উনিশে ডিসেম্বর মরশুমের শীতলতম রাত – ৬

দ্য নাম্বার ইউ আর ট্রাইং টু রিচ… ইস আনরিচেবল, যে নাম্বারটিতে আপনি যোগাযোগ করতে চাইছেন সেটি নেটওয়ার্ক কভারেজ এরিয়ার বাইরে…

এই এক শব্দ শুনে শুনে কানে তালা লেগে গেছে বন্দনার।

সুরজিৎকে যখনই ফোন করছেন, সবসময় ওই একই কথা। দৈবাৎ মাঝেসাঝে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। তাছাড়া অধিকাংশ সময়েই এই ব্যাপার। আজ সকাল থেকে উঠে, অনেকবার ওকে ধরার চেষ্টা করে চলেছে বন্দনা। কিন্তু এই হতচ্ছাড়া নেটওয়ার্ক, একবারও যদি ফোনটা লাগে।

একটা ঘটনা কাল রাতে ঘটেছে, যেটা সুরজিৎকে না বলতে পারলে বন্দনার শান্তি নেই। তাই সকাল থেকেই চেষ্টা করে চলেছে ফোনটা পাওয়ার।

কাল বিকালে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে রাতটাকে বেশ মনোরম করে তুলেছিল। তাড়াতাড়ি রাতের খাবার শেষ করে বন্দনা শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছিল। আজকাল তার বই পড়ার বাতিক হয়েছে, শুয়ে কয়েক পাতা বই না পড়লে, আজকাল তার ঘুম আসতে চায় না। এ-বাড়িতে বইয়ের অভাব নেই। সুবলবাবুর ঘরের প্রতিটা দেওয়ালই বইয়ে ঠাঁসা। তার থেকেই একটা দুটো বই নিয়ে এসে বন্দনা পড়ে আজকাল।

পাশের ঘরে বলাই কম্পিউটারে গোলাগুলি চালাচ্ছে। নীচ থেকে বাহাদুর দারোয়ান তার ছোট্ট মোবাইল ফোনে দেশোয়ালি ভাষায় বাড়ির কারোর সঙ্গে বেশ জোরে জোরে কথা বলছে। এমন সময় জানলা দিয়ে একটা দমকা হাওয়া এসে বইয়ের পাতাগুলোকে এলোমেলো করে দিল। আর তার ভিতর থেকে একটা হলদে হয়ে যাওয়া পুরোনো কাগজের টুকরো উড়ে গিয়ে মেঝেতে পড়ল, আবার উড়ে গিয়ে ঢুকল খাটের তলায়।

ব্যাপারটা নিয়ে প্রথমে বন্দনা অতটা গা করেনি। তারপর, হঠাৎই কেন কে জানে মনে হল, দেখি কাগজটায় কী আছে। এই ভেবে খাটের নীচ থেকে ওটাকে টেনে বার করল সে। আর তাতেই রাতের ঘুমটি তার উড়ে গেল পুরোপুরি।

কাগজটা অনেক পুরোনো। একাত্তর সালের একটা ডায়রির ছেঁড়া পাতা। একইভাবে বহুদিন ভাঁজ করে রাখার ফলে, ভাঁজে ভাঁজে ছিঁড়ে যেতে বসেছে। জানলা দিয়ে আসা হওয়ার ধাক্কায় ছেঁড়া কাগজের টুকরো, আর বুকের আঁচল, দুটোকেই সামলে নিয়ে বন্দনা আলোর কাছে সরে এল।

“কমরেড,

জানিনা, এই চিঠি তোর হাতে কখনও গিয়ে পড়বে কিনা? যদি পড়ে তাহলে বলতে হবে তোর বরাতের জোর আর সরকারি পুলিশ কুকুরগুলোর দুর্ভাগ্য।

আগামীকালের এনকাউন্টারে যদি প্রাণে বেঁচে যাস, তাহলে পলাশপুরে দেখা হবে মাটির নীচে, আর গুলি কপাল ফুঁড়লে, দেখা হবে ওপারে।

শ্রেণি শত্রুর জাতকে খতম না করতে পারলে, রক্ত ঠান্ডা হবে না।

ভালো থাকিস।

বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।

ইতি

হিমু”

এই চিঠি পড়ে, অর্ধেক কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না বন্দনা। তবে এটুকু আন্দাজ করতে পারল, খুব সম্ভবত এই চিঠি তার শ্বশুরকে লেখা। লিখেছে হিমু বলে কেউ একজন। যে সময়ের এই চিঠি, সুবলবাবু তখন একজন কট্টর নকশাল নেতা। চিঠির অনেক কথাই বন্দনার মাথার উপর দিয়ে গেল, কিন্তু একটা শব্দে গিয়ে চোখ আটকাল। — ‘পলাশপুর’।

প্রাণে বাঁচলে পলাশপুরে যাওয়ার কথা লেখা আছে এতে। ঘুরে ফিরে এই জায়গাটার কথাই বার বার উঠে আসছে তাদের জীবনে। জায়গাটার তাৎপর্য কী? অজানা এক বিপদের আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠল বন্দনার। তার শ্বশুরমশাই, নকশাল নেতা সুবল চক্রবর্তীর সঙ্গে এই পলাশপুরের কোনো সম্পর্ক ছিল কি? এই হিমু কে? পলাশপুরে যাওয়ার কথা লিখেছে কেন? ওখানে কী ছিল?

এরকম হাজারো প্রশ্নের মধ্যে একটা মারাত্মক প্রশ্ন মাথায় উঁকি দিচ্ছে— এত জায়গা থাকতে, এত বছর পর, তার স্বামীকে বেছে বেছে ওই পলাশপুরেই যেতে হল কেন?

চিন্তাভাবনায় সারারাত ঘুম আসে না বন্দনার। চোখ বুঝলেই মাথার মধ্যে উদ্ভট সব চলচ্চিত্র ভীড় করে আসে। নকশাল নেতা সুবল চক্রবর্তীর বিগত জীবন সম্পর্কে তার বাড়ির লোকজন প্রায় কেউ কিছুই জানে না। কেউ জানার কোনো চেষ্টাও করেনি। বন্দনার মাথায় ঘুরতে থাকে সেই সব কথা, ঘুরতে থাকে সুবল বাবুর মৃত্যুর দৃশ্য, তার ছেলের আঁকা ওই তিনটে ছবির কথা। আরও কত কী!

রাতে আর সুরজিৎকে ফোন করার চেষ্টা করেনি। সকাল থেকে চেষ্টা করে চলেছে, কিন্তু লাভ হয়নি এখনও। এদিকে এই খবরটা তাকে না জানালেই নয়। আর কিছু না, পলাশপুর জায়গাটার সঙ্গে, বাবার একটা কোনো যোগ ছিল, এটা সুরজিতের জেনে রাখা দরকার।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *