’
‘তাই বুঝি? ও মা। আমাকে বলেনি তো!’
‘কাউকেই বলেনি। ভোটের ব্যাপারে যোগাযোগ করতে গিয়ে শুনলুম।’
‘ইমন যদি ভালো কিছু করে, তাহলে কিন্তু আমার বাড়িতে সেলিব্রেট করব।’ ভেঙ্কট বলল।
‘কী ব্যাপার রে ভেঙ্কট, তোর যে দেখি ভীষণ উৎসাহ!’ মিঠু বলল।
ভেঙ্কট হাসি-হাসি মুখে বলল, ‘আরে বাবা আছে। র্যাটিওসিনেটিভ সিনক্রোনাইজেশন।’
সব্বাই হাসতে লাগল। আসলে ভেঙ্কট একটা ছোটখাটো বিপ্লবই করে ফেলেছে। ওদের বাড়িতে পাঁচ শরিকের ডালপালার সবার সঙ্গে সবাইকার ভালো সম্পর্ক নেই। ফলে অত বড় সেকালের বাড়ি, তার সেগুন কাঠের জানলা দরজা, পাথরের মেঝে, বাথ-টবঅলা বড়-বড় বাথরুম নিয়ে অবহেলিত পড়েছিল। কার্নিশ থেকে গজিয়েছে বিশাল বটগাছ। ছাতের পাঁচিলের ফাঁকে তো রীতিমতো একটা ডুমুর গাছ। তাতে কষা কষা ডুমুর ফলে। যেখান সেখান থেকে ভেঙে ভেঙেও পড়ছিল। কিন্তু কারুর নজর ছিল না। সেইখানে ভেঙ্কট উদ্যোগ নিয়ে, সবাইকার কাছ থেকে টাকাকড়ি আদায় করে বাড়ি সারিয়েছে, উৎকৃষ্টতম রঙ দিয়ে রঙ পালিশ হয়ে বাড়ি এখন ঝকঝক করছে। মাঝের উঠোনটা বাঁধানো হয়েছে তার মাঝখানে একটা লাল নীল মাছের ছোট্ট পুকুর, এবং ধারে ধারে হরেক রকমের গোলাপ। ঘরের মালিকানার একটু অদলবদলও হয়েছে। এখনও নিচেই সবাইকার আলাদা আলাদা রান্নাঘর। কিন্তু দোতলায় তেতলায় প্রত্যেকটা পরিবার মোটামুটি পাশাপাশি। সকলেই মোটের ওপর তুষ্ট, এবং ভেঙ্কটের ওপর সবারই একটা আলাদা রকম আস্থা এসেছে। সবচেয়ে খুশি হয়েছেন তার দুই জীবিত দাদু, মেজদাদু ও ছোড়দাদু। পুরস্কারস্বরূপ মেজদাদু তাঁর অংশের দোতলার পাশাপাশি ঘরদুটো ভেঙ্কটকে ব্যবহার করবার অনুমতি দিয়েছেন। ঘর দুটো বিশাল। তাতে খুব সুন্দর সেকেলে আসবাব আছে। সেগুলো পালিশ করে হয়েছে যেন রাজরাজড়ার ঘর। একটা শোয়া, পড়াশোনা ইত্যাদির জন্যে ব্যবহার করে ভেঙ্কট, আরেকটা বসার ঘর। অদূরেই বাথরুম, এটাকেও একেবারে আধুনিক করে ফেলেছে ভেঙ্কট। বসার ঘরে একটু রান্নার ব্যবস্থাও রেখেছে। মেজদাদু এবং ছোড়দাদু দুজনেই তাকে বেশ কিছু টাকা দিয়েছেন। উপরন্তু মেজদাদু তাকে শেয়ার বাজারের নানা খুঁটিনাটি শেখাচ্ছেন। সে শিগগিরই একটা পরীক্ষা দেবে। দাদুদের কাছ থেকে পাওয়া টাকাগুলো সে খাটাচ্ছে। বাড়ির আর সবাইকে সে বলেছে, ‘দেখো, আজকাল বড় বড় ফ্ল্যাট বাড়িতে অ্যাসোসিয়েশন করে কমন খরচগুলো চালায়, তা তোমরাও আমাকে বাড়ির কেয়ারটেকার করে দাও। প্রত্যেক ফ্যামিলি কিছু কিছু দেবে, আমি সব কিছু দেখাশোনা করব।’
পরীক্ষামূলকভাবে এ ব্যবস্থা চালু হয় এক মাস। ভেঙ্কট সবাইকার আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছে। ফলে, এখন তার নিজের নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হয়েছে, সে বাড়ির প্রয়োজনে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, ছুতোর মিস্ত্রি, জমাদার ইত্যাদি সব কিছুরই দায়িত্ব নিয়েছে। ছোটখাটো কাজ সে নিজেই করে দেয়। তার এখন এসব বিষয়ে প্রচুর ব্যবহারিক জ্ঞান। কোন পেন্টের কত দর, সিমেন্ট কোন কোম্পানির ভালো, পুরনো সেগুন কোথায় কিনতে পাওয়া যায়, রাজমিস্ত্রির রোজ, জোগাড়ের রোজ, কিভাবে ওরা ফাঁকি দেয়, এসব এখন তার নখদর্পণে। পাড়ার নিতাই জ্যাঠা তাকে অনুরোধ করছেন তাঁদের বাড়িটা সারিয়ে দিতে। ভেঙ্কট বলেছে, ‘টু পাইস দেবেন তো জ্যাঠা!’
‘আরে ভাই, কনট্রাক্টরকে দিলেও তো সে নেবে।’
‘হ্যাঁ, নেবে মানে সব মালের থেকে কেটে কেটে নেবে, আপনি জানতেও পারবেন না। কত নিল, কোনখানে দু নম্বরি মাল দিয়ে এক নম্বরের দাম আদায় করল। তো আমি তা করব না। কাজেই আমার খাটুনির দাম পুষিয়ে দেবেন।’
এখন নিতাই জ্যাঠার সঙ্গে তার দর কষাকষি চলছে।
যাই হোক, তার নিজের একখানা চমৎকার আস্তানা হয়েছে, এবার সে কলেজের বন্ধুদের এখানে এনে আড্ডা দিতে চায়। ভেঙ্কটের এখন সর্বদাই ফুরফুরে মেজাজ। দিলদরিয়া ভাব। দাড়িটা আজকাল সে খুব কায়দা করে ট্রিম করছে। তার গোল মুখটা, ঈষৎ ছুঁচলো আঁতেল আঁতেল দেখায়, জামাকাপড়ের যত্ন বেড়েছে। রাজেশ্বরীর থেকে বেঁটে হওয়ার মনোদুঃখটা বোধ হয় অনেকটা ভুলেও গেছে সে।
গৌতমকে একদিন কোচিং থেকে ফিরতে ফিরতে বলল, ‘তুই সেদিন ভবিষ্যৎ-ভবিষ্যৎ করছিলি না? কী করবি ঠিক করলি?’
‘কী আর ঠিক করব? এখন আমি দু ফুট দূর পর্যন্ত দেখতে পাই। তো তাইতেই সন্তুষ্ট আছি। বেশি দূর অবধি দেখতে চাইলে সমস্ত মজাই মাটি। খিদে চলে যাবে। মাথা ধরবে, অম্বল হবে….’
‘থাম, থাম। তোর সঙ্গে অনেক জরুরি আলোচনা আছে’
‘জরুরি আলোচনা? কে করবে রে ভেঙ্কট? তুই? হাঃ হাঃ।’
‘কিছুদিন আগেই তো তুই ভবিষ্যতের কথা জিজ্ঞেস করছিলি। এখন আবার উল্টো গাইছিস?
‘কিন্তু এখন এই মুহূর্তে ভাবতে ইচ্ছে করছে না। তুই হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে গেলি কেন? তোর সঙ্গে কথা বলে আমি যা হোক একটু শান্তি পাই। এমনিতেই তো সবারই মুখ গোমড়া, বাবা মা, দিদি দাদা বউদি। সব একধার থেকে রামগরুড়। কলেজে এসে মনটা একটু মুখ বদলায়।
গৌতমকে নিয়ে ভেঙ্কট হেদুয়ার ভেতর ঢুকল। খালি বেঞ্চি আর পাওয়াই যায় না। অবশেষে ঘাসের ওপরেই দুজনে বসে পড়ল। ভেঙ্কট বলল, আমার মাথায় অনেক কিছু খেলছে। দেখ তুই যদি পার্টনার হোস তো সাহস করে নেমে পড়তে পারি।’
‘ব্যবসা-ট্যাবসা করবি না কি?’ গৌতম সন্দিগ্ধ সুরে বলল, ‘দেখ ঘেঁটু। ওসব আনসার্টন ব্যাপারে আমি নেই। মাস গেলে থোক পকেটে আসবে। নিশ্চিন্ত মনে ঘুম যাব। আমি এই বুঝি। প্রাণপণে রেজাল্টটা ভালো করবার চেষ্টা করছি। আজকাল টিচিং লাইনে মালকড়ি ভালোই দিচ্ছে।’
‘দূর দূর ও আবার একটা টাকা নাকি? জানিস, আমি এখন শুধু পার্টটাইমে কত কামাচ্ছি!’
‘এই যাঃ, মনে করিয়ে দিলি। উঠি রে ভেঙ্কট টুইশনি আছে।’ গৌতম তড়বড় করে উঠে পড়ল, ‘আরেকদিন হবে।’
গৌতম চলে গেলেও ভেঙ্কট একা একা বসে রইল জলের দিকে তাকিয়ে। তার মাথায় ঘুরছে আর সি সি, এফ এ আর, ট্রাডিশনাল ব্রিক, মডুলার ব্রিক, নীট সিমেন্ট, ডেডো ফিনিশ, চাঝা, কলাম, বিম…। কলকাতার আশেপাশে বিশাল-বিশাল বাড়ি উঠছে ভেঙ্কটের। মোটা মোটা তাড়ার নোট সে গুনে গেঁথে মেজদাদুর আয়রন চেস্টে তুলে রাখছে। আস্তে আস্তে ভরে গেল সিন্দুকটা। তখনও টাকা রয়ে গেছে প্যান্টের পাশ পকেটে, হিপ পকেটে। ভেঙ্কট মস্ত বড় একটা গাড়ির পাল্লা খুলে বসল, স্প্রিংটা তাকে নাচিয়ে নিল একবার। ভেতরটা চমৎকার ঠাণ্ডা। এয়ার-কন্ডিশনড তো! সে নিজেই ড্রাইভ করছে। ভি আই পি রোড ধরে সোজা। দুধারে সুন্দর সুন্দর বাড়ি সরে সরে যাচ্ছে। গাছপালা, মাঠ-ময়দান, গরু-বাছুর। তার পেছনে, সামনে আরও গাড়ি। ভেঙ্কট একটা সিগারেট ধরালো। না, পাইপ। পাইপ না হলে ঠিক মানায় না। সে এখন এয়ারপোর্টে যাচ্ছে। তার গাড়ির বুটে একটা ফাইবারের সুটকেস আছে। সঙ্গে একটা বিউটিফুল ব্যাগ। সে আজ সন্ধের ফ্লাইটে নিউ ইয়র্ক যাচ্ছে। দিন সাতেক নিউ ইয়র্ক, তার পিসতুতো ভাই শুভো আছে, তারপর কানাডা। উত্তর আমেরিকা মহাদেশটা সে ভালো করে দেখবে। তিন মাস ধরে। কয়েক লাখ টাকা খরচ হবে। তা হোক।