একজন নিঃসঙ্গ মানুষের দিনলিপি
।।প্রথম দিন।।
নিঃসঙ্গতা আশীর্বাদের মত। সঙ্গী যদি অপছন্দের হয় তবে সে সঙ্গ অভিশাপ ডেকে আনে। অশান্তি হয়, কখনও কখনও বলতে না পারলেও মনের মধ্যে যে ঝড় ওঠে, সে ঝড়কে দমন করা বড় কঠিন হয়ে ওঠে।
ঈশ্বর বলে যদি কেউ থেকে থাকেন, তাঁর করুণায় আমি সঙ্গীবিহীন। খানিকটা ভয়েই হোক, খানিকটা বা নিজের ত্রুটিতেই, আমার সঙ্গে আজ থেকে কেউ থাকবেন না। এক নিঃসঙ্গ দ্বীপে, পরিত্যক্ত জাহাজের নাবিকের ন্যায় আমি একা।
আমি, শ্রী অতীন্দ্রনারায়ণ হোমচৌধুরী, আমার নিঃসঙ্গতার দিনলিপির প্রথম দিন নথিভুক্ত করছি এই আধুনিক পৃথিবীতে।
জ্ঞান হবার কিছু দিনের মধ্যেই আমার জন্মদাতার জীবনাবসান হয়। কঠিন রোগে ভুগছিলেন তিনি। পরিবারের যা আয় ইত্যাদি ছিল, তাতে আমার মায়ের আমাকে নিয়ে সংসার চালাতে কোন রকম অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় নি।
উপযুক্ত শিক্ষালাভের কিছুদিনের মধ্যেই আমার মা আমার জন্য একজন সঙ্গিনী নির্বাচনে সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। আমি তাকে নিরস্ত করি এই বলে যে এই মুহূর্তে সংসার ধর্ম পালনের কোন ইচ্ছা আমার নেই। মা নাতি নাতনীর মুখে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করলে আমি তাকে বোঝাই শুধু মাত্র এই ইচ্ছার জন্য পৃথিবীর কত পরিবার যে বিনষ্ট হয়েছে তার হিসেব মেলা ভার।
মা আমার কথায় যে খুব সন্তুষ্ট হয়েছিলেন তা নয়। দুর্ভাগ্যবশতঃ গত কাল বাড়ির বাগানের খরিশের কামড়ে মার মৃত্যু হয়।
মাকে দাহ করে আসার পর আমি আবিস্কার করি, এই পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই।
আমি একজন নিঃসঙ্গ ব্যক্তি।
অপরদিকে একজন স্বাধীন ব্যক্তিও বটে।
এই নিঃসঙ্গতা এবং স্বাধীনতার টানাপোড়েনে আগামীদিনে কে জয়ী হয়, খানিকটা সে তথ্যাবলী নথিবদ্ধ করতেই আমার এই ডায়েরী লেখার সূত্রপাত।
।। দ্বিতীয়দিন।।
… রাত্রি এগারোটা…
“ভালবাসার নামে ব্যবহৃত হতে নেই…”
জীবনের সব থেকে বড় শিক্ষা দিয়েছিলেন আমাকে আমার এক শিক্ষক। তিনিও নিঃসঙ্গ ছিলেন। আমাকে বলেছিলেন নারীর চোখের ছলনায় ভুলে যাওয়ার মত ভুল করে যারা তারা মস্তিষ্কহীন হয়। উদাহরণস্বরূপ আমাকে অনেক কিছু বলেছিলেন। আমি তার সব মনে করে নথিভুক্ত করতে পারছি না। তার পরিবর্তে অন্য কথা বলি।
শোকস্তব্ধ মন। অনাথ এবং একলা থাকার কথা ভেবে খানিকটা দুঃখী হয়েই বসে ছিলাম বিকেল নাগাদ। অশৌচের সময়। পরিজনের ভিড় লেগেই রয়েছে।
এর মধ্যেই মাসী এলেন। মায়ের থেকে ছোট। মা তাকে কন্যাস্নেহে দেখতেন।
এ হেন মাসী, তার অগ্রজার কথা না তুলেই আমার বিয়ের কথা বললেন। এত বড় বাড়ি কে দেখবে, ইত্যাদি বলে গেলেন। আমি শুনলাম, প্রতিবাদ করলাম না।
মাসী একটি মেয়ের ফটো দিয়ে গেলেন। বলে গেলেন আমি যেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমি ফটোটি না দেখেই টেবিলে রেখে দিয়েছিলাম।
রাতে হবিষ্যি খাবার পরে আমি ছবিখানি দেখলাম।
আর একখানি কাগজে মেয়েটির নাম ঠিকানা ফোন নাম্বার লেখা। আমি কাগজখানি দেখে কালকের কথা স্মরণ করলাম। আপাতত নিঃসঙ্গ জীবনকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলার কোন রকম ইচ্ছা না দেখিয়ে ছবি এবং কাগজখানি যেমন ছিল তেমন রেখে দিলাম।
।।তৃতীয় দিন।।
…রাত্রি সাড়ে দশটা…
মোবাইল ফোন নামক বস্তুটি পৃথিবীতে কবে এবং কেন এসেছিল তা সবাই জানেন। আমি কোন দিন জানার চেষ্টা করি নি। কিন্তু ডেটা প্যাক একটি বিষম বস্তু, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
ফেসবুক ইত্যাদিতে আমি কোনদিনই খুব একটা সড়গড় ছিলাম না। অফিসের কাজে ব্যস্তও থাকতে হয়, যার ফলে সোশ্যাল নেটওয়ারকিং এ আমি বরাবরই কাঁচা। সমস্যা বাধল অন্য জায়গায়। আমার পিসির মেয়ে পিম্পি বরাবরই বড্ড জ্বালাতন করে আমায়, ভালোও বাসে। পিসি, পিসে এবং পিম্পি এসেছিল আজ সকালে।
পিম্পি কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। এসে আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদল পিসি। পিম্পি আমার আলমারি পরিষ্কার করে দিল এবং যেটা চাই নি, সেই অনভিপ্রেত ঘটনাটি ঘটে গেল।
পিম্পির হাতে মেয়েটির ফটো চলে গেল। পিম্পি চিন্তিত মুখে ছবিখানি দেখে আমায় জানাল “দাদা, এই মেয়েটাকে না আমার খুব চেনা চেনা লাগছে, এর সাথে কি তোর বিয়ের কথা চলছে?”
আমি বললাম “ধুস, খেপেছিস? আমি এখন বিয়ে টিয়ে করব না। মাসী দিয়ে গেল এই ছবিটা। আমার কোন ইচ্ছা নেই”।
পিম্পি খানিকক্ষণ তার মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি করে আমায় মেয়েটার একটা ছেলের সাথে ছবি বের করে দিয়ে বলল “এই দেখ, এই মেয়ে তো অলরেডি এনগেজড। হ্যাঁ করে দিস নি তো?”
আমি জোরে জোরে মাথা নাড়লাম। পিম্পি আশ্বস্ত হল।
ওরা সব চলে গেলে আমি সন্ধ্যে থেকে ফেসবুক রহস্য উদ্ধারে সচেষ্ট হলাম। একখানা অ্যাকাউন্ট খুললাম এবং মেয়েটির প্রোফাইলও খুঁজে পেলাম। ছবিটা আমিও দেখলাম।
আমার রাগ হল। ভাবলাম মাসীকে ফোন করে বকাঝকা করি।
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালাম।
।।চতুর্থ দিন।।
লিখলাম বটে চতুর্থ দিন, আসলে কিন্তু চতুর্থ দিন নয়। এর মধ্যে অনেক দিন চলে গেছে। এতদিন ডায়েরী লিখি নি। শ্রাদ্ধ শান্তি, মুন্ডন, মৎস্যমুখ সব শেষ করে লিখছি। কাহিনী অনেক জমে গেছে।
সেগুলো লিখি।
প্রথমে ভেবেছিলাম মাসীকে বলব মেয়ে পছন্দ নয়।
পরের দিন আমি মত পরিবর্তন করলাম। নিঃসঙ্গতা অভিশাপ, আগেই বলেছি, আবার কোন এক গুণীজন বলে গেছেন, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।
এই দুয়ের যৌথভূমিকার ফলেই হয়ত আমি এই দুঃসাহসিক কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
মাসীকে ফোন করলাম এবং বললাম মেয়েটিকে আমার পছন্দ হয়েছে। কথা এগোনো যেতে পারে।
চুল দাড়ি কামানো সম্ভব নয়, সাবানও দেওয়া যাচ্ছে না, তবু তার মধ্যেই মাসী মেয়েটিসুদ্ধ তার পরিবারকে এ বাড়িতে নিয়ে চলে এলেন।
আমাদের পরিবার এককালে জমিদার বংশ ছিল। বিরাট ঘরবাড়ি দেখে তারা যে মুগ্ধ হলেন বলাই বাহুল্য।
এবং যে কাজটি আমি কোনদিন করি নি, মাসী সেই ভয়ানক কাজটি করলেন। একটি আলাদা ঘরে মেয়েটির সঙ্গে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলেন। আধুনিক সময়, পাত্র পাত্রী আলাদা করে কথা বলে নেবে, এখন নাকি এটাই দস্তুর।
গালভর্তি দাড়ি, সাবানহীন মুখ, শ্যাম্পুহীন চুল, পরনে ধরা, আমি একজন আধুনিকার মুখোমুখি হলাম আমার ঘরে।
মেয়েটি সপ্রতিভ। আমার ঘরের চারপাশ দেখে বলল “ভারি সুন্দর আপনাদের বাড়ি”।
হঠাৎ পাওয়া প্রশংসায় আমি কিঞ্চিৎ সংকুচিত হয়ে বললাম “ধন্যবাদ”।
মেয়েটি বলল “আপনার মায়ের এবং বাবার কথা শুনলাম। কেউ নেই আপনার। খুব আনফরচুনেট”।
এবার মুখটা দুঃখী করতে হয় নিয়মানুসারে।
আমি তাই করলাম। মেয়েটি বলল “আপনি কিছু বলুন”।
আমি বললাম “আমার পিতৃপুরুষরা জমিদার ছিলেন। এখন আমি একাই এ সম্পত্তির ওয়ারিশন বলতে পারেন। মাসীমণি আপনার সঙ্গে পরিচয় করার কথা বললেন। আপনাকে আমার ভাল লেগেছে। আপনার জীবনে কেউ আছে?”
মেয়েটি জোরে জোরে দুদিকে মাথা নেড়ে বলল “একেবারেই নয়। আমি সিঙ্গল। আপনার ঘরের ড্রেসিং টেবিলটা নিশ্চয়ই ইংরেজ আমলের। অসাধারণ। এখানে সাজার মজাই আলাদা”।
মেয়েটির দু চোখ জ্বলে উঠল।
আমি মেয়েটির দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে বললাম “তাহলে আমি হ্যাঁ করে দিচ্ছি?”
মেয়েটি খুশি মুখে বলল “নিশ্চয়ই”।
আমি বললাম “চলুন, সবাই অপেক্ষা করছেন”।
মেয়েটি আমার সঙ্গে ঘরের বাইরে এল।
সবাই বসে ছিলেন। মাসী অতিথিদের আপ্যায়ন করলেন। আমি তাদের সঙ্গে হাসি মুখে কথা বললাম। যথাসময়ে তারা চলেও গেলেন।
রাত হল।
আমি ফেসবুকে মেয়েটির প্রোফাইলে উঁকি মারলাম। ছেলেটির সঙ্গে ছবি। আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখা করেছে হয়তো।
আমি মেয়েটিকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালাম।
কিন্তু ফেসবুক জানাল মেয়েটির অসংখ্য ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট ঝুলে আছে তাই আর কারো অনুরোধ নেওয়া সম্ভবপর নয়।
অতঃপর আমি আশা ছাড়লাম।
।।পঞ্চম দিন।।
আমরা ছোটবেলায় রচনা পড়েছিলাম বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ।
আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা নিঃসঙ্গতা আশীর্বাদ না অভিশাপ। বড় বাড়ি, রক্ষণাবেক্ষণের ঝামেলা রয়েছে। তার ওপর রয়েছে উটকো আত্মীয়স্বজনের ভিড়। কোন দিন চিনি না, জানি না লোক জন, বাক্স প্যাটরা নিয়ে চলে আসতে লাগল। আমি একা আছি, চিন্তায় তাদের ঘুম হচ্ছে না।
আমি যে এত দুর্মুখ, আমার নিজেরই ধারণা ছিল না। জঘন্য ভাষায় তাদের বিদায় করা শুরু করলাম। এর ফলে বাজারে কিঞ্চিৎ দুর্নামও হল। বাড়িতে এক বার চোরের উপদ্রবও ঘটল। অগত্যা সিকিউরিটি এজেন্সীতে কথা বলে মাসিক চুক্তিতে দুজন নিরাপত্তারক্ষী রাখা হল।
তাদের কাজ দেখে আমার নিজেরই হিংসা হওয়া শুরু করল। সকালে একজন এবং রাত্রে একজন। দুজনেরই কাজ হল খাটিয়ায় ঘুমানো। মানুষে যে এত ঘুমাতে পারে আমি কোন দিন কল্পনাও করতে পারি নি।
তবু তাদের কিছু বললাম না। এমনিতে ঘুমালেও, এলাকায় যখন চাউর হয়ে যায় এ বাড়িতে নিরাপত্তারক্ষী এসেছে, তখন চোরেদের যাওয়া আসা কমে যায়।
মাসী এর মধ্যে ফোন করলেন। কন্যাপক্ষের বাড়ি যেতে হবে।
আমি এবারেও বারণ করলাম না। আমার মাথা মুন্ডন হয়েছে, পরনে স্যুট প্যান্ট, আমি মেয়েটির বাড়িতে গেলাম।
তারাও যে খুব গরীব ঘরের লোক, এ কথা বলা অন্যায় হবে। তারাও বেশ ধনী। তবে হঠাৎ বড়লোক সেটা বাড়ির রঙের শেড দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না।
এবারে বিয়ের দিন ক্ষণের ব্যাপারে কথা বলা শুরু হতেই আমি বললাম মেয়েটির সঙ্গে একান্তে আরও কিছু কথা আছে।
মেয়েটি আমাকে তার ঘরে নিয়ে গেল।
আগ্রহী গলায় বলল “বলুন”।
আমি বললাম “আপনি আমাকে বিয়েতে আগ্রহী”?
মেয়েটি বলল “হ্যাঁ। আমার দিক থেকে কোন আপত্তি নেই”।
আমি খুশি হয়ে বললাম “ধন্যবাদ। প্রত্যাখ্যানের কষ্ট সহ্য করতে হল না”।
মেয়েটি হাসল। বলল “আর কিছু বলবেন?”
আমি আমার ব্যাগ নিয়ে এসেছিলাম, সে ব্যাগের ভিতর থেকে একখানি ফ্ল্যাপি ফাইল বার করে মেয়েটির হাতে দিয়ে বললাম “একটু দেখবেন?”
মেয়েটি ফ্ল্যাপিটা হাতে নিয়ে বলল “কী আছে?”
আমি বললাম “প্লিজ দেখুন”।
মেয়েটি ফাইলটা খুলল। তার ফেসবুক টাইমলাইনে করা ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরা একগাদা ফটো, মাখো মাখো কমেন্ট, সব পেজ আমি প্রিন্ট আউট করে নিয়ে এসেছিলাম। মেয়েটি সে সব দেখে আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল “এগুলো কী?”
আমি উঠে পড়ে বললাম “ফটোপেপারে প্রিন্ট করা, অ্যালবাম করতে পারবেন। ভাল থাকবেন, ধন্যবাদ”।
মেয়েটি চিৎকার জুড়ল “অসভ্য, ইতর, রাসকেল, সাইকো কোথাকার” তার সঙ্গে বিভিন্ন বাছাবাছা বিশেষণ। আমি হাসি মুখে মেয়েটির ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে মাসীকে বললাম “আমি এলাম, সব রিপোর্ট মেয়েটার থেকে পেয়ে যাবে”, বাকি সবাইকে হাসিমুখে শুভরাত্রি বলে আমি বেরিয়ে এলাম।
।।ষষ্ঠ দিন।।
পিম্পি আমাকে “গোল্ড ডিগার” শব্দটির মানে শিখিয়েছে।
আমি গুগল করি, বিভিন্ন ভিডিও দেখি। নিরাপত্তারক্ষীদের হাতের ছাতুমাখা খাই।
মাঝে মাঝে অফিস ডুব মারি। একা একা শহর দেখি।
ভালই আছি।
তবে মাসী আমার সঙ্গে চিরকালের মত সম্পর্কচ্ছেদ করেছে।
সোশ্যাল মিডিয়াকে আমি আগে ভাল চোখে দেখতাম না। পরে দেখলাম নিঃসঙ্গ লোকেদের জন্য এর থেকে ভাল আর কিছু হতে পারে না। আমি এর মধ্যে একদিন মেয়েটির প্রোফাইলে গেলাম। মেয়েটির বিয়ে হচ্ছে অন্যত্র। আগের সমস্ত ছবি ডিলিট করা হয়েছে। নতুন ছেলেটির সঙ্গে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে প্রি ওয়েডিং ফটোশ্যুটের ছবি দিয়েছে।
আমার ভারি ভাল লাগে ফেসবুক।
নিঃসঙ্গ মানুষদের জন্য, এর থেকে ভাল জিনিস আর কিছু হতে পারে না…