একাদশ পরিচ্ছেদ— কথোপকথন
“আমি তোমার সঙ্গে একলা কিছু কথা বলতে চাই তুর্বসু”, বলল অপর্ণা ।
“না। যা বলার আমার সামনেই বলুন।” আমি কিছু বলার আগেই চাপা কিন্তু স্পষ্ট প্রতিবাদ ভেসে এল উর্ণার গলা থেকে। “এতদিন অনেক অন্ধকারে ছিলাম।এবার আমি সব কিছু জানতে চাই।”
“কিন্তু সেই জানা তোমার পক্ষে সহ্য করা মুশকিলও হতে পারে। বুঝতে
পারছ তো?” আবার চোখের জল মুছে প্রায় ইস্পাতকঠিন গলায় উর্ণা বলল, “তা হোক। আমি সহ্য করে নেব। আপনাকে সেটা ভাবতে হবে না।”
উর্ণার গলার শ্লেষকে উপেক্ষা করেই অপর্ণা এবার উর্ণার মায়ের দিকে তাকাল। উনি মাথা নিচু করে বসে আছেন। অপর্ণার বর্তমান স্বামী সুতনু বরং “আমি একটা সিগারেট খেয়ে আসি” বলে বেরিয়ে গেলেন। ঘরে এখন আমরা চারজন। চারজনই চুপ। অপেক্ষা করছি কে প্রথম কথা বলে।
বলল অপর্ণাই।
“প্যারামাউন্টে তোমার সঙ্গে প্রথমবার দেখা হবার সময় আমি সজ্ঞানে কিছু মিথ্যে বলেছিলাম। আসলে তুমি যে এই পরিবারের সঙ্গে যুক্ত, এই বাড়িতেই থাকো, সেটা আমার জানা ছিল না। কিন্তু এখন যা বুঝতে পারছি, তোমার গোটা ঘটনাটা জানা উচিত। না হলে তুমিও অন্ধকারে থেকে যাবে।”
আমি কিছু বললাম না। বলার কিছু নেইও।
খানিক চুপ থেকে আবার শুরু করল অপর্ণা, “এতদিনে তুমি নিশ্চিতভাবে নীবারের নাম জেনেছ। প্রায় একশো বছর আগে কলকাতার ফ্রিম্যাসনদের মধ্যে একটা ভাঙন ধরে। সেটা ঠিক কী নিয়ে, আমিও জানি না। তবে ম্যাসনদের মধ্যে অনেকেই ব্রাদারহুড ছেড়ে দেয়। কিছু ব্রাদার নীবার নামে এক গোপন সংগঠন তৈরি করে।”
“আপনি এত কিছু জানলেন কী করে?”
“বাবার মুখে শুনেছি। তোমাকে শুরুতেই বললাম না, আগের দিন কিছু মিথ্যে কথা বলেছি…. দেবাশিসের সঙ্গে আমার জীবনানন্দ সভাঘরে দেখা হয়নি। হয়েছিল আমার নিজের বাড়িতে। দেবাশিসের বাবা ছোটোবেলাতেই মারা গেছিল। দেবাশিস আর তার মায়ের দায়িত্ব নীবার নিয়েছিল। সেই সূত্রেই…”
“মানে দেবাশিসদাও নীবারের সদস্য ছিলেন?”
“হ্যাঁ। বুদ্ধিমান ছেলে, কথাবার্তায় ভালো। আমার পছন্দ হয়ে যায়। বাবা তখন বেঁচে। আমি বাবাকে বলি। বাবার ইচ্ছে ছিল না।”
“কারণ?”
“জানি না। শুধু বলতেন যতই ছেলে ভালো হোক, ওর রক্তের দোষ আছে।”
“সেটা ঠিক কী বলতে পারেন?”
“না। বাবা বলেননি। আমি গোপনে দেখা করতাম। সম্পর্ক রাখতাম। এমন চলল মাস দুই। তারপর বাবা একদিন আচমকা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। আমার আর দেবাশিসকে বিয়ের পথে কোনও বাধা রইল না।”
“আপনার মা কিছু বলেননি?”
অপর্ণা চুপ থেকে তার মায়ের দিকে তাকাল। ভদ্রমহিলা আমি আসা অবধি একটাও কথা বলেননি। মাটিতে রাখা কার্পেটের দিকে ঠায় তাকিয়ে বসে আছেন।
একটু গলা খাঁকরে আবার শুরু করল অপর্ণা, “মায়ের বিশেষ কিছু বলার ছিল না। আমার তখন দশ বছর বয়স। মা নিশীথ দত্তের জন্য আমাদের ছেড়ে চলে আসেন। নিশীথ দত্ত আর আমার বাবা বেস্টফ্রেন্ড ছিলেন। ছোটোবেলায় উনি প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসতেন নীবারের কাজে। আমাকে ঘুরতে নিয়ে যেতেন। আদর করতেন। তারপর একদিন সকালে শুনি মা চলে গেছে নিশীথ আঙ্কলের কাছে। আর আসবে না। বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে দেননি।”
“আপনি চেষ্টা করেননি?” উর্ণার মার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
ওঁর চোখেও জল। “করেছিলাম। অনেকবার করেছিলাম। ফার্গাস চাইত না। নিশীথ-ও অপছন্দ করত।”
“ফার্গাস! আপনার বাবা?”
“হ্যাঁ। তোমায় বলা হয়নি। আমরা আদতে খ্রিস্টান। আমার পুরো নাম অ্যালিস অপর্ণা। বাবা ফার্গাস পবিত্র অ্যাভেরি। মা বিয়ের আগে ছিলেন এলিজা সুপর্ণা। মা সুপর্ণা, আমি অপর্ণা আর ও উর্ণা।”
“কিন্তু নিশীথ দত্ত তো হিন্দু।”
“একেবারেই। ম্যাসনিক ব্রাদারহুডে সবাই যোগ দিতে পারত। ধর্ম দেখা হত না। কেন, তোমার পূর্বপুরুষ, তারিণীচরণ রায়, তিনিও তো হিন্দুই ছিলেন।”
চমকে উঠলাম। তারিণীর কথা অপর্ণা জানল কী করে? হয়তো আমার মনের কথা জেনেই অপর্ণা বলল, “ব্রাদারহুডের সবাই আজও তারিণীচরণ রায়কে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। তিনি ব্রাদারহুডকে নাকি একবার ভয়ানক বিপদের হাত থেকে বাঁচান। কিন্তু সেটা কীভাবে তা আমার জানা নেই। তুমি জানো না তুর্বসু, তুমি কী বিরাট মানুষের বংশধর!”
শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। একেবারে প্রথম দিন অনেকটা ঠিক এমনই কিছু একটা বলেছিলেন না দেবাশিসদা? এদিকে অপর্ণা বলে চলেছে, “বাবার মৃত্যুর পরে মায়ের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করি। নিশীথ দত্ত বাধা দেননি। দেবাশিসকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তে ওঁর সায় ছিল বলেই মনে হয়। আমরা কোর্ট ম্যারেজ করি। মা, আমার এক বান্ধবী আর দেবাশিসের পুলিশ বন্ধু অমিতাভ সাক্ষী দিয়েছিল। তারপরেই আমার দুর্দিন শুরু হয়।”
“কেন?”
“মা, তুমি একটু অন্য ঘরে যাও প্লিজ। আমি এই কথাগুলো তোমার সামনে আলোচনা করতে চাইছি না। আর তুমি তো সবই জানো।”
ঊর্ণার মা কিচ্ছু না বলে উঠে চলে গেলেন। অপর্ণা এবার উর্ণার দিকে তাকাল।
“আমি থাকব।” কঠিন স্বরে বলল ঊর্ণা।
“বেশ। তবে বলি। বিয়ে ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত জানো। বিয়ের আগে দুইজনেরই মনে নানারকম কল্পনা থাকে, সঙ্গে অবশ্যই যেটা থাকে, সেটা হল শরীরী চাহিদা। বিয়ের প্রথম বছরগুলোতে সেই শরীরের মেলামেশা দুজনের মধ্যে একটা মানসিক বাঁধন তৈরি করে। সেটাই বিয়ে নামের এই অদ্ভুত প্রতিষ্ঠানটাকে চালিয়ে নিয়ে যায়। যদি এই মানসিক বাঁধন কোনও কারণে তৈরি না হয়, তবে একসময় ছেলেটা আর মেয়েটা দুজনেই দ্যাখে তারা আবার বিয়ের আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। শুধু মাঝখান থেকে বিয়ে নিয়ে তাদের ইলিউশন, তাদের কল্পনাটা ধ্বংস হয়ে যায় একেবারে।”
“আপনাদের বেলাতেও তাই হয়েছিল?”
“আমাদের বেলা যা হয়েছিল, তা তুমি ভাবতেও পারবে না। আমি ওর কাজকর্ম মেনে নিতে পারিনি। প্রায়ই ঝামেলা হত। ও নিয়মিত যাতায়াত শুরু করল বেশ্যাপট্টি আর হিজড়াখোলে। আমি উপায় না দেখে আলাদা থাকা শুরু করলাম। আর তখনই ও চরম পথ বেছে নিল।”
“কী পথ?”
“তখন সেপারেশন চলছে। ডিভোর্স হব হব। আমি ওকে ছেড়ে বাবার ফ্ল্যাটে থাকা শুরু করেছি। আমায় ফোন করে আসতে বলল চন্দননগরে। ডিভোর্স নিয়ে না কী সব কথা আছে। আমিও গেলাম। গিয়ে দেখি বিকেলে তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে ফিরে এসেছে। সঙ্গে একগাদা খাবার। মুড ভালো থাকলে ভালো ব্যবহারই করত। বলল একসঙ্গে ডিনার করবে। অনিচ্ছাতেও আমি রাজি হলাম। খাবার মধ্যে কিছু একটা মেশানো ছিল। খেয়ে আমার খুব ঘুম পেতে লাগল। ও আমাকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর আমার আর কিচ্ছু মনে নেই। সকালে যখন উঠলাম, বুঝলাম আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে।”
“কী সর্বনাশ?”
খানিক চুপ থেকে অপর্ণা বলল, “আমি ঘুম থেকে ওঠার পর দেবাশিস গম্ভীর মুখে মোবাইল খুলে আমাকে দেখাল। আই ওয়াজ রেপড বাই সামওয়ান। নট দেবাশিস। গোটা ব্যাপারটা ও ভিডিও করে রেখেছে।”
“যে করেছে তাকে চিনতে পারলেন?”
“নাহ। ভিডিওটা দেখার প্রবৃত্তি হয়নি। দেড় মাস বাদে বুঝলাম আমি প্রেগন্যান্ট।”
“তবে এই বাচ্চার বাবা…” আমি অপর্ণাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলাম।
“জানি না। আর দেবাশিস মরে গেছে। এখন আর জানা সম্ভব না।”
“সুতনু জানেন?”
“ও সব জানে।”
“উনি কিছু স্টেপ নিতে বলেননি? এ তো একরকম রেপ।”
“নাহ! তখন অলরেডি উই ওয়্যার ইন রিলেশনশিপ। ও অ্যাডভাইস করল এসব করলে কাদা ছোড়াছুড়িতে আমাদের সম্মান নষ্ট হবে। পরে পেটে বাচ্চা এলে সুতনু বলল, ও নিজেই বাবার পরিচয় দেবে। ওর মতো মনের মানুষ হয় না।”
“বুঝেছি। কিন্তু আমাকে এসব বলার কারণ কী?”
“এই দ্যাখো, আসল কথাটাই বলিনি। যে কারণে তোমাকে ডাকা। সেপারেশন চলাকালীন আমি মাঝেমধ্যে বিভিন্ন দরকারে ওই বাড়িতে যেতাম। একদিন কিছু কাগজপত্র দিতে গিয়ে দেখি বাড়িতে দেবাশিস নেই, কিন্তু দরজা খোলা। আমি দোতলায় উঠে দেখলাম দোতলায় বাথরুমের পাশে ইট বালি সিমেন্ট মেখে কীসব কাজ হচ্ছে। মিস্তিরিদের জিজ্ঞেস করায় ওরা বলল। ঘরের কাজ হচ্ছে। একইরকম কাজ বাড়ির পিছনদিকটাতেও হচ্ছিল। আমি আগ্রহী হয়ে কিছু দেখার আগেই দেবাশিস চলে আসে। প্রথমে বেশ রেগে যায়, কেন আমি ওকে না জানিয়ে এসেছি। তারপর আমাকে নিয়ে বাইরে চলে যায়। একটা কফিশপে বসে মিনিট পাঁচেকের কথা হয়। ও বলে বাথরুম রিপেয়ার হচ্ছে। কিন্তু আমি যতদূর জানি, বাথরুম যথেষ্ট ঠিক ছিল। রিপেয়ারের দরকার নেই। আমার ধারণা ও বাথরুমের পিছন দিকে কোনও ঘর বানিয়েছিল। গোপনে। আজ আমাকে মা ফোন করে জানালেন, পুলিশ নিশীথ আঙ্কলকে ধরে নিয়ে গেছে দেবাশিসকে খুনের অভিযোগে। প্রমাণ বলতে সিসিটিভি ফুটেজ। পুলিশ ওঁকে অকারণে ফাঁসিয়ে দেবে। তুমি ভাই প্লিজ একটু নিজের মতো করে তদন্ত করো।”
“ঠিক আছে, আমি দেখছি। আর একটা প্রশ্ন। আপনি বললেন দেবাশিস গুহরা নীবারের সদস্য ছিলেন। তবে তো নিশীথকাকুর মতো ওঁরাও হিন্দু হয়েও ব্রাদারহুডের সদস্য।”
এবার হেসে ফেললেন অপর্ণা।
“দেবাশিসের শয়তানি তুমি আর কতটা জানবে? এতদিন এত কথা হয়েছে আর নিজের আসল নামটা জানায়নি? আমার মতো ও নিজেও অ্যাংলো। কিন্তু হিন্দু সেজে থাকত। হিন্দু পরিচয় দিত। যাতে অপরিচয়ের বাধা না থাকে। নিজের নামটা জাস্ট উলটে বঙ্গীকরণ করে নিয়েছিল ও।”
আমার মাথা বনবন করে ঘুরছে। “তাহলে দেবাশিস গুহের আসল নাম কী?”
“গুয়াফি ডিবাসি। গুয়াফি নামে আগুন, জানো নিশ্চয়ই।”