কল্পনা চাকমার ডায়েরি, চিঠিপত্র ও ছবি
কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচারের দাবি : রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও প্রতিরোধ
কল্পনা চাকমা অপহরণের প্রতিক্রিয়া : বিভিন্ন লেখকদের লেখা

এই নিশ্চুপতাটি আমাদের জাত্যাভিমানের একটা স্মারক হয়ে উঠল – মানস চৌধুরী

এই নিশ্চুপতাটি আমাদের জাত্যাভিমানের একটা স্মারক হয়ে উঠল – মানস চৌধুরী

কল্পনা অপহরণের পর পাঁচ বছর হয়ে গেছে। এই সময়কালে বিষয়টাকে নিয়ে এত ধরনের আলাপ-আলোচনা হয়েছে যে অপহরণ এবং তৎপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে একটা দৃশ্যপ্রবাহ এখন আমাদের মনে বা মাথায় কাজ করে, সেটা সবক্ষেত্রে প্রবল জাতির সদস্য হিসেবে – ঠিক স্বস্তিকর না হলেও। ফলে গোড়াতেই নিশ্চুপতার প্রসঙ্গটি তোলা এক হিসেবে নাহক এবং অ-যথাযথ। কিন্তু নিশ্চুপতাকে কেবল কথা না-বলা বা না-পাড়া হিসেবে দেখতে চাইছি না আমি। বরং, আলাদা করেই উল্লেখ করতে চাই যে, বাংলাদেশের অনেকগুলো মানবাধিকার সংগঠন এবং কিছু নারী সংগঠন কল্পনা অপহরণের বিচার চেয়ে নানাবিধ তৎপরতার জন্ম দিয়েছিল, একটা বিশেষ সময় অবধি। লেখ্য প্রচার-মাধ্যমে অর্থাৎ পত্র-পত্রিকায় এ সংক্রান্ত যতটা আলাপ-বিস্তার ঘটেছে – তা এই তৎপরতারই ফল বটে। প্রবল জাতির তৎপরতায় নিশ্চুপতার প্রসঙ্গটি কিছু জটিল বিষয় হিসেবে উপলব্ধি করতে চাইছি আমি। আর সেই নিশ্চুপতা আসলে এজেন্ডার খেই হারিয়ে যাওয়া মাত্র। একটা আচ্ছন্নতা যার মধ্যে আর অনুধাবন করা যায় না যে ঠিক এই মুহূর্তে করণীয় কী – বিশেষ করে যখন সবাই বোঝেন হয়তো কোন তৎপরতাই আর কল্পনা চাকমাকে ফিরিয়ে আনবে না। কিন্তু যে বিষয়টা ভেবে এই সামান্য প্রস্তাবনাটি হাজির করছি তা একেবারে ভিন্নতর রাজনৈতিক গুরুত্বে প্রোথিত। কল্পনা চাকমা বেঁচে আছেন কি নেই – পাঁচ বছর ধরে প্রবল জনমনে চর্চা করতে থাকা এই প্রশ্নের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। ওর অপহরণ, তারপর থেকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এবং অপহরণকারীরা বিনা বিচারে নিশ্চিন্তে থাকতে পারা ইত্যাদি বিষয় অনেকগুলো রাজনৈতিক জিজ্ঞাসার সঙ্গে সম্পর্কিত। নিপীড়িত জাতির জিজ্ঞাসা, অধস্তন লিঙ্গের জিজ্ঞাসা, রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর হিংস্রতার জিজ্ঞাসা, লড়াকু যোদ্ধার সামাজিক অস্তিত্বের জিজ্ঞাসা। ফলে অনুমিত এবং উপলব্ধ নিশ্চুপতাটি আসলে এতগুলি জিজ্ঞাসার হন্তাও বটে। তাই ওই আচ্ছন্নতার খোঁজ জানাটা জরুরী।

কল্পনাকে শাসক জাতির আমরা চিনলাম ওর অপহরণের মধ্য দিয়ে। সেটা খেয়াল রাখা গুরুত্বপূর্ণ। এই রাষ্ট্রে অধস্তন লিঙ্গের প্রতি বলবৎ থাকা হিংস্রতা – বিশেষভাবে ভিন্ন জাতির ও নিপীড়িত শ্রেণীর নারীদের প্রতি – বিবেচনায় রাখলে ওর অপহৃত হওয়াটাকে আলাদাভাবে স্মরণ রাখাই কঠিন, দুর্ভাগ্যজনক এই আমাদের বাস্তবতা। কিন্তু অমর যে বিস্মৃত হতে পারলাম না – অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও – সেটার কারণ কল্পনা ছিলেন সরব এবং সাহসী নারী। সেই গল্পটা আমরা জানতে শুরু করেছিলাম। তিনি যে ভিঙ্গ উইমেন্স ফেডারেশন-এর সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন সেটা তাঁকে চিনবার মাত্র একটা এবং খুবই সাধারণ একটা লক্ষণ। এর চেয়ে ঢের গুরুত্বের ছিল তাঁর ওই বৈশিষ্ট্যটি—প্রতিবাদে সরব থাকা। তাঁর সহযোদ্ধারা আমাদেরকে এই ব্যাপারে জানান দিয়ে গেছেন ধারাবাহিকভাবে কল্পনার জীবন উপস্থাপন করে। সাহসী নারীদেরকে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে ভিন্ন জাতির সাহসী নারীদেরকে চিনতে পারার পদ্ধতি যে আমরা খুব একটা রপ্ত করি না প্রবল জাতির সদস্যদের, প্রবল লিঙ্গের সদস্যদের নিশ্চুপতার সেইটা একটা বড় প্রমাণ। কিন্তু কল্পনা নিশ্চুপ ছিলেন না। তিনি ছিলেন সরব। তাঁর ডায়েরীর পাতায় পাতায় সেই পরিচয়ের স্বাক্ষর। তবে সেটাও তাঁকে চিনবার পক্ষে যথেষ্ট নয়। ডায়েরীর পাতার বাইরে তাঁর জীবনের মুহূর্তগুলি এর আরও বড় পরিচয়। তিনি যে সরব ছিলেন আর আমরা নিশ্চুপ – এটা একটা বিরাট বিষমসঙ্গতি বা প্যারাডক্স। এক হিসেবে এ দুই কাঠামোগতভাবে সম্পর্কিতও বটে। তিনি সরব আর প্রতিবাদী ছিলেন বলেই তাঁর এই শাস্তির ব্যবস্থা হয়েছিল। আর প্রবল জাতির আর লিঙ্গের সদস্যরা গড়ে নিশ্চুপ বলেই সাহসী নারীদের এই শাস্তিবিধান এত নিরাপদে ঘটানো সম্ভব হয়। এই নিশ্চুপতা আরও সব লড়িয়েদের বলি দেবার পথ বানিয়ে দেয়, আকছার দিচ্ছে।

কল্পনাকে নিয়ে বর্তমান নিশ্চুপতা, আগেই বলেছি, আসলে এজেন্ডার খেই হারিয়ে যাওয়া। আবার এটাও তো ঠিক যে, বিষয়টা কেবল একজন কল্পনা চাকমাকে নিয়ে নয়। পাহাড়ি মানুষের লড়াইয়ের প্রসঙ্গ এটা, তেমনি জাতিরাষ্ট্রের হিংস্রতার মুখে অন্যজাতির লড়াইয়ের, নারীর লড়াইয়ের, নিপীড়িত মানুষের লড়াইয়ের প্রসঙ্গ। এজেন্ডা গোল পাকিয়ে যাবার আলোচ্য সঙ্কটটিকে দুইটা বড় দাগে দেখা যেতে পারে। এজেন্ডার খেই হারানো একটা মোড় হচ্ছে, সাম্প্রতিকতম যেটি, ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত বহুল উদ্যাপিত শান্তি চুক্তি’। প্রবল জাতির সিংহভাগ বলিয়ে-লিখিয়েগণ এত সহজেই প্রচারণাতে আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন যে তাঁদের পক্ষে আর অনুধাবনই সম্ভব হলো না কেন প্রবল জাতির প্রাবল্য প্রতিটি মুহূর্তে মোকাবিলা হতে হবে। চুক্তিটিকে পাহাড়ি জাতির জন্য এত বড় প্রাপ্তি হিসেবে ভাবতে শুরু করলেন তাঁরা যে পাহাড়ি মানুষদের আর কিছু চাইবার থাকতে পারে না বলেই ভেবে বসলেন। এই আস্থা এবং আত্মপ্রসাদে চাপা পড়ে গেল এমনকি চুক্তিকে বরখেলাপের সম্ভাব্য রাষ্ট্রীয় চালচলনের সম্ভাবনা। পাহাড়ি মানুষজনের কিংবা অন্য জাতির সদস্যদের প্রাপ্তি প্রসঙ্গে এই অপরিমিতি বোধ প্রবল জাতির সদস্যদের এক চরম জাত্যাভিমান। কল্পনা প্রসঙ্গ চাপা পড়েছে মূলত এই অভিমানের তলে। বিশেষভাবে এই বক্তব্য অর্থবহ যখন হিল উইমেন্স ফেডারেশন চেষ্টা করছিল কল্পনা অপহরণের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ্যে হাজির করবার দাবি তুলতে। বিষয় হলো: দাবিটা বাঙালি চিন্তুকদের ভাবায়নি, অন্তত জোরে সোরে।

এজেন্ডার খেই হারিয়ে যাবার দ্বিতীয় মোড়টা আরও জটিল ধরনের। একে দ্বিতীয় মোড় বললেও আসলে এটিই আগে ঘটেছে। এই মোড়টা রাষ্ট্রের অধিপতি শ্রেণীর আত্মপ্রতিকৃতি বানাবার এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্নির্ধারণ করবার একটা জোরালো উত্থানের মোড়। ৯০ দশকের সিভিল সমাজের তৎপরতা এবং এ সংক্রান্ত আলাপ- আলোচনাকেই আমি এক্ষেত্রে শনাক্ত করতে চাইছি। এই তৎপরতা এবং আলাপ-পরিক্ষেত্র নানাবিধ লড়াইয়ের ক্ষেত্রকে পরিসীমিত করেছে। এই তৎপরতার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে রাষ্ট্রের একটা পুনর্নির্ধারিত সংজ্ঞা—অনেক শিথিল আর তরল, এবং সেই সঙ্গে ক্ষমতার ও অনেক মনপছন্দমুখী বা চয়েস-সমৃদ্ধ। এতে আদতেই রাষ্ট্রের ক্ষমতার খামতি কিছু হয়নি, বরং জোরালো হয়েছে। কারণ রাষ্ট্র কেবল আলাপ আর ব্যাখ্যা নয়, মূর্ত প্রতিষ্ঠানের একটা সম্পর্কজাল—এর আমলাতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র সমেত। সাধারণ মানুষজনের ক্ষমতারও কিছু হেরফের হয়নি, বরং অক্ষম অবস্থাই ক্ষমতায়িত (এমপাওয়ার্ড) হিসেবে পাঠ করবার পদ্ধতি চালু হয়েছে। এই পরিবর্তনটা বিশেষ গুরুত্ববহ। কারণ নগর-মধ্যবিত্ত রাজনৈতিক কর্মী এবং বিশ্লেষকগণ নিজেদের খুঁজে পেয়েছেন নতুন পরিসরে। এই নতুন পরিসরটা কিছু এজেন্ডাকে হারিয়ে যেতে সাহায্য করেছে, মানে মধ্যবিত্ত পরিসর থেকে হারিয়ে যেতে। কেবল কল্পনাকে নিয়ে এই দ্বিধা নয়, কেবল কল্পনা এখানে গুরুত্বপূর্ণ নন। এটা হচ্ছে প্রান্তিক অবস্থানকে চিনবার এবং রাজনৈতিক মোকাবিলা করবার জিজ্ঞাসা। একটা স্থূল নির্দেশক হচ্ছে সিভিল সমাজে সাবেক সামরিক কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ। অংশগ্রহণ তো কেবল একটা সভায় বসতে পারা, কথা কইতে পারাতে পরিসীমিত নয়। মূল বিষয় হচ্ছে সেই সামরিক কর্তাদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হবার, তার/তাঁদের বক্তব্যমালার বৈধতা তৈরি হবার। সেই বৈধতা দিয়ে দিচ্ছে এই নতুন সিভিল তৎপরতা। ফলে সিভিল তৎপরতাতে আত্মপ্রতিকৃতি খুঁজে পায় যে কর্মী তার পক্ষে কল্পনার অপহরণকে, মানে রাষ্ট্রের হিংস্রতাকে মোকাবিলা করবার এজেন্ডা বজায় রাখা সম্ভব নয়। এটা নিছক কোন একজন সামরিক কর্তার ব্যক্তিগত চালচলনের প্রশ্ন নয়, তার থেকে ঢের বড় বিষয়। এজেন্ডার খেই হারাবার বিষয়টা তাই গুরুতর। স্পষ্ট হওয়া দরকার, কল্পনা চাকমা প্ৰসঙ্গে এই চর্চিত নিশ্চুপতা আসলে জাত্যাভিমানের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে। নিপীড়িত জাতির পক্ষে এরকম খেই হারানো সম্ভব নয়।

অপ্রকাশিত, জুন ২০০১

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *