একটি মৃত্যু সম্পর্কে পূর্ব ঘোষণা
মুখবন্ধ
মাননীয়াসু,
এটা খুব দুঃখের বিষয় যে, বিগত ৫ বছর ধরে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে দিয়ে স্পেশাল সুপারিন্টেন্ডেণ্ট-র নাম টিভি এবং রেডিয়োয় ঘোষণার পর ঘোষণা করিয়ে, পুলিশ এবং অন্যান্য সূত্রে আপনার নিরুদ্দিষ্ট স্বামীর খোঁজ পাবার বৃথা চেষ্টার পর এই চিঠি যখন আপনার হাতে পৌঁছাবে, তার আগেই আপনি খবর পেয়ে যাবেন যে, তিন-তিনটি বছর জুড়ে খুঁজে-খুঁজে, প্রত্যাশায় থেকে থেকে, শেষ পর্যন্ত আপনি যাকে মৃত বলে ধরে নিয়েছিলেন এবং তবুও সিঁদুর মোছেননি বা শাঁখা ভাঙেননি, আপনার স্বামী সেই কৃষ্ণেন্দু বেরা এতদিন জীবিত ছিলেন এবং অবশেষে তিনি সত্যই মৃত। কাল সন্ধেবেলা আমি তাকে খুন করব।
মৃতদেহ আবিষ্কার হবার কথা পরশুদিন ভোরের দিকে। যখন পাতাকুড়োনিরা জঙ্গলে ঢুকবে। তারাই দেখতে পাবে।
তাহলে, পরের দিন অর্থাৎ ২৩ জুন, এইরকম একটা খবর কাগজে বেরোতে পারে। যথা :
ডাক্তারের আত্মহত্যা
(নিজস্ব সংবাদদাতা)
ঝাড়গ্রাম, ২৩ জুন : ঝাড়গ্রাম-ময়ূরভঞ্জ সীমান্তের গোঁসাইগোবিন্দপুর গ্রামের অদূরে জঙ্গলের মধ্যে প্রাচীন চন্দ্ররেখা দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। এখানে আজ প্রত্যুষে মুষলধারা বৃষ্টির মধ্যে কলকাতা মেডিকেল কলেজের নিরুদ্দিষ্ট অধ্যাপক ও গায়নাকোলজি বিভাগের উপ-প্রধান ডাঃ কৃষ্ণেন্দু বেরার মৃতদেহ গলাকাটা অবস্থায় পাওয়া যায়। দিনকয়েক আগে স্থানীয় নরসুন্দর মেঘনাথ পাত্রকে দিয়ে ডাঃ বেরা ঝাড়গ্রাম থেকে একটি ধারালো ক্ষুর কিনে আনান বলে জানা গেছে। রক্তাক্ত ক্ষুরটি মৃতদেহের পাশেই পড়ে ছিল। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ডাঃ বেরা বিগত পাঁচ বছর যাবত নিরুদ্দিষ্ট ছিলেন। সারা ভারতবর্ষ জুড়ে, এমনকি বিদেশেও অনুসন্ধান চালিয়ে এতদিন তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। এই ঘটনায় এ-অঞ্চলে ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে।
এরকম, এতখানি বা আরও সংক্ষিপ্ত কি অধিক বিশদভাবে খবরটি প্রকাশিত হতে পারে। মৃতের পকেটে স্বহস্তে লেখা একটি এক পঙক্তির বিবৃতির সঙ্গে ( ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়’) যদি তাঁর প্রকৃত নাম ও ঠিকানা না থাকত (ভারতবর্ষের প্রতিটি থানাই ওর নাম ও ঠিকানা জানে), তাহলে দুর্গের অভ্যন্তরে প্রাচীন জগদ্বন্ধু মন্দিরের পুরোহিত, মুণ্ডিতমাথা, গলায় যজ্ঞোপবীত, শ্বশ্রুগুম্ভময় ও পরনে রক্তাম্বর শঙ্কর মহারাজ ওরফে শঙ্করানন্দ মুখোপাধ্যায়কে পুলিশ দূরস্থান, আপনার পক্ষেও চেনা সম্ভব হত না। অন্তত ছবি-টবি দেখে। তাহলে ওই নামেই বেরত সংবাদটা এবং শিরোনাম হত : পুরোহিতের মৃত্যু, বা আত্মহত্যা।
যাইহোক, এই সংক্ষিপ্ত আত্মপরিচিতির কারণে মৃতদেহ শনাক্ত করতে পুলিসের এতটুকু দেরি হবে না। হয়তো, ২২ জুনের মধ্যেই তারা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবে অর্থাৎ পরদিন সংবাদ হয়ে ওঠার আগে ও মৃতদেহ শনাক্ত করতে মেদিনীপুর সদরে আপনাকে নিয়ে আসবে। কিন্তু পুলিসের এহেন তৎপরতায় আমি বিশ্বাস রাখি না আর ধরে নিতেও পারি না যে, ২৩ জুন সাতসকালেই খবরটি আপনার চোখে পড়বেই। তাই ওই দিন ভোরবেলা যত আগে সম্ভব ঝাড়গ্রাম থেকে টেলিফোন যোগে আমি খবরটির প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করব। এর দু-একদিনের মধ্যেই আশাকরি পুলিশ আমার বিষয়ে জানতে পারার আগেই আপনি এই পৃষ্ঠাগুলি রেজিস্ট্রি ডাকে পেয়ে যাবেন এবং পুলিশকে জানাতে পারবেন যে, আত্মহত্যা নয়, এটি একটি ঠান্ডা মাথার খুনের ব্যাপার এবং সেই হিমশীতল মস্তিষ্ক ধারিণীটিই বা কে।
আপনার এরকম কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক যে, আমি পুলিশকে না জানিয়ে কেন আপনার কাছে স্বীকারোক্তি করছি। শুধু স্বীকারোক্তিই যদি আমার উদ্দেশ্য হত, তাহলে আমি নিঃসন্দেহে তাই করতাম। কিন্তু আমি জানাতে চাই, কেন এই হত্যা; আর সেটা জানাতে চাই শুধু আপনাকেই। তাই এই সুদীর্ঘ পত্র-প্রতিবেদনটি আপনাকে না পাঠিয়ে আমার উপায় নেই।
২
মৃত্যুর আগেই মৃত
আচ্ছা, প্রথমেই আমি আপনাকে জানাই আপনার স্বামীর নিরুদ্দিষ্ট হবার কারণটা কী, যেটা নাকি আপনার কাছে আজও একটা রহস্য। কাগজে দেখেছিলাম, পুলিশকে আপনি একাধিকবার বলেছেন, আপনাদের দাম্পত্য জীবন ছিল দৃষ্টান্ত স্বরূপ (‘কোথাও কোনো খাদ ছিল না’); এবং স্বামীর জীবনাশঙ্কাও আপনি করেন না, যেহেতু রাজনীতি ছিল ওঁর পক্ষে হিন্দু গো বা মুসলমানের শূকর মাংসের মতন; তথা সামাজিক জীবনেও উনি ছিলেন নিঃশত্রু, মর্মান্তিক দেরিতে হলেও, এখন আপনি বুঝতে পারছেন, অন্তত একজন ছিল।
হায়, করুণা হয় আপনার জন্য, মিসেস অদিতি বেরা, আপনি বিশ্বাস করুন। শিশু যেমন মাতৃস্তন্যকে, সত্যি আপনাদের মতো নিরাপত্তাপায়ী, সরলা গৃহবধূরা নিজ নিজ স্বামী সম্পর্কে কত কম খবর রাখেন, কত কম চেনেন তাদের, ভাবলে অবাক হই। ওর কেনা ফ্ল্যাট আমার নামে, ওর টাকাকড়ি যা—সাদা বা কালো—সব আমার ব্যাঙ্কের ভল্ট আমার—ড্রাঙ্ক অর আদারওয়াইজ রোজ এসে আমার পাশেই তো শোয়। মাঝে মাঝেই সঙ্গম করে। আমি সতী। আমি ওর বিবাহিতা স্ত্রী। অতএব? অতএব ও আমার! সতীন বলতে আবার যদি কেউ থাকে তো সে ইনকাম-ট্যাক্স, বা সি বি আই। কিন্তু হায়, প্রকৃত প্রস্তাব ঠিক এর বিপরীত। অন্তত আপনার স্বামী ডাঃ কৃষ্ণেন্দু বেরা এম আর সি ও জি, লন্ডন-এর ক্ষেত্রে।
কেননা, মিসের বেরা, ডাঃ কৃষ্ণেন্দু বেরার ফ্ল্যাট টাকাকড়ি এসব আপনার হতে পারে, কিন্তু কৃষ্ণেন্দু ‘ছিল’ আমার। সত্যি কথা বলতে কী, কৃষ্ণেন্দুর বিনিময়ে ওগুলি ছিল (ওইসব ফ্ল্যাট-টল্যাট) আপনাকে আমার অনুকম্পা-ভরা উপহার মাত্র। ভিক্ষা ভাবলেও ভাবতে পারেন।
শুনে আকাশ ভেঙে পড়বে আপনার মাথায় যে, এই অবিবাহিতা পঞ্চবিংশতিবর্ষীয়া, পত্রলেখিকা মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে আপনার তখন অনূর্ধ্ব চল্লিশ স্বামীর সন্তান গর্ভে ধারণ করেছে (আপনি যা পারেননি)—যদিও সে অঙ্কুর-হত্যায় প্রধান সহযোগী ছিল ফিটাসের ‘বিবাহিত’-বাবা! দেখতে দেখতে চার মাসে পড়েছিল ও প্লাজেন্টা ফর্ম করে গিয়েছিল। তাই অতখানি অগ্রসর অবস্থায় গর্ভপাত কতখানি বিপজ্জনক হতে পারে জানার জন্য আলট্রা সোনোগ্রাফ করা হয়, আর তাই জানা গিয়েছিল, তারা ছিল যমজ এবং পুত্রসন্তান, আমি যদি অ্যাবোর্ট করাতে রাজি না হতাম, তাহলে তখনই আপনার নটেগাছটি মুড়তো, তাই নয় কি মিসেস বেরা? তাহলে তো, জোড়া প্যারাম্বুলেটর ঠেলে আমি এখন লেকে বেড়াচ্ছি আর সার্দান অ্যাভিনিউয়ের আকাশলীনার দশতলার বারান্দা থেকে আপনি সেই সুদৃশ্য উপভোগ করছেন। তাই না কি? আপনার চোখে বায়নাকুলার!
ম্যাডাম, আমি ওপরে লিখেছি, কৃষ্ণেন্দু ‘ছিল’ আমার। দোষ ধরবেন না ওই ক্রিয়াপদের, যদিও আমি আগেই জানিয়েছি, এই চিঠি লেখার সময় পর্যন্ত সে বেঁচে আছে। আসলে সে তো থেকেও নেই। কেননা আমি তাকে মৃত্যুর আগেই মেরে রেখেছি। এই চিঠি যখন আপনি পাবেন, তার বেশ ক-দিন আগেই, ২২ জুন ভোররাত্রির পর সে তো আর থাকবে না। আমার কাছে সে তাই এই মুহূর্তেই মৃত।
৩
আমিই সে
পত্রলেখিকাকে আপনি মোট তিনবার দেখেছেন। প্রথমবার দেখেন ১৯৮৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। তখন বিকেলবেলা। আপনার বড়দির বিবাহের ২৫ বছর উপলক্ষে আপনি সকালেই যোধপুর পার্কে চলে যান। কৃষ্ণেন্দুর রাত্রে যোগ দেবার কথা ছিল। জামাইবাবুকে উপহার দেবার জন্য নক্সাদার সোনার চামচটি আমিই পছন্দ করে আগের দিন কিনিয়ে দিই কৃষ্ণেন্দুকে। কিন্তু সেটি সঙ্গে নিয়ে যেতে ভুলে যাবার দরুণ এবং ফোনে বারবার না-পাবার কারণে আপনি সোজা চলে আসেন আপনাদের তৎকালীন মহেন্দ্র রোডের বাসায় ও বেল দিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকেই ‘একি তুমি এখনও চেম্বারে যাওনি’ বলে অপাঙ্গ দৃষ্টিপাতে আপনাদের বাইরের ঘরের সোফায় ছোটখাটো, জড়োসড়ো, কিন্তু স্বাস্থ্যবতী (আপনার স্বামীর মতে ‘স্বাস্থই সৌন্দর্য’— বিশেষ মেয়েদের ক্ষেত্রে) যে মেয়েটিকে দেখতে পান, আমিই সে। একপলকের সেই একটু দেখা, আমাকে আপনার সম্পূর্ণ ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। তবে ঘটনাটি অবশ্যই মনে পড়ছে আশা করি? অবশ্য, ততক্ষণে আমাদের শোবার ব্যাপার বার-দুই হয়ে গেছে। কেননা, পূর্ব ব্যবস্থামতো আপনি বেরিয়ে যাবার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমি ওখানে।
যাইহোক, ক্যালকাটা ক্লাবে সেদিন রাতের রজতজয়ন্তী পার্টিতে স্বামীর কাছ থেকে আমার ও-হেন উপস্থিতির জন্য ‘মেয়েটা কে গো’ বা ‘কী জন্যে এসেছিল’ ধরনের একটা কৈফিয়ত নিয়ে নিলেই হবে এবং তা গ্রহণযোগ্য হতেও বাধ্য এমন আত্মবিশ্বাসে সোনার চামচের বাক্স হাতে, ‘আটটার আগেই যাবে কিন্তু, ডিনার ঠিক ন’টায়’, এত বলে আপনি ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যান। আপনার দিদি গাড়িতে বসে। তাড়াহুড়ো, তাই লক্ষ্য করেননি, টেলিফোনের রিসিভারটা ছিল নামানো আর সেই সকাল থেকেই।
এবং সেই যে প্রথমবার, তা নয়। তার আগে এবং পরে, আপনাদের পূর্বতন মহেন্দ্র রোডের ফ্ল্যাটে এবং অধুনা আকাশলীনাতেও আমি বেশ অনেকবার গেছি। বলা বহুল্য, আপনি তখন নেই। ইওনেস্কোকে ধন্যবাদ! মূক-বধির ও বিকলাঙ্গ শিশুদের সংগঠনটি নিয়ে আপনার উদয়াস্ত ব্যস্ততাই আপনাদের ফ্ল্যাটে আমার অবিরত যাতায়াতকে অনর্গল করে দিয়েছে। ঘটি-বাটি চুরির ভয়ে বাড়িতে রাতদিনের কাজের লোক নেই অথচ স্বামী খোয়া গেছে কবে, তার খবরই রাখে না, এমন গৃহিণীকে করুণা করা ছাড়া আর কী করা যায়, আপনিই বলুন তো মিসেস বেরা! অবশ্য মাঝে মাঝে যখন মনে পড়ে কী গভীর বিশ্বাস ছিল আপনার, আপনার স্বামীর বিশ্বস্ততায়, তখন দুঃখও হয় আপনার জন্য।
কিন্তু এখন তো স্রেফ হাসি পাচ্ছে। আচ্ছা, স্বামীকে এই যে এতখানি বিশ্বাস আপনার, এর লজিকটা কী বলতে পারেন? না-না, আমাকে নয়। আপনি নিজেকে বলতে পারেন? কৃষ্ণেন্দু আমাকে যা বলত, ধৃষ্টতা মাপ করবেন, ম্যাডাম, আপনি নাকি মাসে এক কী বড়জোর দু-বার সেক্স হওয়াই যথেষ্ট মনে করেন এবং তাও শহিদসুলভভাবে? সন্তানাদি তো হলই না, কিন্তু এ কী সত্যি যে, আপনার কখনও অর্গাজম হয়নি? আপনি নাকি জামাকাপড়ও সব খুলতেন না। হাঃ-হাঃ-হাঃ-হাঃ। বলুন, এরপরেও হাসি পাবে না? এ-সত্বেও আপনি বিশ্বাস রাখতেন স্বামীর বিশ্বস্ততায়? হাসি আমি থামাই কী করে, আপনিই বলুন! দেখুন, এমন মানসিকতা খড়-গাদার কুকুরকে সাজে, যে যখন নিজে খেতে পারব না, গোরুকেও খেতে দেব না। মানুষের কী শোভা পায়? ছিঃ।
তবে, আকাশলীনায় খুব একটা যেতে হয়নি আমাকে, কারণ, ততদিনে জোকার কাছে একটি রিসর্টে মাসভাড়ায় ঘর ভাড়া নিয়েছিল কৃষ্ণেন্দু। কিন্তু মহেন্দ্র রোডের বাসায় বেশ বহুবার গেছি। বেডরুমে, আপনার নিজ হাতে পেতে-যাওয়া দামী বেড স্প্রেডগুলোর প্রায় প্রতেকটির ওপর শুয়েছি, জামাকাপড়ের সঙ্গে যাবতীয় লজ্জা মেঝেয় খুলে রেখেই, বলাবাহুল্য। কৃষ্ণেন্দু বলতো, শুধু নগ্ন হওয়াই যথেষ্ট নয়। মেয়েমানুষের সার্থকতা অপর ভূষণ লজ্জাও খুলে রেখে নগ্নতর হতে পারায়। অন্যথায় তারা যে যেখানে সার্থক হয়েছে হোক, উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি হোক তাদের সেইসব সফলতায়, শুধু তারা যেন বিছানায় না আসে। আর আপনি কিনা জামাকাপড়ই খুলতেন না সবগুলো! মাপ করবেন, এখানে লেখা থামিয়ে আমি আবার একচোট হেসে নিলাম।
আমি আর কৃষ্ণেন্দু কিন্তু ফর ইওর ইনফর্মেশন, শাওয়ার খুলে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থেকেছি, ওই মহেন্দ্র রোডের হাউস-ট্রি দিয়ে সাজানো, সাদা টালির বাথরুমে! আমি আদ্যোপান্ত সাবান মাখিয়ে দিয়েছি তাকে। আপনারা তো তখন থেকেই ‘হোয়াইট ডাভ’ ছাড়া অন্য সাবান ব্যবহার করেন না, তাই না?
বিশেষত, বিছানা-ব্যবহারের আগে কৃষ্ণেন্দু প্রত্যেকবার একই কথা বলতো আমাকে যে, কোথায়, কী, কীভাবে রেখে গেছে ভাল করে দেখে নাও। ওর ওই শাড়িটা যেমন এলোমেলোভাবে রেখে গেছে, সেভাবেই থাকবে। পাট করে রেখো না যেন। ঘর ছাড়ার আগে তন্নতন্ন করে দেখা হতো আমার দরুণ কোথাও কিছু পড়ে রইল কিনা। একটা হেয়ারপিন কী একটা ছেঁড়া বোতাম। ঠিক যেন খুনীরা বেরিয়ে যাচ্ছে খুন করার পর, প্রমাণ না রেখে। মাত্র একবারই একটা প্রমাণ হাতে এসেছিল আপনার। আপনার মনেও পড়বে। মেঝে থেকে একটা টিপ তুলে আপনি জানতে চান কৃষ্ণেন্দুর কাছে, যে, সেটা কোথা থেকে এল। যার উত্তরে কৃষ্ণেন্দু ‘ওসব টিপ-ফিপের আমি কী জানি’, বলে একটা প্রতি-প্রশ্ন জুড়ে দেয়, যে, আপনাদের পার্ট-টাইম রাঁধুনি মালতির হতে পারে না কি? যার উত্তরে আপনি অবাক হয়ে বলেন, ‘কিন্তু, এতো শিল্পার টিপ। বেশ দামি। মালতির হবে কী করে?’— মনে পড়ে কি আপনার? ব্যাপারটার ঐখানে ইতি হয় যদিও। বা, ঠিক ঐখানে নয়। তারও পরে, যখন হোটেল রাতদিনের লবিতে আমরা দু-জনে ‘এন্ডলেস স্টোরি’ (ককলেট একটা) খাচ্ছি, তখন যখন চাপা গলায় হাসতে হাসতে আমি কৃষ্ণুেন্দুকে বলি, ‘আমি যদি খুন করি কখনও’, ওর ওদিকে তর্জনী তুলে দেখিয়ে, ‘তোমাকে, তারও কোনো প্রমাণ থাকবে না।’
আপনাকে এত কথা সবিস্তারে জানানোর উদ্দেশ্য একটাই। আমার আইডেনটিটি প্রতিষ্ঠা করা। আশাকরি, এতক্ষণে নিঃসন্দেহ হয়েছেন।
৪
কেন নিরুদ্দেশ
আপনার স্বামী নিরুদ্দিষ্ট হয়েছিলেন কেন, আপনি তা জানেন না। কিন্তু আমি জানি। আসুন, এবার সেই প্রসঙ্গে আসা যাক।
আমার স্বামী রজত আত্মহত্যা করে ১৯৯০ সালের ৭ জানুয়ারি। এর বিস্তৃত বিবরণে আমি যাব না। কেননা, সেকথা এই কাহিনীর পক্ষে অবান্তর। কৃষ্ণেন্দুর নিরুদ্দেশ হওয়ার সঙ্গে রজতের আত্মহত্যার সম্পর্ক যেটুকু, শুধু সেটাই প্রাসঙ্গিক। আপাতত, শুধু একটু বলাই যথেষ্ট যে, রজত আত্মহত্যা করেছিল শেষ রাতে বাথরুমে ঢুকে। সে রান্নাঘরে ঢুকে গ্যাসে জল গরম করেছিল। এবং রিস্ট কেটে হাতে ডুবিয়ে রেখেছিল জলে। না, বাথরুমে দরজা সে বন্ধ করেনি। ভোরে উঠে ম্যাডক্স স্কোয়ারে জগিং করতে যেত রোজ। আমি ভেবেছি তাই। বাথরুমের দরজা ঠেলে হঠাৎ—যাক সেকথা।
আমার দাদা তখন মেটিয়াবুরুজ থানার এ এস আই। খুব কিছু ঝামেলা হল না। যদিও পোস্টমর্টেম হয়ে বডি পেতে ৮ জানুয়ারি বিকেল হয়ে গেল। ৯ জানুয়ারি সকালে কৃষ্ণেন্দুকে আমি চেম্বারে ফোন করলাম। পেলামও। বললাম, আমি আসছি। ও যেন থাকে। দাদার সার্ভিস রিভলবার থাকে আলমারিতে। লোড করাই থাকে। রিভলবার চালানো আমি শিখি দাদার কাছে, বাবা-মার সঙ্গে চাঁদিপুরে বেড়াতে গিয়ে। তখন স্কুলে পড়ি। একমাত্র বোনকে দাদা তখনই উদয়-সূর্যের দিতে তাক করে রিভলবার ছুড়তে শিখিয়ে দেয়।
চেম্বারে কৃষ্ণেন্দু ছিল না। বুঝলাম, কাগজে রজতের খবরটা সে পড়ছে। পরের দিন সকালে আমি আকাশলীনায় গেলাম। আপনি বললেন, একটু আগে নার্সিং হোমে চলে গেছে। এমারজেন্সি। আমি অবিশ্বাস করলাম না। কারণ ট্যাক্সিতে হাজরা পেরোবার সময় যে গাড়িটা হুস করে বেরিয়ে গেল, সেটা ছিল কৃষ্ণেন্দুর ফিয়াটের মতোই। আমি ট্যাক্সি ঘোরাবার কথা ভেবেছিলাম। তখন আমার হ্যান্ডব্যাগে রিভলবারটা ছিল, যখন আপনার কাছে যাই। কিন্তু সে আপনি জানবেন কী করে। কিছু নদী আছে যাতে জোয়ার-ভাটা খেলে না। কিছু মুখ আছে যাতে অভিব্যক্তি ধরা দেয় না। সমস্ত খুনীর মুখ সেরকম।
সেই প্রথম আপনি আমাকে খুঁটিয়ে দেখলেন। এবং অনেকক্ষণ ধরে। জানতে চাইলেন, আমি কে এবং কেন এসেছি। আমি বললাম, আমার মা ওঁর পেসেন্ট। এবং আমাদেরও এমারজেন্সি। আপনি নার্সিং হোমে ফোন করলেন কিছুক্ষণ পরে। আমি বসে থাকলাম। নার্সিং হোম আপনাকে জানাল, উঁনি সেখান যাননি। এবং সেদিন ওঁর যাবার কথা নয়।
‘কোথায় গেল বল তো?’ আপনি আমার কাছেই জানতে চাইলেন। অন্তত আমার দিকে চেয়ে। যদিও একেবারে মনহীন অব শূন্য ছিল আপনার চাহনি।
আমি কিন্তু ততক্ষণে বুঝে গেছি, কৃষ্ণেন্দু টের পেয়েছে আমি তাকে খুঁজছি। এবং কেন। দাদার রিভলবারের অস্তিত্বের কথা তার অজানা নয়। আমি বেশ বুঝতে পারলাম, কৃষ্ণেন্দু পালাচ্ছে এবং আমার থেকে।
পরদিন ফোন করে জানলাম, রাত্রে সে বাড়ি ফেরেনি এবং সর্বত্র খোঁজ নিয়ে, না পেয়ে, থানায় খবর দেওয়া হয়েছে। তারপরের তিন বছরের কথা তো আপনার জানা। নিরুদ্দেশ কলমে ডাঃ কৃষ্ণেন্দু বেরার ছবির পর ছবি বেরুল। ভারতবর্ষের সমস্ত টিভি কেন্দ্র থেকে তার ছবি দেখানো হল। সমস্ত থানায় তার ছবি গেল। এমনকি বিদেশেও খোঁজখবর করা হতে লাগল। বিশেষত লন্ডনে। যেখানে সে দু-বছর ছিল। কৃষ্ণেন্দুর খোঁজ পাওয়া গেল না।
৫
সম্পত্তি সমর্পণ
রজতের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ৮৮-র গোড়ার দিকে। মাল্টি-ন্যাশনাল লাইকাল্যাব কোম্পানির মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ, সুদর্শন ছেলেটির সঙ্গে কৃষ্ণেন্দুই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। রজতের ব্যাপারে বিশেষ কিছু বলার নেই। শুধু এই যে আমার সেই সমান্তরাল মেলামেশা কোনো গোপন ব্যাপার ছিল না। এটা ঘটেছিল কৃষ্ণেন্দুর জ্ঞাতসারেই, এমন কি, তার অভিভাবকত্বে। শুরুতে ওর সঙ্গে প্রেমের অভিনয়ই করতাম আমি। কিন্তু বছর ঘোরার আগেই দেখলাম সরল ও স্বাস্থ্যবান (এবং সুদর্শন) ছেলেটি আমার প্রেমে পাগল। এবং, আমিও নিজের মনের ভুলে কখন যে ভালোবেসে ফেলেছি তাকে! আমার এই উভয়-সংকটে কৃষ্ণেন্দু যে উদারতার পরিচয় দেয়, তা ভুলতে পারি না। আমাদের মিলনের পথে বাধা হওয়া দূরে থাক, সে কিনা এগিয়ে এল সর্বতোভাবে সাহায্য ও সমর্থন করতে, আমারই ভবিষ্যতের কথা ভেবে! আমার উপর সব দাবি সে ছেড়ে দিচ্ছে, বুকে জড়িয়ে ধরে সে আমাকে জানায়। কথা হয়, আমি রজতকে বিয়ে করব। এবং বিয়ের পর আমাদের কোনো যোগাযোগ থাকবে না। অন্তত আমার সন্তান জন্মাবার আগে। বিয়ের বনেদ পাকা হবার পর, ভালো বুঝলে আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি। যদিও আমাদের সে নতুন সম্পর্কে পূর্বমেঘের ছায়াটুকুও থাকবে না, কৃষ্ণেন্দু আমাকে জানায়।
৮৮ সালে অক্টোবরে রজত ও আমার বিয়ে হল খুব ঘটা করে। সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের প্যারিস হলে নিমন্ত্রিতের সংখ্যা পাঁচশো ছুঁয়েছিল। ছন্নছাড়া বোনের মতিগতি ফিরেছে দেখে সব থেকে খুশি হয়েছিল দাদা। বলা বাহুল্য, কৃষ্ণেন্দু ছায়া মাড়ায়নি।
তবু এ-কথাও সত্যি যে বোধহয়ত তার প্রতি আপনার সীমাহীন কৃতজ্ঞতাবশতই বিয়ের এক সপ্তাহ আগে পর্যন্ত আমি কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে সম্পর্ক রেখে গেছি। সমস্ত খুঁটিনাটি সে জেনেছে। সব রকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব পেরিয়ে যেতে সে আমাকে সাহায্য করে গেছে। আমি কি বিয়ের আগে রজতের কাছে আমাদের সম্পর্কের কথা বলব? যে আমার স্বামী হতে যাচ্ছে—এমন একটা গুরুতর বিষয় গোপন রাখার ভার আমি সারাজীবন বইব কী করে? উত্তরে গীতা থেকে একটি শ্লোক উচ্চারণ করে (কর্ম-যোগ অধ্যায়ে শ্লোকটি আমি পড়েও ছিলাম) কৃষ্ণেন্দু বলেছিল, কিছুই জানতে পারবে না রজত। কিছু জানতে চাইবে না। কাম হল সেই ধোঁয়া যা অগ্নিকে ঢেকে রাখে। সেই মল যা দর্পণ ঢেকে রাখে। কোনো ছায়া সেখানে পড়তে দেয় না। তুমি সেই পাঁক ঘাঁটিয়ে ওকে পাতালে নিয়ে যাবে। কৃষ্ণেন্দু বলছিল।
আমাদের সম্পর্কের আমরা কোনো প্রমাণ রাখিনি। কোনো চিঠিপত্র দিইনি রাস্তাঘাটে ক্বচিৎ হেঁটেছি। হাঁটলেও আগে-পরে। সিনেমা হলের লবিতে অচেনার মতো দাঁড়িয়ে থেকেছি। দেখা হয়েছে অন্ধকারে। যখন আমি বা কৃষ্ণেন্দু এ ওর পাশে গিয়ে বসেছি। শুধু একবার জোকায় কৃষ্ণেন্দু আমার এক রিল ন্যুড ছবি তুলেছিল। তখন তো প্রতিপদের চাঁদ হয়েও রজত দেখা দেয়নি দিগন্তে। ওর কোনো আবদারেই রাজি না-হবার কোনো কারণ তখন ছিল না। ঐ যে বলেছি আপনাকে আগেই, সেই অপর ভূষণ ত্যাগ করার কথা। তবু, ক্ষীণ আপত্তি যে করিনি তা নয়। ফ্ল্যাশের পর ফ্ল্যাশ দিয়ে সে আমাকে উলটে-পালটে শুইয়ে বসিয়ে দাঁড় করিয়ে পুরো চব্বিশটি ছবি তুলল।
আমি ভুলেই গিয়েছিলাম সে-কথা। বিয়ের সাতদিন আগে আমাদের শেষ দেখা। ফ্রী স্কুল স্ট্রীটের একটা চীনে রেস্তোরাঁয়। হৌ-হুয়া। কৃষ্ণেন্দুর প্রিয় জায়গা। কেবিনে বসে আমার সামনে সেই চব্বিশটি ছবি সে কুটি কুটি করে ছিঁড়ল। এমন কি, নেগেটিভগুলো। এবং বাথরুমে ফেলে এল। আমি ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু কৃষ্ণেন্দু ভোলেনি।
তারপর অভিভূত আমাকে শেষবারের মত সে নিয়ে গেল সদর স্ট্রীটের ফেয়ারলন হোটেলে। আমার ধারণা ছিল, ওকে যা দেবার আমি সব দিয়েছি এবং তার বেশি কিছু দেওয়া যায় না। কিন্তু আমি স্বীকার করতে বাধ্য যে, একজন পুরুষকে সর্বস্ব উজাড় করে দেওয়া বলতে কী বোঝায়, আমি সেই একদিন, সেই একবার প্রথম বুঝি। অমন অভিজ্ঞতা এক জীবনে দু-বার হয় না, কোনো মেয়ের।
৬
দা ইয়ালো হ্যান্ডকারচিফ
বিয়ের পর কৃষ্ণেন্দু কিন্তু কথা রেখেছিল। পথে-ঘাটে হঠাৎ মুখোমুখি হবার তো কথা নয়। ওর যাতায়াত গাড়িতে। যাতায়াতের পথে, গাড়ির সানগ্লাসের ভেতর দিয়ে যদি কোনোদিন দেখেও থাকে, কখনও গাড়ি থামায়নি। এগিয়ে আসেনি।
ওর ওপর পুরোপুরি আস্থা আর বিশ্বাস থাকা সত্বেও, আমি তবু কয়েকটি সাবধানতা অবলম্বন না করে পারিনি। কেন না, আমি জানতাম, এসব আসলে অদ্ভুত আবেগের ব্যাপার, জ্যামিতির ব্যাপার। যার প্রতিটি উপপাদ্য শুরু হয় ‘ধর’ দিয়ে। যেমন ধরুন, ‘ধর, ABC একটি বিষমবাহু ত্রিভুজ।’ প্রগলভতা মাপ করবেন, কতদূর, প্রায় অন্তঃস্থল পর্যন্ত দেখে নিয়ে, আমি এইসব পদক্ষেপ নিই, তা বোঝার সুবিধে হবে বলেই আমি জ্যামিতির উপমাটি নিলাম। প্রায় হুবহু একই গল্পে ওর কবি-বন্ধু দিলীপ সেনগুপ্ত ঘাটশিলায় চলে যায় এবং নিজের ভাগ্নির ফুলশয্যার রাতে সুবর্ণরেখার ধারে আত্মহত্যা করে, তা আপনার অজানা থাকার কথা নয়। আমি ভেবেছিলাম, হয়ত সেই কথাই ওর মনে পড়ছে যখন কৃষ্ণেন্দু আমাকে অনেক আগে থেকেই বলে রেখেছিল, ”তবে তোমার বিয়ের দিনটা কবে, তা আমাকে বলবে না। আমি ওটা জানতে চাই না।” বিসমিল্লায় যদি গলদই না থাকবে, তাহলে বলবে কেন-ও-কথা, আপনিই বলুন। আমি বলিওনি।
সতর্কতা বলতে, রজতের সঙ্গে সেই সব রেস্তোরাঁ বা হোটেলে আমি কখনও যাইনি, যেখানে, অন্তত, একাধিকবার কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে গেছি। আমার শ্বশুরবাড়িও ছিল নির্ভেজাল মুসলিম পাড়ায়, সার্কাস রেঞ্জে একমাত্র হিন্দু পরিবার, মুসলিম রমণীর গর্ভে হিন্দু ভ্রুণের মতো। ওদিকে আমাদের চেনাশোনা কেউ তো বড়ো একটা যায় না। এ-ছাড়া, বিয়ের পর, আমি কদাচিৎ রাস্তায় বেরিয়েছি, যখন রজত পাশে নেই। সেও একটা সতর্কতা। অন্তত, একটা প্রাথমিক বাধা তো বটেই, কৃষ্ণেন্দুর এগিয়ে আসার পক্ষে, সর্বক্ষণ আমার পাশে রজতের এই উপস্থিতি! এরপরেও যদি উলটো সিধে কিছু করে বসে, সে রজত দেখবে। তার সঙ্গে মাত্র একটি রাতের অভিজ্ঞতাই, আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, তার চেয়ে অধিক নির্ভরযোগ্য আমার পাশে আর কেউ নেই, হতে পারে না। হাজার বছরের সংস্কার এখানে কাজ করছিল, আপনি বলতে পারেন। কিন্তু, বিশ্বাস হচ্ছে বিশ্বাস। সকল চক্ষুষ্মানতার মধ্যে বিশ্বাস হল কেন্দ্রীয় সহ্যত্ব। তাকে কে অস্বীকার করবে?
কিন্তু, রজতের কথা আমার চিঠিতে নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক। আমার এ-পাপের গল্পে তার নাম মনে আনতে গেলেও তাকে অপমান করা হয়; আমার অস্তিত্ব টলে যায়, আগুন হয়ে সে ঘিরে ধরে আমাকে। জ্যোৎস্নায়, সুবর্ণরেখা-তীরে, গায়ে পেট্রল ঢেলে কবির মৃত্যু সেওতো রজত—ও-হো-হো, সে কি ভাবতেও পারা যায়? ঐ দেখুন, আমার মন আমাকে ছেড়ে ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে!
ও, রজত! হায়, রজত!
প্রায় আধঘণ্টা পরে আবার লিখতে বসেছি। কাঁদছিলাম, ভাববেন না যেন মিসেস বেরা। সে বাঁদিই আমি নই। আমি এক গ্লাস জল খেতে গিয়েছিলাম।
হ্যাঁ, সতর্কতার বিষয় কী যেন বলছিলাম আপনাকে? ও-হ্যাঁ। হ্যাঁ। মনে পড়েছে। যা বলছিলাম। বিপদ যে বাড়ির বাইরে শুধু, তা তো নয়। যেমন ধরুন, কৃষ্ণেন্দুর দেওয়া সব উপহারই আমি নষ্ট করে ফেলেছিলাম। শুধু সোনা বলে, আর বড় প্রিয় বলে আমার কানের টপটা ফেলিনি। কিন্তু রজত যেদিন বলল, ”ওটা কি মুক্তো?” আমি বললাম, ”হ্যাঁ”। রজত বলল, ”অত বড়?” আমি বললাম, ”হ্যাঁ।” কিন্তু রজত যখন জানতে চাইল, ”আসল?”— সে তো তখন ওটা ছুঁয়ে। আপনি কি অনুমানও করতে পারেন মিসেস বেরা, সে তখন কী ছুঁয়েছিল আর কাকে ছুঁয়েছিল? তার পুণ্য এসে ছুঁয়েছিল আমার পাপকে। তার বিশ্বাস এসে ছুঁয়েছিল আমার বিশ্বাসঘাতকতাকে! শিউরানিতে গা আমার নরম হয়ে এল। আমি কাঁপতে কাঁপতে নেতিয়ে পড়লাম তারই গায়ে।
বুঝতেই পারছেন, আমি ততদিন রজতকে ভালবেসে ফেলেছি। ‘ভালবেসে ফেলেছি’ একটা কথার কথা, মিসেস বেরা। কিন্তু, বিশ্বাস করুণ ‘ওর মধ্যে হারিয়ে গেছি’ কথাটা তা নয়।
ততদিনে আমি যুবক স্বামীর প্রেমাসক্তা পত্নী; বিপত্নীক শ্বশুর-পিতার একমাত্র পুত্রবধু ও কন্যা; দুই দেওর ও পুঁচকে ননদের বৌদি। এ-ছাড়া, নিকট আর দূর-সম্পর্কের দিক থেকে মাসি-পিসি-আর খুড়ি আমি কত জনের যে। মায়, মাতৃসমা ওর এক খুড়তুতো দিদির দৌহিত্রের রাঙা-দিদা!
কিন্তু এত সতর্কতা, এত নিরাপত্তা সবই যে চোরাবালি, তা কে জানত।
১৯৮৯-এর নভেম্বর মাস। ৪ তারিখ। গ্লোবে ‘দা ইয়ালো হ্যান্ডকারচিফ’ ছবিটা দেখতে গিয়েছিলেন, মনে পড়ে? আমাদের ঢুকতে দেরি হয়েছিল। ড্রেস সার্কেলে একদম পিছনের সীটে যে আপনারা, জানব কী করে? রজত আমাকে হলের মধ্যে দুবার চুমু খেল। দ্বিতীয়বারের দীর্ঘ স্থায়িত্বের জন্যে দুর্ভাগ্যক্রমে আমিই দায়ী। ইন্টারভেলে যা বোঝার বুঝলাম। নইলে দুর্বলতা প্রকাশ পাবে বলে, অকারণে, রজতের অত্যন্ত মানডেন কথাগুলোর উত্তর দিতে লাগলাম হেসে হেসে। বরং, কৃষ্ণেন্দুই বাইরে গেল আপনাকে রেখে।
ছবিটা ছিল হট। ফুটন্ত না হলেও অন্তত ঈষদুষ্ণ। বিশেষত দ্বিতীয়ার্ধটা। কিসিং, মুচিং, হপিং— কী যে ছিল না। একের পর এক নৈশ বিছানা দৃশ্য। তার ওপর নাইট শো। নিশ্চিদ্র অন্ধকার। কৃষ্ণেন্দুর উপস্থিতির কথা ভেবে, আমি প্রথমটা যথেষ্ট বাধা দিয়েছিলাম। কিন্তু, ও তো শুনল না। বোতাম ছিঁড়ে ও আমার ব্লাউজ খুলল। দেখুন, আমাদের নতুন বিয়ে। থ্রি-একস-ছবি। এ অস্বাভাবিক নয় কিছু। আপনার মতন আর্ষ প্রয়োগ বাদে, আমি বলছি আপনাকে, এ-হেন-যৌবন-দোষে প্রায় সব নতুন স্বামী-স্ত্রীই দোষী। কিন্তু, কৃষ্ণেন্দুর নাকের ডগায় প্রায় আধঘণ্টা ধরে-এ সব…ছবি শেষ হবার আগেই শরীর খারাপের অজুহাতে আমি হল থেকে বেরিয়ে এলাম ওকে নিয়ে।
সুদীর্ঘ আট মাসের মধ্যে যা করেনি, কৃষ্ণেন্দু তাই করল। সে আমাকে ফোন করল।
”আট মাস হল তোমার বিয়ে হয়েছে। একদিনও কী ডিসটার্ব করেছি?”
”এটা অফিসের ফোন। মাঝখানে অপারেটর আছে।”
”তুমি একবার এসো।”
”না।”
”একদিনের জন্যে এসো?”
”আমি। যাব। না।”
আমি ফোন রেখে দিলাম।
তারপর নভেম্বর মাস জুড়ে প্রায় রোজ ফোন। অপারেটর বন্দনা সেন আমার চেনা। বলে দিলাম আমাকে কোনো আউট-কল না দিতে। কিছুদিন।
ডিসেম্বরের শেষাশেষি আমার মাত্র একটি ছবি সে রজতকে ডাকে পাঠাল। বুঝলাম, আমার সামনে রীল নষ্ট করলেও ছবি ছিঁড়ে ফেললেও, কমপক্ষে একটি ছবি তার কাছে ছিল। রজতের অফিস ডেজিগনেশান সবই জানত কৃষ্ণেন্দু। আমি তো পুরোপুরি বিশ্বাস করেছিলাম ওকে। সবই বলেছিলাম। আমাদের বিয়েতে মন্ত্রোচ্চারণ অন্যে করলেও, কৃষ্ণেন্দুই ছিল একাধারে প্রকৃত সম্প্রদানকর্তা ও প্রধান পুরোহিত। যদিও নেপথ্যচারী।
কিছু না বলে, রজত আমাকে কাছাকাছি দীঘায় নিয়ে গেল। ছবি দেখাল না, এত ভদ্র। কিন্তু, ছবির কথা তুলল। ভয়ে নীল হয়ে গেলাম আমি। আমি আর দেরি করলাম না। আমি সব বললাম ওকে। আমি ওর হাঁটু জড়িয়ে ধরলাম। বিশ্বাস করবেন আপনি? রজত ক্ষমা করল আমাকে। কী বলল জানেন? বলল, ”আমি তোমাকে বিয়ে করেছি রুচি, তোমার কৌমার্যকে নয়।” মনে হল ভগবান আছেন। বা, সে নিজেই সেই নরনারায়ণ।
তারপর…শেষ রাতে বাথরুমে ঢুকে সে যা করল, আপনাকে আগেই জানিয়েছি। সব কাগজে প্রথম পাতার খবর হয়েছিল।
৭
আঁধারের অনুসরণ
এরপর আপনাকে সমগ্র দক্ষিণ ভারত ভ্রমণের এক সুদীর্ঘ কাহিনি শোনাতে হয়— যদিও কাহিনি অংশ খুবই ছোট্ট আর হয়তো দু-টি মাত্র শব্দ ব্যবহারেই তা সম্পূর্ণ হয়ে যায় এবং তা হল : কোথায় কৃষ্ণেন্দু? আপনার ধারণা, খোঁজখবর পুলিশই যেটুকু যা করার করেছে, কিন্তু তা ঠিক নয়। তাদের কাজ থানায় ছবি পাঠিয়ে দেওয়া আর রেডিও-টিভিতে বিজ্ঞাপন দেবার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। কৃষ্ণেন্দুকে খুঁজে বের করার জন্য প্রকৃত চেষ্টা করি আমি আর আমার দাদা মুক্তিনাথ মুখার্জি, এ এস আই। একবার শুনলাম, হৃষিকেশ আনন্দময়ী আশ্রমে সে। কাতরাসগড়, বড়জামদা, নোয়ামুণ্ডি এইসব কাছাকাছি জায়গা থেকেও তার খোঁজ আসতে লাগল। একবার খবর এল বোম্বের কুখ্যাত ধারাবি বস্তি থেকে। তার নাকি এইডস হয়েছে। সর্বত্র গেলাম আমরা।
সূত্রাদি বলে অযথা সময় নষ্ট করবো না, প্রায় দু-বছর ধরে হারিয়ে যাওয়া কৃষ্ণেন্দুর শেষ নির্ভুল খবর আনলো দাদাই। তিন মাসের ছুটির দরখাস্ত দিয়ে ও করমণ্ডলের দুটি টিকিট কেটে এনে দাদা বলল, ‘আজই মাদ্রাজ যেতে হবে।’ পুজোর ছুটি চলছে। অনেক কষ্টে এমার্জেন্সি কোটা থেকে দাদা রিজার্ভেশন পেয়েছে। ছুটি নিতে নিতে ততদিনে দাদার আর্নড লিভ, মেডিকেল সব শেষ। তখন হাফ-পে পাচ্ছে।
ছ’টি বুলেট বের করে, আবার পুরে, সেফটি খুলে ও বন্ধ করে, রিভলবারটি সুটকেশে জামাকাপড়ের নিচে রেখে দাদা বলল, ‘ম্যারিনা বীচের কাছে ওয়ালাঝা রোড। ওখানে ওয়েস্ট বেঙ্গল গভর্নমেন্টের ইয়ুথ হোস্টেল। ডাক্তার সেখানে। একদম পাকা খবর।’ বিকেলবেলার ট্রেন ধরে, লেট বহার দরুন, পরদিন রাত ন-টা নাগাদ হোস্টেলে পৌঁছে ওয়ার্ডেনকে দাদা কৃষ্ণেন্দুর ছবি আর নিজের আইডেনটিটি কার্ড দেখাল। ছবি দেখে ওয়ার্ডেন পরমেশ্বরম বললেন, ‘ইয়েস। মিস্টার সাততেন সানিয়াল। বাট হী হ্যাজ চেকড আউট দিস ভেরি মর্নিং।’
এরপর শুরু হল ‘সত্যেন সান্যাল’কে খুঁজে বের করার জন্য সেই কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত তোলপাড় করা তিনমাসব্যাপী দীর্ঘ কাহিনি। ইয়ুথ হোস্টেলের ছাদে মাদ্রাজের একমাত্র মাছ-ভাত খাবার জায়গা। বৈদ্যবাটি থেকে শঙ্কর নেত্রালয়ে গ্লুকোমা দেখাতে এসেছেন নীহার চৌধুরী। আমাদের টেবিলেই খেতে বসেছিলেন। বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ। সত্যেনবাবু। চার নম্বর ঘরে প্রায় একমাস ছিলেন। ট্রিটমেন্ট করাচ্ছিলেন অ্যাপোলোয়।’ আর একজনের কাছে জানা গেল, সত্যেন সান্যাল তিরুপতি যাবার ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছেন তাঁর কাছে।
দাদা যা বলেছিল। পরদিন ভোরবেলা টি টি ডি সি-র আন্নামালাই রোডের অফিসে যেতে সত্যেন সান্যালের গতিবিধি সহজেই জানা গেল। কাউন্টারের ছেলেটি ছবি আর রেজিস্টার দেখে বলল, সাতদিনের প্যাকেজ ট্যুরে একজনই বাঙালি ভদ্রলোক কাল দক্ষিণভারত ভ্রমণে গেছেন। তাঁর নাম বিমল বসাক। ছবির সঙ্গে তাঁর মিল আছে। তিরুপতি অন্য ট্যুর। তাতে কোনো বাঙালি যায়নি।
মিনিট পনের পরে ওই একটি ট্যুরে বাস যাচ্ছে শুনে দাদা টিকিট আছে কিনা জানতে চাইল। ভাগ্যিস, চার জনের একটি পার্টি টিকিট ক্যানসেল করেছে। আমরা দুটি সিট পেয়ে গেলাম।
প্রথম হল্ট শ্রীরঙ্গমের মন্দিরে। টানা ৮ ঘণ্টার জার্নি। বাস যখন ম্যারিনা বীচ ধরে যাচ্ছে, এই প্রথম আমার সঙ্গে কথা বলল দাদা। দাদা বলল, ‘পুলিশকে দোষ দিস কেন? যে লোক ঘণ্টায় ঘণ্টায় নাম বদলায় আর একদিনের জন্যে তিরুপতি যাবে বলে যায় সাতদিনের জন্যে দক্ষিণ ভারত ট্যুরে…’ দাদা চুপ করে গেল।
তামিলনাড়ু ট্যুরিজম-এর এই ট্যুরগুলোয় সারাদিন ধরে বাস ছোটে—এক-একটা মন্দিরে নিয়ে যায়—তারপর সে-রাত্রির জন্য টি টি ডিসি-র হোটেলে রাখে। পরদিন ভোরে আবার বেরিয়ে পড়ে। তিরুচিরাপল্লী, শ্রীরঙ্গম, মাদুরাই, সুচিন্দ্রম, তিরুভেন্দর, তাঞ্জাভুর, রামেশ্বরম—আমরা যেখানেই পৌঁছাই, ‘বিমল বসাক’-এর হদিশ পাই। কিন্তু সর্বত্র থেকে সেদিনই সকালে সে বেরিয়ে গেছে।
এ-যেন ফিজিক্সের সেই মাসহীন অ্যান্টি-পার্টিকেলের হালচাল, যার অস্তিত্বের কথা সবসময় জানা যায় সে ‘ছিল’ বলে। তাকে কখনও বর্তমান অবস্থায় ধরা যায় না।
কন্যাকুমারীতে পৌঁছে, চিদাম্বরমের বিখ্যাত নটরাজ মন্দিরের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে দাদা আমাকে বলল, ‘আমরা বাস ছেড়ে দিয়ে একটা ট্যাক্সি নেব আর রাতারাতি নেকস্ট হল্ট কোদাইকানালের হোটেলে পৌঁছে যাব। টি টি ডি সি-র হোটেলেই তো থাকবে। কুত্তার বাচ্চাকে ভোরের বাসের ওঠার আগেই পেয়ে যাব।’
ট্যুর-বাস কন্যাকুমারিকা থেকে যায় ত্রিবান্দমে। সেখানে একদিন থাকে। ফিরে কোদাইকানাল। যারা ত্রিবান্দাম যাবে না, তারা ইচ্ছে করলে কন্যাকুমারিকায় দু-রাত্রি থাকতে পারে। দিনটা ছিল কোজাগরী পূর্ণিমার রাত। ঐ দিন সূর্যাস্ত ও চন্দ্রোদয় একই সঙ্গে দেখা যায় বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর আর আরব সাগরের মিলন-মোহনায়। এ-দৃশ্য নাকি পৃথিবীর নয়। স্বর্গের। আরও ক-জন ট্যুরিস্টের সঙ্গে কৃষ্ণেন্দু তাই থেকে গিয়েছিল। সে ত্রিবান্দাম যায়নি জেনে আমরা এইরকম অনুমান করলাম। ঠিক হল, সন্ধ্যায় সাগরবেলায় তাকে খুঁজে বের করা হবে। না পেলে, হোটেলের ২০৪ নং রুম তো আছেই, যেটা তাকে দেওয়া হয়েছে। যেখান থেকে সে বেরিয়ে গেছে দুপুরে।
‘কুকুরের মত যাকে আস্তাকুঁড়ে মারার কথা’ ফেরগুলিগুলো খুলে দেখে নিয়ে চেম্বারে পুরতে পুরতে দাদা বলল, ‘সেই কুত্তা, কামিনে কিনা মরবে তিন সমুদ্রের মোহনায়? যখন’, বলতে গিয়ে দাদা গুলিয়ে ফেলল, ‘যখন সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত একসঙ্গে।’
‘ওঃ হো। হোয়াট এ গ্রান্ড ফিনালে ফর অ পারিয়া ডগ!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাদা বলল। দাদার বুকের উত্তাল ওঠা-নামা দেখে মনে হয়, একটি সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন ঘটে চলেছে যেন। তাঁর দাঁতের পাটি জিঘাংসায় কচকচ করে ওঠে, আমি শুনতে পাই।
দেখা হয়ে গেল, কিন্তু বিকেলবেলাতেই। যখন সমুদ্রের বুকে ঢেউ তুলে বিশাল স্টিমারে আমরা বিবেকানন্দ শিলায় যাচ্ছি আর কৃষ্ণেন্দু ফিরছে। দোতলার খোলা ডেকে, ড্রাইভারের কেবিনের পাশে সে একা দাঁড়িয়ে ছিল। একদম পাশাপাশি দু-টি স্টিমার। ওর স্টিমারের ঢেউ আমাদের স্টিমারের ঢেউকে ধাক্কা মেরে লাফ দিয়ে উঠলো প্রবল সংঘর্ষে।
আমরা দেখলাম, কৃষ্ণেন্দু আমাদের দেখছে। অপরাহ্নের রক্তাভ রোদ এসে পড়েছে তার মুখে-চোখে। তাকে স্পষ্ট দেখা গেল। এমনকি নিজের মনের ভুলে, সে একবার ডান হাত তুলে উইশও করে ফেলল আমাদের। অটোমেটিক অতি-আধুনিক আমেরিকান মেসিন। এবং রেঞ্জের একেবারে বাইরে ছিল না সে।
বুম-বুম-বুম। বুম-বুম। বুম। দাদার হাতে রিভলবারের চেম্বার খালি হয়ে গেল।
কিন্তু, তার অনেক আগেই কৃষ্ণেন্দু শুয়ে পড়েছে।
এরপর তিনমাস ধরে সারা দক্ষিণ ভারত তোলপাড় করে আমরা আরও দু-বার তার সংস্পর্শে আসি। একবার সিচাভরমে। আর একবার মীনাক্ষী মন্দিরের পশ্চিম গো-পুরমের ঠিক সামনে।
কিন্তু গুলি করার সুযোগ সে আর দেয়নি।
৮
নিয়তি কে ন বাধ্যতে
সাউথ ইন্ডিয়া থেকে ফেরার পর প্রায় বছর ঘুরতে চলল, কৃষ্ণেন্দু সম্পর্কে আর কোনো খবর নেই। কিন্তু তা বলে আপনার মতো আমি হাল ছেড়ে দিইনি, মিসেস বেরা। একটি মুহূর্তের জন্যও নয়। আপনি জানেন, কৃষ্ণেন্দু রোজ সকালে আপনাদের পারিবারিক নারায়ণ শিলার সামনে কুশাসন পেতে গীতা পড়ত। গীতার, বিশেষত, একাদশ অধ্যায়টি ছিল তার কণ্ঠস্থ। সে আমাকে আর একটি শ্লোকের কথা বলেছিল :
ময়ৈবৈতে নিহতাঃ পূর্ব্বমেব।
নিমিত্তমাত্রং ভব সব্যসাচিন।।
যা নাকি পরাঙ্মুখ অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন। কুরুক্ষেত্রে। যে, কাকে, কাদের মারতে দ্বিধাগ্রস্ত তুমি! ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ আর্থ! আমি তো ওদের আগেই মেরে রেখেছি। তুমি এদের মৃত্যুর নিমিত্তমাত্র হও। তারপর বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন।
সে যে খুন হবে এবং আমার হাতে, এতে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না কখনও। সমস্ত যুক্তি-তর্ক পেরিয়ে এটা একটা সিদ্ধান্ত, একটা উপসংহার—এদিক থেকে এই কাহিনির শুরুই শেষ থেকে—এমনটা যদি ভাবতে হয় তো ভাবতে পারেন। সচেতন— অচেতন আমার মন বা নির্মনের কোথাও থেকে এ-ব্যাপারে কখনও কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। আসলে তার এই অবধারিত ভবিতব্যই আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল কৃষ্ণেন্দুর দিকে। অনেক সময় মেসিনের চাকায় জামাকাপড় আটকে যায় না? যার পর থেকে মেসিনের গতিবিধির নিয়মে চলে যেতে হয় তার গর্ভে—ব্যাপারটা ছিল শুরু থেকেই সে-রকম। অতএব তার খবর আসুক, বা না-আসুক, সে নিয়ে আমার মাথাব্যথা ছিল না কোনোদিনই।
তারপর মাত্র গতকালই বিনা মেঘের আকাশ থেকে জলের মতো এই চিঠিটা ডাকে এল, যার কপি নিচে দিলাম, আমি স্বীকার করতে বাধ্য যে, এই চিঠি ছিল আমার কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত।
ঝাড়গ্রাম। ১৫ জুন। ‘৯৩
কল্যাণীয়া রুচিরা,
ছোটবেলায় বিভূতিভুষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’ নামে একটি বই পড়েছিলাম। আফ্রিকার রেল-শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে গিয়েছিল শঙ্কর। একদিন প্রান্তরের মধ্যে তাঁবুতে দেখা দিল অতিকায় মাম্বা। চার ফুট উঁচু শুধু তার ফণাটাই। জ্বলন্ত টর্চ ধরে রেখে শঙ্কর তাকে নিস্পন্দ করে রাখে বহুক্ষণ! সে জানে, একটু নড়লেই ছোবল, নিশ্চিত মরণ। কিন্তু ছ-সেলের টর্চ ধরে ততক্ষণ! হাত পালটাবারও উপায় নেই। একসময় তার হাত সিসের মত ভারী হয়ে এল। সে বুঝল শুধু হাত কেন, এই টর্চের ভার বহন করার ক্ষমতা তার সমগ্র অস্তিত্বেরই আর নেই। একে নামিয়ে রাখার স্বস্তি, সাপের ছোবলের চেয়ে এখন অনেক বেশি কাম্য।
আশা করি, এই গল্পের পর তোমাকে আর বলতে হবে না যে আমি অবশেষে আমার মৃত্যুকামনাই করছি এবং তোমার হাতে এবং কেন। আজ তিন বছর ধরে অবধারিত মৃত্যুর আগে আগে ছুটে ছুটে—আমি অবশেষে ক্লান্ত। হৃষিকেশ, কাতরাসগড়, নোয়ামুণ্ডি—এমনকি বোম্বের ধারাবি, যেখানে লুকিয়েছি—কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে তোমাদের ছায়া। কিন্তু যে-সব জায়গা ছিল তোমাদের ধরাছোঁয়ার বা অনুমানের বাইরে— যেমন এখন আমি যেখানে সেখানেও একটা মুহূর্ত আমি চোখের পাতা ফেলতে পারি না। সত্যি কথা বলতে কি, এখন তোমার ছায়া নির্গত হয় আমার শরীর থেকে। তোমার হাতে ছায়া-রিভলবার।
হ্যাঁ, আমি খুনী। রজতকে আমি খুনই করেছি। আমার শাস্তি মৃত্যু। এবং তোমার হাতে। ২১ ডিসেম্বর আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করবো। শুধু একটা ব্যাপারে আমি তোমাকে পুনর্বিবেচনা করতে অনুরোধ করি। প্রথমত, দাদাকে এবার সঙ্গে আনার দরকার নেই। রিভলবার আনবে। কিন্তু, আমার মতে, নিরাপদ দূর থেকে ছোড়া রিভলবারের গুলি দিয়ে হত্যার মধ্যে তোমার জিঘাংসা তৃপ্ত হবার নয়। আমি তাই একটি ধারাল ক্ষুর আনিয়ে রেখেছি। আমি ডাক্তার। অ্যানাটমি জানি। কীভাবে গলার ঠিক কোনখানে বসাতে হবে সব আমি শিখিয়ে দেব তোমাকে। তারপর দু-জনে জঙ্গলে যাব। সবশেষে কন্যাসমা হওয়া সত্বেও তোমার নিষ্কাম ক্ষমাহীনতাকে আমি সশ্রদ্ধ প্রণাম করে যাই। ইতি—
তবু তোমারই
কৃষ্ণেন্দু
পথনির্দেশ
এসপ্ল্যানেড থেকে বারিপদার বাস। লোধাশুলি পেরিয়ে সুবর্ণরেখার ওপর নতুন ব্রিজ। সেখানে নেমে অটোরিকশায় ব্রিজ পেরিয়ে গোঁসাইগোবিন্দপুর। ২০ কিলোমিটার। সঙ্গে একটি ম্যাপ এঁকে দিলাম।— কৃ.
আজ ২০ জুন। এখন বিকেলবেলা। কাল ভোরের বাসে আমি গোঁসাইগোবিন্দপুর যাচ্ছি। এখন গোখেল রোডে দাদার পুলিশ কোয়ার্টারে। ফ্রিজ থেকে একটা আইসক্রিম বের করে খেতে খেতে এখন লিখছি আপনাকে। বুঝতেই পারছেন, আমার মনে কোনো উদ্বেগ নেই। কারণ, কৃষ্ণেন্দু আমার কাছে এখনই মৃত। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ যে-ভাবে অর্জুনকে জীবিতাবস্থায় আত্মীয়-স্বজনের লাশ দেখিয়েছিলেন, আমি সেভাবে দেখাচ্ছি আপনাকে।
ঝাড়গ্রাম-ময়ূরভঞ্জ সীমান্ত থেকে অদূরে জঙ্গলের মধ্যে প্রাচীন চন্দ্ররেখা দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। ঐ দেখুন, ২২ জুন ভোরবেলা ঘন শালবনের ভেতর কৃষ্ণেন্দুর লাশ পড়ে আছে। তার গলা কাটা তার শবের ওপর মুষলধারায় বৃষ্টি। কোথাও রক্ত নেই।
চিঠি পড়া শেষ। আপনি এখন পুলিশে খবর দিতে পারেন, মিসেস বেরা। আমি ঝাড়গ্রামের ফরেস্ট রেস্ট হাউসে। আমি একা।
১৯৯৪